06-02-2022, 07:35 PM
পর্ব দশ
ইতিমধ্যে, একদিন শিভের কাছ থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, বাপি আর ভাই খেলা দেখছে, ইন্ডিয়া- ইরানের ম্যাচ। তখন প্রায় রাত নটা। শিভ কে খাইয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেছিল কোলে আমার। তাই আমিও চলে এসেছিলাম। আমি আটটার দিকে চলে যাব কালকে সকালে।
আমি বাড়ি ঢুকতেই, আমাকে দেখে ভাই বলল,
- দিদি বস , দ্যাখ ইন্ডিয়া ভালো খেলছে খুব। ১-১ চলছে। রাকা দা দারুন খেলছে।
ভাবলাম মরন নেই আমার!! আমি বললাম
- তুই দ্যাখ। আমাকে বলছিস কেন?
বেচারী ভাই। ঝাড় খেয়েও কিছু বলল না আমাকে। খেলায় মত্ত ছিল। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং এ বসলাম । রাত হয়েছে। মা খেতে দেবে একটু পরে। চোখ গেল টি ভি তে। খেলা টা দেখতে শুরু করলাম। প্রায় ছয় বছর, ভারতের কোন খেলা আমি দেখিনি। জানিনা না কেন আজকে দেখতে বসে গেলাম। রাকার সাথে হওয়া আমার ওই সব ঘটনার আগে খুব দেখতাম খেলা। রাকার প্রতি টা ম্যাচ দেখতাম। ম্যাচ শেষ হবার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ওর ফোন আসত। জিজ্ঞাসা করত। আমিও বলতাম ওকে অনেক কথা। কিন্তু অনেক দিন আমি ওর খেলা দেখিনি ইচ্ছে করেই। দেখার মন বা ইচ্ছে কোনটাই ছিল না। ওর মুখ তো দুরের কথা নাম শুনলেই গা আমার জ্বলে উঠত অপমানে।
আজ চোখে পরে গেল খেলা টা। বসেই ছিলাম তাই চোখ দিলাম টিভি তে। সেই পুরোন ৭ নাম্বার জার্সি পরেই খেলছে ও। পিছনে লেখা বড় বড় করে- আর এ কে এ। আর নামের নীচে ৭ আর তার নিচে লেখা আই এন ডি আই এ। জার্সি অনেক বদলে গেছে। নীলের সাথে কত রকম কারিকুরি করেছে। ভালো লাগছে জার্সি টা দেখতে। অনেক স্কিন টাইট জার্সি বানায় এখন। দেখলাম ও বেশ ডিপ থেকে অপারেট করছে। দৌড়চ্ছে কম। ওকে ওর কোচ একেবারে মাঝ খানে রেখেছে। পুরো খেলা টা ওর পা থেকেই ডিস্ট্রিবিউট হচ্ছে। ও তো বাঁ পায়ের প্লেয়ার। ওকে একটু ডান দিক থেকে অপারেট করালে ওর খেলা টা খোলে বেশি। বাঁ পায়ের ভাসানো শেষ মুহুর্তে ইনসুইং নেওয়া শট গুলো বরাবর ই বিপজ্জনক হয়। সে গুলো নিতে পারছে না। আর ছটফট করছে।
কিন্তু খেলছে ভালো। হয়ত ফাইনাল পাস দিতে পারছে না। কিন্তু ওপেন করে ফেলছে ও অনেক টা জায়গা, উপরে উঠে আসলেই। কিন্তু ইরানের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না ওপরে। উপরে লোক না পেলে যা হয়। ইম্ম্যাচ্যুওর এটেম্পট। ডান দিকে রয় বলে একটা একেবারে বাচ্চা ছেলে খেলছে। দেখলাম ওর সাথে তাল মেল ভাল। ইরান দারুন টিম। যখন উঠছে ওরা একেবারে টোটাল উঠছে। তখন ইন্ডিয়া চার নয়তো পাঁচ জনে চলে যাচ্ছে নিচে। কখনো কখনো রাকা নেমে গেলে ছয় বা সাত জনে ডিফেন্ড করছে ইন্ডিয়া। আবার সেখানে বলের পজেশন পেলেই, কাউন্টার এ আসছে। তখন উপরের তিন চার জন প্লেয়ারের উপরে চাপ পরে যাচ্ছে। আর সেই জন্য গোল অব্দি যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবছি, তুই একটু বাঁ দিকে চলে আয় রাকা। তোর ক্রস গুলো ইন্স্যুইং করে গোল মুখে যাবে। করিম বলে একটা স্ট্রাইকার খেলছে ৯ নাম্বার জার্সি পরে। খুব ছটফট করছে। রাকার ওই ইনস্যুইং গুলো পেলে ছেলেটা বলে বলে গোল করতে পারবে। করিম কে দেখলাম, জটলা থেকেই শট নিতে। ম্যাচুওর করছিল না ওর শট গুলো। রাকা অনেক টা ডিপ থেকে খেলছে বলে, ওর নেওয়া শট গুলো ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, গোল না হলে ইন্ডিয়ার চাপ আছে। কারন ইরানের আক্রমন তখন বাড়ছে। শক্তির অনেক তফাত দুটো দলে। কোথায় একটা দল বিশ্বকাপ নিয়মিত খেলে আর ভারত প্রথমবার খেলবে হয়ত এবারে।
খেলা টা শেষ হলো, মন টা খারাপ হয়ে গেল, ২ -১ এ হারল ভারত। দেখা যাক আরো দুটো ম্যাচ খেলবে এই সিরিজ এ ভারত, ইরান এর সাথে। যদিও পরের দুটো ম্যাচই ভারত ১ – ১ এ ড্র করল। দুটো খেলা দেখিনি কিন্তু খোঁজ নিয়েছিলাম। মন্দ না। ইরানের মতন শক্তিশালী টিমের সাথে এই রেজাল্ট খারাপ কি?
কিন্তু এদিকে আমি পরে গেলাম মুশকিল এ একটু। আমি একদম ই রাকার জীবনের সাথে জড়াতে চাইনি। শিভের আমার উপরে টান দেখে হয়ত বা ভাল লেগেছিল আমার। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই টান এমন মারাত্মক আকার নেবে আমিও বুঝিনি। সেই টান উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। কি করেই বা পারি? ওই টুকু একটা ছেলে আকড়ে ধরলে,কোন মেয়ের পক্ষে সম্ভব না সেই টান কে অগ্রাহ্য করার। যদিও রাকা আমাকে হিজড়ে বলেই সম্বোধন করেছিল, শেষ দেখার সময়ে। মেয়ে তো আমাকে ও ভাবে না। ওই ছক্কা বা হিজড়েই ভাবে ও আমাকে। সেই অপমান আমি গায়ে নিয়েই ঘুরি। রাকা এবং রাকার সম্পর্কিত কাউকে দেখলে সেই অপমান আমাকে প্রতি মুহুর্তে দগ্ধ করে। দাউ দাউ করে আমার মন , মনে ভিতরে আজন্ম লালিত, মায়া মমতা সব পুড়ে ছারখার হতে থাকে। কই তবুও তো পারিনি আন্টি কে ফেলে দিতে। তবুও পারছি না রাকার মা মরা ছেলেকে , নিজের মমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। এটা বুঝেছি সব ব্যাপার টা নিজের হাতে থাকে না। ভগবান এতো ক্ষমতা তো আমাকে দেন নি । রাকা কে হারানোর যাতনা বুঝি ভগবান আমাকে এই ভাবে মিটিয়ে দিচ্ছেন।
বড্ড দ্রুত জড়িয়ে পরতে থাকলাম আমি। জানি আমার জীবনে অপমান কষ্ট আসবে,কিন্তু শিভ কে ফেলে দিতে পারছি না। আর ও ছেলে যেন আমার মধ্যে কি একটা দেখেছে। রোজ যাওয়া চাই আমার। না গেলে কান্না। মাঝে এমন ও হয়েছে,ওর ঘুম ভেঙ্গে আমাকে না দেখতে পেয়ে কান্না কাটি করেছে আর আমাকে রাতে চলে এসেও যেতে হয়েছে ওর কাছে। না আমার বিরক্ত লাগে নি একদম ই। আমিও ওর সাথে থাকতে পছন্দ করি খুব। কিন্তু ভয় লেগেছিল। কত দিন চলবে এমন? ওর বাবা বিশাল প্লেয়ার। থোড়াই ওকে এখানে রেখে দেবে? নিয়ে যাবে। বড় কলেজে পড়বে। কিন্তু আমাকে রোজ ওকে রাতে খাইয়ে দিয়ে আমাকে ফিরতে হয় বাড়ি। আবার সকালে , তাড়াতাড়ি স্নান করে চলে যাই ওর জন্য রাকার বাড়িতে। ওকে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে তারপরে কলেজ যাওয়া আমার। আমার মা তো গজগজ করে সর্বক্ষন। কিন্তু কি করব আমি? মা এর একদম ভালো লাগছে না ব্যাপার টা। সর্বক্ষন আমাকে বলে চলেছে মা।
- শিক্ষা নেই শয়তান মেয়ের। তোর না হয় মান সম্মান জ্ঞান নেই। আমাদের তো আছে। যে সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে, সেই নিয়ে আবার টানা হেঁচড়া কেন? ভালো লাগে না বাবা। পছন্দ করি না আমি এসব একদম।
আমিও ভাবছিলাম কি ভাবে বেরিয়ে আসব শিভের থেকে। ওদের ছেলে, আমি তো দাবী করতে পারব না কোনদিন যে ও আমার ছেলে। এতো কেন জড়িয়ে পরছি আমি? ভাবি যাব না আর ডাকলেও। ও কাঁদলেও যাব না আমি। একদিন কাঁদবে? দুদিন কাঁদবে? তারপরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু থাকতে পারি না আমি। জানিনা ওর কান্নার খবর শুনলেই আমার মন কেমন একটা হয়ে যায়। আমি দামড়ি বুড়ি। বাপি আর মায়ের আদর খাই আর ওই টুকু ছেলে, কোনটাই পাচ্ছে না । তাই হয়ত আমাকে আঁকড়ে ধরে। কি করে ফেলে আসি আমি ওকে? নাহ যাই থাক কপালে। আরো একটু না হয় অপমান জুটবে। কষ্ট জুটবে। ওই টুকু ছেলের অমন টানের কাছে সে সব তো তুচ্ছ। যাই বলুক মা। মায়ের আর কি? মায়ের ছেলে মেয়েরা তো কাছেই। ওর মা বাবা কেউ নেই সাথে। মা বুঝতে পারছে না। বুঝবেও না।
সমস্যা হল তখন যখন রাকা ফিরল ট্যুর টা শেষ করে। ও আসার পরে আমার যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। যাই নি দুদিন কোন কল ও আসে নি আমার কাছে। মন টা খারাপ লাগছিল আমার। যে একবার ও শিভ কাঁদল না আমার জন্য? মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, ভালই হয়েছে। এবারে এই টান টা কেটে যাবে। আর মা কে চিন্তা করতে হবে না আমার জন্য। মনে মনে মুক্তির স্বাদ। কিন্তু সেই স্বাদ আমি নিতে পারছি না। মেয়েরা কি এমনি ই হয়? মুক্তি নিতে চায় না? কি জানি মা কে জিজ্ঞাসা করব একদিন কথাটা। আমি তো মেয়ে নই। রাকার বলা কথা মনে পরল, আমি তো হিজড়ে। চোখে জল চলে এল আমার।
যাই হোক। সেদিনে রনি এসেছিল সন্ধ্যে বেলায়। সাথে রনির হবু বউ। গল্প করছিলাম আমরা। তখন প্রায় রাত দশ টা হবে। ভাই ও বাড়িতে। আমি রনির জন্য ফ্রায়েড ম্যাগি করেছিলাম। ও খেতে ভালোবাসে। এতোক্ষনে রনি রাও উঠি উঠি করছে। মন টা ঠিক নেই আমার। শিভের জন্য কেমন একটা করছে মন টা। বাড়িতে রাকা আছে যে না হলে যেমন চলছিল চলত। রনি বার বার আমাকে দেখছে। বলল,
- কি রে মন ঠিক নেই মনে হচ্ছে?
