11-01-2022, 11:41 AM
আট
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ভাবছিলাম আমি কি কিনব আর এদিক ওদিক চাইছিলাম। সেই রকম ভাবেই চোখ এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে, মনে হলো ওই অন্ধকারে একটা দলে, আমি অর্জুন কে দেখলাম। ওরকম লম্বা তো সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু মনে হলো ওর কি ইঞ্জিনিয়ারীং পড়ার বয়েস হয়ে গেল? এই তো কবে শুনলাম টেন্থ দেবে। ও নয় মনে হয়। আবার ভাবছি নাহ এতো ভুল তো দেখব না। ওকে চিনতে পারব না তা কি করে হয়? লাস্ট বার যখন ওকে দেখেছিলাম, ওর মুখ টা মনে করার চেস্টা করলাম। আর সাথে সাথেই চোখে ভেসে উঠল ওর হাসি মুখ টা, মায় গালে ওঠা একটা ছোট্ট পিম্পল অব্দি। আর আমি ওকে ভুল করব?
আমি ওকে হাঁ হয়ে দেখছিলাম। ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতন সব মাথায় রিকল্ড হয়ে গেল। মার খাওয়া। পুকুর থেকে বাঁচানো। সন্ধ্যে বেলার ওর মায়ের সাথে ঝগড়া আর রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না ও। রোজ সকালে উঠে হরলিক্স খাওয়া, দৌড়তে যাওয়া, সব কিছু।
আমি ফিরে গেলাম ওই জটলার কাছে। চার পাঁচ টা ছেলে রয়েছে। ওদের মধ্যে পিছনে বসে রয়েছে ও। মনের সুখে সিগারেট এ টান দিচ্ছে। আমি তো জানতাম ই না ও এখানে পড়ে। আমি গেটের ভিতরে চলে এলাম। কিকবক্সিং করতাম আমি তখন। মাথায় একটা ফেটি কিম্বা ক্যাপ আমার থাকত। তখনো ন্যাড়া মাথা আমার। সেদিনে মাথায় একটা ফেটি ছিল আমার সেটা খুলে ক্যাপ টা পরে নিলাম আমি। তখন ক্যাম্পাস এ ফুটবল ও খেলি ছেলেদের সাথে। সমস্যা হয় না। পাল্লা দিয়ে খেলতেও পারি।
ও আমাকে দেখতে পায় নি তখনো, অন্ধকার তো রাস্তা টা। আর দোকানের সামনে আলো জ্বলছে। সব থেকে লম্বা সুঠাম চেহারা ওর। দূর থেকে ওকে চেনা যায়। ডাকব? নাহ সিগারেট খাচ্ছে। যদি লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু ওর সাথে কথা না বলে কি ভাবে থাকব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বাবাহ সেই ছোট ছেলে টা এখন সিগারেট ও খাচ্ছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষন। ওদের সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে ওকে ডাকলাম।
আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো এতে কোন সন্দেহ নেই। চোখে অবাক হবার সাথে একটা খুশীর ঝলক। আনন্দ পেয়েছে সেটা ওর চোখে মুখে পরিষ্কার। ওর বন্ধু গুলো একটু অবাক। ও পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে ওদের সাথে।
- আমার মিমি।
মাসী বা ছোট মাসী বলল না। ও ওদের বন্ধু দের বিদেয় দিয়ে আমার সাথে হাঁটতে লাগল। বললাম
- কোন স্ট্রিম এ আছিস
- মেক। তুমি এখানে?
- পি এইচ ডি
- বাহ। কোন হোস্টেল এ আছ?
- আমি হস্টেল এ থাকি না। ওই যে আমার ফ্ল্যাট।
বলে আঙ্গুল তুলে আমি আমার ফ্ল্যাটের দিকে দেখালাম।
আমি জানি এখন ওদের সিঙ্গেল রুম নয়। ওকে বলে দিলাম, আমার সিঙ্গেল রুম ফ্ল্যাট এবং যথেষ্ট ভাল। ভিতরে সব কিছু ব্যবস্থা আছে। ওর অসুবিধা হলে যেন চলে আসে আমার রুম এ। আমার ভাই ওর বন্ধু। ও বলল আমার ভাই মানে, তুহিন এর সাথে ওর কথা খুব হয়। প্রায় ই ফোন করে একে অপর কে। ওকে দেখে যেন আমি বিহবল হয়ে গেছি। কেমন আছে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা, কোনটার পরে কি জিজ্ঞাসা করব খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা পয়সা আছে কিনা। ও সাড়া দিল না। আমি বললাম
- কেন বাবার কাছ থেকে নিস না?
- দিত আগে। কিন্তু এখন কমিয়ে দিয়েছে।
- কেন?
- জেনে গেছে আমি স্মোক করি।
- কটা খাস দিনে?
- বেশী খাই না। হয়ত চার পাঁচটা হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের ধারনা আমি অনেক খাই।
- ড্রিঙ্ক করিস না তো?
- নাহ এখনো অব্দি করিনি। তবে ইচ্ছে আছে
- তবে রে দুষ্টু।
- না না এখন না চাকরী বাকরী পেলে করব।
আমি জানি ও মিথ্যে বলে না। ওর জীবন দর্শন টা খুব সিম্পল। কিছু করলে লুকোয় না। আর নিজের করা কোন কাজ মেনে নিতে পিছুপা হয় না। আর কিছুই বেশি বাড়াবাড়ি করে না ও। আমি বললাম
- খেলা ধুলা করছিস?
- হুম , তবে আর ফুটবল খেলি না
- তবে?
