03-02-2022, 11:29 AM
আগের পর্বের কিছু অংশ......
মায়ের গলায় অভিমানের সুর থাকত। আর বাপি ও একশবার সরি বলত মা কে। আমরাও তিন ভাই বোনে খুশ। ওদের মেজাজ ঠিক থাকলে আমারাও খুব আনন্দে থাকতাম। আমাদের ও বয়স অনুযায়ী প্যাম্পার করা হত। কিন্তু একটা ব্যাপার মনে দাগ কাটত সেটা হল, এই যে বাপি, নিজের নিয়ে কত গর্ব করে। মা গর্ব করে নিজের ইনভল্ভমেন্ট , বা আমাদের মানুষ করা নিয়ে। ওদিকে রাকা ও বার বার বলে, শালা মর্দ হতে পারছিস না। এই টুকু তেই কাহিল হয়ে পড়লি।সেও নিজের মর্দাংগির প্রত্যক্ষ গর্বে মশগুল। বা মায়ের সামান্য হাত কেটে গেলে বঁটি তে, বাপি আঙ্গুল চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করত আর মা বলত,- ছাড়ো তো, মেয়েদের এমন অনেক হয়। অতো ধরলে কি চলে নাকি? মানে সবাই জানে তাদের গরিমা, তাদের ক্ষমতা, তাদের সহ্য শক্তি, তাদের ইমোশন। কিন্তু কই আমার তো কোন দিন ছেলে হওয়া নিয়ে গর্ব বোধ আসে নি? কেন আমার মনে হয়েছে, এই শরীর, এই পোশাক, এই গর্ব আমার না, গর্ব এই ছেলে শরীর টার। তার ভিতরে কি আছে কে আছে, কে মাথা ঘামাচ্ছে?
পর্ব পাঁচ
কলেজের মেয়েরা আসে, নিজেদের সুন্দর করে। কি সুন্দর লম্বা লম্বা নখ রাখে ওরা। লম্বা চুল। একটা গরিমা যেন চোখে মুখে ফুটে বেরোয়। আমি কেন পারি না, নিজের পুরুষ হবার গরিমা জাহির করতে? বা আমি কেন পারিনা, আমি মেয়ে সেই কথা টা সবাই মুখ ফুটে বলতে? ক্লাস এইট এ থেকেই আমি বুঝে গেছিলাম, আমাদের সমাজ নতুন কোন কিছুই মেনে নিতে পারে না। সেটা নিয়ে উপহাস করে, উক্তি কটুক্তি তে ক্ষতবিক্ষত করে, আর না হলে সরাসরি রিজেক্ট করে। আমি তো আরো ভয়ে থাকি। কারন আমি নিজের চোখে দেখেছি সে দৃশ্য।
আমরা তখন ক্লাস সিক্স এ পড়তাম। ক্লাস ইলেভেনের একটি ছেলে ছিল, নাম ছিল কার্তিক। শুনলাম আমাদের কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করছিলাম মায়ের। ততক্ষনেই জানলাম, একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে মেয়েদের বাথরুম এ। দুটো হাতের ই শিরা কেটে ফেলেছিল। আমি দাড়িয়েই ছিলাম যখন ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল স্ট্রেচার এ করে। মা আমার চোখ দুটো নিজের হাত দিয়ে আড়াল করে দিয়েছিল। ফাঁক দিয়ে আমি যতটুকু দেখতে পাওয়ার দেখতে পাচ্ছিলাম। কার্তিক বেঁচে ছিল মনে হয় তখনো। দুটো হাত ঝুলে পড়েছিল ওর। ওর ই জামা দিয়ে বাঁধা ছিল কব্জির ওখান টা। কিন্তু চুইয়ে চুইয়ে রক্ত টপাচ্ছিল হাত থেকে কলেজ প্রাঙ্গন এ। বুকের বাম দিকে মোচর দিয়েছিল মারাত্মক।
পরে শুনেছিলাম, কার্তিকের হাব ভাব মেয়েদের মতন ছিল। ওকে সবাই কলেজে ক্ষেপাত। বাড়িতে বকত। টিচার্স রাও ছেড়ে কথা বলত না। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট হওয়া সত্ত্বেও একটা প্রাণের বলি সেদিন হয়েছিল। হয়ত কেউ দায়ী নয়, কিন্তু দায় টা সবার মনের মধ্যে বসে গেছিল। আজকে আমার ওকে খুব আপন মনে হয়। কিন্তু আমার থেকে ও অনেক সাহসী ছিল। নিজের কথা ও রাখতে পেরেছিল সবার সামনে। আমার মধ্যে তো সেই সাহস টুকুও নেই। আমি তো বাপির চোখের দিকে তাকালেও ভুলে যাই আমি কি চাই।
সবাই তারপরে, তার নামে হয়ত অনেক ভালো কথা বলেছিল। হয়ত বুঝেছিল, অতো টা ওকে একা করে দেওয়া ঠিক হয় নি। বা বুঝেছিল, আরেক টু কাছে টেনে নিলে হয়ত অকালে এই প্রাণ টা ঝরে যেত না। কিন্তু একটা তাজা প্রাণ চলে যাবার পরে এই সব ভাবনার তো মানে হয় না তাই না? ওর জন্য আমার চোখে জল আসে। হয়ত ওর বাবা মা ও স্ট্রিক্ট ছিল আমার বাবা মায়ের মতন। হয়ত ওরা ভেবেছিল, মরে গেছে আপদ গেছে। তখন আমি ছোট ছিলাম, আমার মা আমাকে পরের দিন ও কলেজে পাঠায় নি আর। কিন্তু আমার আজকেও জানতে ইচ্ছে করে, কার্তিকের বাবা কি কান্না কাটি করেছিল কার্তিকের জন্য?
আমার কান্না পায় সেই জন্য। নিজের এই ব্যাপার গুলো কে যে কি কস্ট করে দাবিয়ে রাখি আমি ই জানি। খালি ভয় লাগে, যদি আমার বাবা মা জেনে যায় আর ওরাও আমাকে না চায়? আমি কার্তিকের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম, কারন আমার জানার ইচ্ছে ছিল, কার্তিকের বাবা মায়ের ভালোবাসা কি কমে গেছিলো? কার্তিকের ভাই বোন ওকে কেমন চোখে দেখত? নিশ্চই খুব উইয়ার্ড ভাবত কার্তিক কে। তাই কার্তিক এই পৃথিবীতে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন আরো কান্না পায় আমার।
আমিও বুঝতে পারছি, আমিও ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ছি। মানসিক ভাবে। এমন না যে কেউ আমার সাথে মিশতে চায় না। কিন্তু আমি নিজেকে আলাদা করে নিচ্ছি। আমার কেন জানিনা ভয় লাগছে, যদি কেউ কিছু বুঝে ফেলে আমার ব্যাপারে। তাই এড়িয়ে থাকছি দূরে দূরে থাকছি। বাড়িতেও বিশেষ কথা বলি এমন না। বার বার মনে হচ্ছে মা কিছু বুঝে গেল। বাপি কিছু ধরে ফেলল। সব সময়ে একটা ভয় কাজ করছে মনের মধ্যে আমার। কোন কারনে মা যদি আমাকে দেখছে, তাহলেই ভয় লাগছে। ভয় লাগছে মা যদি আমাকে দূরে ঠেলে দেয় আরো? বাপি কে তো ভাবি ই না। আমার কাছে মা ই সব। মা যদি কোন কারনে আমাকে সরিয়ে দেয়, আমার ও হাল কার্তিকের মতই হবে।
উল্টো দিকে, নিজেকে আর এই ভুল শরীরে নিজেকে আমি মেনে নিতেও পারছি না। আজকে না হোক কালকে, সবাই বুঝবে, আমার এই শরীরের ভিতরে কোন ছেলে নেই, আছে একটা মেয়ে। তখন কি হবে? আমি যতই লোকানোর চেষ্টা করি, ব্যাপার টা বাইরে আসবেই। আমাকে এখনি দেখতে আলাদা লাগে ছেলেদের থেকে। মেয়েদের মতই গোল মুখ। সামান্য লোম ও নেই। ঠোঁটের গঠন ও মেয়েদের মতন। ফুটবল খেলার জন্য যে পেশী তৈরি হয়েছিল, সেগুলো আসতে আসতে আবার নরম হচ্ছে। জানিনা কি হবে। হয়ত আরো খেললে ব্যাপার টা ঠিক ঠাক হবে, কিন্তু খেলতেও ভাল লাগে না, যা ছেলেরা খেলে। কারন ভিতরের নেশা টা বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে মেয়ে হিসাবে দেখার নেশা। ভিতরের কয়েদ খানায় বন্দী থাকা ইচ্ছে গুলো কে বাইরে বের করে ওড়ার নেশা।
ইতিমধ্যে একদিন কি হল, আমাকে রাকা বলল
- তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে
আমরা সেই তাশী নদীর তিন মাথার মোড়ে মোমো খাচ্ছিলাম। আমি বললাম
- কি বল?