- নাহ তেমন কিছু না। তবে ঠিক বলেছিস, ভাল নেই মন টা আমার।
- কি হলো আবার
তাকিয়ে রইলাম। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। রনি কে বললে রনিও আমার উপরে চেঁচামেচি করবে। চুপ করে গেলাম। ঠিক সেই সময়েই ফোন টা এলো আমার ফোন এ। দেখলাম আন্টি মানে রাকার মায়ের ফোন। এতো রাতে?
- হ্যালো
- শিব? আন্টি বলছি বাবা!
গলার মধ্যে একটা ধরা ভাব। ভয় লাগল,
- হ্যাঁ আন্টি বল? কি হয়েছে। গলা টা এমনি শোনাচ্ছে কেন?
- না না তুই তো আসছিস না। আমি তোকে ফোন ও করিনি রাকা এসেছে বলে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে আর সামলাতে পারছি না
আমি একবার রনি কে আর মা কে দেখলাম। আন্টি কে বললাম,
- কেন কি হল? আমাকে বলো আন্টি
আন্টি চুপ করেই আছে। উফ মা ছেলের এক স্বভাব। কথা বলতে বলতে চুপ করে যায়। আমি আবার বললাম
- আন্টি বল? কি হলো শিভের?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে পরেছিলাম। আন্টি বললেন,
- আরে চারদিন ধরেই ওকে বলছি, কালকে আসবে তোর শিব। এই করতে করতে, আজকে সকাল থেকে আর কিছু খায় নি। সন্ধ্যে থেকেই কাঁদছে। ওর মাসী দাদু দিদা সবাই এল। কিছুতেই কিছু হলো না। ওর বাবা তো খানিক বকে ঝকে বেরিয়ে গেল রেগে শশুর শাশুড়ি আর শালী কে পৌঁছে দিতে। সেই থেকে ছেলে জোরে জোরে কাঁদছে আর হাঁপাচ্ছে। আমি আর তোর আঙ্কল ফোন করলাম তোকে। কি যে করব বুঝতে পারছি না।
থম হয়ে গেলাম। আমি কি করব এখন? জানিনা রনি আর মা শুনলে কি বলবে? যা বলে বলুক আমি আন্টি কে বললাম বেশ জোরের সাথেই,
- সকাল থেকে খায় নি, একবার আমাকে সকালেই কল করতে পারলে না? অতো ছোট ছেলে না খেলে শরীর খারাপ করে যাবে তো।আর হাঁপাচ্ছে কেন ও?
- কি করব? রাকা আছে বাড়িতে। তোকে কল করব মা? তোর সাথে সেই অপমান আমার ও হয়েছিল। কিন্তু এখন ছেলেটার জন্য বাধ্য হলাম কল করতে তোকে।
আমি বেশ উদ্বিগ্ন স্বরেই বললাম আন্টি কে,
- আর পারি না তোমাকে নিয়ে। আমার অপমান টা আগে হলো? ছেলেটা কিছু না?
উফফ ভাল লাগে না আর। ব্যাপারের গুরুত্ব কেউ বোঝে না। কোথায় একটা ফুলের মতন বাচ্চা ছেলের ভালো লাগা মন্দ লাগা। আর কোথায় আমার মতন একটা আধ দামরীর অপমান। ততক্ষনে মা আর রনি একে অপর কে দেখছে। বুঝে গেছে কি হয়েছে। আর আমি কি করতে চলেছি। আমি রেগেই আমি আন্টি কে বললাম,
- আমি আসছি । সন্ধ্যে বেলাতেই যখন কাঁদছিল , ফোন করতে পারতে আমাকে।
মনের মধ্যে থেকে সব ভাবনা উড়ে গেল আমার। যা হয় হবে। আমি ফোন টা রেখে উঠে পড়লাম। স্কার্ট টা পরেইছিলাম। শুধু টপ টা বদলে নিলাম। গলায় একটা ছোট ওড়না নিয়ে নিলাম। পার্স টা নিয়ে স্কুটির চাবি টা নিয়ে আমি ডাইনিং এ আসতেই মা আমার পথ আটকে দাঁড়ালো।
- কোথাও যাবি না তুই। ঠেকা নিয়ে রেখেছিস নাকি? কার না কার ছেলে। ও চলল রাত দুপুরে তার ছেলেকে দেখতে। তুই বল ওদের আমি যাব।
আমার মায়ের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না। কি বোঝাবো মা কে। বলতে গেলেই অনেক বাজে প্রসঙ্গ উঠে আসবে। রনিও উঠে এলো। রনির বউ বেচারী কিছু বুঝতে পারছে না। রনি আমাকে বলল।
- কি ছেলে মানুষি করছিস শিব? যাবি না তুই। রাকা একবার ও খবর নিয়েছে তোর?
মা কে কিছু বলতে পারছিলাম না। কিন্তু রনির উপরে রাগে ফেটে পরলাম আমি।
- রনি তুই ও এ কথা বলছিস? ও একটা বাচ্চা ছেলে। খায় নি সকাল থেকে। আর আমি এখানে বসে থাকব? আর রাকা খবর নেয় নি বলে ওর ছেলে তো কোন দোষ করে নি।
রনি টা ঝাড় খেয়ে শুধরে গেল। আমাকে আমতা আমতা করে বোঝানোর চেষ্টা করল,
- না, মানে কি করবি তুই? তুই বুঝতে পারছিস না তুই জড়িয়ে পরছিস? আবার অপমানিত হবি।
- হলে হব। তা বলে আমি এখন দূরে থাকতে পারব না। আর আমার তো রাকার সাথে দেখাও হয় নি। ও একটা চার বছরের বাচ্চা রনি। প্লিস মাকে বোঝা। আমি তো যাবই। তাতে আমাকে এ বাড়িতে ঢুকতে না দিলেও আমি যাব।
শেষের কথায় মা কেঁদে উঠল। আমাকে শুনিয়ে চিৎকার করে উঠল,
- হ্যাঁ এখন , রোজগার করছিস। অনায়াসে তুই এ বাড়িতে না ঢুকতে পারিস।
মা হাঁপাচ্ছে রাগে। আমিও চুপ। যাব তো আমি বটেই। কিছুক্ষন দেখি, বেশী ঝামেলা করলে ঝগড়া করেই যাব। বাপি দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আমাকে মানা ও করতে পারছে না আর মা কেও কিছু বলতে পারছে না। রনিও আমার এই মুর্তি দেখে একেবারে ব্যোমকে গেছে। মা খানিক চুপ থেকে, বেশ জোরের সাথেই বলল,
- বেশ আমিও যাব সাথে। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে মানা করলে আমি এখানে কুরুক্ষেত্র করব বলে দিলাম।
উফ। পারা যায় না আর মা কে নিয়ে। ওখানে গিয়ে ঠিক কিছু না কিছু বলবে। আমি বললাম মা কে,
- বেশ চল। গিয়ে দেখ তোমার মেয়ের রাকার উপরে কোন লোভ আর নেই। সেই দেখতেই তো তুমি যাচ্ছ? চল। কিন্তু বলে দিলাম, ওখানে গিয়ে, আঙ্কল আন্টি কে কোন অপমান জনক কিছু বললে, আমি ওখানে কুরুক্ষেত্র বাঁধাব। আমার একটা সম্মান আছে ও বাড়িতে।
মা শুনল না আমার কথা। মা কে নিয়ে আমি বেরোলাম বাড়ি থেকে। একটু খানি এগিয়েই স্পিড তুললাম আমি জোরে। আমার আর তর সইছে না। সন্ধ্যে বেলায় বললেই আমি তো চলে আসতাম।
মা ভয়ে ভয়ে আমাকে বলল পিছন থেকে,
- আস্তে চালাতে পারছিস না গাড়ী টা। তোর বাবাকে বলে তোকে গাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আরে বাবা, এটা গাড়ি, এরোপ্লেন নয়। আস্তে চালানা বাবা?