- বক্সিং করি
- তাই? আমিও কিক বক্সিং করি। একদিন চলে আয় রিং এ।
- তুমি পারবে না আমার সাথে
- ভারী তোর ক্ষমতা।
- ঠিক আছে দেখো।
কিছুক্ষন গল্প করে আমি চলে এলাম আমার ফ্ল্যাট এ। নিজের পড়াশোনা নিয়ে মত্ত হয়ে গেলাম। তখনো নর্ম্যাল আর ভীষন ক্যাসুয়াল ছিলাম । রোজ ই গেটের বাইরে ওকে দেখি। খানিক গল্প করি আর চলে আসি নিজের ফ্ল্যাট এ। একদিন ওকে দেখলাম জিম এ। সকালে। আমি সাধারনত যেতাম খুব সকালে। আর ও হয়ত একটু পরে। সেদিনে আমার লেট হয়েছিল আর দেখা হলো। দেখলাম বক্সিং গ্লাভস পরে বসে আছে। আমার হয়ে গেছিল ওয়ার্ক আউট। ওর জন্য বসে গেলাম কিছুক্ষন। তারপরে ও বেরোলে দুজনে মিলে কচুরী তরকারি খেয়ে যে যার দিকে হাঁটা।
বড় হয়েছে ও। বন্ধু বান্ধব কত কিছু হবে এই সময়ে। আমি চাইতাম না ওকে বেশি দেখা দিতে বা কথা বলতে। হয়তো ও অপছন্দ করে সেটা। হয়ত চায় না মিমি সারাক্ষণ পিছনে ঘুরঘুর করুক। এভয়েড ঠিক না কিন্তু ওই রাস্তা ঘাটে যত টুকু দেখা হতো তত টুকুই হত। এর বেশী আমি আর ট্রাই নিতাম না। সেই রকম ই একদিন দেখা হলো দুপুর বেলায় ও আর একটা বন্ধু। রাহুল। ছেলে টা কলকাতার ছেলে। দুজনাকেই বললাম
- খেয়েছিস তোরা?
রাহুল বলল
- হ্যাঁ আমি তো খেয়েছি, কিন্তু অর্জুন কোন দিনেই খায় না।
- কেন?
অর্জুন ততক্ষনে রাহুল কে থামাতে চাইছে। রাহুল বলে দিল
- মাসী জানিনা, ওকে আমি কোন দিন ও খাবার শেষ করে উঠতে দেখিনি।
কথা শেষ ও হলো না। অর্জুন ওকে টেনে নিয়ে চলে গেল অন্য ক্লাসে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। আমি তো চিরকাল ই একটু অন্যরকম। কেউ বলতে না চাইলে জানার কোন ইচ্ছে আমার হয় না। বুঝলাম অর্জুন ওকে কথাটা আমাকে বলতে দেবে না বলেই টেনে নিয়ে চলে গেল। ভাবলাম, বুঝুক গা ওর মা। আমি কি করব। আবার ভাবলাম হস্টেলে না থাকলে এই ব্যাপার গুলো তো ও শিখবে না ও কোন দিন।
হস্টেলে থাকা তো শুধু মজা আর মস্তি না। হস্টেলে থাকা একটা লার্নিং। একটা নিজের উপরে খোঁজ চালানো চার বছর ধরে। এই খোঁজ টাই তাকে স্ট্রং করে পরবর্তী জীবনে। কত কিছু শেখা। নতুন জিনিস এডপ্ট করা। হস্টেলে প্রতিটা মানুষ একা, কিন্তু দেখতে গেলে সবাই একসাথে। এই খোঁজ টা তো ওকেও পেতে হবে। শিখুক। আমি আর বেশি মাথা ঘামাবো না। কিন্তু ও খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না, এই ভাবনা টা কে ফেলে দিতে পারলাম না। মনে কোন এক কোনায় রয়ে গেল।
তারপর থেকে দেখা হলে, কোন দোকানে নিয়ে গিয়ে দুজনে খেতাম। বলা ভালো ওকে খাওয়াতাম। চিকেন বেশী করে। ভাবতাম হস্টেল এ যেটা পাচ্ছে না সেটা মাঝে মাঝে পুষিয়ে নিলে ঠিক আছে। জানিনা কেন, আমি যখন ই নিজের ঘরে খেতে বসতাম রাহুলের কথা টা আমার মনে পড়ত। - যে অর্জুন কিছুই খায় না। এই সব মুখ চোরা ছেলের বাইরে না বেরোনোই উচিৎ। ওর মা কিচ্ছু শেখায় নি ওকে।
বুঝতাম না কিছুই। কেন এই ভাবনা। এই আমার সমস্যা। অবসেসড হয়ে পড়ি। ব্যালান্স করতে পারছি না এখনো নিজের ভাবনার সাথে, নিজের মনে সাথে জীবনের। ভাবতাম গত তিন চার বছর তো আমার অর্জুনের কথা মনেও পড়ে নি। এখন ভাবছি কেন। ও তো তখনো এমনি ই ছিল। তখন আমার সমস্যা হয় নি এখন হচ্ছে কেন? ভাবলাম এখানে আমি আছি, ওর মা জানে, ওর কিছু হলে হয়ত ওর মা বলবে ছেলে টা কে দেখতে পারিস নি? সেই ভয়েই কি করছি আমি এমন? হতেও পারে।
এই ভাবে চলল তো কিছু দিন। একদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি ওকে দেখলাম না গেটের বাইরে। কিছু মনে হয় নি। ভাবলাম হয়ত আসে নি আজকে। পরের দিন সকালেও ওকে দেখলাম না জিম এ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কি মনে হলো, ও যখন এলো না, ওর হস্টেলে গেলাম খুঁজে পেতে। অনেকক্ষণ পরে একটা ছেলে নেমে বলল,জ্বর এসেছে বেশ। নামতে পারছে না।
- সেকী, ওষুধ খাচ্ছে না সেটাও খায় নি?
