07-01-2022, 09:33 AM
এরপর হুহু করে দিন কাটতে লাগলো। মাঝে মধ্যেই সুচি আর আকাশকে ছাদের এক কোনায় দেখা যেতে লাগলো। বলা বাহুল্য দুজনের বাবা মা এটা জানেন না।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরে গোধূলি অফিসে এলো। আকাশ লক্ষ্য করলো সে তার বাবার সাথে কথা বলছে না। তাতে আকাশের কিছু যায় আসে না। গোধূলি আসতেই সে তার সুইজারল্যান্ডের বিভাগে তাকে জয়েন করানোর জন্য রিকোয়েস্ট করলো। গোধূলি বললো , “ এতে রিকোয়েস্ট করছো কেন ? আমি এমনিতেও পুরো সেকশনটা একা চালাতে পারবো না। তার সাহায্য পার্টনারস চাই। তুমি হবে আমার পার্টনার ? „
আকাশ একবার হাসি দেওয়া ছাড়া কিছু বললো না। পরের দিন থেকেই কাজ শুরু হয়ে গেল । সুইজারল্যান্ডে মোট কটা হোটেল আছে। কোন হোটেল লিজে নেওয়ার জন্য সবথেকে ভালো। কার কেমন পরিসেবা। কোন কোন এয়ারলাইন্স ওই দেশে যায়। কার কতো টিকিট। ওই দেশে কি কি দর্শনীয় স্থান আছে। কোন মরসুমে সবথেকে বেশি পর্যটক হয়। আপাতত এইসব দেখে একটা নির্দিষ্ট বাজেটের প্যাকেজ বানানো হলো কাজ।
আর এইসব কাজের জন্য একজনকে ওই দেশে যেতে হবে। যেহেতু আকাশের বিয়ে হবে তাই গোধূলি আর আরও দুজন ওই দেশে যাবে। আর আকাশ এখানে থেকে সামলাবে।
এর চার পাঁচ দিনের মধ্যেই বিয়ের কার্ড তৈরী হয়ে চলে এলো। দুজনের ফটো দিয়ে বিয়ের কার্ড বানানো হয়েছে। সোসাইটির সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্নো দিতে গেলেন সুচির মা আর আকাশের মা। যথারীতি প্রথমে সবাই বিশ্বাস করতে চাইলো না। তারপর বিয়ের কার্ড দেখে কিছুটা বিশ্বাস করলো সবাই। যেহেতু পাশাপাশি বিয়ে হচ্ছে তাই সবকিছুই ঘেটে ঘ। কোনটা বৌভাত আর কোনটা বিয়ে এটা বলা মুশকিল। তাই বৌভাত-টা কেই রিসেপশন বলে দেওয়া হলো।
বিয়ের কার্ড সবার বাড়িতে পৌছানোর পর সবথেকে বেশি অবাক হলো দুজন। একজন হলো বিপ্লব বিচ্ছু আর একজন হলো জয়শ্রী। মায়ের কাছে সব শুনে বিপ্লব সোজা আকাশের ঘরে চলে এলো। সে এখন একটা ডিলিভারি কোম্পানিতে কাজ করে। এমনিতে সপ্তাহন্তে একবার কি দুবার কথা হয় আকাশ আর বিপ্লবের মধ্যে। দুজনেই চাকরি প্রাপ্ত মানুষ। তাই আর আগের মতো কথা হয়না।
ঘরে ঢুকে আকাশের গলা টিপে বিপ্লব বললো , “ শালা এতো কিছু হয়ে গেল আর তুই আমাকে কিছুই জানাস নি। ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে ! „
“ ছাড় দম নিতে পারছি না। আরে হঠাৎ করে হয়ে গেল সবকিছু ! „
“ আমাকে আর টুপি পড়াতে হবে না। শেষমেশ সুচিদিকে বিয়ে ! ছি্ এ কি করলি তুই ! „
“ দিদি হবে তোর জন্য , ও আমার হবু বউ। আমাকে জামাইবাবু বলে ডাক । '.রা কি বলে ? হ্যাঁ , দুলাভাই বলে ডাক। „
“ তবে রে শালা । „ বলে আকাশের পেটে একটা নকল ঘুষি মারলো বিপ্লব।
স্নেহা দেবী লিভাংরুম থেকেই আকাশের ঘরের ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন , “ কি করছিস রে তোরা। এতো আওয়াজ হচ্ছে কেন ? মারপিট করছিস নাকি ? „
আকাশ ঘর থেকে জোরে বললো , “ না মা। কিছু না । „
কাকিমার আওয়াজ শুনে বিপ্লব বিচ্ছু শান্ত হয়ে এলো। কিন্তু আকাশের সাথে ইয়ার্কি মেরে কথা বলা থামালো না।
সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্ন করা হয়ে গেল। বাকি আছে ডেকরেশন , জামাকাপড় , গয়না কেনা। ডেকরেশন এর দায়িত্ব সুচির বাবা আর আকাশের বাবা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। এবার পাত্র পাত্রীর জন্য গয়না কিনতে হবে। তাই শেয়ার মার্কেট দেখে সুচি , আকাশ , সুচির মা , আকাশের মা , সুমি মিলে গেলেন গীতাঞ্জলি জুয়েলার্সে ।
সুচি নিজের কথা মতো আকাশকে নিজের টাকা দিয়ে একটা পনের হাজার টাকার আংটি কিনে দিল। সুচির বৌভাত আর বিয়ে মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকার গয়না কিনলেন আকাশের মা। সুচির মা বাঁধা দিতে গেলে তিনি বললেন , “ তুমি থামতো। একবার গয়না কিনতে এসছি। কিনতে দাও। আর তোমার জন্য কিনছি না আমি। আমি কিনছি আমার বৌমার জন্য। „
শুধু সুচির জন্য না। সাথে আকাশের মা সুচির মা আর সুমিও নিজের জন্য কিনলো। সব শেষে দেখে গেল প্রায় সত্তর লাখ টাকা হয়ে গেছে। এটা আকাশের মায়ের কাছে কিছুই না। কিন্তু সুচির মা বিল দেখে শুধু বিষম খাওয়াটাই বাকি রাখলেন।
সুচির বাবা রাতে অফিস থেকে এসে গয়নার বিল দেখলেন , শুধু গয়নার পিছনেই সব খরচা হয়ে যাওয়ায় তিনি মুষড়ে পড়লেন। আর টাকা কোথায় পাবেন তিনি ! সেটাই ভাবতে বসলেন। যদিও গয়নার বেশিরভাগ টাকাটাই আকাশের বাবা দিয়েছেন তবুও তার যতোটা খরচা হয়েছে তাই অনেক । জামাকাপড় কিনবেন কি দিয়ে সেটাই তিনি ভাবতে লাগলেন।
‘ এই সময়ে কোন লোন তো নেওয়া যাবে না। শুভ শুনলে আস্তো রাখবে না। কারোর কাছে চাইবো ! না। এমন কেউ নেই যে এখন ধার দিতে রাজি হবে। , এইসব ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ মনে পড়লো ফিক্সড ডিপোজিট এর কথা। দুই মেয়ের বিয়ের জন্য তিনি দুটো আলাদা ফিক্সড ডিপোজিট করে ছিলেন। একটা তো সুমির বিয়ের সময় ভাঙা হয়েছিল। আর একটা ভাঙার সময় হয়ে এসছে।
তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়লো আরও একটা ফিক্সড ডিপোজিট এর কথা। রহমত চাচার টাকা দিয়ে যে ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন সেটা পাঁচ বছর অন্তর রিনিউ করা হয়। শেষ তিন বছর আগে করিয়েছিলেন। তাই মনে ছিল না। এখন মনে পড়াতে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাচলেন ।
পরের দিন সকালেই তিনি ব্যাঙ্কে গিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে নিলেন। বাড়ি ফিরে পুরো টাকাটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন , “ এটা রাখো । „
“ এতোগুলো টাকা কোথায় পেলে ? „
“ তোমার মনে নেই ! রহমত চাচার টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিলাম। „
“ উনি তো সুচিকে দিয়ে গেছিলেন। „
“ সুচির জন্যেই তো খরচা হচ্ছে। ওর বিশেষ দিনের উপহার কিনবেন বলে রেখে গেছিলেন। এখন সুচির বিয়ের থেকে আর বড়ো বিশেষ দিন কি হতে পারে ! „
এরপর আর কোন কথা হয়না।
এই সব আনন্দের মধ্যেই কলকাতা শহরের মধ্যে এক রাতে , বিখ্যাত পাবে চার জন বসে মদ খেয়ে নেশা করছিল। আজ একটু বেশিই নেশা হয়ে গেছে সবার। চার বোতল rum হয়ে গেছে এর মধ্যে। তাদের বিভিন্ন কথাবার্তার হচ্ছিল । কে কতো ভিতু এই নিয়ে। এর মাঝে একজন বললো , “ এ শালা তো শরীর গরম করতে গিয়ে মেয়ের হাতে চড় খেয়ে এসছে। সেটা বল ! „
আর একজন গম্ভীর হয়ে সিগারেটের ছাই এসট্রে তে ফেলে বললো , “ বাবা এখনও জানে না। জানতে পারলে কি হবে ভেবেছিস ! „
বড়দার কথাটা গায়ে লাগলো পলাশের।
পরের দিন ছিল রবিবার। দুপুর দুপুর সেই পুরানো দলবল নিয়ে যাওয়া হলো জামাকাপড় কিনতে। এবার সাথে সুচির বাবাও গেলেন। আকাশের বাবাকে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। তাই আকাশকে গাড়ি দিয়ে তিনি একটা ক্যাব বুক করে অফিস চলে গেলেন। আকাশ গাড়ি চালাতে পারে। তাই সে নিচে চালিয়েই মা , সুচি আর জেঠু জেঠিমা কে নিয়ে যেতে লাগলো শপিং মলে। ওখানেই সুমি দেখা করবে।
