Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
(লেখক/লেখিকার নাম জানতে পারিনি। তাই নামটা দিতে পারলাম না।)
[Image: 1f49a.png][Image: 1f499.png][Image: 1f49c.png][Image: 2764.png]শুধু একদিন[Image: 2764.png][Image: 1f499.png][Image: 1f49a.png][Image: 1f49c.png]


বাটি থেকে অল্প মাংসের ঝোল নিয়ে শুকনো শুকনো করে ভাত মাখল তিন্নি । আজ একদম খেতে ইচ্ছে করছে না । গোটা বাড়ি জুড়ে কেমন একটা দমবন্ধ ভাব, কেউ কথা বলছে না কারো সঙ্গে । মন খারাপ লাগছিল তিন্নির। মনে হচ্ছে যেন একটা শক্ত বরফের পাহাড় তৈরী হয়েছে ঘরের মধ্যে ।
সপ্তাহের অন্য দিনগুলো তো ঝড়ের মত কাটে। এই রবিবার টাই যা হোক সবার থেকে আলাদা । অন্য দিনগুলোতে তো কলেজ তারপর সেখান থেকে ফিরেই নাচের ক্লাস, ড্রয়িং কলেজ , সাঁতার শেখা । দম ফেলার সময় থাকে না মোটেই। এই রবিবারটাই সব দিনের থেকে আলাদা। এই দিনটার জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকে তিন্নি ।
কি মজার দিন এই রবিবার । দুপুরবেলা হৈ হৈ করে ডাইনিং টেবিলে হাজির হওয়া যায়, বাটিতে মাংস তুলে দিতে দিতে ঘামতেল মাখা ঠামির মুখটা কেমন আলো আলো হয়ে যায় ,সেটা দেখা যায়, দুপুরবেলা ঠামির বুকে মুখ গুঁজে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যায় । রোববারটা তো অন্যদিনের মত নয়, এক্কেবারে আলাদা।
কিন্তু হঠাৎ কেমন বদলে গেছে সবকিছু ।কি থমথমে চারদিক । কান্না পাচ্ছিল তিন্নির ।

খাওয়ার পরে ঠামির ঘরের দিকে যাচ্ছিল তিন্নি আর ঠিক তখনই ডেকে পাঠাল মা। “ তিন্নি , এদিকে এস , কথা আছে ।” মায়ের গলার সেই সহজ সুরটাই উধাও একেবারে। বুক ধুকপুক করছিল তিন্নির । লাস্ট উইকের ম্যাথস টেস্টের মার্কস নিয়ে নিশ্চয়ই এখন বকুনি দেবে মা ।বলবে, “ মন দিলে কিছুই অসম্ভব নয় তিন্নি । আসলে তুমি খুব ইনঅ্যাটেনটিভ হয়ে গেছ । “ খুব ভয় করছিল তিন্নির । মায়ের ঘরের দিকে যেতে যেতে দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটার দিকে তাকাল তিন্নি । কেন যে বাবা তাকে একলা ফেলে এত তাড়াতাড়ি তারার দেশে চলে গেল !!
মায়ের ঘরে ঢুকে অবাক হল তিন্নি। কি অন্ধকার ঘরটা ! সব দরজা , জানালা বন্ধ করে রেখেছে মা । ঘরে আলো , হাওয়া না থাকলে মায়ের ভাল লাগেনা , এটাই তো তিন্নি দেখে এসেছে সারা জীবন। তিন্নির দিকে তাকাল সোনালী । তারপর ,কোনরকম ভূমিকা না করে বলল, “ তোমাকে এখন থেকে কলেজের বোর্ডিংএ থাকতে হবে তিন্নি।। আসলে আ— আ- মি তোমাকে ঠিক ক সময় দিতে পারছি না , মানে অফিসে এত কাজের চাপ । কথা বলতে গিয়ে খেই হারাচ্ছিল সোনালী ।
চোখ ফেটে জল আসছিল তিন্নির । একটা ম্যাথস টেস্টে কম মার্কস পাওয়ার জন্য এতবড় শাস্তি ? শেষ পর্যন্ত বোর্ডিংএ চলে যেতে হবে তাকে !
একটু চুপ করে রইল সোনালী । বোধহয় মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল । “ “আমি চলে গেলে ঠামির কি হবে?” তিন্নির প্রশ্ন শুনে ম্লান হাসল সোনালী । কি অদ্ভুত অচেনা মায়ের হাসিটা । যেন হাসি দিয়ে কান্না ঢাকতে চাইছে মা ।
“ ঠামির জন্যও একটা বোর্ডিংএর ব্যবস্হা করেছি।” “ যাহ্ , তাই আবার হয় নাকি।” এবার হেসে ফেলেছে তিন্নি । “বড়দের বোর্ডিং হয় বুঝি ?”
দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বুক ঠেলে আসা কান্না আড়াল করার চেষ্টা করল সোনালী । তারপর ধরা গলায় বলল, “ না , মানে ঠিকক বোর্ডিং নয় , ওটা একটা ওল্ড এজ হোম। “

