30-12-2021, 08:46 PM
আটের দশকে জীবনের এক অন্যতম আকর্ষন ছিলো বিয়ে বাড়ীর ভোজ। কেউ নেমন্তন্ন করতে আসলেই শোনার চেষ্টা করতাম বাবা-মা কে কি বলছে। "তোমরা সবাই যাবে কিন্তু", "আপনারা সবাই না এলে খুব কষ্ট পাবো" এসব কথাবার্তার মধ্যেই মনের কোনে ভেসে উঠতো কোন নিরীহ পাঁঠার ব্যা ব্যা আওয়াজ অথবা বড় বড় মাপের রুইয়ের পেটি। জিহ্বা অতিরিক্ত সিক্ত হয়ে উঠত নিজের অজান্তেই।
গ্রাম এবং মফস্বলের মাঝামাঝি জায়গার মানুষ আমরা তাই আটের দশকে আমাদের এলাকার মহিলারা বিউটি পার্লারে যাওয়া তো দূরের কথা সেসবের নামই হয়তো শোনেননি। এলাকার সবচেয়ে স্টাইলিস্ট মহিলারা কনে সাজানোর দায়িত্ব নিতেন। অবশেষে চলে আসতো সেই বহু প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা। সকালে তরকারি দিয়ে দুটো রুটি আর দুপুরে টলটলে মুসুর ডাল, লেবু আর বেগুনভাজা দিয়ে স্বল্প পরিমানে ভাত। এ এক অদ্ভুত কৃচ্ছসাধন। রাতের জন্য পেটে জায়গাটা রাখতে হবে যে!
বিয়ে বাড়ীর অন্দরসজ্জায় কোনোও আগ্রহ ছিলনা বরং কতক্ষনে খেতে বসবো সেই চিন্তায় বিভোর থাকতাম। মা ভেতরে বউ দেখার ফাঁকে সামাজিকতাটাও সেরে ফেললেন। কিছু সময় পর গৃহকর্তা জোড়হাতে সামনে এসে বললেন "এবার তাহলে আপনারা বসে যান"। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে এগিয়ে গেলাম খাবার জায়গায়। আমাদের কোনোও লজ্জ্বা ছিলনা। আর একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয় যে তখন কিন্তু আমাদের অঞ্চলে টিফিনের নামে অতিথিদের চিকেন পকোড়া, কফি, চা, ফুচকা ইত্যাদি খাইয়ে খিদে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র আমদানি হয়নি।
২০ ইঞ্চি চওড়া এবং ৬ ফুট লম্বা পাতলা তক্তার নীচে ইংরাজী A অক্ষরের এর মত দুটো স্ট্যন্ড নিয়ে বেশ নড়বড়ে টেবিল আর কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। ঠিকভাবে চেপে না বসলে দুর্ঘটনা ঘটে অপদস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। পুরানো খবরের কাগজ বিছিয়ে দেওয়া হল আমাদের সেই নড়বড়ে টেবিলের উপর। আমার সামনে পড়েছে আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপনের পাতা যাতে "অনুরাগের ছোঁয়া" ছবির বিজ্ঞাপন রয়েছে। কেউ পেতে দিল জলে ধোওয়া কলাপাতা আবার কেউ বসিয়ে গেল শঙ্কু আকৃতির মাটির জলের গ্লাস যেটা টেবিলটার মতই নড়বড় করছে। গাঢ় সবুজ কলাপাতার কোনায় আকাশের তারার মত চিক করে ফুটে উঠলো নুন এবং পাতিলেবু। তখনও মফস্বলি বাঙালির রসনায় স্যালাডের আমদানি হয়নি। পাড়ার ছেলেরাই এলুমিনিয়ামের বালতির থেকে চিনামাটির প্লেটে করে তুলে ভাত পরিবেশন শুরু করলো। এরপরে এলো মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল আর বেগুন ভাজা। আহা কি স্বাদ! বাবার সাইলেন্ট ওয়ার্নিং, "এসব দিয়ে বেশী খেলে পেটে