29-01-2022, 12:03 PM
(This post was last modified: 29-01-2022, 12:06 PM by nandanadasnandana. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
শিবের শিব প্রাপ্তি
প্রতি টা মানুষের ই নিজের জন্য কিছু সময় বের করা উচিৎ। এমন একটা সময় যেখানে সে নিজের মতন বাঁচবে। হতে পারে ওই টুকু সময়,সে কবি হয়ে বাঁচল, বা গায়ক, বা কারোর স্বামী, বা কারোর বউ। বা তার মধ্যে অনেক ফ্যান্টাসী থাকে যেগুলো নিয়ে তার মনের মধ্যে পাগলামি আছে। সেই গুলো নিয়ে সে বাঁচল। সেই সময়ে সে থাকবে একা। আর ওই টাই তার সময়। আমার মনে হয় এমন পাগলামো সবার মধ্যেই আছে। আর সে সেই পাগলামো টা কে ছাড়তে চায় না। কারন সেই পাগলামী তে তার সুখ। সেই সুখ আমার মনে হয় নেওয়া উচিৎ। কারন এতে সে আনন্দে থাকে। আর আনন্দে থাকা খারাপ না , বরং ভাল। নিজে আনন্দে না থাকলে আশে পাশের ঘটনা, মানুষ, কাছের মানুষ, বন্ধু বান্ধব, বর, বউ কেউ ই ঠিকঠাক ভাবে কারোর সাথে কমিউনিকেট করতে পারে না। যাই হোক এই কথা গুলোর প্রাসঙ্গিকতা আছে আমার গল্পের কাহিনীর সাথে।চলুন পড়ি এই গল্প টা। এই গল্প টাও আমার জবানী তেই লেখা। কিন্তু এই গল্প বাস্তব। বাস্তব থেকেই নেওয়া। হ্যাঁ আমার কল্পনার মিশেল তো আছেই। কিন্তু এই গল্পের ভিতরে কোন খাদ নেই। আমার আপনার মতই একজনের জীবনের সত্য এখানে উঠে এসেছে।
শুরু
কলেজ থেকে বের হয়ে আমি স্কুটি স্টার্ট দিয়ে বাড়ির দিকে গেলাম না। জানি মা চিন্তা করবে একটু। কিন্তু আজকে ভালো লাগছে না একদম। মন টা খুব খুব খারাপ।কেন খারাপ বলতে পারব না। গত মাস খানেক ধরেই কলেজ ছুটি হবার পরেই এমন মন খারাপ টা হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছিল, সেই জায়গায় যাই যেখানে গেলে আমার মন ভাল হয়ে যেত। সময় হচ্ছিল না। কলেজ ছুটির পরেও এতো কাজ থাকে বলার না। কাজের ফিরিস্তি দিলাম না আজকে আর। তাই আজকে ভাবলাম চুলোয় যাক সব কাজ। আজকে যাবোই। আর সময় নিলাম না, হেলমেট টা পরে নিলাম। গাড়ি ঘুরিয়ে তাশির ধার ধরে জোরে ছূটিয়ে দিলাম স্কুটি টা। চুল টা বেঁধে নিলে ভালো হত। লম্বা হয়ে গেছে বড্ড। বার বার চোখে পরছে আমার। এক হাতে বার বার কানের পিছনে গুঁজতে হচ্ছে আমাকে। কিন্তু গাড়ি দাঁড় করতেও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে পৌঁছতে পারলে ভাল হয়।
স্কুটি টা স্ট্যান্ড করে আমি গিয়ে বসে পরলাম নদীর ধারে আমাদের চেনা পাথরের উপরে। রোদের তেজ কমে গেছে। তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। কত পাথর স্রোতের টানে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ আটকে যাচ্ছে। এদের মধ্যেই কেউ কেউ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে একদিন। আবার তাকে নিয়ে নদী বইতে শুরু করবে সামনের দিকে। এটাই মনে হয় জীবনের সব থেকে বড় রূপক। রোজ স্বপ্নের টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া। রোজ সেই টুকরো জোড়া দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। মৃত্যুর আগে সব ইচ্ছে, সব স্বপ্ন, সব ভালো লাগা মন্দ লাগা গুড়ো গুঁড়ো হয়ে বালি তে রূপান্তরিত হবে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। সে খারাপ নয়। জীবনের তো এটাই মাহাত্ব্য। ভালোর সাথে খারাপের ও বলি হয়ে যায়। ভালো স্বপ্ন ও যেমন ভেঙ্গে চুর্ন বিচুর্ণ হয়ে যায়, তেমনি খারাপ স্মৃতি ও ধুলোর মতন মিলিয়ে যায়। তারপরে, বীতশোক, বীতস্পৃহ হয়ে মরন হোক, তাতে কার কি বলার থাকতে পারে?
কিছু দুরেই একটা আওয়াজে আমার চমক ভাঙল। দেখলাম একটা ভীষণ মিস্টি বাচ্চা খেলছে আমার পিছনের বিশাল ফাকা জায়গায়। সাথে একটা ছোট ফুটবল। সাথে কেউ নেই? এদিক ওদিক চেয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না আমি। কত হবে? চার পাঁচ বছরের একটা দস্যি। তাকিয়ে রইলাম আমি ওর দিকে। টুক্টুক করছে ফরসা। মুখের হাসি যেন সাত রাজার ধন। আহা কার বাচ্চা কে জানে? কত না ভাগ্যবতী সে মা। আমার কী? আমি তো আর জীবনে মা হতে পারব না। তখন কি ভেবেছিলাম? জীবনে এতো লড়াই করে এগিয়ে এসে, সব কিছু পাবার পরেও, আমার মনে এই আক্ষেপ রয়ে যাবে?
আমি ঘুরে গেলাম পিছন দিকে। ভালো লাগছিল ওকে খেলতে দেখে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ছেলেটি কে। মন ভালো হয়ে গেল। বলে না, ভগবান নিজে থেকে কাউকে খুশী বা দুঃখী হবার অধিকার দিয়ে রাখেন নি। উনি যা চান তাই হয়। মন টা খুব মুষড়ে ছিল আমার। না জানি কেন, ভালো হয়ে গেল। ডাকলাম বাচ্চা টা কে। ওমা! ডাকতেই কাছে চলে এল। সাধারণত আসে না বাচ্চা রা। তারপরে এই রকম সফিস্টিকেটেড একটা বাচ্চা। দেখেই বোঝা যায় বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের বাচ্চা। কিন্তু মন টা দশ গুন ভাল করে দিয়ে বাচ্চা টা প্রায় ছুটে এলো আমার কাছে। কাছে এসে টাল সামলাতে না পেরে সোজা আমার কোলে। আমিও প্রায় ওকে লুফে নিলাম আমার বুকে।
- উফ কি দুষ্টু কি দুষ্টু! অতো জোরে কেউ দৌড়ে আসে নাকি? ব্যাথা পেলে?
আমার কোলে ধুপুস করে পড়ে গিয়ে ঘাবড়ে গেছিল বাচ্চা টা। কিন্তু আমি আদুরে গলায় উপরের কথা টা বলতেই মুখে হাসি ফিরে এল। আমি দাঁড় করিয়ে দিতেই ওকে, জামা প্যান্ট থেকে কাল্পনিক ধুলো ঝেড়ে নিল একটু ও। আমি আবার এদিক ওদিক দেখলাম ওর সাথে কেউ আছে নাকি। কি অদ্ভুত, এমন একটা সুন্দর বাচ্চা কে কেউ একলা ছেড়ে দেয় নাকি? নাম জিজ্ঞাসা করতেই ছোট্ট উত্তর এলো
- শিভ।
- শিব?
আমার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল সে। কি বড় বড় চোখ! কাজল দিয়ে এঁকে দিয়েছে কেউ। হয়ত মা। না হলে অন্য কেউ। কিন্তু চোখ দুটো থেকে মায়া যেন গড়িয়ে পরছে। আমার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল,
- উঁহু ,শিব না, শিব না। এস এইচ আই ভি, শিভ
আমার হাসি পেয়ে গেল ওর বলার ভঙ্গী তে। কেমন বড়দের মতন করে বলল দেখ? মনে হচ্চে চটকে দি একেবারে। বললাম ওকে,
- ওমা এতো আমার নাম। আমার নাম শিবানী। ডাক নাম শিব। এস এইচ আই বি।
- ও তুমি শিব আর আমি শিভ
- হ্যা ঠিক বলেছ। একলা এসেছ? কেউ আসে নি সাথে?
