16-02-2022, 09:55 PM
আমি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার প্রিয় আম গাছটার দিকে তাকিয়ে, না আজ কোনো টিয়া পাখি এসে পেয়ারা গাছটায় বসে নি, অনেকগুলো হলুদ হলুদ পেয়ারা দেখতে পাচ্ছি। একটু আগে ছোটোমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে গেলো। একটা ফালতু বিষয় নিয়ে, মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে, মাঝে মাঝে আমার যে কি হয়, আমি বুঝি না, মল্লিকদা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনলো, আমার সম্বন্ধে একটা খারাপ ধারনা তৈরি হলো, সত্যি আমার মনে হয় আমার মনের ভেতর একটা ভূত লুকিয়ে আছে, কখন যে সেই ভূতটা তার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয় জানি না। ছোটোমা কেনো ওই কথা বলতে গেলো, আমি বিধর্মী, না বললেই এই ঘটনা ঘটতো না। আমি তো ছোটো মাকে জিজ্ঞাসা করতে যাই নি তুমি * না .। আমি মানি না, মানুষের আবার ধর্ম আছে নাকি, যার যার স্বার্থে সে তার ধর্ম পালন করে। একটা শিশু যখন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় বলতে পারবে কেউ, তার ধর্ম কি, যদি মা বাবার পরিচয় না পাওয়া যায়, পাখিদের দিকে তাকিয়ে দেখোতো তাদের কোনো ধর্ম আছে। না। তারা তো কোন মন্দির মসজিদ গির্জাতে গিয়ে মাথা নোয়ায় না। তুমি মানুষ হও, পৃথিবীতে তুমি এসেছো কয়েকটা দিনের জন্য তারপর চলে যাবে, কি রেখে যাচ্ছ তুমি, এটা কখনো ভেবে দেখেছো। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীর সেই কবিতাটা মনে পরে তোমার ছোটো মা,
“যত চাও তত লও তরণী ভরে
আর আছে আর নাই দিয়েছি ভরে
এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভূলে
সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে
এখন আমারে লহ করুণা করে’’
তখন সেই কালের যাত্রী কি বলেছিল শুনবে।
“ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটে সে তরী
আমার সোনার ধানে গিয়েছি ভরি”।
এই কাল তোমার কর্মটুকু নেবে তোমাকে নেবে না, আর সেখানে লেখা থাকবে না তুমি কোন ধর্মের। তুমি ইতিহাসকে কি উত্তর দেবে। তুমি * , তুমি '. তুমি খ্রীস্টান না তুমি মানুষ। * ধর্মে দেখেছো তুমি সন্ন্যাস নিতে গেলে তোমায় তোমার শ্রাদ্ধটা আগে করে নিতে হবে। মানে তোমার কোনো পিছুটান নেই। তুমি পৃথিবীতে একা। সব ধর্মের মধ্যেই এই ব্যাপারটা আছে। তুমি এই যে এক সঙ্গে সবাইকে দেখছো না এটা মায়া। আমার একজন পরিচিত বন্ধু আছে, তার বয়স কত শুনবে। ৮১ বছর। একদিন কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বন্ধু জীবনে চরম সত্য কি। তিনি কি বললেন শুনবে, মৃত্যু। বললাম তাহলে চরম মিথ্যে, বললেন কেনো বেঁচে থাকা। তাহলে আমরা কি নিয়ে বেঁচে আছি। হাসতে হাসতে সেই বুড়ো কি বললো শুনবে, আশা। যাকে তোমরা কেতাবী ঢঙে বলো হোপ।