- কি জানি।
বলে ছেলেটা চলে গেল। আমি আর রিস্ক নিলাম না। নিজেকে আর নর্ম্যাল আর ক্যাসুয়াল রাখতে পারলাম না। একেই খাওয়া দাওয়া করে না। তার পরে জ্বর। ওকে নিয়ে যাব আমার ফ্ল্যাট এ। কি ছেলে রে বাবা। একটু সাবধানে থাকতে হয় তো। এখানে তোর মা আছে? নাহ ওকে নিয়ে যাই, সারিয়ে আবার দিয়ে যাব এখানে। রাহুল কে ডাকলাম। ও এসেই আমাকে ওয়ার্ডেনের কাছে নিয়ে গেল হস্টেল ওয়ার্ডেন কে নিজের পরিচয় দিলাম। আমি যে ওর মাসী হই সেটা বলতেই ওকে ছেড়ে দিল আমার সাথে। রাহুল আর একটা ছেলে ওকে ধরে ধরে নামিয়ে নিয়ে আসতেই, আমি রিকশা করে ওকে আমার ফ্ল্যাট এ নিয়ে এলাম।
বিছানায় শুইয়ে দিতেই জবুথবু হয়ে শুয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস নিয়ে এলাম। গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। আমার কাছে ছিল প্যারাসিটামল। ওকে একটু গরম চা করে আর দুটো বিস্কুট খাইয়ে, ওষুধ টা গিলিয়ে, বেড়িয়ে পড়লাম, ডাক্তারের খোঁজে। আমাদের জিমের যে ইন্সট্রাক্টার তার একজন বন্ধু ছিল ডাক্তার। তাকে পেলাম, সে এলো আমার সাথে। ওকে চেক করে বলল,
- সাধারন জ্বর। ভাইরাল। ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটু ভোগাবে। সাবধানে রাখতে হবে।
ডাক্তার কে বিদায় দিয়ে, টাকা পয়সা মিটিয়ে, ওষুধ গুলো কিনলাম।একটা থার্মোমিটার কিনলাম। কিছু ফল কিনলাম। বেশ কিছু ডিম নিয়ে নিলাম। আর চিকেন কিনলাম। হয়ে যাবে আশা করি। বাড়িতে এসে দেখি, জ্বর টা কমেনি। আমি ওকে পাউরুটি আর ডিম সিদ্দ খাইয়ে, ওষুধ দিয়ে শুইয়ে দিলাম। প্যারাসিটামল আগেই দিয়ে রেখেছিলাম আমি।
ভাবলাম পরের ছেলে, ওর বাড়িতে খবর দিয়ে দেওয়াই ভাল? তারপরে ভাবলাম, ওর মা চলে আসবে। ওকে নিয়ে যাবে। এই অবস্থায় মুভ না করানোই ভাল। দেখি কাল অব্দি না কমলে খবর তো দিতেই হবে। আমি রান্না করে নিলাম। খুব যে ভাল করতে পারি সেই নিয়ে কোন বিশ্বাস আমার ছিল না। কেউ তো শিখিয়ে দেয় নি রান্না আমাকে। আর আমার রান্না কেউ খায় ও নি আজ পর্যন্ত। যে, ভালো কি মন্দ কিছু জানব। খুব হালকা চিকেন আলুর ঝোল আর ভাত। ওর জন্য একটু উচ্ছে সিদ্দ। জ্বর টা কিছু বাদেই দেখলাম কমে গেল। ওকে বললাম স্নান করতে হবে না তোকে আজকে। কালকে জ্বর টা না এলে স্নান করিস। উত্তরে বলল
- খিদে পেয়েছে।
খেলো, বলতে নেই অনেক টা ভাত। আমি দেখলাম একে এখন হস্টেলে ছাড়া যাবে না। থাকুক কিছু দিন এখানে। ওর তো কোন কিছু তেই না নেই আর হ্যাঁ ও নেই। বিশেষ করে খাওয়া দাবার ব্যাপারে। উচ্ছে সিদ্দ টাই খেল অনেক টা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমার ঘরে থাকা একটা দুটো গল্পের বই পড়ল। দুপুরে ফল কেটে দিলাম খেল। আমি চাইছিলাম, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক ছোঁড়া।
ও একটু ভালো আছে দেখে ওকে বেরোতে মানা করে আমি গেলাম ক্লাস এ। পি এইচ ডির কাজ তখন ফুল ফ্লেজড চলছে আমার। সময় নষ্ট করার সামান্য ও সময় নেই। ফিরে আসছিলাম তাড়াতাড়ি। ভুলে গেছিলাম বাড়িতে অর্জুন আছে। আর ও অসুস্থ। ভাবলাম রান্না করাই আছে। রুটি নিয়ে নি অর্জুনের জন্য। জ্বর গা, ভাত খাওয়া ঠিক হবে না রাতে। রুটি কিনে ঢুকে দেখি, আরো একটা ছেলে এসেছে। রাহুল।
বলল
- ওই যে মাসী এসে গেছে। এবারে আমি যাই। আর কোন বই লাগলে বলিস দিয়ে যাব।
- আর বেসিক ইলেক এর নোটস?
- কালকে সকালে দিয়ে যাব, না হয় মাসীর ডেপ্ট এ দিয়ে আসব মাসীর কাছে।
কিছু খেয়ে যেতে বললাম। খেলো না রাহুল। আমাকে বলল
‘- মাসী ওকে এখানে এনে ভালো করেছ তুমি। আমার চিন্তা হচ্ছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।
রাতে খাইয়ে দাইয়ে ওকে বললাম
- চুপ করে ঘুমোবি। পড়াশোনা দুদিন থাক। আর হ্যাঁ আমি জানি রাহুলের আসার কারনের মধ্যে সিগারেট নিয়ে আসাও একটা কারন। এখন নো স্মোকিং, মনে থাকবে?
