Thread Rating:
  • 106 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) সমাপ্ত :---
Update 2  

কথাটা বলে সিদ্ধার্থ চলে গেল। সিদ্ধার্থ কাকুর কথাটা শুনে আকাশের মুখ চোখ বেকে গেল। মুখ দিয়ে “ অ্যাঁ „ জাতীয় একটা শব্দ বেরিয়ে এলো । মনে মনে ভাবলো , ‘ বাবা পাগল হয়ে গেছে ! এইতো সকালে একসাথে ব্রেকফাস্ট করলাম। , বলে পিছন ফিরে সিদ্ধার্থের দিকে তাকালো । আকাশ দেখলো , যেসব এমপ্লয়ি কথাটা শুনতে পেয়েছে তারা ওরই দিকে তাকিয়ে আছে।

আকাশ আবার মনে মনে বললো , ‘ ইয়ার্কি মারছে মারুক। তাই বলে এতো গুলো লোকের সামনে এই ধরনের ইয়ার্কি ! ,

সিদ্ধার্থের কথাটাকে আকাশ ইয়ার্কি হিসেবেই নিল। এডভোকেট সিদ্ধার্থ বহু বছর ধরে এই কোম্পানির সাথে যুক্ত। প্রায় আকাশের বাবার সমবয়সী , তাই আকাশের বাবাকে ‘ তুমি , বলে সম্বোধন করে। গম্ভীর স্বভাবের হলেও আপনজনের সাথে ইয়ার্কি মারাটা ওর একটা রসিক দিক । তাই সিদ্ধার্থের এই কথাটাকেও আকাশ ইয়ার্কি হিসাবেই নিল।

দুই দিন পর রাতে , খাওয়া দাওয়া করে , আকাশ বিপ্লব বিচ্ছুর সাথে ফোনে কথা বলছিল । এতদিন পর বা বলা ভালো জীবনে এই প্রথম কোন মেয়েকে বিপ্লবের ভালো লেগেছে। মেয়েটা বিপ্লবের অফিসেরই একজন কর্মী। কয়েকদিন ধরে কথা বলার পর গতকাল তারা ডিনার বা ডেটিংয়ে গেছিল এবং ডিনারের পর বিপ্লব মেয়েটাকে প্রোপজ করে। মেয়েটা একসেপ্ট করার পর দুজনে মিলে লেট নাইট শো দেখতে যায় । সেই নিয়েই এখন বিপ্লব আকাশকে বলছে --- শোন ভাই ! লেট নাইট শো-তেই আসল মজা। বেশি কেউ দেখতে যায় না। যারা যায় তারা সবাই বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড।

আকাশ --- আমার আর গার্লফ্রেন্ড ! আমার তো বিয়েই হয়ে গেল। বিয়ের আগে একবার গেলে মজা হতো।

বিপ্লব --- এই শোন। রাখছি। ও ফোন করছে।

আকাশ --- বল , কথা বল। এখন তো তোরই দিনকাল !

বিপ্লব হাসতে হাসতে ফোনটা কেটে দিল। তারপর ওর গার্লফ্রেন্ড কে ঘুরিয়ে ফোন করে কথা বলতে লাগলো। সুচি মাকে ঘর গোছানোয় সাহায্য করছিল। মায়ের কাজে সাহায্য করে , সুচি ঘরে এসে দেখলো আকাশ আনমনে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। সুচি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে হাতের চুড়ি , কানের দুল , গলার হার খুলে , চুলে বিনুনি করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি ভাবছো ? „

আকাশ সুচির কথা শুনতে না পেয়ে ‘ উম , বলে উঠল। সুচি গলার স্বর তুলে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি ভাবছো ? „

আকাশ সিলিংয়ে তাকিয়ে আনমনে বললো , “ আমরা কোনদিন নাইট শো দেখতে যাইনি। সেটাই ভাবছিলাম। „

সুচি আকাশের কথা শুনে ভাবলো , ‘ হঠাৎ এইসব ভাবার মানে কি ! , তখনই সুচির চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আকাশ বললো , “ যাবে কালকে ? নাইট শো দেখতে ? „

সুচি বললো , “ তুমি হয়তো ভুলে গেছো ! „ তারপর নিজের সিঁথির  সিঁদুরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পয়েন্ট করে বললো , “ আমরা বিবাহিত । ওসব যারা সদ্য প্রেম করছে তাদের মানায়।

আকাশ সুচির দিকে দিকে ঘুরে , ডান হাতের কনুই বালিশের উপর রেখে , মাথটাকে ডান হাতের তালুর উপর ফেলে বললো , “ তুমি কি বলতে চাইছো যে আমি আর তুমি প্রেমিক প্রেমিকা নই ? আমরা প্রেম করি না ? „

“ না মশাই , আমরা প্রেম করিনা , কখনো করিওনি । আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। „

সুচির কথায় আকাশ ভাবলো , ‘ কথাটা একদিক থেকে ঠিক। আমরা কখনো প্রেম করিনি। মানে প্রেমিক প্রেমিকাদের মতো এঞ্জয় করিনি। সারাজীবন বন্ধু ছিলাম। তারপর ছাড়া ছাড়ি আর এই এক মাস আগে বিয়ে। ,