বলল
- না এখানে হবে না , আমার বাড়িতে গেলে দেখাব।
অধৈর্য লাগছিল নিজের। কিন্তু কিছু বললাম না। আমি এতো দিনে জেনে গেছি ও কোন খারাপ সারপ্রাইজ আমাকে দেয় না। মনে মনে ফুটছিলাম আমি, কবে শনিবার আসবে। কথা মতো শনিবার দিন ওর বাড়ি যেতে, আন্টি আমাদের খাওয়ালো। ওর বাড়িতে গেলে শনিবারে দুপুরের লাঞ্চ টা ওর বাড়িতেই হয় আমাদের। ভাত, আলু ভাতে, গরম ডাল আর কোন দিন চিকেন থাকে, কোন দিন মাছ থাকে। আমার মন্দ লাগে না। আমি আন্টির কাছে এই খাওয়া টা সময় নিয়ে খাই। খেতে আমার একটু সময় লাগে। ধীরে ধীরে খেতে আমি পছন্দ করি। কিন্তু সেদিনে আমার কোন মন ছিল না। মন ছিল সারপ্রাইজে।
খেয়ে দেয়ে সেই পোড়ো বাড়ির ঘরে যেতেই ও আমাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল আমার হাতে। আমি অবাক হয়ে বললাম
- কি এটা?
- খুলেই দেখ।
আমি তাড়াতাড়ি খুলে ফেললাম প্যাকেট টা। দেখলাম, একটা নীল রঙের কোন পুরোন ঘাঘরার মতন পোশাক আর তার সাথে একটা ছোট প্যাকেট। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। যে ইচ্ছে কয়েদ ছিলো , ওকে কোন দিন বলিও নি, সেই রকম একটা ইচ্ছে পুরন করছে আজকে ও আমার। সেই প্যাকেট টা খুলে দেখলাম, কিছু ফলস নেল, একটা ইমিটেশনের হার, দুটো কানের ঝুমকো মতন। অন্যান্য ছেলেরা হয়ত এই গুলো কি জানত ও না। কিন্তু আমার ইন্টারেস্ট ছিল এই সব ব্যাপারে। তাই আমি জানতাম, কোন টা কি গয়না। কোন ড্রেস এর কি নাম। বিশেষ করে মেয়েদের। আমার খুব আনন্দ হল। কিন্তু সমস্যা হল পরতে জানি না আমি। বুকের ভিতর টা ঢিবঢিব করছিল আমার। আমি ড্রেস টা দেখছি, আর রাকা কে দেখছি। আর ভাবছি কি ভাবে ও বুঝল আমার ইচ্ছে। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম
- এগুলো কেন আনলি?
ও তখন নিজের এমপ্লিফায়ার টা রেডি করছিল। ওদিকে তাকিয়েই বলল
- আমি তোর নাচ দেখছিলাম গত কয়েক শনিবার আর ভাবছিলাম, ইউ ডান্স ব্রিলিয়ান্টলি। কিন্তু কীসের যেন একটা অভাব ছিল। গত দুই তিন সপ্তাহ ভেবেও আমি বের করতে পারিনি। কিন্তু গত শনিবার তুই - বাবুজি ধীরে চলনা গান টায় নাচ ছিলিস, আর তখন আমার মাথায় এল যে, প্রপার ড্রেস না পরলে তো , যে বিট গুলো তুই নিচ্ছিস নাচে, সে গুলো বোঝা যাচ্ছে না।
আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মানে আমি যে ভাবতাম ও জাস্ট আমার জন্যেই আমার নাচ দেখছে, ব্যাপার টা সেরকম না। ও খেয়াল ও করেছে আর যেটা দরকার সেটার ব্যবস্থা ও করেছে। আমি মনে তার পর থেকেই ওর উপরে নির্ভরশীল হয়ে পরেছিলাম নিশ্চিত ভাবেই। কত ঝড় গেছে। কিন্তু ও আমার হাত ছাড়ে নি। আর ওর উপরে আমার ভরসা দিনে দিনে বেড়ে গেছে সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
মুশকিল হল, আমি তো কোনদিন ও পরিনি, মেয়েদের কোন পোশাক। কাজেই ওই ঘাগরা টা পরতে সময় লাগল একটু। কিন্তু অর্নামেন্ট গুলো পরে ফেললাম। সমস্যা হল, কানের ঝুমকো পরতে গিয়ে। কারন আমার কানের ফুটো করা ছিল না। সে যাই হোক, জীবনে আবার আমি আনন্দ পেলাম। একটা ছোট আয়নায় দেখলাম নিজেকে। কোন সস্তার লিপস্টিক এনেছিলো রাকা। সেটাই লাগালাম। নিজেকে দেখে নিজেই আপ্লুত হয়ে গেলাম বলাই বাহুল্য। আমার যেন এনার্জির কোন কমতি ছিল না সেদিন। একের পর এক গানে আমি নাচলাম। সবটাই আমার ফোনে রেকর্ড করল রাকা।
হয়ে যাবার পরে আমার তো ড্রেস টা ছাড়তেই ইচ্ছে করছিল না। তাও সন্ধ্যে হয়ে আসছে ভেবে, ছেড়ে নিলাম ড্রেস টা। রাকা ওর একটা রুমাল দিয়ে আমার লিপস্টিক মুছিয়ে দিল। আমি সব সাজ এক এক করে ছেড়ে ফের সুন্দর করে গুছিয়ে ছোট প্যাকেট এ ভরে রেখে দিলাম। ঘাগরা টা কে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিলাম প্যাকেট এ। একটা পুরোন ট্রাঙ্ক ছিল, সেখানে রাকা রেখে দিলো দুটো কেই। তারপরে আমরা বেড়িয়ে পরলাম, কলেজ ড্রেস পরে।
সাইকেল টা তে পাম্প ছিল না। দিতে দিতে রাকা কে বললাম,
- থ্যাঙ্কস
- কেন?
- তুই বুঝতে পারছিস না কেন?
