31-12-2021, 09:35 AM
সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে যাওয়ার পর অফিস আওয়ার শেষ হল । আকাশ একবার পুরো অফিস ঘুরে দেখে নিয়ে নিচে নেমে পার্কিংয়ে সুচির অপেক্ষা করতে লাগলো। বাকি সব এমপ্লয়ি কেউ স্কুটি , কেউ বাইক , কেউ গাড়ি বার করে চলে যেতে লাগলো। সুচি আসার পর আকাশ বাইকের চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিয়ে দিলে সুচি আকাশের পিছনে উঠে পড়লো। নিজেদের কোম্পানির এমপ্লয়ি এমনকি অন্য কোম্পানির এমপ্লয়িরাও দেখতে লাগলো এই দৃশ্য।
রাস্তায় নেমে কিছুদূর যাওয়ার পর আকাশ লক্ষ্য করলো সুচি বাইকের পিছনের হাত রেখে বসে আছে। আকাশ রেগে গিয়ে মনে মনে বললো , ‘ কোথায় একটু জড়িয়ে বসবে , তা না ! উনি বসেছেন কাকিমাদের মতো। , তারপরেই মনে পড়লো সকালে অফিস আসার সময়েও সুচি এইভাবেই এসছিল। ওকে একবারও জড়িয়ে ধরেনি।
এখন কথাটা মনে পড়তেই আকাশ ইচ্ছা করে ব্রেক চাপলো । হঠাৎ ব্রেক মাথায় সুচি আকাশের পিঠের উপর এসে পড়লো। বিরক্ত হয়ে সুচি বললো , “ দেখে চালা। „
আকাশ মিচকি হেসে কয়েক মিটার যাওয়ার পর আবার ব্রেক মারলো। এবার সুচি রেখে গিয়ে বললো , “ কি অসভ্যতামি হচ্ছে এসব ? আমি বুঝতে পারছি তুই ইচ্ছা করে করছিস এসব । „
“ অসভ্যতামি কোথায় ? আমি তোর হবু বর । কোথায় জড়িয়ে ধরে বসবি । তা না ! উনি বসেছেন কাকিমাদের মতো করে । „
“ আমি পারবো না। „
“ তাহলে আমিও ইচ্ছা করে ব্রেক মারবো । „ বলে একবার ব্রেক মারলো ।
আবার আকাশের পিঠের উপর পড়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে সুচি রাগী স্বরে বললো , “ পড়ে যাবো তো । „
“ আমাকে ধরে বসলে পড়বি না তো ! „
“ কাল থেকে আর তোর বাইকে বসবো না। আমার স্কুটি আছে । ওতেই আসবো । „
“ সে আসিস। কিন্তু আজকে আমাকে ধরেই বসতে হবে । না হলে পুরো রাস্তা আমি এইভাবেই ব্রেক মারবো। „ বলে আরও একবার আকাশ ব্রেক মারলো।
“ অসভ্যের ধারী একটা । লজ্জাশরম কিচ্ছু নেই। „
আরও দুই বার ব্রেক চাপার পর একরকম বাধ্য হয়েই সুচি আকাশকে জড়িয়ে ধরলো । লজ্জার কারনে সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আকাশকে জড়িয়ে ধরে বাইকে যেতে মোটেও খারাপ লাগছিল না তার। কিন্তু লজ্জা তো লাগবেই। তাই সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।
চোখ খোলা থাকলে সে দেখতে পেত যে , সোসাইটির বড়ো লোহার গেটের পাশের ফুটপাতে , লেম্পপোস্টের নিচে দাড়িয়ে , এক জোড়া ভুরুর শয়তান , তার দিকেই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগে ফুসতে ফুসতে যে গালে সুচি চড় মেরেছিল সেই গালে একবার হাত বুলিয়ে নিল। আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে লাগলো তার মনে । মনে মনে সেই জোড়া ভুরুর শয়তান বললো , ‘ আমার গালে চড় মেরেছিলি তুই। ,
বিল্ডিংয়ের নিচে এসে আকাশ বাইক থামাতেই সুচি বাইক থেক নেমে উপরে উঠে গেল। আকাশও বাইকে থেকে চাবি খুলে নিয়ে উপরে এসে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখলো সুচি আগে থেকেই তাদের ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আকাশ সুচিকে ওইভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। সে তড়িঘড়ি নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলো সুচি একভাবে সোফার দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ সেখানে তাকিয়ে দেখলো জেঠু আর বাবা সামনাসামনি বসে আছে। আর তাদের মাঝের টেবিলে আছে একটা পুরানো আমলের কাঠের কারুকার্য করা সুন্দর দাবার বোর্ড। তাতে গুটি সাজানো। অর্থাৎ দুজনেই দাবা খেলছে।
এতক্ষণ পর আকাশ বুজতে পারলো কেন বাবা অফিস থেকে এক ঘন্টা আগে চলে এসছিল । আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সুচির মতো মা আর জেঠিমা-ও ওই দুজন দাবাড়ুর দিকেই তাকিয়ে আছে। সুচি আর আকাশকে দেখতে পেয়ে সুচেতা দেবী সুচির উদ্দেশ্যে বললেন , “ আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছিল। আমি বুঝতে পারি নি। হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়ে এখানে এসে সেই যে বসলো , আধ ঘন্টা হয়ে গেছে কেউ কথা বলছে না । আমরা কথা বললে বিরক্ত হচ্ছে। সসসস বলে থামিয়ে দিচ্ছে। „
আরও কিছুক্ষণ থাকার পর সুচেতা দেবী সুচিকে নিয়ে চলে গেলেন। আকাশও হাত মুখ ধুতে চলে গেল।
সুচি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ভাবলো বাবা আর কাকার দাবা খেলা দেখবে । এই সুযোগে দাবা খেলাটাও সে শিখে নিতে পারবে । বাবা যে দাবা খেলতে পারে এটা তো এতদিন জানতোই না সে। তাই সিড়ি দিয়ে উঠে আকাশদের ফ্ল্যাটের ভিতর মাকে দেখে কৌতূহলবশত সে ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকেছিল। তারপর বাবা আর কাকাকে ওইভাবে মগ্ন থাকতে দেখে খুব অবাক হয়েছিল। মুখ থেকে কথা সরছিল না তার।
ফ্রেশ হয়ে , নিজের খাটের উপর শুয়ে , ফোন ঘাটতেই তার দিদিকে ফোন করার ইচ্ছা হলো । দিদিকে ফোন করার পর বাবা কাকার দাবা খেলা দেখা যাবে ভেবে সে দিদিকে ফোন করলো। ফোন করার পর ওইপার থেকেই প্রথম গলার আওয়াজ এলো , “ হ্যাঁ বল । „
সুচি --- কি করছিস ?