যাহ শুনলোই না। ততক্ষনে কোল থেকে উঠে বলের কাছে ফিরে গেছে ও। বল টা নিয়ে পাগলের মতন এদিক ওদিক দৌড়োতে শুরু করার আগে, ঘাড় নেড়ে আমাকে – না কথাটা বলে দিয়ে গেল ও। কেউ নেই সাথে ওর? এটা তো হতে পারে না। দেখি জিজ্ঞাসা করি, কিছু জানতে পারি নাকি।এগিয়ে গেলাম। ওর সাথে খেলতে খেলতেই কথা বলে জানতে হবে। নাকি ওর ফুটবল খেলা দেখে আমার ও ফুটবল খেলার পোকা টা মাথায় চড়ে বসল? পা থেকে আমার স্যান্ডেল টা খুলে রাখাই ছিল। নুপুর দুটো কে খুলে পার্স এ রাখলাম আমি। কোমরে ওড়না টা বেঁধে নিলাম আমি। কেউ তো নেই আশে পাশে। বুক ঢাকার দরকার নেই। এগিয়ে গেলাম শিভ এর দিকে। বলটা চাইতেই ও দিয়ে দিল। জানিনা পারব কিনা। বল টা পায়ে নিয়ে নাচাতে শুরু করলাম আমি। বাহ এই তো পারছি এখনো। কখনো পায়ের পাতা দিয়ে, বা ব্যাক হিল দিয়ে ছোট ছোট টোকা দিয়ে আমি বল টা নাচাতে নাচাতে, বল টা শিভ কে দিচ্ছি । ও আমার বল নাচানো দেখে হাত তালি দিতে দিতে বল টা আমার দিকে ফেরত দিচ্ছে আবার। আমি আমার বল টা পায়ের টোকায় তুলে নিয়ে কিছুক্ষন নাচিয়ে আবার ওকে দেখছি।
উফ ঘেমে গেলাম একেবারে। কত দিন বাদে পা ছোঁয়ালাম আমি। যদিও আমি বেশ স্লিম। লম্বা বেশ আমি। পাচ ছয় হব। ওজন একদম মাপেই রেখে দি আমি। পঞ্চান্ন ছাপান্নর ধারে কাছে থাকে ওজন আমার। বলটা কে আর না নাচিয়ে একে অপর কে ছোট ছোট শটে দেওয়া নেওয়া করতে লাগলাম। ও আমাকে বলটা দিয়েই হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছে। কি মিস্টি! সবেতেই আনন্দ যেন। আমাকে বলল,
- আমার পাপাও পারে ওমনি বল নিয়ে জাগল করতে।
- তাই? কি নাম তোমার পাপার?
ঠিক সেই সময়ে, - ছোটেএএএ সাআআব বলে একটা চিৎকারে তাকিয়ে দেখি, একটা ঢাউস কালো গাড়ি দাঁড় করানো, আর সেখান থেকে একটা লোক, সম্ভবত ড্রাইভার হবে, ছুটে আসছে আমাদের দিকে। বুঝলাম, এই বাচ্চা টা কেই ছোটে সাব বলছে। মানে আমি ঠিক ছিলাম। এ কোন বড় ঘরের বাচ্চা। ছেলেটি আমার উত্তর দিতে গিয়েও দিতে পারল না। আমাকে বলল,
- চলে এসেছে আমাকে নিতে। উফ একটু খেলতেও দেয় না আমাকে।
আমি আবার হেসে ফেললাম বলার ধরনে। পেকাম একেবারে। বললাম
- তুমি যাও। সন্ধ্যে হয়ে আসছে না? কালকে আবার এস কেমন?
- তুমি আসবে কালকে?
- হুম তুমি চাইলে আসব। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি না, তুমি আমাকে পছন্দ করলে কিনা?
- প্লিস এস কালকে।
- আচ্ছা আসব।
ড্রাইভার টা ততক্ষনে এসে বাচ্চা টা কে কোলে তুলে নিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
- খুব দুষ্টু। সারাদিন খেলতে দিলে ভালো ওকে।
আমি হাসলাম ড্রাইভারের দিকে চেয়ে। দেখলাম শিভ কে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল। আর সে কোলের মধ্যে হাত পা ছুঁড়ছে। ছাড়িয়ে নিতে না, আনন্দে। খুশী হয়ে গেছে পুচকু টা। আহা, এখন কার দিনের বাচ্চা। না বাবাকে পায় সময়ে, না মা কে পায়। আমিও খুশি হয়ে গেছিলাম। নদীর জলে পা টা ধুয়ে নিলাম। নুপুর দুটো পরে নিলাম। ওড়না টা বুকে জড়িয়ে, চুল টা বেঁধে নিলাম পিছনে, পনি টেল করে। করি না সাধারণত আমি পনি টেল। লম্বা হয়ে গেছে দেখতে বাজে লাগে। কিন্তু গাড়ি চালাব। খুলে রাখলে ভালো লাগে, কিন্তু হাওয়ায় উড়বে। থাক কাকেই বা ভালো লাগাব। এই রুদ্রপুরে সবাই আমাকে চেনে। গত আঠাশ বছর ধরে আমাকে চেনে। জন্ম থেকে আমাদে দেখছে এরা। চোর ডাকাত অব্দি আমাকে চেনে। সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয় আমার। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমি।
- কি রে? এতো দেরী আজকে?
মায়ের প্রশ্ন টা ডজ করে তাড়াতাড়ি বাথরুম এ ঢুকে গেলাম। ঘেমে গেছি আজকে বেশ। শাওয়ার টা চালিয়ে দিলাম। উফ ঠাণ্ডা হল শরীর টা। একটা স্কার্ট আর টপ পরে বাথরুম থেকে বেরোলাম। ব্যালকনি তে শোকাতে দিলাম কাচা সালোয়ার, অন্তর্বাস। ডাইনিং এসে দেখলাম বাপিও চলে এসেছে বাড়ি।
- মা ভাই ফেরে নি এখনো?
- না। দেখোগে তোমার ভাই , তার হবু বউ এর সাথে কোন ডেটিং এ আছে নাকি।
রান্না ঘর থেকে উত্তর ভেসে এল মায়ের। উফ একেবারে শার্লক হোমস এর লেডি এডিশন। আমি বাপির দিকে তাকালাম। দেখলাম বাপি হাসছে। সামনে মোবাইল টা খোলা বাপির। ইদানিং, রিটায়ার করার সময় ঘনিয়ে আসছে আর মোবাইল এর প্রতি উৎসাহ বাড়ছে বাপির। মায়ের গলা রান্না ঘর থেকে তখনো আসছে
- বললি না, দেরী করলি কেন আজকে? কখন তো ফোন করেছিলি বাবা, যে মা বেরোচ্ছি।
উফ, ছাড়বে না । সব প্রশ্নের উত্তর চাই। অতি বিরক্ত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে বললাম,
- কাজ ছিল একটুউউ।
তারপরে বাপির দিকে ঘুরে বললাম
- বাপি এতো মোবাইল নিয়ে ঘেঁটো না। চোখ দুটো যাবে কিন্তু।
আমার শাসনে, ফোন টা রেখে দিল। ততক্ষনে মা মুড়ি আর চা নিয়ে আসছে। এসেই বলল
- হ্যা, তুই বললি বলে রেখে দিল। আমি বললে রাখত না।
আমার বাপি এখন সাধু সন্ত হয়ে গেছে। মায়ের কথায় বিশেষ উত্তর দেয় না। শুধু হাসে। অর্থবাহী হাসি। আমিও মুচকি হেসে মায়ের হাত থেকে মুড়ির বাটি টা নিয়ে খেতে শুরু করলাম। চা আমি খাই না। সকালে এক কাপ খাই তাও গ্রীন টি। মা ও চা টা খেয়ে বলল,
- এবারে বাপ বেটি অর্ডার করুক, রাতে কি খাওয়া হবে। সেই অনুযায়ী তো চলতে হবে আমাকে।
এবারে বাবা কথা বলল
- আমাদের না, তোমার গুনধর ছেলে কে জিজ্ঞাসা কর। সব থেকে ঝামেলা সেই করে বেশী।
- বাজে কথা বোল না, আমার ছেলের কোন জ্বলন নেই।
আমি আর বাপি হেসে ফেললাম মায়ের কথায়। মনে মনে বললাম একচোখো মা কোথাকার। তা করতে করতেই ভাই ঢুকল। মায়ের কথা শুনতে পেয়েছিল মনে হয়। এসেই বলল,
- সয়াবিনের তরকারি খাব না বলে দিলাম কিন্তু আমি।
আমি আর বাবা আরো জোরে হেসে উঠলাম। আমরা চিরকাল ই – আমার ছেলের কোন জ্বলন নেই , কথাটায় প্রতিবাদ করেছি। আজকে স্বয়ং ভাই ও প্রতিবাদ করল। আর মা তাতেই রেগে গেল।
- হ্যা রে তোর বাবা দাসী বাঁদি রেখে গেছে অনেক। পারব না। ওই সয়াবিন ই করব আমি। খেলে খাবি ,না খেলে না খাবি।
- যাহ বাবা, আমি চিকেন কিনে আনলাম যে?
