11-01-2022, 10:22 AM
*লুকোচুরি*
জীবনটা কি অদ্ভুত, তাইনা? যখন শশ্মানে কাউকে দাহ করতে যাই তখন অজান্তেই এক শূণ্যতা ভর করে। আমাদের শেষ ঠিকানা! আজ শশ্মানে দাহ করতে এসেছি শশিভূষন বাবুকে। দীর্ঘদিন বৃদ্ধাশ্রমে ছিলেন তিনি, আর আমিই তাঁর লোকাল গার্ডিয়ান। মানে আমার হাত থেকেই আশ্রমে টাকাপয়সা যেত, উনার সুবিধা অসুবিধাও আমিই দেখতাম। উনার সন্তান পরিমল আমার বন্ধু ছিল, পরিমল ছোটবেলা থেকেই মাতৃহীন, বিদেশে থাকার জন্য বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা। প্রায় ১৪ বছরের মতন শশিভূষন বাবু বৃদ্ধাশ্রমে কাটিয়েছেন। তবে এই দীর্ঘসময়ে উনার ছেলে পরিমল একবারও আসেনি, এমনকি এই আধুনিক ইন্টারনেটের যুগেও কখনো ভিডিও কলে কথা বলেনি। আশ্রম কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আমাকে কয়েকবার বললেও আমি এড়িয়ে গেছি, তারাও আর বিশেষ ঘাঁটায়নি। ঠিক সময়ে টাকা পাচ্ছে এমনকি আমি কখনো অতিরিক্ত টাকার জবাব চাইনি, তাই হয়তো এ বিষয়কে আর তত গুরুত্ব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তারা ধরেই নিয়েছে শশিভূষন বাবুর উপর তার ছেলের কেবল সামাজিক দায় আছে কোনরকম আত্মীয়তার বন্ধন নাই, তাই অর্থের বিনিময়ে এই দায়মোচন করে চলেছে 'কুপুত্র'। তবে একটা বিষয় আমাকে বরাবর অবাক করেছে। শশিভূষন বাবু কখনো তার ছেলের সাথে দেখা করতে চাওয়া দূরে থাক কেমন আছে তাও জানতে চাইতেন না। আমি বছরে ১/২ বার পরিমলের পত্র ওনার হাতে দিতাম, উনি শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সেগুলো নিতেন, কোনোদিন সেগুলোর উত্তর দেন নি। উত্তর দেন নি এজন্য বলছি কারণ পরিমলের ঠিকানা একমাত্র আমি জানতাম, তাই চিঠি লিখতে হলে আমার মাধ্যমে ওঁকে পাঠাতে হত।
একসাথে এতবছর থাকার ফলে বৃদ্ধাশ্রমের সাথে শশিভূষন বাবুর একটা আন্তরিক আত্নীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছ। আশ্রমের বেশ কয়েকজন কর্মীছেলে এসেছেন দেখতে পাচ্ছি, প্রবীণদের মধ্যেও কয়েকজন উপস্থিত। কর্মীদের মধ্যে অল্পবয়সি একটা ছেলে, নাম পরিতোষ, এগিয়ে এল আমার কাছে। ছেলেটার চোখ ভেজা, বেশ শোক পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। কে বলে , স্বার্থ থেকে সৃষ্ট সম্পর্ক স্বার্থকে কখনো ছাড়িয়ে যায়না? আমি অবশ্য কোনো শোক বা বেদনা অনুভব করছি না, বরং ভারমুক্তির একটা অনুভুতি অনুভব করছি। চিন্তার জগৎ এ চলে গিয়েছিলাম বোধহয়, পরিতোষের কথায় চমক ভাংলো!