আমার বলতেও ওকে কেমন লাগছিল, যে আমি ওই মেয়েদের ড্রেস পরা টা খুব এনজয় করেছি। বা বলা ভালো, ও আমার একটা স্বপ্ন আজকে পূরন করেছে। কিন্তু সেটা বলতে পারছি না। ও কিছু বলল না আমাকে। দুটো চাকা টিপে দেখে বলল,
- আর পাম্প দিতে হবে না চল।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম তাশীর পাশ দিয়ে। আজকে দারুন খুশী আমি। দারুন খুশী। খুশীর কোন সীমা নেই মনে হচ্ছে। ওকে আমি ই বললাম,
- তোকে থ্যাঙ্কস দিলাম কারন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল আমি মেয়েদের ড্রেস পরব। আর তোর জন্য আমি সেটা পরতে পারলাম।
রাকা জানিনা ব্যাপার টা বুঝল কিনা। আমাকে কোন সাড়া দিল না ও। পাশে পাশে হাঁটছিল। কখনো কোন ইটের টুকরো, দূরে ছুড়ে দিচ্ছিল তাশির জলে। আবার চলে আসছিল পাশে। মনে হল ও আমার কথা গুলো শুনতে চাইছে না। একটু অন্য রকম লাগলেও আমি কিছু মনে করলাম না। এই সবের পরেও ও আমাকে ঘেন্না করছে না বা আমাকে উইয়ার্ড ভাবে নি এটাই অনেক। কিছু টা হলেও ওর সাথে থাকলে আমি ফ্রি থাকি। বাকিদের সাথে যে ভয় টা কাজ করে, ওর সাথে থাকলে সেই ভয় টা আমি পাই না। আমি চুপ রইলাম। ওকে আর ঘাঁটালাম না। আমি সাইকেল টা ধরে হাঁটছি। ও এদিক ওদিক করছিল তখন। কখন আমার ডান দিকে চলে আসছে, ইটের খোঁজে। বা কখনো এগিয়ে যাচ্ছে ইটের খোঁজে। কিন্তু অনবরত জলে ইট মেরেই যাচ্ছে ও। হঠাৎ একটা বড় ইট জলে ছুঁড়েই আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
- শোন, তোর যখন ইচ্ছে করবে, আমাকে ফোন করে দিবি। মানে এই সাজ গোজের ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে হলে বা নাচের ব্যাপারে। আর এর বাইরেও কোন ইচ্ছে থাকলে সেই ব্যাপারেও।
আমি বুঝতে পারছিলাম না। একটু আগে যা বুঝলাম ও আমার কথা শুনছিলো ও না। আর এখন কি হল যে একেবারে এই কথা বলছে? আমি ওকে বললাম,
- একটু আগে তো শুনলিও না আমার কথা। এখন আবার এই কথা বলছিস?
- না না শুনিনি এমন না। শুনছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে অন্য কথা চলছিল তখন।
- কি কথা?
- ধুর বাল, অতো জানতে হবে না তোকে। যদি দরকার পরে সেই কথা বলার তোকে নিশ্চই বলব। এখন তোকে যেটা বললাম সেটা করবি।
রেগে গেল কেন সেটাও বুঝলাম না। ও আমার উপরে রাগ দেখালে আমার রাগ হয়। কিন্তু এবারে ওর উপরে রাগ করলাম না। কেননা, ওর কোন ব্যাপার নেই আমি রেগে গেলাম কি না গেলাম।বলেছিলাম না, আমাকে ও শুধু বন্ধু হিসাবে দেখে মাত্র। লাস্ট এক্সাম এও আমার সাজেশন এ ব্যাটা নাম্বার পেয়েছে ভালই। তবুও আমার উপরে রাগ করল। মানে আমার সাথে কোন স্বার্থের জন্য ও থাকে না। বা আমাকে আমার ইচ্ছে গুলো কে ওর নিজের জন্যেও ও পূরন করে না। নেহাত ভালো বন্ধু তাই ও করে। বা ও এটাও ভাবে নি যে আমাকে ওমনি করলে আমি রেগে যেতে পারি। র্যাদার আমি কিন্তু ওর চোখে একটা চিন্তা দেখলাম কথা গুলো বলার সময়ে। ও কিন্তু বলেই চলে,
- তোর যখন মনে হবে ওই সব কথা বলতে, আমাকে ফোন করবি। রাতের দিকে করিস। আমি মায়ের ফোন টা নিয়ে রেখে দেব। কিন্তু মন গুমরে থাকবি না বুঝলি? আর তোর বাবা মা যেন না বোঝে। বা আমার মা। বা কলেজে কেউ। মনে থাকবে?
আমি তখন ও ওকে দেখছিলাম। ও এতো চিন্তিত কেন ব্যাপার টা নিয়ে সেটা বুঝতে পারছি না আমি। কিন্তু ঠিক আছে। ওকে বললাম
- সে ঠিক আছে। কিন্তু তোকে আরো কিছু বলার আছে।
- বল, এই সংক্রান্ত যা কথা, আমাকে বলবি। সমস্যা হলে দুজনে মিলে যুক্তি করব। কিন্তু একা একা কিছু ভাববি না একদম
- না রে বাবা। একলা ভাবতেই পারি না আমি। সময় কোথায়?
- আচ্ছা বল কি বলবি?
- তুই আজকে আমার একটা বহু দিনের সখ মিটিয়েছিস। কিন্তু কি বলত, আমার না মাঝে মাঝে খুব ডিপ্রেসড লাগে।
- কেন?
- মনে হয়… মনে হয়……
নিজেকে আটকে নিলাম। বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না আমি। ও আমাকে নক করল আবার
- কি রে বল কি বলবি?
- জানিনা । কি ভাবে বলব সেটাও বুঝতে পারছি না। এই যেমন আজকের এই কথাটাই আমি তোকে সাহস করে বলতে পারিনি।
- কোন কথাটা?
- এই মেয়েদের ড্রেস পরতে পছন্দ করি, এই ব্যাপার টা।
- হুম।
- আমি ভাবতাম কি জানি কি মনে করবি। আমার নাচের ইচ্ছে হয়ত তুই পূর্ন করেছিস, কিন্তু সব ইচ্ছে শুনতে যাবি ই বা কেন?
- আরে আমাকে বলেই তো দেখতিস। তুই আমাকে বলেছিলি, ইউ উইল নেভার স্টপ কিপিং ট্রাস্ট অন মি।
- হ্যাঁ বলেছিলাম। আর আমি তোকে ট্রাস্ট করিও। কিন্তু এই কথা গুলো, হয়ত তোকে বোঝাতে পারছি না আমি, নিজেই মানতে পারি না। তাই একটা ভয় লাগে।
- কীসের ভয় ভাই?
- ভয় লাগে হয়ত তুই আমাকে ভুল বুঝলি। আর এই ফ্রেন্ডশিপ টা আর রাখলি না।
- ধুর পাগলা। আমি একটু অন্যরকম রে।
ওই বয়সে কেই বা বোঝে, যে ভালোবাসে তোমাকে তাকেই ভালোবাস। কিছু না বুঝেও যদি এই কানেক্ট টা হয়ে গেলে, কোন ব্যাপার থাকে না। মারামারি হলেও, ভাব হয়ে যায়। আর সত্যি ই ও অন্য রকম। নেহাত আমার জোরাজুরি তে পড়াশোনা টা করে। না হলে ওর কাছে রেজাল্ট কোন ম্যাটার করত বলে আমার কোন দিন মনে হয় নি। ও বলেই চলে,
- বল এবারে কি বলতে যাচ্ছিলি। আমি তোকে বলে দিচ্ছি, যাই হয়ে যাক, তোর সাথে বন্ধুত্ব আমি কোন দিন নষ্ট করব না রে।
আমি তখন ও ভাবছি। মনে মধ্যে আকুলি বিকুলি করছে, যে ওকে বলে দি। আমি কি এবং কি ওরিয়েন্টেশন এর মানুষ আমি। কিন্তু বলতে পারছি না। আমি জানি ও যা শুনবে আমার থেকে সেটা ওর কাছে প্রথম বার শুনবে। ও বুঝতে হয়ত পারছে না কত খানি মুশকিল একটা মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া যে সে ছেলের শরীরে একটা মেয়ে। এবং সেটা যারা শুনবে, তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কত কঠিন সেটা আমি জানি। কারন আমার মা কে আমি দেখেছি। আমার মা হয়েও সে মানতে পারছে না, আর ও আমার এই মাস তিনেকের বন্ধু হয়ে কি ভাবে মেনে নেবে?
