04-01-2022, 07:42 AM
উন্মুক্তমনা
ঝুম্পা মন্ডল
জয়দীপকে ঘরের মধ্যে আসতে দেখেই সবাই যেন একটু নড়ে চড়ে বসলো, ভুরু কুঁচকে গেলো সবাইয়ের, গত রাতের শ্মশান থেকে পরে আসা একবস্ত্রর ধুতি আজ জয়দীপের পরনে নেই, একি কথা!!
দশা..ঘাট আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের জন্য কি আয়োজন হবে! কোথায় কোন খাতে কত টাকা পয়সা খরচা করবে জয় ! কত জনকে নিমন্ত্রণ করা হবে..কাউকে বাদ দিলে চলবেনা , একটা ছেলে.. এটুকু দায়িত্বতো নিতেই হবে নইলে মান থাকেনা..,
এইসব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত আজ সকালে জমায়েত হওয়া পুরোহিত আর বাড়ির বড়োদের সামনে আমার স্বামী জয়দীপ একটা চিঠি নিয়ে সামনের টেবিলে সযত্নে রাখলো ,
বললো.. " অনেক দিন আগে লেখা চিঠিটা, মনে ছিলোনা আমার.. সকালে হঠাৎ মনে পড়লো..মা বলেছিলো..এতে মায়ের শেষ ইচ্ছে লেখা আছে "
আমি বুঝলাম সকালে মায়ের আলমারি থেকে এই চিঠিটা বের করেই বসে থাকতে দেখেছি জয়কে একটু আগেই,
উপস্থিত আত্মীয় স্বজন.. আমার জ্যাঠা শ্বশুর.. শাশুড়িরা সবাই ঝুঁকে পড়লো চিঠিটার উপরে,
আমার বড়োজ্যাঠাশ্বশুর চিঠিটা হাতে তুলে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে পাশের জনের কাছে হস্তান্তরিত করে গম্ভীর মুখে বলে ওঠেন.. "হয়ে গেলো.. তাহলে আর কি.. ল্যাঠা চুকে গেলো "
সবাই এক ঝলক চিঠিটা দেখার পরে..মেজো জেঠি শাশুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বললো.. "বুঝলাম..এখানেও তিনি নিজে যে অত্যাধুনিক সেটাই প্রমান করবার চেষ্টা করেছেন .."
সঙ্গে সঙ্গে বাকি যে দুই চার জন বাড়ির লোক ছিল প্রত্যেকে সায় দিলো.. এ আমার শাশুড়ির ভীষণ বাড়াবাড়ি, অনাচার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়,
মেজো জ্যাঠাশ্বশুর জয়কে বললেন.. "তাহলে বাবা আর আমাদের কাজ কি এখানে থেকে.. তুমিই যা ভালো বোঝো কোরো.. কি পুরোহিত মশাই ঠিক কিনা!"
পুরোহিতের কাছেও ব্যাপারটা নতুন, তিনিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নাড়লেন,
জয়ের বাড়ি আমাদের পাশের পাড়ায়..একটু বুঝতে শেখা থেকেই আমার শাশুড়ির নামে নানারকম মন্দ কথা শুনে এসেছি আমি ,
আমার বাবা মা তাই খুব একটা রাজি ছিলোনা ওই বাড়িতে আমাকে বিয়ে দিতে, নেহাত জয় এর সাথে আমার সম্পর্ক আজ বহু দিনের..জয় ছেলেটা ভীষণ ভালো বলে বাবা ফেলতে পারেনি , তাই নিমরাজি হয়ে বিয়েটা হয়েছে ,
আমি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম বিয়ের পরে কিভাবে ওনাকে মানিয়ে নেবো..!! আমি বোধহয় পারবোনা, উনি বিয়ের আগে আলাপ করার জন্য ছেলেকে অনেক বার ওদের বাড়ি আমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন , জয়েরও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমি যায়নি, ওনার প্রতি প্রথম থেকে মনের মধ্যে কেমন একটা বিরক্তি ছিল, যেটা জয়ের সামনেও লুকানো থাকতোনা, ওকে ঠারে ঠরে বোঝাতাম আমি কিন্তু বিয়ের পরে ওনার সাথে একবাড়িতে কিছুতেই থাকবোনা,
আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারলেই জয়ের মুখটা ব্যথায় কেমন কুঁকড়ে যেত তখন.., চুপ করে থাকতো সে, মনে মনে ভাবতাম অমন মা কে জয় শ্রদ্ধা করে কিভাবে!!
বিয়ের পরে এবাড়িতে এসে দেখেছি একা হাতে সবাইকে বকা ঝকা ভালোবেসে কী নিপুন পারদর্শীতায় একা সমস্ত আয়োজন নিখুঁতভাবে করছেন, শাশুড়ির সাথে প্রথম পরিচয়ে ওনার মধ্যে হাসিখুশি অথচ মুখের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েই দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম ,
হলুদ ছাড়ানোর পরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অবাক আমি..উনি সকালে আমাকে ডেকে দোতালায় আলাদা রান্নাঘরের চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন.. "শাশুড়ি বৌমার খিটির মিটির আমার পছন্দ নয়.. আজ থেকে তোরা আলাদা.. দোতালায় থাকবি..ভালো মন্দ রান্না করলে ইচ্ছে হলে দিবি.. নইলে দিবিনা, আমি নিচের তলায় আমি আমার মত দুটো ফুটিয়ে নিয়ে বুটিকের ব্যবসা নিয়ে থাকবো ..এতে সম্পর্ক ভালো থাকবে.."
