06-02-2022, 11:14 AM
আগের পর্বের কিছু অংশ......
ভাবলাম ও সেই জন্যে ও অনেক দিন থেকে আমার সামনে গালি দেয় না? রাকা শেষ কথাটা বলে খাওয়া হয়ে যাওয়া কাপ টা, ছাদের মাঝে একটা পিলারে রেখে এগিয়ে গেল সামনে দিকে। আমি ওকে দেখছিলাম। আমি ছুটে গিয়ে লাফ মেরে ওর পিঠে চেপে পরলাম।
- আরে কি করছিস? নাম নাম।
আমি ধরে রেখেছিলাম ওকে। ছাড়ছিলাম না । কিন্তু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা আসছে। আমাদের দেখে মা থমকে গেল। পরক্ষনেই সামলে নিল। আমি মা কে দেখে নেমে পরলাম। রাকা বেচারী ভ্যাবলাম মতন তাকিয়ে রইল। মা একবার দেখে নিল চারিদিক। কেন কে জানে?
পর্ব আট
সেদিন রাতে খেয়ে দেয়ে, মা আমার ঘরে গিয়ে আমার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছিল। আমার বেশ ভাল লাগে মা চুলে তেল লাগিয়ে দিলে। আমি চুপ করে বসে ছিলাম। হরমোনাল ইফেক্ট এ মাথায় যন্ত্রণা হয় একটা সব সময়ে। হালকা, কিন্তু খেয়াল করলে দেখি, একটা ব্যাথা থাকেই।তাই বেশ করে টেনে টেনে চুলে তেল দিলে খুব আরাম পাই। আমি মাথাটা পিছনে হেলিয়ে ছিলাম। চোখ বুজে আসছিলো আরামে। চুল টা পিঠ অব্দি লম্বা ও হয়েছে। মা বলেছে পার্লার এ নিয়ে যাবে আমাকে। আমাকে আর বোন কে একসাথে। এই সময়ে মা বলল
- হ্যাঁ রে তুই রাকার পিঠে চেপে ঘুরছিলি কেন?
ভাবলাম তাতে আর কি আছে। কত তো ঘুরেছি ওর পিঠে চেপে। কিছু বললাম না মা কে। কিছু বললেই ঝাড় খাব, সকালে দেখেই বুঝেছিলাম, মা রেগে গেছিল। তার থেকে মা কি বলে শুনি আগে। সাড়া দিলাম না দেখে মা বলল
- তোর এখন ব্রেস্ট বড় হয়ে গেছে না? ও বেচারী অস্বস্তি তে পরে গেছিল। আর যেন না দেখি কোন দিন।
মায়ের কথাটার সাথেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিনানি ভাব বুঝতে পারলাম। সকালেই ওর ঘাড়ে ঝাঁপানোর সময়ে ব্যাথা টা পেয়েছিলাম আমি। আর এখন আমার ব্রেস্ট এ সামান্য টোকা লাগলেও মনে হয় প্রান টা বেড়িয়ে আসবে, এতো টন টন করে। আমি বেশী কিছু না বলে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম মা কে। আমি ভাবিনি এটা আগে। রাকা কে বলতেই হবে।
মা চলে গেলে আমি রাকা কে ফোন করলাম। বললাম
- কি রে পড়তে বসেছিলি?
- ধুর। সারা দিন এতো পড়েছি আমি, তারপরে ঘুম না এলেও আর পড়তে ভালো লাগছে না। তুই নিশ্চয়ই পড়বি এখন?
- হুম।
- পড়, আমাকে ফোন করলি কি করতে? আমাকে ও কি পড়তে বসতে হবে নাকি এখন? প্লিস ভাই আমাকে ছেড়ে দে আজকে। মাথা ঘুরছে আমার।
আমি ওর কথায় গুরুত্ব দিলাম না। ওকে বললাম
- আজকে মা আমাকে বকল।
- কেন? কি করেছিলি?
- তোর ঘাড়ে চেপেছিলাম বলে।
- তাতে বকলেন কেন কাকিমা?
- বলল আমার নাকি ব্রেস্ট বড় হয়ে গেছে। আর তুই ছেলে। বলে দিল কোন দিন যেন না দেখি এমনি।
খানিক চুপ করে রইল রাকা। তারপরে বলল
- ঠিক ই তো বলেছে। হুড়ুম করে ঘাড়ে চাপতে গেলি কেন?
- এই তুই থাম। বেশ করেছি। আমি তোকে কথাটা জানালাম। কোন মন্তব্য করতে বলিনি।
- আবার বলে? বেশ করেছি কি? ঠিক ই বলেছে কাকিমা। খুব বড় হয়েছে তোর ব্রেস্ট।
- চুপ কর। ফালতু কথা বললে কিন্তু লাথি জুটবে।
- রক্ষে কর। ফুটবল খেলা পায়ের লাথি খেলে আর দেখতে হবে না। এখন জানিস আমি মারতে পারব না , তোকে খিস্তী দিতে পারব না। মারবি বৈকি।
- ঠিক হয়েছে।
- যাক এবারে ঘুমো। ভাই কালকেও কি পড়তে যেতে হবে?
- হ্যাঁ অবশ্যই।
- তুই তো নিজের পড়া পড়িস। আমার দিকে তাকাস ও না। আমাকে বলে দিস কি পড়তে হবে, আমি বাড়িতে পড়ে নেব। তোর সামনে পড়ার কি দরকার?
- না না তুই পড়বি না আমি জানি বাড়িতে। চুপচাপ এখানে চলে আসবি। মনে থাকে যেন। ভুল যেন না হয়।
- হিটলার সালা।
আমি মুখ টা টিপে হেসে ফেললাম। ওকে বললাম
- ওই ,শোন
- কি
- তুই না টেন্থ এর পরে কলকাতা যাবি।
- কোন দুঃখে
- কোনো দুঃখে না। ওখানে ফুটবল কোচিং এ ভর্তি হবি।
- কে বলল?
খেকিয়ে গেলাম আমি
- কে আবার বলবে? আমি বলছি তো।
- বালের কথা বলিস না তো।
- এই খিস্তী মারলি?
- সরি সরি
- না না মেরেই যখন দিয়েছিস তখন অন্যায় করেছিস। আমি আন্টি কে বলে দেব।
- আবার?
- তবে আমার কথা শোন
- কি কথা? কলকাতায় খেলতে যাবার কথা?
- হুম
- যা ভাগ।
- প্লিস
- কি প্লিস। ফোন রাখ।
- প্লিস
- আরে? কোন প্লিস না
- প্লিস প্লিস প্লিস
- আজব ঝামেলা তো। জোর করে পড়াশোনা করাস, ঠিক আছে। কিন্তু এই রকম অত্যাচার করবি না কিন্তু।
- প্লিস প্লিস
- আচ্ছা আচ্ছা
চুড়ান্ত বিরক্ত হয়ে শেষের কথা টা বলল রাকা। আমি তাতেই খুশী হয়ে বললাম
- ঠিক তো? কথা দিলি কিন্তু
- উফফফ। হ্যাঁ রে ভাই। তুই ঘুমো, পড় যা খুশী কর, আমাকে মুক্তি দে। আমাকে ঘুমোতে দে। দয়া কর আমাকে।
- আচ্ছা আচ্ছা ঘুমো। অনেক পড়েছিস সারাদিনে। গুড নাইট। কালকে চলে আসবি। মনে থাকবে?