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তিন্নি। ওল্ড এজ হোম মানে কি? ওল্ড মানে তো তার অজানা নয়। কিন্তু ঠামি কি ওল্ড হয়েছে নাকি ? মাথায় কয়েকটা সাদা চুল আছে ঠিকই ই কিন্তু কি সুন্দর ঠামি । টুকটুকে গায়ের রঙ, একমাথা চুল। ঠিকক ঠামির গল্পের কেশবতী রাজকন্যার মত। সেই ঠামিকে ওল্ড এজ হোমে চলে যেতে হবে । সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল তিন্নির ।
অনেক কিছু বলার ছিল, বলল না কিছুই। এই নয় বছর বয়সেই সে বুঝে গেছে সব কথা বলতে হয়না, বলা যায়না ।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল তিন্নি । হঠাৎ সোনালী উঠে এসে হাত রাখল কাঁধে । তারপর গলাটাকে যতটা সম্ভব নরম করা যায় সেই চেষ্টা করতে করতে বলল, “ এরপর থেকে আবিরকাকুকে তুমি বাবা বলে ডাকবে কেমন।”
অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তিন্নি। সোনালীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। অস্বস্তি হচ্ছিল সোনালীর । সব থেকে নিকট সম্পর্কের মধ্যে যেন অন্তহীন দুরত্ব তৈরী হয়ে গেল এক নিমেষে। একজনের বুক জুড়ে অন্তহীন অনিশ্চয়তা, অন্যজনের মন জুড়ে অপরাধবোধের প্লাবন ।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বাবার ছবিটার দিকে তাকাল তিন্নি। তারপর বলল, “ আমাকে কবে যেতে হবে মা। “ বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সোনালীর । গলা নামাল অল্প, তারপর বলল” সামনের রোববার ।”
বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল তিন্নি , তারপর ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে করতে বেরিয়ে গেল মায়ের ঘর থেকে।