সুমি --- আমি এই চা বানাচ্ছি। তোর জামাইবাবু এই এলো। তা হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো । কি ব্যাপার !
সুচি --- মানে
সুমি --- টানা দুদিন ফোন করিস নি। তাই জিজ্ঞাসা করছি ।
সুচি --- ওই সময় হয়নি।
সুমি --- সময় হয়নি নাকি আকাশের সাথে গল্প করছিলি।
সুচি --- ওর সাথে আবার কি গল্প করবো !
সুমি --- ন্যাকামি মারিস না। মা আমাকে সব বলেছে। আমি জানি সব। এমনকি আজকে রাতে পুরোহিত এসে তোদের বিয়ের তারিখ ঠিক করবে , সেটাও আমি জানি।
সুচি --- এতোই যখন জানিস সবকিছু ! তখন এলি না কেন আজ ।
সুমি --- যাওয়ার ইচ্ছা ছিল খুব। কিন্তু সময় পাচ্ছি না। এই রবিবার যাবো সবাই।
সুচির হঠাৎ প্রজ্ঞার কথা মনে পড়তে সে বললো , “ প্রজ্ঞা কোথায় রে ? „
“ এই নে । „ বলে সুমি একবার ‘ প্রজ্ঞা , বলে ডাকলো। সুচি সেটা ফোন কানে রেখেই শুনতে পেল। সুমি বললো , “ প্রজ্ঞা তোর মাসি ফোন করেছে। এই নে কথা বল। „
কিছুক্ষণ পরেই একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের গলা ভেসে এলো , “ মাসি ! তুমি কেমন আছো ? „
সুচি --- আমি ভালোই ! তুই কেমন আছিস ?
প্রজ্ঞা -- আমিও ভালো আছি। আমি কিন্তু লাগ করেছি তোমার উপর । কথা বলবো না তোমার সাথে।
প্রজ্ঞার বয়স তিন হতে যায়। এখনও তোতলায় । তবে খুব কম। প্রজ্ঞার মিষ্টি রাগ দেখে সুচি মজা পেল , “ কেন ! আমি কি করলাম ? „
প্রজ্ঞা --- তুমি এই রবিবার আসো নি কেন ?
সুচি --- আমার কাজ ছিল রে। সামনের রবিবার তো দিদি তোকে এখানে আনছে আমার কাছে। এবার রাগ কমলো তো !
প্রজ্ঞা --- সত্যি !
সুচি --- হ্যাঁ সত্যি। মাকে জিজ্ঞাসা কর না !
