06-01-2022, 07:15 PM
রাখী বন্ধন
উনুনে মাংসটা কষাতে কষাতে চম্পা চেঁচালো,
--ভাই... এই ভাই করছিস কি সেই সকাল থেকে? খাবি না? আয়...
--হ্যাঁ দিদি আসছি রে আর একটু...
চম্পা আজ মাংস রাঁধছে ভাইয়ের জন্য। ভাইটা মাংস খেতে বড্ডো ভালোবাসে। চার পাঁচ বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে পেটে ডাল-ভাত জোটানোই মুশকিল। মাংস কিনবে কোত্থেকে। আজ জমানো টাকা থেকে একটু কিনতে হলো। আজ যে রাখী।
দু কামরার ভাঙা টালির ঘর চম্পার। বৃষ্টি এলেই ঘরে জল ঢোকে, বিছানা ভিজে যায়। হাতে কিছু টাকার খুব দরকার। চিন্তায় ঘুম আসেনা রাতে।
ভাইটা ছোট, ইকলেজে পড়ে। চম্পারই বা কতো বয়স ! কেলাস ফোর এ পড়ে তখন মা মারা গেলো। ভাইয়ের জন্মের কয় মাস আগেই বাপটা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে পালালো। ভাই জন্মানোর পরেই মা বিছানা নিলো। সেই থেকে চম্পা ঝিয়ের কাজ করে সংসারের হাল ধরেছে।তারপর বছরখানেক বেঁচে ছিলো মা, ভাইকে দেখাশোনা করতো। মা মরতে চম্পাই ভাইকে সামলাতো, কখনো কোলে চাপিয়ে কাজে নিয়ে যেত, কখনো পাশের বাড়ির পিসির কাছে রেখে যেত। পিসি বলেছিলো ভাইকে কাজে পাঠাতে। অনেকেই নাকি বাড়ির বাচ্চাকে ধার দেয়। ওরা নাকি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেবে বাচ্চাকে, তারপর কোলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে নয়তো রাস্তার ধারে ফেলে রেখে ভিক্ষে চাইবে। সারাদিন শেষে বাচ্চাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবে। দৈনিক পঞ্চাশ টাকাও দেবে বলেছিলো। তবে চম্পা রাজি হয়নি। ওর স্বপ্ন ভাইকে পড়ালেখা শিখিয়ে বড়ো মানুষ করবে।
ভাইটা প্রতি বছর ক্লাসে পাশ দেয়। চম্পা ঠাকুরের থানে মানত করে, "ভাইটাকে দেখো ঠাকুর, যেন ভালো মানুষ বানাতে পারি। " তবে ইদানিং পাড়ায় লোকের মুখে শুনেছে ভাইকে নাকি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। কোনো বদ সঙ্গে পড়লো কিনা চম্পা ভয় পায়। তবে ও খুঁটিয়ে দেখেছে ভাইটা একটুও বদলায় নি। দিদি বাড়িতে এলেই ক্ষেপিয়ে তোলে ছড়া শুনিয়ে, " চম্পা চম্পা, বেনুনীটা লম্বা "। দিদি লাঠি হাতে তেড়ে এলেই দৌড়ে পালায়।
চম্পা কাজের বাড়িগুলো থেকে ছুটি নিয়েছে আজ। ভাইয়ের জন্য পুজো দিয়ে এসেছে মন্দিরে। ফেরার পথে অল্প মাংস নিয়ে এসেছে। ভাইটা কি যে ভীষণ খুশি হবে...
কিন্তু ভাই সেই সকাল থেকে দরজা দিয়ে কি করছে কে জানে ! চম্পা আবার ডাকে,
--কিরে ভাই? কি করছিস? বেরো বলছি নয়তো...
দরজাটা জোরে ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। চম্পা ঘরে ঢুকেই আঁতকে ওঠে !
--এতো রক্ত !! কি করে? হাত কেটেছিস কেন? এসব কি?