সুচির সাথে আকাশ কখনোই প্রেমিক যুগলের মতো ঘোরেনি , এঞ্জয় করেনি । সব সময় বন্ধু হিসাবেই ছিল। এই কথাটা ভাবতেই আকাশের নাইট শো দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হাজার গুন বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খাটে উঠে বসে বললো , “ প্লিজ , প্লিজ চলো না। তুমি আর আমি একবার শুধু। শুধু একবার ! „

সুচি এবার রাগি গলায় বললো , “ ছেলেমানুষি করোনা , বলেছি তো না । মা কি বলবে ভেবেছো ! „

“ মায়ের চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দাও। একবার চলো। কখনো নাইট শো দেখিনি। প্লিইইইজ । „ বলেই আকাশ ফোন বার করে কিছু একটা করতে লাগলো।

সুচি ভাবলো , ‘ এ আবার কিসের ভুত চাপলো ! নিশ্চয়ই কেউ কান ভরিয়েছে । , এইসব ভাবতে ভাবতেই আকাশের ফোনে কয়েকটা মেসেজ আসার শব্দ সুচি শুনতে পেল। কিছুক্ষণ পরেই মুখে একটা বিজয়ের হাসি ফুটিয়ে তুলে ফোনটা সুচিকে দেখিয়ে আকাশ বললো , “ বুকড। কালকে নটার শো দেখতে যাচ্ছি দুজনে । „

আকাশের ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে , সিনেমার টিকিট বুকিং এর কনফার্মেশন মেসেজ দেখার পর , সুচির একসাথে রাগ দুঃশ্চিন্তা এবং বিরক্তি লাগতে শুরু করলো। এতো বলার পরেও , বোঝানোর পরেও এইরকম ছেলেমানুষি সহ্য করা যায় না। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকার পর , গলায় একরাশ বিরক্তি ঝড়িয়ে সুচি বললো , “ রাত নটায় শো শুরু হলে শেষ হবে বারোটায়। একবারও ভেবে দেখেছো রাত বারোটায় বাড়ি ফিরলে মা কি বলবে ......

“ তুমি মায়ের চিন্তা করো না। আমি বলে দেবো। „ বলেই খাটে শুয়ে পড়লো। সুচি আর আকাশের সাথে কথা বললো না। খুব বিরক্ত লাগছে তার। লাইট নিভিয়ে মশারি টাঙিয়ে সে শুয়ে পড়লো ।

পরের দিন অফিস শেষ হওয়ার পর , বাড়ি ফেরার জন্য পার্কিংয়ে এসে দাঁড়ালে , আকাশ সুচিকে বললো , “ ভাবছি এখন আর বাড়ি গিয়ে লাভ নেই। কোন শপিংমলে গিয়ে সময় কাটিয়ে নেওয়া যাবে । „

“ মা কিন্তু খুব রাগ করবে । „

“ তুমি বারবার মা মা করো না তো। মাকে বলে এসছি ফিরতে দেরি হবে । „

আর কোন রাস্তা নেই দেখে সুচি নাছোড়বান্দা আকাশের বাইকের পিছনে বসে পড়লো। এতক্ষণ সে মনে মনে এটাই ভাবছিল যে ‘ যদি আকাশের জন্য তাকে মায়ের কাছে বকা খেতে হয় তাহলে সে আকাশকে ছাড়বে না। এইরকম ছেলেমানুষি করলে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। ওকেও তো বুঝতে হবে যে এখন আমরা বিবাহিত। ,

কিছুটা অনিচ্ছা আর কিছুটা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সে আকাশের সাথে শপিং করতে গেল। সন্ধ্যাটা ভালোই কাটলো। বিভিন্ন শোরুমে বিভিন্ন ডিজাইনের ড্রেস দেখছিল তারা । সেই সময় আকাশকে স্নেহা দেবী ফোন করলেন --- কোথায় তোরা ? ফিরবি কখন ?

আকাশ --- একটু দেরি হবে ফিরতে । তুমি চিন্তা করো না। যদি বেশি রাত হয় তাহলে খেয়ে নিও । রাখছি

ফোনটা রেখে দিয়ে , আটটায় দিকে হাল্কা কিছু খেয়ে দুজনে সিনেমা দেখতে চলে গেল ।

সিনেমা শুরু হওয়ার প্রায় এক ঘন্টা পরেই আকাশ বিপ্লবের কথা মত চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যি কয়েকজন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে একান্ত মূহুর্ত কাটাতে ব্যাস্ত। তাদের কে দেখে আকাশের মনে ফুল ফুটে উঠতে বেশি সময় লাগলো না । প্রেম মাখা দৃষ্টিতে পাশের সিটে তাকাতেই দেখলো সুচি রাগী দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছ , আর তার হাতে ধরা ফোনে কাকি বলে একটা নাম্বার ফুটে আছে ।

আকাশের মনে যে প্রেমের ফুল ফুটেছিল সেটা নিমেষে শুকিয়ে গেল। সে সুচির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সিনেমা দেখতে লাগলো। সুচি ফোনটা রিসিভ করে বলেদিল যে , “ একটু দেরি হবে । তোমরা খেয়ে নাও । „