গাড়ির চালকের সিটে আকাশ । পাশের সিটে তার মা। আর পিছনের সুচি আর সুচির মা বাবা বসলেন। গাড়ি রাস্তাতে নামতেই সুচি বুঝতে পারলো যে আকাশ ব্যাকভিউ মিররে পিছনের গাড়ি দেখার ভান করে তাকেই দেখে চলছে। সুচি মনে মনে বললো , ‘ কি অসভ্যতামি শুরু করেছে। পাশে বাবা মা বসে আছে সেটাও দেখছে না। ,
এর পরেই যখন আকাশ সুচিকে দেখতে গেল তখন সুচি চোখ গোল গোল করে , রাগি মুখ করে , পাশে বাবা মা বসে আছে সেটা বলে দিল। , আকাশ নিরুপায় হয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিল।
প্রায় দুপুর দুটোর দিকে সবাই পৌঁছালো শপিং মলে। যাওয়ার কথা ছিল রাতে। কিন্তু তখন সুমির হবে না। তাই দিনের বেলাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
শপিং মলে পৌছে গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে মলে ঢুকতেই সুমি আর প্রজ্ঞাকে দেখতে পেল সবাই। সুমিকে দেখে সুমির বাবা খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কেমন আছিস ? কৌশিকের এলো না ! „
“ আমরা সবাই ভালো আছি। ওকে অফিসের কাজে শিলিগুড়ি যেতে হলো। তাই আমি আর প্রজ্ঞা এসছি। আজ তোমাদের ওখানেই থাকবো। „
“ খুব ভালো করেছিস। „
এদিকে সুচির মা প্রজ্ঞাকে কোলে নিয়ে একটা চুমু খেলেন , “ কেমন আছিস তুই ? „
“ আমি ভালো আছি । তুমি কেমন আছো দিম্মা ? „ সুমির মেয়ের বয়স বেশি না। এই বয়সে সবার তোতলানোর কথা। কিন্তু সে খুব ভালো মিষ্টি কথা বলতে পারে।
“ উম্ , আমি ভালো নেই। „
“ কেন ? কি হয়েছে তোমার ? „
“ তুই তো আর আমার কাছে আসিস না। তাই আমি ভালো নেই । „
“ মা বলেছে আজকে মাসির বাড়িতে থাকবো। বাবা অফিসের কাজে অন্য জায়গায় গেছে তো , তাই। „
আরও একটা চুমু খেয়ে সুচির মা বললেন , “ চল , তোকে একটা ভালো জামা কিনে দিই। কি পছন্দ তোর ? „
“ আমার ফ্রগ পছন্দ । „
“ তাহলে তোকে দুটো ফ্রগ কিনে দেবো। „
“ সত্যি ! „
“ সত্যি , সত্যি , সত্যি । „
দিম্মা আর নাতনির কথাবার্তাতে তারা সবাই এক বিখ্যাত ব্রান্ডের দোকানের সামনে চলে এলো। এরা মূলত বিয়ের কাপড়ের জন্যেই বিখ্যাত । দোকানে ঢুকে সবাই প্রথমে সুচির জন্য পছন্দ করতে লাগলো। সুচির জন্য প্রথমে সবাই একটা লাল রঙের উপরে সোনালী সুতো দিয়ে কারুকার্য করা একটা সুন্দর বেনারসি পছন্দ করলো । তারপর আকাশের জন্য অনেক কটা পাঞ্জাবি দেখে তাদের মধ্যে একটা সাদার উপর সোনালী রঙের ফুল আঁকা আর একটা হলুদ পাঞ্জাবী কেনা হলো। লাল ধুতি কিনতে গেলে আকাশ বললো , “ আমি ধুতি পড়বো না। এখন ধুতি কেউ পড়ে নাকি ! „
আকাশের মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন , “ পড়ে না মানে ! সবাই পড়ে। তুইও পড়বি । „
মায়ের কথায় আকাশ চুপচাপ হয়ে গেল। পাত্র পাত্রীর জন্য কেনা কাটা হয়ে গেলে সবাই নিজের জন্য পছন্দ করতে শুরু করলো। এই সুযোগে আকাশ আর সুচি আলাদা হয়ে অন্যান্য জামা কাপড় দেখতে লাগলো। আকাশ একটা ম্যানিকুইন এর গায়ে পড়ানো মেরুন রঙের গাউন দেখিয়ে বললো , “ এটা তোকে মানাবে ভালো। একবার ট্রায়াল দে না । „
সুচি রাগি চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, “ আবার তুই করে বলছিস ! „
আকাশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এতদিনের অভ্যাস একদিনে তো যাবে না। আকাশকে চুপচাপ থাকতে দেখে সুচি কিছুক্ষণ উদাস হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলো , “ তুই পছন্দ করে দিচ্ছিস ? „
“ হ্যাঁ আমার তো ভালো লাগছে । চাইলে কিনেও দিতে পারি। „
সুচি একজন সেল্স গার্লকএ ডেকে জিজ্ঞাসা করলো , “ এটা ট্রায়াল দেওয়া যাবে ? „
“ হ্যাঁ ম্যাম , আপনি এদিকে আসুন। আমাদের কাছে এর আরও স্টক আছে। „
সুচির সাথে আকাশও সেই মহিলার পিছন পিছন গেল। একটা থাকে আরও এরকম কয়েকটা গাউন আছে। সেল্স গার্ল সেখান থেকে একটা কোমর 26 সাইজের গাউন বার করে সুচিকে দিল। সুচি “ থ্যাঙ্ক ইউ বলে । „ ট্রায়াল রুমে চলে গেল। আকাশ বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর যখন সুচি বার হলো তখন আকাশ আর সুচির উপর থেকে চোখ সরাতে পারলো না। একভাবে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলো।
আকাশের মুখ হা দেখে সুচি বললো , “ কি দেখছিস ? „
“ তোকে খুউব সুন্দর দেখাচ্ছে। „
সুচি রাগী চোখে তাকাতেই আকাশ বললো , “ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে । „ তারপর একটু ব্যাঙ্গ করে আকাশ বললো , “ তুমি আমাকে দিয়ে তুমি বলাচ্ছো , কিন্তু তুমি নিজে আমাকে তুই করে বলো , তখন ! „
“ আমার কথা আলাদা। এটা আমার কোন অভ্যাস না। আমি চাইলেই তোকে এখন তুমি বলতে পারি। কিন্তু তোর এই অভ্যাসটা আগে ছাড়াতে হবে। „
আকাশ সুচির লজিকে চুপ করে গেল। আজ যেন তার চুপ করে যাওয়ার দিন। মুখটা বাংলার পাঁচ করে সে বললো , “ তোমাকে এই গাউনে ভালো মানাচ্ছে। „
সুচি হেসে বললো , “ তুই যখন পছন্দ করছিস তখন এটা আমি বৌভাতে পড়বো। আর নিজের টাকায় কিনবো ...
সুচির কথা শেষ হতে না হতেই সুচির মায়ের ডাক পড়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে আবার ট্রায়াল রুমে ঢুকে , গাউন খুলে , আগের জিন্স আর চুড়িদার পড়ে বেরিয়ে এলো।
সবার পছন্দের মতো কেনাকাটা করার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে সবাই গাড়িতে চেপে বসলো । সুমি স্কুটি করে এসছিল। তাই সে গাড়িতে না উঠে নিজের স্কুটি করেই বাপের বাড়ি যেতে লাগলো।
আকাশের মা কিনেছেন তিনটে দামী শাড়ি । সুচির মা কিনেছেন দুটো। সুমি নিজের জন্য কিনেছে দুটো আর প্রজ্ঞাকে একটা জামা প্যান্ট। আর সুচির মা প্রজ্ঞাকে তার কথা মতো কিনে দিয়েছেন দুটো ফ্রগ। আর সুচির জন্য তিনটে এক্সট্রা শাড়ি। আকাশের জন্য আরও দুটো পাজামা পাঞ্জাবি। আর সুচির বাবা কিনেছেন দুটো পাজামা পাঞ্জাবি আর এক সেট জামা প্যান্ট।
আগের মতো আকাশই ড্রাইভ করছে। আকাশের পাশে বসছেন আকাশের মা। সুচি আর সুচির মা বাবা পিছনের সিটে। আকাশের মা আর সুচির মা মিলে ফেলে আসা দোকানের কোন শাড়ির রঙ কেমন ছিল। কোনটার দাম বেশি। কোনটার দাম কম। ওটা কিনলে আরও ভালো হতো। এইসব আলোচনা করছিলেন । আর আকাশ আসার সময়ের মতো রেয়ারভিউ মিরর দিয়ে মাঝেমাঝে সুচিকে দেখতে লাগলো। সুচিও দেখলো আকাশ আবার তাকেই দেখছে। তাই একবার চোখ রাঙিয়ে আকাশকে শাসন করে মায়ের কথা শুনতে লাগলো।
এইসব কথা বলতে বলতে কখন তারা সোসাইটিতে চলে এলো সেটা খেয়াল করলো না। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসছে। সোসাইটিতে সবে লাইট জ্বালানো শুরু হচ্ছে। তবে এখনও কয়েকটা বিল্ডিংয়ে জ্বালানো হয়নি। নিজেদের বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থামতেই সবার হুশ ফিরলো। সবথেকে ধারে বসার জন্য সুচি প্রথমেই নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো।
তাদের গাড়ির ঠিক কিছুদূরে , এক জোড়া ভুরুর লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল যে গাড়িটা ঢুকছে। তার হাতে একটা কাঁচের বোতল ধারা আছে। গাড়ির মধ্যে থেকে সুচি বেরিয়ে আসতেই সে সুচির দিকে এগিয়ে গেল।
গাড়ি থেকে বার হতেই সুচির কেন জানি খুব অস্বস্তি হলো। তার সিক্সথ সেন্স তাকে সাবধান করে দিতে লাগলো । গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকাতেই সুচি দেখলো পলাশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। সুচি বুঝতে পারলো না পলাশ এখানে কি করছে !