- হুম গুড নাইট।
রাকা কে এখন বেশ লাগে আমার। না মানে আগেও ভালো লাগত। কিন্তু এখন বেশ অন্য রকম ভালো লাগা। জানিনা হয়ত ইস্ট্রোজেনের প্রভাব। ডক্টর বলেছিল, ছেলেদের ভাল লাগতে পারে। ছেলেদের গন্ধ ভাল লাগতে পারে। আমি পড়তে বসে পড়লাম। শরীরে লাখো সমস্যা কিন্তু মন টা আমার ভালো হয়ে আছে। আমাকে খুব ভালো নাম্বার পেতেই হবে।
পাশ করলাম অনেক নাম্বার পেয়ে। প্রথম হলাম কলেজ থেকে আর রুদ্রপুর থেকে। রাকাও পাশ করল প্রায় ৮৩ পারসেন্ট পেয়ে। আমার থেকেও রাকার নাম্বার এ আমার বেশী আনন্দ হয়েছিল। আমাদের ক্লাসের তথাকথিত ভালো ছেলেরাও রাকার নাম্বার দেখে বেশ অবাক। ততদিনে আমি বেশ ডাকসাইটে সুন্দরী হয়ে গেছি। আমার কনফিডেন্স তখন তুঙ্গে। পাশ করার পরেই আমরা ভর্তি হয়ে গেলাম কলেজে আবার। আমি সায়েন্স নিলাম। আর রাকা নিল কমার্স। আমি জোর করিনি। জানতাম আমি এবারে ওকে কলকাতায় পাঠাব যে করেই হোক। খেলতে গেলে বেশী পড়ার চাপ দিলে চলবে না ওকে। তাই কমার্স এ আপত্তি করিনি। না হলে সায়েন্স তো নেওয়া করাতাম ই আমি।
রাস্তা ঘাটে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা চলে। কিন্তু একবার যে আমাকে সামনা সামনি দেখে সে আর কোন কথা বলতে পারে না। আমার সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। তাই আজকে আমি দাগ হীন এক মেয়ে। এতো দিন সময় লেগেছে রুদ্র পুরের সবার আমাকে চিনতে। আর যেহেতু আমি নিজের ইচ্ছেয় মেয়ের জীবন বেছে নিয়েছি, আমি চেস্টা করি সব সময়েই সফট থাকতে। তাতে যে আমাকে পছন্দ করে তার সাথেও আর যে করে না তার সাথেও। তাই ধীরে ধীরে আমার ও একটা পরিচিতি তৈরী হচ্ছিল রুদ্রপুরে।
একদিন আমি আর রাকা বসে আছি তিন মাথার মোড়ে। আমরা সেদিনে খেতেই গেছিলাম। আর আমাদের হাফ প্লেটে হয় না। ফুল প্লেট লাগে দুজনের ই। টেন্থ পাশ করার পরেই আমার পকেট মানি বেরে গেছিল বেশ কিছুটা। কাজেই সপ্তাহে দু তিন দিন বিকালে দু বন্ধু তে কিছু খাওয়া টা বড় ব্যাপার ছিল না। আমরা কথা বলছিলাম রাকার কলকাতা যাওয়া নিয়ে। রাকা যথারীতি বিরক্ত আমার উপরে। আমি ঠিক করে নিয়েছি, তুই বিরক্ত হ, রাগ কর, আমি কিচ্ছু শুনব না। ওদের বাড়ি গিয়ে আঙ্কল আন্টি দুজনাকেই পটিয়ে এসেছি। ওরা ওদিক থেকে প্রেশার দেয় আর আমি দেখা হলেই প্রেসার দি। বড় মামার সাথে কথা বলে , এ টি কে র ট্রেনিং সেন্টার এ ট্রায়াল এর ব্যবস্থা করেছি আমি। ওর নাম আর আই ডি চলে এসেছে আমার কাছে। বলে না যার বিয়ে তার খোঁজ নেই , পারা পড়শীর ঘুম নেই। আমি তো ওকে, পাঠাবই। সব মিলিয়ে দেড় লাখ লাগবে। না মানে যদি ও ট্রায়াল এ পাশ করতে পারে তবে দেড় লাখ লাগবে দু বছরের ওয়ার্ক শপ এ। সেখান থেকে কোন ভালো জায়গায় খেলতে পেলে আর কে দেখে।
রোজ সকালেই এখন আমি আর ও দৌড়তে বের হই। আট দশ কিমি দৌড়ই দুজনে মিলে। ওর জন্যেই যাই। তারপরে বাপি কে বলে, বাপির বন্ধুর ক্লাব এ প্র্যাক্টিস করার ব্যবস্থা করেছি। ও যায় ওখানে, ঘন্টা তিনেক প্র্যাক্টিস করে। তারপরে দুপুরে খেয়ে দেয়ে আবার যায় ও প্র্যাক্টিস করতে। আমার কলেজ শেষ হলে আমিও চলে যাই গ্রাউন্ড এ। সেখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে হয় বাড়ি যাই না হলে এখানে এসে গল্প করি। ওকে ছাড়ি না। ছাড়লেই প্রায়ক্টিস এ ঢিল দেবে। ট্রায়াল এ ওকে পাশ হতেই হবে। কিন্তু ও বড্ড উদাসীন। হলে হবে না হলে আরো ভাল হবে, গোছের ব্যাপার ওর কাছে। সেটাই আমার ভয় লাগে।
সেদিনেও সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমি বসে আছি। আমি একটা লং ফ্রক পরে আছি। চুল টা খোলা। মাথায় একটা লাল হেয়ার ব্যান্ড। আমি ওর স্কুটার এ বসে আর ও দাঁড়িয়ে গল্প করছি। ও সেই ঘ্যান ঘ্যান করছে।
- ছেড়ে দে ভাই। আমি যাব না কোথাও। কেন এমন শত্রুতা করছিস তুই আমার সাথে?
নানান কথা বলছে। বেশী টাই আমার হিটলারি সংক্রান্ত নানান কথা। অনুযোগ। আমি ওর দিকে কটমট করে তাকাতেই, রেগে চলে গেল অর্ডার টা আনতে। আমি ভেবে যাচ্ছি দেড় লাখ টাকা জোগার হবে কোথা থেকে। আমার কাছে ২১ হাজার জমে ছিল। ভাঁড়ে। আমি সেটা ভেঙ্গে টাকা করিয়ে নিয়েছি। সেটা এখন পঞ্চাশ হাজার। এটা আমাকে বাপি করে দিয়েছে। বাপি আমাকে সেই কোন ছোট বেলায় বলেছিল যে আমি যা জমাবো বাপি সেটা ডবল করে দেবে আমাকে। বাপি কে বলতেই বাপি আমার কথা মেনে নিয়েছিল। মা শুধু বলেছিল, ২১ টা ৪২ হবে। আর আট দিলেই তো মেয়ের আমার পঞ্চাশ হয়ে যায়। বাপি হেসে তাতেই রাজি হয়ে গেছিল।
তাহলে আমার কাছে পঞ্চাশ আছে। রাকার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে পঞ্চাশ ব্যবস্থা করেছি। আন্টি নিজের যা গয়না ছিল সেগুলো বিক্রী করার ব্যবস্থা করেই পঞ্চাশ হয়েছে। করুক, ওদের ছেলে। তবে এখন না, রাকা চান্স পেলে বিক্রী করতে হবে। তাহলে, এক লাখ হচ্ছে। বাকী টা পাই কোথা থেকে? সেই সময়ে একটা বচসার আওয়াজে দেখি, রাকা আর রনি প্রায় হাতাহাতির উপক্রম।
উফফ আর পারি না এদের কে নিয়ে। রনি আবার কোথা থেকে এল। এদের মাঝেও একদুবার মারপিট হয়েছিল। ছুটে গেলাম আমি। রনি কে বললাম,
- ভাই প্লিস। ভুলে যা শত্রুতা। দেখ রাকা কোন দিন ও তোর সাথে কোন ঝামেলা করবে না আমি কথা দিলাম
রাকা তেড়ে এলো আমার দিকে
- তুই কেন বলছিস এই কথা। আমাকে ল্যাজে পা দিলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না।
আমি রেগে বললাম রাকাকে
- আমি কথা বলছি তো। তুই থাম। কেন ঝগড়া বাড়াচ্ছিস?