আমি মনে মনে খুশি হলেও এতো তাড়াতাড়ি এমন ডিসিশান শুনে চাবি হাতে নিয়ে যারপরনাই অবাক হলাম আমি !!
এ দেখি মেঘ না চাইতেই জল.. কিন্তু আমি ভেবেছিলাম.. আমাকেই বুঝি জয়ের মাথা খেতে হবে আলাদা হবার জন্য.. কিন্তু একমাত্র ছেলেকে মায়ের থেকে আলাদা করা এতো তো সহজ নয়.. তবে এই ব্যাপারটা ভারী অভিনব..,
উল্টো দিকেই জয়ের জ্যাঠাদের মহল, নিচের তলায় ভাগাভাগি হলেও.. সবাইয়ের সুবিধার জন্য..উপরের তলার সিঁড়ি ভাগাভাগি হয়নি..,
দুপুরবেলা ঠিক যে সময় শাশুড়ি নিচের তলায় তার বুটিকের দোকানে ব্যাস্ত .., সেই সময় জেঠি শাশুড়ি আর খুড় শাশুড়ি চুপিচুপি দোতালার সিঁড়ি দিয়ে আমার কাছে এসে শাশুড়ির এই নতুন নিয়ম নিয়ে যা নয় তাই বললো.. ছেলে বৌ বুঝি চোখের বিষ..আসতে না আসতেই আলাদা!! একসাথে খেলে কী এমন অসুবিধা হত!! নাকি চাকরি ওয়ালা বৌকে রেঁধে খাওয়াতে হবে বলে ওনার চটজলদি এমন সিদ্ধান্ত!!
আমারও তখন সকালের আনন্দ ভুলে ওনাদের কথায় খুব অপমানিত লাগছিলো, গুম মেরে ছিলাম কিছুদিন, কিন্তু মাসখানেক পরে বড়ো জেঠিশাশুড়ির সাথে তার বৌমার সংসারের নানা বিষয় নিয়ে নিত্য চিল চিৎকার শুনে ভাবলাম.. আমার শাশুড়ি যেটা করেছেন ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হলেও.. ভুল উনি কিছু করেননি, আমাদের বাইরে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখে রাত করে ফেরা.. কোনোকিছুতেই উনি নাক গলাননা .. একা একার মত থাকেন,
তারপরে যতদিন গেছে ওনার পাশে থেকে বুঝেছি মানুষটা খারাপ নন, ওনার পাশে থেকে ওনার কাছে গল্প শুনে সমস্ত কাজের পিছনে ওনার নিজস্ব যুক্তি দেখে অবাক হয়েছি...,আর সেই সঙ্গে ওনার প্রতি এতদিনের অবজ্ঞা থেকে শ্রদ্ধায় মন ভরে গেছে আমার.. উনিই হেসে হেসে গল্প করেছেন আমায়.., আমার শাশুড়ি নাকি বরাবর ওনাদের বাড়ির অযথা রীতি রেওয়াজ মানতেননা, কেন মানবেন ভুলভাল রীতিনীতি!
বিশ্বাসের সম্পর্ক ভালোবাসতেন বলেই ঘোমটার বালাই ছিলোনা তার কোনোকালে ..,
অবেলায় স্নান করে ভিজে চুল বেঁধে কাজ করতে হত বলে..কোমর ছাপানো চুল বিয়ের পরে কেটে ঘাড় অবধি নামিয়ে ছিল.. তা দেখে প্রথম দিন তার শাশুড়ির অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়, বাকি জায়েদের চোখও কপালে উঠেছিল সাহস দেখে, উনি যদিও কাউকে কোনো কৈফিয়ত দেয়নি, গট গট করে দোতালায় উঠে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওনার স্বামী কৈফিয়ত দেবার স্বরে বলেছিলো.. "ঠান্ডা লাগার ধাত.. ভিজে চুল বেঁধে রেখে কাজ করতে হয়..শুকাতে চায়না বলেই.."এইটুকু বলে তাড়াতাড়ি দোতালায় বৌ এর পিছনে পিছনে চলে এসেছিলো, সাধে কি তাকে স্ত্রৈন বলে আত্মীয় স্বজন ?
আমি মনে মনে ভাবি.. আমার জয় ঠিক অমনটাই হোক,
তাছাড়া উনি নাকি প্রায় শ্বশুর..ভাসুরদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন যুক্তি দিয়ে, বাড়ির সবাই পিছনে তাকে 'দেমাকি' বলে ডাকতো, অথচ পরে শুনেছি জায়েরা নাকি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আফসোস করতো .. "ইস এইভাবে যদি আমিও একটু প্রতিবাদটা করতে পারতাম."