কিন্তু এই ব্যাপারে আমি ওকে আমার মায়ের থেকে বেশিই নির্ভর করি। জানিনা কেন করি। কিন্তু করি। সেই নির্ভরতাই, বার বার ওকে কথা গুলো বলার জন্য একটা ধ্বনাত্মক ইচ্ছে মনে ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে। আমি মনে হয় ভাবনায় হারিয়ে গেছিলাম। চমক ফিরলে দেখলাম, আমরা সেই তিনমাথার মোড়ে এসে হাজির। আজকে পয়সা কম ছিল। ভেজ চাউমিনের অর্ডার দিলাম।
একটা বাড়ির পাঁচিলে দুজনে হেলান দিয়ে খাচ্ছি। আমার সাইকেলের কেরিয়ার এ রাকা বসে আছে আমার দিকে মুখ করে। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি রাকা দিকে মুখ করে। ও খেতে খেতে বলল আমাকে,
- আমি বুঝতে পারছি, তুই হেসিটেট করছিস। কিন্তু তুই বলতে পারিস আমাকে। বা যখন তোর বলতে ইচ্ছে হবে বলিস আমাকে। আমি জোর করছি না তোকে।
- না বলতে তো ইচ্ছে করছে। কিন্তু একটু সময় দে আমাকে।
- ওকে।
খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে, আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কিছু টা এসেই একটা জায়গা আছে, সেই জায়গা টার নাম হল, দক্ষিনা কালী রোড। সেখান টা একটু ফাঁকা থাকে। আমরা এই জায়গা টা আসার আগে অব্দি চুপ করেই হেঁটে এসেছি। আমি সময় নিচ্ছি ওকে কথা টা বলতে। মনে ভাবনার ঝড় চলছে আমার। বলার পরে ও বন্ধুত্ব ছেড়ে দিলে আমার সব দিক যাবে। কিন্তু আজকে না জেনে ,পরে জানলে তখন ও যাবে বন্ধুত্ব। রিস্ক তো আমাকেই নিতে হবে। সত্যি ই তো। আমি যদি ভয়ে ওর বাড়িতে নাচ না করতাম, বা আজকে যদি ড্রেস না পরতাম, তবে তো এই আনন্দ টাও পেতাম না। কে বলতে পারে, রাকা আমাদের বন্ধুত্বে কোন আঁচ আসতেই দিল না। বা হয়ত রেগে গেল, কিন্তু বন্ধুত্ব টা রেখে দিল। সব রকম পসিবিলিটি আছে। কিন্তু আমার সব চিন্তা গুলোই ভ্যালিড হবে ,যদি আমি কথা টা ওকে বলতে পারি। ও কোন কথাই বলছে না। ছেলেটা কিন্তু এই ব্যাপারে ম্যাচুওর। আমাকে সময় দিচ্ছে। অনেক ক্ষন সময় নেবার পরে, আমার বাড়ি আর ওই তিন কিমি মতন, তখন ঠিক করে নিলাম ওকে বলেই দি। বলতে গেলাম,
- বেশ শোন তবে বলি, আমার মনে হয়…
কথার মাঝেই কেউ চেঁচিয়ে উঠল,
- কিরে শালা, রাকা, নতুন গার্লফ্রেন্ড নাকি তোর?
আমি এদিক ওদিক তকিয়ে দেখলাম দু তিনটে ছেলে ছেলে সামনেই দাঁড়িয়ে। আমি চিনি না। কারন আমাদের কলেজের না। কিন্তু রাকার উত্তর ভেসে এল
- কেন তোর ও কি ছেলে গার্লফ্রেন্ড নাকি? রনি, ফালতু ঝাঁট জ্বালাস না। আগের বারে মতন কিন্তু এবারেও ক্যালাবো।
- আচ্ছা? এই ধর তো ওকে। তোকে আমি খেলতে মানা করেছিলাম না?
- কে তুই বাল! তুই আমাকে মানা করবি, আর আই মাস্ট লিসেন? ওহ গড । ইউ আর কিডিং
- কিডিং করছি না কি করছি আজকেই বুঝবি।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। খুব বাজে ভাবেই ঘাবড়ে গেলাম। ব্যাপার হল, আমি জানি রাকা পালাবে না। কারন ওর মধ্যে এই মারামারির পোকা টা আছে। এই ব্যাপার টা তে ও খুব ম্যানলি ফিল করে। আমার মধ্যে ম্যানলি ব্যাপার টা নেই তাই ভয় ও পাই। তাই খুব ঘাবড়ে গেছি। রাকা কিন্তু খুব ই এগ্রেসিভ। তা সে বন্ধুত্বের ব্যাপারেই হোক বা শত্রুতার ব্যাপারে। যার বন্ধুত্ব এতো মারাত্মক, তার শত্রুতাও তেমন ই ইন্টেন্সিটি মেন্টেন করবে স্বাভাবিক ভাবেই। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার ই চোখে সামনে রাকা কে ধরতে এলে রাখা খানিক খুব হাত পা ছুঁড়ল। তাতে দু বার নিজেকে ছাড়িয়েও নিল। কিন্তু ততক্ষনে রনি বলে ছেলেটা রাকা কে পিছন থেকে চেপে ধরেছে। তিনটে ছেলের সাথে রাকা আর কি করে যুঝবে? রাকাকে ওরা কাবু করে ফেলল চোখের পলকেই। আমি না তখন প্রায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। মনে হচ্ছে কোন সিনেমা দেখছি। চমক ভাঙল যখন দেখলাম রাকা কে পিছন থেকে হাত গলিয়ে ঘাড়ের কাছে চেপে ধরে একেবারে কাবু করে ফেলেছে রনি। আর সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলের হাতে একটা করে সরু বাশের লাঠি।
এদিকে রনি চেঁচাচ্ছে,
- কালকে ওর খেলা, তোরা মার ওর পায়ে। কাল যেন খেলতে না পারে।
আমি না কিছু বুঝতে পারছি না তখন ও। কিন্তু এটা বুঝলাম ওরা রাকার পায়ে মারবে। একটা ছেলের খেলা নিয়ে লোকের কীসের এত সমস্যা কে জানে। আমি জানতাম আমি খুব বড় সমস্যার মধ্যে আছি। রাকার এই সমস্যা টা আমার চোখ খুলে দিল বলতে গেলে। ওর পায়ে মারবে কী? পায়ে কিছু হয়ে গেলে ও খেলবে কি করে? মাথা কাজ করল না। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধীর পায়ের এগিয়ে গেলাম। যারা বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা মনে হয় আমার এগিয়ে যাওয়া টা কে গুরুত্ব দিল না। ওদের মারার আগের মুহুর্তে, রনি কে আমি পাশ থেকে মারলাম একটা পাঞ্চ। খট করে আওয়াজ টা হতেই আমি চোখ বুঝে নিয়েছি। ধপ করে একটা আওয়াজ পেতেই মনে হল,
- যাহ্ , রাকা কে বসিয়ে দিলাম না তো। হাত তো আমার কাঁপছিল তখন।
মায়ের গলায় অভিমানের সুর থাকত। আর বাপি ও একশবার সরি বলত মা কে। আমরাও তিন ভাই বোনে খুশ। ওদের মেজাজ ঠিক থাকলে আমারাও খুব আনন্দে থাকতাম। আমাদের ও বয়স অনুযায়ী প্যাম্পার করা হত। কিন্তু একটা ব্যাপার মনে দাগ কাটত সেটা হল, এই যে বাপি, নিজের নিয়ে কত গর্ব করে। মা গর্ব করে নিজের ইনভল্ভমেন্ট , বা আমাদের মানুষ করা নিয়ে। ওদিকে রাকা ও বার বার বলে, শালা মর্দ হতে পারছিস না। এই টুকু তেই কাহিল হয়ে পড়লি।সেও নিজের মর্দাংগির প্রত্যক্ষ গর্বে মশগুল। বা মায়ের সামান্য হাত কেটে গেলে বঁটি তে, বাপি আঙ্গুল চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করত আর মা বলত,- ছাড়ো তো, মেয়েদের এমন অনেক হয়। অতো ধরলে কি চলে নাকি? মানে সবাই জানে তাদের গরিমা, তাদের ক্ষমতা, তাদের সহ্য শক্তি, তাদের ইমোশন। কিন্তু কই আমার তো কোন দিন ছেলে হওয়া নিয়ে গর্ব বোধ আসে নি? কেন আমার মনে হয়েছে, এই শরীর, এই পোশাক, এই গর্ব আমার না, গর্ব এই ছেলে শরীর টার। তার ভিতরে কি আছে কে আছে, কে মাথা ঘামাচ্ছে?