মাছ-মাংস খাবার যায়গা থাকবে না"। এসেছে চিংড়ী দিয়ে ইঁচড়ের তরকারি যা আমার ভীষন প্রিয়। সেটাও মেপেজুপেই খেলাম। এবার মিষ্টির দোকানের শোকেসে যেরকম ট্রে দেখা যায় সেরকম ট্রে তে করে এল মশলা মাখা বড়বড় মাছের পিস এবং আলাদা বালতিতে ঝোল আলু। চারটে বেশ বড় সাইজের পিস নিয়ে একটু একটু করে ভেঙে মুখের মধ্যে পুরে তার স্বর্গীয় স্বাদ আস্বাদন করছি আর বাকি পিস গুলোর উপর লেবুর রস ছড়িয়ে দিচ্ছি যাতে মুখের রুচি বজায় থাকে। মাছের পালা খতম হতে না হতেই খাসির মাংসের আবির্ভাব। পরিবেশনকারীদের চোখমুখও যেন এই সময় যথেষ্ট সিরিয়াস হয়ে উঠতো। ভাত নিলাম আর একবার। ঝরঝরে সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাতের চূড়ার উপর দিয়ে যখন মাংসের ঝোলের হিমবাহ নেমে আসে সেই দৃশ্য বর্ননা করতে হলে কাব্যিক জ্ঞান থাকা ভীষণ জরুরী। সুসিদ্ধ খাসির মাংস ঝোল আর ভাতে মাখিয়ে যখন মুখে দিলাম মনে হল মানব জীবন সার্থক। তাছাড়া খাসির মাংসের মধ্যে একটা আহ্লাদী পিচ্ছিল ভাব আছে যা আপনারা ওই চিকেনে কোনোওদিনই পাবেন না। ঝোলের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা চোকলা সহ আলুর পিস গুলিও কোনও এক অজানা মন্ত্রবলে হয়ে উঠতো দেবভোগ্য। মাংসের এপিসোড হত সবচেয়ে দীর্ঘ। কেউ কেউ অবলীলায় প্রায় কেজিখানেক উড়িয়ে দিতেন। মাংস শেষ করে যখন পাঁপরভাজায় চাটনী মাখাচ্ছি তখন অনেকেই আলোচনা করতে শুরু করেছেন কিভাবে রসগোল্লা বেশী খাওয়া যায়। একজন এক্সপার্ট তো বলেই দিলেন রস চিপে বের করে দিলে রসগোল্লা বেশী খাওয়া সম্ভব না। জমাট বাঁধা দইয়ের দুটো খন্ড পাতে পড়ার পরে আঙুলে ভেঙে যখন মুখে তুলছি ততক্ষনে মাঠে রসগোল্লা এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে। ১১ পিস খেয়েছিলাম মনে আছে। হাতে মিষ্টিপান নিয়ে খাবার আসর ছেড়ে যখন কলতলার দিকে এগোই হাত ধোবার জন্য, তখন বিয়েবাড়ীকে যথেষ্টই ম্লান লাগতে শুরু করেছে। গৃহকর্তা কৃতজ্ঞচিত্তে বাবাকে অনুষ্ঠানে আসার জন্য ধন্যবাদ দেন, মা চলে আসার আগে আর একবার নুতন বৌকে দেখতে যান, আর আমার চোখ চলে যায় প্যান্ডেল আলো করে বসে থাকা কিশোরীদের দিকে। এক অজানা ভালোলাগা থাকে সেই দেখার মধ্যে।
লেখাটা ছোট বেলার কথা মনে পড়িয়ে দিলো
সংগৃহীত ...
গ্রাম এবং মফস্বলের মাঝামাঝি জায়গার মানুষ আমরা তাই আটের দশকে আমাদের এলাকার মহিলারা বিউটি পার্লারে যাওয়া তো দূরের কথা সেসবের নামই হয়তো শোনেননি। এলাকার সবচেয়ে স্টাইলিস্ট মহিলারা কনে সাজানোর দায়িত্ব নিতেন। অবশেষে চলে আসতো সেই বহু প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা। সকালে তরকারি দিয়ে দুটো রুটি আর দুপুরে টলটলে মুসুর ডাল, লেবু আর বেগুনভাজা দিয়ে স্বল্প পরিমানে ভাত। এ এক অদ্ভুত কৃচ্ছসাধন। রাতের জন্য পেটে জায়গাটা রাখতে হবে যে!