আসলে প্রতিবাদ করে সমালোচনার পাত্রী সবাই হতে চায়না যে, সব সহ্য করে 'আমি ভালো' এই তকমার লোভ আমাদের সমাজের নারীদের মধ্যে মজ্জায় মজ্জায় মিশে গেছে দীর্ঘদিন ধরে,
আমার শাশুড়ি আরও সমালোচনার মুখে পড়ে ..যখন জয় বছর দশেক বয়সে তার বাবাকে হারায়.., হঠাৎ স্বামী মারা যাবার পরে ওনাকে প্রথম দিকে একটু বিদ্ধস্ত লাগলেও একদিনের জন্যও কারোর সামনে ওনাকে স্বামীশোকে কাঁদতে দেখেনি কেউ.., আসলে শোক সবাইকে দেখাতে আমার শাশুড়ি পারতেননা.., ফলে বাড়ি এসে দুইতিন দিন পাশে থেকে "আহা উহু" করার সুযোগও কেউ পায়নি কখনো,
এটা আত্মীয় স্বজনের পক্ষে মেনে নেওয়াটা সত্যিই কঠিন..কোথায় সবার দয়ার পাত্রী হয়ে মাথা নিচু করে থাকবে তা নয় , ভেবেছিলো এবারে হয়ত তেজ মরবে ছোট বৌ এর, কিন্তু না..বরং উল্টো হয়েছিল,
স্বামী মারা যাবার পরে ভাসুরেরা যখন ছেলে আর মা কে সম্পত্তি থেকে বাদ দেওয়ার তালে ছিল তখনি তিনি বুঝিয়ে ছিলেন তিনি সহজে দমবার পাত্রী নন, এতো বড়ো সাহস ভাসুরদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আর জিতেওছেন তিনি,
কোর্টে তার তেজ দেখে অবাক হয় ওনার বাড়ির সবাই, কি করে পারলো একজন বাড়ির বৌ হয়ে!.. কে এসব পরামর্শ দিচ্ছে? কেনই বা দিচ্ছে? অতএব একলা মেয়ে মানেই.. তার চরিত্র হনন ভীষণ সহজ.. এক্ষেত্রেও তাই,
ওনার এইসব কাজের পিছনে কোনো না কোনো পুরুষ মানুষের সাহায্যর হাত থাকে..এ আবার উনি সবার সামনে স্বীকারও করেন..এই নির্লজ্জতাটা সহজে কেউ মেনে নিতে পারত না,
ওনার নির্ভেজাল স্বীকারোক্তিতে আরও নোংরা রঙ মাখিয়ে প্রচার করে আত্মতুষ্টি পেত সবাই, এমনি এমনি কেউ সাহায্য করে নাকি আজকাল!!..এই যুক্তিতে অভ্যস্ত টিকে থাকা সমাজ চোরা কথা আর ফুসফাসেই বিশ্বস্ত,
একে বিধবা তায় সুন্দরী..তারউপরে নিজেই বাড়ির নিচের তলায় শাড়ির ব্যবসা খুলেছেন .., একজন মহিলার পক্ষে একি এতোই কি সহজ..! পিছনে কোনো রহস্য না থাকলে!
আসলে পাড়ার মেয়ে বৌরাই ওনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে.., তো পুরুষ মানুষের মাথা খেতে কতক্ষন!!
আমি নিজেও শাশুড়িকে দেখি..সাজতে ভালোবাসেন উনি, এই বয়সেও যথেষ্ট আকর্ষণীয়া, সুন্দরী না হয়েও এক আভিজত্য ঝকমক করে ওনার চোখে মুখে, সাধারণ শাড়িও ওনার পরার ধরণে অসাধারণ হয়ে ওঠে .. সেই সঙ্গে ম্যাচ করা মস্ত বড়ো এক টিপ ওনার কপাল জুড়ে ,
কথা বার্তা ওনার স্টাইল এই অঞ্চলে ছেলে বুড়ো মহিলামহলে ভীষণ আলোচনার বিষয়, একবার আলোচনা সভায় উঠলেই হয়.. "ওই যে বোসেদের বাড়ির বেধবা ছোট বৌ টা, গতকাল সন্ধ্যা আটটার সময় একটা বড়ো গাড়ি এলো বাড়ির সামনে .. পাক্কা একঘন্টা ছিল..হহেহে "..