- উফ এই রাতে আবার চিকেন করতে হবে? এই শিবানী, আয় আমার সাথে তাড়াতাড়ি। পারি না বাপু। শান্তি নেই একটু। ভাবলাম মিঠাই টা দেখব শান্তি করে তা আর হবে না। যত সব ঘর জ্বালানে পর ভোলানে ছেলে জুটেছে আমার কপালে। একেবারে বাপের মতন।
বাপি কিছু বলে ওঠার আগেই বাপির মুখ টা চেপে ধরলাম আমি। মাথায় চিরুনি টা আটকানো ছিল। সেটা, ভাই এর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মায়ের কাছে রান্না ঘরে চলে গেলাম। সাড়ে আটটার দিকে আমি মাংস রেঁধে, নিজের ঘরে উঠে আসব সেই সময়ে রনির ফোন টা এলো। ধরলাম ফোন টা। শিওর মদ মেরেছে। মদ মারলেই,পুরোন স্মৃতি উপচে ওঠে।
- হেলো, বল। মদ মেরেছিস? ক পেগ হলো?
ওদিকে চুপ খানিকক্ষণ। ভয়ে ভয়ে উত্তর এলো
- কি করে জানলি?
- বুঝতে পারি। মদ না খেলে তো আমাকে মনে পরে না।
- কি করব? ভুলতে চেস্টা করি খুব ই।
- জানি সেটা। এতই ভুলে গেছিস আমাকে যে, যে রেস্টুরেন্ট এই যাই কেন আমার পয়সা দেওয়া যায় না। আর কটা খুলবি রে রেস্টুরেন্ট? নতুন হয়েছে দেখে তাশি ভিলা তে গেলাম। সেখানেও পয়সা নিল না। বলল রনিদার মানা আছে। ইচ্ছে করছিল দি এক টা ঘুষি মেরে নাকে।
- কি করব বল। যা করেছিস আমার জন্য, সে তো ভুলতে পারি না। তোর প্রার্থনা কাজ করে বুঝলি আমার জন্য।
- ঢং
- না রে। তোর মনে আছে। আমি যখন প্রথম স্টল দিয়েছিলাম। তুই রোজ এসে সার্ভ করে দিতিস।
- হুম মনে আছে
ধড়াস করে শুয়ে পরলাম বিছানায়। খামচা টা খুলে দিলাম চুলের। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে খুব। ওদিকে রনি বলে চলে
- আমি সেই টা ভুলতে পারি না। শত্রু তো ছিলাম বল আমরা।
- মোটেই না। কোন দিন ও তোকে আমি শত্রু ভাবিনি।
- বাজে বকিস না।
- সত্যি ভাবিনি। তোর মতন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার রে।
- ফালতু কথা। এতোই ভালো বন্ধু আমি যে তোর মনের দেওয়াল টা কেও ভাঙতে পারলাম না। কিন্তু যা, তোকে মুক্তি দিলাম আমি, আর আমার নাকে মারতে হবে না তোকে।
- কেন? সেটাও মারতে দিবি না? মারবার কেউ চলে এলো বুঝি?
- সে তো রনি মহাপাত্র কে বিয়ে করতে হাজারের উপরে মেয়ে মরে যাচ্ছে। কিন্তু রনি যাকে চাইল, সে তো পাত্তাও দিল না। যদিও অন্য মেয়েরা তোর ধারে কাছেও লাগে না। মনের ইচ্ছে তো ছিল তোকেই কেই বিয়ে করার। কিন্তু কিছু করার নেই তাই বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হচ্ছে না হলে ভার্জিন থেকেই মরতে হবে আমাকে।
ইশ, কি যে বলে নিজেই জানে না।
- কুত্তামোর একটা সীমা থাকে রে হারামজাদা।
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম ওর কথায়। কিন্তু ওর বিয়ের খবর টা সত্যি আনন্দের। রনি এই রকম ই। আমাকে হাজার বার প্রপোজ করেছে। আমি হাজার বার না বলেছি। কিন্তু বন্ধুত্বে কোন আঁচ আসে নি। আমি চেয়েছিলাম ও বিয়ে করুক তাড়াতাড়ি। আমি আনন্দেই বলে উঠলাম,
- ওয়াও। কবে বিয়ে?
- যাব তোর বাড়ি। কার্ড দিয়ে আসব। তোর কোন নেমতন্ন নেই বাল । কাকু কাকিমা কে বলে আসব।
- ও আমাকে নেমতন্ন করবি না। আসবি তবে , চা করে দিতে পারব না বলে দিলাম
- ফালতু মেয়েছেলে একেবারে। শালা এক কাপ চা খাওয়াবে। এমন ঘ্যাম!
- জানোয়ার। হাতের চা খেতেই তো আসিস রে ভিখারির মতন । কবে আসবি?
- চেয়ে তো ছিলাম সারা জীবন চা করে খাওয়াবি আমাকে। দেখি ফোন করে নেব তোকে।
- মেয়ে টা কে রে চিনি আমি?
- হ্যা তুই তো রুদ্রপুরের বটবৃক্ষ। সবাই কেই চিনবি
- ফালতু কথা বলিস না তো। বল না কে?
- আরে চিনিস না । এখান কার মেয়ে নয়। শিলিগুড়ির মেয়ে।
- ও। আসার আগে ফোন করে দিস। তোর ফেভারিট ফ্রায়েড ম্যাগী বানিয়ে খাওয়াবো।
- ভাগ্যিস বিয়ে টা হচ্ছে, না হলে তো ফোন ও জোটে না আমার কপালে। যদি এই রকম ট্রিট্মেন্ট জোটে তবে, ভাবছি খান দশেক বিয়ে করেই ফেলব।
- কুত্তা সালা
- যাক তোকে একটা খবর দিতে ফোন করলাম।
গলার মধ্যে সিরিয়াস একটা ভাব ছিল। ওরকম আমার হয় এখন। এই রকম গলা শুনলেই বুক টা ধড়াস ধড়াস করে, বললাম
- কি হয়েছে?
- রাকা এসেছে গতকাল রুদ্রপুরে।
ধক করে উঠল বুক টা। কিন্তু দেখালাম যে , আমি ইন্টারেস্ট নিলাম না কথা টায়। ছোট্ট উত্তর দিলাম
- ও । আমি কি করব। আমাকে বলছিস কেন?
- কারন আছে। না হলে যে আমি তোকে নিজে মানা করেছিলাম ওর সাথে আর যোগাযোগ রাখতে, সেই আমি কেন বলব আগ বাড়িয়ে এই কথা? যদিও আমিও ঠিক করেছি। বিয়ের পরে আর তোর সাথে যোগাযোগ রাখব না আমি।
- কেন? আমি কি দোষ করলাম?
- ধুর বাল, মজা করছি। তোর সাথে কথা না বলে থাকতেই পারি না আমি। আমার হবু বউ কে দশ টা ফোন করলে দশ বার তোর কথা আমি বলি। ওকে নিয়েই যাব তোর বাড়িতে আমি নেমতন্ন করতে।
মন টা খারাপ হয়ে গেল। রানির মতন ছেলে হয় না। আমি জানি। আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা সম্ভব হয় নি। কারন যাকে ভালোবাসি, মন তার কাছেই পরে আছে আমার। কাজেই রনির জীবন টা নষ্ট করার কোন অধিকার আমার নেই। আমার জীবন তো গেছেই। ওর জীবন টা কে নরক বানানোর কোন মানে হয় না । আর তাছাড়া…… থাক ওসব কথা। রনি বুঝবে না। পাবার নেশা খুব বেশী ছেলেদের। ওকে বললাম,
- সে আমি চাইনি বলে যোগাযোগ রাখিনি। কি দরকার একজন সুখী মানুষের জীবনে ঢুকে সমস্যা বাড়ানোর। কি বলবি বলছিলি বল?
- রাকার বউ, গত মাসে মারা গেছে।
- হোয়াট????????????
মনে হচ্ছিল মাথা টা ঘুরছে আমার। এ কী শুনলাম আমি। রাকার বউ মানে তো অঞ্জনা। মারা গেছে মানে। নিশ্চই ভুল শুনেছি আমি। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
- কি বললি শুনতে পেলাম না।
- বললাম, অঞ্জনা মারা গেছে, বলছে তো হার্ট এ সমস্যা ছিল। সমস্যা কাউকে বলে নি। বাড়ি থেকেও লুকিয়েছিল। ছোট বেলায় সমস্যা ছিল। কিন্তু বড় হয়ে নাকি ঠিক হয়ে গেছিল। কিন্তু তারপরেও……। রাকা আর রাকার ছেলে এসেছে রুদ্রপুরে। ও ইন্ডিয়া খেলতে যেতে পারে নি। বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ টা মিস করেছে।
- দুত্তোর, ম্যাচের কথা কে জিজ্ঞাসা করছে তোকে। তুই ঠিক শুনেছিস তো?