রাগে, ভয়ে, দুঃখে চড় বসালো ভাই-এর গালে। ছি ছি কি করছিস তুই এসব? এইজন্যই পাড়ার লোক তাহলে...
--বকিস না দিদি, আমি তোর জন্যই...
বেশ ক'ঘা পিটিয়ে তারপর ভাইয়ের হাতে গাঁদা ফুলের পাতা ডলে কাপড় বেঁধে দিলো চম্পা। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
--এবার বল কি করছিলিস তুই?কোনোদিন আমি বাড়িতে থাকি না টের পাইনা... বল...
ভাই কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে গেলো পড়ার টেবিলের কাছে। তারপর দিদির হাতটা টেনে পরিয়ে দিলো রাখী।
--এটা দিদি তোর জন্য, আমি বানিয়েছি। এটা বানাতেই তাড়াহুড়োতে বেলেড দিয়ে...
চম্পা অবাক!
--এতো সুন্দর রাখী তুই...কি করে !!
--হ্যা দিদি। আমাদের ইকলেজে আমাদের কর্মশিক্ষার কেলাসে মাস্টারমশাই শেখালো। আমি দু মাস ধরে জমানো টিফিনের টাকা দিয়ে পুঁতি, ফিতে, জরি এই সব কিনে অনেক রাখী বানিয়েছি। ইকলেজের বন্ধুরা আমার থেকে কিনলো। কেষ্ট কাকার দোকানে অনেকগুলো দিয়ে এসেছি বিক্রি করতে। কাকা পাঁচশো টাকা দিয়েছে দেখ। ইকলেজ থেকে আরও দুশো টাকা উঠেছে। সব টাকা তোর দিদি, এই নে...
চোখে জল আসতেই চম্পা গর্বে বুকে টেনে নিলো ভাইকে। ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে এসে পড়েছে রাখীর জড়ির ওপর। চম্পা দেখলো সমস্ত ঘরটা যেন আলোতে ঝলমল করছে।
সোমাশ্রী পাল চন্দ
উনুনে মাংসটা কষাতে কষাতে চম্পা চেঁচালো,
--ভাই... এই ভাই করছিস কি সেই সকাল থেকে? খাবি না? আয়...
--হ্যাঁ দিদি আসছি রে আর একটু...
চম্পা আজ মাংস রাঁধছে ভাইয়ের জন্য। ভাইটা মাংস খেতে বড্ডো ভালোবাসে। চার পাঁচ বাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে পেটে ডাল-ভাত জোটানোই মুশকিল। মাংস কিনবে কোত্থেকে। আজ জমানো টাকা থেকে একটু কিনতে হলো। আজ যে রাখী।
দু কামরার ভাঙা টালির ঘর চম্পার। বৃষ্টি এলেই ঘরে জল ঢোকে, বিছানা ভিজে যায়। হাতে কিছু টাকার খুব দরকার। চিন্তায় ঘুম আসেনা রাতে।
ভাইটা ছোট, ইকলেজে পড়ে। চম্পারই বা কতো বয়স ! কেলাস ফোর এ পড়ে তখন মা মারা গেলো। ভাইয়ের জন্মের কয় মাস আগেই বাপটা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে পালালো। ভাই জন্মানোর পরেই মা বিছানা নিলো। সেই থেকে চম্পা ঝিয়ের কাজ করে সংসারের হাল ধরেছে।তারপর বছরখানেক বেঁচে ছিলো মা, ভাইকে দেখাশোনা করতো। মা মরতে চম্পাই ভাইকে সামলাতো, কখনো কোলে চাপিয়ে কাজে নিয়ে যেত, কখনো পাশের বাড়ির পিসির কাছে রেখে যেত। পিসি বলেছিলো ভাইকে কাজে পাঠাতে। অনেকেই নাকি বাড়ির বাচ্চাকে ধার দেয়। ওরা নাকি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেবে বাচ্চাকে, তারপর কোলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে নয়তো রাস্তার ধারে ফেলে রেখে ভিক্ষে চাইবে। সারাদিন শেষে বাচ্চাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবে। দৈনিক পঞ্চাশ টাকাও দেবে বলেছিলো। তবে চম্পা রাজি হয়নি। ওর স্বপ্ন ভাইকে পড়ালেখা শিখিয়ে বড়ো মানুষ করবে।