"তাপ্পর তাপ্পর..!!"সঙ্গে সঙ্গে সবাই মুখিয়ে থাকে নতুন রসাস্বদনের জন্য,
বিয়ের পর মাত্র তিন বছর আমরা পাশাপাশি থেকেছি, দেখেছি কত লোক ওনার কাছে আনাগোনা করে, আমি মিথ্যে বলবোনা, প্রথম প্রথম সন্দেহের বসে আড়ি পেতেছি আমিও .. কিন্তু মানুষের প্রতি একে ওপরের বিশ্বাস ছাড়া কোনো আদিম রহস্য আমার চোখে পড়েনি.., আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া তো ওত সহজ নয়,
বিয়ের মাস খানেক পরে..সেদিন ভীষণ ঝড়বৃষ্টির রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে কোনো বাস অটো পাইনি, জয়ও চেষ্টা করেছিল যেভাবেই হোক আমাকে অফিস থেকে নিয়ে যেতে, কিন্তু রাস্তায় কারেন্টের তার যত্র তত্র ছিঁড়ে থাকায় আর তার উপরে রাস্তায় জল জমায় আমি ভয় পেয়ে ওকে বারণ করি..ও অনেক চেষ্টা করেও আসতে পারছিলোনা , এদিকে রাত বাড়তে থাকায় অসহায় আমি আর ওদিকে জয় আর শাশুড়ির ছটফটানি.. শেষে অফিসের কাছে কলেজ লাইফের এক বন্ধু অম্লানের কথা মনে পড়তেই তাকে ফোন করলাম, অম্লান অম্লানবদনে রাজি হয়ে যেতেই জয়কে বলে তাদের বাড়িতে সেই রাতটুকু ছিলাম আমি.. বলাইবাহুল্য..অম্লান অবিবাহিত, মাকে নিয়ে থাকতো ফ্ল্যাটে.., কিন্তু ওর মা সেদিন আত্মীয়র বাড়িতে ছিল বলে ওর ফ্ল্যাটে থাকতে আমার ভিতরে একটু সংকোচ বোধ হলেও জয়ের গলায় স্বস্তির সুরে বুঝেছিলাম ও কি ভীষণ ভাবে বিশ্বাস করে আমায়.. আমাদের বন্ধুত্বকে ,
ভোর বেলাতে কোনোরকমে বাড়ি ফিরি আমি, বাড়িতে আমার শাশুড়ি আর জয় ছাড়া সবার মুখে রহস্যর হাসি ছিল, কারণ ততক্ষনে ওরা জেনে গেছে বাড়ির বৌ রাত্রে বাইরে কাটিয়ে এসেছে.., ওরা আমাকে সরাসরি কিছু বলতে পারেনি ঠিকই , কিন্তু ঠারে ঠরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো বেশ,
বড়ো জ্যাঠাশাশুড়ির নাতি টুবাই এর জন্মদিনে মেজো জেঠিশাশুড়ি আর থাকতে পারলোনা..পাশের জনকে বলছিলো.. "যেমন শাশুড়ি তেমন বৌমা ..এদের বর গুলোও কেমন ভেড়া হয় দ্যাখো ..বৌ বাইরে রাত কাটিয়ে এসেও বিন্দাস সংসার করে কি সুন্দর,"
আমি লজ্জায় সংকোচে চুপ করে গেলেও আমার শাশুড়ির কানে যে কথাটা গেছে সেটা বুঝতে পারিনি প্রথমে, উনি দেখি আমার পাশ থেকে উঠে মেজো জেঠিশাশুড়ির কাছে গিয়ে হেসে কিন্তু বেশ জোরেই বললেন .. "রাত কাটালেই চরিত্র খারাপ হয় আর দিন কাটালে হয়না বুঝি..সব চরিত্র নষ্টর কাজ রাতে হয় কে বলেছে তোমাকে মেজদি..নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল দাও, শুনেছি বাইকে করে দিনের বেলাতেই অনেক ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি করে "
সমস্ত হলঘর পিনড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গিয়েছিলো.., সেদিন বুঝেছিলাম জয় কেন এতো উন্মুক্তমনের ..,
সেই থেকে আমার শাশুড়ির সাথে আমার হৃদয়ের সখ্যতা শুরু , ওনার সাথে থেকে বুঝেছি সমাজের কোনো কাজে কোনো মহিলা যদি এগিয়ে থাকে তাহলে সে বুঝি সবার কাছে আগে খারাপ হয়ে যায়,
তখন ভেবেছি.. একলা একজন মেয়ে বিভিন্ন কাজে কোনো পুরুষের সাহায্য নিতেই পারে..তার সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক হতেই পারে..কিন্তু আমাদের সমাজ..সমস্ত সম্পর্ককে তুচ্ছ করে শুধুমাত্র পুরুষ নারীর আদিম সম্পর্কর মধ্যেই আটকে থেকে তাদেরকে দূর থেকে দেখে চুল চেরা বিচার করতে বসে ..,
এই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বরাবর সমালোচনার শীর্ষে থাকা শাশুড়িকে.. কাছ থেকে দেখে আমার না ভালোবেসে উপায় ছিলোনা কিছুতেই,
যত দিন গেছে জয় আমার আর শাশুড়ির সম্পর্কের পরিবর্তনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, কিন্তু এ সুখ আমার বেশিদিন সইলোনা,
গতকাল ভোরে আমাকে আর জয়কে একেবারে নিঃসঙ্গ করে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন তিনি..,
আজ সকালে আবারও তার মৃত্যুর পরে তিনি সমালোচনার শীর্ষে রইলেন..
ওনারা রেগে বেরিয়ে যাবার পরে পুরোহিতের সাথে আলোচনা করে তিনি চলে যাবার পরে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে জয় চুপচাপ বসে ছিল সজল চোখে, আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখা চিঠিটা হাতে নিলাম ..কী এমন লেখা আছে এতে!!
চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল ওনার শেষ ইচ্ছেটুকু ..
মৃত্যুর পরে যেন ঘাট..শ্রাদ্ধ শান্তিতে লোক খাওয়ানো না হয় , তাছাড়া ছেলের নেড়া হওয়া, চুল না আঁচড়ে.. তেল না মেখে.. মালসার সেদ্ধ ভাত খেয়ে..একবস্ত্র পরে.. এইসব লোকদেখানো দুঃখের আয়োজন যেন না করা হয় , শুধু যতটা সম্ভব কম খরচে পূজা শ্রাদ্ধ শান্তি যেটুকু প্রয়োজন.. সেটুকুই করা হয় যেন ..ওনার মতে লোকদেখানো আচারব্যবস্থার থেকে ছেলের দুইফোঁটা চোখের জলের তর্পনে উনি অনেক বেশি শান্তি পাবেন মৃত্যুর পরে ,
চিঠিটা পড়ে জয়ের পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললাম আমিও ।
©ঝুম্পা মন্ডল
ঝুম্পা মন্ডল
জয়দীপকে ঘরের মধ্যে আসতে দেখেই সবাই যেন একটু নড়ে চড়ে বসলো, ভুরু কুঁচকে গেলো সবাইয়ের, গত রাতের শ্মশান থেকে পরে আসা একবস্ত্রর ধুতি আজ জয়দীপের পরনে নেই, একি কথা!!