- হ্যা রে বাবা, তুই একবার যাস পারলে।
- আমি?
- হ্যা।
মনে পরল, কি দরকার যাবার। যদি ভাবে বউ মরে গেছে বলে আবার এসেছে। এমনি আমি ওদের বাড়ি যে যাই না তা নয়। বেশ যাই। আন্টি আর আঙ্কল আমার কাছে অনেক টা জায়গা জুড়ে আছেন। সে অনেক গল্প। কিন্তু রাকার জন্য যে খারাপ তা লাগছিল, এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। মনের ক্ষত গুল সামনে এসে গেল আমার। মন টা একটা ঘেন্নায় ভরে গেল একেবারে।না না কারোর উপরে না । নিজের উপরে ঘেন্নায়। রনি কে বললাম,
- না রে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি গেলেই ও অন্যরকম ভাবতে পারে। ভাববে হয়ত আবার ফিরতে চাইছি আমি। জানিনা, মানে মনে হচ্ছে যাওয়া টা ঠিক না। আমি তো আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম ওকে। আমার মান, সম্মান, মন কে ও পায়ের তলায় মাড়িয়ে আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আমাকে। আবার যাবো নিজের মান সম্মান বিকিয়ে দিয়ে?
রনি চুপ করে ছিল। আমার কথা শেষ হতেই বলল
- হ্যা ঠিক কথাই বলেছিস। দেখি আমি একবার যাব কালকে। তোকে জানাবো কি হলো।
- হুম ঠিক আছে।
- রাখছি এখন। কালকে দেখা করে এসে ফোন করব আবার।
রনি ফোন টা রেখে দিল। কিন্তু আমাকে চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে গেল। গত সাত বছর আমার সাত কোটি বার আমার রাকার কথা মনে পরেছে। রেগে গেছি। কষ্ট পেয়েছি মারাত্মক। কেঁদেছি সারা সারা রাত। ওকে দোষ দিয়েছি। ওকে গালাগাল দিয়েছি। নিজেকে কষ্ট দিয়েছি এমন একটা জীবনের জন্য। বাপি কে, মা কে দুষেছি। কিন্তু ভগবানের দিব্যি, কোন দিন ও ওকে আমি অভিশাপ দিই নি। কোন দিন ও চাইনি ও অসুখী হোক। কোন দিন ও চাইনি যে ও বিপদে পড়ুক। কোন দিন ও ওর সামান্য কষ্ট আমি বরদাস্ত করতে পারিনি। তবে আজকে ওর জীবনে এতো দুঃখ কেন দিলেন কেন ভগবান? ওর বউ মানে অঞ্জনা আর আমি একি ক্লাসে পড়েছি। ইভেন রাকাও এক সাথেই পড়ত। রাকার ছোট থেকেই অঞ্জনার উপরে ক্রাশ ছিল। আমিও বলতে পারিনি কোন দিন আমি রাকা কে পছন্দ করি ভালোবাসি। বলতে না পারার অনেক কারন ছিল আমার কাছে। যেদিন বলেছিলাম, এক রাশ অপমান পেয়েছিলাম। আমি কিন্তু রাকার থেকেই সাহস পেয়েছিলাম , রাকা কে মনের কথা বলার। কিন্তু জুটেছিল অপমান। আমাকে রাস্তা ঘাটে, মেলায়, কলেজে যেখানে পেয়েছে অঞ্জনা, মানে রাকার বউ, আমাকে অপমান করেছে। কিন্তু অতো অপমানিত হয়েও আমি কোন দিন অঞ্জনার ক্ষতি চাইনি। সত্যি বলতে আমি মায়ের সাথে মন্দিরে গেলে ওদের জন্য আর রনির জন্য প্রার্থনা আমার অভ্যেস। কিন্তু তারপরেও ভগবান রাকা কে এতো বড় কষ্ট কেন দিল।
নাহ মন টা একেবারে ভেঙ্গে গেল আমার। আমার কি যাওয়া উচিৎ? আমার রাকার আর অঞ্জনার সম্পর্কের কথা পুরো শহর জানত। যদি যাই, কে কি ভাববে? হয়ত ভাববে না কেউ। কিন্তু সবাই এটাও ভাবতে পারে যে আমি আবার সুযোগ নিতে গেছি। অঞ্জনার বাড়ির লোক থাকবে। তারা কি ভাববে? হয়ত অপমান করে দিল আমাকে। আর পারছি না অপমান নিতে আমি। যথেস্ট অপমানিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আমার বেঁচে না থাকাই ভালো। আমার বাপি আর মা অপমানে একেবারে শেষ হয়ে গেছিল। পাগলের মতন করত তখন দুজনায়। কিন্তু না গিয়েও থাকতে পারছি না আমি। রাকা টার এতো বড় দুঃখের সময়ে আর আমি যাব না?
রান্না ঘরে রুটি বেলছিলাম আমি। কোন কথা বলছিলাম না। মা রুটি সেঁকছে। আর আমি বেলে দিচ্ছি।
- রুটি তে জলের ফোঁটা কোথা থেকে পরছে?
মা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে জলের ফোঁটার উৎস খুজতে। মায়ের কথায় চমক ভাঙল আমার। তাকালাম না। মাকে দেখাব নাকি আমি কাঁদছি? তাও রাকার সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে আমি কান্না কাটি করছি জানলে, সিমপ্যাথি তো পাবোই না, উল্টে বকা জুটবে। মা আমার কাছে এসে আমার চিবুক ধরে মুখ টা তুলে দেখল, আমি কাঁদছি। নিজের আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে দিল। আবার রুটি সেঁকতে শুরু করল। বলল,
- কি ব্যাপার পুরোন কথা মনে পড়ছে নাকি?
ঘাড় নাড়ালাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে মা বলল
- তবে কান্না কেন? কি হয়েছে?
ইচ্ছে তো করছে মায়ের কাছে গিয়ে কাঁদতে। কেমন একটা অনুতাপ মনের ভিতরে আমার। মনে হচ্ছে আমি যদি রাকা কে না বলতাম, সেই সময়ে ঝামেলা টা হতো না। আমি দুঃখ পেতাম না। আর আমি দুঃখ না পেলে আমার ভিতর থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেরোত না আর রাকার এই ক্ষতি হতো না। আমি সোজা গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মা হয়ত বুঝল, যে মেয়েটা শেষ পাঁচ বছর কাঁদে নি, সে আজকে কাঁদছে মানে, কোন ব্যাপার হয়েছে। মা গ্যাস টা বন্ধ করে, আমাকে বুকে টেনে নিল। আমার চুলে হাত বোলাতে লাগল মা।
- কি হয়েছে, শিব? সোনা কি হয়েছে?
জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি। ভিতরে অনুতাপ টা আমি আর নিতে পারছিলাম না। শরীর, কেমন গরম হয়ে গেছে আমার। কেমন একটা ছটফটানি ভিতরে। মাকে বলে দিলাম রনি যা বলল আমাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মায়ের হাত টা থেমে গেল। বুঝলাম, ধাক্কা টা মা ও নিতে পারল না।
ডাইনিং টেবিল এ বসে ফোঁপাচ্ছিলাম আমি। মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাপিও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ধাক্কা টা সবার লেগেছে। এতো বড় ক্ষতি কেউ তো চাইনি আমরা। কিন্তু কথা যখন বলল মা তখন শুনে আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম,
- তুই কেন কাঁদছিস? অতো ভালোবাসা ভালো না। সবাই নিজের নিজের নিয়তি, ভাগ্য নিয়ে আসে। তার জন্য তুই এতো ভেঙ্গে পরেছিস কেন? মনে নেই তোর? তোকে কি ভাবে অপমান করেছিল ও।ওর শাশুড়ি শালী, ওর বউ ও তোকে অপমান করতে ছাড়ে নি। ঢং করিস না অতো। পছন্দ করি না আমি একদম। দরকার নেই দেখতে যাবার। তোর বাবা যাবে দরকারে। তোর বাবা কে বলব যেতে আমি। কাঁদিস না। চুপ কর।
মা খুব ই সোজা সাপটা এ ব্যাপারে নিজের কথা গুলো বলে দিয়ে চলে গেল রান্না ঘরে। আমি চুপ করে রইলাম। মাঝে মাঝে ফোঁপানি টা ভিতর থেকে উঠে আসছে আমার, নিঃশ্বাস নিতে গেলেই। রান্না ঘরের ভিতর থেকে মা গজগজ করছে,
- আমরা মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি কাঁদছেন পুরোন প্রেম এ। শিক্ষা নেই এই মেয়ের জীবনে। মরন আমার।
আমার বাপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তখনো। রাতে বিশেষ খেতে পারলাম না। কোন রকম খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। মনে পরতে লাগল সব কথা। সব কিছু। বুঝে গেলাম আজকে আর ঘুম হবে না আমার।
প্রতি টা মানুষের ই নিজের জন্য কিছু সময় বের করা উচিৎ। এমন একটা সময় যেখানে সে নিজের মতন বাঁচবে। হতে পারে ওই টুকু সময়,সে কবি হয়ে বাঁচল, বা গায়ক, বা কারোর স্বামী, বা কারোর বউ। বা তার মধ্যে অনেক ফ্যান্টাসী থাকে যেগুলো নিয়ে তার মনের মধ্যে পাগলামি আছে। সেই গুলো নিয়ে সে বাঁচল। সেই সময়ে সে থাকবে একা। আর ওই টাই তার সময়। আমার মনে হয় এমন পাগলামো সবার মধ্যেই আছে। আর সে সেই পাগলামো টা কে ছাড়তে চায় না। কারন সেই পাগলামী তে তার সুখ। সেই সুখ আমার মনে হয় নেওয়া উচিৎ। কারন এতে সে আনন্দে থাকে। আর আনন্দে থাকা খারাপ না , বরং ভাল। নিজে আনন্দে না থাকলে আশে পাশের ঘটনা, মানুষ, কাছের মানুষ, বন্ধু বান্ধব, বর, বউ কেউ ই ঠিকঠাক ভাবে কারোর সাথে কমিউনিকেট করতে পারে না। যাই হোক এই কথা গুলোর প্রাসঙ্গিকতা আছে আমার গল্পের কাহিনীর সাথে।চলুন পড়ি এই গল্প টা। এই গল্প টাও আমার জবানী তেই লেখা। কিন্তু এই গল্প বাস্তব। বাস্তব থেকেই নেওয়া। হ্যাঁ আমার কল্পনার মিশেল তো আছেই। কিন্তু এই গল্পের ভিতরে কোন খাদ নেই। আমার আপনার মতই একজনের জীবনের সত্য এখানে উঠে এসেছে।
শুরু
কলেজ থেকে বের হয়ে আমি স্কুটি স্টার্ট দিয়ে বাড়ির দিকে গেলাম না। জানি মা চিন্তা করবে একটু। কিন্তু আজকে ভালো লাগছে না একদম। মন টা খুব খুব খারাপ।কেন খারাপ বলতে পারব না। গত মাস খানেক ধরেই কলেজ ছুটি হবার পরেই এমন মন খারাপ টা হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছিল, সেই জায়গায় যাই যেখানে গেলে আমার মন ভাল হয়ে যেত। সময় হচ্ছিল না। কলেজ ছুটির পরেও এতো কাজ থাকে বলার না। কাজের ফিরিস্তি দিলাম না আজকে আর। তাই আজকে ভাবলাম চুলোয় যাক সব কাজ। আজকে যাবোই। আর সময় নিলাম না, হেলমেট টা পরে নিলাম। গাড়ি ঘুরিয়ে তাশির ধার ধরে জোরে ছূটিয়ে দিলাম স্কুটি টা। চুল টা বেঁধে নিলে ভালো হত। লম্বা হয়ে গেছে বড্ড। বার বার চোখে পরছে আমার। এক হাতে বার বার কানের পিছনে গুঁজতে হচ্ছে আমাকে। কিন্তু গাড়ি দাঁড় করতেও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে পৌঁছতে পারলে ভাল হয়।
স্কুটি টা স্ট্যান্ড করে আমি গিয়ে বসে পরলাম নদীর ধারে আমাদের চেনা পাথরের উপরে। রোদের তেজ কমে গেছে। তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। কত পাথর স্রোতের টানে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ আটকে যাচ্ছে। এদের মধ্যেই কেউ কেউ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে একদিন। আবার তাকে নিয়ে নদী বইতে শুরু করবে সামনের দিকে। এটাই মনে হয় জীবনের সব থেকে বড় রূপক। রোজ স্বপ্নের টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া। রোজ সেই টুকরো জোড়া দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। মৃত্যুর আগে সব ইচ্ছে, সব স্বপ্ন, সব ভালো লাগা মন্দ লাগা গুড়ো গুঁড়ো হয়ে বালি তে রূপান্তরিত হবে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। সে খারাপ নয়। জীবনের তো এটাই মাহাত্ব্য। ভালোর সাথে খারাপের ও বলি হয়ে যায়। ভালো স্বপ্ন ও যেমন ভেঙ্গে চুর্ন বিচুর্ণ হয়ে যায়, তেমনি খারাপ স্মৃতি ও ধুলোর মতন মিলিয়ে যায়। তারপরে, বীতশোক, বীতস্পৃহ হয়ে মরন হোক, তাতে কার কি বলার থাকতে পারে?
কিছু দুরেই একটা আওয়াজে আমার চমক ভাঙল। দেখলাম একটা ভীষণ মিস্টি বাচ্চা খেলছে আমার পিছনের বিশাল ফাকা জায়গায়। সাথে একটা ছোট ফুটবল। সাথে কেউ নেই? এদিক ওদিক চেয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না আমি। কত হবে? চার পাঁচ বছরের একটা দস্যি। তাকিয়ে রইলাম আমি ওর দিকে। টুক্টুক করছে ফরসা। মুখের হাসি যেন সাত রাজার ধন। আহা কার বাচ্চা কে জানে? কত না ভাগ্যবতী সে মা। আমার কী? আমি তো আর জীবনে মা হতে পারব না। তখন কি ভেবেছিলাম? জীবনে এতো লড়াই করে এগিয়ে এসে, সব কিছু পাবার পরেও, আমার মনে এই আক্ষেপ রয়ে যাবে?
আমি ঘুরে গেলাম পিছন দিকে। ভালো লাগছিল ওকে খেলতে দেখে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ছেলেটি কে। মন ভালো হয়ে গেল। বলে না, ভগবান নিজে থেকে কাউকে খুশী বা দুঃখী হবার অধিকার দিয়ে রাখেন নি। উনি যা চান তাই হয়। মন টা খুব মুষড়ে ছিল আমার। না জানি কেন, ভালো হয়ে গেল। ডাকলাম বাচ্চা টা কে। ওমা! ডাকতেই কাছে চলে এল। সাধারণত আসে না বাচ্চা রা। তারপরে এই রকম সফিস্টিকেটেড একটা বাচ্চা। দেখেই বোঝা যায় বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের বাচ্চা। কিন্তু মন টা দশ গুন ভাল করে দিয়ে বাচ্চা টা প্রায় ছুটে এলো আমার কাছে। কাছে এসে টাল সামলাতে না পেরে সোজা আমার কোলে। আমিও প্রায় ওকে লুফে নিলাম আমার বুকে।
- উফ কি দুষ্টু কি দুষ্টু! অতো জোরে কেউ দৌড়ে আসে নাকি? ব্যাথা পেলে?
আমার কোলে ধুপুস করে পড়ে গিয়ে ঘাবড়ে গেছিল বাচ্চা টা। কিন্তু আমি আদুরে গলায় উপরের কথা টা বলতেই মুখে হাসি ফিরে এল। আমি দাঁড় করিয়ে দিতেই ওকে, জামা প্যান্ট থেকে কাল্পনিক ধুলো ঝেড়ে নিল একটু ও। আমি আবার এদিক ওদিক দেখলাম ওর সাথে কেউ আছে নাকি। কি অদ্ভুত, এমন একটা সুন্দর বাচ্চা কে কেউ একলা ছেড়ে দেয় নাকি? নাম জিজ্ঞাসা করতেই ছোট্ট উত্তর এলো
- শিভ।
- শিব?
আমার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল সে। কি বড় বড় চোখ! কাজল দিয়ে এঁকে দিয়েছে কেউ। হয়ত মা। না হলে অন্য কেউ। কিন্তু চোখ দুটো থেকে মায়া যেন গড়িয়ে পরছে। আমার দিকে ওই ভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল,
- উঁহু ,শিব না, শিব না। এস এইচ আই ভি, শিভ
আমার হাসি পেয়ে গেল ওর বলার ভঙ্গী তে। কেমন বড়দের মতন করে বলল দেখ? মনে হচ্চে চটকে দি একেবারে। বললাম ওকে,
- ওমা এতো আমার নাম। আমার নাম শিবানী। ডাক নাম শিব। এস এইচ আই বি।
- ও তুমি শিব আর আমি শিভ
- হ্যা ঠিক বলেছ। একলা এসেছ? কেউ আসে নি সাথে?