পলাশ যখন প্রায় সুচির কাছে পৌছে গেছে ঠিক তখনই সামনের সিটে বসে থাকা আকাশের মা বেরিয়ে এলেন। পলাশ একবার নিজের গালে হাত বুলিয়ে নিল। কাল রাতে যা ঘটেছে তারপরে এই মেয়েকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। গত রাতের ঘটনা ভাবতেই রাগ আরও বেড়ে গেল। সুচির পুরো কাছে এসে হাতে ধরা কাঁচের বোতলটা সুচির মুখে ছুঁড়তে গেল। কিন্তু হঠাৎ আকাশের মা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসায় পলাশের হাত কেঁপে গিয়ে দিক ভ্রষ্ট হলো ।
সুচি আগেই তার হাতে ধরা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা নিজের মুখ গার্ড করে নিল। পলাশের ছোঁড়া বোতল এসে লাগলো সেই প্লাস্টিকের উপর। তার মধ্যে থাকা কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ছিটকে গিয়ে লাগলো সুচির বাম হাতে কনুইয়ের নিচে। আর বোতলটা নিচে পড়ে গিয়ে ইটে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য জ্বালা নিয়ে নিজের হাত ধরে ওখানেই বসে পড়লো সুচি। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে আর নিজের কাজ সফল হলো না দেখে , পলাশ সোসাইটির গেটের দিকে দৌড় দিল । সেখানে আগে থেকেই একটা বাইক দাঁড়িয়ে ছিল। পলাশকে দৌড়ে আসতে দেখে বাইকের উপরে বসে থাকা লোকটা বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল। পলাশ দৌড়ে চলন্ত বাইকের উপর উঠতেই বাইকটা হুশ করে বেরিয়ে গেল।
কি হয়েছে সেটা বুঝতে সবার বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। আকাশ এসে গাড়ির ভিতর থেকে জলের বোতলটা বার করে সুচির হাতে ঢালতে লাগলো। সুচি মেঝেতে বসে নিজের বাঁ হাত ধরে অসহ্য জ্বালায় কেঁদে ফেললো। সুচির মা আর আকাশের মা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন । আর অনর্গল প্রলাপ বকতে লাগলেন।
পলাশকে কেউ না চিনলেও সুমি চিনতো। সুচি তাকে পলাশের ফটো দেখিয়ে ছিল। পলাশ যখন দৌড়ে সোসাইটির গেট দিয়ে বার হচ্ছিল তখন সুমি স্কুটি চালিয়ে ঢুকছিল । পলাশকে ওইভাবে দৌড়ে যেতে দেখে সুমি খুব অবাক হয়েছিল। ভিতরে এসে ঢুকে পরিস্থিতি দেখে সে বুঝতে পারলো কি হয়েছে।
সুমি এসেই সুচির ক্ষত দেখে বললো , “ নার্সিংহোমে নিয়ে চলো । „ সুমির কথা শেষ হতেই সুচির বাবা আর আকাশ মিলে সুচিকে তুলে পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে গেলেন।
এতক্ষণে সোসাইটির সবাই জড়ো হয়ে গেছে আর বলাবলি শুরু করেছে , আমাদের সোসাইটি তে এইসব ! কে করলো ? কেউ দেখেছো ? কি হলো সমাজটার ? দিন দুপুরে এইসব ? এখন মানুষ কোথাও নিরাপদ নয়।
এদিকে সুমি নিজে কেঁদে ফেললো। সে ভাবতে লাগলো এইসব তার জন্যেই হয়েছে। তার জন্যেই সুচি ওই পশুটার সাথে রিলেশনে গেছিল। তাই সে কাঁদতে কাঁদতে বললো , “ এসব আমার জন্য হয়েছে। শুধু আমার জন্য। আমি না বললে বোনের সাথে এরকম হতো না। „
মাকে কাঁদতে দেখে প্রজ্ঞাও কেঁদে ফেললো , “ মা , কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছো কেন ? „
কিছুক্ষণ কান্নাকাটি আর প্রলাপ বকার পর আকাশের মা তার স্বামীকে ফোন করলেন। স্বামী ফোন ধরলেই তিনি চোখের জল মুছে বললেন , “ তুমি কি হ্যাঁ ! এদিকে বাড়ির একজনের মুখে এ্যাসিড ছুঁড়ছে আর তুমি ছুটির দিনেও অফিসে গেছো ! „
আকাশের বাবা একবার অফিস পরিদর্শনে গেছিলেন। আর মহিলাদের কেনাকাটায় তিনি থাকতে চান নি। তাই বাহানা বানিয়ে অফিসে গেছিলেন। এখন স্ত্রীর মুখে এতোটা শুনেই তিনি কেঁপে উঠলেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তিনি মাথা ঠান্ডা রাখা সমীচীন মনে করলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে ট্যাক্সি ধরলেন।
গাড়িতে বাবার কোলে মাথা রেখে সুচি কেঁদে চলেছে। চোখ লাল হয়ে গেছে তার , “ বাবা , খুব জ্বালা করছে বাবা। পারছি না আমি ! পুড়ে যাচ্ছে হাতটা। „
সুচির বাঁ হাতের কনুইয়ের নিচে প্রায় দুই ইঞ্চি মতো চামড়া পুড়ে গেছে। সেই ক্ষত দেখে সুচির বাবা চোখের জল মুছে বললেন , “ আমরা চলে এসছি , এইতো । „
আকাশ গাড়ি চালাতে চালাতেই সামনে ঝাপসা দেখলো। বারবার চোখের জল মুছে গাড়ি যতো জোরে চালানো যায় ততো জোরে চালাতে লাগলো। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। কিন্তু এখন সুচিকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া বেশি জরুরি। তাকে শক্ত হতে হবে। এখন তাকেই শক্ত হতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা নার্সিংহোম পৌঁছে গেলে সুচিকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। ডাক্তারকে সব বললে ডাক্তার বললো , “ Fir করাতে হবে। আপনারা fir করুন আমি দেখছি । „বলে চেম্বারে ঢুকে গেলেন।
এদিকে আকাশের বাবা অফিস থেকে ফিরে সুমির মুখে সব শুনলেন। সুমি যে পলাশকে চেনে সেটা শুনলেন। আর স্ত্রীর মুখে ‘ পাষাণ , দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ , এইসবও শুনলেন।
তিনি আবার সুমিকে নিয়ে এবং প্রজ্ঞাকে তার দিম্মার কাছে রেখে নার্সিংহোমের দিকে রওনা হলেন। এতক্ষনে সোসাইটির কয়েকজন সুচির মাকে শান্তনা দিচ্ছিল ‘ বেশি কিছু হয়নি। খুব বাঁচা বেচে গেছে সুচি। বড়ো কিছু হতে পারতো । , এইসব কথায় সুচির মা শান্ত হয়ে এসছেন।
আসার সময় বারবার আকাশকে ফোন করছিলেন আকাশের বাবা কিন্তু আকাশ ফোন ধরছিল না। এখন আবার ফোন করাতে আকাশ ফোন ধরলো । আকাশের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোথায় তুই ? „
আকাশ কান্না জড়ানো গলায় বললো , “ আমি এই নার্সিংহোমে। ডাক্তার দেখছে সুচিকে। „
“ আমি আসছি । „ বলে ফোন কেটে দিলেন আকাশের বাবা।
আরও প্রায় পনের মিনিট পর নার্সিংহোমে পৌছে ছেলে আর সমুর মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি । সুচির বাবা এতক্ষণ পর কাউকে পেলেন দুঃখ ভাগ করার জন্য। আকাশের বাবা আসতেই তিনি বললেন , “ এ আমার মেয়ের সাথে কি হলো শুভো ! „
“ তুই শান্ত হ , ভেঙে পড়িস না আমি দেখছি । „ বলে জিজ্ঞাসা করলেন , “ ডাক্তার কি বললো ? „
আকাশ চোখ মুছে বললো , “ ডাক্তার fir করতে বলেছে। „
আকাশকে কাঁদতে দেখে সুমি এগিয়ে গেল। আকাশের কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্তনা দিতে লাগলো। তারপরেই ডাক্তার বেরিয়ে আসতে সবাই ছেঁকে ধরলো , “ কি হয়েছে ও কেমন আছে ? ...
ডাক্তার বললো , “ বেশি ইনজুরি হয়নি। ক্ষত গভীর নয়। আমি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছি। তবে পেশেন্ট মেন্টালি শক পেয়েছে। আপনারা গিয়ে দেখতে পারেন । „
ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই ভিতরে ঢুকলো। সুচি বেডে শুয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসে দুই গাল ভাসিয়ে দিচ্ছে। সুচির বাবা গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন , “ ঈশ্বর বাঁচিয়ে দিয়েছে তোকে। „
সুচি অশ্রুসিক্ত চোখে একবার আকাশকে দেখলো। আকাশের চোখ লাল হয়ে আছে। দুজনের মধ্যে চোখে চোখে কি কথা হলো সেটা বাকি কেউ বুঝতে চাইলো না।
কিছুক্ষণ পর মহল চুপচাপ হতে এবং বাড়িতে ফোন করে ‘ কিছু হয়নি। সুচি ঠিক আছে। , বলার পর আকাশের বাবা সুমিকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন , “ চল থানায়। „
সুমি এটারই অপেক্ষা করছিল । এখন আকাশের বাবার কথায় সুমি চুপচাপ মুখটা বজ্রের মতো শক্ত করে থানায় চললো। লোকাল থানায় গিয়ে সবকিছু খুলে বলতেই পুলিশ বললো , “ আপনারা ঠিক বলছেন ? বিধায়কের ছোট ছেলেই ছিল ! আপনাদের কাছে কোন প্রমাণ আছে ? „
সুমি দৃঢ় কন্ঠে বললো , “ প্রমাণ নেই। সাক্ষী আছে। আমি নিজে দেখেছি পলাশকে। „
এরপর আর পুলিশ কিছু বললো না। কিছুক্ষণ সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে fir লিখে নিল আর বললো , “ ঠিক আছে । ইন্সপেকশনে একজনকে পাঠিয়ে দেবো। আপনারা যান। „
সুমি আর আকাশের বাবা নার্সিংহোম হয়ে আকাশ আর সুচির বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। সুচিকে কাল সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে।
বাড়ি তো এলেন সবাই কিন্তু কারোর মুখে কোন কথা নেই। সবাই বোবা হয়ে গেছে। আকাশদের লিভিংরুমে পাথর হয়ে বসে আছে সবাই। সুচির আর আকাশের মা থেকে থেকেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। আকাশের বাবা মাঝে একবার বললেন , “ আমি ওকে ছেড়ে দেবো না সমু । „
তবুও একমাত্র প্রজ্ঞা ছাড়া বড়ো কারোর মুখে কথা নেই। প্রজ্ঞা মায়ের কোলে বসে মাঝেমাঝে জিজ্ঞাসা করছে , “ কি হয়েছে মা ? „
কিন্তু সুমির মুখে কোন জবাব নেই। প্রাণহীন মুখ সবার। গালে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের দাগ স্পষ্ট।
এইসব ভাগাভাগি দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে কারোর সময়ের হুশ ছিল না। ঠিক রাত দশটা বাজতেই আকাশের বাবার ফোন নাম্বারে একটা ফোন এলো। অচেনা নাম্বার দেখে অবাক হয়ে ফোনটা ধরে প্রাণহীন কন্ঠে ‘ হ্যালো , বলতেই অপর প্রান্ত থেকে এক মখমলের মতো গলায় একটা আওয়াজ ভেসে এলো , “ আপনি কি মি. মিত্র বলছেন ? „
আকাশের বাবা --- হ্যাঁ বলছি। আপনি কে ? চিনিলাম না তো
ফোনের ভিতরের মানুষ --- ওই যার বিরুদ্ধে , কিছুক্ষণ আগে fir করলেন না আপনি ! তার বাবা বলছি ।
আকাশের বাবা ভাবলেন , ‘ এই লোকটা তার নাম্বার কোথা থেকে পেল ! নিশ্চয়ই থানা থেকে। ওখানে নিজের নাম্বার দিয়ে এসছেন তো। , এটা ভেবেই তিনি ফোনটা স্পিকারে দিয়ে দিলেন আর বললেন , “ পঙ্কজ সহায়। „
পঙ্কজ সহায় --- “ হ্যাঁ আমার নামই পঙ্কজ । পরিচয় পর্ব তো হলো। এবার কাজের কথায় আসি। আপনি যে fir টা করেছেন ওটা ফিরিয়ে নিন । „
আকাশের বাবা রেগে গিয়ে বললেন , “ কি বলছেন আপনি ! আপনার ছেলে আমার মেয়ের এতো বড়ো একটা ক্ষতি করলো ....