দশা..ঘাট আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের জন্য কি আয়োজন হবে! কোথায় কোন খাতে কত টাকা পয়সা খরচা করবে জয় ! কত জনকে নিমন্ত্রণ করা হবে..কাউকে বাদ দিলে চলবেনা , একটা ছেলে.. এটুকু দায়িত্বতো নিতেই হবে নইলে মান থাকেনা..,
এইসব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত আজ সকালে জমায়েত হওয়া পুরোহিত আর বাড়ির বড়োদের সামনে আমার স্বামী জয়দীপ একটা চিঠি নিয়ে সামনের টেবিলে সযত্নে রাখলো ,
বললো.. " অনেক দিন আগে লেখা চিঠিটা, মনে ছিলোনা আমার.. সকালে হঠাৎ মনে পড়লো..মা বলেছিলো..এতে মায়ের শেষ ইচ্ছে লেখা আছে "
আমি বুঝলাম সকালে মায়ের আলমারি থেকে এই চিঠিটা বের করেই বসে থাকতে দেখেছি জয়কে একটু আগেই,
উপস্থিত আত্মীয় স্বজন.. আমার জ্যাঠা শ্বশুর.. শাশুড়িরা সবাই ঝুঁকে পড়লো চিঠিটার উপরে,
আমার বড়োজ্যাঠাশ্বশুর চিঠিটা হাতে তুলে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে পাশের জনের কাছে হস্তান্তরিত করে গম্ভীর মুখে বলে ওঠেন.. "হয়ে গেলো.. তাহলে আর কি.. ল্যাঠা চুকে গেলো "
সবাই এক ঝলক চিঠিটা দেখার পরে..মেজো জেঠি শাশুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বললো.. "বুঝলাম..এখানেও তিনি নিজে যে অত্যাধুনিক সেটাই প্রমান করবার চেষ্টা করেছেন .."
সঙ্গে সঙ্গে বাকি যে দুই চার জন বাড়ির লোক ছিল প্রত্যেকে সায় দিলো.. এ আমার শাশুড়ির ভীষণ বাড়াবাড়ি, অনাচার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়,
মেজো জ্যাঠাশ্বশুর জয়কে বললেন.. "তাহলে বাবা আর আমাদের কাজ কি এখানে থেকে.. তুমিই যা ভালো বোঝো কোরো.. কি পুরোহিত মশাই ঠিক কিনা!"
পুরোহিতের কাছেও ব্যাপারটা নতুন, তিনিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নাড়লেন,
জয়ের বাড়ি আমাদের পাশের পাড়ায়..একটু বুঝতে শেখা থেকেই আমার শাশুড়ির নামে নানারকম মন্দ কথা শুনে এসেছি আমি ,
আমার বাবা মা তাই খুব একটা রাজি ছিলোনা ওই বাড়িতে আমাকে বিয়ে দিতে, নেহাত জয় এর সাথে আমার সম্পর্ক আজ বহু দিনের..জয় ছেলেটা ভীষণ ভালো বলে বাবা ফেলতে পারেনি , তাই নিমরাজি হয়ে বিয়েটা হয়েছে ,
আমি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম বিয়ের পরে কিভাবে ওনাকে মানিয়ে নেবো..!! আমি বোধহয় পারবোনা, উনি বিয়ের আগে আলাপ করার জন্য ছেলেকে অনেক বার ওদের বাড়ি আমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন , জয়েরও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমি যায়নি, ওনার প্রতি প্রথম থেকে মনের মধ্যে কেমন একটা বিরক্তি ছিল, যেটা জয়ের সামনেও লুকানো থাকতোনা, ওকে ঠারে ঠরে বোঝাতাম আমি কিন্তু বিয়ের পরে ওনার সাথে একবাড়িতে কিছুতেই থাকবোনা,
আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারলেই জয়ের মুখটা ব্যথায় কেমন কুঁকড়ে যেত তখন.., চুপ করে থাকতো সে, মনে মনে ভাবতাম অমন মা কে জয় শ্রদ্ধা করে কিভাবে!!
বিয়ের পরে এবাড়িতে এসে দেখেছি একা হাতে সবাইকে বকা ঝকা ভালোবেসে কী নিপুন পারদর্শীতায় একা সমস্ত আয়োজন নিখুঁতভাবে করছেন, শাশুড়ির সাথে প্রথম পরিচয়ে ওনার মধ্যে হাসিখুশি অথচ মুখের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েই দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম ,
হলুদ ছাড়ানোর পরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অবাক আমি..উনি সকালে আমাকে ডেকে দোতালায় আলাদা রান্নাঘরের চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন.. "শাশুড়ি বৌমার খিটির মিটির আমার পছন্দ নয়.. আজ থেকে তোরা আলাদা.. দোতালায় থাকবি..ভালো মন্দ রান্না করলে ইচ্ছে হলে দিবি.. নইলে দিবিনা, আমি নিচের তলায় আমি আমার মত দুটো ফুটিয়ে নিয়ে বুটিকের ব্যবসা নিয়ে থাকবো ..এতে সম্পর্ক ভালো থাকবে.."