কি করে আবিরকাকুকে বাবা বলে ডাকবে তিন্নি? আবিরকাকু কি কখনও ওর বাবা হতে পারবে? যাকে তাকে বাবা বলা যায় বুঝি? আর তাছাড়া আবিরকাকুকে ওর মোটেই পছন্দ নয় । কি বিশ্রীরকমের গম্ভীর আবিরকাকু । তিন্নিকে অবশ্য চকোলেট কিনে দেন মাঝেমধ্যেই, বার্বি ডলের সেট ও কিনে দিয়েছেন দুখানা । কিন্তু আবিরকাকু তো বাবার মত নয়। সেই যে বাবা অফিস থেকে এসে তিনু বুড়ি বলে টপটপাটপ হামি খেত , নাকের মধ্যে নাক ঘষতে ঘষতে ,“ দেখ আমার খাঁদু নাকি রাজকন্যে, “ বলে হৈহৈ করে হাসত , এমনটা কেউ পারবে?
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল তিন্নির । মনে মনে হিসেব করল সে । মাঝখানে আর কটা মোটে দিন । তারপরেই আর রোববার দুপুরে ঠামির হাতের মাংস ভাত নেই, গল্প শোনা নেই, দুপুরবেলা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আচার চুরি করে খাওয়া নেই , মায়ের গায়ের গন্ধ নেই । সব চলে যাবে তিন্নির জীবন থেকে। বুকের ভেতরটা খুব ফাঁকা লাগছিল তিন্নির ।
আজকাল রাতে ঘুম আসেনা সহজে । ঘুমের ওষুধেও কাজ হয়না আর। দুপুরবেলা একটু ঘুমোবার চেষ্টা করছিল নিরুপমা। বিকেলে একটু গুছিয়ে নিতে হবে । এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এল ।জামাকাপড় সব বোঝাই করতে হবে সুটকেসে । এত বছরের সংসার ছেড়ে যাওয়া , এত বছরের স্মৃতি । বুকের ভেতরটা যেন শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। কোনকিছুই আর স্পর্শ করেনা তাকে ।ঐ একরত্তি নাতনীটাকে নিয়েই তো এতদিনপুত্রশোক ভোলার চেষ্টা করেছিল নিরুপমা । এবার থেকে তাও থাকবে না আর ।
অমন ফুটফুটে একটা মেয়ে । রাতদিন কেবল বায়না , “ ঠামি গরম গরম লুচি খাব ,ভেজে দাও, ঠামি আমার পুতুলের ড্রেস সেলাই করে দাও, ঠামি গল্প বল , ঠামি মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও।” এই রাগ, তো এই বায়না , এই খিলখিল হাসি ,তো এই কান্না । রাতদিন নাচছে, গাইছে , ছবি আঁকছে , অন্তহীন প্রশ্নের বাণ ছোটাচ্ছে সারাক্ষণ ।
কিন্তু সময় বদলায় , পরিস্হিতি বদলায় ।
তিন্নিকে ঘরে ঢুকতে দেখে হাসল নিরুপমা । বলল, “ পায়েস করেছি। খাবি একটু ?”

মাথা নাড়ল তিন্নি ।কি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা !! নিরুপমার বুকের ভেতরটা টনটন করছিল !
একটু চুপ করে থাকল তিন্নি , তারপর বলল” আচ্ছা ঠামি, আবিরকাকু কি তোমার ছেলে হয়? থমকে গেল নিরুপমা । একটু সামলে নিয়ে বলল, “ হঠাৎ , একথা কেন ? “ “ না , মানে তোমার ছেলে না হলে আমি ওঁকে বাবা বলব কি করে ? “ গুছিয়ে যুক্তি সাজিয়েছে নয় বছরের তিন্নি ।

ম্লান হাসল নিরুপমা । তিন্নি তাকিয়ে ছিল ঠামির দিকে । কি কষ্টমাখা ঠামির হাসিটা । বুকের ভেতর মোচড় পড়ছিল তিন্নির ।” ছেলেই তো, “আবার হাসল নিরুপমা । ও তো তোর বাবার প্রাণের বন্ধু ছিল রে। তাই আমার ছেলের বন্ধু তো আমার ছেলেই হয়।
অবাক লাগছিল তিন্নির । এ তো বড় অদ্ভুত কথা । তার কলেজের অর্ক , মেঘ, নীলাদ্রী সবাই তো তার বন্ধু। পাশের ফ্ল্যাটের গাবলু ও তো তার বন্ধু।তা বলে ওরা সবাই কি ওর মায়ের ছেলে নাকি? সবারই আলাদা মা আছে , বাবা আছে । শুধু আবিরকাকু ঠামির ছেলে হল কি কারণে? নাহ, সব কেমন যেন উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে ।
তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল নিরুপমা । বলল, “এত প্রশ্ন করতে নেই রে। বড় হও , সব নিজেই বুঝবি তখন। “
খুব রাগ হচ্ছিল তিন্নির । বড় কি সে হয়নি । কবেই বড় হয়েছে সে। কেবল এ বাড়ির লোকজন সেটা মানতে চায়না ।
সেদিন টেস্টে কম মার্কস পেয়ে যখন কাঁদছিল সে, তখন ক্লাসের সবাই হাসছিল তাকে দেখে। আয়তাক্ষী তো বলেই ফেলল “এত বড় মেয়ে , ছোটদের মত কাঁদিস , লজ্জা করেনা তোর “। অথচ কি অদ্ভুত ! এরা সবাই তাকে ছোট ভাবে।