পর্ব পাঁচ
কলেজের মেয়েরা আসে, নিজেদের সুন্দর করে। কি সুন্দর লম্বা লম্বা নখ রাখে ওরা। লম্বা চুল। একটা গরিমা যেন চোখে মুখে ফুটে বেরোয়। আমি কেন পারি না, নিজের পুরুষ হবার গরিমা জাহির করতে? বা আমি কেন পারিনা, আমি মেয়ে সেই কথা টা সবাই মুখ ফুটে বলতে? ক্লাস এইট এ থেকেই আমি বুঝে গেছিলাম, আমাদের সমাজ নতুন কোন কিছুই মেনে নিতে পারে না। সেটা নিয়ে উপহাস করে, উক্তি কটুক্তি তে ক্ষতবিক্ষত করে, আর না হলে সরাসরি রিজেক্ট করে। আমি তো আরো ভয়ে থাকি। কারন আমি নিজের চোখে দেখেছি সে দৃশ্য।
আমরা তখন ক্লাস সিক্স এ পড়তাম। ক্লাস ইলেভেনের একটি ছেলে ছিল, নাম ছিল কার্তিক। শুনলাম আমাদের কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করছিলাম মায়ের। ততক্ষনেই জানলাম, একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে মেয়েদের বাথরুম এ। দুটো হাতের ই শিরা কেটে ফেলেছিল। আমি দাড়িয়েই ছিলাম যখন ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল স্ট্রেচার এ করে। মা আমার চোখ দুটো নিজের হাত দিয়ে আড়াল করে দিয়েছিল। ফাঁক দিয়ে আমি যতটুকু দেখতে পাওয়ার দেখতে পাচ্ছিলাম। কার্তিক বেঁচে ছিল মনে হয় তখনো। দুটো হাত ঝুলে পড়েছিল ওর। ওর ই জামা দিয়ে বাঁধা ছিল কব্জির ওখান টা। কিন্তু চুইয়ে চুইয়ে রক্ত টপাচ্ছিল হাত থেকে কলেজ প্রাঙ্গন এ। বুকের বাম দিকে মোচর দিয়েছিল মারাত্মক।
পরে শুনেছিলাম, কার্তিকের হাব ভাব মেয়েদের মতন ছিল। ওকে সবাই কলেজে ক্ষেপাত। বাড়িতে বকত। টিচার্স রাও ছেড়ে কথা বলত না। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট হওয়া সত্ত্বেও একটা প্রাণের বলি সেদিন হয়েছিল। হয়ত কেউ দায়ী নয়, কিন্তু দায় টা সবার মনের মধ্যে বসে গেছিল। আজকে আমার ওকে খুব আপন মনে হয়। কিন্তু আমার থেকে ও অনেক সাহসী ছিল। নিজের কথা ও রাখতে পেরেছিল সবার সামনে। আমার মধ্যে তো সেই সাহস টুকুও নেই। আমি তো বাপির চোখের দিকে তাকালেও ভুলে যাই আমি কি চাই।
সবাই তারপরে, তার নামে হয়ত অনেক ভালো কথা বলেছিল। হয়ত বুঝেছিল, অতো টা ওকে একা করে দেওয়া ঠিক হয় নি। বা বুঝেছিল, আরেক টু কাছে টেনে নিলে হয়ত অকালে এই প্রাণ টা ঝরে যেত না। কিন্তু একটা তাজা প্রাণ চলে যাবার পরে এই সব ভাবনার তো মানে হয় না তাই না? ওর জন্য আমার চোখে জল আসে। হয়ত ওর বাবা মা ও স্ট্রিক্ট ছিল আমার বাবা মায়ের মতন। হয়ত ওরা ভেবেছিল, মরে গেছে আপদ গেছে। তখন আমি ছোট ছিলাম, আমার মা আমাকে পরের দিন ও কলেজে পাঠায় নি আর। কিন্তু আমার আজকেও জানতে ইচ্ছে করে, কার্তিকের বাবা কি কান্না কাটি করেছিল কার্তিকের জন্য?
আমার কান্না পায় সেই জন্য। নিজের এই ব্যাপার গুলো কে যে কি কস্ট করে দাবিয়ে রাখি আমি ই জানি। খালি ভয় লাগে, যদি আমার বাবা মা জেনে যায় আর ওরাও আমাকে না চায়? আমি কার্তিকের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম, কারন আমার জানার ইচ্ছে ছিল, কার্তিকের বাবা মায়ের ভালোবাসা কি কমে গেছিলো? কার্তিকের ভাই বোন ওকে কেমন চোখে দেখত? নিশ্চই খুব উইয়ার্ড ভাবত কার্তিক কে। তাই কার্তিক এই পৃথিবীতে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন আরো কান্না পায় আমার।
আমিও বুঝতে পারছি, আমিও ধীরে ধীরে একা হয়ে পড়ছি। মানসিক ভাবে। এমন না যে কেউ আমার সাথে মিশতে চায় না। কিন্তু আমি নিজেকে আলাদা করে নিচ্ছি। আমার কেন জানিনা ভয় লাগছে, যদি কেউ কিছু বুঝে ফেলে আমার ব্যাপারে। তাই এড়িয়ে থাকছি দূরে দূরে থাকছি। বাড়িতেও বিশেষ কথা বলি এমন না। বার বার মনে হচ্ছে মা কিছু বুঝে গেল। বাপি কিছু ধরে ফেলল। সব সময়ে একটা ভয় কাজ করছে মনের মধ্যে আমার। কোন কারনে মা যদি আমাকে দেখছে, তাহলেই ভয় লাগছে। ভয় লাগছে মা যদি আমাকে দূরে ঠেলে দেয় আরো? বাপি কে তো ভাবি ই না। আমার কাছে মা ই সব। মা যদি কোন কারনে আমাকে সরিয়ে দেয়, আমার ও হাল কার্তিকের মতই হবে।
উল্টো দিকে, নিজেকে আর এই ভুল শরীরে নিজেকে আমি মেনে নিতেও পারছি না। আজকে না হোক কালকে, সবাই বুঝবে, আমার এই শরীরের ভিতরে কোন ছেলে নেই, আছে একটা মেয়ে। তখন কি হবে? আমি যতই লোকানোর চেষ্টা করি, ব্যাপার টা বাইরে আসবেই। আমাকে এখনি দেখতে আলাদা লাগে ছেলেদের থেকে। মেয়েদের মতই গোল মুখ। সামান্য লোম ও নেই। ঠোঁটের গঠন ও মেয়েদের মতন। ফুটবল খেলার জন্য যে পেশী তৈরি হয়েছিল, সেগুলো আসতে আসতে আবার নরম হচ্ছে। জানিনা কি হবে। হয়ত আরো খেললে ব্যাপার টা ঠিক ঠাক হবে, কিন্তু খেলতেও ভাল লাগে না, যা ছেলেরা খেলে। কারন ভিতরের নেশা টা বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে মেয়ে হিসাবে দেখার নেশা। ভিতরের কয়েদ খানায় বন্দী থাকা ইচ্ছে গুলো কে বাইরে বের করে ওড়ার নেশা।
ইতিমধ্যে একদিন কি হল, আমাকে রাকা বলল
- তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে
আমরা সেই তাশী নদীর তিন মাথার মোড়ে মোমো খাচ্ছিলাম। আমি বললাম
- কি বল?