আরও প্রায় এক ঘন্টা পর দুজনের খেলা শেষ হলো। জিতলেন সুচির বাবা। চেক মেট বলার পরে তিনি বললেন , “ এখনও বাচ্চাদের মতো ভুল করলি তুই। আমি যখন মন্ত্রীকে স্যাক্রিফাইস করলাম তখনই তোর বোঝা উচিত ছিল। „ বলে হাসতে লাগলেন
আকাশের বাবা অজুহাত দেওয়ার জন্য বললেন , “ এত বছর পর খেলছি। এটা ফ্রি প্রাকটিস ম্যাচ ছিল । এখন আর একটা খেল । দেখবি তখন ! „
“ আমি চললুম খবর দেখতে। „বলে সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। ঠিক তখনই রাধানাথ ঠাকুর এসে ঘরে ঢুকলেন আর সুচির বাবার মুখোমুখি হয়ে গেলেন। পুরোহিত কে দেখে খুশী হয়ে সুচির বাবা বললেন , “ আসুন আসুন। „ বলে ভিতরে নিয়ে এলেন।
আকাশের বাবা পুরোহিতকে দেখেই উঠে দাড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন তার জন্য সোফাটা ছেড়ে দিয়ে বললেন , “ আপনি বসুন । „ তারপর আকাশের মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন , “ স্নেহা চা নিয়ে এসো। „
আকাশের বাবার কথায় পুরোহিত সোফায় বসলে সুচির বাবা বললেন , “ আপনি বসুন আমি সবাইকে ডাকছি। „
আকাশের মা ঘরেই ছিলেন। বেরিয়ে এসে দেখলেন পুরোহিত এসছে। তাই তিনি চা বানাতে চলে গেলেন। সুচির বাবাও তার স্ত্রী আর মেয়েকে ডাকতে চলে গেলেন । সোফায় বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে রাধানাথ ঠাকুর বললেন , “ অনেক দিন পর এখানে এলাম । „
সত্যি বলতে কি আকাশের বাবাও অনেক দিন পর এই লোকটাকে দেখছেন। গায়ের রঙ আগের থেকে ফ্যাকাশে হয়েছে। ধবধবে সাদা চুল। মুখের চামড়া কোঁচকানো । চোখে একটা হাই পাওয়ারের চশমা। পরনে আছে একটা ধুতি আর গায়ে একটা হরে কৃষ্ণ নাম লেখা গেরুয়া চাদর জড়ানো। নয় নয় করেও ষাট সত্তর বছরের বেশি বয়স হয়ে গেল লোকটার।
স্নেহা দেবী চা করে নিয়ে এসে রাখলেন। রাধানাথ ঠাকুর আকাশের মাকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোমার মেয়ের-ই তো বিয়ে ! „
স্নেহা দেবী হেসে বললেন , “ মেয়ের না। ছেলের । আমার ছেলের বিয়ে। „
পুরোহিত অবাক হয়ে বললেন , “ কিন্তু আমাকে তো মেয়ের কুষ্ঠি দেখতে ডাকলো। আমি কি ভুল বাড়ি ঢুকে পড়লাম। „
আকাশের বাবা হেসে বললেন , “ না আপনি ঠিক বাড়িতেই এসছেন । যার কুষ্ঠি দেখতে এসছেন। তার সাথেই আমার ছেলের বিয়ে । „
রাধানাথ ঠাকুর এখনও বুঝতে পারেননি। কিন্তু তিনি বিচক্ষণ লোক। তাই বুঝতে পারলেন যে ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং সব বুঝতেও পারবেন। এইসব ভেবেই তিনি আকাশের মায়ের হাতের বানানো চায়ে চুমুক দিলেন।
সুচির বাবা সুচির মাকে নিয়ে এলেন। হাতে তার সুচির কুষ্ঠি আর একটা পঞ্জিকা আছে। সুচিকে একবার তিনি ডেকেছিলেন । তার উত্তরে সুচি লজ্জা পেয়ে বলেছে , “ তোমরা যাও আমার ভালো লাগছে না। „
সুচির বাবা ঘরে এসে রাধানাথ ঠাকুরের সামনে কুষ্ঠি আর পঞ্জিকা ধরে বললেন , “ এই নিন । „
রাধানাথ ঠাকুর পঞ্জিকা নিয়ে দিন দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোমরা কোন মাসে তারিখ চাইছো ? „
আকাশের মা বললেন , “ দুই তিন মাস পর হলে আমাদের সুবিধা। সবকিছু আয়োজন করতে একটু সুবিধা হবে। „
আর একবার পঞ্জিকা দেখে পুরোহিত বললেন তাহলে মে মাসের নয় থেকে বারো সবকটা দিন ভালো আছে। সেই দিন গুলোর মধ্যে একটা বেছে নাও বলে সুচির কুষ্ঠি তুলে নিলেন আর বললেন , “ পাত্রের কুষ্ঠি কোথায় ? „
আকাশের মা , “ আনছি। „ বলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন । আলমারি খুলে ছেলের কুষ্ঠি বার করে এনে দিলেন। রাধানাথ ঠাকুর দুটো কুষ্ঠি মিলিয়ে বললেন , “ পাত্রীর রাশি সিংহ আর পাত্রের মেষ। সব ঠিক আছে। কিন্তু মেয়ের বয়স বেশি , আর ছেলের কম দেখাচ্ছে তো ! „
আকাশের মা বললেন , “ হ্যাঁ আমার ছেলের বয়স তেইশ। আপনি ওর অন্নপ্রাশনের দিন কুষ্ঠি দেখে বলেছিলেন ওকে তেইশ বছরে বিয়ে দিতে। তাই । „
“ ও .. কি বলেছিলাম তা মনে নেই। তবে এখন কুষ্ঠি দেখেও সেটাই বলছি। এ ছেলের বিয়ে এই তেইশেই দিলে ভালো। সারাজীবন সুখে ঘর করতে পারবে। „ তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন , “ পাত্রীর কুষ্ঠীতে একটা বিপদ দেখতে পাচ্ছি। মোটেও ভালো লাগছে না । „
সুচেতা দেবীর বুক কেঁপে উঠলো , মুখটা নিমেষের মধ্যে রক্তশূন্য হয়ে উঠলো , “ কি বিপদ দাদা ? „
“ পাত্রীর বিয়ের আগে একটা ফাঁড়া আছে । „
“ কিরকম ফাঁড়া ? „
“ একটা ক্ষতি। কিরকম ক্ষতি সেটা বুঝতে পারছি না। সব যদি এইভাবে বোঝা যেত তাহলে তো ... „ বলে চুপ করে গেলেন ।