এদিকে খাওয়ার টেবিলে খেতে বসে সুচেতা দেবী একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে , “ দুজন কোথায় ? „

স্নেহা দেবী বললেন , “ সিনেমা দেখতে গেছে । ফিরতে রাত হবে । „ বলা বাহুল্য এটা শোনার পর সুচেতা দেবী মোটেও খুশি হলেন না । ছোটবেলা থেকে অবাধ্য সুচি এখনও নিজের মর্জি মত চলছে । এটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না ।

সাধারণত কোন বাঙালী পরিবারে বড়ো কোন কিছু ঘটলে , বাড়ির মহিলাদের মুখে সবসময় সেই ঘটনার পুণঃ সম্প্রসারন শোনা যায়। কিন্তু সুচির ওই ঘটনার পর বা ওই ঘটনা নিয়ে এই একমাস কেউই কোন কথা বলে নি। পাড়া প্রতিবেশীরা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছিল কিন্তু বারবার সুচি আর আকাশের মা কথাটা চেপে গেছেন। বলতে গেলে যে একটা ভয় পেয়ে বসে , গলার ভিতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে আটকে আছে মনে হয়। আর সেদিন রাতের ওই ভয়ংকর খুনি হুমকিটা মনে পড়ে যায় ।

রাতের খাওয়া খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। সুচি আর আকাশের সিনেমা শেষ হলো পাক্কা বরোটায় । বাইক করে বাড়ি ফেরার সময় সুচি মনে মনে ভাবতে লাগলো , ‘ হে ঠাকুর , পুলিশের ঝামেলায় যেন জড়িয়ে পড়তে না হয়। ,

মনে মনে পুলিশের ভয় পেলেও মধ্যরাতের কলকাতার রাস্তার সৌন্দর্য সুচিকে কিছুটা হলেও শান্ত করে দিল। রাস্তার ফুটপাতে এক পায়ে দাড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের লালচে আলোয় রাস্তাটাও লাল রঙের হয়ে উঠেছে। রাস্তার পাশের বাড়ি গুলোর বেশিরভাগ ঘরে লাইট নিভে গেলেও কয়েকটা তে এখনও আলো জ্বলছে। আর কিছুদূর পরপর পেট্রোল পাম্পের সাদা আলো রাস্তা এসে পড়ছে। কয়েকটা কুকুর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ঝিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটা তো আকাশের বাইককে উদ্দেশ্য করে ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠছে। আর মেঘহীন আকাশের তারাদের ঝিকিমিকি আলো এই কৃত্রিম সৌন্দর্যের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কিছু অবদান রাখছে ।

সুচির খুব ইচ্ছা হলো এই মনোরম পরিবেশে আকাশের হাত ধরে রাস্তায় হাটতে। কিংবা ফুটপাতের চায়ের দোকানে পাশাপাশি বসে ভাঁড়ের গরম চায়ে ফু দিয়ে খেতে , কিংবা বাইকের পিছনে বসে বসেই , দুই হাত দুই দিকে ফেলে নিজের স্বাধীনতা জানান দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এত রাতে বাড়ি ফিরলে মা নিশ্চয়ই বকবে তাই মনের সব ইচ্ছা আপাতত দমন করে রাখাই ভালো।

এদিকে আকাশের পেটে খিদের জন্য ছুঁচো দৌড় শুরু হয়েছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার। যেটার জন্য নাইট শো প্ল্যান করেছিল সেটা তো হলোই না ! এখন বাড়ি ফিরে মায়ের বকা খেতে হবে সেটা আর এক। 23 বছরের জীবনে কখনো এত রাত অব্দি বাড়ির বাইরে সে থাকে নি। তাই মায়ের বকুনি খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

বাকি রাস্তাটা নির্বিঘ্নে আসার পর , সোসাইটিতে ঢুকে নিজেদের বিল্ডিংয়ের নিচে এসে আকাশ বাইকটা পার্ক করলো । স্নেহা দেবী উপর থেকেই তার ছেলের Yamaha বাইকের আওয়াজ শুনে পেলেন । বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে আর বৌমা ফিরেছে। ফোনটা অন করে তিনি দেখলেন , একটা বাজতে আর চোদ্দো মিনিট বাকি ।

কিছুক্ষণ পরেই আকাশের মা ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলেন। সুচির কাছে বাড়ির এক্সট্রা চাবি আছে সেটা তখনই মনে পড়ে গেল। আকাশের মা মনে মনে বললেন , “ আজ ঘুমিয়ে নিক। কালকে কথা বলবো । „

কিন্তু সেটা হলো না। কিছুক্ষণ পরেই রান্নাঘরের খুটখাট আওয়াজে তিনি বুঝলেন যে দুজনে খালি পেটে আছে। আকাশের মা চুপচাপ খাট থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দেখলেন , আকাশ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে আর সুচি দুটো থালায় রুটি সাজাচ্ছে।

সুচি আর আকাশ মাকে দেখে চমকে উঠলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। এখন যতো চুপ থাকা যায় ততই ভালো , তাই দুজনেই মুখে কুলুপ এঁটে দিল। আকাশের মা এসে সুচিকে বললেন , “ বস আমি দিচ্ছি। „

সুচি চুপচাপ গিয়ে আকাশের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। আকাশের মা দুজনের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন , “ ভেবেছিলাম আমার ছেলে ছোট হলেও তুই বড় , তুই সামলে নিবি। কিন্তু তুইও আকাশের কথায় গা ভাসিয়ে দিবি এটা জানতাম না। তাহলে কি লাভ হলো তোর সাথে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে। এতো রাত করে বাড়ি ফিরলে পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে সেটা ভেবেছিস তোরা .....