বলল
- না এখানে হবে না , আমার বাড়িতে গেলে দেখাব।
অধৈর্য লাগছিল নিজের। কিন্তু কিছু বললাম না। আমি এতো দিনে জেনে গেছি ও কোন খারাপ সারপ্রাইজ আমাকে দেয় না। মনে মনে ফুটছিলাম আমি, কবে শনিবার আসবে। কথা মতো শনিবার দিন ওর বাড়ি যেতে, আন্টি আমাদের খাওয়ালো। ওর বাড়িতে গেলে শনিবারে দুপুরের লাঞ্চ টা ওর বাড়িতেই হয় আমাদের। ভাত, আলু ভাতে, গরম ডাল আর কোন দিন চিকেন থাকে, কোন দিন মাছ থাকে। আমার মন্দ লাগে না। আমি আন্টির কাছে এই খাওয়া টা সময় নিয়ে খাই। খেতে আমার একটু সময় লাগে। ধীরে ধীরে খেতে আমি পছন্দ করি। কিন্তু সেদিনে আমার কোন মন ছিল না। মন ছিল সারপ্রাইজে।
খেয়ে দেয়ে সেই পোড়ো বাড়ির ঘরে যেতেই ও আমাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল আমার হাতে। আমি অবাক হয়ে বললাম
- কি এটা?
- খুলেই দেখ।
আমি তাড়াতাড়ি খুলে ফেললাম প্যাকেট টা। দেখলাম, একটা নীল রঙের কোন পুরোন ঘাঘরার মতন পোশাক আর তার সাথে একটা ছোট প্যাকেট। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। যে ইচ্ছে কয়েদ ছিলো , ওকে কোন দিন বলিও নি, সেই রকম একটা ইচ্ছে পুরন করছে আজকে ও আমার। সেই প্যাকেট টা খুলে দেখলাম, কিছু ফলস নেল, একটা ইমিটেশনের হার, দুটো কানের ঝুমকো মতন। অন্যান্য ছেলেরা হয়ত এই গুলো কি জানত ও না। কিন্তু আমার ইন্টারেস্ট ছিল এই সব ব্যাপারে। তাই আমি জানতাম, কোন টা কি গয়না। কোন ড্রেস এর কি নাম। বিশেষ করে মেয়েদের। আমার খুব আনন্দ হল। কিন্তু সমস্যা হল পরতে জানি না আমি। বুকের ভিতর টা ঢিবঢিব করছিল আমার। আমি ড্রেস টা দেখছি, আর রাকা কে দেখছি। আর ভাবছি কি ভাবে ও বুঝল আমার ইচ্ছে। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম
- এগুলো কেন আনলি?
ও তখন নিজের এমপ্লিফায়ার টা রেডি করছিল। ওদিকে তাকিয়েই বলল
- আমি তোর নাচ দেখছিলাম গত কয়েক শনিবার আর ভাবছিলাম, ইউ ডান্স ব্রিলিয়ান্টলি। কিন্তু কীসের যেন একটা অভাব ছিল। গত দুই তিন সপ্তাহ ভেবেও আমি বের করতে পারিনি। কিন্তু গত শনিবার তুই - বাবুজি ধীরে চলনা গান টায় নাচ ছিলিস, আর তখন আমার মাথায় এল যে, প্রপার ড্রেস না পরলে তো , যে বিট গুলো তুই নিচ্ছিস নাচে, সে গুলো বোঝা যাচ্ছে না।
আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মানে আমি যে ভাবতাম ও জাস্ট আমার জন্যেই আমার নাচ দেখছে, ব্যাপার টা সেরকম না। ও খেয়াল ও করেছে আর যেটা দরকার সেটার ব্যবস্থা ও করেছে। আমি মনে তার পর থেকেই ওর উপরে নির্ভরশীল হয়ে পরেছিলাম নিশ্চিত ভাবেই। কত ঝড় গেছে। কিন্তু ও আমার হাত ছাড়ে নি। আর ওর উপরে আমার ভরসা দিনে দিনে বেড়ে গেছে সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
মুশকিল হল, আমি তো কোনদিন ও পরিনি, মেয়েদের কোন পোশাক। কাজেই ওই ঘাগরা টা পরতে সময় লাগল একটু। কিন্তু অর্নামেন্ট গুলো পরে ফেললাম। সমস্যা হল, কানের ঝুমকো পরতে গিয়ে। কারন আমার কানের ফুটো করা ছিল না। সে যাই হোক, জীবনে আবার আমি আনন্দ পেলাম। একটা ছোট আয়নায় দেখলাম নিজেকে। কোন সস্তার লিপস্টিক এনেছিলো রাকা। সেটাই লাগালাম। নিজেকে দেখে নিজেই আপ্লুত হয়ে গেলাম বলাই বাহুল্য। আমার যেন এনার্জির কোন কমতি ছিল না সেদিন। একের পর এক গানে আমি নাচলাম। সবটাই আমার ফোনে রেকর্ড করল রাকা।
হয়ে যাবার পরে আমার তো ড্রেস টা ছাড়তেই ইচ্ছে করছিল না। তাও সন্ধ্যে হয়ে আসছে ভেবে, ছেড়ে নিলাম ড্রেস টা। রাকা ওর একটা রুমাল দিয়ে আমার লিপস্টিক মুছিয়ে দিল। আমি সব সাজ এক এক করে ছেড়ে ফের সুন্দর করে গুছিয়ে ছোট প্যাকেট এ ভরে রেখে দিলাম। ঘাগরা টা কে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিলাম প্যাকেট এ। একটা পুরোন ট্রাঙ্ক ছিল, সেখানে রাকা রেখে দিলো দুটো কেই। তারপরে আমরা বেড়িয়ে পরলাম, কলেজ ড্রেস পরে।
সাইকেল টা তে পাম্প ছিল না। দিতে দিতে রাকা কে বললাম,
- থ্যাঙ্কস
- কেন?
- তুই বুঝতে পারছিস না কেন?