- উফ চুপ কর তো। আস্তেই তো চালাচ্ছি। ৪০ এর কমে এই গাড়ি চলে না। চুপ করে বসে থাক।
সব থেকে শর্ট কাট এ আমি রাকার বাড়িতে পৌছুলাম। গিয়ে দেখি কাকু কাকিমা বসে আছে দুয়ারে। আমি যেতেই দুজনাই উঠে দাঁড়াল। আমার মা কে আমার পিছনে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে দুজনাই। আমি সে সব আর না দেখে ঘরের মধ্যে ঢুকতে যাব, আর শিভ বিদ্যুৎ গতি তে ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরল একেবারে। আর সাথে ফুঁপিয়ে কান্না। চোখের জল সামলে আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। আমার মা অবাক হয়ে দেখছে, শিভ কে। আমাকে আঁকার করে ধরে শিভের কান্না কে। আমি ওকে ভোলাতে শুরু করলাম,
- কি হয়েছে? শিভ। এস এইচ আই ভি?
সে আমার ঘাড়ে মুখ টা কে গুঁজে ঘাড় নেড়ে জানান দিল আমি ঠিক স্পেলিং টা করেছি।
বোঝ! আমি বললাম,
- কান্না কেন? খাও নি কেন?
ওই ভাবেই আমার কাঁধে মুখ টা গুঁজে জবাব দিল
- আস নি কেন?
- ও এই জন্য খায় নি শিভ বাবু? তা আমাকে ডাকলেই হতো। আমি চলে আসতাম। আমি কি করে জানব আমাকে ছাড়া শিভ বাবু খাবে না কিছূ?
আমার কথাটা শুনে, মুখ টা তুলে বলল আমাকে,
- তোমাকে ডাকলেই তুমি আসতে? কই আমার মম কে কত ডেকেছি, আর তো আসে নি।
কথা টা শুনে আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। ওকে টেনে নিলাম আমার কাছে সজোরে। মাথায় হাত দিয়ে ওর মাথাটা আমার কাঁধে চেপে ধরলাম। মুখ টা ওর গলায় ঢুকিয়ে দিলাম আমি। হয়ত কান্না লোকালাম ওই ভাবে। বললাম,
- আমাকে ডাকলেই পেতে তুমি।
উত্তর দিলো না ও। ভাবে নি হয়ত, যে আমাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। সেটা জানলে হয়ত ও আগেই কাঁদত।বাচ্চাদের বিশ্বাস কত সহজে আসে আর কত সহজে মেনে নেয় ওরা। ওর মা কে ডীকে পায় নি বলে ও নিশ্চিন্ত ছিল আমাকেও ডাকলে ও পাবে না। কিন্তু আমাকে আরো আঁকার করে ধরল যেন। যেমন ভয় পেলে আমি মা কে ধরতাম আঁকার করে তেমন করে। ওর চোখের জলে ভিজে গেল আমার কাঁধ। বুঝলাম, আমার না আসা টা ওর মনে বেশ বড় রকমের প্রভাব ফেলছিল।মনে অনেক চিন্তা ছিল আমার, কিন্তু ওই আঁকার করে ধরার জন্য আমার কোন চিন্তা , কোন ভয় আর রইল না , সব চলে গেল। মনে হলো, এতো আঁকার করে তো আমাকে কেউ ধরে নি। এতো বিশ্বাস আমাকে কেউ করে নি। মা কে তার সন্তান মনে হয় এমনি ভাবেই আঁকড়ে ধরে। চোখের জল বেরিয়ে এলো আমার নিঃশব্দে। ধরা গলা তেই ওকে বললাম আমি,
- আচ্ছা আচ্ছা আর কাঁদে না। এবারে আমি তো এসে গেছি। এবারে দুটি খাবে? কি খাবে বল? আমি বানিয়ে দি?
মুখ টা আমার কাঁধের উপরে, আমার অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেই ঘাড় নাড়ল ও খাবে। আমি বললাম
- কি খাবে? দুটি ভাত একটু মাছ? আমি বেছে দি মাছ টা আর খাইয়ে দি?
আবার ঘাড় নারল শিভ ওই ভাবেই। আমার কথা শুনে আন্টি চলে গেল রান্না ঘরে। দুটি ভাত একটু আলু সিদ্দ আর মাছের ঝোল নিয়ে এলো আন্টি। আমি দুয়ারেই ওকে নিয়ে বসে পরলাম। আমার মা বসে আছে কিছু দুরেই। কোন কথা বলে নি। অবাক হয়ে দেখছিল মা আমাদের । আমি মায়ের দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছি। মায়ের চোখে রাগ বিরক্তি কিছুই নেই। শুধু বিস্ময়। আর হয়ত একটা ভালো লাগা।
আঙ্কল আর আন্টি বেশ অবাক মা আমার সাথে আসায়। বুঝতে পারছিলাম আমি সেটা। এখন কিন্তু সবাই হাসি মুখে রয়েছে। শিভের মুখে হাসি আর কেউ ই এখানে কিছু চাইছিল বলে আমার মনে হলো না। শুধু আঙ্কল আন্টি অবাক, যে মা ও আমার সাথে এসেছে। আমি শিভ কে খাওয়াতে খাওয়াতে বললাম আঙ্কল আর আন্টি কে।
- আসলে এতো রাতে একা তো বেরোই না আন্টি। তাই মা সাথে এলো।
- না না ঠিক করেছে। সত্যি তো আমাদের ভুল এতো রাতে খবর দেওয়া ঠিক হয় নি। আসলে সন্ধ্যে অব্দি ,ও ঠিক ছিল। তারপর থেকেই কেঁদে কেঁদে কেমন একটা করছিল। তাই ভয় পেলাম দিদি। কিছু মনে করবেন না
আমার মা মনে হয় তখনো আমাকে আর শিভ কে দেখছিল। আন্টির কথা টা শুনতে পেয়ে বলল
- না না ঠিক আছে। আরো আগে খবর দিলে ও দুপুরেই চলে আসতে পারত।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম মায়ের দিকে। উফ কি পাল্টিবাজ হয়েছে মা টা আমার। আমি আন্টির দিকে মুখের ইশারা তে বললাম একটা ডিম সিদ্দ নিয়ে আসতে। শিভ শুনতে পেলেই বলবে খাব না । মনে হলো ছেলেটা কিছু খায় নি সকাল থেকে। আর একটা ডিম সিদ্দ দেওয়াই যায়। শেষে ঠিক ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দেব। আন্টি উঠে গেল তাড়াতাড়ি। আন্টি ডিম সিদ্দ চাপিয়ে এসে বসলেন বাইরে।
বাপি ফোন করল মা কে। মা সব ঠিক আছে বলে দিল। দেরী হবে বাপি আর ভাই যেন খেয়ে নেয় সেটাও বলে দিল। আমি মা কে অবাক হয়ে দেখছি মাঝে মাঝেই। কি হলো মায়ের। একেবারে মা সারদা হয়ে গেলো যে। কে বলবে, আধ ঘন্টা আগে আমার সাথে অগ্নিশর্মা হয়ে কি ঝামেলা টাই না করল। মাছের কাঁটা বেছে আমি মুখে পুরে দিচ্ছি শিভের। ও খেয়ে নিচ্ছে। আমি মাঝে মাঝেই ওকে বলছি,
- জানো মা, আন্টি, আমাদের শিভের কি সুন্দর দাঁত। কি যে ভালো করে ও চিবোতে পারে তোমরা জানই না। হ্যাঁ ভালো চিবিয়ে খাও তো সোনা। মাছ খেলেই চিবিয়ে খেতে হয় কেমন?
মা উঠে এসে শিভের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
- দেখি? ওমা তাই তো! দেখি দেখি কেমন চিবিয়ে খায় আমাদের শিব?
