31-12-2021, 09:30 AM
Update 7
“ মানে ? „ সুচির হঠাৎ এইসময়ে এইধরনের প্রশ্নের কোন মানে আকাশ বুঝতে পারলো না
“ তখন তুই বললি না নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবি। সেটাই জিজ্ঞাসা করছি। তোর যোগ্যতা কোনটা ? „
আকাশ বুঝতে পারলো না সুচি কি বলতে চাইছে । একদিকে সারারাত না ঘুমানোর একটা ক্লান্তি আর এই এখনকার প্রশ্নের অর্থ বুঝতে না পেরে আকাশের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। এর ফলে আকাশ বাইক চালানোয় অমনোযোগী হয়ে পড়লো । সুচি দেখলো দুটো গাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাইকটা গাড়ি দুটোর গা ঘেসে বিপদজ্জনক ভাবে পাশ কাটালো। সেটা দেখে ভয় পেয়ে সুচি বললো , “ সাবধানে , দেখে চালা। অফিসে গিয়ে উত্তর দিস। „
সুচির কথায় আকাশ বেশি না ভেবে বাইক চালানোয় মনোযোগ দিল। অফিসে পৌছে পার্কিংয়ে বাইক পার্ক করতে সুচি বাইক থেকে নেমে , আশেপাশে কেউ নেই দেখে নিয়ে বললো , “ প্রোপজের কথা মনে আছে তো ? „
“ মনে থাকবে না আবার ! „ তারপর রিকোয়েস্ট করার ভঙ্গিতে আকাশ বললো , “ প্লিজ তুই অল্প কথায় রাজি হয়ে যাস। অফিসের সবার সামনে প্রোপজ করতে হবে ভেবে এমনিই লজ্জা পাচ্ছি। বেশিক্ষণ থাকলে কি অবস্থা হবে সেটা ভেবেই ভয় পাচ্ছি । „
কথাটা শুনে সুচির চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো , “ তুই কি পরিক্ষা দিতে যাচ্ছিস যে ভয় পাচ্ছিস ! „
আকাশ চোখ বড়ো বড়ো করে বললো , “ অবশ্যই পরিক্ষা। এর থেকে বড় পরিক্ষা কখনো দিই নি । তাই ভয় তো হবেই । „
মিচকি হাসি হেসে সুচি বললো , “ ঠিক আছে। ভেবে দেখবো। তবে যা করবি সব লাঞ্চের আগে । „ বলে সুচি লিফ্টের দিকে চলে গেল । লাঞ্চের আগে , কারন লাঞ্চের সময় বাবা আর কাকার পুরানো ঝগড়া শুনবে সে। তাই লাঞ্চের আগেই প্রোপজের শাস্তি সেরে ফেলতে চায়।
আকাশের হঠাৎ মনে পড়লো সেই যোগ্যতা নিয়ে কথাটা , “ তখন কি জিজ্ঞাসা করছিলি যোগ্যতা নিয়ে ? „
“ টিফিন ব্রেকে বলবো । „ বলে লিফ্টে উঠে ঢুকে গেল সুচি ।
স্বামী আর সন্তান অফিস চলে গেলে আকাশের মায়ের এই বড়ো ফ্ল্যাটটা হঠাৎ খালি খালি লাগতে শুরু করলো। আজকে কেন এরকম লাগছে সেটা তিনি বুঝতে পারলেন না। আগেও তো এই ফ্ল্যাটেই ঘন্টার পর ঘন্টা একা কাটিয়েছেন। তাহলে আজকে হঠাৎ এরকম মনে হচ্ছে কেন !
কিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারলেন যে এটা মনের ভুল। আসলে তার কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। যার সাথে এই দীর্ঘ চার পাঁচ বছর কথা বন্ধ ছিল , তার সাথেই কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। কারন আগে তো স্বামী অফিসে আর ছেলে কলেজ কলেজে চলে যাওয়ার পর তার সাথেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটতো।
বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর , দোটানা মন নিয়ে তিনি ঘরের বাইরে এসে পাশের ফ্ল্যাটে তাকিয়ে দেখলেন যে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আকাশের মায়ের মনে হলো যেন তার জন্যেই দরজাটা খুলে রাখা আছে। তিনি বুকে দ্বিধা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন সুচির মা ফ্লোর পরিষ্কার করছেন। যে জল দিয়ে ফ্লোর মুছছিলেন সেই জলে কিছু একটা মেশানোর জন্য একটা অচেনা ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে।
আকাশের মাকে দেখে সুচির মা মৃদু হেসে সোফা দেখিয়ে , “ বসো „ বললেন। তারপর নোংরা জলের বালতিটা বাথরুমে রেখে , সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এসে বললেন , “ তুমি বসো আমি চা করে আনছি । „
আকাশের মা কি বলে কথা শুরু করবেন সেটা তিনি বুঝতে পারলেন না। অথচ কাল রাতে এই মহিলার সাথেই নিজের ছেলের বিয়ে নিয়ে কথা বলেছিলেন। কিন্তু তখন কথা বলছিলেন ছোটবেলার দুই ভাই রুপি বন্ধু সমু আর শুভো। এই দুই মহিলা মূলত শ্রোতা হিসাবেই ছিলেন। বেশি কথা তারা বলেন নি।
কতদিন পর ! না দিন নয় , বছর , প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর পর এই ফ্ল্যাটে তিনি ঢুকলেন। চারিদিকে দেখতে দেখতে ঘরের রঙের উপর খেয়াল হলো । মনে হচ্ছে আগে আলাদা রঙ ছিল। হ্যাঁ আগে ছিল নিল এখন সবুজ হয়েছে। তারপর নিজের মনেই তিনি বললেন , ‘ ও হ্যাঁ , মনে পড়েছে। সুমির বিয়ের সময়েই রঙ করা হয়েছিল। , চার পা হাটলেই এই ফ্ল্যাটে আসা যায়। আগে আসা যাওয়া ছিল। হঠাৎ করে সব সম্পর্ক , যাওয়া আসা , একে অপরের খেয়াল নেওয়া , সব বন্ধ হয়ে গেছিল। কি কারণে বন্ধ হয়েছিল ? হ্যাঁ , সেই অষ্টমীর রাতে সুচি আর আকাশ ....
এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন সুচেতা দেবী চা নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন সেটা তিনি খেয়াল করেননি। কিন্তু যেটা খেয়াল করলেন সেটা হলো পেয়ালা ভর্তি আদা চা। যেটা তিনি খেয়ে থাকেন এবং পছন্দ করেন। কিন্তু সুচির মা দুধ চিনি চা ছাড়া খান না সেটা তার তখনই মনে পড়লো। কথাটা মনে পড়তেই তিনি সুচির মায়ের কাপে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন সেখানেও আদা চা বা রঙ চা আছে। এতদিন পরেও যে সুচির মা তার এই ছোট্ট পছন্দের কথা মনে রেখেছে সেটা দেখে তার চোখে জল চলে এলো। মুখ থেকে আপনাআপনি একটা কথা বেরিয়ে এলো , “ আমি ভেবেছিলাম সুচি আমার ছেলেকে মেরেছে তাই তুমি কথা বন্ধ করে দিয়েছো । „
ওদিক থেকে যে কথাটা ভেসে এলো সেটা তাকে একেবারে কাঁদিয়ে দিল। সুচির মা বললেন , “ আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়ে তোমার ছেলেকে মেরেছে বলে তুমি কথা বন্ধ করে দিয়েছো । „
কথাটা শুনে আকাশের মা মুখে হাত চেপে ফুপিয়ে কেদে উঠলেন। কথা দুটো যে একই। একজনের দৃষ্টিতে এটা রাগের বহিঃপ্রকাশ , আর একজনের দৃষ্টিতে কথাটা অনুশোচনার বহিঃপ্রকাশ। আকাশের মা ভেবেছিলেন সুচির মা সুচির এই ঘটনায় অনুতপ্ত হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আর সুচির মা ভেবেছিলেন আকাশের মা আকাশকে কে মারার জন্য রেগে গিয়ে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে , দুজনেই নিজে থেকে কিছু ভুল ভাবনা ভেবে নিয়ে , নিজে থেকেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।