আমার বলতেও ওকে কেমন লাগছিল, যে আমি ওই মেয়েদের ড্রেস পরা টা খুব এনজয় করেছি। বা বলা ভালো, ও আমার একটা স্বপ্ন আজকে পূরন করেছে। কিন্তু সেটা বলতে পারছি না। ও কিছু বলল না আমাকে। দুটো চাকা টিপে দেখে বলল,
- আর পাম্প দিতে হবে না চল।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম তাশীর পাশ দিয়ে। আজকে দারুন খুশী আমি। দারুন খুশী। খুশীর কোন সীমা নেই মনে হচ্ছে। ওকে আমি ই বললাম,
- তোকে থ্যাঙ্কস দিলাম কারন, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল আমি মেয়েদের ড্রেস পরব। আর তোর জন্য আমি সেটা পরতে পারলাম।
রাকা জানিনা ব্যাপার টা বুঝল কিনা। আমাকে কোন সাড়া দিল না ও। পাশে পাশে হাঁটছিল। কখনো কোন ইটের টুকরো, দূরে ছুড়ে দিচ্ছিল তাশির জলে। আবার চলে আসছিল পাশে। মনে হল ও আমার কথা গুলো শুনতে চাইছে না। একটু অন্য রকম লাগলেও আমি কিছু মনে করলাম না। এই সবের পরেও ও আমাকে ঘেন্না করছে না বা আমাকে উইয়ার্ড ভাবে নি এটাই অনেক। কিছু টা হলেও ওর সাথে থাকলে আমি ফ্রি থাকি। বাকিদের সাথে যে ভয় টা কাজ করে, ওর সাথে থাকলে সেই ভয় টা আমি পাই না। আমি চুপ রইলাম। ওকে আর ঘাঁটালাম না। আমি সাইকেল টা ধরে হাঁটছি। ও এদিক ওদিক করছিল তখন। কখন আমার ডান দিকে চলে আসছে, ইটের খোঁজে। বা কখনো এগিয়ে যাচ্ছে ইটের খোঁজে। কিন্তু অনবরত জলে ইট মেরেই যাচ্ছে ও। হঠাৎ একটা বড় ইট জলে ছুঁড়েই আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
- শোন, তোর যখন ইচ্ছে করবে, আমাকে ফোন করে দিবি। মানে এই সাজ গোজের ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে হলে বা নাচের ব্যাপারে। আর এর বাইরেও কোন ইচ্ছে থাকলে সেই ব্যাপারেও।
আমি বুঝতে পারছিলাম না। একটু আগে যা বুঝলাম ও আমার কথা শুনছিলো ও না। আর এখন কি হল যে একেবারে এই কথা বলছে? আমি ওকে বললাম,
- একটু আগে তো শুনলিও না আমার কথা। এখন আবার এই কথা বলছিস?
- না না শুনিনি এমন না। শুনছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে অন্য কথা চলছিল তখন।
- কি কথা?
- ধুর বাল, অতো জানতে হবে না তোকে। যদি দরকার পরে সেই কথা বলার তোকে নিশ্চই বলব। এখন তোকে যেটা বললাম সেটা করবি।
রেগে গেল কেন সেটাও বুঝলাম না। ও আমার উপরে রাগ দেখালে আমার রাগ হয়। কিন্তু এবারে ওর উপরে রাগ করলাম না। কেননা, ওর কোন ব্যাপার নেই আমি রেগে গেলাম কি না গেলাম।বলেছিলাম না, আমাকে ও শুধু বন্ধু হিসাবে দেখে মাত্র। লাস্ট এক্সাম এও আমার সাজেশন এ ব্যাটা নাম্বার পেয়েছে ভালই। তবুও আমার উপরে রাগ করল। মানে আমার সাথে কোন স্বার্থের জন্য ও থাকে না। বা আমাকে আমার ইচ্ছে গুলো কে ওর নিজের জন্যেও ও পূরন করে না। নেহাত ভালো বন্ধু তাই ও করে। বা ও এটাও ভাবে নি যে আমাকে ওমনি করলে আমি রেগে যেতে পারি। র্যাদার আমি কিন্তু ওর চোখে একটা চিন্তা দেখলাম কথা গুলো বলার সময়ে। ও কিন্তু বলেই চলে,
- তোর যখন মনে হবে ওই সব কথা বলতে, আমাকে ফোন করবি। রাতের দিকে করিস। আমি মায়ের ফোন টা নিয়ে রেখে দেব। কিন্তু মন গুমরে থাকবি না বুঝলি? আর তোর বাবা মা যেন না বোঝে। বা আমার মা। বা কলেজে কেউ। মনে থাকবে?
আমি তখন ও ওকে দেখছিলাম। ও এতো চিন্তিত কেন ব্যাপার টা নিয়ে সেটা বুঝতে পারছি না আমি। কিন্তু ঠিক আছে। ওকে বললাম
- সে ঠিক আছে। কিন্তু তোকে আরো কিছু বলার আছে।
- বল, এই সংক্রান্ত যা কথা, আমাকে বলবি। সমস্যা হলে দুজনে মিলে যুক্তি করব। কিন্তু একা একা কিছু ভাববি না একদম
- না রে বাবা। একলা ভাবতেই পারি না আমি। সময় কোথায়?
- আচ্ছা বল কি বলবি?
- তুই আজকে আমার একটা বহু দিনের সখ মিটিয়েছিস। কিন্তু কি বলত, আমার না মাঝে মাঝে খুব ডিপ্রেসড লাগে।
- কেন?
- মনে হয়… মনে হয়……
নিজেকে আটকে নিলাম। বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না আমি। ও আমাকে নক করল আবার
- কি রে বল কি বলবি?
- জানিনা । কি ভাবে বলব সেটাও বুঝতে পারছি না। এই যেমন আজকের এই কথাটাই আমি তোকে সাহস করে বলতে পারিনি।
- কোন কথাটা?
- এই মেয়েদের ড্রেস পরতে পছন্দ করি, এই ব্যাপার টা।
- হুম।
- আমি ভাবতাম কি জানি কি মনে করবি। আমার নাচের ইচ্ছে হয়ত তুই পূর্ন করেছিস, কিন্তু সব ইচ্ছে শুনতে যাবি ই বা কেন?
- আরে আমাকে বলেই তো দেখতিস। তুই আমাকে বলেছিলি, ইউ উইল নেভার স্টপ কিপিং ট্রাস্ট অন মি।
- হ্যাঁ বলেছিলাম। আর আমি তোকে ট্রাস্ট করিও। কিন্তু এই কথা গুলো, হয়ত তোকে বোঝাতে পারছি না আমি, নিজেই মানতে পারি না। তাই একটা ভয় লাগে।
- কীসের ভয় ভাই?
- ভয় লাগে হয়ত তুই আমাকে ভুল বুঝলি। আর এই ফ্রেন্ডশিপ টা আর রাখলি না।
- ধুর পাগলা। আমি একটু অন্যরকম রে।
ওই বয়সে কেই বা বোঝে, যে ভালোবাসে তোমাকে তাকেই ভালোবাস। কিছু না বুঝেও যদি এই কানেক্ট টা হয়ে গেলে, কোন ব্যাপার থাকে না। মারামারি হলেও, ভাব হয়ে যায়। আর সত্যি ই ও অন্য রকম। নেহাত আমার জোরাজুরি তে পড়াশোনা টা করে। না হলে ওর কাছে রেজাল্ট কোন ম্যাটার করত বলে আমার কোন দিন মনে হয় নি। ও বলেই চলে,
- বল এবারে কি বলতে যাচ্ছিলি। আমি তোকে বলে দিচ্ছি, যাই হয়ে যাক, তোর সাথে বন্ধুত্ব আমি কোন দিন নষ্ট করব না রে।
আমি তখন ও ভাবছি। মনে মধ্যে আকুলি বিকুলি করছে, যে ওকে বলে দি। আমি কি এবং কি ওরিয়েন্টেশন এর মানুষ আমি। কিন্তু বলতে পারছি না। আমি জানি ও যা শুনবে আমার থেকে সেটা ওর কাছে প্রথম বার শুনবে। ও বুঝতে হয়ত পারছে না কত খানি মুশকিল একটা মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া যে সে ছেলের শরীরে একটা মেয়ে। এবং সেটা যারা শুনবে, তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কত কঠিন সেটা আমি জানি। কারন আমার মা কে আমি দেখেছি। আমার মা হয়েও সে মানতে পারছে না, আর ও আমার এই মাস তিনেকের বন্ধু হয়ে কি ভাবে মেনে নেবে?