কোন কথা বলল না ও। ঘাড় নাড়ল। ওকে শুইয়ে দিলাম মশারী টাঙিয়ে। আর আমি বাইরে ডাইনিং এ আসন পেতে পড়তে বসলাম। মাঝে মাঝেই উঠে দেখে আসছিলাম গায়ে জ্বর আছে নাকি। রাত তখন দুটো, গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম জ্বর টা আসছে। পায়ের পাতাও ঠান্ডা মনে হলো। ওকে তুলে প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলাম আমি। ওকে চাপা দিয়ে দিলাম, একটা কম্বল ছিল আমার সেটা দিয়ে । আধ ঘন্টা বসলাম পাশে। দেখলাম একটা সময়ে ঢাকা টা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। বুঝলাম ঘামছে ও। জ্বর টা নামছে।
জ্বরের সময়ে করণীয় ব্যাপার গুলো সব আমি জানি। ছোট বেলায় জ্বর আসলে আমার ট্রিট্মেন্ট নিজেই করতাম। ছোড়দি চলে যাবার পরে আমি তো কাউকে বলতাম ও না এই রকম কিছু হলে। মায়ের অতো সময় ছিল না অতো গুলো ছেলে মেয়েকে ধরে ধরে জ্বরের সময়ে কাছে নিয়ে শোবার। আর তাছাড়া, আমি গ্র্যাজুএশন থেকেই একলা থাকি। কাজেই এই ব্যাপার গুলো জানতাম।
আমি ফ্যান টা হালকা চালিয়ে দিয়ে, বাইরে এসে পড়তে বসলাম। জানিনা হয়ত চোখ টা লেগে গেছিল পড়তে পড়তে। চোখ টা খুলল
- গুড মর্নিং মিমি
তাকিয়ে একলাম সেই এক গাল হাসি আর এক হাতে একটা কাপ অন্য হাতে একটা গ্লাস।
- গুড মর্নিং। উঠে পরেছিস কেন? দেখি!
বলে কপালে হাত দিতেই বুঝলাম, জ্বর নেই। ঠান্ডা ওর গা। ও বলল
- জ্বর নেই গো বাবা। জ্বর হলে আমার কোন হুশ থাকে না। মা কে জিজ্ঞাসা কোর বলে দেবে। কিন্তু তোমার না একটাই কাপ, তাই গ্লাসে চা টা আনতে হলো।
আমি ওকে দেখছিলাম। ওর হাত থেকে গ্লাস টা নিতে গেলাম। ও কাপ টা নিতে বলল আমাকে।
- কেন? কাপে তুই খা
- না না গ্লাস টা গরম তুমি পারবে না হাতে নিতে।
- আর তুই খুব পারবি? তুই আমার ছেলে না আমি তোর? দে গ্লাস টা আমাকে।
বলে একবারে ছিনিয়ে নিলাম গ্লাস টা । উফ সত্যি গরম। মেঝেতে রেখে দিলাম গ্লাস টা। ওকে আসন টা এগিয়ে দিলাম আমি। বললাম, খালি মেঝেতে বসিস না। এই আসনে বস। ও বলল,
- ঘরে চল। এখানে বসার ই বা কি দরকার
ঘরে গিয়ে মশারী তুলে দুজনে চা খেতে বসলাম। সকাল হচ্ছে আসতে আসতে। বড্ড ভাল লাগছে। জানি না কেন।
সেই দিন টা খুব ব্যস্ত ছিলাম। সেই অবস্থাতেই ফাঁকে ফোঁকরে, স্যার এর স্কুটি টা নিয়ে ওকে দেখে আসছিলাম আমি। রান্না করে দিয়ে এসেছিলাম সকালেই। শুধু ওকে নিয়ে খেয়ে নিতে হতো। জ্বর টা আসে নি। তাও, আমি যাচ্ছিলাম ওষুধের সময় গুলো তেই, খাইয়ে দিয়ে আসছিলাম ওষুধ।
সন্ধ্যে বেলায় ফিরে ওর সাথেই সময় কাটালাম আমি। ওর সাথে গল্প করে। আমার মা দিদিরা বলে ও কথাই বলে না একদম। কই সে রকম না তো। কত কথাই তো বলল, পুটুর পুটুর করে। কম কথা বলে কিন্তু বলছিল কথা। সাবজেক্ট ডেপথ মারাত্মক। কিন্তু জীবন সম্পর্কে বেশী জ্ঞান না থাকলেও, কথা মন্দ বলে না ও। ওকে আমার ছোট থেকেই ভালো লাগত। কিন্তু আজকে যেন নতুন করে একটা ভালো লাগা তৈরি হলো।
এমন নিঃশব্দ ঘুম আমি কারোর দেখিনি। এতো কাছ থেকে ওকে দেখিনিও আগে আমি। ও ঘুমোল আর আমি সারা রাত পড়ার নাম করে লাইট জ্বেলে আমি ওকে দেখলাম। ভগবান ওকে অনেক যত্ন করে তৈরি করেছে। নিখুঁত শরীর। না না, উপর থেকেই দেখছি। লম্বা নাক। পুরুষালী কিন্তু বেশ মিস্টি একটা মুখ। গালে হালকা দাড়ি। হালকা গোঁফের রেখা। পেশীবহুল নয় কিন্তু শক্তিশালী হাত। এই শক্তিশালী হাতের পরিচয় আমি পেয়েছি জিম এ। এদিকে কাত হয়ে, হাত দুটো কে বুকের কাছে জড় করে স্টাইল করে ঘুমোচ্ছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ভাবছিলাম আমি কি কিনব আর এদিক ওদিক চাইছিলাম। সেই রকম ভাবেই চোখ এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে, মনে হলো ওই অন্ধকারে একটা দলে, আমি অর্জুন কে দেখলাম। ওরকম লম্বা তো সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু মনে হলো ওর কি ইঞ্জিনিয়ারীং পড়ার বয়েস হয়ে গেল? এই তো কবে শুনলাম টেন্থ দেবে। ও নয় মনে হয়। আবার ভাবছি নাহ এতো ভুল তো দেখব না। ওকে চিনতে পারব না তা কি করে হয়? লাস্ট বার যখন ওকে দেখেছিলাম, ওর মুখ টা মনে করার চেস্টা করলাম। আর সাথে সাথেই চোখে ভেসে উঠল ওর হাসি মুখ টা, মায় গালে ওঠা একটা ছোট্ট পিম্পল অব্দি। আর আমি ওকে ভুল করব?