সুচির মা উঠে আকাশের মাকে সান্ত্বনা দিতে গেলেন। কিন্তু সুচেতা দেবী আকাশের মায়ের পাশে গিয়ে বসতেই আকাশের মা দেখলেন যে সুচির মায়ের চোখেও জল টলটল করছে। আচলে চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে তিনি বললেন , “ আমার কম বয়সী ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়েতে কোন আপত্তি নেই তো ? কাল রাতে তো দাদা আর আকাশের বাবাই সিদ্ধান্ত নিল। তোমার কথা তো কেউ শুনলো না। „
সুচির মা গম্ভীর হয়ে বললেন , “ আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমার বয়স ছিল বাইশ আর সুচির বাবার পঁচিশ। না , আমার কোন আপত্তি বা অসুবিধা নেই। আকাশের সাথে বিয়ে না হলে আমার মেয়ে চোখের জল ফেলবে। তাতে আমার আপত্তি আছে বৈকি । „
এরপর আর কোন কথা হয় না। আকাশের মা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিলেন। এতবছর পর সুচির মায়ের হাতে চা খেয়ে তার প্রাণ জুড়িয়ে এলো। চা খুব ভালো বানান সুচির মা।
অফিস আওয়ার শুরু হয় দশটা থেকে। আকাশ সুচি পোঁছে ছিল সাড়ে এগারোটায়। তারপর দুজনেই দুটো ফ্লোরে নিজের নিজের জায়গায় বসে পড়েছিল। আকাশকে কেউ কিছু না বললেও সুচিকে সুচির বস দুটো কথা শুনিয়েছিল। সুচি কোন অজুহাত না দিয়ে , “ সরি „ বলেছিল।
মনে কোন অহংকার সে রাখে নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই কোম্পানির মালিকের ছেলে এসে তাকে সবার সামনে প্রোপোজ করবে আর তারপরেই সে হয়ে যাবে এই কোম্পানির ভবিষ্যতের মালকিন। এই অহংকার সে পোষণ করে না। আর তাই যখন তার বস তাকে অফিসে দেরি করে আসার জন্য কথা শোনাচ্ছিল তখন , “ সরি স্যার , শরীর খারাপ লাগছিল । „ ছাড়া আর কিছু সে বলেনি।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা থেকে একটার ঘরের দিকে যতো এগিয়ে যেতে লাগলো সুচির মন তত বেশি উশখুশ করতে লাগলো। , ‘ কখন আকাশ এসে প্রোপজ করবে ? কখন ! , সময় কাটতে চাইছে না তার , কাজে মন নেই। হঠাৎ সুচি দেখলো যে আকাশ এই ফ্লোরে ঢুকছে। কিন্তু এ কি ! ও তো একটা ফাইল নিয়ে চলে গেলো ! মেসেজ করবে কি ! না করবে না। রাগ হলো সুচির। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভাবলো যে , এই রাগের বহিঃপ্রকাশ যেন না হয়। তাই সে শান্ত হয়ে কাজে মন দিল।
ঠিক দেড়টা বাজার সময়েই আকাশ ঢুকলো। সুচি সেটা খেয়াল করলো না। দরজা ঢেলে ভিতরে ঢোকার সময়েই তার মুখ দেখে বোঝা গেল যে সে ভীষণ নার্ভাস। কয়েক জন কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে আকাশকে দেখে আবার স্ক্রিনে চোখ দিল। আকাশ এসে সুচির পাশে দাঁড়াতেই সুচির নজর আকাশের উপর পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সুচির মুখে হাসি , চোখে লজ্জা দেখা দিল আর হৃৎপিন্ডের ধুকপুকানি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল।
সুচির পাশে বসা কাজ করা কয়েকজন এমপ্লয়ি আকাশের হাবভাব দেখে অবাক হলো। আকাশের মুখের নার্ভাসনেস তাদের চোখ এড়ালো না। হঠাৎ আকাশ একটা হুটু ভাজ করে মেঝেতে দাঁড়াতেই আশেপাশের সবার নজর কারলো । সবাই উঠে দাঁড়িয়ে দেখতো লাগলো যে কি হচ্ছে। সবাই আন্দাজ করতে পারলো কি হতে যাচ্ছে। তাই তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
আকাশ একটা হাটু ভাজ করে মেঝেতে রাখতেই সুচি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো । চোখের মনি কাঁপছে তার । মেঝেতে হাটু রাখতেই আকাশ পকেট থেকে অফিসে আসার সময় কেনা সেই আংটিটা বার করে সুচির চোখের সামনে মেলে ধরে মিষ্টি গলায় বললো .....