আকাশের বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিধায়ক বললো , “ আমার ছোট ছেলে এখনও বাচ্চা রয়ে গেল। সিনেমা দেখে ওইসব শিখেছে। . ....
এবার বিধায়কের কথার মাঝে আকাশের বাবা বলে উঠলেন , “ আপনার ছোট ছেলে আর যাই হোক বাচ্চা নয় ! „
পঙ্কজ সহায় ---“ বাচ্চা তো আপনিও নন মি. মিত্র। আপনার মেয়ের শুধু হাত পুড়েছে। মুখটা এখনও আগের মতোই আছে। আপনি কি চান ! ওটাও পুড়ুক ! „
আকাশের বাবা --- “ আপনি মানুষ নন। আপনি পশু। আমি আপনাদের কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না। „
পঙ্কজ সহায় --- ওসব প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলার থাকলে এই বিধানসভার পরে খেলবেন। শুনুন কান খুলে। এবারের বিধানসভায় আমি CM candidate হয়ে দাড়াচ্ছি। যদি আপনার বা আপনার মেয়ের জন্য আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় তাহলে সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো। এখন যা বলছি শুনুন। বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা খুলুন আর সে যে কাগজ গুলো দিচ্ছে তাতে সই করুন । আর আমার ছেলে আপনাদের কখনো ডিস্টার্ব করবে না। „ বলেই ফোনটা কেটে গেল।
ফোনটা হাতে নিয়ে রাগে ফুসতে লাগলেন আকাশের বাবা। ফোন স্পিকারে দেওয়ায় ঘরের সবাই বিধায়ক আর তার কথা শুনছিল। এতক্ষণ সবার চোখের জল শুকিয়ে গেছিল। এখন আবার বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। আচলে মুখ চাপা দিয়ে সুচির মা আর আকাশের মা কাঁদতে শুরু করলেন। সব শুনে সুচির বাবা ধপ করে সোফায় বসে বললেন , “ এই পশুটাকে আমরাই ভোট দিয়েছিলাম। „
সুমি ভাবলো , “ এই লোকটাই উচ্চমাধ্যমিকে তাকে স্কুটি গিফ্ট দিয়েছিল। সেই স্কুটি দুই বোন মিলে চালাতাম । „
ঠিক তখনই এদের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ডোরবেল বেজে উঠলো। আকাশের বাবা বজ্র কঠিন মুখ করে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন । দেখলেন একজন ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের ছেলে হাতে কিছু কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের বাবার দরজা খোলার পর সে বললো , “ স্যার এতে আপনাদের তিনজনের সই দিতে বলেছেন। „ বলে হাতে ধরা কাগজটা এগিয়ে দিল ।
আকাশের বাবা কাগজটা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে গেলেন। কিন্তু কি একটা ভেবে সেই চিন্তা বাদ দিলেন । কাগজ গুলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতেই সুচির বাবা আর বাকি সবাই এসে পড়লো। সব পড়ে আকাশের বাবা নিচে সই করে দিলেন।
বাবার সই করা দেখে আকাশ পাথর হয়ে গেল। বাবা কি ভয় পেয়েছে ! এতো ভিতু বাবা। এ কি করলো বাবা !
আকাশের বাবা সই করার পর সুচির বাবার দিকে এগিয়ে দিলেন। সুচির বাবা কিছুক্ষণ হা করে শুভোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তিনিও সই করলেন আর কাগজটা একমাত্র সাক্ষী সুমির দিকে এগিয়ে দিলেন। সুমি বাবার দিকে তাকাতেই তার বাবা একটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন । বাবার ইশারা দেখে সুমিও সই করে দিল।
তিনজনের সই করার পর ছেলেটা চলে গেল । রাতে প্রজ্ঞা বাদে কেউ খেলো না। সবাই না খেয়েই ঘুমালো। বলাবাহুল্য ঘুম কারোর চোখে এলো না। আকাশ বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলো তার বাবা এতোটা কাপুরুষ ! মেরুদণ্ডহীন ভিতু। একজনের ভয় দেখানোতে ভয় পেয়ে সই করে দিল।
ওদিকে নার্সিংহোমে সুচির ও ঘুম এলো না। শেষ রাতের দিকে একবার চোখ জুড়িয়ে এসছিল। সেই সময়েই দেখলো দুঃস্বপ্নটা।
সুচি দেখলো পলাশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে এসে বোতলের সব তরল পদার্থ তার মুখে ছুঁড়ে মারলো। মুখ পুড়ে যাচ্ছে তার। অসহ্য জ্বালায় সে ছটফট করছে .... একটা চিৎকার করে সুচির ঘুম ভাঙতে সে উঠে বসলো। দেখলো নার্সিংহোমে শুয়ে আছে। মুখের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। আর শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত চলছে।
সুচির চিৎকারে একজন নার্স ছুটে এলো। এসেই পাশের টেবিলে রাখা জল খেতে দিল। জল খাইয়ে নার্স নিজে সুচিকে জড়িয়ে ধরে বললো , “ এরকমই হয় বোন। মেয়েদের সাথে আজীবন এরকমই হয়ে আসছে। তোমার তো তাও কিছুই হয় নি। এরকম আরো পেশেন্ট দেখেছি। তাদের মুখের কোনটা নাক , কোনটা ঠোঁট বোঝা যায় না। ঈশ্বর তোমায় বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তুমি ঘুমাও। আমি এখানেই আছি। „
নার্সের কথায় সুচি ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। এক অজানা ভয়ে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।
সকাল হতেই আকাশ চুপিচুপি নার্সিংহোমে চলে এলো। গার্ড বললো , “ এখনও ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়নি আপনি ঢুকতে পারবেন না। „
গার্ডের বাঁধা দেওয়ায় আকাশ ওয়েটিং রুমেই বসে রইলো। কাল রাতে সুচির ফোন নিয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছিল । না হলে রাতে কথা বলতো । ‘ না জানি কিভাবে আছে মেয়েটা। , এখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। দশটা বাজলেই আকাশ সুচির ওয়ার্ডে ঢুকে পড়লো। সেখানে পর্দা দিয়ে ঘেরা আরো তিন জন পেশেন্ট আছে।
আকাশ ঘরে ঢুকতেই সুচি কেঁদে ফেললো । সুচির পাশে বসতেই সুচি তাকে জড়িয়ে ধরলো , “ কোথায় ছিলি তুই ! রাতে ঘুমাসনি ! „
“ তুইও তো ঘুমাসনি । „ বলতেই সুচি আকাশকে ছেড়ে বসলো। আশেপাশের সবাই দেখতে শুরু করেছে যে।
সুচির ডান হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমু খেয়ে আকাশ কাল রাতের সব ঘটনা বলতে শুরু করলো। বিশেষ করে বাবার কাপুরুষতার কথাটা। কিভাবে নিজে সই করে জেঠু আর সুমিদিকে সই করাতে বাধ্য করলো সেই কথাটা। এতোটা বলতেই আকাশের বাবা এসে ঢুকলেন।
তিনি সকালে উঠে স্ত্রীর মুখে শুনলেন যে ছেলে ঘরে নেই। আকাশের মাকে শান্ত করার জন্য বললেন , “ নিশ্চয়ই নার্সিংহোমে গেছে। তুমি টেনশন করো না। আমি আনছি সবাইকে। „ বলে এখানে চলে আসলেন।
ঘরে ঢুকেই তিনি সুচিকে বললেন , “ তোকে তো এবার ছেড়ে দেবে। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন , “ গিয়ে পেপারওয়ার্ক গুলো কর। আমার সুচির সাথে কথা আছে। „
আকাশ আর বাবার সাথে কথা বলতে চায় না। ইচ্ছা নেই তার এই মেরুদণ্ডহীন মানুষটার সাথে কথা বলতে। তাই সে উঠে রিসেপশনে চলে গেল।
এদিকে কিছুক্ষণ সুচির সাথে কথা বলতেই সুচি আকাশের বাবাকে জড়িয়ে ধরলো , “ সব আমার দোষের জন্য হয়েছে কাকা। সব আমার জন্য । „
আকাশের বাবা বললেন , “ নিজেকে দোষ দিস না সুচি। তুই কোন দোষ করিস নি। „
আকাশের পেপারওয়ার্ক আর পেমেন্ট করা হয়ে গেলে আকাশের বাবা সুচি আর আকাশকে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন।
এরপর দিন যায় , কালের নিয়মে সুচির হাতের ক্ষত সেরে উঠতে লাগলো কিন্তু মনের ক্ষত মিটলো না। আগের থেকে অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে সে। একা চুপচাপ বসে থাকে। অফিস যায় না। আকাশও অনিয়মিত অফিস যায়। সবসময় সুচির পাশে থাকার চেষ্টা করে সে।
এদিকে আকাশ বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। শুভাশীষ বাবু বুঝতে পারলেন কেন তার ছেলে তার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে।