ঘরের মধ্যে সবারই এখন বুক শুকিয়ে গেছে। সুচেতা দেবী কাঁপা গলায় বললেন , “ কিছু তো বলুন । এর থেকে কিভাবে আমার মেয়েকে বাঁচাবো সেটা বলুন । „
“ আমি বুঝতে পারছি না । ও নিজেই উপায় বার করবে। আর কিছু বলতে পারছি না । „
আরও কিছুক্ষণ থেকে সুচির বাবার কাছ থেকে প্রণামী নিয়ে রাধানাথ ঠাকুর চলে গেলেন। তেইশ বছর আগে তিনি একটা বোম মেরে চলে গেছিলেন। এখন তার থেকেও বড়ো বোম মেরে চলে গেলেন। ঘরে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে , কারোর মুখে আর একটাও কথা নেই। সবাই থম মেরে গেছে। কি বিপদ ? সেটাই সবার মাথায় ঘুরছে। আকাশের বাবা এটাকে অবিশ্বাস করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু বিপদ শব্দটাই বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সুচেতা দেবী সেই যে চুপচাপ হয়ে গেলেন আর কথা বললেন না ।
রাত প্রায় আটটার সময়ে গোধূলি বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ঢুকতেই গোধূলির মা এসে বললো , “ দেখ না কি হয়েছে ! সেই যে অফিস থেকে ফিরলো , তখন থেকেই এরকম আচরণ করছে তোর বাবা । „
ফোনেই বাবার গলা শুনি গোধূলি বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা হয়েছে। এখন মায়ের মুখে বাবার আচরণ শুনে সে গম্ভীর হয়ে গেল , “ দাড়াও , আমি জিজ্ঞাসা করছি। „
তারপর বাবার ঘরে গিয়ে দেখলো তার বাবা এক জায়গায় স্থির নেই। সারাঘর পায়চারি করছে। ওইভাবে পায়চারি করতে দেখে গোধূলি জিজ্ঞাসা করলো , “ কি হয়েছে বাপি ? এরকম করছো কেন ? „
গোধূলি কে দেখেই সঞ্জয় ফেটে পড়লো , “ কি হয়েছে ! আকাশ আর একটা মেয়েকে প্রোপজ করেছে। আর তুই জিজ্ঞাসা করছিস কি হয়েছে ! „
গোধূলি বাবার কথা শুনে বুঝতে পারলো যে আকাশ নিশ্চয়ই সুচিত্রা কে প্রোপজ করেছে। তাই সে বললো , “ হ্যাঁ প্রোপজ করেছে। তাতে অসুবিধা কোথায় ? „
সঞ্জয়ের মাথা ঠিক নেই। চোখ লাল হয়ে উঠেছে , “ অসুবিধা ! আমার এতদিনের অপেক্ষা , এতদিনের প্ল্যান সব জলে ডুবে গেল আর তুই ....
বাবার কথার কোন মানেই গোধূলি বুঝতে পারলো না। তাই তার ভুরু কুঁচকে গেল , “ কিসের অপেক্ষা ? কিসের প্ল্যান ? বাপি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ! „
“ তোর সাথে আকাশের বিয়ের প্ল্যান। এটার জন্যেই তো আমি এত বছর অপেক্ষা করেছি ...
গোধূলি অবাক হয়ে বললো , “ বাপি তুমি , আমার আর আকাশের বিয়ের জন্যে এতদিন অপেক্ষা করেছিলে ! „
“ তুই তো ওকে গোলাপ দিয়েছিলি। ও সেটা নিয়ে thank you ও বলেছিল। তাহলে হঠাৎ ও সুচিত্রা কে কেন প্রোপজ করলো ? তুই জানিস কিছু ? „
“ হ্যাঁ ও সুচিত্রাকে ভালোবাসে। তাই প্রোপজ করেছে। আকাশ আমাকে বলেছিল ও সুচিত্রা কে ভালোবাসে। „
সঞ্জয় প্রায় পাগল হয়ে গেল , “ না , না , না , আমার স্বপ্ন ! আমার এতদিনের সবকিছু এইভাবে তছনছ হতে পারে না ! „
গোধূলি বাবার কথায় আরও অবাক হলো , “ কি বলছো কি তুমি বাপি ? কি তছনছ হয়েছে ? কোন স্বপ্নের কথা বলছো ? „
নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সে। বদ্ধ উন্মাদের মত সব সত্যি বলে দিল সঞ্জয় , “ আমি চেয়েছিলাম তোর সাথে আকাশের বিয়ে হবে। তারপর ওই সম্পত্তি সব শুধু আমি ভোগ করবো। শুধু আমি । „
বাবা যে পাগল হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে এবং বাবার কথার মানে বুঝতে পেরে গোধূলি কেঁদে ফেললো। দুই গালে চোখের জলের রেখা দেখা দিল । কাঁদতে কাঁদতে সে বললো “ তুমি আমাকে একটা পন্য হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছো বাপি ! আমি শুধু তোমার কাছে সম্পত্তি পাওয়ার চাবিকাঠি ছিলাম এতদিন ! তুমি আমাকে ভালোবাসোনি কখনো। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার সুখের জন্য আমাকে আকাশের সাথে সম্পর্কে যেতে বলছো। এখন দেখছি সেটাও তোমার এক জঘন্য প্ল্যান ছিল। i hate you বাপি। i hate you... বলে দৌড়ে উপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দিল। বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভেজাতে লাগলো।
এদিকে সঞ্জয় মেয়ের কথায় এতক্ষণ পর নিজের হুশ ফিরে এলো। গোধূলির বলা কথা গুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগলো। “ পণ্য , হ্যাঁ , পণ্য হিসাবেই তো ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম নিজের মেয়েকে । „ বিড়বিড় করে কথা গুলো বলে , ঘরের মধ্যে রাখা সোফার উপর ধপ করে বসে পড়লো ।