“ আমি জানতাম না তুই আমার জীবনের কতোটা জুড়ে আছিস। হঠাৎ করে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি বুঝতে পেরেছি আসলে তুই-ই আমার জীবন ছিলি। গত চার পাঁচ বছর আমি যা কষ্ট পেয়েছি আমার বিশ্বাস তুইও ততোটাই পেয়েছিস। ভবিষ্যতে এরকম অসহ্য কষ্ট আমি কিংবা তুই কেউই আর নিতে পারবো না। যাতে এই ধরনের কষ্ট আমাদের কে আর পেতে না হয় তাই তুই কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবি ? তুই কি আমার সাথে সারাজীবন একসাথে থাকবি ? „
আকাশের কথা শেষ হতেই আশেপাশের সব এমপ্লয়ি মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ বার করে সেলিব্রেট করলো। তারা আকাশের বলা কথার মানে একদম বুঝতে পারে নি। কিন্তু তাতে তাদের কিছু যাস আসে না। কোম্পানির মালিকের ছেলে একজন সাধারণ এমপ্লয়ি কে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে এটাই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়।
সুচি একসাথে লজ্জা পেল আবার আকাশের উপর রেগেও গেল। সে ভেবেছিল আকাশ হয়তো তাকে ইংলিশে প্রোপজ করবে। যদি বাংলাতে প্রোপজ করে তাহলে অন্তত তুমি বলে তাকে সম্বোধন করবে। কিন্তু সেরকম কিছুই না হওয়ায় সুচি রেগে গেল। এদিকে এটা বিয়ে করার প্রোপজ বলে সে লজ্জাও পেল।
যতোই রাগ হোক ! সুচির জেদের জন্যেই তো আকাশ তাকে প্রোপজ করেছে। তাই সে , “ yes „ বলে মাথা উপর নিচ করে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিতেই আকাশ তার অনামিকাতে আংটিটা পড়িয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশের সব এমপ্লয়িদের হাততালি শুনে আস্তে আস্তে ওখান থেকে কেটে পড়লো। এতো লজ্জা কখনো সে পায়নি।
সুচি মুখে হাসি আর লজ্জা নিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়লো। তার মুখ পাকা টমেটোর মত লাল হয়ে উঠেছে । পাশের এক মহিলা এসে পিঠে হাত দিয়ে অভিন্দন জানালো। তারপর পরপর প্রায় সবাই এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। লজ্জায় কারোর দিকে তাকাতে পারছে না সে। কম্পিউটারে খুটখুট করতে করতে সে ভাবলো , ‘ এই তুই নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। তুই-তোকারি বন্ধ করতেই হবে। ,
আকাশ এসে আবার নিজের চেয়ারে বসে পড়লো। আজকে গোধূলি আসেনি কিন্তু সঞ্জয় এসছে । গোধূলি সেই নিজের মাসতুতো দিদির সাথে দেখা করতে গেছে। সুচিকে আকাশ প্রোপজ করেছে এটা সঞ্জয় দেখেনি । কিন্তু কোন খবর এ দেশ থেকে ও দেশে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। তাই সুচির ফ্লোর থেকে আকাশের ফ্লোরের এমপ্লয়িদের কাছে খবরটা পৌঁছাতেও বেশি সময় লাগলো না। তাদের কাছে এটাই এখন সবথেকে জনপ্রিয় মুখরোচক খবর।
তখন টিফিন ব্রেক সবে শুরু হয়েছে। সুচি আকাশকে মেসেজ করে নিচের ধাবাতে আসতে বললো । বাবা আর কাকার কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল সেটা শোনার কৌতূহল সে আর চেপে রাখতে পারছে না। সুচির মেসেজ পেয়ে আকাশ বাবাকে “ নিচে যাচ্ছি। „ বলে নিচের রাস্তার পাশে ধাবাতে চলে এলো।
এদিকে এমপ্লয়িদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে হঠাৎ আকাশ সুচিকে কেন প্রোপজ করলো ? সুচি তো আকাশের থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছরের বড়ো। এবং সুচি আর আকাশ একই সোসাইটি তে থাকে । যেভাবে তুই তুই করে কথা বলছিল তার থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে এরা পূর্ব পরিচিত। এই নিয়েই অফিস সরগরম যাকে বলে। আর মেয়েটাও একটা বড়ো দাও মারলো। একেবারে মালিকের ছেলের সাথে।
এই আলোচনা সঞ্জয়ের কানে যেতেই তার ভুরু কুঁচকে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলে একজন এমপ্লয়ি বিস্তারিত সব বললো । সব শুনে সে রাগে ফেটে পড়লো । মাথার ঠিক রইলো না আর। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের বাবার কেবিনের দরজা ঢেলে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো , “ আপনার ছেলে নিচের ফ্লোরের কি নাম ! সুচিত্রা না কে ! ওকে বিয়ের জন্য প্রোপজ করেছে ? এটা সত্যি ? „