সুমি , সুমির মা আর আকাশের মা মাঝেমাঝেই চোখের জল ফেলেন । কৌশিক শিলিগুড়ি থেকে এসে সব শুনে পাথর হয়ে গেলো। আর সুচির বাবা চুপচাপ বসে থাকেন। আর সেদিনের কেনা জামা কাপড় যেমন দোকান থেকে এসছিল তেমনি ঘরের এক কোনায় পড়ে রইলো।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরে গোধূলি অফিসে এলো। আকাশ লক্ষ্য করলো সে তার বাবার সাথে কথা বলছে না। তাতে আকাশের কিছু যায় আসে না। গোধূলি আসতেই সে তার সুইজারল্যান্ডের বিভাগে তাকে জয়েন করানোর জন্য রিকোয়েস্ট করলো। গোধূলি বললো , “ এতে রিকোয়েস্ট করছো কেন ? আমি এমনিতেও পুরো সেকশনটা একা চালাতে পারবো না। তার সাহায্য পার্টনারস চাই। তুমি হবে আমার পার্টনার ? „
আকাশ একবার হাসি দেওয়া ছাড়া কিছু বললো না। পরের দিন থেকেই কাজ শুরু হয়ে গেল । সুইজারল্যান্ডে মোট কটা হোটেল আছে। কোন হোটেল লিজে নেওয়ার জন্য সবথেকে ভালো। কার কেমন পরিসেবা। কোন কোন এয়ারলাইন্স ওই দেশে যায়। কার কতো টিকিট। ওই দেশে কি কি দর্শনীয় স্থান আছে। কোন মরসুমে সবথেকে বেশি পর্যটক হয়। আপাতত এইসব দেখে একটা নির্দিষ্ট বাজেটের প্যাকেজ বানানো হলো কাজ।
আর এইসব কাজের জন্য একজনকে ওই দেশে যেতে হবে। যেহেতু আকাশের বিয়ে হবে তাই গোধূলি আর আরও দুজন ওই দেশে যাবে। আর আকাশ এখানে থেকে সামলাবে।
এর চার পাঁচ দিনের মধ্যেই বিয়ের কার্ড তৈরী হয়ে চলে এলো। দুজনের ফটো দিয়ে বিয়ের কার্ড বানানো হয়েছে। সোসাইটির সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্নো দিতে গেলেন সুচির মা আর আকাশের মা। যথারীতি প্রথমে সবাই বিশ্বাস করতে চাইলো না। তারপর বিয়ের কার্ড দেখে কিছুটা বিশ্বাস করলো সবাই। যেহেতু পাশাপাশি বিয়ে হচ্ছে তাই সবকিছুই ঘেটে ঘ। কোনটা বৌভাত আর কোনটা বিয়ে এটা বলা মুশকিল। তাই বৌভাত-টা কেই রিসেপশন বলে দেওয়া হলো।
বিয়ের কার্ড সবার বাড়িতে পৌছানোর পর সবথেকে বেশি অবাক হলো দুজন। একজন হলো বিপ্লব বিচ্ছু আর একজন হলো জয়শ্রী। মায়ের কাছে সব শুনে বিপ্লব সোজা আকাশের ঘরে চলে এলো। সে এখন একটা ডিলিভারি কোম্পানিতে কাজ করে। এমনিতে সপ্তাহন্তে একবার কি দুবার কথা হয় আকাশ আর বিপ্লবের মধ্যে। দুজনেই চাকরি প্রাপ্ত মানুষ। তাই আর আগের মতো কথা হয়না।
ঘরে ঢুকে আকাশের গলা টিপে বিপ্লব বললো , “ শালা এতো কিছু হয়ে গেল আর তুই আমাকে কিছুই জানাস নি। ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে ! „
“ ছাড় দম নিতে পারছি না। আরে হঠাৎ করে হয়ে গেল সবকিছু ! „
“ আমাকে আর টুপি পড়াতে হবে না। শেষমেশ সুচিদিকে বিয়ে ! ছি্ এ কি করলি তুই ! „
“ দিদি হবে তোর জন্য , ও আমার হবু বউ। আমাকে জামাইবাবু বলে ডাক । '.রা কি বলে ? হ্যাঁ , দুলাভাই বলে ডাক। „
“ তবে রে শালা । „ বলে আকাশের পেটে একটা নকল ঘুষি মারলো বিপ্লব।
স্নেহা দেবী লিভাংরুম থেকেই আকাশের ঘরের ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন , “ কি করছিস রে তোরা। এতো আওয়াজ হচ্ছে কেন ? মারপিট করছিস নাকি ? „
আকাশ ঘর থেকে জোরে বললো , “ না মা। কিছু না । „
কাকিমার আওয়াজ শুনে বিপ্লব বিচ্ছু শান্ত হয়ে এলো। কিন্তু আকাশের সাথে ইয়ার্কি মেরে কথা বলা থামালো না।
সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্ন করা হয়ে গেল। বাকি আছে ডেকরেশন , জামাকাপড় , গয়না কেনা। ডেকরেশন এর দায়িত্ব সুচির বাবা আর আকাশের বাবা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। এবার পাত্র পাত্রীর জন্য গয়না কিনতে হবে। তাই শেয়ার মার্কেট দেখে সুচি , আকাশ , সুচির মা , আকাশের মা , সুমি মিলে গেলেন গীতাঞ্জলি জুয়েলার্সে ।
সুচি নিজের কথা মতো আকাশকে নিজের টাকা দিয়ে একটা পনের হাজার টাকার আংটি কিনে দিল। সুচির বৌভাত আর বিয়ে মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকার গয়না কিনলেন আকাশের মা। সুচির মা বাঁধা দিতে গেলে তিনি বললেন , “ তুমি থামতো। একবার গয়না কিনতে এসছি। কিনতে দাও। আর তোমার জন্য কিনছি না আমি। আমি কিনছি আমার বৌমার জন্য। „
শুধু সুচির জন্য না। সাথে আকাশের মা সুচির মা আর সুমিও নিজের জন্য কিনলো। সব শেষে দেখে গেল প্রায় সত্তর লাখ টাকা হয়ে গেছে। এটা আকাশের মায়ের কাছে কিছুই না। কিন্তু সুচির মা বিল দেখে শুধু বিষম খাওয়াটাই বাকি রাখলেন।
সুচির বাবা রাতে অফিস থেকে এসে গয়নার বিল দেখলেন , শুধু গয়নার পিছনেই সব খরচা হয়ে যাওয়ায় তিনি মুষড়ে পড়লেন। আর টাকা কোথায় পাবেন তিনি ! সেটাই ভাবতে বসলেন। যদিও গয়নার বেশিরভাগ টাকাটাই আকাশের বাবা দিয়েছেন তবুও তার যতোটা খরচা হয়েছে তাই অনেক । জামাকাপড় কিনবেন কি দিয়ে সেটাই তিনি ভাবতে লাগলেন।
‘ এই সময়ে কোন লোন তো নেওয়া যাবে না। শুভ শুনলে আস্তো রাখবে না। কারোর কাছে চাইবো ! না। এমন কেউ নেই যে এখন ধার দিতে রাজি হবে। , এইসব ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ মনে পড়লো ফিক্সড ডিপোজিট এর কথা। দুই মেয়ের বিয়ের জন্য তিনি দুটো আলাদা ফিক্সড ডিপোজিট করে ছিলেন। একটা তো সুমির বিয়ের সময় ভাঙা হয়েছিল। আর একটা ভাঙার সময় হয়ে এসছে।
তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়লো আরও একটা ফিক্সড ডিপোজিট এর কথা। রহমত চাচার টাকা দিয়ে যে ফিক্সড ডিপোজিট করেছিলেন সেটা পাঁচ বছর অন্তর রিনিউ করা হয়। শেষ তিন বছর আগে করিয়েছিলেন। তাই মনে ছিল না। এখন মনে পড়াতে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাচলেন ।
পরের দিন সকালেই তিনি ব্যাঙ্কে গিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে নিলেন। বাড়ি ফিরে পুরো টাকাটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন , “ এটা রাখো । „
“ এতোগুলো টাকা কোথায় পেলে ? „
“ তোমার মনে নেই ! রহমত চাচার টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিলাম। „
“ উনি তো সুচিকে দিয়ে গেছিলেন। „
“ সুচির জন্যেই তো খরচা হচ্ছে। ওর বিশেষ দিনের উপহার কিনবেন বলে রেখে গেছিলেন। এখন সুচির বিয়ের থেকে আর বড়ো বিশেষ দিন কি হতে পারে ! „
এরপর আর কোন কথা হয়না।
এই সব আনন্দের মধ্যেই কলকাতা শহরের মধ্যে এক রাতে , বিখ্যাত পাবে চার জন বসে মদ খেয়ে নেশা করছিল। আজ একটু বেশিই নেশা হয়ে গেছে সবার। চার বোতল rum হয়ে গেছে এর মধ্যে। তাদের বিভিন্ন কথাবার্তার হচ্ছিল । কে কতো ভিতু এই নিয়ে। এর মাঝে একজন বললো , “ এ শালা তো শরীর গরম করতে গিয়ে মেয়ের হাতে চড় খেয়ে এসছে। সেটা বল ! „
আর একজন গম্ভীর হয়ে সিগারেটের ছাই এসট্রে তে ফেলে বললো , “ বাবা এখনও জানে না। জানতে পারলে কি হবে ভেবেছিস ! „
বড়দার কথাটা গায়ে লাগলো পলাশের।
পরের দিন ছিল রবিবার। দুপুর দুপুর সেই পুরানো দলবল নিয়ে যাওয়া হলো জামাকাপড় কিনতে। এবার সাথে সুচির বাবাও গেলেন। আকাশের বাবাকে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। তাই আকাশকে গাড়ি দিয়ে তিনি একটা ক্যাব বুক করে অফিস চলে গেলেন। আকাশ গাড়ি চালাতে পারে। তাই সে নিচে চালিয়েই মা , সুচি আর জেঠু জেঠিমা কে নিয়ে যেতে লাগলো শপিং মলে। ওখানেই সুমি দেখা করবে।