চুপ করে ছিল শিভ। মা এর কথা টা শুনেই একেবারে তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার কোল থেকে তারপরে বলল,
- আমি এস এইচ আই ভি শিভ। শিব আমি নই ,এস এইচ আই বি , শিব হলো এইটা।
বলে আমার বুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আবার আমার কোলে মুখ লোকালো। আমরা হেসে উঠলাম। ভাত টা খাইয়ে ওর গা মুছিয়ে দিলাম। বাস ছেলে রেডি। এদিক ওদিক করতে লাগল ও। আমি ততক্ষনে ডিম টা ছাড়িয়ে, হালকা নুন দিয়ে রাখলাম। খেলতে খেলতে কাছে এলেই খাইয়ে দেব একটু একটু করে। ঠিক খেয়ে নেবে ।
আন্টি মা কে বলল
- দিদি দেরী হয়ে গেছে। ভাতে ভাত তুমি আর শিব খেয়ে নাও না এখানেই। বেশী কিছু করব না। ডিম আলু ভাতে, গরম ভাত আর মাছের ঝোল আছে। ভাগ করে হয়ে যাবে।
মা চিন্তায় পরে গেল। দেরী হবে মা বুঝতেই পারছে। আবার রাত ও হয়েছে। মা কিন্তু কিন্তু করতে লাগল। তাতে আন্টি বলল,
- আর না বোল না। তোমাকে আমি যাই খাওয়াই না কেন আমার লজ্জা নেই দিদি। বোস আমি ভাত আর আলু ভাতে চাপিয়ে দিয়ে আসি।
আমি আবার ও মা কে হা করে দেখলাম। পাল্টির শেষ সীমা তে পৌঁছে গেছে আমার মা। মনে মনে খারাপ লাগল। মা কে আমি ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু ওতো রেগে থাকা আমার মা কি করে পালটি খেল আমি এখনো বুঝতে পারছি না। মাঝে পুচকু টা কে আরেক বার ধরে ডিমের একটু খানি খাইয়ে দিলাম। কথা কম বলে খেলে বেশী। কখনো দুয়ারে ছুটছে তো কখন ঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে সেটা নিয়ে খেলছে।
ঠিক সেই সময়ে দরজা খুলে রাকা ঢুকল। আমার বুক টা ধক করে উঠল।কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ছয় বছর পরে ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আর আমি ওখান থেকে চলে যাবার রাস্তা খুঁজছি। একটা ভয় মনের মধ্যে। আবার হয়ত হিজড়া শুনব আমি। সেই ঘেন্না মাখানো চোখ আমার মনে আছে। আমি তাকালাম ও না ওর দিকে। মুখ দেখতে চাই না আমি ওর। কি জানি হয়ত নিজের মুখ দেখাতে চাই না আমি ওকে। আমি শিভ কে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। বাকী ডিম টা খাইয়ে, পিছন দিকের বারান্দায় বেরিয়ে, ছোট বেসিনে ওর মুখ টা ধুইয়ে, বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেললাম। ভাবলাম ঘুম পারিয়ে দি। তারপরে চলে যাব। কালকে সকালে ও কাঁদলে, তখন দেখা যাবে।
আমি যে ঘরে শিভ কে ঘুম পারাচ্ছি, সেই ঘর টা অন্ধকার। বাইরে ওরা আছে। আলো জ্বলছে। পর্দা সরানো। আমি দেখতে পাচ্ছি বাইরে টা । শিভ কে আমার কাছে নিয়ে পিঠে চাপড়াচ্ছি। ও চুপ্টি করে আমার বুকে মাথা টা গুঁজে ঘুমোনোর চেস্টা করছে। বাইরে রাকা কেও দেখছি আমি। মা কে দেখে অবাক হয়ে গেছে। বেশ ভালো রকম অবাক হয়ে গেছে ও। মানে এতো রাতে মা কেন সেই ব্যাপার টা ও বুঝতে পারছে না। অথবা আমরা যে আন্টির ফোন পেয়ে চলে আসব হয়ত ভাবে নি।
কিন্তু ও সামলে নিল। মা কে প্রনাম করল। মা বলল,
- থাক থাক। আর প্রনাম করতে হবে না।
- কেমন আছেন কাকিমা আপনি? কাকু ভালো আছে? গরিমা , পিনাকী এরা কেমন আছে সবাই।
আমার কথা জিজ্ঞাসা করল না। কিন্তু ওর নজর আমাকেই খুঁজছে। বার বার আমি যে ঘরে আছি সেই ঘরের দিকে নজর আসছে ওর। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। ও যখন বাড়িতে ঢুকেছিল তখন আমাকে বসে থাকতে দেখেছিল। কিন্তু ওকে দেখেই আমি শিভ কে নিয়ে ঘরে চলে এসেছিলাম। মা বলল,
- সবাই ভাল আছে বাবা। রোগা হয়ে গেছ বেশ।
- কাকিমা আপনি আমাকে তুই তুই বলতেন। এখন তুমি বলছেন।
- এখন কত বড় মানুষ তুমি। সাড়া ভারত জোড়া তোমার নাম। আর কি সেই ছোট টা আছ। যে বকার হলে বকব আবার আদর করে বসিয়ে দুটি খাইয়ে বাড়ি পাঠাবো?
মায়ের উপরে রাগে আমি ফেটে পরছি আমি বলতে গেলে। এতো কথা বলার তো কিছু নেই। আমার থেকেও বেশী মা রাকার উপরে রেগে ছিল। কিন্তু এখন দেখ? একেবারে গলে জল। আমার কিন্তু রাকা কে দেখে মনে হলো, অনেক অনেক ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে। একেবারও যেন কাহিল হয়ে পরেছে। ক্লান্ত শ্রান্ত মনে হচ্ছে ওকে। শিভ কে জড়িয়ে ধরলাম আমি। সেও কেমন আমার ভিতরে ঢুকে এল আমাকে জড়িয়ে ধরে। রাকা খানিক চুপ থেকে বলল,
- হুম। আমি নিজেই অনেক দূরে সরে গেছি তাই না কাকিমা?
পরক্ষনেই কথা ঘুরিয়ে দিল ও,
- মা কাকিমা কে খেতে দেবে না? রাত হয়েছে কিছু নিয়ে আসব? রনি কে ফোন করে দি তবে?
আন্টি তেড়ে গেল রাকার দিকে
- তুই বলবি তার পরে দেব নাকি? ওসব আমার চিন্তা। তুই তোর নিজের টা দেখ গা। মানুষ টা প্রথম বার বাড়ি এসেছে, তাকে কিনে খেতে দেব? বাড়িতে বানিয়ে দেব। তোকে অতো ভাবতে হবে না।
কাকিমার খেঁকানি তে চুপ করে গেল রাকা। বেচারী মা কে চিরকাল ই ভয় পায়। এখন তো আঁকড়ে ধরতে চাইছে মা কে আরো বেশী করে। কিন্তু আন্টি র কাছে এই সবের কোন মূল্য নেই আর। আন্টি কোন আশাই রাখেন না রাকার কাছে থেকে সেটা আমি জানি। আমাকে কথা বলতে হবে আন্টির সাথে। অনেক অনেক রাগ জমে ছিল, কিন্তু ওর এই মুখ টা দেখার পরে মনে হলো, আমার রাগ হয়ত ওকে আরো ক্ষত বিক্ষত করবে। কিন্তু তাতেও ও উদাসীন ই থাকবে। জীবনে কিছু পাবার আশা ও কোন দিন করে নি। আর হারিয়ে যাবার ভয় ও পায় নি। নিজের কষ্ট কাউকেই বলে না কোন দিন ও। ও এক প্রকার জীব। কিন্তু জীবনে সব পেয়েও না কিছু না থাকার যে একটা মুখ হয় সেটা ওকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম আজকে।
কিছু বলল না ও আন্টি কে আর। দুয়ারে বসে পড়ল। যে ঘরে আমি আছি সেই ঘরেই হয়ত ওর জামা কাপড় আছে। ও ঢুকতে পারছে না। আর একদিন ছিল, জোর করে আমার ঘরে ঢুকে পরত ও। মনে হলো হয়ত ও চেঞ্জ করবে। আমি বাইরে না গেলে ও আসতে পারবে না। আমি শিভ কে ধরে বুঝলাম ও ঘুমিয়ে গেছে। ওকে ভালো করে শুইয়ে, দু দিকে দুটো বালিশ দিয়ে আমি উঠে আসতে যাব দেখি আমার স্কার্টের দড়ি দুটো তে টান পরল। ভালো করে দেখলাম দেখি, আমার স্কার্টের দড়ি, ও হাতে পাকিয়ে ধরে রেখে দিয়েছে।
আমি দড়ি টা ওর হাত থেকে খুলে ফেলার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু টানাটানি তে ও উঠে পড়ল। আমি আবার পাশে শুয়ে পরলাম ওর। আচ্ছা ঝামেলা তে পরলাম আমি। এখন আমাকে না ছাড়লে তো আরো সমস্যা। ওদিকে বাইরে আন্টি খেতে দিয়েছে। আর আমি না বেরোলে রাকাও ঢুকতে পারছে না ঘরে। আমি শিভ কে কোলে নিয়েই বাইরে গেলাম। কোলে নিয়ে খেয়ে নেব। ততক্ষনে ওর ঘুম টাও ডিপ হয়ে যাবে আরও।
সবাই আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রাকা হা করে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমাকে দেখল ও প্রায় ছয় বছর বাদে। আমি মাঝে মাঝে টিভি তে দেখেছি। চোখ পরে গেছে আমার। অ্যাড ও দেয় দু একটা। কাজেই দেখব না বললেও মাঝে মাঝে চোখে পরে যাইয় বৈকি। চোখ সরছে না ওর আমার থেকে। আমি মা কে বললাম,
- আরে , সবাই ওমনি করে তাকিয়ে আছ কেন? উঠে আসার সময়ে দেখলাম, আমার স্কার্টের দড়ি নিজের হাতে পাকিয়ে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি খুলতে গেলাম ও উঠে পরল। আবার শুয়ে ঘুম পারিয়ে একেবারে ওকে নিয়েই উঠে এলাম। না হলে তোমরা সবাই বসে আছ না খেয়ে।
আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মা কে কি আমি অবাক করছি প্রতি মুহুর্তে? কে জানে? মা আমার উপরে আর কোন ভাবেই রেগে নেই সেটা বুঝতে পারছি। আমি শিভ কে কোলে নিয়ে বাঁ হাতে ওর মাথা টা রেখে খেতে লাগলাম। কেমন একটা লাগছিল। একটা আনন্দ মনে আবার একটা ভয়, যে এই ভাবে নিয়ে খাচ্ছি, ওতে ওর কোথাও ব্যথা লাগছে নাকি। কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আমি এক গ্রাস করে মুখে ভাত তুলছি, আর ওকে দেখছি। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি। এখন কেউ আর আমাকে দেখছে না। সবাই নিশ্চিন্ত। শিবের কাছে শিভ আছে। এই নিশ্চিন্ততা , এই ভরসা, এ যে কত বড় পাওয়া বলে বোঝানো যাবে না। খাওয়া হয়ে গেলে, আন্টি আমাকে জল এনে দিলেন, ওখানেই হাত ধুয়ে নিলাম আমি। কারন উঠে হাত ধুতে গেলে, ও ঘুম থেকে উঠে পরবে। এর পরে আসতে আসতে হাত থেকে খুলে নিতে হবে আমার স্কার্টের দড়ি টা।
খেয়ে দেয়ে ওকে শুইয়ে দিলাম। আন্টি শোয় ওর কাছে। আমি ওকে শুইয়ে দিলাম। পাশে শুয়ে আস্তে করে ওর হাত থেকে আমার স্কার্ট এর দড়ি টা খুলে নিয়ে উঠে আসতে যাব, এবারে আমার হাতের আঙ্গুল টা ধরল ও। চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি ঘুমোয় নি। বড় বড় চোখ দুটো পরিষ্কার ভাবে খোলা। আমার আঙ্গুল টা ধরে টানছে ওর দিকে।
ইতিমধ্যে, একদিন শিভের কাছ থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, বাপি আর ভাই খেলা দেখছে, ইন্ডিয়া- ইরানের ম্যাচ। তখন প্রায় রাত নটা। শিভ কে খাইয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেছিল কোলে আমার। তাই আমিও চলে এসেছিলাম। আমি আটটার দিকে চলে যাব কালকে সকালে।
আমি বাড়ি ঢুকতেই, আমাকে দেখে ভাই বলল,
- দিদি বস , দ্যাখ ইন্ডিয়া ভালো খেলছে খুব। ১-১ চলছে। রাকা দা দারুন খেলছে।
ভাবলাম মরন নেই আমার!! আমি বললাম
- তুই দ্যাখ। আমাকে বলছিস কেন?