তুমি ধর্মী কি বিধর্মী আমি জানার দরকার নেই তুমি আমার ছোটোমা এটাই আমার কাছে শেষ কথা।
-না অনি তোকে শুনতে হবে।
-কি বলতে চাও বলো।
-আমার একটা জীবন কেটেছে, গণিকা পল্লীতে।
-ছোটোমা।
-হ্যাঁ অনি আমি তোকে মিথ্যে কথা বলছি না। বিশ্বাস কর। আমি গণিকা।
-তুমি মুখ সামলে কথা বলো।
-৭১ সালের যুদ্ধে ওপার বাংলা থেকে যখন এপার বাংলায় চলে এলাম, একদিন বর্ডারের এক লংগরখানা থেকে আমি হারিয়ে গেলাম, পেটের জ্বালায়। তুই বলেছিলি না সেদিন অভাবের কোনো রং নেই অভাবের কোনো জাত নেই। তোর আজকের ইসলাম ভাই তখন আমার নিজের ভাই মুন্না, সেদিন তার দিদিকে বাঁচাতে পারে নি, সেদিন যে ও ইসলাম ভাই হয় নি। শরীরটা ওরা ছিবরে করে দিলো কয়েকদিনে। তারপর বহু হাত ঘুরে তোর ছোটোমার স্থান হলো গণিকা পল্লীর রাজপ্রাসাদে, নাম তার নীলকমল। সেখানেই একদিন তোর মল্লিকদা আমাদের নিয়ে একটা আর্টিকেল লেখার জন্য গেলো। প্রথম আলাপ। কেনো জানি না তোর মল্লিকদাকে ভালো লেগে গেলো, তারপর প্রেম, তখন তোর দামিনী মাসির জন্ম হয়নি, হয়তো বা হয়েছিলো, আমি জানতাম না, কতো পুরুষকে এই শরীরে আশ্রয় দিয়েছি, তারপর একদিন তোর মল্লিকদার হাত ধরে গণিকা পল্লী থেকে * ঘরের সতী সাধ্বী স্ত্রী। কপালে সংসার জুটলো না, তোর মল্লিকদাকে, বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো। অনেক ঝড় বয়ে গেছে এই শরীরের ওপর দিয়ে, তবে তোর দাদা ভগবান বড়মা সত্যি মা আমার দিদি, আমারও এই পৃথিবীতে তোর মতো কেউ নেই। তাই বর পেলাম ঘর পেলাম, দাদা পেলাম দিদি পেলাম, তিনি আশ্রয় না দিলে হয়তো আবার ভাসতাম, তুই বলেছিলি আমার খোঁজ নিবি, আমি এই কারণে তোকে বারণ করেছিলাম। শুনলে তুই হয়তো আঘাত পাবি, কেনো জানিস আমি এখনো একজনের কাছে সপ্তাহে একদিন যাই, তোর মল্লিকদা জানে, তার সঙ্গে চুক্তি ছিলো, সে আমাকে ওখান থেকে বার করে দেবে, তবে তার কাছে আমাকে প্রতিদিন যেতে হবে, তা সেটা নেগোসিয়েশনে সপ্তাহে একদিন হয়েছে। আমাকে মাসোহারাও দেয়। সবাই জানে। তোর ছোটোমা এখনো কোনোদিন মা হয় নি। গণিকারা কোনোদিন মা হতে পারে না, তাহলেই তাদের কাছে খরিদ্দার আর আসবে না, তুই মা বলে ডেকেছিলি, দুর্বল হয়ে পরেছিলাম, শরৎচন্দ্র পরিসনি, শ্রীকান্তের পিয়ারী কি কোনোদিন মা হতে পেরেছিলো, তাই তো সে জননী রাজলক্ষ্মীর বেশ ধরতে বাধ্য হয়েছিলো।
-তুমি একবার তার নাম ঠিকানা বলো।
-কেনো তাকে মারবি।
-না অনি কোনো দিন কাউকে মারবে না।
-তাহলে।
-তাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো।
-না।
-তোমায় কথা দিলাম, এখবর জোগাড় করতে আমার বাহাত্তর ঘন্টা সময় লাগবে না। আর তোমায় এও বলে দিলাম, আমার হাতেই তার মৃত্যু লেখা আছে। মায়ের সম্মান রক্ষার্থে ছেলে তাকে হত্যা করতেই পারে। ছাড়ো তুমি আমায় ছাড়ো। তোমার মুন্নাকে বলো যদি তার ক্ষমতা থাকে অনিকে আটকাতে।