গাড়ির চালকের সিটে আকাশ । পাশের সিটে তার মা। আর পিছনের সুচি আর সুচির মা বাবা বসলেন। গাড়ি রাস্তাতে নামতেই সুচি বুঝতে পারলো যে আকাশ ব্যাকভিউ মিররে পিছনের গাড়ি দেখার ভান করে তাকেই দেখে চলছে। সুচি মনে মনে বললো , ‘ কি অসভ্যতামি শুরু করেছে। পাশে বাবা মা বসে আছে সেটাও দেখছে না। ,
এর পরেই যখন আকাশ সুচিকে দেখতে গেল তখন সুচি চোখ গোল গোল করে , রাগি মুখ করে , পাশে বাবা মা বসে আছে সেটা বলে দিল। , আকাশ নিরুপায় হয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিল।
প্রায় দুপুর দুটোর দিকে সবাই পৌঁছালো শপিং মলে। যাওয়ার কথা ছিল রাতে। কিন্তু তখন সুমির হবে না। তাই দিনের বেলাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
শপিং মলে পৌছে গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে মলে ঢুকতেই সুমি আর প্রজ্ঞাকে দেখতে পেল সবাই। সুমিকে দেখে সুমির বাবা খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কেমন আছিস ? কৌশিকের এলো না ! „
“ আমরা সবাই ভালো আছি। ওকে অফিসের কাজে শিলিগুড়ি যেতে হলো। তাই আমি আর প্রজ্ঞা এসছি। আজ তোমাদের ওখানেই থাকবো। „
“ খুব ভালো করেছিস। „
এদিকে সুচির মা প্রজ্ঞাকে কোলে নিয়ে একটা চুমু খেলেন , “ কেমন আছিস তুই ? „
“ আমি ভালো আছি । তুমি কেমন আছো দিম্মা ? „ সুমির মেয়ের বয়স বেশি না। এই বয়সে সবার তোতলানোর কথা। কিন্তু সে খুব ভালো মিষ্টি কথা বলতে পারে।
“ উম্ , আমি ভালো নেই। „
“ কেন ? কি হয়েছে তোমার ? „
“ তুই তো আর আমার কাছে আসিস না। তাই আমি ভালো নেই । „
“ মা বলেছে আজকে মাসির বাড়িতে থাকবো। বাবা অফিসের কাজে অন্য জায়গায় গেছে তো , তাই। „
আরও একটা চুমু খেয়ে সুচির মা বললেন , “ চল , তোকে একটা ভালো জামা কিনে দিই। কি পছন্দ তোর ? „
“ আমার ফ্রগ পছন্দ । „
“ তাহলে তোকে দুটো ফ্রগ কিনে দেবো। „
“ সত্যি ! „
“ সত্যি , সত্যি , সত্যি । „
দিম্মা আর নাতনির কথাবার্তাতে তারা সবাই এক বিখ্যাত ব্রান্ডের দোকানের সামনে চলে এলো। এরা মূলত বিয়ের কাপড়ের জন্যেই বিখ্যাত । দোকানে ঢুকে সবাই প্রথমে সুচির জন্য পছন্দ করতে লাগলো। সুচির জন্য প্রথমে সবাই একটা লাল রঙের উপরে সোনালী সুতো দিয়ে কারুকার্য করা একটা সুন্দর বেনারসি পছন্দ করলো । তারপর আকাশের জন্য অনেক কটা পাঞ্জাবি দেখে তাদের মধ্যে একটা সাদার উপর সোনালী রঙের ফুল আঁকা আর একটা হলুদ পাঞ্জাবী কেনা হলো। লাল ধুতি কিনতে গেলে আকাশ বললো , “ আমি ধুতি পড়বো না। এখন ধুতি কেউ পড়ে নাকি ! „
আকাশের মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন , “ পড়ে না মানে ! সবাই পড়ে। তুইও পড়বি । „
মায়ের কথায় আকাশ চুপচাপ হয়ে গেল। পাত্র পাত্রীর জন্য কেনা কাটা হয়ে গেলে সবাই নিজের জন্য পছন্দ করতে শুরু করলো। এই সুযোগে আকাশ আর সুচি আলাদা হয়ে অন্যান্য জামা কাপড় দেখতে লাগলো। আকাশ একটা ম্যানিকুইন এর গায়ে পড়ানো মেরুন রঙের গাউন দেখিয়ে বললো , “ এটা তোকে মানাবে ভালো। একবার ট্রায়াল দে না । „
সুচি রাগি চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, “ আবার তুই করে বলছিস ! „
আকাশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এতদিনের অভ্যাস একদিনে তো যাবে না। আকাশকে চুপচাপ থাকতে দেখে সুচি কিছুক্ষণ উদাস হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলো , “ তুই পছন্দ করে দিচ্ছিস ? „
“ হ্যাঁ আমার তো ভালো লাগছে । চাইলে কিনেও দিতে পারি। „
সুচি একজন সেল্স গার্লকএ ডেকে জিজ্ঞাসা করলো , “ এটা ট্রায়াল দেওয়া যাবে ? „
“ হ্যাঁ ম্যাম , আপনি এদিকে আসুন। আমাদের কাছে এর আরও স্টক আছে। „
সুচির সাথে আকাশও সেই মহিলার পিছন পিছন গেল। একটা থাকে আরও এরকম কয়েকটা গাউন আছে। সেল্স গার্ল সেখান থেকে একটা কোমর 26 সাইজের গাউন বার করে সুচিকে দিল। সুচি “ থ্যাঙ্ক ইউ বলে । „ ট্রায়াল রুমে চলে গেল। আকাশ বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর যখন সুচি বার হলো তখন আকাশ আর সুচির উপর থেকে চোখ সরাতে পারলো না। একভাবে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলো।
আকাশের মুখ হা দেখে সুচি বললো , “ কি দেখছিস ? „
“ তোকে খুউব সুন্দর দেখাচ্ছে। „
সুচি রাগী চোখে তাকাতেই আকাশ বললো , “ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে । „ তারপর একটু ব্যাঙ্গ করে আকাশ বললো , “ তুমি আমাকে দিয়ে তুমি বলাচ্ছো , কিন্তু তুমি নিজে আমাকে তুই করে বলো , তখন ! „
“ আমার কথা আলাদা। এটা আমার কোন অভ্যাস না। আমি চাইলেই তোকে এখন তুমি বলতে পারি। কিন্তু তোর এই অভ্যাসটা আগে ছাড়াতে হবে। „
আকাশ সুচির লজিকে চুপ করে গেল। আজ যেন তার চুপ করে যাওয়ার দিন। মুখটা বাংলার পাঁচ করে সে বললো , “ তোমাকে এই গাউনে ভালো মানাচ্ছে। „
সুচি হেসে বললো , “ তুই যখন পছন্দ করছিস তখন এটা আমি বৌভাতে পড়বো। আর নিজের টাকায় কিনবো ...
সুচির কথা শেষ হতে না হতেই সুচির মায়ের ডাক পড়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে আবার ট্রায়াল রুমে ঢুকে , গাউন খুলে , আগের জিন্স আর চুড়িদার পড়ে বেরিয়ে এলো।
সবার পছন্দের মতো কেনাকাটা করার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে সবাই গাড়িতে চেপে বসলো । সুমি স্কুটি করে এসছিল। তাই সে গাড়িতে না উঠে নিজের স্কুটি করেই বাপের বাড়ি যেতে লাগলো।
আকাশের মা কিনেছেন তিনটে দামী শাড়ি । সুচির মা কিনেছেন দুটো। সুমি নিজের জন্য কিনেছে দুটো আর প্রজ্ঞাকে একটা জামা প্যান্ট। আর সুচির মা প্রজ্ঞাকে তার কথা মতো কিনে দিয়েছেন দুটো ফ্রগ। আর সুচির জন্য তিনটে এক্সট্রা শাড়ি। আকাশের জন্য আরও দুটো পাজামা পাঞ্জাবি। আর সুচির বাবা কিনেছেন দুটো পাজামা পাঞ্জাবি আর এক সেট জামা প্যান্ট।
আগের মতো আকাশই ড্রাইভ করছে। আকাশের পাশে বসছেন আকাশের মা। সুচি আর সুচির মা বাবা পিছনের সিটে। আকাশের মা আর সুচির মা মিলে ফেলে আসা দোকানের কোন শাড়ির রঙ কেমন ছিল। কোনটার দাম বেশি। কোনটার দাম কম। ওটা কিনলে আরও ভালো হতো। এইসব আলোচনা করছিলেন । আর আকাশ আসার সময়ের মতো রেয়ারভিউ মিরর দিয়ে মাঝেমাঝে সুচিকে দেখতে লাগলো। সুচিও দেখলো আকাশ আবার তাকেই দেখছে। তাই একবার চোখ রাঙিয়ে আকাশকে শাসন করে মায়ের কথা শুনতে লাগলো।
এইসব কথা বলতে বলতে কখন তারা সোসাইটিতে চলে এলো সেটা খেয়াল করলো না। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসছে। সোসাইটিতে সবে লাইট জ্বালানো শুরু হচ্ছে। তবে এখনও কয়েকটা বিল্ডিংয়ে জ্বালানো হয়নি। নিজেদের বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থামতেই সবার হুশ ফিরলো। সবথেকে ধারে বসার জন্য সুচি প্রথমেই নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো।
তাদের গাড়ির ঠিক কিছুদূরে , এক জোড়া ভুরুর লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল যে গাড়িটা ঢুকছে। তার হাতে একটা কাঁচের বোতল ধারা আছে। গাড়ির মধ্যে থেকে সুচি বেরিয়ে আসতেই সে সুচির দিকে এগিয়ে গেল।
গাড়ি থেকে বার হতেই সুচির কেন জানি খুব অস্বস্তি হলো। তার সিক্সথ সেন্স তাকে সাবধান করে দিতে লাগলো । গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকাতেই সুচি দেখলো পলাশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। সুচি বুঝতে পারলো না পলাশ এখানে কি করছে !