রাকা চুপ করে গেল। আমি রনির দিকে ফিরে বললাম
- প্লিস রনি। ভুলে যা, যা হয়েছে। প্লিস বন্ধুত্ব করে নে ভাই।
রনি আমার দিকে হা করে দেখছে। চোখে প্রশংসা ঝড়ে পড়ছে ওর। আমার কেমন একটা লাগে ইদানীং এ সবে। আমাকে ইম্প্রেস করতে,ঠান্ডা হয়ে বলল
- প্রথমত আপনি মেয়ে। আপনাকে আমি চিনি না। আমাকে তুই তুই বলছেন কেন আপনি?
- আমাকে চিনতে পারলি না? আমি শিবানী। মানে ত্র্যম্বক ছিলাম। এখন শিবানী হয়েছি।
সবাই যাতে শুনতে না পায়, চিবিয়ে চিবিয়ে, ইতস্তত করে কথা গুল আমি রনি কে বললাম। রনি খানিক, ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
- আরে!!! কি সুন্দরী তুই মাইরি? একেবারে ঝাক্কাস।
বোঝ। ছেলেরা এই রকম হয় জানা ছিল না। এতোক্ষন রেগে ছিল। যেই সুন্দরী দেখল রাগ জল। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ গর্ব বোধ করলাম আমি। কিন্তু আমাকে ঝাক্কাস বলায় রাকা গেল রেগে। রুখে এলো একেবারে।
- তোর সাহস কি করে হয় শিবের সাথে এই নোংরা টোনে কথা বলার?
উফ আবার শুরু করল এই ছেলেটা। কি করে যে সাম্লাই কে জানে বাবা। রনিও রুখে এল,
- গান্ডু, আমি, কি বলেছি?
তারপরে রনি আমার দিকে চেয়ে নিল একবার। মানে আমার সামনে গান্ডু বললে, আমার ইম্প্রেশন ওর উপরে কেমন হবে সেটা ভেবে একটু গুটিয়ে গেল । তারপরে আমতা আমতা করে বলল,
- না মানে আমি তো কিছু খারাপ বলিনি। - কি সুন্দরী এটা খারাপ কথা না তাই না?
- কিন্তু আরেক টা যেটা বললি? সেটা?
রাকার তেড়েফুঁড়ে উত্তরে আমি রাকার হাত টা চেপে ধরলাম, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম,
- ঝাক্কাস কথা টাও খারাপ নয়। তুই চুপ কর দয়া করে।
রাকা চুপ করে গেল। আমি বললাম রনি কে,
- ব্যস হয়ে গেল। মিটমাট কেমন?
- না মিটমাট হয় নি এখনো
উফ আবার কি হলো বলতে যাচ্ছি দেখলাম, রনি স্যালুট করার ভঙ্গী নিয়ে রাকার দিকে তাকিয়ে। আমি ভাবছি এ আবার কি নাটক? তখন রনি আমার দিকে ফিরে বলল,
- দ্যাখ ত্র্যম্বক, না না শিবানী, তুই বললি বলে নয়, কিন্তু আজকে বুঝলাম, রাকা এতো দিন কেন তোর সাথে থাকত। তোকে গার্ড দিত। তোর খারাপ সময়ে তোকে নিয়েই ও থাকত। দ্যাখ, রনি খারাপ কাজ করতে পারে, কিন্তু রনি ছেলে ভাল।
তারপরে আবার রাকার দিকে ফিরে স্যালুট এর ভঙ্গী তে পা ঠুকে নিল একবার তারপরে বলল,
- স্যালুট ভাই তোকে । আমি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালাম। তুই ভাব কি করবি।
আমি তখন রাকার হাতে চিমটি কেটে ধরেছি। ফিস ফিস করে বলছি
- যাআআআ।
দুজনায় গলাগলি করে নিলো। আমিও হেসে বাঁচি না। নাটকে দুটোই ভাল এক্টিং করতে পারবে। যাই হোক সেই দিনের খাবারের পয়সা রনি ই দিল। প্রথম বার আমি রাকা ছাড়া কোন ছেলের উপরে ইম্প্রেসড হলাম। রনির সাথে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু হলো। এখনো রনি আমাকে পাগলের মতন ভালোবাসে। আমি জানিনা রনি সত্যি করেই আমাকে চায় কিনা। নাকি আমাকে শুধুই ভালবাসে। যাই হোক আমার কাছে ও আমার জীবনের সম্পদ।
সেদিন রাতে ভাবছিলাম, আমার তো কিছু নেই আর। যা ছিল সেটা দিয়েও হবে না। ভাবলাম মা কে জপাতে হবে। রান্না ঘরে মায়ের কাছে গেলাম। ইদানীং যাই। এখন পড়ার চাপ কম। মা কে হেল্প করি। সেই কোন ছোট বেলার ইচ্ছে আমার এখন মিটছে। মা ও কিছু বলে না বরং শিখিয়ে দেয়। রুটি করা, রুটি বেলা। এখন ও আমি প্রপার গোল করতে পারি না রুটি কিন্তু অনেকটাই হয়। আমি করেছি বললে বাপিও বেশ উৎসাহ নিয়ে খায়। আমার ভাই বোনেরা তো অজ্ঞান আমার রান্নায়। সবাই উৎসাহ দেয় এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
সেই রকম ই রাতে আমি আটা মাখছি। মা বলে দিচ্ছে,
- হয় নি তো, অল্প অল্প করে জল দে। মাখ। বুঝতে পারবি টান টা। আটায় টান না পেলে আরেক টু জল দে আবার মাখ।
আমি সেই ভাবেই চেস্টা করছি। একটা সময়ে ব্যাপার টা কে বাগে আনলাম। তারপরে মাকে বললাম,
- ও মা একটা কথা বলব?
- কি?
মা তরকারি সাঁতলাচ্ছিল। বললাম, কিছু টাকা আমাকে আরো দেবে?
- মানে? কি করবি?
- আগে বল দেবে কিনা তাহলে বলব।
- না সে দেবার চেস্টা করতে পারি। কারন আমার ও তিন চারটে আর ডি মাচুওর করেছে। তোর বাবার কাছেই আছে। চাইলেই দিয়ে দেবে। কিন্তু কেন?
মনে মনে ভাবলাম বাহ মা তো বেশ ভালো ভাবেই নিল ব্যাপার টা। বললাম মা কে পুরো ব্যাপার টা। শুধু বললাম লাগবে এক লাখ। আমি দেব তিরিশ, রাকার বাবা ষাট। দশ কম পরছে। দশ পেলেও অনেক। মানে যা পাওয়া যায় আরকি। মা শুনে কাজ করতে করতেই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কি মানে বুঝলাম না আমি সেটার। বলল,
- ঠিক আছে। কবে লাগবে?