কিন্তু এই ব্যাপারে আমি ওকে আমার মায়ের থেকে বেশিই নির্ভর করি। জানিনা কেন করি। কিন্তু করি। সেই নির্ভরতাই, বার বার ওকে কথা গুলো বলার জন্য একটা ধ্বনাত্মক ইচ্ছে মনে ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে। আমি মনে হয় ভাবনায় হারিয়ে গেছিলাম। চমক ফিরলে দেখলাম, আমরা সেই তিনমাথার মোড়ে এসে হাজির। আজকে পয়সা কম ছিল। ভেজ চাউমিনের অর্ডার দিলাম।
একটা বাড়ির পাঁচিলে দুজনে হেলান দিয়ে খাচ্ছি। আমার সাইকেলের কেরিয়ার এ রাকা বসে আছে আমার দিকে মুখ করে। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি রাকা দিকে মুখ করে। ও খেতে খেতে বলল আমাকে,
- আমি বুঝতে পারছি, তুই হেসিটেট করছিস। কিন্তু তুই বলতে পারিস আমাকে। বা যখন তোর বলতে ইচ্ছে হবে বলিস আমাকে। আমি জোর করছি না তোকে।
- না বলতে তো ইচ্ছে করছে। কিন্তু একটু সময় দে আমাকে।
- ওকে।
খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে, আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কিছু টা এসেই একটা জায়গা আছে, সেই জায়গা টার নাম হল, দক্ষিনা কালী রোড। সেখান টা একটু ফাঁকা থাকে। আমরা এই জায়গা টা আসার আগে অব্দি চুপ করেই হেঁটে এসেছি। আমি সময় নিচ্ছি ওকে কথা টা বলতে। মনে ভাবনার ঝড় চলছে আমার। বলার পরে ও বন্ধুত্ব ছেড়ে দিলে আমার সব দিক যাবে। কিন্তু আজকে না জেনে ,পরে জানলে তখন ও যাবে বন্ধুত্ব। রিস্ক তো আমাকেই নিতে হবে। সত্যি ই তো। আমি যদি ভয়ে ওর বাড়িতে নাচ না করতাম, বা আজকে যদি ড্রেস না পরতাম, তবে তো এই আনন্দ টাও পেতাম না। কে বলতে পারে, রাকা আমাদের বন্ধুত্বে কোন আঁচ আসতেই দিল না। বা হয়ত রেগে গেল, কিন্তু বন্ধুত্ব টা রেখে দিল। সব রকম পসিবিলিটি আছে। কিন্তু আমার সব চিন্তা গুলোই ভ্যালিড হবে ,যদি আমি কথা টা ওকে বলতে পারি। ও কোন কথাই বলছে না। ছেলেটা কিন্তু এই ব্যাপারে ম্যাচুওর। আমাকে সময় দিচ্ছে। অনেক ক্ষন সময় নেবার পরে, আমার বাড়ি আর ওই তিন কিমি মতন, তখন ঠিক করে নিলাম ওকে বলেই দি। বলতে গেলাম,
- বেশ শোন তবে বলি, আমার মনে হয়…
কথার মাঝেই কেউ চেঁচিয়ে উঠল,
- কিরে শালা, রাকা, নতুন গার্লফ্রেন্ড নাকি তোর?
আমি এদিক ওদিক তকিয়ে দেখলাম দু তিনটে ছেলে ছেলে সামনেই দাঁড়িয়ে। আমি চিনি না। কারন আমাদের কলেজের না। কিন্তু রাকার উত্তর ভেসে এল
- কেন তোর ও কি ছেলে গার্লফ্রেন্ড নাকি? রনি, ফালতু ঝাঁট জ্বালাস না। আগের বারে মতন কিন্তু এবারেও ক্যালাবো।
- আচ্ছা? এই ধর তো ওকে। তোকে আমি খেলতে মানা করেছিলাম না?
- কে তুই বাল! তুই আমাকে মানা করবি, আর আই মাস্ট লিসেন? ওহ গড । ইউ আর কিডিং
- কিডিং করছি না কি করছি আজকেই বুঝবি।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। খুব বাজে ভাবেই ঘাবড়ে গেলাম। ব্যাপার হল, আমি জানি রাকা পালাবে না। কারন ওর মধ্যে এই মারামারির পোকা টা আছে। এই ব্যাপার টা তে ও খুব ম্যানলি ফিল করে। আমার মধ্যে ম্যানলি ব্যাপার টা নেই তাই ভয় ও পাই। তাই খুব ঘাবড়ে গেছি। রাকা কিন্তু খুব ই এগ্রেসিভ। তা সে বন্ধুত্বের ব্যাপারেই হোক বা শত্রুতার ব্যাপারে। যার বন্ধুত্ব এতো মারাত্মক, তার শত্রুতাও তেমন ই ইন্টেন্সিটি মেন্টেন করবে স্বাভাবিক ভাবেই। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার ই চোখে সামনে রাকা কে ধরতে এলে রাখা খানিক খুব হাত পা ছুঁড়ল। তাতে দু বার নিজেকে ছাড়িয়েও নিল। কিন্তু ততক্ষনে রনি বলে ছেলেটা রাকা কে পিছন থেকে চেপে ধরেছে। তিনটে ছেলের সাথে রাকা আর কি করে যুঝবে? রাকাকে ওরা কাবু করে ফেলল চোখের পলকেই। আমি না তখন প্রায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। মনে হচ্ছে কোন সিনেমা দেখছি। চমক ভাঙল যখন দেখলাম রাকা কে পিছন থেকে হাত গলিয়ে ঘাড়ের কাছে চেপে ধরে একেবারে কাবু করে ফেলেছে রনি। আর সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলের হাতে একটা করে সরু বাশের লাঠি।
এদিকে রনি চেঁচাচ্ছে,
- কালকে ওর খেলা, তোরা মার ওর পায়ে। কাল যেন খেলতে না পারে।
আমি না কিছু বুঝতে পারছি না তখন ও। কিন্তু এটা বুঝলাম ওরা রাকার পায়ে মারবে। একটা ছেলের খেলা নিয়ে লোকের কীসের এত সমস্যা কে জানে। আমি জানতাম আমি খুব বড় সমস্যার মধ্যে আছি। রাকার এই সমস্যা টা আমার চোখ খুলে দিল বলতে গেলে। ওর পায়ে মারবে কী? পায়ে কিছু হয়ে গেলে ও খেলবে কি করে? মাথা কাজ করল না। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ধীর পায়ের এগিয়ে গেলাম। যারা বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা মনে হয় আমার এগিয়ে যাওয়া টা কে গুরুত্ব দিল না। ওদের মারার আগের মুহুর্তে, রনি কে আমি পাশ থেকে মারলাম একটা পাঞ্চ। খট করে আওয়াজ টা হতেই আমি চোখ বুঝে নিয়েছি। ধপ করে একটা আওয়াজ পেতেই মনে হল,
- যাহ্ , রাকা কে বসিয়ে দিলাম না তো। হাত তো আমার কাঁপছিল তখন।