আমি মনে মনে খুশি হলেও এতো তাড়াতাড়ি এমন ডিসিশান শুনে চাবি হাতে নিয়ে যারপরনাই অবাক হলাম আমি !!
এ দেখি মেঘ না চাইতেই জল.. কিন্তু আমি ভেবেছিলাম.. আমাকেই বুঝি জয়ের মাথা খেতে হবে আলাদা হবার জন্য.. কিন্তু একমাত্র ছেলেকে মায়ের থেকে আলাদা করা এতো তো সহজ নয়.. তবে এই ব্যাপারটা ভারী অভিনব..,
উল্টো দিকেই জয়ের জ্যাঠাদের মহল, নিচের তলায় ভাগাভাগি হলেও.. সবাইয়ের সুবিধার জন্য..উপরের তলার সিঁড়ি ভাগাভাগি হয়নি..,
দুপুরবেলা ঠিক যে সময় শাশুড়ি নিচের তলায় তার বুটিকের দোকানে ব্যাস্ত .., সেই সময় জেঠি শাশুড়ি আর খুড় শাশুড়ি চুপিচুপি দোতালার সিঁড়ি দিয়ে আমার কাছে এসে শাশুড়ির এই নতুন নিয়ম নিয়ে যা নয় তাই বললো.. ছেলে বৌ বুঝি চোখের বিষ..আসতে না আসতেই আলাদা!! একসাথে খেলে কী এমন অসুবিধা হত!! নাকি চাকরি ওয়ালা বৌকে রেঁধে খাওয়াতে হবে বলে ওনার চটজলদি এমন সিদ্ধান্ত!!
আমারও তখন সকালের আনন্দ ভুলে ওনাদের কথায় খুব অপমানিত লাগছিলো, গুম মেরে ছিলাম কিছুদিন, কিন্তু মাসখানেক পরে বড়ো জেঠিশাশুড়ির সাথে তার বৌমার সংসারের নানা বিষয় নিয়ে নিত্য চিল চিৎকার শুনে ভাবলাম.. আমার শাশুড়ি যেটা করেছেন ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হলেও.. ভুল উনি কিছু করেননি, আমাদের বাইরে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখে রাত করে ফেরা.. কোনোকিছুতেই উনি নাক গলাননা .. একা একার মত থাকেন,
তারপরে যতদিন গেছে ওনার পাশে থেকে বুঝেছি মানুষটা খারাপ নন, ওনার পাশে থেকে ওনার কাছে গল্প শুনে সমস্ত কাজের পিছনে ওনার নিজস্ব যুক্তি দেখে অবাক হয়েছি...,আর সেই সঙ্গে ওনার প্রতি এতদিনের অবজ্ঞা থেকে শ্রদ্ধায় মন ভরে গেছে আমার.. উনিই হেসে হেসে গল্প করেছেন আমায়.., আমার শাশুড়ি নাকি বরাবর ওনাদের বাড়ির অযথা রীতি রেওয়াজ মানতেননা, কেন মানবেন ভুলভাল রীতিনীতি!
বিশ্বাসের সম্পর্ক ভালোবাসতেন বলেই ঘোমটার বালাই ছিলোনা তার কোনোকালে ..,
অবেলায় স্নান করে ভিজে চুল বেঁধে কাজ করতে হত বলে..কোমর ছাপানো চুল বিয়ের পরে কেটে ঘাড় অবধি নামিয়ে ছিল.. তা দেখে প্রথম দিন তার শাশুড়ির অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়, বাকি জায়েদের চোখও কপালে উঠেছিল সাহস দেখে, উনি যদিও কাউকে কোনো কৈফিয়ত দেয়নি, গট গট করে দোতালায় উঠে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওনার স্বামী কৈফিয়ত দেবার স্বরে বলেছিলো.. "ঠান্ডা লাগার ধাত.. ভিজে চুল বেঁধে রেখে কাজ করতে হয়..শুকাতে চায়না বলেই.."এইটুকু বলে তাড়াতাড়ি দোতালায় বৌ এর পিছনে পিছনে চলে এসেছিলো, সাধে কি তাকে স্ত্রৈন বলে আত্মীয় স্বজন ?
আমি মনে মনে ভাবি.. আমার জয় ঠিক অমনটাই হোক,
তাছাড়া উনি নাকি প্রায় শ্বশুর..ভাসুরদের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন যুক্তি দিয়ে, বাড়ির সবাই পিছনে তাকে 'দেমাকি' বলে ডাকতো, অথচ পরে শুনেছি জায়েরা নাকি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আফসোস করতো .. "ইস এইভাবে যদি আমিও একটু প্রতিবাদটা করতে পারতাম."
