12-02-2022, 03:44 PM
পায়ে পায়ে সকলে চলে এলাম, সুরমাসি কাকীমা বাঁশবাগানে দাঁড়িয়েছিলো, আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন, সবার চোখেই একই বিষ্ময়, ইসলাম ভাই, ভজু। ভজু তবু চলেবেল, কিন্তু ইসলাম ভাই!
বড়মাকে সবাই প্রণাম করলো
-থাক থাক ভাই তোমাদের বাড়িতে আসা হলো, এই মর্কটটার জন্য। বড়মা আমার দিকে দেখছেন।
-অনি, আমি কিন্তু ফার্স্ট ফিতে কাটবো।
-কিসের?
-ওই যে দেখতে পাচ্ছিস। মিত্রা বাথরুমের দিকে আঙুল তুলে দেখালো।
-ওটা কি তোর ফিতে কাটার জন্য অপেক্ষা করে আছে!
-তুমি জানলে কি করে। অনাদিদা বলেছে, ওরা এসে আগে ব্যবহার করবে তারপর তোরা। নীপা বললো
মিত্রা আমার দিকে চোখ মেরে বলল
-দেখছিস এখানে তোর পপুলারিটির থেকে আমার পপুলারিটি একটু হলেও বেশি। তোর পালের হাওয়া এবার আমি কেরে নেবো।
-আবার শুরু করলি। বড়মা মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো।
বাড়ির ভেতর এলাম। বড়মা সব অবাক হয়ে দেখছে, ছোটো মাও তাই, ইসলাম ভাই-এর চোখের পাতা পরছে না।
-তোমরা এবাড়িতে বসো আমরা ওই বাড়িতে যাই, নীপা ওরা ব্যাগগুলো নিয়ে এসেছে?
-হ্যাঁ, কখন। বাইরের বারান্দায় রেখেছি কোনটা কোন বাড়িতে যাবে বলো, পৌঁছে দিচ্ছি।
আমি ইসলাম ভাইকে বললাম চলো আমার সুইট হোমে। নীপার দিকে তাকালাম।
-বুঝেছি, চা তো, যাও পৌঁছে যাবে। চায়ের সঙ্গে আর কিছু।
হাসলাম। আমি ইসলাম ভাই চলে এলাম। ইসলাম ভাই-এর মাথা ঠেকে যাচ্ছে। সবসময় ঘাড় কাত করে রয়েছে।
-জানিস অনি তোর এই মাটির বাড়ি আর খড়ের চাল দেখে আমাদের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
-তোমাদের গ্রামের বাড়িও কি এই রকম।
-না। তোদের মতো এতো নীচু নয়, মাটির দেওয়াল, তবে আমাদের খোলার চাল, আমাদের ধানের ব্যবসা ছিলো, থাক এখন, পরে তোকে সব বলবো। ইসলাম ভাই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলো
-এখন এই পোষাকটা আমায় খুলে ফেলতে হবে।
হাসলাম, কেনো।
-উঃ সবাই যে ভাবে আমাকে দেখছে, আমি যেন যাত্রা দলের সং।
-এরা এই পোষাকে এখানে আগে কাউকে দেখে নিতো, তাই।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম।
-তোর বাড়িটা কিন্তু বেশ দারুণ। এইটা তোর ঘর।
-হ্যাঁ। নিচে আরো দুটো ঘর আছে। আমি ব্যবহার করি না। কোথায় থাকি তার ঠিক নাই।
-তুই কি একেবারেই আসিস না।
-না।
-কেনো?
-সে অনেক কথা, তবে অভিমান একটা বড় কারণ। এই অভিমানটা বড় মা অমিতাভ দা ভেঙে দিয়েছে।
-বড়দি তোর জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে।
-অনেকটা অংশ নয়, পুরোটা। জ্ঞান হওয়া অবস্থায় জীবনে প্রথম মা বলে ডেকেছি। এরপর ছোটো মা, তারপর মিত্রা।
-আমি।
-তুমি এবার জুড়ে বসবে।
-এতদিন......