আকাশের মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে সুচি পাথর হয়ে গেল । পুরো ব্যাপারটাই যে তার ঘাড়ে এসে পড়বে সেটা সে ভাবেনি। এখন আকাশের ছেলেমানুষির জন্য তাকে বকা খেতে হচ্ছে। এইটুকু একটা ঘটনার জন্য এত কথা শুনতে হবে সেটা সুচি স্বপ্নেও ভাবেনি। দুটো পরিবার অনেক অংশে আধুনিক হলেও , সিনেমা দেখে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরাটা আধুনিকতার মধ্যে পড়ে না। আর এমনিতেও সুচি এবাড়ির বৌমা । তাই চুপ থেকে শুনে যাওয়াটাও শ্রেয় ।

আকাশের মা দুজনের জন্য রুটি আর ভেন্ডির তরকারি দুটো প্লেটে সাজিয়ে দুজনকে খেতে দিয়ে বললেন , “ খাওয়া হয়ে গেলে , জল দিয়ে একবার থালা দুটো ধুয়ে রেখে দিস। সকালে মেজে দেবো । „ বলে তিনি ঘুমাতে চলে গেলেন।

এদিকে আকাশের মায়ের কথা গুলো শোনার পর সুচির আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করলো। খেতে গিয়ে রুটির টুকরো বারবার গলায় আটকে যাচ্ছিল।

আকাশ মাঝে একবার ‘ সরি , বলেছিল কিন্তু সুচি কোন উত্তর দেয়নি । দেওয়ার ইচ্ছা তার নেই। খাওয়া হয়ে গেলে থালা দুটো একবার ধুয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণ পর সুচির নিরবতা আকাশের মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। তাই সে বললো , “ আমি সত্যিই ভাবিনি যে মা তোমাকে এত কথা শোনাবে। প্লিজ ক্ষমা করে দাও । এরকম আবদার , জেদ আর কখনো করবো না । „ বলে সুচিকে নিজের কাছে টানতে গেল।

সুচি এক ঝটকায় আকাশের হাত ঢেলে সরিয়ে দিয়ে বললো , “ আমাকে ছোঁবে না তুমি ! „

এখন সুচির রাগ কমার অপেক্ষা করাটাই শ্রেয়। তাই আকাশ আর কথা না বলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

পরবর্তী কয়েকদিনে আকাশের জীবন পুরো উলটপালট হয়ে গেল। একটা বাঁধা ধরা নিয়মে তার দৈনন্দিন জীবন বেঁধে গেল। বাড়ি থেকে অফিস , অফিস থেকে বাড়ি , এই হলো ওর জীবন । এমনকি প্রায় রোজ বাড়ি ফেরার পথে ফুটপাতের বিভিন্ন স্টলে ফুচকা , এগরোল , পকোড়া , ভেলপুরি , পাপরিচাট জাতীয় ফার্স্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাসটাও তাকে ছাড়তে হলো। কথায় আছে যা হয় ভালোর জন্যেই হয়। এখন সুচি ওই ঘটনা ভালোর জন্যেই হয়েছিল এরকম মনে করে। না হলে যে তার স্বামী তার কথা শুনতোই না। এবার একটা সুস্থ স্বাভাবিক সংসার করার স্বপ্ন সুচি দেখতে পারে। সেই স্বপ্ন টাকেই সে সফল করার চেষ্টা করতে লাগলো। তাই মনে মনে সে বেশ খুশি।

এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর , অফিসের টিফিন ব্রেক হওয়ার কিছু আগে , সিদ্ধার্থ আকাশের বাবার কেবিনে এসে ঢুকলো। কোন অনুমতি না নিয়েই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে বসে বললো , “ আর একবার ভেবে দেখো। এতে তোমারই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ...

আকাশের বাবা নির্বিকার চিত্তে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। সিদ্ধার্থ একভাবে তাকিয়ে থেকে , নিরুপায় হয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে , তার থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করলো। সেটা আকাশের বাবার বাড়িয়ে রাখা ডান হাতে দিয়ে বললো ,“ কেউ তো ভয়ে কিছু বলতেই চাইছিল না । তার পর একজনকে হাত করে , তাকে কিছু বকশিশ দিতে , সে কিছুটা হলেও বললো । মোট চার জন ওর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তিন জনকে সরকারি উকিল বানিয়ে অন্য জেলায় ট্রান্সফার করিয়ে দিয়েছে। এই একজনই আছে যার কিছু করতে পারে নি .....