বেচারী ভাই। ঝাড় খেয়েও কিছু বলল না আমাকে। খেলায় মত্ত ছিল। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং এ বসলাম । রাত হয়েছে। মা খেতে দেবে একটু পরে। চোখ গেল টি ভি তে। খেলা টা দেখতে শুরু করলাম। প্রায় ছয় বছর, ভারতের কোন খেলা আমি দেখিনি। জানিনা না কেন আজকে দেখতে বসে গেলাম। রাকার সাথে হওয়া আমার ওই সব ঘটনার আগে খুব দেখতাম খেলা। রাকার প্রতি টা ম্যাচ দেখতাম। ম্যাচ শেষ হবার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ওর ফোন আসত। জিজ্ঞাসা করত। আমিও বলতাম ওকে অনেক কথা। কিন্তু অনেক দিন আমি ওর খেলা দেখিনি ইচ্ছে করেই। দেখার মন বা ইচ্ছে কোনটাই ছিল না। ওর মুখ তো দুরের কথা নাম শুনলেই গা আমার জ্বলে উঠত অপমানে।
আজ চোখে পরে গেল খেলা টা। বসেই ছিলাম তাই চোখ দিলাম টিভি তে। সেই পুরোন ৭ নাম্বার জার্সি পরেই খেলছে ও। পিছনে লেখা বড় বড় করে- আর এ কে এ। আর নামের নীচে ৭ আর তার নিচে লেখা আই এন ডি আই এ। জার্সি অনেক বদলে গেছে। নীলের সাথে কত রকম কারিকুরি করেছে। ভালো লাগছে জার্সি টা দেখতে। অনেক স্কিন টাইট জার্সি বানায় এখন। দেখলাম ও বেশ ডিপ থেকে অপারেট করছে। দৌড়চ্ছে কম। ওকে ওর কোচ একেবারে মাঝ খানে রেখেছে। পুরো খেলা টা ওর পা থেকেই ডিস্ট্রিবিউট হচ্ছে। ও তো বাঁ পায়ের প্লেয়ার। ওকে একটু ডান দিক থেকে অপারেট করালে ওর খেলা টা খোলে বেশি। বাঁ পায়ের ভাসানো শেষ মুহুর্তে ইনসুইং নেওয়া শট গুলো বরাবর ই বিপজ্জনক হয়। সে গুলো নিতে পারছে না। আর ছটফট করছে।
কিন্তু খেলছে ভালো। হয়ত ফাইনাল পাস দিতে পারছে না। কিন্তু ওপেন করে ফেলছে ও অনেক টা জায়গা, উপরে উঠে আসলেই। কিন্তু ইরানের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না ওপরে। উপরে লোক না পেলে যা হয়। ইম্ম্যাচ্যুওর এটেম্পট। ডান দিকে রয় বলে একটা একেবারে বাচ্চা ছেলে খেলছে। দেখলাম ওর সাথে তাল মেল ভাল। ইরান দারুন টিম। যখন উঠছে ওরা একেবারে টোটাল উঠছে। তখন ইন্ডিয়া চার নয়তো পাঁচ জনে চলে যাচ্ছে নিচে। কখনো কখনো রাকা নেমে গেলে ছয় বা সাত জনে ডিফেন্ড করছে ইন্ডিয়া। আবার সেখানে বলের পজেশন পেলেই, কাউন্টার এ আসছে। তখন উপরের তিন চার জন প্লেয়ারের উপরে চাপ পরে যাচ্ছে। আর সেই জন্য গোল অব্দি যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবছি, তুই একটু বাঁ দিকে চলে আয় রাকা। তোর ক্রস গুলো ইন্স্যুইং করে গোল মুখে যাবে। করিম বলে একটা স্ট্রাইকার খেলছে ৯ নাম্বার জার্সি পরে। খুব ছটফট করছে। রাকার ওই ইনস্যুইং গুলো পেলে ছেলেটা বলে বলে গোল করতে পারবে। করিম কে দেখলাম, জটলা থেকেই শট নিতে। ম্যাচুওর করছিল না ওর শট গুলো। রাকা অনেক টা ডিপ থেকে খেলছে বলে, ওর নেওয়া শট গুলো ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, গোল না হলে ইন্ডিয়ার চাপ আছে। কারন ইরানের আক্রমন তখন বাড়ছে। শক্তির অনেক তফাত দুটো দলে। কোথায় একটা দল বিশ্বকাপ নিয়মিত খেলে আর ভারত প্রথমবার খেলবে হয়ত এবারে।
খেলা টা শেষ হলো, মন টা খারাপ হয়ে গেল, ২ -১ এ হারল ভারত। দেখা যাক আরো দুটো ম্যাচ খেলবে এই সিরিজ এ ভারত, ইরান এর সাথে। যদিও পরের দুটো ম্যাচই ভারত ১ – ১ এ ড্র করল। দুটো খেলা দেখিনি কিন্তু খোঁজ নিয়েছিলাম। মন্দ না। ইরানের মতন শক্তিশালী টিমের সাথে এই রেজাল্ট খারাপ কি?
কিন্তু এদিকে আমি পরে গেলাম মুশকিল এ একটু। আমি একদম ই রাকার জীবনের সাথে জড়াতে চাইনি। শিভের আমার উপরে টান দেখে হয়ত বা ভাল লেগেছিল আমার। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই টান এমন মারাত্মক আকার নেবে আমিও বুঝিনি। সেই টান উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। কি করেই বা পারি? ওই টুকু একটা ছেলে আকড়ে ধরলে,কোন মেয়ের পক্ষে সম্ভব না সেই টান কে অগ্রাহ্য করার। যদিও রাকা আমাকে হিজড়ে বলেই সম্বোধন করেছিল, শেষ দেখার সময়ে। মেয়ে তো আমাকে ও ভাবে না। ওই ছক্কা বা হিজড়েই ভাবে ও আমাকে। সেই অপমান আমি গায়ে নিয়েই ঘুরি। রাকা এবং রাকার সম্পর্কিত কাউকে দেখলে সেই অপমান আমাকে প্রতি মুহুর্তে দগ্ধ করে। দাউ দাউ করে আমার মন , মনে ভিতরে আজন্ম লালিত, মায়া মমতা সব পুড়ে ছারখার হতে থাকে। কই তবুও তো পারিনি আন্টি কে ফেলে দিতে। তবুও পারছি না রাকার মা মরা ছেলেকে , নিজের মমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। এটা বুঝেছি সব ব্যাপার টা নিজের হাতে থাকে না। ভগবান এতো ক্ষমতা তো আমাকে দেন নি । রাকা কে হারানোর যাতনা বুঝি ভগবান আমাকে এই ভাবে মিটিয়ে দিচ্ছেন।
বড্ড দ্রুত জড়িয়ে পরতে থাকলাম আমি। জানি আমার জীবনে অপমান কষ্ট আসবে,কিন্তু শিভ কে ফেলে দিতে পারছি না। আর ও ছেলে যেন আমার মধ্যে কি একটা দেখেছে। রোজ যাওয়া চাই আমার। না গেলে কান্না। মাঝে এমন ও হয়েছে,ওর ঘুম ভেঙ্গে আমাকে না দেখতে পেয়ে কান্না কাটি করেছে আর আমাকে রাতে চলে এসেও যেতে হয়েছে ওর কাছে। না আমার বিরক্ত লাগে নি একদম ই। আমিও ওর সাথে থাকতে পছন্দ করি খুব। কিন্তু ভয় লেগেছিল। কত দিন চলবে এমন? ওর বাবা বিশাল প্লেয়ার। থোড়াই ওকে এখানে রেখে দেবে? নিয়ে যাবে। বড় কলেজে পড়বে। কিন্তু আমাকে রোজ ওকে রাতে খাইয়ে দিয়ে আমাকে ফিরতে হয় বাড়ি। আবার সকালে , তাড়াতাড়ি স্নান করে চলে যাই ওর জন্য রাকার বাড়িতে। ওকে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে তারপরে কলেজ যাওয়া আমার। আমার মা তো গজগজ করে সর্বক্ষন। কিন্তু কি করব আমি? মা এর একদম ভালো লাগছে না ব্যাপার টা। সর্বক্ষন আমাকে বলে চলেছে মা।
- শিক্ষা নেই শয়তান মেয়ের। তোর না হয় মান সম্মান জ্ঞান নেই। আমাদের তো আছে। যে সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে, সেই নিয়ে আবার টানা হেঁচড়া কেন? ভালো লাগে না বাবা। পছন্দ করি না আমি এসব একদম।
আমিও ভাবছিলাম কি ভাবে বেরিয়ে আসব শিভের থেকে। ওদের ছেলে, আমি তো দাবী করতে পারব না কোনদিন যে ও আমার ছেলে। এতো কেন জড়িয়ে পরছি আমি? ভাবি যাব না আর ডাকলেও। ও কাঁদলেও যাব না আমি। একদিন কাঁদবে? দুদিন কাঁদবে? তারপরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু থাকতে পারি না আমি। জানিনা ওর কান্নার খবর শুনলেই আমার মন কেমন একটা হয়ে যায়। আমি দামড়ি বুড়ি। বাপি আর মায়ের আদর খাই আর ওই টুকু ছেলে, কোনটাই পাচ্ছে না । তাই হয়ত আমাকে আঁকড়ে ধরে। কি করে ফেলে আসি আমি ওকে? নাহ যাই থাক কপালে। আরো একটু না হয় অপমান জুটবে। কষ্ট জুটবে। ওই টুকু ছেলের অমন টানের কাছে সে সব তো তুচ্ছ। যাই বলুক মা। মায়ের আর কি? মায়ের ছেলে মেয়েরা তো কাছেই। ওর মা বাবা কেউ নেই সাথে। মা বুঝতে পারছে না। বুঝবেও না।
সমস্যা হল তখন যখন রাকা ফিরল ট্যুর টা শেষ করে। ও আসার পরে আমার যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। যাই নি দুদিন কোন কল ও আসে নি আমার কাছে। মন টা খারাপ লাগছিল আমার। যে একবার ও শিভ কাঁদল না আমার জন্য? মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, ভালই হয়েছে। এবারে এই টান টা কেটে যাবে। আর মা কে চিন্তা করতে হবে না আমার জন্য। মনে মনে মুক্তির স্বাদ। কিন্তু সেই স্বাদ আমি নিতে পারছি না। মেয়েরা কি এমনি ই হয়? মুক্তি নিতে চায় না? কি জানি মা কে জিজ্ঞাসা করব একদিন কথাটা। আমি তো মেয়ে নই। রাকার বলা কথা মনে পরল, আমি তো হিজড়ে। চোখে জল চলে এল আমার।
যাই হোক। সেদিনে রনি এসেছিল সন্ধ্যে বেলায়। সাথে রনির হবু বউ। গল্প করছিলাম আমরা। তখন প্রায় রাত দশ টা হবে। ভাই ও বাড়িতে। আমি রনির জন্য ফ্রায়েড ম্যাগি করেছিলাম। ও খেতে ভালোবাসে। এতোক্ষনে রনি রাও উঠি উঠি করছে। মন টা ঠিক নেই আমার। শিভের জন্য কেমন একটা করছে মন টা। বাড়িতে রাকা আছে যে না হলে যেমন চলছিল চলত। রনি বার বার আমাকে দেখছে। বলল,
- কি রে মন ঠিক নেই মনে হচ্ছে?