-অনি অনি।
--বুবুন এই বুবুন।
-অনি ও অনি বাবা চোখ খোল।
আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার মাথার দুই দিকে ছোটো মা বড়মা। ছোটো মা আমার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসেছে, মিত্রা আমার বুকে হাত বোলাচ্ছে, আমার পায়ের কাছে ইসলাম ভাই। নীপা অনাদি বাসু চিকনা দাঁড়িয়ে, পেছনে সুরমাসি, কাকীমা।
ঘোর কাটতে মিনিট খানেক সময় লাগলো, তারপর জিভ বার করে সটাং উঠে বসার চেষ্টা করলাম।
-না না তোকে উঠতে হবে না। ছোটোমা বললো।
-বাবাঃ কি খেল দেখাচ্ছিস তুই, আর তোকে কালী ঠাকুর হতে হবে না। আমি তো ভাবছিলাম তোর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে জিভ বার করে আমি কালী ঠাকুর হয়ে যাই, তাহলে যদি শিবের ধ্যান ভাঙে।
-ওরে মিত্রা তুই থাম।
-কেনো থামবে বলোতো। ও তো সবাইকেই মেরে ফেললে, শেষ পযর্ন্ত দেখা যাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলছে মিত্রা তোকে খুন করে দেবো। আমাকে মারিস ভাই কোন ক্ষতি নেই মারার আগে আর একবার চিকেন বাটার ফ্রাই করে খাওয়াস, মুখে লেগে রয়েছে।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
আমি উঠে বসলাম।
-ছোটোমাকে খুন করবি কেনো বলতো। তোর কি পাকা ধানে মই দিয়েছে।
-ও মিত্রা তুই থাম না। ছোটো মা বললো।
আমি ছোটো মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
-কি স্বপ্ন দেখছিলি বল। বড়মা বললো।
-ও কিছু না।
-এই তো সব হেঁপি মেরে উরিয়ে দিস। মল্লিক তোকে কিছু বলেছে।
-না।
-তাহলে।
-মল্লিকদার সাথে আমার কথা হয় নি তো।
-একবারে মিথ্যে কথা বলবি না, আমি তোর ফোন লিস্ট দেখেছি, ঘুমোবার আগে, তুই দাদা মল্লিকদার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিস।
-মিত্রা ফোনটা দে তো, দুটোকে দেখাচ্ছি মজা। এখানে এসেও একটু শান্তি দেবে না। বড়মা বললো।
-আরে ব্যস্ত হচ্ছ কেনো। সত্যি বলছি কিছু হয় নি। হাই তুললাম।
-প্লিজ বুবুন তোর হাঁ দেখাস না, বিশ্ব ব্রহ্মান্ড ঢুকে যাবে।
হেসে ফেললাম।
-দেখলে দেখলে তোমার ছেলের কান্ড, কি রকম চড়কি নাচ নাচালো।
-আচ্ছা অনির ভুল হয়েছে, কিন্তু আমাদের ডাকলি তো তুই।
-ভয়ে।ঘরে এসে দেখি, বালিসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। একবার কাছে গিয়ে দেখলাম ভালো করে, ভাবলাম আমাকে দেখে ঘাপটি মেরে পরে হয়তো অভিনয় করছে। ওমা বলে কিনা ছোটো মাকে খুন করবো, শ্মশানে-টসানে যায় ভাবলাম ভূতে ধরেছে হয়তো, তাই তো তোমাদের ডাকলাম।
আচ্ছা করে তোকে দিতে হয় বুঝলি। মিত্র কিল তুললো।
সবাই হাসছে মিত্রার রঙ্গ দেখে।
-কটা বাজে বলোতো।
ছোটোমা আমার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