- দেরী আছে। আগে ওর ট্রায়াল টা হোক। পাশ করুক।
- তুই ই মামা কে বলেছিলি না ওর কথা?
মাথা নামিয়ে আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মা কিছু বলল না।
দুদিন পরে আবার মোড়ের মাথায় বসে আছি। সেদিনে অবশ্য আমি আকাশী সালোয়ার পরেছিলাম। পনিটেল করে রেখেছিলাম চুল টা। একটা সাদা গার্ডার ছিল আটকানো চুলে। রনি এলো। সেদিনে আমি অর্ডার করেছিলাম। তিন প্লেট চিকেন চাউমিন। দু দিন পরেই রাকার ট্রায়াল ছিল। আমার মাথায় চিন্তার আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে ট্রায়ালে রাকা সিলেক্টেড হলে, পুরো টা একসাথে না দিলেও হবে। তিনমাস পরে পঞ্চাশ দিলেও চলবে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম জোগাড় করে রাখলে মন্দ কী।
চুপ করে ভাবছিলাম আমি। রনি আর রাকা খানিক কথা বলেই আমার কাছে এলো। দুজনাই তাই। একটু সময় নিয়ে ভাবব। সেটার অবকাশ দেবে না। সারাক্ষন গায়ে গায়ে লেগে না থাকলে হবে না। রনি এসে বলল,
- কি ভাবছিস অতো।
- ছাড় ওর কথা। মারাদোনা করবে আমাকে
রাকার কথায় মাথা গরম হয়ে গেলো আমার। সারা দিলাম না। রনি আবার বলল আমার দিকে তাকিয়ে,
- ভাই বুঝলাম না। কি হয়েছে বলবি।
দেখলাম উপায় নেই। বললাম ওকে সমস্যা টা। আবার মুখ নামিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বড় মামা কে বলব? নাকি আন্টি কে বলব, যে তুমি গয়না বিক্রী কর আমি ছাড়িয়ে আনব, চাকরি পেলে। মা কে বলা যাবে না। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। নাহ আন্টি কেই বলি। ওদের ছেলে নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন আন্টি। খানিক বাদে রনি বলল,
- ভাই উপায় পেয়েছি।
আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম
- কি বল বল
- আমার খাবারের দোকানের হোটেল করব বলে কিছু টাকা আছে। যা আছে তাতে হবে না এখন দোকান। তোকে দি চল্লিশ?
রাকা সটান না করে দিল। আমরা সবাই জানি, রুদ্র পুরে একটা খাবারের দোকান মানে হোটেল করার স্বপ্ন ওর অনেক পুরোন। আমিও রাজী হলাম না। আমাদের মুখ দেখে বুঝে গেল আমরা চাইছি না। বলল,
- ও আমি তবে কোন বন্ধুই নই। শিব দিতে পারে ষাট হাজার টাকা। আর আমি পারি না।
- না তুই পারিস। একশবার পারিস
- তবে নিচ্ছিস না কেন? আরে ভাই আমি কি এমনি এমনি দিচ্ছি নাকি? তুই ট্রায়াল ক্লিয়ার করতে পারলে তো হয়েই গেল, সারা ভারত থেকে একশ জনের একজন তুই। আমি তো ইনভেস্ট করছি। পরে ফেরত দিস।
- এসব কিছুর কি ঠিক আছে? ধর পারলাম না কিছু করতে। বল?
- আমি কিচ্ছু জানিনা। ব্যস হয়ে গেছে। তুই মহানন্দে যা। খুব ভালো করে ট্রায়াল দে। হয়ে গেলে যখন তুই যাবি ক্যাম্প এ আমিও যাব তোর সাথে টাকা নিয়ে। তোর গার্জেন হয়ে বুঝলি?
ওদের কথা শুনছিলাম আমি। আমি আবারো ইনপ্রেসড হলাম রনির উপরে। সত্যি ও ভালো ছেলে। এমন খোলা মন আমি রাকার ছাড়া কারোর হয় ভাবতেও পারিনি। আমি কিন্তু এতো খোলা মনের নই। আমার কাছে ভালবাসার ভালো লাগার মানুষ গুলো অনেক আগে জায়গা পায়। রাকা বা রনির মতন সবাই কে আপন করে নিতে আমি পারি না ।
যেদিন রাকা ট্রেনে চাপল আমি আর রনি গেছিলাম ওকে তুলে দিতে। মনের মধ্যে একটা ভয় আমার। ও নিশ্চই পারবে। এই ভরসার উল্টো দিকে, যদি না পারে, এই ভয় টাও কাজ করছে। রাকা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এ মাসের হাত খরচা টা এনেছিলাম, ওকে দেব বলে। এতো দূর যাবে। হাতে টাকা না থাকলে হয় নাকি? আমি ওর পাশে বসে, ওর হাতে টাকা টা গুঁজে দিলাম। ও সেটা দেখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
- এটা কেন?
- রাখ কাছে। পরশু ট্রায়াল, আগের দিনে ভালো মন্দ খাবি। গায়ে জোর লাগবে না?
আমার দিকে চেয়েই রইল রাকা। জানিনা কি ভাবছিল ও। তারপরে ঝপ করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সজোরে। আমাকে আগেও ও জড়িয়ে ধরেছে আগে। কিন্তু এটা যেন অন্য রকম ছিল। আমার বুক টা ওর বুকের সাথে লেপ্টে গেল। একটা টনটনানি ব্যাথা বুকে। আমার কাঁধে মুখ টা গুঁজে আছে ও। আমার কানে ওর নিঃশ্বাস পরছে। ওর নিঃশ্বাসের হাওয়ায় আমার ঘাড়ের চুল উড়ছে। কেমন একটা শিরশির করছে ওই সময়ে আমার শরীর টা। আমিও খুব ইতস্তত করে আমার দুটো হাত ওর পিঠে রাখলাম। পিছনে দেখছি, সবাই আমাদের দেখছে। জানি সবাই ভাবছে আমরা প্রেম করছি। ভাবুক। সেটা তো সত্যি নয়। আমি কিন্তু ছাড়লাম না ওকে।
পিছন থেকে রনি ফিস ফিস করে বলল,
- ভাল বাসাবাসি হয়ে গেলে এবারে নেমে চল শিব। ট্রেন ছেড়ে দেবে।
রনির কথায় আমাকে ছেড়ে দিলো রাকা। আমিও ছেড়ে দিলাম। নেমে এলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। মিলিয়ে গেল। ও আবার আসবে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় টা লাগল যে, যদি ও ট্রায়ালে পাশ করে যায় তাহলে দু বছর ও আসবে না। আসবে হয়ত মাঝে মাঝে, কিন্তু এই যে রোজ দেখতে পাই দুজন দুজন কে সেটা তো হবে না। এতদিন এতো করে টাকা জোগাড় করলাম। যে ওকে পেতেই হবে চান্স। কিন্তু এটা তো ভাবিনি, গত ছয় বছরের এমন অছেদ্য বন্ধুত্ব আমাকে ওকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা এই ভাবে দেবে। এতদিনে কেউ রাগারাগি করলে, একে অপরের বাড়ি চলে যেতাম। এখন তো সেটার ও উপায় নেই। মন টা ভয়ঙ্কর উদাস ছিল আমার।
ভাবলাম ও সেই জন্যে ও অনেক দিন থেকে আমার সামনে গালি দেয় না? রাকা শেষ কথাটা বলে খাওয়া হয়ে যাওয়া কাপ টা, ছাদের মাঝে একটা পিলারে রেখে এগিয়ে গেল সামনে দিকে। আমি ওকে দেখছিলাম। আমি ছুটে গিয়ে লাফ মেরে ওর পিঠে চেপে পরলাম।
- আরে কি করছিস? নাম নাম।
আমি ধরে রেখেছিলাম ওকে। ছাড়ছিলাম না । কিন্তু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা আসছে। আমাদের দেখে মা থমকে গেল। পরক্ষনেই সামলে নিল। আমি মা কে দেখে নেমে পরলাম। রাকা বেচারী ভ্যাবলাম মতন তাকিয়ে রইল। মা একবার দেখে নিল চারিদিক। কেন কে জানে?