- নাহ তেমন কিছু না। তবে ঠিক বলেছিস, ভাল নেই মন টা আমার।
- কি হলো আবার
তাকিয়ে রইলাম। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। রনি কে বললে রনিও আমার উপরে চেঁচামেচি করবে। চুপ করে গেলাম। ঠিক সেই সময়েই ফোন টা এলো আমার ফোন এ। দেখলাম আন্টি মানে রাকার মায়ের ফোন। এতো রাতে?
- হ্যালো
- শিব? আন্টি বলছি বাবা!
গলার মধ্যে একটা ধরা ভাব। ভয় লাগল,
- হ্যাঁ আন্টি বল? কি হয়েছে। গলা টা এমনি শোনাচ্ছে কেন?
- না না তুই তো আসছিস না। আমি তোকে ফোন ও করিনি রাকা এসেছে বলে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে আর সামলাতে পারছি না
আমি একবার রনি কে আর মা কে দেখলাম। আন্টি কে বললাম,
- কেন কি হল? আমাকে বলো আন্টি
আন্টি চুপ করেই আছে। উফ মা ছেলের এক স্বভাব। কথা বলতে বলতে চুপ করে যায়। আমি আবার বললাম
- আন্টি বল? কি হলো শিভের?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে পরেছিলাম। আন্টি বললেন,
- আরে চারদিন ধরেই ওকে বলছি, কালকে আসবে তোর শিব। এই করতে করতে, আজকে সকাল থেকে আর কিছু খায় নি। সন্ধ্যে থেকেই কাঁদছে। ওর মাসী দাদু দিদা সবাই এল। কিছুতেই কিছু হলো না। ওর বাবা তো খানিক বকে ঝকে বেরিয়ে গেল রেগে শশুর শাশুড়ি আর শালী কে পৌঁছে দিতে। সেই থেকে ছেলে জোরে জোরে কাঁদছে আর হাঁপাচ্ছে। আমি আর তোর আঙ্কল ফোন করলাম তোকে। কি যে করব বুঝতে পারছি না।
থম হয়ে গেলাম। আমি কি করব এখন? জানিনা রনি আর মা শুনলে কি বলবে? যা বলে বলুক আমি আন্টি কে বললাম বেশ জোরের সাথেই,
- সকাল থেকে খায় নি, একবার আমাকে সকালেই কল করতে পারলে না? অতো ছোট ছেলে না খেলে শরীর খারাপ করে যাবে তো।আর হাঁপাচ্ছে কেন ও?
- কি করব? রাকা আছে বাড়িতে। তোকে কল করব মা? তোর সাথে সেই অপমান আমার ও হয়েছিল। কিন্তু এখন ছেলেটার জন্য বাধ্য হলাম কল করতে তোকে।
আমি বেশ উদ্বিগ্ন স্বরেই বললাম আন্টি কে,
- আর পারি না তোমাকে নিয়ে। আমার অপমান টা আগে হলো? ছেলেটা কিছু না?
উফফ ভাল লাগে না আর। ব্যাপারের গুরুত্ব কেউ বোঝে না। কোথায় একটা ফুলের মতন বাচ্চা ছেলের ভালো লাগা মন্দ লাগা। আর কোথায় আমার মতন একটা আধ দামরীর অপমান। ততক্ষনে মা আর রনি একে অপর কে দেখছে। বুঝে গেছে কি হয়েছে। আর আমি কি করতে চলেছি। আমি রেগেই আমি আন্টি কে বললাম,
- আমি আসছি । সন্ধ্যে বেলাতেই যখন কাঁদছিল , ফোন করতে পারতে আমাকে।
মনের মধ্যে থেকে সব ভাবনা উড়ে গেল আমার। যা হয় হবে। আমি ফোন টা রেখে উঠে পড়লাম। স্কার্ট টা পরেইছিলাম। শুধু টপ টা বদলে নিলাম। গলায় একটা ছোট ওড়না নিয়ে নিলাম। পার্স টা নিয়ে স্কুটির চাবি টা নিয়ে আমি ডাইনিং এ আসতেই মা আমার পথ আটকে দাঁড়ালো।
- কোথাও যাবি না তুই। ঠেকা নিয়ে রেখেছিস নাকি? কার না কার ছেলে। ও চলল রাত দুপুরে তার ছেলেকে দেখতে। তুই বল ওদের আমি যাব।
আমার মায়ের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না। কি বোঝাবো মা কে। বলতে গেলেই অনেক বাজে প্রসঙ্গ উঠে আসবে। রনিও উঠে এলো। রনির বউ বেচারী কিছু বুঝতে পারছে না। রনি আমাকে বলল।
- কি ছেলে মানুষি করছিস শিব? যাবি না তুই। রাকা একবার ও খবর নিয়েছে তোর?
মা কে কিছু বলতে পারছিলাম না। কিন্তু রনির উপরে রাগে ফেটে পরলাম আমি।
- রনি তুই ও এ কথা বলছিস? ও একটা বাচ্চা ছেলে। খায় নি সকাল থেকে। আর আমি এখানে বসে থাকব? আর রাকা খবর নেয় নি বলে ওর ছেলে তো কোন দোষ করে নি।
রনি টা ঝাড় খেয়ে শুধরে গেল। আমাকে আমতা আমতা করে বোঝানোর চেষ্টা করল,
- না, মানে কি করবি তুই? তুই বুঝতে পারছিস না তুই জড়িয়ে পরছিস? আবার অপমানিত হবি।
- হলে হব। তা বলে আমি এখন দূরে থাকতে পারব না। আর আমার তো রাকার সাথে দেখাও হয় নি। ও একটা চার বছরের বাচ্চা রনি। প্লিস মাকে বোঝা। আমি তো যাবই। তাতে আমাকে এ বাড়িতে ঢুকতে না দিলেও আমি যাব।
শেষের কথায় মা কেঁদে উঠল। আমাকে শুনিয়ে চিৎকার করে উঠল,
- হ্যাঁ এখন , রোজগার করছিস। অনায়াসে তুই এ বাড়িতে না ঢুকতে পারিস।
মা হাঁপাচ্ছে রাগে। আমিও চুপ। যাব তো আমি বটেই। কিছুক্ষন দেখি, বেশী ঝামেলা করলে ঝগড়া করেই যাব। বাপি দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আমাকে মানা ও করতে পারছে না আর মা কেও কিছু বলতে পারছে না। রনিও আমার এই মুর্তি দেখে একেবারে ব্যোমকে গেছে। মা খানিক চুপ থেকে, বেশ জোরের সাথেই বলল,
- বেশ আমিও যাব সাথে। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে মানা করলে আমি এখানে কুরুক্ষেত্র করব বলে দিলাম।
উফ। পারা যায় না আর মা কে নিয়ে। ওখানে গিয়ে ঠিক কিছু না কিছু বলবে। আমি বললাম মা কে,
- বেশ চল। গিয়ে দেখ তোমার মেয়ের রাকার উপরে কোন লোভ আর নেই। সেই দেখতেই তো তুমি যাচ্ছ? চল। কিন্তু বলে দিলাম, ওখানে গিয়ে, আঙ্কল আন্টি কে কোন অপমান জনক কিছু বললে, আমি ওখানে কুরুক্ষেত্র বাঁধাব। আমার একটা সম্মান আছে ও বাড়িতে।
মা শুনল না আমার কথা। মা কে নিয়ে আমি বেরোলাম বাড়ি থেকে। একটু খানি এগিয়েই স্পিড তুললাম আমি জোরে। আমার আর তর সইছে না। সন্ধ্যে বেলায় বললেই আমি তো চলে আসতাম।
মা ভয়ে ভয়ে আমাকে বলল পিছন থেকে,
- আস্তে চালাতে পারছিস না গাড়ী টা। তোর বাবাকে বলে তোকে গাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আরে বাবা, এটা গাড়ি, এরোপ্লেন নয়। আস্তে চালানা বাবা?