রাস্তায় নেমে কিছুদূর যাওয়ার পর আকাশ লক্ষ্য করলো সুচি বাইকের পিছনের হাত রেখে বসে আছে। আকাশ রেগে গিয়ে মনে মনে বললো , ‘ কোথায় একটু জড়িয়ে বসবে , তা না ! উনি বসেছেন কাকিমাদের মতো। , তারপরেই মনে পড়লো সকালে অফিস আসার সময়েও সুচি এইভাবেই এসছিল। ওকে একবারও জড়িয়ে ধরেনি।
এখন কথাটা মনে পড়তেই আকাশ ইচ্ছা করে ব্রেক চাপলো । হঠাৎ ব্রেক মাথায় সুচি আকাশের পিঠের উপর এসে পড়লো। বিরক্ত হয়ে সুচি বললো , “ দেখে চালা। „
আকাশ মিচকি হেসে কয়েক মিটার যাওয়ার পর আবার ব্রেক মারলো। এবার সুচি রেখে গিয়ে বললো , “ কি অসভ্যতামি হচ্ছে এসব ? আমি বুঝতে পারছি তুই ইচ্ছা করে করছিস এসব । „
“ অসভ্যতামি কোথায় ? আমি তোর হবু বর । কোথায় জড়িয়ে ধরে বসবি । তা না ! উনি বসেছেন কাকিমাদের মতো করে । „
“ আমি পারবো না। „
“ তাহলে আমিও ইচ্ছা করে ব্রেক মারবো । „ বলে একবার ব্রেক মারলো ।
আবার আকাশের পিঠের উপর পড়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে সুচি রাগী স্বরে বললো , “ পড়ে যাবো তো । „
“ আমাকে ধরে বসলে পড়বি না তো ! „
“ কাল থেকে আর তোর বাইকে বসবো না। আমার স্কুটি আছে । ওতেই আসবো । „
“ সে আসিস। কিন্তু আজকে আমাকে ধরেই বসতে হবে । না হলে পুরো রাস্তা আমি এইভাবেই ব্রেক মারবো। „ বলে আরও একবার আকাশ ব্রেক মারলো।
“ অসভ্যের ধারী একটা । লজ্জাশরম কিচ্ছু নেই। „
আরও দুই বার ব্রেক চাপার পর একরকম বাধ্য হয়েই সুচি আকাশকে জড়িয়ে ধরলো । লজ্জার কারনে সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আকাশকে জড়িয়ে ধরে বাইকে যেতে মোটেও খারাপ লাগছিল না তার। কিন্তু লজ্জা তো লাগবেই। তাই সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।
চোখ খোলা থাকলে সে দেখতে পেত যে , সোসাইটির বড়ো লোহার গেটের পাশের ফুটপাতে , লেম্পপোস্টের নিচে দাড়িয়ে , এক জোড়া ভুরুর শয়তান , তার দিকেই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগে ফুসতে ফুসতে যে গালে সুচি চড় মেরেছিল সেই গালে একবার হাত বুলিয়ে নিল। আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে লাগলো তার মনে । মনে মনে সেই জোড়া ভুরুর শয়তান বললো , ‘ আমার গালে চড় মেরেছিলি তুই। ,
বিল্ডিংয়ের নিচে এসে আকাশ বাইক থামাতেই সুচি বাইক থেক নেমে উপরে উঠে গেল। আকাশও বাইকে থেকে চাবি খুলে নিয়ে উপরে এসে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখলো সুচি আগে থেকেই তাদের ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আকাশ সুচিকে ওইভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। সে তড়িঘড়ি নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলো সুচি একভাবে সোফার দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ সেখানে তাকিয়ে দেখলো জেঠু আর বাবা সামনাসামনি বসে আছে। আর তাদের মাঝের টেবিলে আছে একটা পুরানো আমলের কাঠের কারুকার্য করা সুন্দর দাবার বোর্ড। তাতে গুটি সাজানো। অর্থাৎ দুজনেই দাবা খেলছে।
এতক্ষণ পর আকাশ বুজতে পারলো কেন বাবা অফিস থেকে এক ঘন্টা আগে চলে এসছিল । আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সুচির মতো মা আর জেঠিমা-ও ওই দুজন দাবাড়ুর দিকেই তাকিয়ে আছে। সুচি আর আকাশকে দেখতে পেয়ে সুচেতা দেবী সুচির উদ্দেশ্যে বললেন , “ আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছিল। আমি বুঝতে পারি নি। হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়ে এখানে এসে সেই যে বসলো , আধ ঘন্টা হয়ে গেছে কেউ কথা বলছে না । আমরা কথা বললে বিরক্ত হচ্ছে। সসসস বলে থামিয়ে দিচ্ছে। „
আরও কিছুক্ষণ থাকার পর সুচেতা দেবী সুচিকে নিয়ে চলে গেলেন। আকাশও হাত মুখ ধুতে চলে গেল।
সুচি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ভাবলো বাবা আর কাকার দাবা খেলা দেখবে । এই সুযোগে দাবা খেলাটাও সে শিখে নিতে পারবে । বাবা যে দাবা খেলতে পারে এটা তো এতদিন জানতোই না সে। তাই সিড়ি দিয়ে উঠে আকাশদের ফ্ল্যাটের ভিতর মাকে দেখে কৌতূহলবশত সে ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকেছিল। তারপর বাবা আর কাকাকে ওইভাবে মগ্ন থাকতে দেখে খুব অবাক হয়েছিল। মুখ থেকে কথা সরছিল না তার।
ফ্রেশ হয়ে , নিজের খাটের উপর শুয়ে , ফোন ঘাটতেই তার দিদিকে ফোন করার ইচ্ছা হলো । দিদিকে ফোন করার পর বাবা কাকার দাবা খেলা দেখা যাবে ভেবে সে দিদিকে ফোন করলো। ফোন করার পর ওইপার থেকেই প্রথম গলার আওয়াজ এলো , “ হ্যাঁ বল । „
সুচি --- কি করছিস ?