"কাকার তো দাহর সময় হয়ে এলো, পরিমল বাবুকে কি খবর দেওয়া হয়েছে? আসবেন? মুখাগ্নি করবেন কে?" অন্যদের মতন বডি না বলে কাকা বলা এবং 'পরিমল বাবু' শব্দ দুটো ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। অনেক কিছু জানাতে ইচ্ছে হল কিন্তু তার বদলে এমন কিছু বললাম যা হাস্যকর শোনাল, অবশ্য পরিতোষ বা তার সঙ্গীরা কেউই হাসল না, একটু অবাক হলো অবশ্য। আমি বললাম, "পরিমল এখানেই আছে, তবে মুখাগ্নি করার ক্ষমতা নাই ওর, তোমরা কেউ কর।" মনে হলো পরিতোষ একটু খুশীই হলো মুখাগ্নি করতে পেরে।
শশ্মানের কাজ শেষ হলে আরেকবার বৃদ্ধাশ্রমে আসলাম শশিভূষন বাবুর সব হিসাবনিকাশ চুকিয়ে দিতে। আমার সন্তান যদি এখানে না পাঠায় তবে এটাই আমার অন্তিমবার এখানে আসা। উনার হিসাবে বাকি বিশেষ কিছুই ছিল না, বরং কিছু টাকা জমা হিসেবে ছিল। সেগুলো আর ফেরত নিলাম না, ওদের ট্রাস্টেই দান করলাম! চলেই যাচ্ছিলাম, তখন পরিতোষ ডাক দিল, একটা ব্যাগ দিয়ে বলল, কাকার শেষ স্মৃতিচিহ্ণ। নিয়ে যান, এর উপর কেবল পরিমল দাদার অধিকার। বলতে বলতে ওর গলা বুজে আসল। আমি কোনো কথা না বলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
বিকালে আবার সেই শশ্মানে আসলাম। শশ্মানে এখনো চিতা জ্বলে চলেছে। একটু দূরে নদীর পাশে ঘাসের উপর বসলাম। প্রায় ১৫ বছর আগে আমি আর পরিমল এখানে বসেছিলাম আর একটা নাটকের প্লট রচনা করেছিলাম। তারপর এতবছর ধরে আমরা শুধু অভিনয় করে চলেছি।
পরিমল আমার খুব ভালো বন্ধু। না, ছোটবেলার বন্ধু নয়। আমাদের বন্ধুত্ব কর্মজীবনে। আমরা এক জায়গাতেই চাকরি করতাম। সেদিন অবশ্য পরিমল আমাকে এখানে ডেকে এনেছিল। প্রথমে জীবন নিয়ে সব দার্শনিকতার কথা শোনাচ্ছিল। তারপর বলল ওর ব্রেন ক্যান্সার। নিজের রোগের কথা এমনভাবে বলল যেন অন্য কারও রোগের কথা বলছে! তারপর নিজের বাবাকে নিয়ে পরিকল্পনা করল। এদেশে ওদের তেমন আত্নীয় কেউ ছিলনা। তারপর শুরু করল বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ। সবচেয়ে ভালো আশ্রমের সবচেয়ে ভালো রুমটাই সে ঠিক করল বাবার জন্য। তারপর বিভিন্ন বছরের তারিখ দিয়ে ৫০ টা চিঠি লিখে ফেলল। আমার কাজ সেসব চিঠি নির্দিষ্ট তারিখের ২/৩ দিন পর শশীভূষন বাবুর কাছে পৌঁছানো। নিজের চিকিৎসার জন্য সামান্য টাকা রেখে সবই আমার নামে ব্যাংকে জমা রাখল যেন ওর বাবার কখনো কোন অভাব না হয়। এরপর ৩ মাসের ভেতর পরিমল দেহ রাখল। প্রিয় বন্ধুকে আমি এই শশ্মানেই দাহ করেছিলাম। এতবছর ধরে এক "পিতার নিকট তার পুত্রের" এই গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছি। আর আজ তো সব শেষ।