আকাশের বাবা ভিজিটিং কার্ডটি নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলেন তাতে লেখা আছে ‘ মোঃ. শেখ , এডভোকেট হাইকোর্ট , । পিছনে টেলিফোন নাম্বারও দেওয়া আছে। আকাশের বাবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কার্ডটা দেখার সময় , সিদ্ধার্থ না বলে থাকতে পারলো না , “ তুমি আগুন নিয়ে খেলতে চাইছো। হাত পুড়বেই। „

আকাশের বাবা উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন , “ এটা আমার মেয়ের প্রশ্ন ! „

এরপর আর বোঝানোর কোন মানে হয় না। ঠিক সেই সময় সুচি টিফিন কৌটো নিয়ে কেবিনে ঢুকলেই দুজনেই চুপ হয়ে গেল। সুচিকে কে ঢুকতে দেখে সিদ্ধার্থ উঠে চলে গেল। এখন সুচিই তিনজনের জন্য টিফিন আনার দায়িত্ব নিয়েছে। আর তিনজনে একসাথে বসে লাঞ্চ করে ।

টিফিন খেয়ে সুচি আর আকাশ চলে গেলে , আকাশের বাবা ভিজিটিং কার্ডে দেওয়া নাম্বারে ফোন করলেন। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর , অপর প্রান্ত থেকে খুব গম্ভীর একটা স্বর ভেসে এসে এলো , “ হ্যালো , কে বলছেন ? „

আকাশের বাবা --- আপনি কি মোঃ .শেখ ....

শেখ --- হ্যাঁ আমিই সেই ব্যাক্তি। আপনি কে বলছেন।

লোকটার গলার স্বরে কর্কশতা এতোটাই তীক্ষ্ণ যে আকাশের বাবা কিছুটা হলেও বিরক্ত হলেন । আকাশের বাবা বললেন --- আমি DS import & export কোম্পানির মালিক শুভাশীষ মিত্র বলছি ...

শেখ --- DS import , শুভাশীষ মিত্র ! ... আপনার মেয়ের সাথেই কি ওই ক্রিমিনাল টা এ্যাসিড ....

এতোটা শুনে আকাশের বাবা আকাশ থেকে পড়লেন। এ কি করে সম্ভব ? এই ঘটনার কথা তো তার সোসাইটিরই বেশিরভাগ কেউ জানে না। তাহলে এই লোকটা জানলো কি করে ? এই ঘটনার কথা তো সবসময় চেপে যাওয়া হয়েছে । তাহলে এই লোকটা জানলো কি করে ?

আকাশের বাবার এইসব চিন্তার মাঝে অপর প্রান্ত থেকে মোঃ শেখের  কন্ঠস্বর শোনা গেল। কিন্তু এবার আর সেই কন্ঠে কর্কশতা নেই। তার বদলে হাসি দেখা দিয়েছে। শেখ --- আমি ভাবিনি আপনি ফোন করবেন। ভেবেছিলাম ভয় পেয়ে একজন ভিক্টিমের জীবন যাপন করবেন। এখন আপনি আমায় ভুল প্রমাণিত করলেন।

আকাশের বাবা এতক্ষণ যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। এই লোকটাকেই তো তার দরকার। এরকম লোককেই তো তিনি খুঁজছিলেন। তাই উতলা হয়ে আকাশের বাবা বললেন --- সব কথা ফোনে বলাটা কি ঠিক হচ্ছে !

শেখ --- তা , ভালো তো। আজ পাঁচটার দিকে ময়দানে চলে আসুন না। ওই মহামেডান ক্লাবের বিপরীতে যে মাঠটা আছে , ওখানে আমায় পেয়ে যাবেন। আর আমার পার্সোনাল নাম্বার টা নিন ।

আকাশের বাবা বুঝতে পারলেন না ময়দানে কেন ? --- ময়দানে ?

শেখ --- হ্যাঁ , ওই কোর্ট শেষ হলে ওখানে একটু হাঁটতে যাই আরকি !

আকাশের বাবা --- ঠিক আছে আমি ওখানে পৌঁছে ফোন করবো ।

শেখ --- ওকে

ফোনটা রাখার পরেও কথাটা আকাশের বাবার মাথায় ঘুরতে লাগলো , ‘ ওই লোকটা কিভাবে এতকিছু জানতে পারলো ? জানার তো কথা নয় ! ,

সাড়ে চারটের আগেই আকাশের বাবা অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন । ঠিক সময় মতো রেড রোডে পৌঁছে তিনি ফোন করলেন ।  একবার রিং হতেই অপর প্রান্ত ফোনটা রিসিভ করলো , “ হ্যাঁ ভিতরে আসুন । দেখুন একটা গাছের নিচে আমি বসে আছে ....