সুমি --- আমি এই চা বানাচ্ছি। তোর জামাইবাবু এই এলো। তা হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো । কি ব্যাপার !
সুচি --- মানে
সুমি --- টানা দুদিন ফোন করিস নি। তাই জিজ্ঞাসা করছি ।
সুচি --- ওই সময় হয়নি।
সুমি --- সময় হয়নি নাকি আকাশের সাথে গল্প করছিলি।
সুচি --- ওর সাথে আবার কি গল্প করবো !
সুমি --- ন্যাকামি মারিস না। মা আমাকে সব বলেছে। আমি জানি সব। এমনকি আজকে রাতে পুরোহিত এসে তোদের বিয়ের তারিখ ঠিক করবে , সেটাও আমি জানি।
সুচি --- এতোই যখন জানিস সবকিছু ! তখন এলি না কেন আজ ।
সুমি --- যাওয়ার ইচ্ছা ছিল খুব। কিন্তু সময় পাচ্ছি না। এই রবিবার যাবো সবাই।
সুচির হঠাৎ প্রজ্ঞার কথা মনে পড়তে সে বললো , “ প্রজ্ঞা কোথায় রে ? „
“ এই নে । „ বলে সুমি একবার ‘ প্রজ্ঞা , বলে ডাকলো। সুচি সেটা ফোন কানে রেখেই শুনতে পেল। সুমি বললো , “ প্রজ্ঞা তোর মাসি ফোন করেছে। এই নে কথা বল। „
কিছুক্ষণ পরেই একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের গলা ভেসে এলো , “ মাসি ! তুমি কেমন আছো ? „
সুচি --- আমি ভালোই ! তুই কেমন আছিস ?
প্রজ্ঞা -- আমিও ভালো আছি। আমি কিন্তু লাগ করেছি তোমার উপর । কথা বলবো না তোমার সাথে।
প্রজ্ঞার বয়স তিন হতে যায়। এখনও তোতলায় । তবে খুব কম। প্রজ্ঞার মিষ্টি রাগ দেখে সুচি মজা পেল , “ কেন ! আমি কি করলাম ? „
প্রজ্ঞা --- তুমি এই রবিবার আসো নি কেন ?
সুচি --- আমার কাজ ছিল রে। সামনের রবিবার তো দিদি তোকে এখানে আনছে আমার কাছে। এবার রাগ কমলো তো !
প্রজ্ঞা --- সত্যি !
সুচি --- হ্যাঁ সত্যি। মাকে জিজ্ঞাসা কর না !
আরও প্রায় এক ঘন্টা পর দুজনের খেলা শেষ হলো। জিতলেন সুচির বাবা। চেক মেট বলার পরে তিনি বললেন , “ এখনও বাচ্চাদের মতো ভুল করলি তুই। আমি যখন মন্ত্রীকে স্যাক্রিফাইস করলাম তখনই তোর বোঝা উচিত ছিল। „ বলে হাসতে লাগলেন
আকাশের বাবা অজুহাত দেওয়ার জন্য বললেন , “ এত বছর পর খেলছি। এটা ফ্রি প্রাকটিস ম্যাচ ছিল । এখন আর একটা খেল । দেখবি তখন ! „
“ আমি চললুম খবর দেখতে। „বলে সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। ঠিক তখনই রাধানাথ ঠাকুর এসে ঘরে ঢুকলেন আর সুচির বাবার মুখোমুখি হয়ে গেলেন। পুরোহিত কে দেখে খুশী হয়ে সুচির বাবা বললেন , “ আসুন আসুন। „ বলে ভিতরে নিয়ে এলেন।
আকাশের বাবা পুরোহিতকে দেখেই উঠে দাড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন তার জন্য সোফাটা ছেড়ে দিয়ে বললেন , “ আপনি বসুন । „ তারপর আকাশের মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন , “ স্নেহা চা নিয়ে এসো। „
আকাশের বাবার কথায় পুরোহিত সোফায় বসলে সুচির বাবা বললেন , “ আপনি বসুন আমি সবাইকে ডাকছি। „
আকাশের মা ঘরেই ছিলেন। বেরিয়ে এসে দেখলেন পুরোহিত এসছে। তাই তিনি চা বানাতে চলে গেলেন। সুচির বাবাও তার স্ত্রী আর মেয়েকে ডাকতে চলে গেলেন । সোফায় বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে রাধানাথ ঠাকুর বললেন , “ অনেক দিন পর এখানে এলাম । „
সত্যি বলতে কি আকাশের বাবাও অনেক দিন পর এই লোকটাকে দেখছেন। গায়ের রঙ আগের থেকে ফ্যাকাশে হয়েছে। ধবধবে সাদা চুল। মুখের চামড়া কোঁচকানো । চোখে একটা হাই পাওয়ারের চশমা। পরনে আছে একটা ধুতি আর গায়ে একটা হরে কৃষ্ণ নাম লেখা গেরুয়া চাদর জড়ানো। নয় নয় করেও ষাট সত্তর বছরের বেশি বয়স হয়ে গেল লোকটার।