পলাশ যখন প্রায় সুচির কাছে পৌছে গেছে ঠিক তখনই সামনের সিটে বসে থাকা আকাশের মা বেরিয়ে এলেন। পলাশ একবার নিজের গালে হাত বুলিয়ে নিল। কাল রাতে যা ঘটেছে তারপরে এই মেয়েকে একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। গত রাতের ঘটনা ভাবতেই রাগ আরও বেড়ে গেল। সুচির পুরো কাছে এসে হাতে ধরা কাঁচের বোতলটা সুচির মুখে ছুঁড়তে গেল। কিন্তু হঠাৎ আকাশের মা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসায় পলাশের হাত কেঁপে গিয়ে দিক ভ্রষ্ট হলো ।
সুচি আগেই তার হাতে ধরা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা নিজের মুখ গার্ড করে নিল। পলাশের ছোঁড়া বোতল এসে লাগলো সেই প্লাস্টিকের উপর। তার মধ্যে থাকা কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ছিটকে গিয়ে লাগলো সুচির বাম হাতে কনুইয়ের নিচে। আর বোতলটা নিচে পড়ে গিয়ে ইটে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য জ্বালা নিয়ে নিজের হাত ধরে ওখানেই বসে পড়লো সুচি। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে আর নিজের কাজ সফল হলো না দেখে , পলাশ সোসাইটির গেটের দিকে দৌড় দিল । সেখানে আগে থেকেই একটা বাইক দাঁড়িয়ে ছিল। পলাশকে দৌড়ে আসতে দেখে বাইকের উপরে বসে থাকা লোকটা বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল। পলাশ দৌড়ে চলন্ত বাইকের উপর উঠতেই বাইকটা হুশ করে বেরিয়ে গেল।
কি হয়েছে সেটা বুঝতে সবার বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। আকাশ এসে গাড়ির ভিতর থেকে জলের বোতলটা বার করে সুচির হাতে ঢালতে লাগলো। সুচি মেঝেতে বসে নিজের বাঁ হাত ধরে অসহ্য জ্বালায় কেঁদে ফেললো। সুচির মা আর আকাশের মা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন । আর অনর্গল প্রলাপ বকতে লাগলেন।
পলাশকে কেউ না চিনলেও সুমি চিনতো। সুচি তাকে পলাশের ফটো দেখিয়ে ছিল। পলাশ যখন দৌড়ে সোসাইটির গেট দিয়ে বার হচ্ছিল তখন সুমি স্কুটি চালিয়ে ঢুকছিল । পলাশকে ওইভাবে দৌড়ে যেতে দেখে সুমি খুব অবাক হয়েছিল। ভিতরে এসে ঢুকে পরিস্থিতি দেখে সে বুঝতে পারলো কি হয়েছে।
সুমি এসেই সুচির ক্ষত দেখে বললো , “ নার্সিংহোমে নিয়ে চলো । „ সুমির কথা শেষ হতেই সুচির বাবা আর আকাশ মিলে সুচিকে তুলে পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে গেলেন।
এতক্ষণে সোসাইটির সবাই জড়ো হয়ে গেছে আর বলাবলি শুরু করেছে , আমাদের সোসাইটি তে এইসব ! কে করলো ? কেউ দেখেছো ? কি হলো সমাজটার ? দিন দুপুরে এইসব ? এখন মানুষ কোথাও নিরাপদ নয়।
এদিকে সুমি নিজে কেঁদে ফেললো। সে ভাবতে লাগলো এইসব তার জন্যেই হয়েছে। তার জন্যেই সুচি ওই পশুটার সাথে রিলেশনে গেছিল। তাই সে কাঁদতে কাঁদতে বললো , “ এসব আমার জন্য হয়েছে। শুধু আমার জন্য। আমি না বললে বোনের সাথে এরকম হতো না। „
মাকে কাঁদতে দেখে প্রজ্ঞাও কেঁদে ফেললো , “ মা , কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছো কেন ? „
কিছুক্ষণ কান্নাকাটি আর প্রলাপ বকার পর আকাশের মা তার স্বামীকে ফোন করলেন। স্বামী ফোন ধরলেই তিনি চোখের জল মুছে বললেন , “ তুমি কি হ্যাঁ ! এদিকে বাড়ির একজনের মুখে এ্যাসিড ছুঁড়ছে আর তুমি ছুটির দিনেও অফিসে গেছো ! „
আকাশের বাবা একবার অফিস পরিদর্শনে গেছিলেন। আর মহিলাদের কেনাকাটায় তিনি থাকতে চান নি। তাই বাহানা বানিয়ে অফিসে গেছিলেন। এখন স্ত্রীর মুখে এতোটা শুনেই তিনি কেঁপে উঠলেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তিনি মাথা ঠান্ডা রাখা সমীচীন মনে করলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে ট্যাক্সি ধরলেন।
গাড়িতে বাবার কোলে মাথা রেখে সুচি কেঁদে চলেছে। চোখ লাল হয়ে গেছে তার , “ বাবা , খুব জ্বালা করছে বাবা। পারছি না আমি ! পুড়ে যাচ্ছে হাতটা। „
সুচির বাঁ হাতের কনুইয়ের নিচে প্রায় দুই ইঞ্চি মতো চামড়া পুড়ে গেছে। সেই ক্ষত দেখে সুচির বাবা চোখের জল মুছে বললেন , “ আমরা চলে এসছি , এইতো । „
আকাশ গাড়ি চালাতে চালাতেই সামনে ঝাপসা দেখলো। বারবার চোখের জল মুছে গাড়ি যতো জোরে চালানো যায় ততো জোরে চালাতে লাগলো। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। কিন্তু এখন সুচিকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া বেশি জরুরি। তাকে শক্ত হতে হবে। এখন তাকেই শক্ত হতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা নার্সিংহোম পৌঁছে গেলে সুচিকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। ডাক্তারকে সব বললে ডাক্তার বললো , “ Fir করাতে হবে। আপনারা fir করুন আমি দেখছি । „বলে চেম্বারে ঢুকে গেলেন।
এদিকে আকাশের বাবা অফিস থেকে ফিরে সুমির মুখে সব শুনলেন। সুমি যে পলাশকে চেনে সেটা শুনলেন। আর স্ত্রীর মুখে ‘ পাষাণ , দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ , এইসবও শুনলেন।
তিনি আবার সুমিকে নিয়ে এবং প্রজ্ঞাকে তার দিম্মার কাছে রেখে নার্সিংহোমের দিকে রওনা হলেন। এতক্ষনে সোসাইটির কয়েকজন সুচির মাকে শান্তনা দিচ্ছিল ‘ বেশি কিছু হয়নি। খুব বাঁচা বেচে গেছে সুচি। বড়ো কিছু হতে পারতো । , এইসব কথায় সুচির মা শান্ত হয়ে এসছেন।
আসার সময় বারবার আকাশকে ফোন করছিলেন আকাশের বাবা কিন্তু আকাশ ফোন ধরছিল না। এখন আবার ফোন করাতে আকাশ ফোন ধরলো । আকাশের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোথায় তুই ? „
আকাশ কান্না জড়ানো গলায় বললো , “ আমি এই নার্সিংহোমে। ডাক্তার দেখছে সুচিকে। „
“ আমি আসছি । „ বলে ফোন কেটে দিলেন আকাশের বাবা।
আরও প্রায় পনের মিনিট পর নার্সিংহোমে পৌছে ছেলে আর সমুর মুখ দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি । সুচির বাবা এতক্ষণ পর কাউকে পেলেন দুঃখ ভাগ করার জন্য। আকাশের বাবা আসতেই তিনি বললেন , “ এ আমার মেয়ের সাথে কি হলো শুভো ! „
“ তুই শান্ত হ , ভেঙে পড়িস না আমি দেখছি । „ বলে জিজ্ঞাসা করলেন , “ ডাক্তার কি বললো ? „
আকাশ চোখ মুছে বললো , “ ডাক্তার fir করতে বলেছে। „
আকাশকে কাঁদতে দেখে সুমি এগিয়ে গেল। আকাশের কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্তনা দিতে লাগলো। তারপরেই ডাক্তার বেরিয়ে আসতে সবাই ছেঁকে ধরলো , “ কি হয়েছে ও কেমন আছে ? ...
ডাক্তার বললো , “ বেশি ইনজুরি হয়নি। ক্ষত গভীর নয়। আমি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছি। তবে পেশেন্ট মেন্টালি শক পেয়েছে। আপনারা গিয়ে দেখতে পারেন । „
ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই ভিতরে ঢুকলো। সুচি বেডে শুয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসে দুই গাল ভাসিয়ে দিচ্ছে। সুচির বাবা গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন , “ ঈশ্বর বাঁচিয়ে দিয়েছে তোকে। „
সুচি অশ্রুসিক্ত চোখে একবার আকাশকে দেখলো। আকাশের চোখ লাল হয়ে আছে। দুজনের মধ্যে চোখে চোখে কি কথা হলো সেটা বাকি কেউ বুঝতে চাইলো না।
কিছুক্ষণ পর মহল চুপচাপ হতে এবং বাড়িতে ফোন করে ‘ কিছু হয়নি। সুচি ঠিক আছে। , বলার পর আকাশের বাবা সুমিকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন , “ চল থানায়। „
সুমি এটারই অপেক্ষা করছিল । এখন আকাশের বাবার কথায় সুমি চুপচাপ মুখটা বজ্রের মতো শক্ত করে থানায় চললো। লোকাল থানায় গিয়ে সবকিছু খুলে বলতেই পুলিশ বললো , “ আপনারা ঠিক বলছেন ? বিধায়কের ছোট ছেলেই ছিল ! আপনাদের কাছে কোন প্রমাণ আছে ? „
সুমি দৃঢ় কন্ঠে বললো , “ প্রমাণ নেই। সাক্ষী আছে। আমি নিজে দেখেছি পলাশকে। „
এরপর আর পুলিশ কিছু বললো না। কিছুক্ষণ সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে fir লিখে নিল আর বললো , “ ঠিক আছে । ইন্সপেকশনে একজনকে পাঠিয়ে দেবো। আপনারা যান। „
সুমি আর আকাশের বাবা নার্সিংহোম হয়ে আকাশ আর সুচির বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। সুচিকে কাল সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে।
বাড়ি তো এলেন সবাই কিন্তু কারোর মুখে কোন কথা নেই। সবাই বোবা হয়ে গেছে। আকাশদের লিভিংরুমে পাথর হয়ে বসে আছে সবাই। সুচির আর আকাশের মা থেকে থেকেই আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। আকাশের বাবা মাঝে একবার বললেন , “ আমি ওকে ছেড়ে দেবো না সমু । „
তবুও একমাত্র প্রজ্ঞা ছাড়া বড়ো কারোর মুখে কথা নেই। প্রজ্ঞা মায়ের কোলে বসে মাঝেমাঝে জিজ্ঞাসা করছে , “ কি হয়েছে মা ? „
কিন্তু সুমির মুখে কোন জবাব নেই। প্রাণহীন মুখ সবার। গালে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের দাগ স্পষ্ট।
এইসব ভাগাভাগি দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে কারোর সময়ের হুশ ছিল না। ঠিক রাত দশটা বাজতেই আকাশের বাবার ফোন নাম্বারে একটা ফোন এলো। অচেনা নাম্বার দেখে অবাক হয়ে ফোনটা ধরে প্রাণহীন কন্ঠে ‘ হ্যালো , বলতেই অপর প্রান্ত থেকে এক মখমলের মতো গলায় একটা আওয়াজ ভেসে এলো , “ আপনি কি মি. মিত্র বলছেন ? „
আকাশের বাবা --- হ্যাঁ বলছি। আপনি কে ? চিনিলাম না তো
ফোনের ভিতরের মানুষ --- ওই যার বিরুদ্ধে , কিছুক্ষণ আগে fir করলেন না আপনি ! তার বাবা বলছি ।
আকাশের বাবা ভাবলেন , ‘ এই লোকটা তার নাম্বার কোথা থেকে পেল ! নিশ্চয়ই থানা থেকে। ওখানে নিজের নাম্বার দিয়ে এসছেন তো। , এটা ভেবেই তিনি ফোনটা স্পিকারে দিয়ে দিলেন আর বললেন , “ পঙ্কজ সহায়। „
পঙ্কজ সহায় --- “ হ্যাঁ আমার নামই পঙ্কজ । পরিচয় পর্ব তো হলো। এবার কাজের কথায় আসি। আপনি যে fir টা করেছেন ওটা ফিরিয়ে নিন । „
আকাশের বাবা রেগে গিয়ে বললেন , “ কি বলছেন আপনি ! আপনার ছেলে আমার মেয়ের এতো বড়ো একটা ক্ষতি করলো ....