সন্ধার পর বাসায় ফিরে বৃদ্ধাশ্রম থেকে আনা সেই ব্যাগটা চোখে পড়ল। আগামীকাল এটার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। তবে কৌতূহলী হয়ে একটু ব্যাগটা খুললাম, সাধারণ পোশাক, ৫০০ টাকার ৫ খানা নোট , কিছু খুচরা টাকা এসব ছাড়া একটা ডায়েরী পেলাম। সেখানে চিঠিগুলো রাখা, সবগুলো খামের মুখ বন্ধ, মানে তিনি কোনোদিনও ওগুলো খুলে দেখেননি। ডায়েরীতে সবই ফাঁকা, শুধু ভেতরে এক পৃষ্ঠায় লেখা- *“খুব ছোট থাকতে পরি আমার সাথে লুকোচুরি খেলত, ও কোথায় লুকাত আমি জানতাম কিন্তু কখনো সেখানে খুঁজতাম না পাছে খেলার মজা নষ্ঠ হয়। বাবা!! ডাক্তারি রিপোর্টগুলো কেন আরও কঠিন জায়গাতে লুকালি না?”*
#collected
জীবনটা কি অদ্ভুত, তাইনা? যখন শশ্মানে কাউকে দাহ করতে যাই তখন অজান্তেই এক শূণ্যতা ভর করে। আমাদের শেষ ঠিকানা! আজ শশ্মানে দাহ করতে এসেছি শশিভূষন বাবুকে। দীর্ঘদিন বৃদ্ধাশ্রমে ছিলেন তিনি, আর আমিই তাঁর লোকাল গার্ডিয়ান। মানে আমার হাত থেকেই আশ্রমে টাকাপয়সা যেত, উনার সুবিধা অসুবিধাও আমিই দেখতাম। উনার সন্তান পরিমল আমার বন্ধু ছিল, পরিমল ছোটবেলা থেকেই মাতৃহীন, বিদেশে থাকার জন্য বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা। প্রায় ১৪ বছরের মতন শশিভূষন বাবু বৃদ্ধাশ্রমে কাটিয়েছেন। তবে এই দীর্ঘসময়ে উনার ছেলে পরিমল একবারও আসেনি, এমনকি এই আধুনিক ইন্টারনেটের যুগেও কখনো ভিডিও কলে কথা বলেনি। আশ্রম কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আমাকে কয়েকবার বললেও আমি এড়িয়ে গেছি, তারাও আর বিশেষ ঘাঁটায়নি। ঠিক সময়ে টাকা পাচ্ছে এমনকি আমি কখনো অতিরিক্ত টাকার জবাব চাইনি, তাই হয়তো এ বিষয়কে আর তত গুরুত্ব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তারা ধরেই নিয়েছে শশিভূষন বাবুর উপর তার ছেলের কেবল সামাজিক দায় আছে কোনরকম আত্মীয়তার বন্ধন নাই, তাই অর্থের বিনিময়ে এই দায়মোচন করে চলেছে 'কুপুত্র'। তবে একটা বিষয় আমাকে বরাবর অবাক করেছে। শশিভূষন বাবু কখনো তার ছেলের সাথে দেখা করতে চাওয়া দূরে থাক কেমন আছে তাও জানতে চাইতেন না। আমি বছরে ১/২ বার পরিমলের পত্র ওনার হাতে দিতাম, উনি শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সেগুলো নিতেন, কোনোদিন সেগুলোর উত্তর দেন নি। উত্তর দেন নি এজন্য বলছি কারণ পরিমলের ঠিকানা একমাত্র আমি জানতাম, তাই চিঠি লিখতে হলে আমার মাধ্যমে ওঁকে পাঠাতে হত।
একসাথে এতবছর থাকার ফলে বৃদ্ধাশ্রমের সাথে শশিভূষন বাবুর একটা আন্তরিক আত্নীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছ। আশ্রমের বেশ কয়েকজন কর্মীছেলে এসেছেন দেখতে পাচ্ছি, প্রবীণদের মধ্যেও কয়েকজন উপস্থিত। কর্মীদের মধ্যে অল্পবয়সি একটা ছেলে, নাম পরিতোষ, এগিয়ে এল আমার কাছে। ছেলেটার চোখ ভেজা, বেশ শোক পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। কে বলে , স্বার্থ থেকে সৃষ্ট সম্পর্ক স্বার্থকে কখনো ছাড়িয়ে যায়না? আমি অবশ্য কোনো শোক বা বেদনা অনুভব করছি না, বরং ভারমুক্তির একটা অনুভুতি অনুভব করছি। চিন্তার জগৎ এ চলে গিয়েছিলাম বোধহয়, পরিতোষের কথায় চমক ভাংলো!