স্নেহা দেবী চা করে নিয়ে এসে রাখলেন। রাধানাথ ঠাকুর আকাশের মাকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোমার মেয়ের-ই তো বিয়ে ! „
স্নেহা দেবী হেসে বললেন , “ মেয়ের না। ছেলের । আমার ছেলের বিয়ে। „
পুরোহিত অবাক হয়ে বললেন , “ কিন্তু আমাকে তো মেয়ের কুষ্ঠি দেখতে ডাকলো। আমি কি ভুল বাড়ি ঢুকে পড়লাম। „
আকাশের বাবা হেসে বললেন , “ না আপনি ঠিক বাড়িতেই এসছেন । যার কুষ্ঠি দেখতে এসছেন। তার সাথেই আমার ছেলের বিয়ে । „
রাধানাথ ঠাকুর এখনও বুঝতে পারেননি। কিন্তু তিনি বিচক্ষণ লোক। তাই বুঝতে পারলেন যে ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং সব বুঝতেও পারবেন। এইসব ভেবেই তিনি আকাশের মায়ের হাতের বানানো চায়ে চুমুক দিলেন।
সুচির বাবা সুচির মাকে নিয়ে এলেন। হাতে তার সুচির কুষ্ঠি আর একটা পঞ্জিকা আছে। সুচিকে একবার তিনি ডেকেছিলেন । তার উত্তরে সুচি লজ্জা পেয়ে বলেছে , “ তোমরা যাও আমার ভালো লাগছে না। „
সুচির বাবা ঘরে এসে রাধানাথ ঠাকুরের সামনে কুষ্ঠি আর পঞ্জিকা ধরে বললেন , “ এই নিন । „
রাধানাথ ঠাকুর পঞ্জিকা নিয়ে দিন দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোমরা কোন মাসে তারিখ চাইছো ? „
আকাশের মা বললেন , “ দুই তিন মাস পর হলে আমাদের সুবিধা। সবকিছু আয়োজন করতে একটু সুবিধা হবে। „
আর একবার পঞ্জিকা দেখে পুরোহিত বললেন তাহলে মে মাসের নয় থেকে বারো সবকটা দিন ভালো আছে। সেই দিন গুলোর মধ্যে একটা বেছে নাও বলে সুচির কুষ্ঠি তুলে নিলেন আর বললেন , “ পাত্রের কুষ্ঠি কোথায় ? „
আকাশের মা , “ আনছি। „ বলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন । আলমারি খুলে ছেলের কুষ্ঠি বার করে এনে দিলেন। রাধানাথ ঠাকুর দুটো কুষ্ঠি মিলিয়ে বললেন , “ পাত্রীর রাশি সিংহ আর পাত্রের মেষ। সব ঠিক আছে। কিন্তু মেয়ের বয়স বেশি , আর ছেলের কম দেখাচ্ছে তো ! „
আকাশের মা বললেন , “ হ্যাঁ আমার ছেলের বয়স তেইশ। আপনি ওর অন্নপ্রাশনের দিন কুষ্ঠি দেখে বলেছিলেন ওকে তেইশ বছরে বিয়ে দিতে। তাই । „
“ ও .. কি বলেছিলাম তা মনে নেই। তবে এখন কুষ্ঠি দেখেও সেটাই বলছি। এ ছেলের বিয়ে এই তেইশেই দিলে ভালো। সারাজীবন সুখে ঘর করতে পারবে। „ তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন , “ পাত্রীর কুষ্ঠীতে একটা বিপদ দেখতে পাচ্ছি। মোটেও ভালো লাগছে না । „
সুচেতা দেবীর বুক কেঁপে উঠলো , মুখটা নিমেষের মধ্যে রক্তশূন্য হয়ে উঠলো , “ কি বিপদ দাদা ? „
“ পাত্রীর বিয়ের আগে একটা ফাঁড়া আছে । „
“ কিরকম ফাঁড়া ? „
“ একটা ক্ষতি। কিরকম ক্ষতি সেটা বুঝতে পারছি না। সব যদি এইভাবে বোঝা যেত তাহলে তো ... „ বলে চুপ করে গেলেন ।
ঘরের মধ্যে সবারই এখন বুক শুকিয়ে গেছে। সুচেতা দেবী কাঁপা গলায় বললেন , “ কিছু তো বলুন । এর থেকে কিভাবে আমার মেয়েকে বাঁচাবো সেটা বলুন । „
“ আমি বুঝতে পারছি না । ও নিজেই উপায় বার করবে। আর কিছু বলতে পারছি না । „
আরও কিছুক্ষণ থেকে সুচির বাবার কাছ থেকে প্রণামী নিয়ে রাধানাথ ঠাকুর চলে গেলেন। তেইশ বছর আগে তিনি একটা বোম মেরে চলে গেছিলেন। এখন তার থেকেও বড়ো বোম মেরে চলে গেলেন। ঘরে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে , কারোর মুখে আর একটাও কথা নেই। সবাই থম মেরে গেছে। কি বিপদ ? সেটাই সবার মাথায় ঘুরছে। আকাশের বাবা এটাকে অবিশ্বাস করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু বিপদ শব্দটাই বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সুচেতা দেবী সেই যে চুপচাপ হয়ে গেলেন আর কথা বললেন না ।