পর্ব আট
সেদিন রাতে খেয়ে দেয়ে, মা আমার ঘরে গিয়ে আমার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছিল। আমার বেশ ভাল লাগে মা চুলে তেল লাগিয়ে দিলে। আমি চুপ করে বসে ছিলাম। হরমোনাল ইফেক্ট এ মাথায় যন্ত্রণা হয় একটা সব সময়ে। হালকা, কিন্তু খেয়াল করলে দেখি, একটা ব্যাথা থাকেই।তাই বেশ করে টেনে টেনে চুলে তেল দিলে খুব আরাম পাই। আমি মাথাটা পিছনে হেলিয়ে ছিলাম। চোখ বুজে আসছিলো আরামে। চুল টা পিঠ অব্দি লম্বা ও হয়েছে। মা বলেছে পার্লার এ নিয়ে যাবে আমাকে। আমাকে আর বোন কে একসাথে। এই সময়ে মা বলল
- হ্যাঁ রে তুই রাকার পিঠে চেপে ঘুরছিলি কেন?
ভাবলাম তাতে আর কি আছে। কত তো ঘুরেছি ওর পিঠে চেপে। কিছু বললাম না মা কে। কিছু বললেই ঝাড় খাব, সকালে দেখেই বুঝেছিলাম, মা রেগে গেছিল। তার থেকে মা কি বলে শুনি আগে। সাড়া দিলাম না দেখে মা বলল
- তোর এখন ব্রেস্ট বড় হয়ে গেছে না? ও বেচারী অস্বস্তি তে পরে গেছিল। আর যেন না দেখি কোন দিন।
মায়ের কথাটার সাথেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিনানি ভাব বুঝতে পারলাম। সকালেই ওর ঘাড়ে ঝাঁপানোর সময়ে ব্যাথা টা পেয়েছিলাম আমি। আর এখন আমার ব্রেস্ট এ সামান্য টোকা লাগলেও মনে হয় প্রান টা বেড়িয়ে আসবে, এতো টন টন করে। আমি বেশী কিছু না বলে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম মা কে। আমি ভাবিনি এটা আগে। রাকা কে বলতেই হবে।
মা চলে গেলে আমি রাকা কে ফোন করলাম। বললাম
- কি রে পড়তে বসেছিলি?
- ধুর। সারা দিন এতো পড়েছি আমি, তারপরে ঘুম না এলেও আর পড়তে ভালো লাগছে না। তুই নিশ্চয়ই পড়বি এখন?
- হুম।
- পড়, আমাকে ফোন করলি কি করতে? আমাকে ও কি পড়তে বসতে হবে নাকি এখন? প্লিস ভাই আমাকে ছেড়ে দে আজকে। মাথা ঘুরছে আমার।
আমি ওর কথায় গুরুত্ব দিলাম না। ওকে বললাম
- আজকে মা আমাকে বকল।
- কেন? কি করেছিলি?
- তোর ঘাড়ে চেপেছিলাম বলে।
- তাতে বকলেন কেন কাকিমা?
- বলল আমার নাকি ব্রেস্ট বড় হয়ে গেছে। আর তুই ছেলে। বলে দিল কোন দিন যেন না দেখি এমনি।
খানিক চুপ করে রইল রাকা। তারপরে বলল
- ঠিক ই তো বলেছে। হুড়ুম করে ঘাড়ে চাপতে গেলি কেন?
- এই তুই থাম। বেশ করেছি। আমি তোকে কথাটা জানালাম। কোন মন্তব্য করতে বলিনি।
- আবার বলে? বেশ করেছি কি? ঠিক ই বলেছে কাকিমা। খুব বড় হয়েছে তোর ব্রেস্ট।
- চুপ কর। ফালতু কথা বললে কিন্তু লাথি জুটবে।
- রক্ষে কর। ফুটবল খেলা পায়ের লাথি খেলে আর দেখতে হবে না। এখন জানিস আমি মারতে পারব না , তোকে খিস্তী দিতে পারব না। মারবি বৈকি।
- ঠিক হয়েছে।
- যাক এবারে ঘুমো। ভাই কালকেও কি পড়তে যেতে হবে?
- হ্যাঁ অবশ্যই।
- তুই তো নিজের পড়া পড়িস। আমার দিকে তাকাস ও না। আমাকে বলে দিস কি পড়তে হবে, আমি বাড়িতে পড়ে নেব। তোর সামনে পড়ার কি দরকার?
- না না তুই পড়বি না আমি জানি বাড়িতে। চুপচাপ এখানে চলে আসবি। মনে থাকে যেন। ভুল যেন না হয়।
- হিটলার সালা।
আমি মুখ টা টিপে হেসে ফেললাম। ওকে বললাম
- ওই ,শোন
- কি
- তুই না টেন্থ এর পরে কলকাতা যাবি।
- কোন দুঃখে
- কোনো দুঃখে না। ওখানে ফুটবল কোচিং এ ভর্তি হবি।
- কে বলল?
খেকিয়ে গেলাম আমি
- কে আবার বলবে? আমি বলছি তো।
- বালের কথা বলিস না তো।
- এই খিস্তী মারলি?
- সরি সরি
- না না মেরেই যখন দিয়েছিস তখন অন্যায় করেছিস। আমি আন্টি কে বলে দেব।
- আবার?
- তবে আমার কথা শোন
- কি কথা? কলকাতায় খেলতে যাবার কথা?
- হুম
- যা ভাগ।
- প্লিস
- কি প্লিস। ফোন রাখ।
- প্লিস
- আরে? কোন প্লিস না
- প্লিস প্লিস প্লিস
- আজব ঝামেলা তো। জোর করে পড়াশোনা করাস, ঠিক আছে। কিন্তু এই রকম অত্যাচার করবি না কিন্তু।
- প্লিস প্লিস
- আচ্ছা আচ্ছা
চুড়ান্ত বিরক্ত হয়ে শেষের কথা টা বলল রাকা। আমি তাতেই খুশী হয়ে বললাম
- ঠিক তো? কথা দিলি কিন্তু
- উফফফ। হ্যাঁ রে ভাই। তুই ঘুমো, পড় যা খুশী কর, আমাকে মুক্তি দে। আমাকে ঘুমোতে দে। দয়া কর আমাকে।
- আচ্ছা আচ্ছা ঘুমো। অনেক পড়েছিস সারাদিনে। গুড নাইট। কালকে চলে আসবি। মনে থাকবে?