- উফ চুপ কর তো। আস্তেই তো চালাচ্ছি। ৪০ এর কমে এই গাড়ি চলে না। চুপ করে বসে থাক।
সব থেকে শর্ট কাট এ আমি রাকার বাড়িতে পৌছুলাম। গিয়ে দেখি কাকু কাকিমা বসে আছে দুয়ারে। আমি যেতেই দুজনাই উঠে দাঁড়াল। আমার মা কে আমার পিছনে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে দুজনাই। আমি সে সব আর না দেখে ঘরের মধ্যে ঢুকতে যাব, আর শিভ বিদ্যুৎ গতি তে ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরল একেবারে। আর সাথে ফুঁপিয়ে কান্না। চোখের জল সামলে আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। আমার মা অবাক হয়ে দেখছে, শিভ কে। আমাকে আঁকার করে ধরে শিভের কান্না কে। আমি ওকে ভোলাতে শুরু করলাম,
- কি হয়েছে? শিভ। এস এইচ আই ভি?
সে আমার ঘাড়ে মুখ টা কে গুঁজে ঘাড় নেড়ে জানান দিল আমি ঠিক স্পেলিং টা করেছি।
বোঝ! আমি বললাম,
- কান্না কেন? খাও নি কেন?
ওই ভাবেই আমার কাঁধে মুখ টা গুঁজে জবাব দিল
- আস নি কেন?
- ও এই জন্য খায় নি শিভ বাবু? তা আমাকে ডাকলেই হতো। আমি চলে আসতাম। আমি কি করে জানব আমাকে ছাড়া শিভ বাবু খাবে না কিছূ?
আমার কথাটা শুনে, মুখ টা তুলে বলল আমাকে,
- তোমাকে ডাকলেই তুমি আসতে? কই আমার মম কে কত ডেকেছি, আর তো আসে নি।
কথা টা শুনে আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। ওকে টেনে নিলাম আমার কাছে সজোরে। মাথায় হাত দিয়ে ওর মাথাটা আমার কাঁধে চেপে ধরলাম। মুখ টা ওর গলায় ঢুকিয়ে দিলাম আমি। হয়ত কান্না লোকালাম ওই ভাবে। বললাম,
- আমাকে ডাকলেই পেতে তুমি।
উত্তর দিলো না ও। ভাবে নি হয়ত, যে আমাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। সেটা জানলে হয়ত ও আগেই কাঁদত।বাচ্চাদের বিশ্বাস কত সহজে আসে আর কত সহজে মেনে নেয় ওরা। ওর মা কে ডীকে পায় নি বলে ও নিশ্চিন্ত ছিল আমাকেও ডাকলে ও পাবে না। কিন্তু আমাকে আরো আঁকার করে ধরল যেন। যেমন ভয় পেলে আমি মা কে ধরতাম আঁকার করে তেমন করে। ওর চোখের জলে ভিজে গেল আমার কাঁধ। বুঝলাম, আমার না আসা টা ওর মনে বেশ বড় রকমের প্রভাব ফেলছিল।মনে অনেক চিন্তা ছিল আমার, কিন্তু ওই আঁকার করে ধরার জন্য আমার কোন চিন্তা , কোন ভয় আর রইল না , সব চলে গেল। মনে হলো, এতো আঁকার করে তো আমাকে কেউ ধরে নি। এতো বিশ্বাস আমাকে কেউ করে নি। মা কে তার সন্তান মনে হয় এমনি ভাবেই আঁকড়ে ধরে। চোখের জল বেরিয়ে এলো আমার নিঃশব্দে। ধরা গলা তেই ওকে বললাম আমি,
- আচ্ছা আচ্ছা আর কাঁদে না। এবারে আমি তো এসে গেছি। এবারে দুটি খাবে? কি খাবে বল? আমি বানিয়ে দি?
মুখ টা আমার কাঁধের উপরে, আমার অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেই ঘাড় নাড়ল ও খাবে। আমি বললাম
- কি খাবে? দুটি ভাত একটু মাছ? আমি বেছে দি মাছ টা আর খাইয়ে দি?
আবার ঘাড় নারল শিভ ওই ভাবেই। আমার কথা শুনে আন্টি চলে গেল রান্না ঘরে। দুটি ভাত একটু আলু সিদ্দ আর মাছের ঝোল নিয়ে এলো আন্টি। আমি দুয়ারেই ওকে নিয়ে বসে পরলাম। আমার মা বসে আছে কিছু দুরেই। কোন কথা বলে নি। অবাক হয়ে দেখছিল মা আমাদের । আমি মায়ের দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছি। মায়ের চোখে রাগ বিরক্তি কিছুই নেই। শুধু বিস্ময়। আর হয়ত একটা ভালো লাগা।
আঙ্কল আর আন্টি বেশ অবাক মা আমার সাথে আসায়। বুঝতে পারছিলাম আমি সেটা। এখন কিন্তু সবাই হাসি মুখে রয়েছে। শিভের মুখে হাসি আর কেউ ই এখানে কিছু চাইছিল বলে আমার মনে হলো না। শুধু আঙ্কল আন্টি অবাক, যে মা ও আমার সাথে এসেছে। আমি শিভ কে খাওয়াতে খাওয়াতে বললাম আঙ্কল আর আন্টি কে।
- আসলে এতো রাতে একা তো বেরোই না আন্টি। তাই মা সাথে এলো।
- না না ঠিক করেছে। সত্যি তো আমাদের ভুল এতো রাতে খবর দেওয়া ঠিক হয় নি। আসলে সন্ধ্যে অব্দি ,ও ঠিক ছিল। তারপর থেকেই কেঁদে কেঁদে কেমন একটা করছিল। তাই ভয় পেলাম দিদি। কিছু মনে করবেন না
আমার মা মনে হয় তখনো আমাকে আর শিভ কে দেখছিল। আন্টির কথা টা শুনতে পেয়ে বলল
- না না ঠিক আছে। আরো আগে খবর দিলে ও দুপুরেই চলে আসতে পারত।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম মায়ের দিকে। উফ কি পাল্টিবাজ হয়েছে মা টা আমার। আমি আন্টির দিকে মুখের ইশারা তে বললাম একটা ডিম সিদ্দ নিয়ে আসতে। শিভ শুনতে পেলেই বলবে খাব না । মনে হলো ছেলেটা কিছু খায় নি সকাল থেকে। আর একটা ডিম সিদ্দ দেওয়াই যায়। শেষে ঠিক ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দেব। আন্টি উঠে গেল তাড়াতাড়ি। আন্টি ডিম সিদ্দ চাপিয়ে এসে বসলেন বাইরে।
বাপি ফোন করল মা কে। মা সব ঠিক আছে বলে দিল। দেরী হবে বাপি আর ভাই যেন খেয়ে নেয় সেটাও বলে দিল। আমি মা কে অবাক হয়ে দেখছি মাঝে মাঝেই। কি হলো মায়ের। একেবারে মা সারদা হয়ে গেলো যে। কে বলবে, আধ ঘন্টা আগে আমার সাথে অগ্নিশর্মা হয়ে কি ঝামেলা টাই না করল। মাছের কাঁটা বেছে আমি মুখে পুরে দিচ্ছি শিভের। ও খেয়ে নিচ্ছে। আমি মাঝে মাঝেই ওকে বলছি,
- জানো মা, আন্টি, আমাদের শিভের কি সুন্দর দাঁত। কি যে ভালো করে ও চিবোতে পারে তোমরা জানই না। হ্যাঁ ভালো চিবিয়ে খাও তো সোনা। মাছ খেলেই চিবিয়ে খেতে হয় কেমন?
মা উঠে এসে শিভের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
- দেখি? ওমা তাই তো! দেখি দেখি কেমন চিবিয়ে খায় আমাদের শিব?