যাহ শুনলোই না। ততক্ষনে কোল থেকে উঠে বলের কাছে ফিরে গেছে ও। বল টা নিয়ে পাগলের মতন এদিক ওদিক দৌড়োতে শুরু করার আগে, ঘাড় নেড়ে আমাকে – না কথাটা বলে দিয়ে গেল ও। কেউ নেই সাথে ওর? এটা তো হতে পারে না। দেখি জিজ্ঞাসা করি, কিছু জানতে পারি নাকি।এগিয়ে গেলাম। ওর সাথে খেলতে খেলতেই কথা বলে জানতে হবে। নাকি ওর ফুটবল খেলা দেখে আমার ও ফুটবল খেলার পোকা টা মাথায় চড়ে বসল? পা থেকে আমার স্যান্ডেল টা খুলে রাখাই ছিল। নুপুর দুটো কে খুলে পার্স এ রাখলাম আমি। কোমরে ওড়না টা বেঁধে নিলাম আমি। কেউ তো নেই আশে পাশে। বুক ঢাকার দরকার নেই। এগিয়ে গেলাম শিভ এর দিকে। বলটা চাইতেই ও দিয়ে দিল। জানিনা পারব কিনা। বল টা পায়ে নিয়ে নাচাতে শুরু করলাম আমি। বাহ এই তো পারছি এখনো। কখনো পায়ের পাতা দিয়ে, বা ব্যাক হিল দিয়ে ছোট ছোট টোকা দিয়ে আমি বল টা নাচাতে নাচাতে, বল টা শিভ কে দিচ্ছি । ও আমার বল নাচানো দেখে হাত তালি দিতে দিতে বল টা আমার দিকে ফেরত দিচ্ছে আবার। আমি আমার বল টা পায়ের টোকায় তুলে নিয়ে কিছুক্ষন নাচিয়ে আবার ওকে দেখছি।
উফ ঘেমে গেলাম একেবারে। কত দিন বাদে পা ছোঁয়ালাম আমি। যদিও আমি বেশ স্লিম। লম্বা বেশ আমি। পাচ ছয় হব। ওজন একদম মাপেই রেখে দি আমি। পঞ্চান্ন ছাপান্নর ধারে কাছে থাকে ওজন আমার। বলটা কে আর না নাচিয়ে একে অপর কে ছোট ছোট শটে দেওয়া নেওয়া করতে লাগলাম। ও আমাকে বলটা দিয়েই হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছে। কি মিস্টি! সবেতেই আনন্দ যেন। আমাকে বলল,
- আমার পাপাও পারে ওমনি বল নিয়ে জাগল করতে।
- তাই? কি নাম তোমার পাপার?
ঠিক সেই সময়ে, - ছোটেএএএ সাআআব বলে একটা চিৎকারে তাকিয়ে দেখি, একটা ঢাউস কালো গাড়ি দাঁড় করানো, আর সেখান থেকে একটা লোক, সম্ভবত ড্রাইভার হবে, ছুটে আসছে আমাদের দিকে। বুঝলাম, এই বাচ্চা টা কেই ছোটে সাব বলছে। মানে আমি ঠিক ছিলাম। এ কোন বড় ঘরের বাচ্চা। ছেলেটি আমার উত্তর দিতে গিয়েও দিতে পারল না। আমাকে বলল,
- চলে এসেছে আমাকে নিতে। উফ একটু খেলতেও দেয় না আমাকে।
আমি আবার হেসে ফেললাম বলার ধরনে। পেকাম একেবারে। বললাম
- তুমি যাও। সন্ধ্যে হয়ে আসছে না? কালকে আবার এস কেমন?
- তুমি আসবে কালকে?
- হুম তুমি চাইলে আসব। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি না, তুমি আমাকে পছন্দ করলে কিনা?
- প্লিস এস কালকে।
- আচ্ছা আসব।
ড্রাইভার টা ততক্ষনে এসে বাচ্চা টা কে কোলে তুলে নিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
- খুব দুষ্টু। সারাদিন খেলতে দিলে ভালো ওকে।
আমি হাসলাম ড্রাইভারের দিকে চেয়ে। দেখলাম শিভ কে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল। আর সে কোলের মধ্যে হাত পা ছুঁড়ছে। ছাড়িয়ে নিতে না, আনন্দে। খুশী হয়ে গেছে পুচকু টা। আহা, এখন কার দিনের বাচ্চা। না বাবাকে পায় সময়ে, না মা কে পায়। আমিও খুশি হয়ে গেছিলাম। নদীর জলে পা টা ধুয়ে নিলাম। নুপুর দুটো পরে নিলাম। ওড়না টা বুকে জড়িয়ে, চুল টা বেঁধে নিলাম পিছনে, পনি টেল করে। করি না সাধারণত আমি পনি টেল। লম্বা হয়ে গেছে দেখতে বাজে লাগে। কিন্তু গাড়ি চালাব। খুলে রাখলে ভালো লাগে, কিন্তু হাওয়ায় উড়বে। থাক কাকেই বা ভালো লাগাব। এই রুদ্রপুরে সবাই আমাকে চেনে। গত আঠাশ বছর ধরে আমাকে চেনে। জন্ম থেকে আমাদে দেখছে এরা। চোর ডাকাত অব্দি আমাকে চেনে। সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয় আমার। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমি।
- কি রে? এতো দেরী আজকে?
মায়ের প্রশ্ন টা ডজ করে তাড়াতাড়ি বাথরুম এ ঢুকে গেলাম। ঘেমে গেছি আজকে বেশ। শাওয়ার টা চালিয়ে দিলাম। উফ ঠাণ্ডা হল শরীর টা। একটা স্কার্ট আর টপ পরে বাথরুম থেকে বেরোলাম। ব্যালকনি তে শোকাতে দিলাম কাচা সালোয়ার, অন্তর্বাস। ডাইনিং এসে দেখলাম বাপিও চলে এসেছে বাড়ি।
- মা ভাই ফেরে নি এখনো?
- না। দেখোগে তোমার ভাই , তার হবু বউ এর সাথে কোন ডেটিং এ আছে নাকি।
রান্না ঘর থেকে উত্তর ভেসে এল মায়ের। উফ একেবারে শার্লক হোমস এর লেডি এডিশন। আমি বাপির দিকে তাকালাম। দেখলাম বাপি হাসছে। সামনে মোবাইল টা খোলা বাপির। ইদানিং, রিটায়ার করার সময় ঘনিয়ে আসছে আর মোবাইল এর প্রতি উৎসাহ বাড়ছে বাপির। মায়ের গলা রান্না ঘর থেকে তখনো আসছে
- বললি না, দেরী করলি কেন আজকে? কখন তো ফোন করেছিলি বাবা, যে মা বেরোচ্ছি।
উফ, ছাড়বে না । সব প্রশ্নের উত্তর চাই। অতি বিরক্ত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে বললাম,
- কাজ ছিল একটুউউ।
তারপরে বাপির দিকে ঘুরে বললাম
- বাপি এতো মোবাইল নিয়ে ঘেঁটো না। চোখ দুটো যাবে কিন্তু।
আমার শাসনে, ফোন টা রেখে দিল। ততক্ষনে মা মুড়ি আর চা নিয়ে আসছে। এসেই বলল
- হ্যা, তুই বললি বলে রেখে দিল। আমি বললে রাখত না।
আমার বাপি এখন সাধু সন্ত হয়ে গেছে। মায়ের কথায় বিশেষ উত্তর দেয় না। শুধু হাসে। অর্থবাহী হাসি। আমিও মুচকি হেসে মায়ের হাত থেকে মুড়ির বাটি টা নিয়ে খেতে শুরু করলাম। চা আমি খাই না। সকালে এক কাপ খাই তাও গ্রীন টি। মা ও চা টা খেয়ে বলল,
- এবারে বাপ বেটি অর্ডার করুক, রাতে কি খাওয়া হবে। সেই অনুযায়ী তো চলতে হবে আমাকে।
এবারে বাবা কথা বলল
- আমাদের না, তোমার গুনধর ছেলে কে জিজ্ঞাসা কর। সব থেকে ঝামেলা সেই করে বেশী।
- বাজে কথা বোল না, আমার ছেলের কোন জ্বলন নেই।
আমি আর বাপি হেসে ফেললাম মায়ের কথায়। মনে মনে বললাম একচোখো মা কোথাকার। তা করতে করতেই ভাই ঢুকল। মায়ের কথা শুনতে পেয়েছিল মনে হয়। এসেই বলল,
- সয়াবিনের তরকারি খাব না বলে দিলাম কিন্তু আমি।
আমি আর বাবা আরো জোরে হেসে উঠলাম। আমরা চিরকাল ই – আমার ছেলের কোন জ্বলন নেই , কথাটায় প্রতিবাদ করেছি। আজকে স্বয়ং ভাই ও প্রতিবাদ করল। আর মা তাতেই রেগে গেল।
- হ্যা রে তোর বাবা দাসী বাঁদি রেখে গেছে অনেক। পারব না। ওই সয়াবিন ই করব আমি। খেলে খাবি ,না খেলে না খাবি।
- যাহ বাবা, আমি চিকেন কিনে আনলাম যে?