আমি ওকে হাঁ হয়ে দেখছিলাম। ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতন সব মাথায় রিকল্ড হয়ে গেল। মার খাওয়া। পুকুর থেকে বাঁচানো। সন্ধ্যে বেলার ওর মায়ের সাথে ঝগড়া আর রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না ও। রোজ সকালে উঠে হরলিক্স খাওয়া, দৌড়তে যাওয়া, সব কিছু।
আমি ফিরে গেলাম ওই জটলার কাছে। চার পাঁচ টা ছেলে রয়েছে। ওদের মধ্যে পিছনে বসে রয়েছে ও। মনের সুখে সিগারেট এ টান দিচ্ছে। আমি তো জানতাম ই না ও এখানে পড়ে। আমি গেটের ভিতরে চলে এলাম। কিকবক্সিং করতাম আমি তখন। মাথায় একটা ফেটি কিম্বা ক্যাপ আমার থাকত। তখনো ন্যাড়া মাথা আমার। সেদিনে মাথায় একটা ফেটি ছিল আমার সেটা খুলে ক্যাপ টা পরে নিলাম আমি। তখন ক্যাম্পাস এ ফুটবল ও খেলি ছেলেদের সাথে। সমস্যা হয় না। পাল্লা দিয়ে খেলতেও পারি।
ও আমাকে দেখতে পায় নি তখনো, অন্ধকার তো রাস্তা টা। আর দোকানের সামনে আলো জ্বলছে। সব থেকে লম্বা সুঠাম চেহারা ওর। দূর থেকে ওকে চেনা যায়। ডাকব? নাহ সিগারেট খাচ্ছে। যদি লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু ওর সাথে কথা না বলে কি ভাবে থাকব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বাবাহ সেই ছোট ছেলে টা এখন সিগারেট ও খাচ্ছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষন। ওদের সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে ওকে ডাকলাম।
আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো এতে কোন সন্দেহ নেই। চোখে অবাক হবার সাথে একটা খুশীর ঝলক। আনন্দ পেয়েছে সেটা ওর চোখে মুখে পরিষ্কার। ওর বন্ধু গুলো একটু অবাক। ও পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে ওদের সাথে।
- আমার মিমি।
মাসী বা ছোট মাসী বলল না। ও ওদের বন্ধু দের বিদেয় দিয়ে আমার সাথে হাঁটতে লাগল। বললাম
- কোন স্ট্রিম এ আছিস
- মেক। তুমি এখানে?
- পি এইচ ডি
- বাহ। কোন হোস্টেল এ আছ?
- আমি হস্টেল এ থাকি না। ওই যে আমার ফ্ল্যাট।
বলে আঙ্গুল তুলে আমি আমার ফ্ল্যাটের দিকে দেখালাম।
আমি জানি এখন ওদের সিঙ্গেল রুম নয়। ওকে বলে দিলাম, আমার সিঙ্গেল রুম ফ্ল্যাট এবং যথেষ্ট ভাল। ভিতরে সব কিছু ব্যবস্থা আছে। ওর অসুবিধা হলে যেন চলে আসে আমার রুম এ। আমার ভাই ওর বন্ধু। ও বলল আমার ভাই মানে, তুহিন এর সাথে ওর কথা খুব হয়। প্রায় ই ফোন করে একে অপর কে। ওকে দেখে যেন আমি বিহবল হয়ে গেছি। কেমন আছে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা, কোনটার পরে কি জিজ্ঞাসা করব খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা পয়সা আছে কিনা। ও সাড়া দিল না। আমি বললাম
- কেন বাবার কাছ থেকে নিস না?
- দিত আগে। কিন্তু এখন কমিয়ে দিয়েছে।
- কেন?
- জেনে গেছে আমি স্মোক করি।
- কটা খাস দিনে?
- বেশী খাই না। হয়ত চার পাঁচটা হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের ধারনা আমি অনেক খাই।
- ড্রিঙ্ক করিস না তো?
- নাহ এখনো অব্দি করিনি। তবে ইচ্ছে আছে
- তবে রে দুষ্টু।
- না না এখন না চাকরী বাকরী পেলে করব।
আমি জানি ও মিথ্যে বলে না। ওর জীবন দর্শন টা খুব সিম্পল। কিছু করলে লুকোয় না। আর নিজের করা কোন কাজ মেনে নিতে পিছুপা হয় না। আর কিছুই বেশি বাড়াবাড়ি করে না ও। আমি বললাম
- খেলা ধুলা করছিস?
- হুম , তবে আর ফুটবল খেলি না
- তবে?