- হুম গুড নাইট।
রাকা কে এখন বেশ লাগে আমার। না মানে আগেও ভালো লাগত। কিন্তু এখন বেশ অন্য রকম ভালো লাগা। জানিনা হয়ত ইস্ট্রোজেনের প্রভাব। ডক্টর বলেছিল, ছেলেদের ভাল লাগতে পারে। ছেলেদের গন্ধ ভাল লাগতে পারে। আমি পড়তে বসে পড়লাম। শরীরে লাখো সমস্যা কিন্তু মন টা আমার ভালো হয়ে আছে। আমাকে খুব ভালো নাম্বার পেতেই হবে।
পাশ করলাম অনেক নাম্বার পেয়ে। প্রথম হলাম কলেজ থেকে আর রুদ্রপুর থেকে। রাকাও পাশ করল প্রায় ৮৩ পারসেন্ট পেয়ে। আমার থেকেও রাকার নাম্বার এ আমার বেশী আনন্দ হয়েছিল। আমাদের ক্লাসের তথাকথিত ভালো ছেলেরাও রাকার নাম্বার দেখে বেশ অবাক। ততদিনে আমি বেশ ডাকসাইটে সুন্দরী হয়ে গেছি। আমার কনফিডেন্স তখন তুঙ্গে। পাশ করার পরেই আমরা ভর্তি হয়ে গেলাম কলেজে আবার। আমি সায়েন্স নিলাম। আর রাকা নিল কমার্স। আমি জোর করিনি। জানতাম আমি এবারে ওকে কলকাতায় পাঠাব যে করেই হোক। খেলতে গেলে বেশী পড়ার চাপ দিলে চলবে না ওকে। তাই কমার্স এ আপত্তি করিনি। না হলে সায়েন্স তো নেওয়া করাতাম ই আমি।
রাস্তা ঘাটে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা চলে। কিন্তু একবার যে আমাকে সামনা সামনি দেখে সে আর কোন কথা বলতে পারে না। আমার সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। তাই আজকে আমি দাগ হীন এক মেয়ে। এতো দিন সময় লেগেছে রুদ্র পুরের সবার আমাকে চিনতে। আর যেহেতু আমি নিজের ইচ্ছেয় মেয়ের জীবন বেছে নিয়েছি, আমি চেস্টা করি সব সময়েই সফট থাকতে। তাতে যে আমাকে পছন্দ করে তার সাথেও আর যে করে না তার সাথেও। তাই ধীরে ধীরে আমার ও একটা পরিচিতি তৈরী হচ্ছিল রুদ্রপুরে।
একদিন আমি আর রাকা বসে আছি তিন মাথার মোড়ে। আমরা সেদিনে খেতেই গেছিলাম। আর আমাদের হাফ প্লেটে হয় না। ফুল প্লেট লাগে দুজনের ই। টেন্থ পাশ করার পরেই আমার পকেট মানি বেরে গেছিল বেশ কিছুটা। কাজেই সপ্তাহে দু তিন দিন বিকালে দু বন্ধু তে কিছু খাওয়া টা বড় ব্যাপার ছিল না। আমরা কথা বলছিলাম রাকার কলকাতা যাওয়া নিয়ে। রাকা যথারীতি বিরক্ত আমার উপরে। আমি ঠিক করে নিয়েছি, তুই বিরক্ত হ, রাগ কর, আমি কিচ্ছু শুনব না। ওদের বাড়ি গিয়ে আঙ্কল আন্টি দুজনাকেই পটিয়ে এসেছি। ওরা ওদিক থেকে প্রেশার দেয় আর আমি দেখা হলেই প্রেসার দি। বড় মামার সাথে কথা বলে , এ টি কে র ট্রেনিং সেন্টার এ ট্রায়াল এর ব্যবস্থা করেছি আমি। ওর নাম আর আই ডি চলে এসেছে আমার কাছে। বলে না যার বিয়ে তার খোঁজ নেই , পারা পড়শীর ঘুম নেই। আমি তো ওকে, পাঠাবই। সব মিলিয়ে দেড় লাখ লাগবে। না মানে যদি ও ট্রায়াল এ পাশ করতে পারে তবে দেড় লাখ লাগবে দু বছরের ওয়ার্ক শপ এ। সেখান থেকে কোন ভালো জায়গায় খেলতে পেলে আর কে দেখে।
রোজ সকালেই এখন আমি আর ও দৌড়তে বের হই। আট দশ কিমি দৌড়ই দুজনে মিলে। ওর জন্যেই যাই। তারপরে বাপি কে বলে, বাপির বন্ধুর ক্লাব এ প্র্যাক্টিস করার ব্যবস্থা করেছি। ও যায় ওখানে, ঘন্টা তিনেক প্র্যাক্টিস করে। তারপরে দুপুরে খেয়ে দেয়ে আবার যায় ও প্র্যাক্টিস করতে। আমার কলেজ শেষ হলে আমিও চলে যাই গ্রাউন্ড এ। সেখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে হয় বাড়ি যাই না হলে এখানে এসে গল্প করি। ওকে ছাড়ি না। ছাড়লেই প্রায়ক্টিস এ ঢিল দেবে। ট্রায়াল এ ওকে পাশ হতেই হবে। কিন্তু ও বড্ড উদাসীন। হলে হবে না হলে আরো ভাল হবে, গোছের ব্যাপার ওর কাছে। সেটাই আমার ভয় লাগে।
সেদিনেও সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমি বসে আছি। আমি একটা লং ফ্রক পরে আছি। চুল টা খোলা। মাথায় একটা লাল হেয়ার ব্যান্ড। আমি ওর স্কুটার এ বসে আর ও দাঁড়িয়ে গল্প করছি। ও সেই ঘ্যান ঘ্যান করছে।
- ছেড়ে দে ভাই। আমি যাব না কোথাও। কেন এমন শত্রুতা করছিস তুই আমার সাথে?
নানান কথা বলছে। বেশী টাই আমার হিটলারি সংক্রান্ত নানান কথা। অনুযোগ। আমি ওর দিকে কটমট করে তাকাতেই, রেগে চলে গেল অর্ডার টা আনতে। আমি ভেবে যাচ্ছি দেড় লাখ টাকা জোগার হবে কোথা থেকে। আমার কাছে ২১ হাজার জমে ছিল। ভাঁড়ে। আমি সেটা ভেঙ্গে টাকা করিয়ে নিয়েছি। সেটা এখন পঞ্চাশ হাজার। এটা আমাকে বাপি করে দিয়েছে। বাপি আমাকে সেই কোন ছোট বেলায় বলেছিল যে আমি যা জমাবো বাপি সেটা ডবল করে দেবে আমাকে। বাপি কে বলতেই বাপি আমার কথা মেনে নিয়েছিল। মা শুধু বলেছিল, ২১ টা ৪২ হবে। আর আট দিলেই তো মেয়ের আমার পঞ্চাশ হয়ে যায়। বাপি হেসে তাতেই রাজি হয়ে গেছিল।
তাহলে আমার কাছে পঞ্চাশ আছে। রাকার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে পঞ্চাশ ব্যবস্থা করেছি। আন্টি নিজের যা গয়না ছিল সেগুলো বিক্রী করার ব্যবস্থা করেই পঞ্চাশ হয়েছে। করুক, ওদের ছেলে। তবে এখন না, রাকা চান্স পেলে বিক্রী করতে হবে। তাহলে, এক লাখ হচ্ছে। বাকী টা পাই কোথা থেকে? সেই সময়ে একটা বচসার আওয়াজে দেখি, রাকা আর রনি প্রায় হাতাহাতির উপক্রম।
উফফ আর পারি না এদের কে নিয়ে। রনি আবার কোথা থেকে এল। এদের মাঝেও একদুবার মারপিট হয়েছিল। ছুটে গেলাম আমি। রনি কে বললাম,
- ভাই প্লিস। ভুলে যা শত্রুতা। দেখ রাকা কোন দিন ও তোর সাথে কোন ঝামেলা করবে না আমি কথা দিলাম
রাকা তেড়ে এলো আমার দিকে
- তুই কেন বলছিস এই কথা। আমাকে ল্যাজে পা দিলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না।
আমি রেগে বললাম রাকাকে
- আমি কথা বলছি তো। তুই থাম। কেন ঝগড়া বাড়াচ্ছিস?