সেই যে সেবার । গরমের ছুটিতে গাবলু দাদু দিম্মার বাড়ি যাচ্ছিল বলে কান্না পাচ্ছিল তিন্নির । তার তো দাদু , দিম্মা নেই । শেষ পর্যন্ত বাবাকেই জিজ্ঞেস করেছিল তিন্নি “ সবার মামাবাডি থাকে , আমার কেন নেই বলতো? একটু থমকে গিয়েছিল বাবা । তারপর বলেছিল “ তোমার মা গরীব ঘরের মেয়ে কিনা , তাই তিনি আর সেখানে যান না ।” কথা বলতে বলতে মিচকি মিচকি হাসছিল বাবা ।
গরীব!!! অবাক হয়েছিল তিন্নি। মায়ের কাছে সে শুনেছে কলেজের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ভিক্ষে করে যে বুড়ো মানুষটা সে নাকি খুব গরীব। অত হেঁয়ালী না বুঝে শেষকালে সটান প্রশ্ন করেছিল মা কে “ আচ্ছা মা, আমার দাদু , দিম্মা কি ভিখারী ? “ সেকি!! আঁতকে উঠেছিল মা । তারপর বাবা এসে বলে দিয়েছিল সব কিছু । ব্যস, তারপর মা আর বাবার সে কি হাসি।
তিন্নি অবশ্য থামেনি। পর্দা সরিয়ে সোজা ঢুকে পড়েছে ঠামির ঘরে । তিন্নির প্রশ্ন শুনে ঠামি হাসেনি। বলেছিলেন “ তোমার মা এ বাড়িতে থাকে সেটা তোমার দাদু দিম্মার পছন্দ নয় , তাই তোমার মা আর সে বাড়িতে যায়না । “ বিরক্ত হচ্ছিল তিন্নি । গাবলু, অর্ক , নিশা সবার মা তো অন্য বাড়িতেই থাকে , তবে কেন ......?
“না মানে। “কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেল ঠামি, তারপর বললেন, “ তোমার মা এ বাড়িতে আসার আগে তাঁদের বলতে ভুলে গিয়েছিল কিনা, তাই অভিমান হয়েছে তাদের ।” এত প্রশ্ন করেনা সোনা, বড় হও সব নিজেই বুঝে যাবে ।” কথা না বাড়িয়ে কাজে মন দিয়েছিল ঠামি।

কিন্তু তিন্নি তো বড় হয়েছে ।সে বুঝতে পেরেছিল মায়ের ভুলটা ঠিক কোথায় । না বলে কোথাও চলে যাওয়া তো ঠিক কথা নয় । পাশের ফ্ল্যাটে গাবলুর সঙ্গে খেলতে গেলেও তো তাকে বলেই যেতে হয় ।মাকে বলেছিল সে কথা ।তারপর তাকে নিয়ে সবার সে কি হাসি ।
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে তিন্নির বড় বড় চোখগুলো জলভরা দীঘি হয়ে গেল হঠাৎ । কি সুন্দর ছিল আগের দিনগুলো।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল তিন্নি । ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসছে আকাশে । দূরের পেয়ারা গাছটায় দুটো শালিক পাখি বাসা বাঁধছে । তিন্নির মনে হল পাখিদুটো ঠিক ওর মতন। কদিন পরেই কোথায় উড়ে চলে যাবে ওরা । বুকের ভেতর খুব কষ্ট হচ্ছিল তিন্নির । মাঝখানে আর তিনটে মোটে দিন। রোববার বিকেলেই চলে যেতে হবে। টসটস করে দুচোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল ওর ।
ঝড়ের মতন কাটছিল দিনগুলো । মাঝখানে দুদিন ছুটি নিল সোনালী । মেয়েটাকে তো এভাবে কাছে পাবেনা আর । ভাবনাটা এলেই তোলপাড় হয় বুকের মধ্যে ।
অসময়ে পাশে দাঁড়ানো মানুষটার সুখদুঃখের সঙ্গে কি করে যেন জড়িয়ে গেল হঠাৎ ।
অথচ কিছুই তো মেলেনা আবিরের সঙ্গে । দুজনে যেন দুটো ভিন্ন মেরুর মানুষ । আবির জেদী, অবুঝ। তবু সোনালী ভালবাসল আবিরকে ।ভালবাসা না নির্ভরতা কে জানে ।

অনেক বুঝিয়েছিল সোনালী । তবু বিয়ের পরে আবির ওদের কারো সঙ্গে থাকতে চাইল না । একটু ভয় করছিল সোনালীর । কিছু ভুল হচ্ছে না তো? মাঝেমাঝেই তো আবিরকে ঠিক মনে হয় না ওর । “একা কোথাও যাবেনা, কারো সঙ্গে কথা বলবে না । “সবসময় হম্বিতম্বি । একটু কষ্ট হয় বৈকি সোনালীর । দমবন্ধ হয়ে আসে শাসনে । তবু বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই হল। আবির ই চাপ দিল ভীষণ । দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোনালী । এখনও কেন যে এত ঘর বাঁধার সাধ হয় , কে জানে ।
ধোয়া বাসনপত্র মুছে মুছে গুছিয়ে রাখছিল মণির মা । তিন্নিকে দেখে একগাল হাসল সে । বলল, “ কি গো ছোট গিন্নী, আজ এখানে কি মনে করে? “অন্যদিন ছোটগিন্নী শুনলে রেগে আগুন হয় তিন্নি । এসব নাম তার খুব অপছন্দ । কিন্তু আজ আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল , “ তোমার ছেলেমেয়েদের দূরে পাঠাও না কেন, মণির মা ?” বেশ তো দূরে থেকে বড় হতে পারে তারা ।” হেসে গড়িয়ে পড়ল মণির মা।
বলল, “ সে কি কথা গো, তারা দূরে যাবে কেন? তাদের মুখে ভালমন্দ তুলে দেব বলেই না রাতদিন এত কষ্ট করি ।” মন খারাপ হয়ে গেল তিন্নির ।মায়ের কথাগুলো এখনও কানে বাজছে। কেন যে মা দূরে পাঠিয়ে দিল তাকে ? আর তো সবে কালকের দিনটা । পরশুই তো রবিবার ।
নিজের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে পাদুটো আটকে গেল তিন্নির। ঠামি আর মা কি সব কথা বলছে যেন । অত জোরে কাঁদছে কেন ঠামি ? কান পাতল তিন্নি ।” আমাকে রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে বলনা সোনালী ।দূর থেকে তোমাদের আশীর্বাদ করব তোমাদের । তোমাদের নতুন জীবন সুন্দর হোক, সুখের হোক ।”কথা বলতে বলতে কাঁদছিল ঠাম্মি ।সব গুলিয়ে যাচ্ছিল তিন্নির । রেজিস্ট্রি অফিস টা আবার কি ? মায়ের অফিসের নাম তো আলাদা। তবে ? আর নতুন জীবন কথাটার মানেই বা কি ! কেন কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে ঠামির ? কিছুই বুঝতে পারছে না সে ।সত্যিই বোধহয় এখন ও বড় হয়নি তিন্নি । বাড়ির সবার কথাই বোধহয় সত্যি ।
শনিবার সকালে উঠে ভেবেছিল বাংলা কবিতাটা মুখস্হ করে নেবে। কিন্তু পড়ায় আর মন বসল না । সারাদিন কেমন থম ধরে রইল বাড়িটা । মা সারাক্ষণ চাপা গলায় আবিরকাকুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে গেল । তিন্নির দিকে ফিরেও তাকাল না ।শুধু তিন্নির যখন কাশি হচ্ছিল তখন কপালে হাত ছোঁয়াল একবার । ঠামিও গম্ভীর হয়ে থাকল সারাটা দিন। তিন্নি যে কাল চলে যাবে ,কারো যেন তাতে কিছুই যায় আসেনা ।
রাতে শুয়ে অনেকক্ষণ একাই কাঁদল তিন্নি । কাল রবিবার । কাল বিকেল থেকেই তো বদলে যাবে সবকিছু । এই বিছানাটা থাকবে না, এই পাশবালিশে পা তুলে ঘুমানো থাকবে না, এই ঝকঝকে আলমারী ভর্তি গল্পের বই থাকবে না ।
সোমবার কলেজের পরে যখন নিশা, দেবালীরা হৈ হৈ করে বাড়ি যাবে , তখন তিন্নি হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখবে ওদের । সবার বাড়ি থাকবে ,কেবল ওর বাড়িটাই বদলে যাবে। কত আদর করত মা । সব মিথ্যে । মা , আসলে খুব নিষ্ঠুর ।
বন্ধ চোখটা খুলে চারদিকে তাকিয়ে দেখল তিন্নি । নাহ্, কেউ আসেনি ওর কাছে । কেউ ভালবাসেনা ওকে আর ।

রোববার দিন খুব ভোরে উঠে পড়েছে তিন্নি ।কাল বেঙ্গলী টেস্ট । এখনও কবিতা মুখস্হ হয়নি । লক্ষী মেয়ের মত বই খুলে বসে গেল সে।
হঠাৎ বসার ঘরে আবিরকাকুর গলার আওয়াজ পেয়ে থমকে গেল তিন্নি। এত রেগে কথা বলছে কেন আবিরকাকু ? উঠে গিয়ে কান পাতল তিন্নি । কিন্তু কি সব যে বলছে মা, কিছুই তো বুঝতে পারছে না সে। এগিয়ে গিয়ে ভাল করে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল তিন্নি ।
“ আমার অকালে থমকে যাওয়া জীবন , গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে থাকা জীবনকে আশ্বাসের স্পর্শ দিয়ে বদলে দিয়েছিলে তুমি। তবু ভেবে দেখলাম , যা পেয়েছি তা ও তো কম নয় । জীবন আমায় ভরিয়ে দিয়েছে আবির ।তিন্নিকে ছেড়ে , মাকে দূরে রেখে আমার ভরা জীবন শূণ্য হয়ে যাবে । অমন শূণ্য জীবন আমার চাই না। তুমি ফিরে যাও ।”একটানা কথার পরে খানিকক্ষণ থামল সোনালী ।
কিছুই বুঝতে পারছিল না তিন্নি । তবে ঠামি সবসময় বলেন বড়দের কথা শোনা ঠিক নয় , তাই সে দাঁড়াল না আর । মায়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। কেমন যেন দুগ্গা ঠাকুরের মতন লাগছে মা কে ।
মনটা হাল্কা লাগছিল খুব । মনে হচ্ছিল ঘরের মধ্যে যে বরফের পাহাড় টা ছিল সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে আর তার নীচ থেকে একটা মরা গাছ মাথা তুলেছে হঠাৎ । গাছটা ভর্তি সবুজ পাতা , ডালে ডালে ফুল এসেছে ।কিছু না বুঝলেও , এটুকু সে বুঝেই গেছে আর বোর্ডিং এ যেতে হবে না তাকে ।
রবিবারগুলো আবার আগের মত হবে। মাংস রাঁধবে ঠামি , লাল লাল ঝোলে নরম নরম আলুর বল ভাসবে। ভাত মেখে খাইয়ে দেবে মা ।
বাংলা বই খুলে মন দিয়ে কবিতা মুখস্হ করছিল তিন্নি

সোম মঙ্গল বুধ এরা সব আসে তাড়াতাড়ি
এদের ঘরে আছে বুঝি ,মস্ত হাওয়া গাড়ি
রবিবার সে কেন ,মাগো ,অমন দেরী করে ?
ধীরে ধীরে পৌঁছায় সে সকল বারের পরে
আকাশ- পারে তার বাড়িটি দূর কি সবার চেয়ে ?
সে বুঝি মা তোমার মত গরিব - ঘরের মেয়ে।
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by dada_of_india - 30-12-2021, 08:52 PM



Users browsing this thread: 21 Guest(s)