- বক্সিং করি
- তাই? আমিও কিক বক্সিং করি। একদিন চলে আয় রিং এ।
- তুমি পারবে না আমার সাথে
- ভারী তোর ক্ষমতা।
- ঠিক আছে দেখো।
কিছুক্ষন গল্প করে আমি চলে এলাম আমার ফ্ল্যাট এ। নিজের পড়াশোনা নিয়ে মত্ত হয়ে গেলাম। তখনো নর্ম্যাল আর ভীষন ক্যাসুয়াল ছিলাম । রোজ ই গেটের বাইরে ওকে দেখি। খানিক গল্প করি আর চলে আসি নিজের ফ্ল্যাট এ। একদিন ওকে দেখলাম জিম এ। সকালে। আমি সাধারনত যেতাম খুব সকালে। আর ও হয়ত একটু পরে। সেদিনে আমার লেট হয়েছিল আর দেখা হলো। দেখলাম বক্সিং গ্লাভস পরে বসে আছে। আমার হয়ে গেছিল ওয়ার্ক আউট। ওর জন্য বসে গেলাম কিছুক্ষন। তারপরে ও বেরোলে দুজনে মিলে কচুরী তরকারি খেয়ে যে যার দিকে হাঁটা।
বড় হয়েছে ও। বন্ধু বান্ধব কত কিছু হবে এই সময়ে। আমি চাইতাম না ওকে বেশি দেখা দিতে বা কথা বলতে। হয়তো ও অপছন্দ করে সেটা। হয়ত চায় না মিমি সারাক্ষণ পিছনে ঘুরঘুর করুক। এভয়েড ঠিক না কিন্তু ওই রাস্তা ঘাটে যত টুকু দেখা হতো তত টুকুই হত। এর বেশী আমি আর ট্রাই নিতাম না। সেই রকম ই একদিন দেখা হলো দুপুর বেলায় ও আর একটা বন্ধু। রাহুল। ছেলে টা কলকাতার ছেলে। দুজনাকেই বললাম
- খেয়েছিস তোরা?
রাহুল বলল
- হ্যাঁ আমি তো খেয়েছি, কিন্তু অর্জুন কোন দিনেই খায় না।
- কেন?
অর্জুন ততক্ষনে রাহুল কে থামাতে চাইছে। রাহুল বলে দিল
- মাসী জানিনা, ওকে আমি কোন দিন ও খাবার শেষ করে উঠতে দেখিনি।
কথা শেষ ও হলো না। অর্জুন ওকে টেনে নিয়ে চলে গেল অন্য ক্লাসে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। আমি তো চিরকাল ই একটু অন্যরকম। কেউ বলতে না চাইলে জানার কোন ইচ্ছে আমার হয় না। বুঝলাম অর্জুন ওকে কথাটা আমাকে বলতে দেবে না বলেই টেনে নিয়ে চলে গেল। ভাবলাম, বুঝুক গা ওর মা। আমি কি করব। আবার ভাবলাম হস্টেলে না থাকলে এই ব্যাপার গুলো তো ও শিখবে না ও কোন দিন।
হস্টেলে থাকা তো শুধু মজা আর মস্তি না। হস্টেলে থাকা একটা লার্নিং। একটা নিজের উপরে খোঁজ চালানো চার বছর ধরে। এই খোঁজ টাই তাকে স্ট্রং করে পরবর্তী জীবনে। কত কিছু শেখা। নতুন জিনিস এডপ্ট করা। হস্টেলে প্রতিটা মানুষ একা, কিন্তু দেখতে গেলে সবাই একসাথে। এই খোঁজ টা তো ওকেও পেতে হবে। শিখুক। আমি আর বেশি মাথা ঘামাবো না। কিন্তু ও খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না, এই ভাবনা টা কে ফেলে দিতে পারলাম না। মনে কোন এক কোনায় রয়ে গেল।
তারপর থেকে দেখা হলে, কোন দোকানে নিয়ে গিয়ে দুজনে খেতাম। বলা ভালো ওকে খাওয়াতাম। চিকেন বেশী করে। ভাবতাম হস্টেল এ যেটা পাচ্ছে না সেটা মাঝে মাঝে পুষিয়ে নিলে ঠিক আছে। জানিনা কেন, আমি যখন ই নিজের ঘরে খেতে বসতাম রাহুলের কথা টা আমার মনে পড়ত। - যে অর্জুন কিছুই খায় না। এই সব মুখ চোরা ছেলের বাইরে না বেরোনোই উচিৎ। ওর মা কিচ্ছু শেখায় নি ওকে।
বুঝতাম না কিছুই। কেন এই ভাবনা। এই আমার সমস্যা। অবসেসড হয়ে পড়ি। ব্যালান্স করতে পারছি না এখনো নিজের ভাবনার সাথে, নিজের মনে সাথে জীবনের। ভাবতাম গত তিন চার বছর তো আমার অর্জুনের কথা মনেও পড়ে নি। এখন ভাবছি কেন। ও তো তখনো এমনি ই ছিল। তখন আমার সমস্যা হয় নি এখন হচ্ছে কেন? ভাবলাম এখানে আমি আছি, ওর মা জানে, ওর কিছু হলে হয়ত ওর মা বলবে ছেলে টা কে দেখতে পারিস নি? সেই ভয়েই কি করছি আমি এমন? হতেও পারে।
এই ভাবে চলল তো কিছু দিন। একদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি ওকে দেখলাম না গেটের বাইরে। কিছু মনে হয় নি। ভাবলাম হয়ত আসে নি আজকে। পরের দিন সকালেও ওকে দেখলাম না জিম এ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কি মনে হলো, ও যখন এলো না, ওর হস্টেলে গেলাম খুঁজে পেতে। অনেকক্ষণ পরে একটা ছেলে নেমে বলল,জ্বর এসেছে বেশ। নামতে পারছে না।
- সেকী, ওষুধ খাচ্ছে না সেটাও খায় নি?