- উফ এই রাতে আবার চিকেন করতে হবে? এই শিবানী, আয় আমার সাথে তাড়াতাড়ি। পারি না বাপু। শান্তি নেই একটু। ভাবলাম মিঠাই টা দেখব শান্তি করে তা আর হবে না। যত সব ঘর জ্বালানে পর ভোলানে ছেলে জুটেছে আমার কপালে। একেবারে বাপের মতন।
বাপি কিছু বলে ওঠার আগেই বাপির মুখ টা চেপে ধরলাম আমি। মাথায় চিরুনি টা আটকানো ছিল। সেটা, ভাই এর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মায়ের কাছে রান্না ঘরে চলে গেলাম। সাড়ে আটটার দিকে আমি মাংস রেঁধে, নিজের ঘরে উঠে আসব সেই সময়ে রনির ফোন টা এলো। ধরলাম ফোন টা। শিওর মদ মেরেছে। মদ মারলেই,পুরোন স্মৃতি উপচে ওঠে।
- হেলো, বল। মদ মেরেছিস? ক পেগ হলো?
ওদিকে চুপ খানিকক্ষণ। ভয়ে ভয়ে উত্তর এলো
- কি করে জানলি?
- বুঝতে পারি। মদ না খেলে তো আমাকে মনে পরে না।
- কি করব? ভুলতে চেস্টা করি খুব ই।
- জানি সেটা। এতই ভুলে গেছিস আমাকে যে, যে রেস্টুরেন্ট এই যাই কেন আমার পয়সা দেওয়া যায় না। আর কটা খুলবি রে রেস্টুরেন্ট? নতুন হয়েছে দেখে তাশি ভিলা তে গেলাম। সেখানেও পয়সা নিল না। বলল রনিদার মানা আছে। ইচ্ছে করছিল দি এক টা ঘুষি মেরে নাকে।
- কি করব বল। যা করেছিস আমার জন্য, সে তো ভুলতে পারি না। তোর প্রার্থনা কাজ করে বুঝলি আমার জন্য।
- ঢং
- না রে। তোর মনে আছে। আমি যখন প্রথম স্টল দিয়েছিলাম। তুই রোজ এসে সার্ভ করে দিতিস।
- হুম মনে আছে
ধড়াস করে শুয়ে পরলাম বিছানায়। খামচা টা খুলে দিলাম চুলের। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে খুব। ওদিকে রনি বলে চলে
- আমি সেই টা ভুলতে পারি না। শত্রু তো ছিলাম বল আমরা।
- মোটেই না। কোন দিন ও তোকে আমি শত্রু ভাবিনি।
- বাজে বকিস না।
- সত্যি ভাবিনি। তোর মতন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার রে।
- ফালতু কথা। এতোই ভালো বন্ধু আমি যে তোর মনের দেওয়াল টা কেও ভাঙতে পারলাম না। কিন্তু যা, তোকে মুক্তি দিলাম আমি, আর আমার নাকে মারতে হবে না তোকে।
- কেন? সেটাও মারতে দিবি না? মারবার কেউ চলে এলো বুঝি?
- সে তো রনি মহাপাত্র কে বিয়ে করতে হাজারের উপরে মেয়ে মরে যাচ্ছে। কিন্তু রনি যাকে চাইল, সে তো পাত্তাও দিল না। যদিও অন্য মেয়েরা তোর ধারে কাছেও লাগে না। মনের ইচ্ছে তো ছিল তোকেই কেই বিয়ে করার। কিন্তু কিছু করার নেই তাই বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হচ্ছে না হলে ভার্জিন থেকেই মরতে হবে আমাকে।
ইশ, কি যে বলে নিজেই জানে না।
- কুত্তামোর একটা সীমা থাকে রে হারামজাদা।
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম ওর কথায়। কিন্তু ওর বিয়ের খবর টা সত্যি আনন্দের। রনি এই রকম ই। আমাকে হাজার বার প্রপোজ করেছে। আমি হাজার বার না বলেছি। কিন্তু বন্ধুত্বে কোন আঁচ আসে নি। আমি চেয়েছিলাম ও বিয়ে করুক তাড়াতাড়ি। আমি আনন্দেই বলে উঠলাম,
- ওয়াও। কবে বিয়ে?
- যাব তোর বাড়ি। কার্ড দিয়ে আসব। তোর কোন নেমতন্ন নেই বাল । কাকু কাকিমা কে বলে আসব।
- ও আমাকে নেমতন্ন করবি না। আসবি তবে , চা করে দিতে পারব না বলে দিলাম
- ফালতু মেয়েছেলে একেবারে। শালা এক কাপ চা খাওয়াবে। এমন ঘ্যাম!
- জানোয়ার। হাতের চা খেতেই তো আসিস রে ভিখারির মতন । কবে আসবি?
- চেয়ে তো ছিলাম সারা জীবন চা করে খাওয়াবি আমাকে। দেখি ফোন করে নেব তোকে।
- মেয়ে টা কে রে চিনি আমি?
- হ্যা তুই তো রুদ্রপুরের বটবৃক্ষ। সবাই কেই চিনবি
- ফালতু কথা বলিস না তো। বল না কে?
- আরে চিনিস না । এখান কার মেয়ে নয়। শিলিগুড়ির মেয়ে।
- ও। আসার আগে ফোন করে দিস। তোর ফেভারিট ফ্রায়েড ম্যাগী বানিয়ে খাওয়াবো।
- ভাগ্যিস বিয়ে টা হচ্ছে, না হলে তো ফোন ও জোটে না আমার কপালে। যদি এই রকম ট্রিট্মেন্ট জোটে তবে, ভাবছি খান দশেক বিয়ে করেই ফেলব।
- কুত্তা সালা
- যাক তোকে একটা খবর দিতে ফোন করলাম।
গলার মধ্যে সিরিয়াস একটা ভাব ছিল। ওরকম আমার হয় এখন। এই রকম গলা শুনলেই বুক টা ধড়াস ধড়াস করে, বললাম
- কি হয়েছে?
- রাকা এসেছে গতকাল রুদ্রপুরে।
ধক করে উঠল বুক টা। কিন্তু দেখালাম যে , আমি ইন্টারেস্ট নিলাম না কথা টায়। ছোট্ট উত্তর দিলাম
- ও । আমি কি করব। আমাকে বলছিস কেন?
- কারন আছে। না হলে যে আমি তোকে নিজে মানা করেছিলাম ওর সাথে আর যোগাযোগ রাখতে, সেই আমি কেন বলব আগ বাড়িয়ে এই কথা? যদিও আমিও ঠিক করেছি। বিয়ের পরে আর তোর সাথে যোগাযোগ রাখব না আমি।
- কেন? আমি কি দোষ করলাম?
- ধুর বাল, মজা করছি। তোর সাথে কথা না বলে থাকতেই পারি না আমি। আমার হবু বউ কে দশ টা ফোন করলে দশ বার তোর কথা আমি বলি। ওকে নিয়েই যাব তোর বাড়িতে আমি নেমতন্ন করতে।
মন টা খারাপ হয়ে গেল। রানির মতন ছেলে হয় না। আমি জানি। আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা সম্ভব হয় নি। কারন যাকে ভালোবাসি, মন তার কাছেই পরে আছে আমার। কাজেই রনির জীবন টা নষ্ট করার কোন অধিকার আমার নেই। আমার জীবন তো গেছেই। ওর জীবন টা কে নরক বানানোর কোন মানে হয় না । আর তাছাড়া…… থাক ওসব কথা। রনি বুঝবে না। পাবার নেশা খুব বেশী ছেলেদের। ওকে বললাম,
- সে আমি চাইনি বলে যোগাযোগ রাখিনি। কি দরকার একজন সুখী মানুষের জীবনে ঢুকে সমস্যা বাড়ানোর। কি বলবি বলছিলি বল?
- রাকার বউ, গত মাসে মারা গেছে।
- হোয়াট????????????
মনে হচ্ছিল মাথা টা ঘুরছে আমার। এ কী শুনলাম আমি। রাকার বউ মানে তো অঞ্জনা। মারা গেছে মানে। নিশ্চই ভুল শুনেছি আমি। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
- কি বললি শুনতে পেলাম না।
- বললাম, অঞ্জনা মারা গেছে, বলছে তো হার্ট এ সমস্যা ছিল। সমস্যা কাউকে বলে নি। বাড়ি থেকেও লুকিয়েছিল। ছোট বেলায় সমস্যা ছিল। কিন্তু বড় হয়ে নাকি ঠিক হয়ে গেছিল। কিন্তু তারপরেও……। রাকা আর রাকার ছেলে এসেছে রুদ্রপুরে। ও ইন্ডিয়া খেলতে যেতে পারে নি। বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ টা মিস করেছে।
- দুত্তোর, ম্যাচের কথা কে জিজ্ঞাসা করছে তোকে। তুই ঠিক শুনেছিস তো?