রাকা চুপ করে গেল। আমি রনির দিকে ফিরে বললাম
- প্লিস রনি। ভুলে যা, যা হয়েছে। প্লিস বন্ধুত্ব করে নে ভাই।
রনি আমার দিকে হা করে দেখছে। চোখে প্রশংসা ঝড়ে পড়ছে ওর। আমার কেমন একটা লাগে ইদানীং এ সবে। আমাকে ইম্প্রেস করতে,ঠান্ডা হয়ে বলল
- প্রথমত আপনি মেয়ে। আপনাকে আমি চিনি না। আমাকে তুই তুই বলছেন কেন আপনি?
- আমাকে চিনতে পারলি না? আমি শিবানী। মানে ত্র্যম্বক ছিলাম। এখন শিবানী হয়েছি।
সবাই যাতে শুনতে না পায়, চিবিয়ে চিবিয়ে, ইতস্তত করে কথা গুল আমি রনি কে বললাম। রনি খানিক, ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
- আরে!!! কি সুন্দরী তুই মাইরি? একেবারে ঝাক্কাস।
বোঝ। ছেলেরা এই রকম হয় জানা ছিল না। এতোক্ষন রেগে ছিল। যেই সুন্দরী দেখল রাগ জল। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ গর্ব বোধ করলাম আমি। কিন্তু আমাকে ঝাক্কাস বলায় রাকা গেল রেগে। রুখে এলো একেবারে।
- তোর সাহস কি করে হয় শিবের সাথে এই নোংরা টোনে কথা বলার?
উফ আবার শুরু করল এই ছেলেটা। কি করে যে সাম্লাই কে জানে বাবা। রনিও রুখে এল,
- গান্ডু, আমি, কি বলেছি?
তারপরে রনি আমার দিকে চেয়ে নিল একবার। মানে আমার সামনে গান্ডু বললে, আমার ইম্প্রেশন ওর উপরে কেমন হবে সেটা ভেবে একটু গুটিয়ে গেল । তারপরে আমতা আমতা করে বলল,
- না মানে আমি তো কিছু খারাপ বলিনি। - কি সুন্দরী এটা খারাপ কথা না তাই না?
- কিন্তু আরেক টা যেটা বললি? সেটা?
রাকার তেড়েফুঁড়ে উত্তরে আমি রাকার হাত টা চেপে ধরলাম, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম,
- ঝাক্কাস কথা টাও খারাপ নয়। তুই চুপ কর দয়া করে।
রাকা চুপ করে গেল। আমি বললাম রনি কে,
- ব্যস হয়ে গেল। মিটমাট কেমন?
- না মিটমাট হয় নি এখনো
উফ আবার কি হলো বলতে যাচ্ছি দেখলাম, রনি স্যালুট করার ভঙ্গী নিয়ে রাকার দিকে তাকিয়ে। আমি ভাবছি এ আবার কি নাটক? তখন রনি আমার দিকে ফিরে বলল,
- দ্যাখ ত্র্যম্বক, না না শিবানী, তুই বললি বলে নয়, কিন্তু আজকে বুঝলাম, রাকা এতো দিন কেন তোর সাথে থাকত। তোকে গার্ড দিত। তোর খারাপ সময়ে তোকে নিয়েই ও থাকত। দ্যাখ, রনি খারাপ কাজ করতে পারে, কিন্তু রনি ছেলে ভাল।
তারপরে আবার রাকার দিকে ফিরে স্যালুট এর ভঙ্গী তে পা ঠুকে নিল একবার তারপরে বলল,
- স্যালুট ভাই তোকে । আমি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালাম। তুই ভাব কি করবি।
আমি তখন রাকার হাতে চিমটি কেটে ধরেছি। ফিস ফিস করে বলছি
- যাআআআ।
দুজনায় গলাগলি করে নিলো। আমিও হেসে বাঁচি না। নাটকে দুটোই ভাল এক্টিং করতে পারবে। যাই হোক সেই দিনের খাবারের পয়সা রনি ই দিল। প্রথম বার আমি রাকা ছাড়া কোন ছেলের উপরে ইম্প্রেসড হলাম। রনির সাথে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু হলো। এখনো রনি আমাকে পাগলের মতন ভালোবাসে। আমি জানিনা রনি সত্যি করেই আমাকে চায় কিনা। নাকি আমাকে শুধুই ভালবাসে। যাই হোক আমার কাছে ও আমার জীবনের সম্পদ।
সেদিন রাতে ভাবছিলাম, আমার তো কিছু নেই আর। যা ছিল সেটা দিয়েও হবে না। ভাবলাম মা কে জপাতে হবে। রান্না ঘরে মায়ের কাছে গেলাম। ইদানীং যাই। এখন পড়ার চাপ কম। মা কে হেল্প করি। সেই কোন ছোট বেলার ইচ্ছে আমার এখন মিটছে। মা ও কিছু বলে না বরং শিখিয়ে দেয়। রুটি করা, রুটি বেলা। এখন ও আমি প্রপার গোল করতে পারি না রুটি কিন্তু অনেকটাই হয়। আমি করেছি বললে বাপিও বেশ উৎসাহ নিয়ে খায়। আমার ভাই বোনেরা তো অজ্ঞান আমার রান্নায়। সবাই উৎসাহ দেয় এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
সেই রকম ই রাতে আমি আটা মাখছি। মা বলে দিচ্ছে,
- হয় নি তো, অল্প অল্প করে জল দে। মাখ। বুঝতে পারবি টান টা। আটায় টান না পেলে আরেক টু জল দে আবার মাখ।
আমি সেই ভাবেই চেস্টা করছি। একটা সময়ে ব্যাপার টা কে বাগে আনলাম। তারপরে মাকে বললাম,
- ও মা একটা কথা বলব?
- কি?
মা তরকারি সাঁতলাচ্ছিল। বললাম, কিছু টাকা আমাকে আরো দেবে?
- মানে? কি করবি?
- আগে বল দেবে কিনা তাহলে বলব।
- না সে দেবার চেস্টা করতে পারি। কারন আমার ও তিন চারটে আর ডি মাচুওর করেছে। তোর বাবার কাছেই আছে। চাইলেই দিয়ে দেবে। কিন্তু কেন?
মনে মনে ভাবলাম বাহ মা তো বেশ ভালো ভাবেই নিল ব্যাপার টা। বললাম মা কে পুরো ব্যাপার টা। শুধু বললাম লাগবে এক লাখ। আমি দেব তিরিশ, রাকার বাবা ষাট। দশ কম পরছে। দশ পেলেও অনেক। মানে যা পাওয়া যায় আরকি। মা শুনে কাজ করতে করতেই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কি মানে বুঝলাম না আমি সেটার। বলল,
- ঠিক আছে। কবে লাগবে?