আসলে প্রতিবাদ করে সমালোচনার পাত্রী সবাই হতে চায়না যে, সব সহ্য করে 'আমি ভালো' এই তকমার লোভ আমাদের সমাজের নারীদের মধ্যে মজ্জায় মজ্জায় মিশে গেছে দীর্ঘদিন ধরে,
আমার শাশুড়ি আরও সমালোচনার মুখে পড়ে ..যখন জয় বছর দশেক বয়সে তার বাবাকে হারায়.., হঠাৎ স্বামী মারা যাবার পরে ওনাকে প্রথম দিকে একটু বিদ্ধস্ত লাগলেও একদিনের জন্যও কারোর সামনে ওনাকে স্বামীশোকে কাঁদতে দেখেনি কেউ.., আসলে শোক সবাইকে দেখাতে আমার শাশুড়ি পারতেননা.., ফলে বাড়ি এসে দুইতিন দিন পাশে থেকে "আহা উহু" করার সুযোগও কেউ পায়নি কখনো,
এটা আত্মীয় স্বজনের পক্ষে মেনে নেওয়াটা সত্যিই কঠিন..কোথায় সবার দয়ার পাত্রী হয়ে মাথা নিচু করে থাকবে তা নয় , ভেবেছিলো এবারে হয়ত তেজ মরবে ছোট বৌ এর, কিন্তু না..বরং উল্টো হয়েছিল,
স্বামী মারা যাবার পরে ভাসুরেরা যখন ছেলে আর মা কে সম্পত্তি থেকে বাদ দেওয়ার তালে ছিল তখনি তিনি বুঝিয়ে ছিলেন তিনি সহজে দমবার পাত্রী নন, এতো বড়ো সাহস ভাসুরদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আর জিতেওছেন তিনি,
কোর্টে তার তেজ দেখে অবাক হয় ওনার বাড়ির সবাই, কি করে পারলো একজন বাড়ির বৌ হয়ে!.. কে এসব পরামর্শ দিচ্ছে? কেনই বা দিচ্ছে? অতএব একলা মেয়ে মানেই.. তার চরিত্র হনন ভীষণ সহজ.. এক্ষেত্রেও তাই,
ওনার এইসব কাজের পিছনে কোনো না কোনো পুরুষ মানুষের সাহায্যর হাত থাকে..এ আবার উনি সবার সামনে স্বীকারও করেন..এই নির্লজ্জতাটা সহজে কেউ মেনে নিতে পারত না,
ওনার নির্ভেজাল স্বীকারোক্তিতে আরও নোংরা রঙ মাখিয়ে প্রচার করে আত্মতুষ্টি পেত সবাই, এমনি এমনি কেউ সাহায্য করে নাকি আজকাল!!..এই যুক্তিতে অভ্যস্ত টিকে থাকা সমাজ চোরা কথা আর ফুসফাসেই বিশ্বস্ত,
একে বিধবা তায় সুন্দরী..তারউপরে নিজেই বাড়ির নিচের তলায় শাড়ির ব্যবসা খুলেছেন .., একজন মহিলার পক্ষে একি এতোই কি সহজ..! পিছনে কোনো রহস্য না থাকলে!
আসলে পাড়ার মেয়ে বৌরাই ওনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে.., তো পুরুষ মানুষের মাথা খেতে কতক্ষন!!
আমি নিজেও শাশুড়িকে দেখি..সাজতে ভালোবাসেন উনি, এই বয়সেও যথেষ্ট আকর্ষণীয়া, সুন্দরী না হয়েও এক আভিজত্য ঝকমক করে ওনার চোখে মুখে, সাধারণ শাড়িও ওনার পরার ধরণে অসাধারণ হয়ে ওঠে .. সেই সঙ্গে ম্যাচ করা মস্ত বড়ো এক টিপ ওনার কপাল জুড়ে ,
কথা বার্তা ওনার স্টাইল এই অঞ্চলে ছেলে বুড়ো মহিলামহলে ভীষণ আলোচনার বিষয়, একবার আলোচনা সভায় উঠলেই হয়.. "ওই যে বোসেদের বাড়ির বেধবা ছোট বৌ টা, গতকাল সন্ধ্যা আটটার সময় একটা বড়ো গাড়ি এলো বাড়ির সামনে .. পাক্কা একঘন্টা ছিল..হহেহে "..
"তাপ্পর তাপ্পর..!!"সঙ্গে সঙ্গে সবাই মুখিয়ে থাকে নতুন রসাস্বদনের জন্য,
বিয়ের পর মাত্র তিন বছর আমরা পাশাপাশি থেকেছি, দেখেছি কত লোক ওনার কাছে আনাগোনা করে, আমি মিথ্যে বলবোনা, প্রথম প্রথম সন্দেহের বসে আড়ি পেতেছি আমিও .. কিন্তু মানুষের প্রতি একে ওপরের বিশ্বাস ছাড়া কোনো আদিম রহস্য আমার চোখে পড়েনি.., আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া তো ওত সহজ নয়,
বিয়ের মাস খানেক পরে..সেদিন ভীষণ ঝড়বৃষ্টির রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে কোনো বাস অটো পাইনি, জয়ও চেষ্টা করেছিল যেভাবেই হোক আমাকে অফিস থেকে নিয়ে যেতে, কিন্তু রাস্তায় কারেন্টের তার যত্র তত্র ছিঁড়ে থাকায় আর তার উপরে রাস্তায় জল জমায় আমি ভয় পেয়ে ওকে বারণ করি..ও অনেক চেষ্টা করেও আসতে পারছিলোনা , এদিকে রাত বাড়তে থাকায় অসহায় আমি আর ওদিকে জয় আর শাশুড়ির ছটফটানি.. শেষে অফিসের কাছে কলেজ লাইফের এক বন্ধু অম্লানের কথা মনে পড়তেই তাকে ফোন করলাম, অম্লান অম্লানবদনে রাজি হয়ে যেতেই জয়কে বলে তাদের বাড়িতে সেই রাতটুকু ছিলাম আমি.. বলাইবাহুল্য..অম্লান অবিবাহিত, মাকে নিয়ে থাকতো ফ্ল্যাটে.., কিন্তু ওর মা সেদিন আত্মীয়র বাড়িতে ছিল বলে ওর ফ্ল্যাটে থাকতে আমার ভিতরে একটু সংকোচ বোধ হলেও জয়ের গলায় স্বস্তির সুরে বুঝেছিলাম ও কি ভীষণ ভাবে বিশ্বাস করে আমায়.. আমাদের বন্ধুত্বকে ,
ভোর বেলাতে কোনোরকমে বাড়ি ফিরি আমি, বাড়িতে আমার শাশুড়ি আর জয় ছাড়া সবার মুখে রহস্যর হাসি ছিল, কারণ ততক্ষনে ওরা জেনে গেছে বাড়ির বৌ রাত্রে বাইরে কাটিয়ে এসেছে.., ওরা আমাকে সরাসরি কিছু বলতে পারেনি ঠিকই , কিন্তু ঠারে ঠরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো বেশ,
বড়ো জ্যাঠাশাশুড়ির নাতি টুবাই এর জন্মদিনে মেজো জেঠিশাশুড়ি আর থাকতে পারলোনা..পাশের জনকে বলছিলো.. "যেমন শাশুড়ি তেমন বৌমা ..এদের বর গুলোও কেমন ভেড়া হয় দ্যাখো ..বৌ বাইরে রাত কাটিয়ে এসেও বিন্দাস সংসার করে কি সুন্দর,"
আমি লজ্জায় সংকোচে চুপ করে গেলেও আমার শাশুড়ির কানে যে কথাটা গেছে সেটা বুঝতে পারিনি প্রথমে, উনি দেখি আমার পাশ থেকে উঠে মেজো জেঠিশাশুড়ির কাছে গিয়ে হেসে কিন্তু বেশ জোরেই বললেন .. "রাত কাটালেই চরিত্র খারাপ হয় আর দিন কাটালে হয়না বুঝি..সব চরিত্র নষ্টর কাজ রাতে হয় কে বলেছে তোমাকে মেজদি..নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল দাও, শুনেছি বাইকে করে দিনের বেলাতেই অনেক ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি করে "
সমস্ত হলঘর পিনড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গিয়েছিলো.., সেদিন বুঝেছিলাম জয় কেন এতো উন্মুক্তমনের ..,
সেই থেকে আমার শাশুড়ির সাথে আমার হৃদয়ের সখ্যতা শুরু , ওনার সাথে থেকে বুঝেছি সমাজের কোনো কাজে কোনো মহিলা যদি এগিয়ে থাকে তাহলে সে বুঝি সবার কাছে আগে খারাপ হয়ে যায়,
তখন ভেবেছি.. একলা একজন মেয়ে বিভিন্ন কাজে কোনো পুরুষের সাহায্য নিতেই পারে..তার সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক হতেই পারে..কিন্তু আমাদের সমাজ..সমস্ত সম্পর্ককে তুচ্ছ করে শুধুমাত্র পুরুষ নারীর আদিম সম্পর্কর মধ্যেই আটকে থেকে তাদেরকে দূর থেকে দেখে চুল চেরা বিচার করতে বসে ..,
এই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বরাবর সমালোচনার শীর্ষে থাকা শাশুড়িকে.. কাছ থেকে দেখে আমার না ভালোবেসে উপায় ছিলোনা কিছুতেই,
যত দিন গেছে জয় আমার আর শাশুড়ির সম্পর্কের পরিবর্তনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, কিন্তু এ সুখ আমার বেশিদিন সইলোনা,
গতকাল ভোরে আমাকে আর জয়কে একেবারে নিঃসঙ্গ করে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন তিনি..,
আজ সকালে আবারও তার মৃত্যুর পরে তিনি সমালোচনার শীর্ষে রইলেন..
ওনারা রেগে বেরিয়ে যাবার পরে পুরোহিতের সাথে আলোচনা করে তিনি চলে যাবার পরে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে জয় চুপচাপ বসে ছিল সজল চোখে, আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখা চিঠিটা হাতে নিলাম ..কী এমন লেখা আছে এতে!!
চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল ওনার শেষ ইচ্ছেটুকু ..
মৃত্যুর পরে যেন ঘাট..শ্রাদ্ধ শান্তিতে লোক খাওয়ানো না হয় , তাছাড়া ছেলের নেড়া হওয়া, চুল না আঁচড়ে.. তেল না মেখে.. মালসার সেদ্ধ ভাত খেয়ে..একবস্ত্র পরে.. এইসব লোকদেখানো দুঃখের আয়োজন যেন না করা হয় , শুধু যতটা সম্ভব কম খরচে পূজা শ্রাদ্ধ শান্তি যেটুকু প্রয়োজন.. সেটুকুই করা হয় যেন ..ওনার মতে লোকদেখানো আচারব্যবস্থার থেকে ছেলের দুইফোঁটা চোখের জলের তর্পনে উনি অনেক বেশি শান্তি পাবেন মৃত্যুর পরে ,
চিঠিটা পড়ে জয়ের পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললাম আমিও ।
©ঝুম্পা মন্ডল