- কি জানি।
বলে ছেলেটা চলে গেল। আমি আর রিস্ক নিলাম না। নিজেকে আর নর্ম্যাল আর ক্যাসুয়াল রাখতে পারলাম না। একেই খাওয়া দাওয়া করে না। তার পরে জ্বর। ওকে নিয়ে যাব আমার ফ্ল্যাট এ। কি ছেলে রে বাবা। একটু সাবধানে থাকতে হয় তো। এখানে তোর মা আছে? নাহ ওকে নিয়ে যাই, সারিয়ে আবার দিয়ে যাব এখানে। রাহুল কে ডাকলাম। ও এসেই আমাকে ওয়ার্ডেনের কাছে নিয়ে গেল হস্টেল ওয়ার্ডেন কে নিজের পরিচয় দিলাম। আমি যে ওর মাসী হই সেটা বলতেই ওকে ছেড়ে দিল আমার সাথে। রাহুল আর একটা ছেলে ওকে ধরে ধরে নামিয়ে নিয়ে আসতেই, আমি রিকশা করে ওকে আমার ফ্ল্যাট এ নিয়ে এলাম।
বিছানায় শুইয়ে দিতেই জবুথবু হয়ে শুয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস নিয়ে এলাম। গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। আমার কাছে ছিল প্যারাসিটামল। ওকে একটু গরম চা করে আর দুটো বিস্কুট খাইয়ে, ওষুধ টা গিলিয়ে, বেড়িয়ে পড়লাম, ডাক্তারের খোঁজে। আমাদের জিমের যে ইন্সট্রাক্টার তার একজন বন্ধু ছিল ডাক্তার। তাকে পেলাম, সে এলো আমার সাথে। ওকে চেক করে বলল,
- সাধারন জ্বর। ভাইরাল। ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটু ভোগাবে। সাবধানে রাখতে হবে।
ডাক্তার কে বিদায় দিয়ে, টাকা পয়সা মিটিয়ে, ওষুধ গুলো কিনলাম।একটা থার্মোমিটার কিনলাম। কিছু ফল কিনলাম। বেশ কিছু ডিম নিয়ে নিলাম। আর চিকেন কিনলাম। হয়ে যাবে আশা করি। বাড়িতে এসে দেখি, জ্বর টা কমেনি। আমি ওকে পাউরুটি আর ডিম সিদ্দ খাইয়ে, ওষুধ দিয়ে শুইয়ে দিলাম। প্যারাসিটামল আগেই দিয়ে রেখেছিলাম আমি।
ভাবলাম পরের ছেলে, ওর বাড়িতে খবর দিয়ে দেওয়াই ভাল? তারপরে ভাবলাম, ওর মা চলে আসবে। ওকে নিয়ে যাবে। এই অবস্থায় মুভ না করানোই ভাল। দেখি কাল অব্দি না কমলে খবর তো দিতেই হবে। আমি রান্না করে নিলাম। খুব যে ভাল করতে পারি সেই নিয়ে কোন বিশ্বাস আমার ছিল না। কেউ তো শিখিয়ে দেয় নি রান্না আমাকে। আর আমার রান্না কেউ খায় ও নি আজ পর্যন্ত। যে, ভালো কি মন্দ কিছু জানব। খুব হালকা চিকেন আলুর ঝোল আর ভাত। ওর জন্য একটু উচ্ছে সিদ্দ। জ্বর টা কিছু বাদেই দেখলাম কমে গেল। ওকে বললাম স্নান করতে হবে না তোকে আজকে। কালকে জ্বর টা না এলে স্নান করিস। উত্তরে বলল
- খিদে পেয়েছে।
খেলো, বলতে নেই অনেক টা ভাত। আমি দেখলাম একে এখন হস্টেলে ছাড়া যাবে না। থাকুক কিছু দিন এখানে। ওর তো কোন কিছু তেই না নেই আর হ্যাঁ ও নেই। বিশেষ করে খাওয়া দাবার ব্যাপারে। উচ্ছে সিদ্দ টাই খেল অনেক টা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমার ঘরে থাকা একটা দুটো গল্পের বই পড়ল। দুপুরে ফল কেটে দিলাম খেল। আমি চাইছিলাম, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক ছোঁড়া।
ও একটু ভালো আছে দেখে ওকে বেরোতে মানা করে আমি গেলাম ক্লাস এ। পি এইচ ডির কাজ তখন ফুল ফ্লেজড চলছে আমার। সময় নষ্ট করার সামান্য ও সময় নেই। ফিরে আসছিলাম তাড়াতাড়ি। ভুলে গেছিলাম বাড়িতে অর্জুন আছে। আর ও অসুস্থ। ভাবলাম রান্না করাই আছে। রুটি নিয়ে নি অর্জুনের জন্য। জ্বর গা, ভাত খাওয়া ঠিক হবে না রাতে। রুটি কিনে ঢুকে দেখি, আরো একটা ছেলে এসেছে। রাহুল।
বলল
- ওই যে মাসী এসে গেছে। এবারে আমি যাই। আর কোন বই লাগলে বলিস দিয়ে যাব।
- আর বেসিক ইলেক এর নোটস?
- কালকে সকালে দিয়ে যাব, না হয় মাসীর ডেপ্ট এ দিয়ে আসব মাসীর কাছে।
কিছু খেয়ে যেতে বললাম। খেলো না রাহুল। আমাকে বলল
‘- মাসী ওকে এখানে এনে ভালো করেছ তুমি। আমার চিন্তা হচ্ছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।
রাতে খাইয়ে দাইয়ে ওকে বললাম
- চুপ করে ঘুমোবি। পড়াশোনা দুদিন থাক। আর হ্যাঁ আমি জানি রাহুলের আসার কারনের মধ্যে সিগারেট নিয়ে আসাও একটা কারন। এখন নো স্মোকিং, মনে থাকবে?