"কাকার তো দাহর সময় হয়ে এলো, পরিমল বাবুকে কি খবর দেওয়া হয়েছে? আসবেন? মুখাগ্নি করবেন কে?" অন্যদের মতন বডি না বলে কাকা বলা এবং 'পরিমল বাবু' শব্দ দুটো ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। অনেক কিছু জানাতে ইচ্ছে হল কিন্তু তার বদলে এমন কিছু বললাম যা হাস্যকর শোনাল, অবশ্য পরিতোষ বা তার সঙ্গীরা কেউই হাসল না, একটু অবাক হলো অবশ্য। আমি বললাম, "পরিমল এখানেই আছে, তবে মুখাগ্নি করার ক্ষমতা নাই ওর, তোমরা কেউ কর।" মনে হলো পরিতোষ একটু খুশীই হলো মুখাগ্নি করতে পেরে।
শশ্মানের কাজ শেষ হলে আরেকবার বৃদ্ধাশ্রমে আসলাম শশিভূষন বাবুর সব হিসাবনিকাশ চুকিয়ে দিতে। আমার সন্তান যদি এখানে না পাঠায় তবে এটাই আমার অন্তিমবার এখানে আসা। উনার হিসাবে বাকি বিশেষ কিছুই ছিল না, বরং কিছু টাকা জমা হিসেবে ছিল। সেগুলো আর ফেরত নিলাম না, ওদের ট্রাস্টেই দান করলাম! চলেই যাচ্ছিলাম, তখন পরিতোষ ডাক দিল, একটা ব্যাগ দিয়ে বলল, কাকার শেষ স্মৃতিচিহ্ণ। নিয়ে যান, এর উপর কেবল পরিমল দাদার অধিকার। বলতে বলতে ওর গলা বুজে আসল। আমি কোনো কথা না বলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
বিকালে আবার সেই শশ্মানে আসলাম। শশ্মানে এখনো চিতা জ্বলে চলেছে। একটু দূরে নদীর পাশে ঘাসের উপর বসলাম। প্রায় ১৫ বছর আগে আমি আর পরিমল এখানে বসেছিলাম আর একটা নাটকের প্লট রচনা করেছিলাম। তারপর এতবছর ধরে আমরা শুধু অভিনয় করে চলেছি।
পরিমল আমার খুব ভালো বন্ধু। না, ছোটবেলার বন্ধু নয়। আমাদের বন্ধুত্ব কর্মজীবনে। আমরা এক জায়গাতেই চাকরি করতাম। সেদিন অবশ্য পরিমল আমাকে এখানে ডেকে এনেছিল। প্রথমে জীবন নিয়ে সব দার্শনিকতার কথা শোনাচ্ছিল। তারপর বলল ওর ব্রেন ক্যান্সার। নিজের রোগের কথা এমনভাবে বলল যেন অন্য কারও রোগের কথা বলছে! তারপর নিজের বাবাকে নিয়ে পরিকল্পনা করল। এদেশে ওদের তেমন আত্নীয় কেউ ছিলনা। তারপর শুরু করল বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ। সবচেয়ে ভালো আশ্রমের সবচেয়ে ভালো রুমটাই সে ঠিক করল বাবার জন্য। তারপর বিভিন্ন বছরের তারিখ দিয়ে ৫০ টা চিঠি লিখে ফেলল। আমার কাজ সেসব চিঠি নির্দিষ্ট তারিখের ২/৩ দিন পর শশীভূষন বাবুর কাছে পৌঁছানো। নিজের চিকিৎসার জন্য সামান্য টাকা রেখে সবই আমার নামে ব্যাংকে জমা রাখল যেন ওর বাবার কখনো কোন অভাব না হয়। এরপর ৩ মাসের ভেতর পরিমল দেহ রাখল। প্রিয় বন্ধুকে আমি এই শশ্মানেই দাহ করেছিলাম। এতবছর ধরে এক "পিতার নিকট তার পুত্রের" এই গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছি। আর আজ তো সব শেষ।
সন্ধার পর বাসায় ফিরে বৃদ্ধাশ্রম থেকে আনা সেই ব্যাগটা চোখে পড়ল। আগামীকাল এটার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। তবে কৌতূহলী হয়ে একটু ব্যাগটা খুললাম, সাধারণ পোশাক, ৫০০ টাকার ৫ খানা নোট , কিছু খুচরা টাকা এসব ছাড়া একটা ডায়েরী পেলাম। সেখানে চিঠিগুলো রাখা, সবগুলো খামের মুখ বন্ধ, মানে তিনি কোনোদিনও ওগুলো খুলে দেখেননি। ডায়েরীতে সবই ফাঁকা, শুধু ভেতরে এক পৃষ্ঠায় লেখা- *“খুব ছোট থাকতে পরি আমার সাথে লুকোচুরি খেলত, ও কোথায় লুকাত আমি জানতাম কিন্তু কখনো সেখানে খুঁজতাম না পাছে খেলার মজা নষ্ঠ হয়। বাবা!! ডাক্তারি রিপোর্টগুলো কেন আরও কঠিন জায়গাতে লুকালি না?”*
#collected