-তোমাকে আমার কাজের মানুষ বলে মনে করতাম। তোমার সঙ্গে আমার একটা ভালো সম্পর্ক আছে এই কিন্তু এখন সেটা দেখছি বন্ধনের পযার্য়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
ইসলাম ভাই আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
-কি দেখছো?
-তোকে। তোর সত্যি কথা বলার হিম্মত দেখে।
নীপা ব্যাগ নিয়ে ঢুকলো।
-তুমি আমায় পরিচয় করিয়ে দিলে না।
-সত্যি তো। ভুল হয়ে গেছে, আমার ফ্রেন্ড ফিলোজফার গাইড, আমার দাদা মুন্না ভাই। খালি এটুকু জানো। এর বেশি কিছু নয়। আমরা একসময় এক সঙ্গে কাটিয়েছি, আমার জীবনের উত্তরণের একটা অংশ জুড়ে আছে মুন্না ভাই।
নীপা প্রণাম করতে গেলো, ইসলাম ভাই ওর হাতটা চেপে ধরলো। না আমি বিধর্মী।
-তুমি একথা বলছো কেনো দাদা! অনিদা কোনো দিন এসব মানে না। অনিদার কাছে পৃথিবীর সবাই মানুষ, তার কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই।
ইসলাম ভাই নীপার মুখটা পদ্মফুলের মতো তুলে ধরেছে। ওর ওই রকম বড় বড় থাবার মতো হাতে নীপার মুখ অত্যন্ত ছোটো লাগছে। ইসলাম ভাই যেন নীপার কাছে লিলিপুটের দেশে গ্যালিভার।
-তুমি অনির কথা বিশ্বাস করো।
-হ্যাঁ।
-যাও আমি তোমার প্রণাম নিলাম। ইসলাম ভাই নীপার কপালে চুমু খেলো।
নীপা ব্যাগগুলো দেখিয়ে বললো, কোনটা তোমার।
-যাও আমি ঠিক করে নিচ্ছি।
-তুমি বলো না, আমি গুছিয়ে দিই যাই আলনায়।
-থাক পরে গোছাবে।
-ঠিক আছে, আমি চা নিয়ে আসি।
-এসো।
-মেয়েটা খুব মিষ্টিরে, ভীষণ ইনোসেন্ট, কে রে?
-সুরমাসির মেয়ে, ওর অবস্থাও খানিকটা আমার মতো।
-জানিস অনি ভালো খারাপটা তৈরি হয় আমাদের মতো ঘরের থেকে। বিচারও হয় আমাদের মতো ঘরে, ওপরে যা নিচে যা, সেখানে ভালো মন্দের বিচার করতে পারবি না, সেখানে সব ভালো, নয় সব মন্দ।
ইসলাম ভাই নিজের ট্রাভেলার ব্যাগটা খুলে একটা শেরওয়ানী বার করলো।
-এখানে তো লুঙ্গি এলাও না, তাই না।
-তুমি পরতে পারো।
-আমার জন্য নিয়ম ভাঙবি কেনো।
হাসলাম।
-আমি বাইরে যাই তুমি চেঞ্জ করে নাও।
-ঠিক আছে।
আমি বাইরের বারান্দায় এলাম।
দেখলাম তিনজনে খামারে দাঁড়িয়ে এই বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে, পাশে মনা কাকা, কাকীমা। আমায় বারান্দায় দেখতে পেয়ে মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো আয় নিচে আয়।
আমি হাত নেড়ে ওপরে ডাকলাম। বড়মা দেখলাম গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে।
ইসলাম ভাই ভেতর থেকে বললো, অনি আমি রেডি।
আমি ভেতরে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললাম, বড় মা ছোটো মা আসছে।
নিচে নেমে এলাম।
পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম। তুই তো খুব ধনী লোক।
আমি বড়মার চোখে চোখ রাখলাম, অর্থের ভেতরে অর্থের খোঁজ করার সন্ধানে।