আকাশের বাবা  মহামেডান ক্লাবের বিপরীত মাঠের মুখে গাড়িটা পার্ক করার সময় দেখলেন যে পাশে একটা সাথা BMW পার্ক করা আছে । নিজের গাড়িটা লক করে মাঠে  ঢুকে দেখলেন সত্যি একজন বসে আছে । কিছুদূরে দুটো বাচ্চা ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে । আর একজন দূর থেকেই তাদের উপর নজর রাখছে । আকাশের বাবা গাছের নিচে বসে থাকা লোকটার কাছে এগিয়ে যেতেই , লোকটা বললো , “ বসুন । „

আকাশের বাবা গাছের নীচে ঘাসেই বসে পড়লেন । কোর্ট প্যান্ট পড়ে মাটিতে বসতে বসতেই একবার ভালো করে লোকটাকে দেখে নিলেন । লোকটা সাধারণ জামা প্যান্ট পড়ে আছে । একটা নীল রঙের জামা আর কালো প্যান্ট । বয়স আন্দাজ আকাশের বাবার মতোই হবে । উচ্চতাও প্রায় একই । . বলে চেনা যাবে না । কারন মুখে দাড়ি নেই । পুরো ক্লিন সেভ করা । আর অতিরিক্ত ফর্সা । দেখতে সুদর্শন। চুল ছোট করে ছাঁটা ।

প্রথমেই আকাশের বাবা প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলেন না , “ আপনি জানলেন কি করে যে আমার মেয়ের ....

লোকটা একটা মুচকি হেসে বললো , “ আমার নাম মোঃ রহমত শেখ । „

“ ও সরি । „ বলে আকাশের বাবা নিজের পরিচয় দিলেন । আকাশের বাবা রহমত নামটা শুনে একটু অবাকই হলেন । এই নামটা তো চাচার ... তবে এক নামের অনেক লোক থাকতে পারে তাই অবাক হয়ে লাভ নেই ।

পরিচয় পর্ব শেষে রহমত আকাশের বাবার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করলো , “ আমার জীবনের প্রথম , একবারে প্রথম কেস ছিল ওটা । ওর একা একজনের এসিস্ট্যান্ট ছিলাম । তারপর নিজের প্র্যাকটিস শুরু করি । প্রথমেই ওই ক্ষমতালোভী জন্তু আর ওর দুই ছেলের বিরুদ্ধে একটা রেপ কেস লড়ি । তখন পঙ্কজ বিধায়ক হয়নি । একটা মেয়েকে ওর ভাইয়ের সামনেই রেপ করে ওই পলাশ ওর এক বন্ধু আর ওর জানোয়ার দাদা । একমাত্র সাক্ষী ছিল মেয়েটার ভাই । কিন্তু ওরা ওই ছেলেটাকে হসপিটাল থেকেই কিডন্যাপ করে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে মেরে দেয় । পঙ্কজের পলিটিক্যাল কেরিয়ার বলে কথা । ওই কেসটা মানে আমার জীবনের প্রথম কেস আমি হেরে গিয়েছিলাম । „ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মোঃ শেখ ।  , “ জীবনের প্রথম কেস হেরে যাওয়াটা আজও ঠিক মেনে নিতে পারিনি ।  সেই দিন থেকে ওদের ওপর নজর রেখে দিয়েছি । ওদের প্রতিটা মুভমেন্টে আমার নজর আছে । তবুও বারবার সাক্ষীর অভাবে বেঁচে যায় ওরা । „

আকাশের বাবা অবাক হয়ে বললেন , “ আপনি আমাকে প্রথম আলাপেই বিশ্বাস করে এতগুলো কথা বলছেন ! „

“ আমি লোক চিনতে ভুল করিনা মি.মিত্র । আপনার মেয়ের উপর ওই জানোয়ারটা এসিড ছুড়েছিল , তাই আপনি আমার কাছে এসেছেন । তাই আপনাকে বিশ্বাস করাই যায় । সেদিনের ওই ঘটনাটা আমার জানতে একটু দেরি হয়ে গেছিল । না হলে আমিই আপনার কাছে যেতাম সাক্ষী নিতে । কিন্তু এখন আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করবো সেটাই বুঝতে পারছি না । আপনি তো স্ট্যাম্প পেপারে সই করে দিয়েছেন । „

“ ওটা স্ট্যাম্প পেপার ছিল না । একটা সাদা কাগজ ছিল । আর একটা কেস উইথড্র এর কাগজ । আর ওতে লেখা ছিল পলাশ ওই কাজ করে নি । আমাদের চিনতে ভুল হয়েছে । তাই আমরা কেস তুলে নিচ্ছি । এরকম কিছু ... „ এতোটা বলেই আকাশের বাবা পকেট থেকে ফোনটা বার করলেন । তারপর একটা অডিও চালিয়ে দিলেন । ময়দানের শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে , একটা শান্ত খুনি আওয়াজ ভেসে উঠলো --- শুনুন কান খুলে । এবারের বিধানসভায় আমি CM candidate হয়ে দাড়াচ্ছি । যদি আপনার বা আপনার মেয়ের জন্য আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় তাহলে সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো। এখন যা বলছি শুনুন। বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা খুলুন আর সে যে কাগজ গুলো দিচ্ছে তাতে সই করুন । আর আমার ছেলে আপনাদের কখনো ডিস্টার্ব করবে না।

বোঝাই যাচ্ছে আকাশের বাবা পঙ্কজের কথা রেকর্ডিং করেছিলেন । সব শুনে মোঃ শেখ বললো , “ আপনি হয়তো জানেন না , অডিও কিংবা ভিডিও ক্লিপিংস কে কোর্টে সাক্ষ্য হিসাবে মানা হয় না । „