- দেরী আছে। আগে ওর ট্রায়াল টা হোক। পাশ করুক।
- তুই ই মামা কে বলেছিলি না ওর কথা?
মাথা নামিয়ে আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মা কিছু বলল না।
দুদিন পরে আবার মোড়ের মাথায় বসে আছি। সেদিনে অবশ্য আমি আকাশী সালোয়ার পরেছিলাম। পনিটেল করে রেখেছিলাম চুল টা। একটা সাদা গার্ডার ছিল আটকানো চুলে। রনি এলো। সেদিনে আমি অর্ডার করেছিলাম। তিন প্লেট চিকেন চাউমিন। দু দিন পরেই রাকার ট্রায়াল ছিল। আমার মাথায় চিন্তার আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে ট্রায়ালে রাকা সিলেক্টেড হলে, পুরো টা একসাথে না দিলেও হবে। তিনমাস পরে পঞ্চাশ দিলেও চলবে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম জোগাড় করে রাখলে মন্দ কী।
চুপ করে ভাবছিলাম আমি। রনি আর রাকা খানিক কথা বলেই আমার কাছে এলো। দুজনাই তাই। একটু সময় নিয়ে ভাবব। সেটার অবকাশ দেবে না। সারাক্ষন গায়ে গায়ে লেগে না থাকলে হবে না। রনি এসে বলল,
- কি ভাবছিস অতো।
- ছাড় ওর কথা। মারাদোনা করবে আমাকে
রাকার কথায় মাথা গরম হয়ে গেলো আমার। সারা দিলাম না। রনি আবার বলল আমার দিকে তাকিয়ে,
- ভাই বুঝলাম না। কি হয়েছে বলবি।
দেখলাম উপায় নেই। বললাম ওকে সমস্যা টা। আবার মুখ নামিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বড় মামা কে বলব? নাকি আন্টি কে বলব, যে তুমি গয়না বিক্রী কর আমি ছাড়িয়ে আনব, চাকরি পেলে। মা কে বলা যাবে না। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। নাহ আন্টি কেই বলি। ওদের ছেলে নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন আন্টি। খানিক বাদে রনি বলল,
- ভাই উপায় পেয়েছি।
আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম
- কি বল বল
- আমার খাবারের দোকানের হোটেল করব বলে কিছু টাকা আছে। যা আছে তাতে হবে না এখন দোকান। তোকে দি চল্লিশ?
রাকা সটান না করে দিল। আমরা সবাই জানি, রুদ্র পুরে একটা খাবারের দোকান মানে হোটেল করার স্বপ্ন ওর অনেক পুরোন। আমিও রাজী হলাম না। আমাদের মুখ দেখে বুঝে গেল আমরা চাইছি না। বলল,
- ও আমি তবে কোন বন্ধুই নই। শিব দিতে পারে ষাট হাজার টাকা। আর আমি পারি না।
- না তুই পারিস। একশবার পারিস
- তবে নিচ্ছিস না কেন? আরে ভাই আমি কি এমনি এমনি দিচ্ছি নাকি? তুই ট্রায়াল ক্লিয়ার করতে পারলে তো হয়েই গেল, সারা ভারত থেকে একশ জনের একজন তুই। আমি তো ইনভেস্ট করছি। পরে ফেরত দিস।
- এসব কিছুর কি ঠিক আছে? ধর পারলাম না কিছু করতে। বল?
- আমি কিচ্ছু জানিনা। ব্যস হয়ে গেছে। তুই মহানন্দে যা। খুব ভালো করে ট্রায়াল দে। হয়ে গেলে যখন তুই যাবি ক্যাম্প এ আমিও যাব তোর সাথে টাকা নিয়ে। তোর গার্জেন হয়ে বুঝলি?
ওদের কথা শুনছিলাম আমি। আমি আবারো ইনপ্রেসড হলাম রনির উপরে। সত্যি ও ভালো ছেলে। এমন খোলা মন আমি রাকার ছাড়া কারোর হয় ভাবতেও পারিনি। আমি কিন্তু এতো খোলা মনের নই। আমার কাছে ভালবাসার ভালো লাগার মানুষ গুলো অনেক আগে জায়গা পায়। রাকা বা রনির মতন সবাই কে আপন করে নিতে আমি পারি না ।
যেদিন রাকা ট্রেনে চাপল আমি আর রনি গেছিলাম ওকে তুলে দিতে। মনের মধ্যে একটা ভয় আমার। ও নিশ্চই পারবে। এই ভরসার উল্টো দিকে, যদি না পারে, এই ভয় টাও কাজ করছে। রাকা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এ মাসের হাত খরচা টা এনেছিলাম, ওকে দেব বলে। এতো দূর যাবে। হাতে টাকা না থাকলে হয় নাকি? আমি ওর পাশে বসে, ওর হাতে টাকা টা গুঁজে দিলাম। ও সেটা দেখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
- এটা কেন?
- রাখ কাছে। পরশু ট্রায়াল, আগের দিনে ভালো মন্দ খাবি। গায়ে জোর লাগবে না?
আমার দিকে চেয়েই রইল রাকা। জানিনা কি ভাবছিল ও। তারপরে ঝপ করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সজোরে। আমাকে আগেও ও জড়িয়ে ধরেছে আগে। কিন্তু এটা যেন অন্য রকম ছিল। আমার বুক টা ওর বুকের সাথে লেপ্টে গেল। একটা টনটনানি ব্যাথা বুকে। আমার কাঁধে মুখ টা গুঁজে আছে ও। আমার কানে ওর নিঃশ্বাস পরছে। ওর নিঃশ্বাসের হাওয়ায় আমার ঘাড়ের চুল উড়ছে। কেমন একটা শিরশির করছে ওই সময়ে আমার শরীর টা। আমিও খুব ইতস্তত করে আমার দুটো হাত ওর পিঠে রাখলাম। পিছনে দেখছি, সবাই আমাদের দেখছে। জানি সবাই ভাবছে আমরা প্রেম করছি। ভাবুক। সেটা তো সত্যি নয়। আমি কিন্তু ছাড়লাম না ওকে।
পিছন থেকে রনি ফিস ফিস করে বলল,
- ভাল বাসাবাসি হয়ে গেলে এবারে নেমে চল শিব। ট্রেন ছেড়ে দেবে।
রনির কথায় আমাকে ছেড়ে দিলো রাকা। আমিও ছেড়ে দিলাম। নেমে এলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। মিলিয়ে গেল। ও আবার আসবে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় টা লাগল যে, যদি ও ট্রায়ালে পাশ করে যায় তাহলে দু বছর ও আসবে না। আসবে হয়ত মাঝে মাঝে, কিন্তু এই যে রোজ দেখতে পাই দুজন দুজন কে সেটা তো হবে না। এতদিন এতো করে টাকা জোগাড় করলাম। যে ওকে পেতেই হবে চান্স। কিন্তু এটা তো ভাবিনি, গত ছয় বছরের এমন অছেদ্য বন্ধুত্ব আমাকে ওকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা এই ভাবে দেবে। এতদিনে কেউ রাগারাগি করলে, একে অপরের বাড়ি চলে যেতাম। এখন তো সেটার ও উপায় নেই। মন টা ভয়ঙ্কর উদাস ছিল আমার।