রাত প্রায় আটটার সময়ে গোধূলি বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ঢুকতেই গোধূলির মা এসে বললো , “ দেখ না কি হয়েছে ! সেই যে অফিস থেকে ফিরলো , তখন থেকেই এরকম আচরণ করছে তোর বাবা । „
ফোনেই বাবার গলা শুনি গোধূলি বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা হয়েছে। এখন মায়ের মুখে বাবার আচরণ শুনে সে গম্ভীর হয়ে গেল , “ দাড়াও , আমি জিজ্ঞাসা করছি। „
তারপর বাবার ঘরে গিয়ে দেখলো তার বাবা এক জায়গায় স্থির নেই। সারাঘর পায়চারি করছে। ওইভাবে পায়চারি করতে দেখে গোধূলি জিজ্ঞাসা করলো , “ কি হয়েছে বাপি ? এরকম করছো কেন ? „
গোধূলি কে দেখেই সঞ্জয় ফেটে পড়লো , “ কি হয়েছে ! আকাশ আর একটা মেয়েকে প্রোপজ করেছে। আর তুই জিজ্ঞাসা করছিস কি হয়েছে ! „
গোধূলি বাবার কথা শুনে বুঝতে পারলো যে আকাশ নিশ্চয়ই সুচিত্রা কে প্রোপজ করেছে। তাই সে বললো , “ হ্যাঁ প্রোপজ করেছে। তাতে অসুবিধা কোথায় ? „
সঞ্জয়ের মাথা ঠিক নেই। চোখ লাল হয়ে উঠেছে , “ অসুবিধা ! আমার এতদিনের অপেক্ষা , এতদিনের প্ল্যান সব জলে ডুবে গেল আর তুই ....
বাবার কথার কোন মানেই গোধূলি বুঝতে পারলো না। তাই তার ভুরু কুঁচকে গেল , “ কিসের অপেক্ষা ? কিসের প্ল্যান ? বাপি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ! „
“ তোর সাথে আকাশের বিয়ের প্ল্যান। এটার জন্যেই তো আমি এত বছর অপেক্ষা করেছি ...
গোধূলি অবাক হয়ে বললো , “ বাপি তুমি , আমার আর আকাশের বিয়ের জন্যে এতদিন অপেক্ষা করেছিলে ! „
“ তুই তো ওকে গোলাপ দিয়েছিলি। ও সেটা নিয়ে thank you ও বলেছিল। তাহলে হঠাৎ ও সুচিত্রা কে কেন প্রোপজ করলো ? তুই জানিস কিছু ? „
“ হ্যাঁ ও সুচিত্রাকে ভালোবাসে। তাই প্রোপজ করেছে। আকাশ আমাকে বলেছিল ও সুচিত্রা কে ভালোবাসে। „
সঞ্জয় প্রায় পাগল হয়ে গেল , “ না , না , না , আমার স্বপ্ন ! আমার এতদিনের সবকিছু এইভাবে তছনছ হতে পারে না ! „
গোধূলি বাবার কথায় আরও অবাক হলো , “ কি বলছো কি তুমি বাপি ? কি তছনছ হয়েছে ? কোন স্বপ্নের কথা বলছো ? „
নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সে। বদ্ধ উন্মাদের মত সব সত্যি বলে দিল সঞ্জয় , “ আমি চেয়েছিলাম তোর সাথে আকাশের বিয়ে হবে। তারপর ওই সম্পত্তি সব শুধু আমি ভোগ করবো। শুধু আমি । „
বাবা যে পাগল হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে এবং বাবার কথার মানে বুঝতে পেরে গোধূলি কেঁদে ফেললো। দুই গালে চোখের জলের রেখা দেখা দিল । কাঁদতে কাঁদতে সে বললো “ তুমি আমাকে একটা পন্য হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছো বাপি ! আমি শুধু তোমার কাছে সম্পত্তি পাওয়ার চাবিকাঠি ছিলাম এতদিন ! তুমি আমাকে ভালোবাসোনি কখনো। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার সুখের জন্য আমাকে আকাশের সাথে সম্পর্কে যেতে বলছো। এখন দেখছি সেটাও তোমার এক জঘন্য প্ল্যান ছিল। i hate you বাপি। i hate you... বলে দৌড়ে উপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দিল। বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভেজাতে লাগলো।
এদিকে সঞ্জয় মেয়ের কথায় এতক্ষণ পর নিজের হুশ ফিরে এলো। গোধূলির বলা কথা গুলো তার মাথায় ঘুরতে লাগলো। “ পণ্য , হ্যাঁ , পণ্য হিসাবেই তো ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম নিজের মেয়েকে । „ বিড়বিড় করে কথা গুলো বলে , ঘরের মধ্যে রাখা সোফার উপর ধপ করে বসে পড়লো ।