-সাড়ে চারটে বাজে, ট্রলি রেডি।
আমি ছোটো মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, একটা বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম, তোমরা আমাকে জাগাও নি কেনো।
-জাগাবো মানে, তোর গায়ে গরম জল ঢালতে খালি বাকি রেখেছি।
-ঢাললি না কেনো।
-ওই যে বড়মা।
-আমি আবার তোকে কখন ব্যাগড়া দিলাম।
-বাঃ তুমি বললে না, থাক মিত্রা ছেলেটার প্রচুর চাপ বুঝলি, তাই ওরকম ভুল বকছে, একটু ঘুমোলে দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।
-দেখলি, ছোটো দেখলি।
-আমার থেকে ভালো গল্প বলে। তাই না বড়মা।
-বড়মা আমার কানটা ধরলো। তবে রে।
-দাও দাও আর একটু জোরে।
এইবার ছোটো মা না হেসে পারলো না।
আমি ছোটো মার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম
-বিশ্বাস করো কিছু হয় নি, রেডি হয়ে নাও অনেকটা পথ যেতে হবে।
-মিটসেফের ওপর তোর আর মুন্না ভাই-এর জামাকাপড় রাখা রয়েছে পরে নে। কোনো প্রশ্ন করবি না।
-এটা বড়মার হুকুম না তোর।
-আ….না বড়মার।
বড়মা হেসে ফেললো।
আমি খাট থেকে নেমে নীপার কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বললাম ভয় পেলে চলে, অনিদাকে দেখে লড়াই করার মানসিক প্রস্তুতি নাও, মাঝে মাঝে ব্রেকডাউন হবে। তাতে কি হয়েছে। যাও রেডি হয়ে নাও।
অনাদিদের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোরা বাজার থেকে কখন এলি।
-এই তো মিনিট পনেরো হলো, এসে দেখি তোর এই কীর্তি। আমি তো গুনীন কাকাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।
হেসে ফেললাম।
-নিজের কানে শোনা মিত্রা মিথ্যে কথা বলে না।
ওরা সবাই চলে গেলো। আমি ইসলাম ভাই-এর দিকে তাকিয়ে বললাম, কিগো কেমন লাগলো জায়গাটা।
-দারুন। বাইক চালালাম।
-অসুবিধে হয় নি।
-না।
অনাদিকে বললাম একটা বাইক জোগাড় করে দাও কয়েকদিনের জন্য।
-কি বললো ও।
-বললো চিকনার বাইকটা এখানে রেখে দেবে।
-তাহলে তুমিতো বেশ জমিয়ে নিয়েছো।
-হ্যাঁ। তোর বন্ধুগুলো ভীষণ সহজ সরল। কলকাতা গেলে একেবারে শেষ।
-সেই জন্যতো এখানেই ওদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করবো।
-জায়গাটা দেখলাম। ভালো স্পট।
-দেখি আজ রাতে একটু বসবো সবাই।
-কি জন্য।
-রাতে বলবো।
-নাও তুমি রেডি হয়ে নাও আমি একটু মুখ-হাতটা ধুয়ে আসি।
বাসুর দোকানে গেছিলাম। আমায় একটা শেরওয়ানী দিলো। পয়সা দিতে চাইলাম, নিলো না। আমি কয়েকটা কাপড় নিয়ে এসেছি তোর কাকীমা, সুরমাসি, দিদি, মন। নীপা, মিত্রার জন্য একটা করে শালোয়ার নিয়ে এসেছি।
-কেনো কিনতে গেলে।
-মেরিনা ছাড়া জীবনে কাউকে কিছু নিজে হাতে কিনে দিই নি।
-ওদের দিয়েছো।
-দেবো কি করে। এসে তো দেখলাম এই অবস্থা।
-যাও নিজে হাতে দিয়ে এসো।
-তোর কাকার জন্য কিছু নেওয়া হয় নি।
-ঠিক আছে, আছোতো এখন।