“ হ্যাঁ কিন্তু যদি আমরা বলি যে , আমাদের হুমকি দিয়ে কাগজে সই করিয়ে কেস তুলে নিতে বাধ্য করেছিল । তখন তো এটাতে সাক্ষ্য হিসাবে মানবে । „

“ আপনার সাহস আছে মি.মিত্র । „ কথাটা না বলে থাকতে পারলো না মোঃ শেখ । তারপর কিছুক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে পশ্চিম দিকে হেলে যাওয়া সূর্যের অস্ত দেখতে দেখতে বললো , “ আপনি কি চান ? আমি আপনার হয়ে কেস লড়ি ? „

“ তাইতো এলাম । „

“ এ চেষ্টা আমি বহুবার করেছি মি.মিত্র । বারবার অসফল হয়েছি । প্রত্যেকবার সাক্ষীকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় আর সাক্ষী পিছিয়ে যায় । কতো না জানি রেপ করেছে ওরা । সাধারণ ঘরের মেয়েগুলোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে হোটেলে নিয়ে গিয়ে .... রেপ , মোলেস্ট , ইভটিজিং আরও কত কি । আমারই কয়েকজন কলিগ ওর বিরুদ্ধে কেস লড়তে চেয়েছিল । কিন্তু তাদের তো ..... জানেন ! ওই বিধায়ক একটা বেআইনী এক্টিভিটির সাথে জড়িত । বেআইনী ভাবে কোটি কোটি টাকা রোজগার করে এবং সেগুলো ভোটের সময় ব্যাবহার করে । এই নিয়ে দুবার ইনকাম ট্যাক্স এবং একবার সিবিআই এর রেড হয়ে গেছে ওর বাড়িতে । কিন্তু কোন কিছুই হাতে আসেনি । বারবার তারা অসফল হয়েছে । ওর একটা এনজিও আছে যেখানে লোকে ডোনেশন দেয় । সেটাকেই সে বারবার গার্ড করে বেঁচে গেছে । কিন্তু এতো টাকা ডোনেশনের মাধ্যমে আসতে পারে না । আসা সম্ভব নয় । একবার ওই বেআইনী কাজটা জানতে পারলে হয় । গলায় দড়ি পড়াতে বেশি সময় লাগবে না । „ এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো মোঃ শেখ । তারপর তিনবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো ।


আকাশের বাবা সব শুনে একটু অবাক হলেন । কিন্তু এতে নতুন কি ! একটা বেআইনী ইনকাম সোর্স থাকাটাই তো স্বাভাবিক । কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন , “ এক কাজ করলে হয় না ! মানে যদি আমার মেয়ের মতো আরো কয়েকজনের সাক্ষ্য জোগাড় করা যায় ।  ক্রাইম তো কম করে নি ওই পশুগুলো । „

“ চেষ্টা করে লাভ নেই । ওরা সবাই ভিক্টিমের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । „

আকাশের বাবা বললেন , “ আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি । „

মোঃ শেখ যেন কথাটা শুনে খুশিই হলো , “ করবেন ! „

আকাশের বাবা উৎসাহিত হয়ে বললেন , “ অবশ্যই । „

“ আমার জানা মতে মোট তিন জন আছে । তাদের মধ্যে একজনকে রেপ করা হয়াছিল । আর দুজনের সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় পরিবারকে পুড়িয়ে মেরে দেয় । পরের দিন খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে হেডিং বেরিয়েছিল , গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে মৃত্যু পুরো পরিবারের । „

আকাশের বাবা একটু হলেও দুঃখ পেলেন । পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মেরে দিয়েছিল ভাবতেই আকাশের বাবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো , “ কেউ বেঁচে নেই ? „

“ আছে । একটা পরিবারের ছোট ছেলে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো । আর একটা পরিবারের বড় মেয়ে বাইরে কাজের সূত্রে গেছিল । এই দুজনই বেঁচে আছে । „

“ তারা এখন কোথায় ? „

“ যাকে রেপ করেছিল তার নাম শালিনী । সে তো এই পার্ক স্ট্রিটে বিয়ে করে সংসার করছে । যে মেয়েটা বাইরে গেছিল কাজের সূত্রে সে এখানে এসে এইসব দেখে আবার চলে যায় । তারপর আর ফেরেনি । আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কিন্তু সে রাজি হয় নি । আর যে ছেলেটা হোস্টেলে ছিল সে তো এখন আমেরিকায় । „

“ তাহলে শুধু ওই পার্ক স্ট্রিটের মেয়েটাই ভরসা । „ কথাটা বলে আকাশের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ।

মোঃ শেখ বললো , “ আর যদি আপনি আপনার মেয়েকে এই বিপদে ফেলতে চান তাহলে সেও । „

“ আমি কোন পরোয়া করিনা । ওই নরকের পোকা গুলো এইভাবে ভদ্র সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে ! আর না জানি কত মেয়ের জীবন নিয়ে খেলবে । এইভাবে চলতে দেওয়া যায় না । আমি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলবো । ও যদি রাজি হয় তাহলে সুচিকেও রাজি করাবো । „

“ সুচি কে ? „

“ সুচিত্রা মিত্র । আমার মেয়ে । মানে আমার ছেলের স্ত্রী । ওর মুখেই ...