চুপ করে ছিল শিভ। মা এর কথা টা শুনেই একেবারে তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার কোল থেকে তারপরে বলল,
- আমি এস এইচ আই ভি শিভ। শিব আমি নই ,এস এইচ আই বি , শিব হলো এইটা।
বলে আমার বুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আবার আমার কোলে মুখ লোকালো। আমরা হেসে উঠলাম। ভাত টা খাইয়ে ওর গা মুছিয়ে দিলাম। বাস ছেলে রেডি। এদিক ওদিক করতে লাগল ও। আমি ততক্ষনে ডিম টা ছাড়িয়ে, হালকা নুন দিয়ে রাখলাম। খেলতে খেলতে কাছে এলেই খাইয়ে দেব একটু একটু করে। ঠিক খেয়ে নেবে ।
আন্টি মা কে বলল
- দিদি দেরী হয়ে গেছে। ভাতে ভাত তুমি আর শিব খেয়ে নাও না এখানেই। বেশী কিছু করব না। ডিম আলু ভাতে, গরম ভাত আর মাছের ঝোল আছে। ভাগ করে হয়ে যাবে।
মা চিন্তায় পরে গেল। দেরী হবে মা বুঝতেই পারছে। আবার রাত ও হয়েছে। মা কিন্তু কিন্তু করতে লাগল। তাতে আন্টি বলল,
- আর না বোল না। তোমাকে আমি যাই খাওয়াই না কেন আমার লজ্জা নেই দিদি। বোস আমি ভাত আর আলু ভাতে চাপিয়ে দিয়ে আসি।
আমি আবার ও মা কে হা করে দেখলাম। পাল্টির শেষ সীমা তে পৌঁছে গেছে আমার মা। মনে মনে খারাপ লাগল। মা কে আমি ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু ওতো রেগে থাকা আমার মা কি করে পালটি খেল আমি এখনো বুঝতে পারছি না। মাঝে পুচকু টা কে আরেক বার ধরে ডিমের একটু খানি খাইয়ে দিলাম। কথা কম বলে খেলে বেশী। কখনো দুয়ারে ছুটছে তো কখন ঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে সেটা নিয়ে খেলছে।
ঠিক সেই সময়ে দরজা খুলে রাকা ঢুকল। আমার বুক টা ধক করে উঠল।কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ছয় বছর পরে ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আর আমি ওখান থেকে চলে যাবার রাস্তা খুঁজছি। একটা ভয় মনের মধ্যে। আবার হয়ত হিজড়া শুনব আমি। সেই ঘেন্না মাখানো চোখ আমার মনে আছে। আমি তাকালাম ও না ওর দিকে। মুখ দেখতে চাই না আমি ওর। কি জানি হয়ত নিজের মুখ দেখাতে চাই না আমি ওকে। আমি শিভ কে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। বাকী ডিম টা খাইয়ে, পিছন দিকের বারান্দায় বেরিয়ে, ছোট বেসিনে ওর মুখ টা ধুইয়ে, বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেললাম। ভাবলাম ঘুম পারিয়ে দি। তারপরে চলে যাব। কালকে সকালে ও কাঁদলে, তখন দেখা যাবে।
আমি যে ঘরে শিভ কে ঘুম পারাচ্ছি, সেই ঘর টা অন্ধকার। বাইরে ওরা আছে। আলো জ্বলছে। পর্দা সরানো। আমি দেখতে পাচ্ছি বাইরে টা । শিভ কে আমার কাছে নিয়ে পিঠে চাপড়াচ্ছি। ও চুপ্টি করে আমার বুকে মাথা টা গুঁজে ঘুমোনোর চেস্টা করছে। বাইরে রাকা কেও দেখছি আমি। মা কে দেখে অবাক হয়ে গেছে। বেশ ভালো রকম অবাক হয়ে গেছে ও। মানে এতো রাতে মা কেন সেই ব্যাপার টা ও বুঝতে পারছে না। অথবা আমরা যে আন্টির ফোন পেয়ে চলে আসব হয়ত ভাবে নি।
কিন্তু ও সামলে নিল। মা কে প্রনাম করল। মা বলল,
- থাক থাক। আর প্রনাম করতে হবে না।
- কেমন আছেন কাকিমা আপনি? কাকু ভালো আছে? গরিমা , পিনাকী এরা কেমন আছে সবাই।
আমার কথা জিজ্ঞাসা করল না। কিন্তু ওর নজর আমাকেই খুঁজছে। বার বার আমি যে ঘরে আছি সেই ঘরের দিকে নজর আসছে ওর। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। ও যখন বাড়িতে ঢুকেছিল তখন আমাকে বসে থাকতে দেখেছিল। কিন্তু ওকে দেখেই আমি শিভ কে নিয়ে ঘরে চলে এসেছিলাম। মা বলল,
- সবাই ভাল আছে বাবা। রোগা হয়ে গেছ বেশ।
- কাকিমা আপনি আমাকে তুই তুই বলতেন। এখন তুমি বলছেন।
- এখন কত বড় মানুষ তুমি। সাড়া ভারত জোড়া তোমার নাম। আর কি সেই ছোট টা আছ। যে বকার হলে বকব আবার আদর করে বসিয়ে দুটি খাইয়ে বাড়ি পাঠাবো?
মায়ের উপরে রাগে আমি ফেটে পরছি আমি বলতে গেলে। এতো কথা বলার তো কিছু নেই। আমার থেকেও বেশী মা রাকার উপরে রেগে ছিল। কিন্তু এখন দেখ? একেবারে গলে জল। আমার কিন্তু রাকা কে দেখে মনে হলো, অনেক অনেক ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে। একেবারও যেন কাহিল হয়ে পরেছে। ক্লান্ত শ্রান্ত মনে হচ্ছে ওকে। শিভ কে জড়িয়ে ধরলাম আমি। সেও কেমন আমার ভিতরে ঢুকে এল আমাকে জড়িয়ে ধরে। রাকা খানিক চুপ থেকে বলল,
- হুম। আমি নিজেই অনেক দূরে সরে গেছি তাই না কাকিমা?
পরক্ষনেই কথা ঘুরিয়ে দিল ও,
- মা কাকিমা কে খেতে দেবে না? রাত হয়েছে কিছু নিয়ে আসব? রনি কে ফোন করে দি তবে?
আন্টি তেড়ে গেল রাকার দিকে
- তুই বলবি তার পরে দেব নাকি? ওসব আমার চিন্তা। তুই তোর নিজের টা দেখ গা। মানুষ টা প্রথম বার বাড়ি এসেছে, তাকে কিনে খেতে দেব? বাড়িতে বানিয়ে দেব। তোকে অতো ভাবতে হবে না।
কাকিমার খেঁকানি তে চুপ করে গেল রাকা। বেচারী মা কে চিরকাল ই ভয় পায়। এখন তো আঁকড়ে ধরতে চাইছে মা কে আরো বেশী করে। কিন্তু আন্টি র কাছে এই সবের কোন মূল্য নেই আর। আন্টি কোন আশাই রাখেন না রাকার কাছে থেকে সেটা আমি জানি। আমাকে কথা বলতে হবে আন্টির সাথে। অনেক অনেক রাগ জমে ছিল, কিন্তু ওর এই মুখ টা দেখার পরে মনে হলো, আমার রাগ হয়ত ওকে আরো ক্ষত বিক্ষত করবে। কিন্তু তাতেও ও উদাসীন ই থাকবে। জীবনে কিছু পাবার আশা ও কোন দিন করে নি। আর হারিয়ে যাবার ভয় ও পায় নি। নিজের কষ্ট কাউকেই বলে না কোন দিন ও। ও এক প্রকার জীব। কিন্তু জীবনে সব পেয়েও না কিছু না থাকার যে একটা মুখ হয় সেটা ওকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম আজকে।
কিছু বলল না ও আন্টি কে আর। দুয়ারে বসে পড়ল। যে ঘরে আমি আছি সেই ঘরেই হয়ত ওর জামা কাপড় আছে। ও ঢুকতে পারছে না। আর একদিন ছিল, জোর করে আমার ঘরে ঢুকে পরত ও। মনে হলো হয়ত ও চেঞ্জ করবে। আমি বাইরে না গেলে ও আসতে পারবে না। আমি শিভ কে ধরে বুঝলাম ও ঘুমিয়ে গেছে। ওকে ভালো করে শুইয়ে, দু দিকে দুটো বালিশ দিয়ে আমি উঠে আসতে যাব দেখি আমার স্কার্টের দড়ি দুটো তে টান পরল। ভালো করে দেখলাম দেখি, আমার স্কার্টের দড়ি, ও হাতে পাকিয়ে ধরে রেখে দিয়েছে।
আমি দড়ি টা ওর হাত থেকে খুলে ফেলার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু টানাটানি তে ও উঠে পড়ল। আমি আবার পাশে শুয়ে পরলাম ওর। আচ্ছা ঝামেলা তে পরলাম আমি। এখন আমাকে না ছাড়লে তো আরো সমস্যা। ওদিকে বাইরে আন্টি খেতে দিয়েছে। আর আমি না বেরোলে রাকাও ঢুকতে পারছে না ঘরে। আমি শিভ কে কোলে নিয়েই বাইরে গেলাম। কোলে নিয়ে খেয়ে নেব। ততক্ষনে ওর ঘুম টাও ডিপ হয়ে যাবে আরও।
সবাই আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রাকা হা করে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমাকে দেখল ও প্রায় ছয় বছর বাদে। আমি মাঝে মাঝে টিভি তে দেখেছি। চোখ পরে গেছে আমার। অ্যাড ও দেয় দু একটা। কাজেই দেখব না বললেও মাঝে মাঝে চোখে পরে যাইয় বৈকি। চোখ সরছে না ওর আমার থেকে। আমি মা কে বললাম,
- আরে , সবাই ওমনি করে তাকিয়ে আছ কেন? উঠে আসার সময়ে দেখলাম, আমার স্কার্টের দড়ি নিজের হাতে পাকিয়ে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি খুলতে গেলাম ও উঠে পরল। আবার শুয়ে ঘুম পারিয়ে একেবারে ওকে নিয়েই উঠে এলাম। না হলে তোমরা সবাই বসে আছ না খেয়ে।
আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মা কে কি আমি অবাক করছি প্রতি মুহুর্তে? কে জানে? মা আমার উপরে আর কোন ভাবেই রেগে নেই সেটা বুঝতে পারছি। আমি শিভ কে কোলে নিয়ে বাঁ হাতে ওর মাথা টা রেখে খেতে লাগলাম। কেমন একটা লাগছিল। একটা আনন্দ মনে আবার একটা ভয়, যে এই ভাবে নিয়ে খাচ্ছি, ওতে ওর কোথাও ব্যথা লাগছে নাকি। কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আমি এক গ্রাস করে মুখে ভাত তুলছি, আর ওকে দেখছি। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি। এখন কেউ আর আমাকে দেখছে না। সবাই নিশ্চিন্ত। শিবের কাছে শিভ আছে। এই নিশ্চিন্ততা , এই ভরসা, এ যে কত বড় পাওয়া বলে বোঝানো যাবে না। খাওয়া হয়ে গেলে, আন্টি আমাকে জল এনে দিলেন, ওখানেই হাত ধুয়ে নিলাম আমি। কারন উঠে হাত ধুতে গেলে, ও ঘুম থেকে উঠে পরবে। এর পরে আসতে আসতে হাত থেকে খুলে নিতে হবে আমার স্কার্টের দড়ি টা।
খেয়ে দেয়ে ওকে শুইয়ে দিলাম। আন্টি শোয় ওর কাছে। আমি ওকে শুইয়ে দিলাম। পাশে শুয়ে আস্তে করে ওর হাত থেকে আমার স্কার্ট এর দড়ি টা খুলে নিয়ে উঠে আসতে যাব, এবারে আমার হাতের আঙ্গুল টা ধরল ও। চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি ঘুমোয় নি। বড় বড় চোখ দুটো পরিষ্কার ভাবে খোলা। আমার আঙ্গুল টা ধরে টানছে ওর দিকে।