ভাইটা প্রতি বছর ক্লাসে পাশ দেয়। চম্পা ঠাকুরের থানে মানত করে, "ভাইটাকে দেখো ঠাকুর, যেন ভালো মানুষ বানাতে পারি। " তবে ইদানিং পাড়ায় লোকের মুখে শুনেছে ভাইকে নাকি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। কোনো বদ সঙ্গে পড়লো কিনা চম্পা ভয় পায়। তবে ও খুঁটিয়ে দেখেছে ভাইটা একটুও বদলায় নি। দিদি বাড়িতে এলেই ক্ষেপিয়ে তোলে ছড়া শুনিয়ে, " চম্পা চম্পা, বেনুনীটা লম্বা "। দিদি লাঠি হাতে তেড়ে এলেই দৌড়ে পালায়।
চম্পা কাজের বাড়িগুলো থেকে ছুটি নিয়েছে আজ। ভাইয়ের জন্য পুজো দিয়ে এসেছে মন্দিরে। ফেরার পথে অল্প মাংস নিয়ে এসেছে। ভাইটা কি যে ভীষণ খুশি হবে...
কিন্তু ভাই সেই সকাল থেকে দরজা দিয়ে কি করছে কে জানে ! চম্পা আবার ডাকে,
--কিরে ভাই? কি করছিস? বেরো বলছি নয়তো...
দরজাটা জোরে ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। চম্পা ঘরে ঢুকেই আঁতকে ওঠে !
--এতো রক্ত !! কি করে? হাত কেটেছিস কেন? এসব কি?
রাগে, ভয়ে, দুঃখে চড় বসালো ভাই-এর গালে। ছি ছি কি করছিস তুই এসব? এইজন্যই পাড়ার লোক তাহলে...
--বকিস না দিদি, আমি তোর জন্যই...
বেশ ক'ঘা পিটিয়ে তারপর ভাইয়ের হাতে গাঁদা ফুলের পাতা ডলে কাপড় বেঁধে দিলো চম্পা। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
--এবার বল কি করছিলিস তুই?কোনোদিন আমি বাড়িতে থাকি না টের পাইনা... বল...
ভাই কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে গেলো পড়ার টেবিলের কাছে। তারপর দিদির হাতটা টেনে পরিয়ে দিলো রাখী।
--এটা দিদি তোর জন্য, আমি বানিয়েছি। এটা বানাতেই তাড়াহুড়োতে বেলেড দিয়ে...
চম্পা অবাক!
--এতো সুন্দর রাখী তুই...কি করে !!
--হ্যা দিদি। আমাদের ইকলেজে আমাদের কর্মশিক্ষার কেলাসে মাস্টারমশাই শেখালো। আমি দু মাস ধরে জমানো টিফিনের টাকা দিয়ে পুঁতি, ফিতে, জরি এই সব কিনে অনেক রাখী বানিয়েছি। ইকলেজের বন্ধুরা আমার থেকে কিনলো। কেষ্ট কাকার দোকানে অনেকগুলো দিয়ে এসেছি বিক্রি করতে। কাকা পাঁচশো টাকা দিয়েছে দেখ। ইকলেজ থেকে আরও দুশো টাকা উঠেছে। সব টাকা তোর দিদি, এই নে...
চোখে জল আসতেই চম্পা গর্বে বুকে টেনে নিলো ভাইকে। ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে এসে পড়েছে রাখীর জড়ির ওপর। চম্পা দেখলো সমস্ত ঘরটা যেন আলোতে ঝলমল করছে।
সোমাশ্রী পাল চন্দ