কোন কথা বলল না ও। ঘাড় নাড়ল। ওকে শুইয়ে দিলাম মশারী টাঙিয়ে। আর আমি বাইরে ডাইনিং এ আসন পেতে পড়তে বসলাম। মাঝে মাঝেই উঠে দেখে আসছিলাম গায়ে জ্বর আছে নাকি। রাত তখন দুটো, গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম জ্বর টা আসছে। পায়ের পাতাও ঠান্ডা মনে হলো। ওকে তুলে প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলাম আমি। ওকে চাপা দিয়ে দিলাম, একটা কম্বল ছিল আমার সেটা দিয়ে । আধ ঘন্টা বসলাম পাশে। দেখলাম একটা সময়ে ঢাকা টা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। বুঝলাম ঘামছে ও। জ্বর টা নামছে।
জ্বরের সময়ে করণীয় ব্যাপার গুলো সব আমি জানি। ছোট বেলায় জ্বর আসলে আমার ট্রিট্মেন্ট নিজেই করতাম। ছোড়দি চলে যাবার পরে আমি তো কাউকে বলতাম ও না এই রকম কিছু হলে। মায়ের অতো সময় ছিল না অতো গুলো ছেলে মেয়েকে ধরে ধরে জ্বরের সময়ে কাছে নিয়ে শোবার। আর তাছাড়া, আমি গ্র্যাজুএশন থেকেই একলা থাকি। কাজেই এই ব্যাপার গুলো জানতাম।
আমি ফ্যান টা হালকা চালিয়ে দিয়ে, বাইরে এসে পড়তে বসলাম। জানিনা হয়ত চোখ টা লেগে গেছিল পড়তে পড়তে। চোখ টা খুলল
- গুড মর্নিং মিমি
তাকিয়ে একলাম সেই এক গাল হাসি আর এক হাতে একটা কাপ অন্য হাতে একটা গ্লাস।
- গুড মর্নিং। উঠে পরেছিস কেন? দেখি!
বলে কপালে হাত দিতেই বুঝলাম, জ্বর নেই। ঠান্ডা ওর গা। ও বলল
- জ্বর নেই গো বাবা। জ্বর হলে আমার কোন হুশ থাকে না। মা কে জিজ্ঞাসা কোর বলে দেবে। কিন্তু তোমার না একটাই কাপ, তাই গ্লাসে চা টা আনতে হলো।
আমি ওকে দেখছিলাম। ওর হাত থেকে গ্লাস টা নিতে গেলাম। ও কাপ টা নিতে বলল আমাকে।
- কেন? কাপে তুই খা
- না না গ্লাস টা গরম তুমি পারবে না হাতে নিতে।
- আর তুই খুব পারবি? তুই আমার ছেলে না আমি তোর? দে গ্লাস টা আমাকে।
বলে একবারে ছিনিয়ে নিলাম গ্লাস টা । উফ সত্যি গরম। মেঝেতে রেখে দিলাম গ্লাস টা। ওকে আসন টা এগিয়ে দিলাম আমি। বললাম, খালি মেঝেতে বসিস না। এই আসনে বস। ও বলল,
- ঘরে চল। এখানে বসার ই বা কি দরকার
ঘরে গিয়ে মশারী তুলে দুজনে চা খেতে বসলাম। সকাল হচ্ছে আসতে আসতে। বড্ড ভাল লাগছে। জানি না কেন।
সেই দিন টা খুব ব্যস্ত ছিলাম। সেই অবস্থাতেই ফাঁকে ফোঁকরে, স্যার এর স্কুটি টা নিয়ে ওকে দেখে আসছিলাম আমি। রান্না করে দিয়ে এসেছিলাম সকালেই। শুধু ওকে নিয়ে খেয়ে নিতে হতো। জ্বর টা আসে নি। তাও, আমি যাচ্ছিলাম ওষুধের সময় গুলো তেই, খাইয়ে দিয়ে আসছিলাম ওষুধ।
সন্ধ্যে বেলায় ফিরে ওর সাথেই সময় কাটালাম আমি। ওর সাথে গল্প করে। আমার মা দিদিরা বলে ও কথাই বলে না একদম। কই সে রকম না তো। কত কথাই তো বলল, পুটুর পুটুর করে। কম কথা বলে কিন্তু বলছিল কথা। সাবজেক্ট ডেপথ মারাত্মক। কিন্তু জীবন সম্পর্কে বেশী জ্ঞান না থাকলেও, কথা মন্দ বলে না ও। ওকে আমার ছোট থেকেই ভালো লাগত। কিন্তু আজকে যেন নতুন করে একটা ভালো লাগা তৈরি হলো।
এমন নিঃশব্দ ঘুম আমি কারোর দেখিনি। এতো কাছ থেকে ওকে দেখিনিও আগে আমি। ও ঘুমোল আর আমি সারা রাত পড়ার নাম করে লাইট জ্বেলে আমি ওকে দেখলাম। ভগবান ওকে অনেক যত্ন করে তৈরি করেছে। নিখুঁত শরীর। না না, উপর থেকেই দেখছি। লম্বা নাক। পুরুষালী কিন্তু বেশ মিস্টি একটা মুখ। গালে হালকা দাড়ি। হালকা গোঁফের রেখা। পেশীবহুল নয় কিন্তু শক্তিশালী হাত। এই শক্তিশালী হাতের পরিচয় আমি পেয়েছি জিম এ। এদিকে কাত হয়ে, হাত দুটো কে বুকের কাছে জড় করে স্টাইল করে ঘুমোচ্ছে।