10-01-2022, 11:40 AM
ছয়
মাধমিকের রেজাল্ট মারাত্মক হয়েছিল আমার। পুরো জেলা তে প্রথম তো বটেই। কলেজ এ ছোড়দির নাম্বার কেও পিছনে ফেলে দিল আমার প্রাপ্ত নাম্বার। যদিও দিদির সময়ের নাম্বার আর আমার সময়ের নাম্বার অনেক ফারাক। দিদিদের সময়ে প্রশ্ন ও খুব কঠিন হয়েছিল। আমাদের সময়ে ঠিক ঠাক হয়েছিল। আমি বাইরে গেলাম না। গ্রামেই পরলাম উচ্চমাধ্যমিক। এগারো ক্লাসে চুটিয়ে পড়াশোনা আর খেলা ধুলা দুটোই করেছিলাম আমি।
এই সময়েই লম্বা হলাম মারাত্মক রকম ভাবে। বুক ভারী হয়ে গেলো আমার। যা যা পছন্দ করতাম না, সেই গুলো হলো আমার। সব সময়ে স্পোর্টস ব্রা পরে থাকতাম, শুধু মাত্র শরীর থেকে মেয়েলি ভাব টা সরিয়ে ফেলার জন্য। নেড়া হবার থেকে শুধু একটু বড় আমি চুল করে নিয়েছিলাম। শুধু একটা কালো ভাব ছিল মাথার মধ্যে আমার। কিন্তু রূপ তো আটকে থাকার না। যতই আমি এই সব করতে লাগলাম, ততই লোকে আমার উচ্চতা, আলো পিছলে যায় এমন মিস্টি গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ, নাক মুখের প্রশংসা করতে শুরু করল। তারপরে আবার চশমা ছিল চোখে। লোকে বলত, রূপ আর গুনের এমন অদ্ভুত কম্বিনেশন সচরাচর হয় না।
মাধমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট এর পরে, যত ছেলে ছিল , সবাই আমাকে খুব সম্মান দিতে থাকল। যাদের সাথে মারপিট করতাম, তারা যেচে এসে আমার থেকে সব কিছু পড়াশোনা বুঝে যেত। আমার আর দিদির এমন রেজাল্ট এর পরে গ্রামের ছেলেরা পড়াশোনার দিকে নজর দিল। খেলে দুলে গরু চড়িয়ে, দুষ্টুমি না করে, লেখাপড়া র দিকে সবাই ঘুরল। শুধু আমার বাড়িতেই কোন কদর রইল না। আমার বাবা কোনদিন জিজ্ঞাসা করল না কেমন রেজাল্ট হয়েছে। আমার দিদিরা এসে গর্ব বোধ করল না। আমি যদিও আশা করিনি সেটা। কিন্তু আমার মা কাকিমা তো পারলে গোটা গ্রামের লোক খাইয়ে দেয় আনন্দে। আমার কাকা আমাকে নিজের আল্মারির চাবি ই দিয়ে দিয়েছিল। যখন যেটা লাগবে সেটা নিয়ে নেবার জন্য। হ্যাঁ জীবনের শুরু তে যেটা আমি পাই নি সেটা আমি আসতে আসতে পেতে শুরু করেছিলাম। জীবন টা তখন থেকেই পালটাচ্ছিল আমার। ঠিক করে নিলাম, উচ্চমাধ্যমিকের পরে আমি এখানে আর থাকব না। কলকাতায় যাব পড়াশোনার জন্য।
উচ্চমাধ্যমিকে অনেক নাম্বার পেলাম বটে, কিন্তু দিদিকে টপকাতে পারলাম না। যদিও আমাদের কলেজের ইতিহাসে সেটা বিশাল নাম্বার। আমি বেঙ্গল জয়েন্ট, আই আই টি সবে তেই র্যাঙ্ক করে ফেললাম। মেডিকেল এও একশোর নীচে র্যাঙ্ক করলাম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কোন টাই আমার পড়ার ইচ্ছে ছিল না। আমি কাউকে কিছু না বলে কলকাতার সব থেকে পুরোন ঐতিহ্যময় আর সব থেকে ভাল কলেজে এডমিশন নিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল ওখানে পড়ার। আমার বাবার তো কম কিছু নেই। আমি চাই পড়তে আর জীবন এ সেটাই করতে যেটা মন চায়। এর বেশী কিছু আমি করব না। হ্যাঁ যদি সায়েন্টিস্ট হতে ইচ্ছে করে তো হব না হলে জানিনা। দেখি কি করা যায়।
আমাদের গ্রাম থেকে কলকাতা যাতায়াত করে পড়াশোনা সম্ভব না। কাকা তাই রাতারাতি আমার নামে একটা এক্যাউন্ট বানিয়ে, যথেষ্ট টাকা পয়সা সেখানে দিয়ে দিল। আমি কলকাতা শিফট করলাম। এক নতুন জীবনে পা দিলাম আমি। ছুটি ছাটায় যেতাম বাড়ি। থাকতাম কিছু দিন। বদলায় নি কিছুই। এখন দিদি রা নেই। তাই একটু বেশী আদর এই আরকি। এর মাঝে একটা ঘটনা ঘটল। আমি বাড়ি গেছিলাম পুজোর সময়ে। ততদিনে বাবা আমাদের বাড়িতে দূর্গাপুজো শুরু করেছিল। ঠিক ই আছে। মা যখন বলল আমাকে বাড়ি পৌঁছনর পরে, যে বাবা দূর্গাপুজো করছে ,আমার আনন্দই হয়েছিল। আমি জানতাম না আমি ছাড়া কেউ ছোড়দি কে নিয়ে ভাবে এই বাড়িতে। আমার ঘরে এসে মা খানিক কেঁদে নিল ছোড়দি কে ভেবে। আমার ও মন টা ততধিক খারাপ হয়ে গেল। সত্যি আজকে আমি ছোড়দি কে মিস করছি ভয়ঙ্কর রকম ভাবে।
আমার যখন ফাইনাল ইয়ার তখন দ্বিতীয়বার পুজো হচ্ছে বাড়িতে। আমার দাদু মারা গেছেন ততদিনে। আমি ভেবে ছিলাম যাব না। এবারে রেজাল্ট টা ইম্পর্ট্যান্ট। যদিও গত দু বছর আমার রেজাল্ট মাত্রাতিরিক্ত ভাল। তবুও রিস্ক নেওয়া ঠিক না। হস্টেলে থাকলে, পড়াশোনা আর শরীর চর্চা দুটোই খুব ভাল হয়। বাড়িতে গেলে হয় না। কিন্তু মা কাকিমা দুজনাই বার বার করে সেদিনে ফোন করে আমাকে বলল। আর ওই দুজনের কথা আমি ফেলতে পারি না।
তইতই করে বড় হয়ে গেলাম আমি। যেমনি লম্বা, তেমনি তন্বী তেমনি সুন্দরী। আমার মা কাকিমা এর কথা নয় এগুলো। ওদের মেয়ে আমি, এমনিতেই ওরা আমার উপরে দুর্বল, কাজেই ওদের কথা আমি ধরতাম না। কিন্তু কথা গুলো বলত আশে পাশের লোক জন। আমি যদি একটু মেয়েদের মতন সাজগোজ করতাম, তবে হয়ত ছেলেরা পাগল হয়ে যেত। নেহাত অতি কাঠখোট্টা ভাবে থাকতাম তাই ওই সবের ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম। আর ব্যাপার টা পছন্দ ও করতাম না। নেড়া মাথা, জিন্স শার্ট পরা, হুজ্জুতি করা মেয়েদের সাথে কোন ছেলে ভিড়তে চাইবে?
গতবারে আমার দুই রাক্ষসী দিদি আসে নি। এবারে সবাই সপরিবারে এসে হাজির। সে তো আসবেই। না না ওরা আসুক। জন্ম জন্ম আসুক। ততদিনে আমার মধ্যে একটা মারাত্মক এটিটিউড চলে এসেছে। বাড়িতেই জিন্স পড়ি। কারোর অতো তোয়াক্কা করি না। আমার কাকি আর কাকার তাতে প্রছন্ন মদত আছে।
ততদিনে ইন্দু দি আর চাঁদের ও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে গেলে ওদের ছেলে মেয়েদের নিয়েই আমার সময় কাটে। পড়াশোনার সময় টুকু বাদ দিলে ওদের সাথেই থাকছি আমি। আমি আর বাড়িতে এতো টাও অছ্যুত নই। শুধু আমার ভাই টা আর অর্জুন বেশ বড় হয়ে গেছে। ওরা ওদের মতন থাকে। আমি যদিও বাড়িতে সবাই কে দেখতে পাচ্ছি, শুধু অর্জুন কে পাচ্ছি না দেখতে। মা কে জিজ্ঞাসা করতে বলল, সীমানাপুরে গেছে বাইক নিয়ে, ওর পিসির মেয়ে আর ছেলে আসছে, ওদের কে আনতে।
- বাবাহ সে এতো বড় হয়ে গেলো যে বাইক চালাতে শিখে গেছে?
- হ্যাঁ, সে এখন তোর থেকেও লম্বা। কত দিন দেখিস নি বলতো তুই?
- বলো কি?
আমি যখন সন্ধ্যে বেলায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলছিলাম, তখন দেখলাম অর্জুন আর তার পিসির ছেলে মেয়ে এলো বাড়িতে। আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আমি ভাবলাম কি হলো কে জানে। হয়ত যত বড় হচ্ছে তত ওর পরিবারের মতন হচ্ছে। জীবনে কখনো আমি কিছু আশা রাখি না। সম্পর্কের দিক থেকে তো নয় ই। ছোড়দি ছাড়া আর ললিত দা ছাড়া কারোর কাছেই কোন আশা আমি রাখি নি। রাখবো ও না।
কিন্তু অর্জুন দেখলো অথচ কথা বলল না এটা আমাকে একটু চুপ করিয়ে দিল। যাক ভালই হয়েছে। হয়ত ওর মা বলেছে কথা না বলতে। আমি আর ভাবলাম না কিছু। কিন্তু ব্যাপার টা আমার জন্য ভাল হলো না। আমি সব ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। দরজা বন্ধ করে পড়তে বসলাম। পরা তে মন বসল না। কি হলো ছেলেটার। ও তো ওর বাবা মায়ের মতন না। কত মার খেয়েছে মায়ের কাছে, শুধু আমার কাছে আসত বলে। আজকে কি হলো? নাহ আমি হয়ত একটু বেশী আশা করে ফেলেছিলাম। আর আশা করব না। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেব। এতো দিন ও ছোট ছিল আমি নিজেই যেতাম। এটাও সত্যি ও নিজে থেকে তো কোন দিন কথা বলতে আসে নি। তাও ভেবেছিলাম, এতো দিন বাদে দেখা হলো একটু তো হাসবেও। যাক আর ভাবব না।
রাতে খাওয়া দাওয়ার সময়েও কথা বলল না আমার সাথে। আমি পরিবেশন করে দিয়েছিলাম। ও ছিল না। একটু পরে দেখলাম কোথা থেকে এসে পরিবেশন শুরু করল আমার সাথে। আমার ভাই ও এল। তিন জনে মিলে প্রায় জনা চল্লিশ লোক কে খাইয়ে দিলাম। অর্জুনের পিসির মেয়ে দেখলাম আমাকে চেনে। আর চেনে টপার বলেই। আমাদের কলেজে কোন সেমিনারে এসে আমাকে দেখেছে নাকি। আমার প্রায় নেড়া মাথা দেখে ও আমাকে চিনতে পেরেছে। ভাল।
আমার অভ্যেস ভোর বেলায় উঠে পরা। আমি পরের দিন সকালে ভোর বেলায় উঠে দৌড়তে যাব। ভোর বেলায় উঠে পড়েছি। দেখলাম মা আর কাকি ও উঠে পড়েছে। ওরা উপোস থাকবে আজকে। আমার ওসব পোষায় না। আমি নিজের হরলিক্স বানিয়ে খেতে যাব দেখলাম, অর্জুন বাবু একেবারে ফ্রেশ হয়ে, একটা ট্রাউজার পরে, পায়ে রানিং শু লাগিয়ে দোলনায় দুলছেন। আমি আমার হাতের হরলিক্স টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই, এক গাল হেসে নিয়ে নিলো। হাসি টা তেমন ই মিস্টি আছে।
ও কথা বলছে না বলে যে কস্ট টা পাচ্ছিলাম সেটা মাথায় আর রইলই না। আমি রান্না ঘরে এসে নিজের জন্য আরেক গ্লাস বানিয়ে , খেয়ে, ওকে নিয়ে বেরোলাম। দুজনে মিলে দৌড় শুরু করলাম বাড়ি থেকে। মেন রোড ধরে প্রায় চার কিমি দৌড়ে, একেবারে ধান জমির কাছে যে বর্ডার আছে, সেইখানে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার ধারে একটা গাছে নিচে দাঁড়িয়ে, ওয়ার্ক আউট করতে লাগলাম দুজনে। ওকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে কথা না হলে বলবে না।
- কত লম্বা হয়ে গেছিস তুই?
- হুম এখন নিয়মিত খেলছি, কলেজ টিম এ
- কি খেলিস?
- ফুটবল
- ভালো করিস। পড়াশোনা তে কিন্তু কোন ছুট দিবি না।
- নাহ দি না
- গুড বয়।
বলে গাল টিপে দিলাম আমি। কি লাল লাল গাল হয়েছে। একেবারে আদর করার মতন। ওর জন্য ওর ক্লাস রুমের মেয়ে গুলো মনে হয় পাগল। হাসি পেল ভেবেই। এই একটা পুঁচকে ছেলে ছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলেই কাঁদত। আর আজকে বাইক নিয়ে যাচ্ছে দিদি কে আনতে। ওয়ার্ক আউট করছে। আমার থেকে প্রায় অনেক টা লম্বা হয়ে গেছে।
এটা রুটিন হয়ে গেল। পর পর তিন দিন আমরা সকালে উঠে দৌড়তে গেলাম। অস্টমীর দিন সকালে আমাকে নিয়ে আরো অনেক টা গেল। আরেক একটু করতে করতে পৌঁছে গেলাম প্রায় সীমানাপুরের অর্ধেক রাস্তা। পৌছতে দেরী হবে বলে ওকে নিয়ে ফিরে এলাম আমি।
ঘটনা টা ঘটল সেদিনেই। গ্রামের একটা মেয়ে পুকুরে পরে মরতে বসেছিল। আমি পুজোর আচার অনুষ্ঠান ভাল লাগে না বলে, পিছনে পুকুরের ধারে হাঁটছিলাম। ওখানে আম গাছের বাগান আছে। কোন একটা গাছের নীচে বসে একটা বই পড়ব । সেই সময়ে জলে খলবল করে আওয়াজ পেয়ে দেখি, হীরেন কাকার মেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না । কিন্তু ওই রঙের ফ্রক পরে আমি হীরেন কাকার মেয়েকে দেখেছি সকালে ফুল তুলতে। আমি দৌড়ে ওই পারে গিয়ে কাউকে ডাকব কিনা ভাবছি সেই সময়ে দেখলাম আরেক জন জলে ঝাঁপ দিল। আমি জামা কাপড় দেখে বুঝতে পারলাম আমাদের অর্জুন।
সর্বনাশ! ও কেন ঝাঁপ দিল? আর যে সময় নেই। আমিও সাত পাঁচ না ভেবে ঝাঁপ দিলাম জলে। আমি সাঁতার জানি না মোটে। আমি লম্বা ছিলাম, তাই পা পাচ্ছি। ওই ভাবেই এগোচ্ছিলাম আমি। কিন্তু ওকে দেখলাম ও এক্সপার্ট। তীব্র বেগে সাঁতার কেটে মেয়েটির দিকে যাচ্ছে। বুঝলাম সে সাঁতার শেখে। বেশ পোক্ত সাঁতারু। একা জলে ডুবন্ত কাউকে বাঁচানো সোজা না। আমি ও গেলাম। দেখলাম অর্জুন ওকে একলা নিয়ে আসতে পারছে না। সে তো পূর্ণ পুরুষ নয় যে পারবে। বা আমার তূল্য শক্তি ও ধরে না। আমি আর ও দুজনে মিলে তাকে জল থেকে তুললাম। মেয়েটি ছোট তাই জলের তল পায় নি। কিন্তু আমাদের পায়ের নীচে তল আমরা পেয়েছিলাম। তল না পেলে অর্জুন কে আজকে আমাকেও বাঁচাতে হতো। বা আজকে আমার সলিল সমাধি ই হত।
জল থেকে তুলে দেখি মেয়েটি ঠিক আছে। জল খায় নি তেমন। শুধু ভয় পেয়ে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার চনমনে হয়ে গেলো মেয়েটা। ওকে চিনি, ক্লাস এইট এ পরে। দেখতে বেশ সুন্দর। ও বলল পশ্চিম দিকে পুকুরের ধারে একটা জবা গাছ থেকে ফুল তুলতে গিয়ে পরে গেছিল। ওদিক টা বেশ খাল। আর ও প্রথম না। ওই দিকে জলের ধারে কিছু তো একটা আছে। অনেকেই টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়েছে। একটি মেয়ে মারাও গেছিল। আমরা যাই না সাধারনত। ও এখানেই থাকে কেন যে জানে না কে জানে? ওকে বলে দিলাম এদিকে আর না আসতে। একলা তো নয় ই। মেয়েটি বলল একলা যেতে পারবে। ওকে ছেড়ে দিলাম আমি। বাড়ি ফিরে এসে নিজের ড্রেস বদলে নিলাম। স্নান তো হয়েই গেল। অর্জুন কে দেখলাম না বাড়িতে।
বিকালে আমি পুজো মন্ডপ থেকে বাড়ি ফিরলাম, সব কটা কচিকাঁচা দের নিয়ে। ওদের নিয়ে সময় কাটাতে মন্দ লাগে না। ওদের মায়েরা সব সাজ গোজে ব্যস্ত। থাক আমার কাছে। আমিও যে বাচ্চাদের পছন্দ করি, এই ব্যাপার টা আমার কাছে এই বারে পরিষ্কার হলো। এসেই দেখি উঠোনে বিচার সভার মতন চলছে। আমি নেই, আর বিচার সভা? দেখলাম অর্জুন চুপ করে মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওর মা হম্বি তম্বি করছে, ওর সামনে, হাত পা নেড়ে কথা বলছে। কি হয়েছে কাকি কে জিজ্ঞাসা করতেই কাকি বলল, অর্জুন নাকি কোন মেয়ের সাথে সকালের দিকে পুকুরে স্নান করছিল। ওর মা রেগে গেছে। ছেলেকে শাসন চলছে সেই জন্য। অর্জুন তো মার খাবে তবু কিছু বলবে না কাউকে। জানিনা আমাদের ছাড়া ও বাইরে কেমন বিহেভ করে। কিন্তু বাড়িতে ওকে মারধোর করলেও একটা কথা ও বলবে না। ওর সাথে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি। ওর মগজের সাথে আমার মগজের মনে হয় কোন যোগ সাজশ আছে। অর্জুন যথারীতি চুপ করে আছে। মাথাটা ভয়ঙ্কর গরম হয়ে গেল আমার।
আমি কাকি কে জিজ্ঞাসা করলাম
- অর্জুন কোন মেয়ের সাথে স্নান করছিল একথা কে বলেছে?
- কে আবার তোমার মেজদি?
- হুম, এই মেয়ে টা বদলাবে না। কে না কে কি বলল, আর ছেলেকে শাসন করছে ওই ভাবে?
আমি এগিয়ে গেলাম। জানিনা কেন, তীব্র রাগ হচ্ছিল আমার। ওর মা ওকে যাতা বলছে। ওর মায়ের তখন রাগের শেষ মুহুর্ত। যে কোন মুহুর্তে গায়ে হাত তুলে দেবে।
- লজ্জা করে না তোর? কি ছেলে পেটে ধরলাম আমি? তুই এই বয়সে, মেয়েদের সাথে পুকুরে স্নান করছিস। নির্লজ্জ। তোকে আমি মেরে ফেলব।
হাত তুলে ওর মা অর্জুন কে মারতে যেতেই আমি হাত ধরে ফেললাম। কোন কথাই বললাম না। শুধু হাত টা ধরে রইলাম। ইচ্ছে তো করছিল মুচড়ে দি। কিন্তু পারলাম না। বড়দি তো বাক্যহারা হয়ে গেল একেবারে। আমার এই রকম সাহস ও তো কল্পনা ও করতে পারে নি। বাড়ির লোক যারা এদিক ওদিক ছিল ওরাও জড়ো হয়ে গেল সামনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জোর করে হাত টা ছাড়ানোর চেস্টা করতেই আমি ছেড়ে দিলাম। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে সপাটে আক্রমন করে বসল
- তোর স্পর্ধা কি করে হয়? সেদিনের মার ভুলে গেছিস তুই। বাবা কে বলে আবার ওই রকম মার খাওয়াবো বলে দিলাম। আমার ছেলেকে আমি শাসন করছি তুই বলার কে? শয়তান রাক্ষুসী। আমার ছেলেও তোর মতন নষ্ট হবে নাকি? সরে যা বলে দিলাম তোকে শেষ বারের মতন।
বলতে তো ওকে অনেক কিছু ইচ্ছে করছিল। তার থেকেও বেশী ইচ্ছে করছিল, সপাটে থাবড়ে দাঁত কপাটি ফেলে দিতে। কিন্তু ওসবের ধার দিয়েও গেলাম না শুধু অর্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। বললাম
- শুধু একবার গায়ে হাত তুলে দেখ তুই ওর।
এবারে বড়দি না, মেজদি বলে উঠল
- দিদি তুই শুনিস না। তুই শাসন কর ছেলেকে। এই বয়সে মেয়ে নিয়ে সাঁতার কাটবে কি? ছেলেকে শাসন করতে হবে না? উহ সবাই যেন ওনার মতন হবে?
শেষ কথা টা আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলা । আমি বড়দি কে কিছু না বলে, মেজদি কে আক্রমন করে বসলাম
- এই যে ডানাকাটা পরী? ভগবান মন টা কে তোর একটু সুন্দর করে নি কেন রে? তুই বড়দি কে ওসকাচ্ছিস? অর্জুন তোর কেউ না? কেমন মেয়ে তুই? তুই আসিস্ কেন বলত আমাদের বাড়িতে। যতবার তুই আসিস, কিছু না কিছু গন্ডোগোল হয়। খবর্দার, কাউকে ওস্কাবি না বলে দিলাম। আর একটা কথা বললে আমাদের মাঝে, এক থাবড়া তে সব গুলো দাঁত ফেলে দেব এখনি। তারপরে বাবা যা করার করবে আমাকে।পরোয়া করি না আমি কিছুর।একদম চুপ করে থাকবি। শয়তান মেয়ে কোথাকার!!!
আমার মা কাকিমা একেবারে থ হয়ে গেছে। আমার এই রূপ কেউ কোন দিন ও দেখে নি। জানিনা কীসের ভয়ে, মেজদি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। যাক । বাবা মারলে বকলে, আর কিছু যায় আসে না আমার। আমি বড়দি কে বললাম
- তোকে কে কি বলল, আর তুই আমার ছেলে টা কে মারতে শুরু করলি? আমি ছিলাম সেখানে। ও একা ঝাঁপ দেয় নি জলে, আমিও দিয়েছিলাম। ওই মেয়েটা ডুবে যাচ্ছিল। ও তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়েছিল। তোর ওকে বকা দরকার। কিন্তু যে জন্য বকছিস সেটার জন্য না। মানুষ করেছিস নিজের ছেলেকে, এই টুকু বিশ্বাস নেই যে ও এই সব কাজ করতে পারে না? তুই ওকে বক। তুই না বকলেও ওকে আমি বকতাম। কিন্তু এটার জন্য বকিস না যেটার জন্য তুই বকছিস। আমার তো ভেবে লজ্জা লাগছে তুই কেমন মা??
আমার কথায় বড়দি স্তম্ভিত হয়ে গেল একেবারে। খুব অল্প বয়সে মা হয়েছে ও। ছেলে জন্মেছে, কি ভাবে মানুষ করতে হয় সেই জ্ঞান ই হয় নি ওর কোন দিন। ওর দোষ দি না আমি। কিন্তু নিজের ছেলের সম্পর্কে, একটা রাক্ষসী কি বলল, সেটা শুনে ছেলেকে উলটো পালটা বলা ঠিক নয় একদম। আমার চিন্তা অন্য জায়গায় ছিল। ও কেন ঝাপালো। বাড়িতে খবর দিতে পারত। ওর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি করতাম?
আমি ঘুরে ওকে বললাম
- অর্জুন, তুই যেটা করেছিস, একদম ভালো করিসনি । কিন্তু তোর যদি কিছু হয়ে যেত আমরা কি করতাম। আমি শুধু তুই ঝাঁপিয়েছিস বলে ঝাঁপ দিলাম। আমি তো সাঁতার ও জানিনা। আমি তো বাড়িতে খবর দিতাম এসে ছুটে। ততক্ষনে তুই ঝাঁপিয়ে পরেছিলি। আমার আর ভাবার সময় ছিল না। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মা কি করত? আমরা কি করতাম? এই টুকু ভাববি না?
দিদি, আমার কথা টা শেষ ও হলো না, ছুটে এসে অর্জুন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। অর্জুন কিন্তু সেই রকম ই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মাঝখানে। বলেছিলাম না, ও এমনি ই। আনন্দেও চুপ আর কস্টেও চুপ। আমি দিদি কে বললাম
- এটাই প্রথম না বড়দি। এর আগেও অনেকবার ওই রাক্ষসী তোকে ভুল বুঝিয়ে আমাকে ছোড়দি কে মার খাইয়েছে বাবার কাছে। সেবারেও অর্জুন পা ফস্কে পরে গেছিল পুকুরে। ছোড়দি সাক্ষী। আমি তখন তাকে বাচাতেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। সেদিনে তুই আমার বাবাকে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিলি। একবার ও ভাবিস নি, আমি ওকে কিভাবে জলে ফেলে দিতে পারি ইচ্ছে করে? ও আমার কেউ নয়? আমি তখনো কিছু বলিনি। আমি আজকেও বল্তাম না। সত্যি বলতে তুই আর মেজদির সাথে কথা বলতেই আমার ঘেন্না করে। কিন্তু তুই ছেলেটা কে মারতে গেলি বলে আমাকে এতো গুল কথা বলতে হলো। এবারে তুই বাবাকে বলে দে আমাকে মার খাওয়া যা খুশী কর। আমিও তৈরি থাকব।
বলে আমি আমার ঘরে চলে এলাম। আমি তখনো হাঁপাচ্ছি।আজকে বড়দির মুখের উপরে এতো গুলো কথা বলে মন টা আমার খুশী। আমি পড়ছিলাম। মানে পড়ার চেস্টা করছিলাম। কিছুক্ষন পড়ার পরে মনে হলো কচিকাঁচা গুলোর প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। ঘরে আর ভাল না লাগাতে ছাদে গেলাম আমি। ছাদ থেকে পুজো মন্ডপ টা দেখা যায় খুব সুন্দর।
ওখানে আজকে কচিকাঁচা গুলো গান আবৃত্তি করছে। আমি শুনতে পাচ্ছি এখান থেকেই। আর মাঝে মাঝে ভাবছি, কি জানি আজকে বাবা কিছু বলল না আমাকে। বাড়িতে নিচে বাবা আসার পরে নিশ্চয়ই দক্ষ যজ্ঞ চলছে। হাসি পেল। বাবা হয়ত আমাকে মারা জন্য বেল্ট নিয়ে ঘুরছে। কি জানি হতেও পারে। সহসা পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে দেখি অর্জুন। এই প্রথম আমার ভয় লাগল। বুক টা ধড়াস করে উঠল। বললাম
- উফ কি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি তুই।
- আমার মিমি কবে থেকে ভয় পাচ্ছে আবার? ভয় তো তুমি কিছুতেই পাও না।
- কে বলল তোকে।
- আমি জানি। ভয় পেলে সাঁতার না জেনেও মিমি আমার জন্য ঝাঁপ দিত না পুকুরে।
কথাটার উত্তর দিলাম না আমি। অন্য কেউ হলে কি ঝাঁপাতাম নাকি? আর ওর বেলাতেও কেন বার বার ঝাঁপিয়েছি জানিনা । সত্যি বলতে কি এর উত্তর আমার কাছেও নেই। ছোট বেলাতেও কেন ঝাঁপিয়েছিলাম জানিনা, আজকেও কেন ঝাঁপালাম, জানিনা। ওর বেলাতেই কি করে আমার এত সাহস চলে আসে সেই উত্তর তখন ও পাই নি আমি। ও ছোট ছেলে ওর সাথে কি কথা বলব এই ব্যাপারে। বললাম ওকে অন্য কথা।
- তুই যাস নি ওদের ওখানে। ওখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে।
- না
- কেন?
- তোমাকে গার্ড দিচ্ছি।
হাসি পেয়ে গেল আমার। বললাম
- আমাকে?
- হুম
- কেন?
- যাতে দাদু কিছু বলতে না পারে তোমাকে বা মারতে না পারে।
- বাবাহ আমার ছোট ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেল? মিমির জন্য চিন্তাও করছে?
- হুম। আর মিমি যে সাঁতার না জেনেও ঝাঁপ দিল আমার জন্য?
- ওলে বাবালে। সে তো মিমিদের ধর্ম। কি হবে মিমির জীবনের যদি এই ছেলেটার কিছু হয়ে যায়?
- আচ্ছা মিমি, ছোট বেলাতেও একবার আমাকে পুকুর থেকে তুমি তুলে এনেছিলে না?
মন টা খারাপ হয়ে গেলো শুনে। সেদিনের মার টাও কম ছিল না। উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম
- হুম
কত কথা মনে পড়ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওকে বলার মতন নয় সে গুলো। কিন্তু জানিনা কেন ওকে বলতেও ইচ্ছে করছে। এই টুকু একটা ছেলের সামনে অভিমান করব? কিন্তু বলেই দিলাম। জানিনা কেন ছোট থেকেই অর্জুন কাছে সেটা হতে ইচ্ছে করেনি যেটা দিদিদের সামনে আমি হয়ে গেছিলাম। নষ্ট, বেপরোয়া আর ঝগরুটে।
ওকে বললাম
- কিন্তু তোর মা আজকেও ভাবে যে আমি সেদিনে তোকে সেদিনে মারতে গেছিলাম ডুবিয়ে। কি করে তোর মা ভাবতে পারে একথা আমি সেটা বুঝি না।
কিছু বলল না অর্জুন। আমার চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে এল। আমি ওকে ডুবিয়ে মেরে দেবো? অর্জুন কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। যাকে বলে আঁকড়ে ধরা। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অথচ ছেলেটা কে দূরে ঠেলে দিতেও পারছি না আমি। এত ভালবাসার জড়ানো ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারব না। সরেও গেলাম না আমি। ওর হাত দুটো কে আমি ধরে রইলাম যতক্ষন আমাকে ও পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ছিল। কিছু পরে ও যেমন ভাবে চুপি চুপি এসেছিল, পালিয়েও গেল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ ছাদে।
মাধমিকের রেজাল্ট মারাত্মক হয়েছিল আমার। পুরো জেলা তে প্রথম তো বটেই। কলেজ এ ছোড়দির নাম্বার কেও পিছনে ফেলে দিল আমার প্রাপ্ত নাম্বার। যদিও দিদির সময়ের নাম্বার আর আমার সময়ের নাম্বার অনেক ফারাক। দিদিদের সময়ে প্রশ্ন ও খুব কঠিন হয়েছিল। আমাদের সময়ে ঠিক ঠাক হয়েছিল। আমি বাইরে গেলাম না। গ্রামেই পরলাম উচ্চমাধ্যমিক। এগারো ক্লাসে চুটিয়ে পড়াশোনা আর খেলা ধুলা দুটোই করেছিলাম আমি।
এই সময়েই লম্বা হলাম মারাত্মক রকম ভাবে। বুক ভারী হয়ে গেলো আমার। যা যা পছন্দ করতাম না, সেই গুলো হলো আমার। সব সময়ে স্পোর্টস ব্রা পরে থাকতাম, শুধু মাত্র শরীর থেকে মেয়েলি ভাব টা সরিয়ে ফেলার জন্য। নেড়া হবার থেকে শুধু একটু বড় আমি চুল করে নিয়েছিলাম। শুধু একটা কালো ভাব ছিল মাথার মধ্যে আমার। কিন্তু রূপ তো আটকে থাকার না। যতই আমি এই সব করতে লাগলাম, ততই লোকে আমার উচ্চতা, আলো পিছলে যায় এমন মিস্টি গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ, নাক মুখের প্রশংসা করতে শুরু করল। তারপরে আবার চশমা ছিল চোখে। লোকে বলত, রূপ আর গুনের এমন অদ্ভুত কম্বিনেশন সচরাচর হয় না।
মাধমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট এর পরে, যত ছেলে ছিল , সবাই আমাকে খুব সম্মান দিতে থাকল। যাদের সাথে মারপিট করতাম, তারা যেচে এসে আমার থেকে সব কিছু পড়াশোনা বুঝে যেত। আমার আর দিদির এমন রেজাল্ট এর পরে গ্রামের ছেলেরা পড়াশোনার দিকে নজর দিল। খেলে দুলে গরু চড়িয়ে, দুষ্টুমি না করে, লেখাপড়া র দিকে সবাই ঘুরল। শুধু আমার বাড়িতেই কোন কদর রইল না। আমার বাবা কোনদিন জিজ্ঞাসা করল না কেমন রেজাল্ট হয়েছে। আমার দিদিরা এসে গর্ব বোধ করল না। আমি যদিও আশা করিনি সেটা। কিন্তু আমার মা কাকিমা তো পারলে গোটা গ্রামের লোক খাইয়ে দেয় আনন্দে। আমার কাকা আমাকে নিজের আল্মারির চাবি ই দিয়ে দিয়েছিল। যখন যেটা লাগবে সেটা নিয়ে নেবার জন্য। হ্যাঁ জীবনের শুরু তে যেটা আমি পাই নি সেটা আমি আসতে আসতে পেতে শুরু করেছিলাম। জীবন টা তখন থেকেই পালটাচ্ছিল আমার। ঠিক করে নিলাম, উচ্চমাধ্যমিকের পরে আমি এখানে আর থাকব না। কলকাতায় যাব পড়াশোনার জন্য।
উচ্চমাধ্যমিকে অনেক নাম্বার পেলাম বটে, কিন্তু দিদিকে টপকাতে পারলাম না। যদিও আমাদের কলেজের ইতিহাসে সেটা বিশাল নাম্বার। আমি বেঙ্গল জয়েন্ট, আই আই টি সবে তেই র্যাঙ্ক করে ফেললাম। মেডিকেল এও একশোর নীচে র্যাঙ্ক করলাম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কোন টাই আমার পড়ার ইচ্ছে ছিল না। আমি কাউকে কিছু না বলে কলকাতার সব থেকে পুরোন ঐতিহ্যময় আর সব থেকে ভাল কলেজে এডমিশন নিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল ওখানে পড়ার। আমার বাবার তো কম কিছু নেই। আমি চাই পড়তে আর জীবন এ সেটাই করতে যেটা মন চায়। এর বেশী কিছু আমি করব না। হ্যাঁ যদি সায়েন্টিস্ট হতে ইচ্ছে করে তো হব না হলে জানিনা। দেখি কি করা যায়।
আমাদের গ্রাম থেকে কলকাতা যাতায়াত করে পড়াশোনা সম্ভব না। কাকা তাই রাতারাতি আমার নামে একটা এক্যাউন্ট বানিয়ে, যথেষ্ট টাকা পয়সা সেখানে দিয়ে দিল। আমি কলকাতা শিফট করলাম। এক নতুন জীবনে পা দিলাম আমি। ছুটি ছাটায় যেতাম বাড়ি। থাকতাম কিছু দিন। বদলায় নি কিছুই। এখন দিদি রা নেই। তাই একটু বেশী আদর এই আরকি। এর মাঝে একটা ঘটনা ঘটল। আমি বাড়ি গেছিলাম পুজোর সময়ে। ততদিনে বাবা আমাদের বাড়িতে দূর্গাপুজো শুরু করেছিল। ঠিক ই আছে। মা যখন বলল আমাকে বাড়ি পৌঁছনর পরে, যে বাবা দূর্গাপুজো করছে ,আমার আনন্দই হয়েছিল। আমি জানতাম না আমি ছাড়া কেউ ছোড়দি কে নিয়ে ভাবে এই বাড়িতে। আমার ঘরে এসে মা খানিক কেঁদে নিল ছোড়দি কে ভেবে। আমার ও মন টা ততধিক খারাপ হয়ে গেল। সত্যি আজকে আমি ছোড়দি কে মিস করছি ভয়ঙ্কর রকম ভাবে।
আমার যখন ফাইনাল ইয়ার তখন দ্বিতীয়বার পুজো হচ্ছে বাড়িতে। আমার দাদু মারা গেছেন ততদিনে। আমি ভেবে ছিলাম যাব না। এবারে রেজাল্ট টা ইম্পর্ট্যান্ট। যদিও গত দু বছর আমার রেজাল্ট মাত্রাতিরিক্ত ভাল। তবুও রিস্ক নেওয়া ঠিক না। হস্টেলে থাকলে, পড়াশোনা আর শরীর চর্চা দুটোই খুব ভাল হয়। বাড়িতে গেলে হয় না। কিন্তু মা কাকিমা দুজনাই বার বার করে সেদিনে ফোন করে আমাকে বলল। আর ওই দুজনের কথা আমি ফেলতে পারি না।
তইতই করে বড় হয়ে গেলাম আমি। যেমনি লম্বা, তেমনি তন্বী তেমনি সুন্দরী। আমার মা কাকিমা এর কথা নয় এগুলো। ওদের মেয়ে আমি, এমনিতেই ওরা আমার উপরে দুর্বল, কাজেই ওদের কথা আমি ধরতাম না। কিন্তু কথা গুলো বলত আশে পাশের লোক জন। আমি যদি একটু মেয়েদের মতন সাজগোজ করতাম, তবে হয়ত ছেলেরা পাগল হয়ে যেত। নেহাত অতি কাঠখোট্টা ভাবে থাকতাম তাই ওই সবের ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম। আর ব্যাপার টা পছন্দ ও করতাম না। নেড়া মাথা, জিন্স শার্ট পরা, হুজ্জুতি করা মেয়েদের সাথে কোন ছেলে ভিড়তে চাইবে?
গতবারে আমার দুই রাক্ষসী দিদি আসে নি। এবারে সবাই সপরিবারে এসে হাজির। সে তো আসবেই। না না ওরা আসুক। জন্ম জন্ম আসুক। ততদিনে আমার মধ্যে একটা মারাত্মক এটিটিউড চলে এসেছে। বাড়িতেই জিন্স পড়ি। কারোর অতো তোয়াক্কা করি না। আমার কাকি আর কাকার তাতে প্রছন্ন মদত আছে।
ততদিনে ইন্দু দি আর চাঁদের ও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে গেলে ওদের ছেলে মেয়েদের নিয়েই আমার সময় কাটে। পড়াশোনার সময় টুকু বাদ দিলে ওদের সাথেই থাকছি আমি। আমি আর বাড়িতে এতো টাও অছ্যুত নই। শুধু আমার ভাই টা আর অর্জুন বেশ বড় হয়ে গেছে। ওরা ওদের মতন থাকে। আমি যদিও বাড়িতে সবাই কে দেখতে পাচ্ছি, শুধু অর্জুন কে পাচ্ছি না দেখতে। মা কে জিজ্ঞাসা করতে বলল, সীমানাপুরে গেছে বাইক নিয়ে, ওর পিসির মেয়ে আর ছেলে আসছে, ওদের কে আনতে।
- বাবাহ সে এতো বড় হয়ে গেলো যে বাইক চালাতে শিখে গেছে?
- হ্যাঁ, সে এখন তোর থেকেও লম্বা। কত দিন দেখিস নি বলতো তুই?
- বলো কি?
আমি যখন সন্ধ্যে বেলায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলছিলাম, তখন দেখলাম অর্জুন আর তার পিসির ছেলে মেয়ে এলো বাড়িতে। আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আমি ভাবলাম কি হলো কে জানে। হয়ত যত বড় হচ্ছে তত ওর পরিবারের মতন হচ্ছে। জীবনে কখনো আমি কিছু আশা রাখি না। সম্পর্কের দিক থেকে তো নয় ই। ছোড়দি ছাড়া আর ললিত দা ছাড়া কারোর কাছেই কোন আশা আমি রাখি নি। রাখবো ও না।
কিন্তু অর্জুন দেখলো অথচ কথা বলল না এটা আমাকে একটু চুপ করিয়ে দিল। যাক ভালই হয়েছে। হয়ত ওর মা বলেছে কথা না বলতে। আমি আর ভাবলাম না কিছু। কিন্তু ব্যাপার টা আমার জন্য ভাল হলো না। আমি সব ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। দরজা বন্ধ করে পড়তে বসলাম। পরা তে মন বসল না। কি হলো ছেলেটার। ও তো ওর বাবা মায়ের মতন না। কত মার খেয়েছে মায়ের কাছে, শুধু আমার কাছে আসত বলে। আজকে কি হলো? নাহ আমি হয়ত একটু বেশী আশা করে ফেলেছিলাম। আর আশা করব না। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেব। এতো দিন ও ছোট ছিল আমি নিজেই যেতাম। এটাও সত্যি ও নিজে থেকে তো কোন দিন কথা বলতে আসে নি। তাও ভেবেছিলাম, এতো দিন বাদে দেখা হলো একটু তো হাসবেও। যাক আর ভাবব না।
রাতে খাওয়া দাওয়ার সময়েও কথা বলল না আমার সাথে। আমি পরিবেশন করে দিয়েছিলাম। ও ছিল না। একটু পরে দেখলাম কোথা থেকে এসে পরিবেশন শুরু করল আমার সাথে। আমার ভাই ও এল। তিন জনে মিলে প্রায় জনা চল্লিশ লোক কে খাইয়ে দিলাম। অর্জুনের পিসির মেয়ে দেখলাম আমাকে চেনে। আর চেনে টপার বলেই। আমাদের কলেজে কোন সেমিনারে এসে আমাকে দেখেছে নাকি। আমার প্রায় নেড়া মাথা দেখে ও আমাকে চিনতে পেরেছে। ভাল।
আমার অভ্যেস ভোর বেলায় উঠে পরা। আমি পরের দিন সকালে ভোর বেলায় উঠে দৌড়তে যাব। ভোর বেলায় উঠে পড়েছি। দেখলাম মা আর কাকি ও উঠে পড়েছে। ওরা উপোস থাকবে আজকে। আমার ওসব পোষায় না। আমি নিজের হরলিক্স বানিয়ে খেতে যাব দেখলাম, অর্জুন বাবু একেবারে ফ্রেশ হয়ে, একটা ট্রাউজার পরে, পায়ে রানিং শু লাগিয়ে দোলনায় দুলছেন। আমি আমার হাতের হরলিক্স টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই, এক গাল হেসে নিয়ে নিলো। হাসি টা তেমন ই মিস্টি আছে।
ও কথা বলছে না বলে যে কস্ট টা পাচ্ছিলাম সেটা মাথায় আর রইলই না। আমি রান্না ঘরে এসে নিজের জন্য আরেক গ্লাস বানিয়ে , খেয়ে, ওকে নিয়ে বেরোলাম। দুজনে মিলে দৌড় শুরু করলাম বাড়ি থেকে। মেন রোড ধরে প্রায় চার কিমি দৌড়ে, একেবারে ধান জমির কাছে যে বর্ডার আছে, সেইখানে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার ধারে একটা গাছে নিচে দাঁড়িয়ে, ওয়ার্ক আউট করতে লাগলাম দুজনে। ওকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে কথা না হলে বলবে না।
- কত লম্বা হয়ে গেছিস তুই?
- হুম এখন নিয়মিত খেলছি, কলেজ টিম এ
- কি খেলিস?
- ফুটবল
- ভালো করিস। পড়াশোনা তে কিন্তু কোন ছুট দিবি না।
- নাহ দি না
- গুড বয়।
বলে গাল টিপে দিলাম আমি। কি লাল লাল গাল হয়েছে। একেবারে আদর করার মতন। ওর জন্য ওর ক্লাস রুমের মেয়ে গুলো মনে হয় পাগল। হাসি পেল ভেবেই। এই একটা পুঁচকে ছেলে ছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলেই কাঁদত। আর আজকে বাইক নিয়ে যাচ্ছে দিদি কে আনতে। ওয়ার্ক আউট করছে। আমার থেকে প্রায় অনেক টা লম্বা হয়ে গেছে।
এটা রুটিন হয়ে গেল। পর পর তিন দিন আমরা সকালে উঠে দৌড়তে গেলাম। অস্টমীর দিন সকালে আমাকে নিয়ে আরো অনেক টা গেল। আরেক একটু করতে করতে পৌঁছে গেলাম প্রায় সীমানাপুরের অর্ধেক রাস্তা। পৌছতে দেরী হবে বলে ওকে নিয়ে ফিরে এলাম আমি।
ঘটনা টা ঘটল সেদিনেই। গ্রামের একটা মেয়ে পুকুরে পরে মরতে বসেছিল। আমি পুজোর আচার অনুষ্ঠান ভাল লাগে না বলে, পিছনে পুকুরের ধারে হাঁটছিলাম। ওখানে আম গাছের বাগান আছে। কোন একটা গাছের নীচে বসে একটা বই পড়ব । সেই সময়ে জলে খলবল করে আওয়াজ পেয়ে দেখি, হীরেন কাকার মেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না । কিন্তু ওই রঙের ফ্রক পরে আমি হীরেন কাকার মেয়েকে দেখেছি সকালে ফুল তুলতে। আমি দৌড়ে ওই পারে গিয়ে কাউকে ডাকব কিনা ভাবছি সেই সময়ে দেখলাম আরেক জন জলে ঝাঁপ দিল। আমি জামা কাপড় দেখে বুঝতে পারলাম আমাদের অর্জুন।
সর্বনাশ! ও কেন ঝাঁপ দিল? আর যে সময় নেই। আমিও সাত পাঁচ না ভেবে ঝাঁপ দিলাম জলে। আমি সাঁতার জানি না মোটে। আমি লম্বা ছিলাম, তাই পা পাচ্ছি। ওই ভাবেই এগোচ্ছিলাম আমি। কিন্তু ওকে দেখলাম ও এক্সপার্ট। তীব্র বেগে সাঁতার কেটে মেয়েটির দিকে যাচ্ছে। বুঝলাম সে সাঁতার শেখে। বেশ পোক্ত সাঁতারু। একা জলে ডুবন্ত কাউকে বাঁচানো সোজা না। আমি ও গেলাম। দেখলাম অর্জুন ওকে একলা নিয়ে আসতে পারছে না। সে তো পূর্ণ পুরুষ নয় যে পারবে। বা আমার তূল্য শক্তি ও ধরে না। আমি আর ও দুজনে মিলে তাকে জল থেকে তুললাম। মেয়েটি ছোট তাই জলের তল পায় নি। কিন্তু আমাদের পায়ের নীচে তল আমরা পেয়েছিলাম। তল না পেলে অর্জুন কে আজকে আমাকেও বাঁচাতে হতো। বা আজকে আমার সলিল সমাধি ই হত।
জল থেকে তুলে দেখি মেয়েটি ঠিক আছে। জল খায় নি তেমন। শুধু ভয় পেয়ে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার চনমনে হয়ে গেলো মেয়েটা। ওকে চিনি, ক্লাস এইট এ পরে। দেখতে বেশ সুন্দর। ও বলল পশ্চিম দিকে পুকুরের ধারে একটা জবা গাছ থেকে ফুল তুলতে গিয়ে পরে গেছিল। ওদিক টা বেশ খাল। আর ও প্রথম না। ওই দিকে জলের ধারে কিছু তো একটা আছে। অনেকেই টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়েছে। একটি মেয়ে মারাও গেছিল। আমরা যাই না সাধারনত। ও এখানেই থাকে কেন যে জানে না কে জানে? ওকে বলে দিলাম এদিকে আর না আসতে। একলা তো নয় ই। মেয়েটি বলল একলা যেতে পারবে। ওকে ছেড়ে দিলাম আমি। বাড়ি ফিরে এসে নিজের ড্রেস বদলে নিলাম। স্নান তো হয়েই গেল। অর্জুন কে দেখলাম না বাড়িতে।
বিকালে আমি পুজো মন্ডপ থেকে বাড়ি ফিরলাম, সব কটা কচিকাঁচা দের নিয়ে। ওদের নিয়ে সময় কাটাতে মন্দ লাগে না। ওদের মায়েরা সব সাজ গোজে ব্যস্ত। থাক আমার কাছে। আমিও যে বাচ্চাদের পছন্দ করি, এই ব্যাপার টা আমার কাছে এই বারে পরিষ্কার হলো। এসেই দেখি উঠোনে বিচার সভার মতন চলছে। আমি নেই, আর বিচার সভা? দেখলাম অর্জুন চুপ করে মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওর মা হম্বি তম্বি করছে, ওর সামনে, হাত পা নেড়ে কথা বলছে। কি হয়েছে কাকি কে জিজ্ঞাসা করতেই কাকি বলল, অর্জুন নাকি কোন মেয়ের সাথে সকালের দিকে পুকুরে স্নান করছিল। ওর মা রেগে গেছে। ছেলেকে শাসন চলছে সেই জন্য। অর্জুন তো মার খাবে তবু কিছু বলবে না কাউকে। জানিনা আমাদের ছাড়া ও বাইরে কেমন বিহেভ করে। কিন্তু বাড়িতে ওকে মারধোর করলেও একটা কথা ও বলবে না। ওর সাথে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি। ওর মগজের সাথে আমার মগজের মনে হয় কোন যোগ সাজশ আছে। অর্জুন যথারীতি চুপ করে আছে। মাথাটা ভয়ঙ্কর গরম হয়ে গেল আমার।
আমি কাকি কে জিজ্ঞাসা করলাম
- অর্জুন কোন মেয়ের সাথে স্নান করছিল একথা কে বলেছে?
- কে আবার তোমার মেজদি?
- হুম, এই মেয়ে টা বদলাবে না। কে না কে কি বলল, আর ছেলেকে শাসন করছে ওই ভাবে?
আমি এগিয়ে গেলাম। জানিনা কেন, তীব্র রাগ হচ্ছিল আমার। ওর মা ওকে যাতা বলছে। ওর মায়ের তখন রাগের শেষ মুহুর্ত। যে কোন মুহুর্তে গায়ে হাত তুলে দেবে।
- লজ্জা করে না তোর? কি ছেলে পেটে ধরলাম আমি? তুই এই বয়সে, মেয়েদের সাথে পুকুরে স্নান করছিস। নির্লজ্জ। তোকে আমি মেরে ফেলব।
হাত তুলে ওর মা অর্জুন কে মারতে যেতেই আমি হাত ধরে ফেললাম। কোন কথাই বললাম না। শুধু হাত টা ধরে রইলাম। ইচ্ছে তো করছিল মুচড়ে দি। কিন্তু পারলাম না। বড়দি তো বাক্যহারা হয়ে গেল একেবারে। আমার এই রকম সাহস ও তো কল্পনা ও করতে পারে নি। বাড়ির লোক যারা এদিক ওদিক ছিল ওরাও জড়ো হয়ে গেল সামনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জোর করে হাত টা ছাড়ানোর চেস্টা করতেই আমি ছেড়ে দিলাম। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে সপাটে আক্রমন করে বসল
- তোর স্পর্ধা কি করে হয়? সেদিনের মার ভুলে গেছিস তুই। বাবা কে বলে আবার ওই রকম মার খাওয়াবো বলে দিলাম। আমার ছেলেকে আমি শাসন করছি তুই বলার কে? শয়তান রাক্ষুসী। আমার ছেলেও তোর মতন নষ্ট হবে নাকি? সরে যা বলে দিলাম তোকে শেষ বারের মতন।
বলতে তো ওকে অনেক কিছু ইচ্ছে করছিল। তার থেকেও বেশী ইচ্ছে করছিল, সপাটে থাবড়ে দাঁত কপাটি ফেলে দিতে। কিন্তু ওসবের ধার দিয়েও গেলাম না শুধু অর্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। বললাম
- শুধু একবার গায়ে হাত তুলে দেখ তুই ওর।
এবারে বড়দি না, মেজদি বলে উঠল
- দিদি তুই শুনিস না। তুই শাসন কর ছেলেকে। এই বয়সে মেয়ে নিয়ে সাঁতার কাটবে কি? ছেলেকে শাসন করতে হবে না? উহ সবাই যেন ওনার মতন হবে?
শেষ কথা টা আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলা । আমি বড়দি কে কিছু না বলে, মেজদি কে আক্রমন করে বসলাম
- এই যে ডানাকাটা পরী? ভগবান মন টা কে তোর একটু সুন্দর করে নি কেন রে? তুই বড়দি কে ওসকাচ্ছিস? অর্জুন তোর কেউ না? কেমন মেয়ে তুই? তুই আসিস্ কেন বলত আমাদের বাড়িতে। যতবার তুই আসিস, কিছু না কিছু গন্ডোগোল হয়। খবর্দার, কাউকে ওস্কাবি না বলে দিলাম। আর একটা কথা বললে আমাদের মাঝে, এক থাবড়া তে সব গুলো দাঁত ফেলে দেব এখনি। তারপরে বাবা যা করার করবে আমাকে।পরোয়া করি না আমি কিছুর।একদম চুপ করে থাকবি। শয়তান মেয়ে কোথাকার!!!
আমার মা কাকিমা একেবারে থ হয়ে গেছে। আমার এই রূপ কেউ কোন দিন ও দেখে নি। জানিনা কীসের ভয়ে, মেজদি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। যাক । বাবা মারলে বকলে, আর কিছু যায় আসে না আমার। আমি বড়দি কে বললাম
- তোকে কে কি বলল, আর তুই আমার ছেলে টা কে মারতে শুরু করলি? আমি ছিলাম সেখানে। ও একা ঝাঁপ দেয় নি জলে, আমিও দিয়েছিলাম। ওই মেয়েটা ডুবে যাচ্ছিল। ও তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়েছিল। তোর ওকে বকা দরকার। কিন্তু যে জন্য বকছিস সেটার জন্য না। মানুষ করেছিস নিজের ছেলেকে, এই টুকু বিশ্বাস নেই যে ও এই সব কাজ করতে পারে না? তুই ওকে বক। তুই না বকলেও ওকে আমি বকতাম। কিন্তু এটার জন্য বকিস না যেটার জন্য তুই বকছিস। আমার তো ভেবে লজ্জা লাগছে তুই কেমন মা??
আমার কথায় বড়দি স্তম্ভিত হয়ে গেল একেবারে। খুব অল্প বয়সে মা হয়েছে ও। ছেলে জন্মেছে, কি ভাবে মানুষ করতে হয় সেই জ্ঞান ই হয় নি ওর কোন দিন। ওর দোষ দি না আমি। কিন্তু নিজের ছেলের সম্পর্কে, একটা রাক্ষসী কি বলল, সেটা শুনে ছেলেকে উলটো পালটা বলা ঠিক নয় একদম। আমার চিন্তা অন্য জায়গায় ছিল। ও কেন ঝাপালো। বাড়িতে খবর দিতে পারত। ওর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি করতাম?
আমি ঘুরে ওকে বললাম
- অর্জুন, তুই যেটা করেছিস, একদম ভালো করিসনি । কিন্তু তোর যদি কিছু হয়ে যেত আমরা কি করতাম। আমি শুধু তুই ঝাঁপিয়েছিস বলে ঝাঁপ দিলাম। আমি তো সাঁতার ও জানিনা। আমি তো বাড়িতে খবর দিতাম এসে ছুটে। ততক্ষনে তুই ঝাঁপিয়ে পরেছিলি। আমার আর ভাবার সময় ছিল না। তোর কিছু হয়ে গেলে তোর মা কি করত? আমরা কি করতাম? এই টুকু ভাববি না?
দিদি, আমার কথা টা শেষ ও হলো না, ছুটে এসে অর্জুন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। অর্জুন কিন্তু সেই রকম ই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মাঝখানে। বলেছিলাম না, ও এমনি ই। আনন্দেও চুপ আর কস্টেও চুপ। আমি দিদি কে বললাম
- এটাই প্রথম না বড়দি। এর আগেও অনেকবার ওই রাক্ষসী তোকে ভুল বুঝিয়ে আমাকে ছোড়দি কে মার খাইয়েছে বাবার কাছে। সেবারেও অর্জুন পা ফস্কে পরে গেছিল পুকুরে। ছোড়দি সাক্ষী। আমি তখন তাকে বাচাতেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। সেদিনে তুই আমার বাবাকে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিলি। একবার ও ভাবিস নি, আমি ওকে কিভাবে জলে ফেলে দিতে পারি ইচ্ছে করে? ও আমার কেউ নয়? আমি তখনো কিছু বলিনি। আমি আজকেও বল্তাম না। সত্যি বলতে তুই আর মেজদির সাথে কথা বলতেই আমার ঘেন্না করে। কিন্তু তুই ছেলেটা কে মারতে গেলি বলে আমাকে এতো গুল কথা বলতে হলো। এবারে তুই বাবাকে বলে দে আমাকে মার খাওয়া যা খুশী কর। আমিও তৈরি থাকব।
বলে আমি আমার ঘরে চলে এলাম। আমি তখনো হাঁপাচ্ছি।আজকে বড়দির মুখের উপরে এতো গুলো কথা বলে মন টা আমার খুশী। আমি পড়ছিলাম। মানে পড়ার চেস্টা করছিলাম। কিছুক্ষন পড়ার পরে মনে হলো কচিকাঁচা গুলোর প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। ঘরে আর ভাল না লাগাতে ছাদে গেলাম আমি। ছাদ থেকে পুজো মন্ডপ টা দেখা যায় খুব সুন্দর।
ওখানে আজকে কচিকাঁচা গুলো গান আবৃত্তি করছে। আমি শুনতে পাচ্ছি এখান থেকেই। আর মাঝে মাঝে ভাবছি, কি জানি আজকে বাবা কিছু বলল না আমাকে। বাড়িতে নিচে বাবা আসার পরে নিশ্চয়ই দক্ষ যজ্ঞ চলছে। হাসি পেল। বাবা হয়ত আমাকে মারা জন্য বেল্ট নিয়ে ঘুরছে। কি জানি হতেও পারে। সহসা পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে দেখি অর্জুন। এই প্রথম আমার ভয় লাগল। বুক টা ধড়াস করে উঠল। বললাম
- উফ কি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি তুই।
- আমার মিমি কবে থেকে ভয় পাচ্ছে আবার? ভয় তো তুমি কিছুতেই পাও না।
- কে বলল তোকে।
- আমি জানি। ভয় পেলে সাঁতার না জেনেও মিমি আমার জন্য ঝাঁপ দিত না পুকুরে।
কথাটার উত্তর দিলাম না আমি। অন্য কেউ হলে কি ঝাঁপাতাম নাকি? আর ওর বেলাতেও কেন বার বার ঝাঁপিয়েছি জানিনা । সত্যি বলতে কি এর উত্তর আমার কাছেও নেই। ছোট বেলাতেও কেন ঝাঁপিয়েছিলাম জানিনা, আজকেও কেন ঝাঁপালাম, জানিনা। ওর বেলাতেই কি করে আমার এত সাহস চলে আসে সেই উত্তর তখন ও পাই নি আমি। ও ছোট ছেলে ওর সাথে কি কথা বলব এই ব্যাপারে। বললাম ওকে অন্য কথা।
- তুই যাস নি ওদের ওখানে। ওখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে।
- না
- কেন?
- তোমাকে গার্ড দিচ্ছি।
হাসি পেয়ে গেল আমার। বললাম
- আমাকে?
- হুম
- কেন?
- যাতে দাদু কিছু বলতে না পারে তোমাকে বা মারতে না পারে।
- বাবাহ আমার ছোট ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেল? মিমির জন্য চিন্তাও করছে?
- হুম। আর মিমি যে সাঁতার না জেনেও ঝাঁপ দিল আমার জন্য?
- ওলে বাবালে। সে তো মিমিদের ধর্ম। কি হবে মিমির জীবনের যদি এই ছেলেটার কিছু হয়ে যায়?
- আচ্ছা মিমি, ছোট বেলাতেও একবার আমাকে পুকুর থেকে তুমি তুলে এনেছিলে না?
মন টা খারাপ হয়ে গেলো শুনে। সেদিনের মার টাও কম ছিল না। উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম
- হুম
কত কথা মনে পড়ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ওকে বলার মতন নয় সে গুলো। কিন্তু জানিনা কেন ওকে বলতেও ইচ্ছে করছে। এই টুকু একটা ছেলের সামনে অভিমান করব? কিন্তু বলেই দিলাম। জানিনা কেন ছোট থেকেই অর্জুন কাছে সেটা হতে ইচ্ছে করেনি যেটা দিদিদের সামনে আমি হয়ে গেছিলাম। নষ্ট, বেপরোয়া আর ঝগরুটে।
ওকে বললাম
- কিন্তু তোর মা আজকেও ভাবে যে আমি সেদিনে তোকে সেদিনে মারতে গেছিলাম ডুবিয়ে। কি করে তোর মা ভাবতে পারে একথা আমি সেটা বুঝি না।
কিছু বলল না অর্জুন। আমার চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে এল। আমি ওকে ডুবিয়ে মেরে দেবো? অর্জুন কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। যাকে বলে আঁকড়ে ধরা। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অথচ ছেলেটা কে দূরে ঠেলে দিতেও পারছি না আমি। এত ভালবাসার জড়ানো ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারব না। সরেও গেলাম না আমি। ওর হাত দুটো কে আমি ধরে রইলাম যতক্ষন আমাকে ও পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ছিল। কিছু পরে ও যেমন ভাবে চুপি চুপি এসেছিল, পালিয়েও গেল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ ছাদে।