আকাশের বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিধায়ক বললো , “ আমার ছোট ছেলে এখনও বাচ্চা রয়ে গেল। সিনেমা দেখে ওইসব শিখেছে। . ....
এবার বিধায়কের কথার মাঝে আকাশের বাবা বলে উঠলেন , “ আপনার ছোট ছেলে আর যাই হোক বাচ্চা নয় ! „
পঙ্কজ সহায় ---“ বাচ্চা তো আপনিও নন মি. মিত্র। আপনার মেয়ের শুধু হাত পুড়েছে। মুখটা এখনও আগের মতোই আছে। আপনি কি চান ! ওটাও পুড়ুক ! „
আকাশের বাবা --- “ আপনি মানুষ নন। আপনি পশু। আমি আপনাদের কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না। „
পঙ্কজ সহায় --- ওসব প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলার থাকলে এই বিধানসভার পরে খেলবেন। শুনুন কান খুলে। এবারের বিধানসভায় আমি CM candidate হয়ে দাড়াচ্ছি। যদি আপনার বা আপনার মেয়ের জন্য আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় তাহলে সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো। এখন যা বলছি শুনুন। বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটা খুলুন আর সে যে কাগজ গুলো দিচ্ছে তাতে সই করুন । আর আমার ছেলে আপনাদের কখনো ডিস্টার্ব করবে না। „ বলেই ফোনটা কেটে গেল।
ফোনটা হাতে নিয়ে রাগে ফুসতে লাগলেন আকাশের বাবা। ফোন স্পিকারে দেওয়ায় ঘরের সবাই বিধায়ক আর তার কথা শুনছিল। এতক্ষণ সবার চোখের জল শুকিয়ে গেছিল। এখন আবার বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। আচলে মুখ চাপা দিয়ে সুচির মা আর আকাশের মা কাঁদতে শুরু করলেন। সব শুনে সুচির বাবা ধপ করে সোফায় বসে বললেন , “ এই পশুটাকে আমরাই ভোট দিয়েছিলাম। „
সুমি ভাবলো , “ এই লোকটাই উচ্চমাধ্যমিকে তাকে স্কুটি গিফ্ট দিয়েছিল। সেই স্কুটি দুই বোন মিলে চালাতাম । „
ঠিক তখনই এদের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ডোরবেল বেজে উঠলো। আকাশের বাবা বজ্র কঠিন মুখ করে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন । দেখলেন একজন ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের ছেলে হাতে কিছু কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের বাবার দরজা খোলার পর সে বললো , “ স্যার এতে আপনাদের তিনজনের সই দিতে বলেছেন। „ বলে হাতে ধরা কাগজটা এগিয়ে দিল ।
আকাশের বাবা কাগজটা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে গেলেন। কিন্তু কি একটা ভেবে সেই চিন্তা বাদ দিলেন । কাগজ গুলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতেই সুচির বাবা আর বাকি সবাই এসে পড়লো। সব পড়ে আকাশের বাবা নিচে সই করে দিলেন।
বাবার সই করা দেখে আকাশ পাথর হয়ে গেল। বাবা কি ভয় পেয়েছে ! এতো ভিতু বাবা। এ কি করলো বাবা !
আকাশের বাবা সই করার পর সুচির বাবার দিকে এগিয়ে দিলেন। সুচির বাবা কিছুক্ষণ হা করে শুভোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তিনিও সই করলেন আর কাগজটা একমাত্র সাক্ষী সুমির দিকে এগিয়ে দিলেন। সুমি বাবার দিকে তাকাতেই তার বাবা একটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন । বাবার ইশারা দেখে সুমিও সই করে দিল।
তিনজনের সই করার পর ছেলেটা চলে গেল । রাতে প্রজ্ঞা বাদে কেউ খেলো না। সবাই না খেয়েই ঘুমালো। বলাবাহুল্য ঘুম কারোর চোখে এলো না। আকাশ বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলো তার বাবা এতোটা কাপুরুষ ! মেরুদণ্ডহীন ভিতু। একজনের ভয় দেখানোতে ভয় পেয়ে সই করে দিল।
ওদিকে নার্সিংহোমে সুচির ও ঘুম এলো না। শেষ রাতের দিকে একবার চোখ জুড়িয়ে এসছিল। সেই সময়েই দেখলো দুঃস্বপ্নটা।
সুচি দেখলো পলাশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে এসে বোতলের সব তরল পদার্থ তার মুখে ছুঁড়ে মারলো। মুখ পুড়ে যাচ্ছে তার। অসহ্য জ্বালায় সে ছটফট করছে .... একটা চিৎকার করে সুচির ঘুম ভাঙতে সে উঠে বসলো। দেখলো নার্সিংহোমে শুয়ে আছে। মুখের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। আর শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত চলছে।
সুচির চিৎকারে একজন নার্স ছুটে এলো। এসেই পাশের টেবিলে রাখা জল খেতে দিল। জল খাইয়ে নার্স নিজে সুচিকে জড়িয়ে ধরে বললো , “ এরকমই হয় বোন। মেয়েদের সাথে আজীবন এরকমই হয়ে আসছে। তোমার তো তাও কিছুই হয় নি। এরকম আরো পেশেন্ট দেখেছি। তাদের মুখের কোনটা নাক , কোনটা ঠোঁট বোঝা যায় না। ঈশ্বর তোমায় বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তুমি ঘুমাও। আমি এখানেই আছি। „
নার্সের কথায় সুচি ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। এক অজানা ভয়ে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো।
সকাল হতেই আকাশ চুপিচুপি নার্সিংহোমে চলে এলো। গার্ড বললো , “ এখনও ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়নি আপনি ঢুকতে পারবেন না। „
গার্ডের বাঁধা দেওয়ায় আকাশ ওয়েটিং রুমেই বসে রইলো। কাল রাতে সুচির ফোন নিয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছিল । না হলে রাতে কথা বলতো । ‘ না জানি কিভাবে আছে মেয়েটা। , এখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। দশটা বাজলেই আকাশ সুচির ওয়ার্ডে ঢুকে পড়লো। সেখানে পর্দা দিয়ে ঘেরা আরো তিন জন পেশেন্ট আছে।
আকাশ ঘরে ঢুকতেই সুচি কেঁদে ফেললো । সুচির পাশে বসতেই সুচি তাকে জড়িয়ে ধরলো , “ কোথায় ছিলি তুই ! রাতে ঘুমাসনি ! „
“ তুইও তো ঘুমাসনি । „ বলতেই সুচি আকাশকে ছেড়ে বসলো। আশেপাশের সবাই দেখতে শুরু করেছে যে।
সুচির ডান হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমু খেয়ে আকাশ কাল রাতের সব ঘটনা বলতে শুরু করলো। বিশেষ করে বাবার কাপুরুষতার কথাটা। কিভাবে নিজে সই করে জেঠু আর সুমিদিকে সই করাতে বাধ্য করলো সেই কথাটা। এতোটা বলতেই আকাশের বাবা এসে ঢুকলেন।
তিনি সকালে উঠে স্ত্রীর মুখে শুনলেন যে ছেলে ঘরে নেই। আকাশের মাকে শান্ত করার জন্য বললেন , “ নিশ্চয়ই নার্সিংহোমে গেছে। তুমি টেনশন করো না। আমি আনছি সবাইকে। „ বলে এখানে চলে আসলেন।
ঘরে ঢুকেই তিনি সুচিকে বললেন , “ তোকে তো এবার ছেড়ে দেবে। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন , “ গিয়ে পেপারওয়ার্ক গুলো কর। আমার সুচির সাথে কথা আছে। „
আকাশ আর বাবার সাথে কথা বলতে চায় না। ইচ্ছা নেই তার এই মেরুদণ্ডহীন মানুষটার সাথে কথা বলতে। তাই সে উঠে রিসেপশনে চলে গেল।
এদিকে কিছুক্ষণ সুচির সাথে কথা বলতেই সুচি আকাশের বাবাকে জড়িয়ে ধরলো , “ সব আমার দোষের জন্য হয়েছে কাকা। সব আমার জন্য । „
আকাশের বাবা বললেন , “ নিজেকে দোষ দিস না সুচি। তুই কোন দোষ করিস নি। „
আকাশের পেপারওয়ার্ক আর পেমেন্ট করা হয়ে গেলে আকাশের বাবা সুচি আর আকাশকে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন।
এরপর দিন যায় , কালের নিয়মে সুচির হাতের ক্ষত সেরে উঠতে লাগলো কিন্তু মনের ক্ষত মিটলো না। আগের থেকে অনেক বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে সে। একা চুপচাপ বসে থাকে। অফিস যায় না। আকাশও অনিয়মিত অফিস যায়। সবসময় সুচির পাশে থাকার চেষ্টা করে সে।
এদিকে আকাশ বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। শুভাশীষ বাবু বুঝতে পারলেন কেন তার ছেলে তার সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে।
সুমি , সুমির মা আর আকাশের মা মাঝেমাঝেই চোখের জল ফেলেন । কৌশিক শিলিগুড়ি থেকে এসে সব শুনে পাথর হয়ে গেলো। আর সুচির বাবা চুপচাপ বসে থাকেন। আর সেদিনের কেনা জামা কাপড় যেমন দোকান থেকে এসছিল তেমনি ঘরের এক কোনায় পড়ে রইলো।