আকাশের বাবা সবে টিফিন কৌটো খুলে তার ভিতরের খাবার দেখছিলেন। হঠাৎ সঞ্জয়ের এইভাবে তেড়েফুড়ে কেবিনে ঢুকতে দেখে তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। সঞ্জয়ের চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথা গুলো শোনার পর তিনি মনে মনে বললেন , ‘ এর মধ্যে প্রোপজ ও করা হয়ে গেল ! , নিজের মনে কথা গুলো বলে সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বললেন , “ এটা আমি শুনিনি। সত্যি কি না জানি না। তবে যদি সত্যি হয়-ও তাহলে অসুবিধা কোথায় ? „
ভুরু কুঁচকে ক্রুদ্ধ স্বরে সঞ্জয় বললো , “ অসুবিধা ! আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবেন । সে কথা আপনি ভুলে গেলেন ? „
সঞ্জয়ের রাগকে অগ্রাহ্য করে শান্ত কন্ঠে আকাশের বাবা বললেন , “ না ভুলিনি। আমার এখনও মনে আছে। কিন্তু আমার ছেলে যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায় তাহলে আমি কি করতে পারি বলো ! „
ততোধিক রাগী স্বরে সঞ্জয় বললো , “ আপনি কি করতে পারেন মানে ! আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন। আপনার কথার কি কোন দাম নেই ? „
ততোধিক শান্ত স্বরে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে আকাশের বাবা বললেন , “ আছে সঞ্জয়। আমার কথার দাম আছে। কিন্তু আমার ছেলের সুখ যে আমার কথার থেকে অনেক দামি। আমি কিভাবে একটা প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমার ছেলের সুখ কেড়ে নেবো .....
হয়তো আকাশের বাবা আরও কিছু বলতেন। হয়তো বলতেন না। কিন্তু আকাশের বাবার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই সঞ্জয় কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর রেগে অফিস থেকেই চলে গেল। সঞ্জয় রেগে আছে বটে তবে তার মাথা ঠিক কাজ করছে। অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার মাথায় সেই গোধূলির দেওয়া গোলাপ আর আকাশের বলা ‘ ধন্যবাদ , কথাটা ঘুরছে।
বহুদিন পর সুচি ধাবাতে বসে দুটো মাশালা ধোসা অর্ডার করলো । আকাশ এসে বসলে সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ বল এবার , বাবা আর কাকার মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ? „
আকাশ কাঠের বেঞ্চে বসতে বসতে বললো , “ আগে খাবারটা তো অর্ডার কর ! নাকি...
আকাশের কথার মাঝে সুচি বলে উঠলো , “ আমি অর্ডার করে দিয়েছি। তুই বল । „
আকাশ সবকিছু আগাগোড়া বলতে শুরু করলো। গতকাল রাতে জেঠুর আসা। তারপর তার হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করা। তারপর একে একে বাবা আর জেঠুর ছোটবেলার কথা। ঠাকুর্দার কথা। জেঠাকে করা ঠাকুর্দার অপমান। সেখান থেকে কথা বন্ধ। ঠাকুমার কষ্ট পাওয়া। বাবার রেগে যাওয়া। নিজের ভুল বুঝতে পেরে জেঠুর কেঁদে ফেলা।
আকাশের কথার মাঝে সুচির অর্ডার করা ধোসা চলে এসছিল। কিন্তু কেউই খাওয়া শুরু করে নি। সব শোনার পর সুচির চোখের কোনায় জল দেখা দিল। বিশেষ করে ঠাকুমার কথা শোনার সময়েই চোখে জল এসছিল। চোখ মুছতে মুছতে সে বললো , “ আমি দেখেছি ঠাকুমাকে। তখন আমি খুব ছোট। আড়াই কি তিন বছর হবে আমার। মুখটা মনে নেই। আমাকে সবসময় কোলে নিয়ে আদর করতো। একটা কথা বলতো আমাকে । এখনও মনে আছে। বলতো , ‘ আমার নায়িকা সুচিত্রা সেন। , সেই প্রথম আমি শুনি যে আমার নাম একজন নায়িকার নামে রাখা। „
আকাশ একটু রেগে গিয়েই বললো , “ সবাই দেখেছে আমার ঠাকুমাকে। সবাই । শুধু আমি ছাড়া। „
আকাশের রাগের কারন সুচি বুঝতে পারলো। তাই সে বললো , “ ধোসা ঠান্ডা হয়ে গেছে । খেয়ে নে । „
আকাশ একটাই প্লেট দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ আমার প্লেট কোথায় ? „
সুচি হেসে বললো , “ প্লেট একটাই। ধোসা দুজনের । „ বলে সুচি খেতে শুরু করলো। সুচির দেখাদেখি আকাশও টুকরো টুকরো ছিড়ে সাম্বারে ডুবিয়ে খেতে শুরু করলো।
খাওয়া হয়ে গেলে আকাশ আর সুচি আবার অফিসের দিকে আসতে শুরু করলো। হঠাৎ আকাশের মনে পড়লো সেই ‘ যোগ্যতা , নিয়ে কথাটা। মনে পড়তেই সে সুচিকে জিজ্ঞাসা করলো , “ তখন তুই বাইকে কি বলছিলি ? আমি কোনটাকে যোগ্যতা মনে করি না কি যেন ! ....
“ তুই সকালে আমাকে বললি না যে , তুই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবি । তারপর কাকিকে তোর দলে নিয়ে কাকাকে রাজি করাবি । সেটাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। কোন যোগ্যতা প্রমাণ করার কথা বলিছিল ? „
কিছুক্ষণ চুপ থেকে পায়ের নিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাটতে হাটতে আকাশ বললো , “ এই যে আমি বড়ো হয়েছি। নিজের পায়ে দাড়াতে শিখে গেছি। একজনের দায়িত্ব নিতে পারবো এইসব । „
“ বড়ো হয়ে গেছিস কি হোসনি সেটা আলাদা প্রশ্ন। নিজের পায়ে কখন দাঁড়ালি তুই !? „
সুচির প্রশ্নে আকাশ অবাক হলো , “ মানে ! এই যে আমি চাকরি করছি। এটা কি ? „ বলে লিফ্টের জন্য বোতাম টিপে দিল।
“ এই চাকরিটা কি নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে পেয়েছিস ! আমি যতদূর জানি তুই কাকার ছেলে বলে এই চাকরি পেয়েছিস। নিজের যোগ্যতা কখন প্রমাণ করলি তুই ? এই যে কলেজে পাঁচ বছর পড়ে MBA ডিগ্রি অর্জন করলি। ওটার কি দরকার ছিল ? কাকার ছেলে বলে আগেই তো অফিসে কাজ করতে পারতিস ! „
“ আমাকে কি কলেজের ডিগ্রি দেখিয়ে আমার কোম্পানিতেই ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি করার বলছিস ! „ বলতে বলতে দুজনেই লিফ্টে ঢুকে গেল।
“ এটাকেই যোগ্যতা বলে। কাকা একজন ব্যাবসায়ী মানুষ। সে কেন এমন একজনের হাতে তার কোম্পানি তুলে দেবে যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেনি । আর তোর কোম্পানি হলে তুই মালিকের আসনে বসে থাকতিস। কিন্তু তুই বসে আছিস পিওনের চেয়ারে। কোম্পানিটা তোর বাবার। তোর না। কাকা চায় তার ছেলে খেটে কোম্পানি কে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে , মালিকের চেয়ারে বসার যোগ্যতা অর্জন করুক। কিন্তু সেরকম কোন চেষ্টা তুই কখনোই করিস নি ....
আকাশ খেয়াল-ও করলো না কখন সুচির ফ্লোর চলে এলো। সুচি নিজের ফ্লোরে ঢুকে গেলে আকাশও উপরে উঠে গেল। কিন্তু তার মাথার মধ্যে সুচির বলা শেষ কথাগুলো ঘুরতে লাগলো ।
সুচি আর আকাশ আধঘন্টা দেরিতে অফিসে ঢুকলো। সকালে দেরি করার জন্য সুচির বস তাকে বকলেও এখন কিছুই বললো না। এটা সুচি লক্ষ্য করলো। অন্যদিন হলে , এইরকম দেরি হলে তো আস্ত রাখতো না।
সঞ্জয় অফিস থেকে চলে যাওয়ার পর আর আসেনি। বাড়ি ফিরে সে এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলো আর দুই বার গোধূলি কে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলে রাগে ফুসতে লাগলো। মাথা কাজ করছে না তার। গোধূলি গেছে দিদির বাড়িতে। মেয়ের আসার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই এখন। তাই সে মেয়ের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলো । গোধূলির মা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু সঞ্জয়ের রাগ দেখে আর কথা বাড়ায়নি ।
অফিস আওয়ার শেষ হওয়ার প্রায় এক ঘন্টা আগে আকাশ দেখলো যে বাবা বেরিয়ে যাচ্ছে । তাই সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো , “ এখন চলে যাচ্ছো কেন ? „
ছেলের কেনোর উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন , “ হ্যাঁ। তুই বাইকেই আসিস । „ বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।