-তাকিয়ে লাভ নেই, যা বলছি ঠিক বলছি।
-এবার বল, বড়মাকে কে মালকিন। মিত্রা বললো।
আমি মাথা নীচু করলাম।
বড়মা চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে, বলতে গেলে জরিপ করে নিচ্ছে।
আমি বড়মাকে ধরে ধরে ওপরে তুললাম। পেছনে সবাই। আমার ঘরটা দেখে বললো।
-তোর ঘরটা বেশ। এই জানলাটার সামনে বুঝি তুই বসে থাকিস।
-মিত্রা বুঝি তোমাকে ডিটেলসে বলেছে।
-তোর থেকে গল্পটা ও ভালো বলে। তুই জল মেশাস, ও জল মেশায় না।
-তুমি যে কখন কার বোঝা মুস্কিল।
-বল বল, কি রকম দিলাম।
আমি মিত্রার দিকে তাকালাম, তুমি খাটে বোসো। ইসলাম ভাই সোফাটায় বসেছে, আমি সোফায় গিয়ে বসলাম, বড়মা ছোটোমা মিত্রা খাটে, মিত্রা ঠ্যাং ছড়িয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পরলো।
-কিরে শুয়ে পরলি কেন?
-কতটা হাঁটালো বলোতো।
-কই এইতো এই টুকু!
-তোমার কাছে এইটুকু, আমার কাছে অনেক।
নীপা চা নিয়ে ঢুকলো, মিটসেফের ওপর ট্রেটা রেখে সকলকে দিলো, মিত্রা তড়াক করে উঠে বসলো।
-নীপা, পাঁপড় ভাজাগুলো নিয়ে আয় তো।
-কেন? তোমার জন্য আছে দিচ্ছি।
-ওকে দিস না, সকাল থেকে কিছু খায় নি, শরীর খারাপ, খালি পেটে পাঁপড় খেলে গ্যাস হবে।
মিত্রা এমন ভাবে কথা বললো, বড়মা হেসে ফললো, ছোটোমা ওর দিকে তাকিয়ে বললো
-তোর কি হয়েছে বলতো।
মিত্রা পাঁপড় খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।
-চা খাব না বুঝলি নীপা, তাহলে ভাত খেতে পারবো না।
নীপা বড়মার দিকে তাকালো।
-তুই ছাড়তো ওর কথা, ওখানে রাখ ঠিক খেয়ে নেবে।
-নীপা অনাদিরা গেলো কোথায়?
-বললো বাজারে যাচ্ছে এখুনি এসে পরবে। ওরা তো সেই কাল রাত থেকে যা বেরিয়েছিল, কি অবস্থা এখানে! তারপর তুমি ফোন করলে একটু থামলো। খুব খারাপ লাগছে শেলিটার জন্য। নীপা মাথা নীচু করলো, গলাটা ভারী হয়ে এলো।
-মন খারাপ করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
-না গো বড়মা, ওকে তো আর দেখতে পাবো না, পরশুদিন রিহ্যারসালে ওর সঙ্গে বসে কত কথা হলো। বললো দেবাদার চাকরি হয়ে গেলেই এখান থেকে চলে যাবে। অনিদা কি বলেছিলো অনাদি দার মারফত, দেবাদা রাজি হয় নি।
-জানো বড়মা আমি বলতে চাই, শোনার লোকের বড় অভাব। কে বুঝবে আমার কথা, দিবাকরের সঙ্গে এক সঙ্গে পড়েছি, খেলা করেছি, ওকে শাস্তি দিতে আমারও খারাপ লাগছে, কিন্তু আমি অপারগ। আমার একটা ছোট্ট ভুলে একটা প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান চলে যেতে পারে, আমি তা করতে দিতে পারি না।
-তুই শান্ত হ। আমি বলছি, তুই ভুল করিস নি।
-তোমাদের বলিনি, বলো তুমি এই কথা তোমাদের বলা যায়। তোমরা আমার মা। নিজের মাকে তো কোনোদিন মা বলে ডাকতে পারি নি।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে।