03-01-2022, 09:53 PM
অনেক দিন পর সতুদার সঙ্গে দেখা। ‘নিরিবিলি’ রেস্তরাঁয় একটা টেবিলে বসে খালি প্লেটেই বিলি কাটছিল সে। একা। তবে একই টেবিলে মুখোমুখি আর একটি প্লেটসজ্জা দেখে মনে হল, আরও কেউ আছে বুঝি, সঙ্গী বা সঙ্গিনী। আমাকে দেখে সতুদার মুখে আনন্দ আর বিষাদ যুগপৎ ঝিলিক দিয়ে গেল।
“আরে দীপ্র, বোসো ভায়া...”
“কিন্তু সতুদা, তোমার সামনের আসনে কে? প্লেট কার? তোমার সঙ্গে কেউ আছেন?”
‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও ঢোঁক গিলে সতুদা বলল, “ওটা আমার একটা ধারা বলতে পার, রেস্তরাঁয় এলে মুখোমুখি একজনকে বসিয়ে রাখি মনে মনেই। ওয়েটাররা প্রথমে একটু আপত্তি করে, তবে ‘নিরিবিলি’তে কাউকে বলতে হয় না, আমি বসলে সঙ্গে সঙ্গে আমার উল্টো দিকে আর একটা প্লেট পড়ে। তুমি ভায়া আমার বাঁ দিকের চেয়ারটায় বোসো না হয়।”টে কি বিশেষ কেউ...” কথাটা তোলা ঠিক হল কি না কে জানে! সতুদার লাল মুখটা পাংশু হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজও আমার কান এড়াল না।
ওয়েটার সতুদার পাতে কবিরাজি কাটলেট পরিবেশন করতে এল।
“তুমি কী নেবে ভায়া?”
“স্রেফ একটা গরম কফি। ওটাই নেশা এ দোকানে। রোজই আসি...”
দুটো কফির অর্ডার দিয়ে সতুদা সিগারেট ধরাল। সতুদা আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। অল্প বয়সে খেলাধুলোর জন্য নামডাক ছিল। ক্রিকেটে জোরে বোলার হিসেবে, ফুটবলে দুর্ধর্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে নানা ক্লাবে খেপ খেলে বেড়াত। আমাদেরই কলেজে ক্লাস পাঁচেক ওপরে পড়ত। সতুদার উচ্চতা কলেজ জীবনের পর বাড়েনি। গাঁট্টাগোঁট্টা ভাবটা অল্প বয়সে মুগুরটুগুর ভেঁজেই হয়ে গিয়েছিল। চকচকে ফর্সা, লালচে মুখ, কপালটা একটু বেশিই চওড়া।
“কপাল ভাই, কপাল। কপালে নেইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?” স্বগতোক্তি করল সতুদা, তার পর বলল, “তোমরা সুখে ঘরসংসার করছ। বাবা-মা-বৌ-ছানাপোনা... কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কীসে...!” সতুদা দার্শনিক হয়ে গেল।
“মাসিমা চলে যাওয়ার পর সত্যিই খুব একা হয়ে গেছ জানি,” আমি প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করি।
তবে সতুদাকে আমি পাড়ার ডাকসাইটে সুন্দরী ইভাদির সঙ্গে অনেক বার এ দিক সে দিক দেখেছি। যত দূর জানি, ব্যাপারটা ম্যাচিওর করেনি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মনে বাধছিল। কিন্তু কী কাকতালীয়, সতুদাই বলল, “ইভাকে চেনো তো! এলাকার সকলেই চিনত। অমন সুন্দরী তো রোজ জন্মায় না। কালেভদ্রে। বলতে পারো, এই প্লেট ওকে উৎসর্গ করেই সামনে রাখি।”
কাটলেট চিবোতে চিবোতে বলে চলল সতুদা, “ওর বাপের ওই দুই মেয়ে, ডাকসাইটে সুন্দরী দু’জনেই। সকলের হার্টথ্রব, ইভা আর নিভা। ওই ইভা আমার প্রেমে পড়ে গেল কৈশোরেই। তখন আমি দুর্ধর্ষ বোলিং করি। পরপর অপোনেন্টের স্টাম্প ওড়াচ্ছি আর খেলা দেখে বারান্দায় আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছে ইভা। শীতের দুপুরে আমার কৃতিত্ব ওকেই দু’হাত তুলে সমর্পণ করছি। ইভার তখন বয়স বড়জোর বছর চোদ্দো।”
বললাম, “ইভাদির বাবা বড়বাজারে কী যেন ব্যবসা ছিল। পান খেতেন, পায়জামা-শার্ট আর কালো বুট পরে ঘুরে বেড়াতেন।”
“অতি হারামি চিজ! কিছু মনে কোরো না ভায়া, মুখ খারাপ করে ফেললাম। অন্তরের জ্বালা, বুঝলে না, আমার বুক থেকে ইভাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল মাইরি! মক্ষিচুষ লোকটার মেয়েদের বিয়ে কবে দেবে আর সম্ভাব্য পাত্রদের ধনসম্পত্তির লিস্ট তৈরি— এ ছাড়া কোনও চিন্তা ছিল না। ধারণা ছিল, মেয়েদের সৌন্দর্যের জোরেই রাজপুত্তুররা হামলে পড়বে।”
বুঝতে পারলাম সতুদা ব্যথার কথা আমাকে বলে মনটাকে একটু হাল্কা করতে চাইছে। আমি বাধা দিলাম না, উসকে দিয়ে বললাম, “তুমিও তো পাত্র হিসেবে খারাপ নও, বাবার একমাত্র ছেলে, খেলাধুলোয় ভালে ছিলে, ক্লাবটাব করতে, পাঁচ জন তোমায় চিনত, লেখাপড়াটা কদ্দুর করলে অবশ্য জানা নেই।”
“বি কম পড়তে পড়তে ইভা মাথাটা খেয়ে নিল, ঠিক ইভা নয়, ইভার ওই ইবলিশ বাপটা, ইভার সঙ্গে আমার ইন্টুমিন্টু ওর নলেজে এসে গেছিল। আমার সামনে বলার সাহস ছিল না। মেয়েকে দিয়ে বলাত। আমার রোজগার নিয়ে আমি কী ভাবছি, কবে ঠিকঠাক দাঁড়াব, কবে কোমরের জোরে রাজকন্যে নিয়ে যেতে পারব... এমনি ঘ্যানঘ্যানানি... তার পর ইভা সুন্দরী বলে অনেক ছেলের মা-ই তো ছেলের বৌ করতে চায় তাকে... বেশ চাপে পড়ে গেলাম...”
সতুদা চোখ বন্ধ করে সিগারেটের শেষ ধোঁয়াটা শুষে নিয়ে অ্যাশট্রেতে ঘষে নেবাল।
“বি কমটা শেষ করে আমার মতো সাধারণ মেধার ছেলেদের যা হয় আর কী! ফ্যা ফ্যা বেকার। টো টো কোম্পানি। কখনও কম্পিউটার টাইপ শিখছি, কখনও স্পোকেন ইংলিশ। রোজগারের ঝোঁক ষোলো আনা। খেলাধুলো থেকে অনেকটা ডিটাচড হয়ে গেছি কলেজ ছাড়ার পর। ভাবছি ব্যবসাপাতি করে যদি দুম করে দু’পয়সা বাগানো যায়, তা হলে বাগিয়ে নেব ইভাকেও। বুক চিতিয়ে পুরুর মতো দাঁড়াব ওর বাবার সামনে। এমনই নানা প্ল্যানের ছক যখন মাথায়, অংশু পাত্র বলল, মাছের কারবার করবে। অংশুর মাছের স্টল আছে বাজারে। বলল সে, দিঘা, ডায়মন্ড হারবার এ সব মাছের আড়তে চলে যাবে থোক টাকা নিয়ে, সস্তায় মাছ কিনে কলকাতার বাজারে সাপ্লাই। নগদ লাভ থুতু দিয়ে গুনে নেবে দিনেরটা দিনে।”
“আরে দীপ্র, বোসো ভায়া...”
“কিন্তু সতুদা, তোমার সামনের আসনে কে? প্লেট কার? তোমার সঙ্গে কেউ আছেন?”
‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও ঢোঁক গিলে সতুদা বলল, “ওটা আমার একটা ধারা বলতে পার, রেস্তরাঁয় এলে মুখোমুখি একজনকে বসিয়ে রাখি মনে মনেই। ওয়েটাররা প্রথমে একটু আপত্তি করে, তবে ‘নিরিবিলি’তে কাউকে বলতে হয় না, আমি বসলে সঙ্গে সঙ্গে আমার উল্টো দিকে আর একটা প্লেট পড়ে। তুমি ভায়া আমার বাঁ দিকের চেয়ারটায় বোসো না হয়।”টে কি বিশেষ কেউ...” কথাটা তোলা ঠিক হল কি না কে জানে! সতুদার লাল মুখটা পাংশু হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজও আমার কান এড়াল না।
ওয়েটার সতুদার পাতে কবিরাজি কাটলেট পরিবেশন করতে এল।
“তুমি কী নেবে ভায়া?”
“স্রেফ একটা গরম কফি। ওটাই নেশা এ দোকানে। রোজই আসি...”
দুটো কফির অর্ডার দিয়ে সতুদা সিগারেট ধরাল। সতুদা আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। অল্প বয়সে খেলাধুলোর জন্য নামডাক ছিল। ক্রিকেটে জোরে বোলার হিসেবে, ফুটবলে দুর্ধর্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে নানা ক্লাবে খেপ খেলে বেড়াত। আমাদেরই কলেজে ক্লাস পাঁচেক ওপরে পড়ত। সতুদার উচ্চতা কলেজ জীবনের পর বাড়েনি। গাঁট্টাগোঁট্টা ভাবটা অল্প বয়সে মুগুরটুগুর ভেঁজেই হয়ে গিয়েছিল। চকচকে ফর্সা, লালচে মুখ, কপালটা একটু বেশিই চওড়া।
“কপাল ভাই, কপাল। কপালে নেইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?” স্বগতোক্তি করল সতুদা, তার পর বলল, “তোমরা সুখে ঘরসংসার করছ। বাবা-মা-বৌ-ছানাপোনা... কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কীসে...!” সতুদা দার্শনিক হয়ে গেল।
“মাসিমা চলে যাওয়ার পর সত্যিই খুব একা হয়ে গেছ জানি,” আমি প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করি।
তবে সতুদাকে আমি পাড়ার ডাকসাইটে সুন্দরী ইভাদির সঙ্গে অনেক বার এ দিক সে দিক দেখেছি। যত দূর জানি, ব্যাপারটা ম্যাচিওর করেনি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মনে বাধছিল। কিন্তু কী কাকতালীয়, সতুদাই বলল, “ইভাকে চেনো তো! এলাকার সকলেই চিনত। অমন সুন্দরী তো রোজ জন্মায় না। কালেভদ্রে। বলতে পারো, এই প্লেট ওকে উৎসর্গ করেই সামনে রাখি।”
কাটলেট চিবোতে চিবোতে বলে চলল সতুদা, “ওর বাপের ওই দুই মেয়ে, ডাকসাইটে সুন্দরী দু’জনেই। সকলের হার্টথ্রব, ইভা আর নিভা। ওই ইভা আমার প্রেমে পড়ে গেল কৈশোরেই। তখন আমি দুর্ধর্ষ বোলিং করি। পরপর অপোনেন্টের স্টাম্প ওড়াচ্ছি আর খেলা দেখে বারান্দায় আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছে ইভা। শীতের দুপুরে আমার কৃতিত্ব ওকেই দু’হাত তুলে সমর্পণ করছি। ইভার তখন বয়স বড়জোর বছর চোদ্দো।”
বললাম, “ইভাদির বাবা বড়বাজারে কী যেন ব্যবসা ছিল। পান খেতেন, পায়জামা-শার্ট আর কালো বুট পরে ঘুরে বেড়াতেন।”
“অতি হারামি চিজ! কিছু মনে কোরো না ভায়া, মুখ খারাপ করে ফেললাম। অন্তরের জ্বালা, বুঝলে না, আমার বুক থেকে ইভাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল মাইরি! মক্ষিচুষ লোকটার মেয়েদের বিয়ে কবে দেবে আর সম্ভাব্য পাত্রদের ধনসম্পত্তির লিস্ট তৈরি— এ ছাড়া কোনও চিন্তা ছিল না। ধারণা ছিল, মেয়েদের সৌন্দর্যের জোরেই রাজপুত্তুররা হামলে পড়বে।”
বুঝতে পারলাম সতুদা ব্যথার কথা আমাকে বলে মনটাকে একটু হাল্কা করতে চাইছে। আমি বাধা দিলাম না, উসকে দিয়ে বললাম, “তুমিও তো পাত্র হিসেবে খারাপ নও, বাবার একমাত্র ছেলে, খেলাধুলোয় ভালে ছিলে, ক্লাবটাব করতে, পাঁচ জন তোমায় চিনত, লেখাপড়াটা কদ্দুর করলে অবশ্য জানা নেই।”
“বি কম পড়তে পড়তে ইভা মাথাটা খেয়ে নিল, ঠিক ইভা নয়, ইভার ওই ইবলিশ বাপটা, ইভার সঙ্গে আমার ইন্টুমিন্টু ওর নলেজে এসে গেছিল। আমার সামনে বলার সাহস ছিল না। মেয়েকে দিয়ে বলাত। আমার রোজগার নিয়ে আমি কী ভাবছি, কবে ঠিকঠাক দাঁড়াব, কবে কোমরের জোরে রাজকন্যে নিয়ে যেতে পারব... এমনি ঘ্যানঘ্যানানি... তার পর ইভা সুন্দরী বলে অনেক ছেলের মা-ই তো ছেলের বৌ করতে চায় তাকে... বেশ চাপে পড়ে গেলাম...”
সতুদা চোখ বন্ধ করে সিগারেটের শেষ ধোঁয়াটা শুষে নিয়ে অ্যাশট্রেতে ঘষে নেবাল।
“বি কমটা শেষ করে আমার মতো সাধারণ মেধার ছেলেদের যা হয় আর কী! ফ্যা ফ্যা বেকার। টো টো কোম্পানি। কখনও কম্পিউটার টাইপ শিখছি, কখনও স্পোকেন ইংলিশ। রোজগারের ঝোঁক ষোলো আনা। খেলাধুলো থেকে অনেকটা ডিটাচড হয়ে গেছি কলেজ ছাড়ার পর। ভাবছি ব্যবসাপাতি করে যদি দুম করে দু’পয়সা বাগানো যায়, তা হলে বাগিয়ে নেব ইভাকেও। বুক চিতিয়ে পুরুর মতো দাঁড়াব ওর বাবার সামনে। এমনই নানা প্ল্যানের ছক যখন মাথায়, অংশু পাত্র বলল, মাছের কারবার করবে। অংশুর মাছের স্টল আছে বাজারে। বলল সে, দিঘা, ডায়মন্ড হারবার এ সব মাছের আড়তে চলে যাবে থোক টাকা নিয়ে, সস্তায় মাছ কিনে কলকাতার বাজারে সাপ্লাই। নগদ লাভ থুতু দিয়ে গুনে নেবে দিনেরটা দিনে।”