“ ওওও । „  সুচিত্রা কে চিনলেও ডাকনাম সুচিকে মোঃ শেখ চিনতো না । সে কিছুক্ষন সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো । সূর্য প্রায় ডুবে গেছে বলা যায় । হঠাৎ সে বলে উঠলো , “ এখন আমায় বাড়ি ফিরতে হবে । আপনি এক কাজ করুন । রবিবার আসুন , দুজনে যাবো । „

আরো কিছুক্ষন কথা বলে আকাশের বাবা বাড়ির রাস্তা ধরলেন । আজ এক নতুন শক্তি , উদ্দোম তার রক্তে বইতে শুরু করলো ।

এর দুই দিন রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমানোর পর সুচি আবার সেই স্বপ্নটা দেখলো । সে একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে । আশেপাশে কেউ নেই । দূর থেকে একটা ছেলে ছুটে আসছে । সুচি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে কিন্তু কেউ আসছে না । ছেলেটা কাছে এসে হাতে ধরে থাকা বোতলের জল ছুঁড়ে দিল সুচির মুখে ।

সুচি ধড়মড় করে উঠে বসলো । খাটে বসে দ্রুত নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ছাড়তে লাগলো । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে । হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করছে তীব্র বেগে । কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে সে আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছে ।

সুচি একটা নিশ্চিন্তের ঢোক গিলতেই আকাশ উঠে বসলো । ঘুম জড়ানো চোখে নাইট বাল্বের আলোয় সে সুচির মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতো পেলো । পাশের টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে , ছিপি খুলে , সুচির দিকে বাড়িয়ে দিতেই সুচি এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে নিল ।

জল খেয়ে ধাতস্থ হওয়ার পর আকাশ জিজ্ঞেস করলো , “ আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছো ? „

সুচি কিছু না বলে আকাশকে জড়িয়ে ধরলো । আকাশও কথা না বাড়িয়ে সুচিকে বুকে টেনে নিল । এই নিয়ে দুবার সে এই দুঃস্বপ্নটা দেখলো । কেন বারবার সে এই দুঃস্বপ্নটা দেখছে সেটা জানে না । আর কতবার দেখতে হবে সেটাও জানা নেই । এখনও পর্যন্ত এই ব্যাপারটা আকাশ বাদে কেউ জানে না । সুচিই বলতে বারণ করে দিয়েছে । অযথা সবাই চিন্তা করবে ।

কিন্তু এইভাবে তো দিন কাটানো যায় না । সুচি আকাশের বুকে মাথা রেখে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিল । বহু আগেই এটা করা উচিত ছিল । যদি করতো তাহলে এই দিন হয়তো দেখতে হতো না ।

পরের দিন অফিস থেকে ফেরার সময় সুচি আকাশকে বললো , “ শোভাবাজার চলো । „

আকাশ জিজ্ঞেস করলো , “ শোভাবাজার কেন ? „

“ চলো না । বলছি । „

শোভাবাজারের একটা গলির ভিতর ঢুকে , নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে , একটা বাড়ির সামনে বাইক পার্ক করতে আকাশ দেখলো সেটা একটা  ক্লিনিক । ডাক্তারের ক্লিনিক নয় , একজন সাইকায়াট্রিস্ট এর ক্লিনিক । একটা বোর্ডে লেখা আছে , ড. পিয়ালি গুপ্তা , সাইকায়াট্রিস্ট । নিচে কিছু ডিগ্রি লেখা আছে কিন্তু সেগুলোর মানে আকাশ জানে না ।

সাইনবোর্ডে নাম পড়ে আকাশ খুব অবাক হলো , “ এখানে কি দরকার ? „

সুচি বাইক থেকে নেমে বললো , “ এপয়েন্টমেন্ট আছে তাই । „

“ কিন্তু কি দরকারে ? „

“ আমার দুঃস্বপ্ন আর বদমেজাজী স্বভাবের জন্য । যদি এটা কয়েক বছর আগে করতাম তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো । তুমি প্লিজ মা বাবা কে বলো না । এক ঘন্টার ব্যাপার প্লিজ ম্যানেজ করে নিও ।„

সুচির কথায় আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । সুচির এই সিদ্ধান্তে তার কিছু বলার নেই । কি বলবে সেটাই তো জানা নেই । যদি এর জন্য দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই । তাই আকাশ চুপচাপ সুচির পিছন পিছন গিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে রইলো । যতক্ষন না তার ট্রিটমেন্ট শেষ হয় । বলা বাহুল্য সুচির এই ট্রিটমেন্টের কথা ঘুনাক্ষরেও সুচি আর আকাশের পরিবার জানতে পারলো না ।
[Image: 20220401-214720.png]
[+] 8 users Like Bichitro's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) চলছে :--- - by Bichitro - 25-01-2022, 09:35 AM



Users browsing this thread: 112 Guest(s)