- হ্যা রে বাবা, তুই একবার যাস পারলে।
- আমি?
- হ্যা।
মনে পরল, কি দরকার যাবার। যদি ভাবে বউ মরে গেছে বলে আবার এসেছে। এমনি আমি ওদের বাড়ি যে যাই না তা নয়। বেশ যাই। আন্টি আর আঙ্কল আমার কাছে অনেক টা জায়গা জুড়ে আছেন। সে অনেক গল্প। কিন্তু রাকার জন্য যে খারাপ তা লাগছিল, এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। মনের ক্ষত গুল সামনে এসে গেল আমার। মন টা একটা ঘেন্নায় ভরে গেল একেবারে।না না কারোর উপরে না । নিজের উপরে ঘেন্নায়। রনি কে বললাম,
- না রে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি গেলেই ও অন্যরকম ভাবতে পারে। ভাববে হয়ত আবার ফিরতে চাইছি আমি। জানিনা, মানে মনে হচ্ছে যাওয়া টা ঠিক না। আমি তো আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম ওকে। আমার মান, সম্মান, মন কে ও পায়ের তলায় মাড়িয়ে আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আমাকে। আবার যাবো নিজের মান সম্মান বিকিয়ে দিয়ে?
রনি চুপ করে ছিল। আমার কথা শেষ হতেই বলল
- হ্যা ঠিক কথাই বলেছিস। দেখি আমি একবার যাব কালকে। তোকে জানাবো কি হলো।
- হুম ঠিক আছে।
- রাখছি এখন। কালকে দেখা করে এসে ফোন করব আবার।
রনি ফোন টা রেখে দিল। কিন্তু আমাকে চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে গেল। গত সাত বছর আমার সাত কোটি বার আমার রাকার কথা মনে পরেছে। রেগে গেছি। কষ্ট পেয়েছি মারাত্মক। কেঁদেছি সারা সারা রাত। ওকে দোষ দিয়েছি। ওকে গালাগাল দিয়েছি। নিজেকে কষ্ট দিয়েছি এমন একটা জীবনের জন্য। বাপি কে, মা কে দুষেছি। কিন্তু ভগবানের দিব্যি, কোন দিন ও ওকে আমি অভিশাপ দিই নি। কোন দিন ও চাইনি ও অসুখী হোক। কোন দিন ও চাইনি যে ও বিপদে পড়ুক। কোন দিন ও ওর সামান্য কষ্ট আমি বরদাস্ত করতে পারিনি। তবে আজকে ওর জীবনে এতো দুঃখ কেন দিলেন কেন ভগবান? ওর বউ মানে অঞ্জনা আর আমি একি ক্লাসে পড়েছি। ইভেন রাকাও এক সাথেই পড়ত। রাকার ছোট থেকেই অঞ্জনার উপরে ক্রাশ ছিল। আমিও বলতে পারিনি কোন দিন আমি রাকা কে পছন্দ করি ভালোবাসি। বলতে না পারার অনেক কারন ছিল আমার কাছে। যেদিন বলেছিলাম, এক রাশ অপমান পেয়েছিলাম। আমি কিন্তু রাকার থেকেই সাহস পেয়েছিলাম , রাকা কে মনের কথা বলার। কিন্তু জুটেছিল অপমান। আমাকে রাস্তা ঘাটে, মেলায়, কলেজে যেখানে পেয়েছে অঞ্জনা, মানে রাকার বউ, আমাকে অপমান করেছে। কিন্তু অতো অপমানিত হয়েও আমি কোন দিন অঞ্জনার ক্ষতি চাইনি। সত্যি বলতে আমি মায়ের সাথে মন্দিরে গেলে ওদের জন্য আর রনির জন্য প্রার্থনা আমার অভ্যেস। কিন্তু তারপরেও ভগবান রাকা কে এতো বড় কষ্ট কেন দিল।
নাহ মন টা একেবারে ভেঙ্গে গেল আমার। আমার কি যাওয়া উচিৎ? আমার রাকার আর অঞ্জনার সম্পর্কের কথা পুরো শহর জানত। যদি যাই, কে কি ভাববে? হয়ত ভাববে না কেউ। কিন্তু সবাই এটাও ভাবতে পারে যে আমি আবার সুযোগ নিতে গেছি। অঞ্জনার বাড়ির লোক থাকবে। তারা কি ভাববে? হয়ত অপমান করে দিল আমাকে। আর পারছি না অপমান নিতে আমি। যথেস্ট অপমানিত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আমার বেঁচে না থাকাই ভালো। আমার বাপি আর মা অপমানে একেবারে শেষ হয়ে গেছিল। পাগলের মতন করত তখন দুজনায়। কিন্তু না গিয়েও থাকতে পারছি না আমি। রাকা টার এতো বড় দুঃখের সময়ে আর আমি যাব না?
রান্না ঘরে রুটি বেলছিলাম আমি। কোন কথা বলছিলাম না। মা রুটি সেঁকছে। আর আমি বেলে দিচ্ছি।
- রুটি তে জলের ফোঁটা কোথা থেকে পরছে?
মা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে জলের ফোঁটার উৎস খুজতে। মায়ের কথায় চমক ভাঙল আমার। তাকালাম না। মাকে দেখাব নাকি আমি কাঁদছি? তাও রাকার সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে আমি কান্না কাটি করছি জানলে, সিমপ্যাথি তো পাবোই না, উল্টে বকা জুটবে। মা আমার কাছে এসে আমার চিবুক ধরে মুখ টা তুলে দেখল, আমি কাঁদছি। নিজের আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে দিল। আবার রুটি সেঁকতে শুরু করল। বলল,
- কি ব্যাপার পুরোন কথা মনে পড়ছে নাকি?
ঘাড় নাড়ালাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে মা বলল
- তবে কান্না কেন? কি হয়েছে?
ইচ্ছে তো করছে মায়ের কাছে গিয়ে কাঁদতে। কেমন একটা অনুতাপ মনের ভিতরে আমার। মনে হচ্ছে আমি যদি রাকা কে না বলতাম, সেই সময়ে ঝামেলা টা হতো না। আমি দুঃখ পেতাম না। আর আমি দুঃখ না পেলে আমার ভিতর থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেরোত না আর রাকার এই ক্ষতি হতো না। আমি সোজা গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মা হয়ত বুঝল, যে মেয়েটা শেষ পাঁচ বছর কাঁদে নি, সে আজকে কাঁদছে মানে, কোন ব্যাপার হয়েছে। মা গ্যাস টা বন্ধ করে, আমাকে বুকে টেনে নিল। আমার চুলে হাত বোলাতে লাগল মা।
- কি হয়েছে, শিব? সোনা কি হয়েছে?
জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি। ভিতরে অনুতাপ টা আমি আর নিতে পারছিলাম না। শরীর, কেমন গরম হয়ে গেছে আমার। কেমন একটা ছটফটানি ভিতরে। মাকে বলে দিলাম রনি যা বলল আমাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মায়ের হাত টা থেমে গেল। বুঝলাম, ধাক্কা টা মা ও নিতে পারল না।
ডাইনিং টেবিল এ বসে ফোঁপাচ্ছিলাম আমি। মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাপিও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ধাক্কা টা সবার লেগেছে। এতো বড় ক্ষতি কেউ তো চাইনি আমরা। কিন্তু কথা যখন বলল মা তখন শুনে আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম,
- তুই কেন কাঁদছিস? অতো ভালোবাসা ভালো না। সবাই নিজের নিজের নিয়তি, ভাগ্য নিয়ে আসে। তার জন্য তুই এতো ভেঙ্গে পরেছিস কেন? মনে নেই তোর? তোকে কি ভাবে অপমান করেছিল ও।ওর শাশুড়ি শালী, ওর বউ ও তোকে অপমান করতে ছাড়ে নি। ঢং করিস না অতো। পছন্দ করি না আমি একদম। দরকার নেই দেখতে যাবার। তোর বাবা যাবে দরকারে। তোর বাবা কে বলব যেতে আমি। কাঁদিস না। চুপ কর।
মা খুব ই সোজা সাপটা এ ব্যাপারে নিজের কথা গুলো বলে দিয়ে চলে গেল রান্না ঘরে। আমি চুপ করে রইলাম। মাঝে মাঝে ফোঁপানি টা ভিতর থেকে উঠে আসছে আমার, নিঃশ্বাস নিতে গেলেই। রান্না ঘরের ভিতর থেকে মা গজগজ করছে,
- আমরা মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি কাঁদছেন পুরোন প্রেম এ। শিক্ষা নেই এই মেয়ের জীবনে। মরন আমার।
আমার বাপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তখনো। রাতে বিশেষ খেতে পারলাম না। কোন রকম খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। মনে পরতে লাগল সব কথা। সব কিছু। বুঝে গেলাম আজকে আর ঘুম হবে না আমার।