বিয়ে বাড়ীর অন্দরসজ্জায় কোনোও আগ্রহ ছিলনা বরং কতক্ষনে খেতে বসবো সেই চিন্তায় বিভোর থাকতাম। মা ভেতরে বউ দেখার ফাঁকে সামাজিকতাটাও সেরে ফেললেন। কিছু সময় পর গৃহকর্তা জোড়হাতে সামনে এসে বললেন "এবার তাহলে আপনারা বসে যান"। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে এগিয়ে গেলাম খাবার জায়গায়। আমাদের কোনোও লজ্জ্বা ছিলনা। আর একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয় যে তখন কিন্তু আমাদের অঞ্চলে টিফিনের নামে অতিথিদের চিকেন পকোড়া, কফি, চা, ফুচকা ইত্যাদি খাইয়ে খিদে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র আমদানি হয়নি।
২০ ইঞ্চি চওড়া এবং ৬ ফুট লম্বা পাতলা তক্তার নীচে ইংরাজী A অক্ষরের এর মত দুটো স্ট্যন্ড নিয়ে বেশ নড়বড়ে টেবিল আর কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। ঠিকভাবে চেপে না বসলে দুর্ঘটনা ঘটে অপদস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। পুরানো খবরের কাগজ বিছিয়ে দেওয়া হল আমাদের সেই নড়বড়ে টেবিলের উপর। আমার সামনে পড়েছে আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপনের পাতা যাতে "অনুরাগের ছোঁয়া" ছবির বিজ্ঞাপন রয়েছে। কেউ পেতে দিল জলে ধোওয়া কলাপাতা আবার কেউ বসিয়ে গেল শঙ্কু আকৃতির মাটির জলের গ্লাস যেটা টেবিলটার মতই নড়বড় করছে। গাঢ় সবুজ কলাপাতার কোনায় আকাশের তারার মত চিক করে ফুটে উঠলো নুন এবং পাতিলেবু। তখনও মফস্বলি বাঙালির রসনায় স্যালাডের আমদানি হয়নি। পাড়ার ছেলেরাই এলুমিনিয়ামের বালতির থেকে চিনামাটির প্লেটে করে তুলে ভাত পরিবেশন শুরু করলো। এরপরে এলো মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল আর বেগুন ভাজা। আহা কি স্বাদ! বাবার সাইলেন্ট ওয়ার্নিং, "এসব দিয়ে বেশী খেলে পেটে মাছ-মাংস খাবার যায়গা থাকবে না"। এসেছে চিংড়ী দিয়ে ইঁচড়ের তরকারি যা আমার ভীষন প্রিয়। সেটাও মেপেজুপেই খেলাম। এবার মিষ্টির দোকানের শোকেসে যেরকম ট্রে দেখা যায় সেরকম ট্রে তে করে এল মশলা মাখা বড়বড় মাছের পিস এবং আলাদা বালতিতে ঝোল আলু। চারটে বেশ বড় সাইজের পিস নিয়ে একটু একটু করে ভেঙে মুখের মধ্যে পুরে তার স্বর্গীয় স্বাদ আস্বাদন করছি আর বাকি পিস গুলোর উপর লেবুর রস ছড়িয়ে দিচ্ছি যাতে মুখের রুচি বজায় থাকে। মাছের পালা খতম হতে না হতেই খাসির মাংসের আবির্ভাব। পরিবেশনকারীদের চোখমুখও যেন এই সময় যথেষ্ট সিরিয়াস হয়ে উঠতো। ভাত নিলাম আর একবার। ঝরঝরে সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাতের চূড়ার উপর দিয়ে যখন মাংসের ঝোলের হিমবাহ নেমে আসে সেই দৃশ্য বর্ননা করতে হলে কাব্যিক জ্ঞান থাকা ভীষণ জরুরী। সুসিদ্ধ খাসির মাংস ঝোল আর ভাতে মাখিয়ে যখন মুখে দিলাম মনে হল মানব জীবন সার্থক। তাছাড়া খাসির মাংসের মধ্যে একটা আহ্লাদী পিচ্ছিল ভাব আছে যা আপনারা ওই চিকেনে কোনোওদিনই পাবেন না। ঝোলের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা চোকলা সহ আলুর পিস গুলিও কোনও এক অজানা মন্ত্রবলে হয়ে উঠতো দেবভোগ্য। মাংসের এপিসোড হত সবচেয়ে দীর্ঘ। কেউ কেউ অবলীলায় প্রায় কেজিখানেক উড়িয়ে দিতেন। মাংস শেষ করে যখন পাঁপরভাজায় চাটনী মাখাচ্ছি তখন অনেকেই আলোচনা করতে শুরু করেছেন কিভাবে রসগোল্লা বেশী খাওয়া যায়। একজন এক্সপার্ট তো বলেই দিলেন রস চিপে বের করে দিলে রসগোল্লা বেশী খাওয়া সম্ভব না। জমাট বাঁধা দইয়ের দুটো খন্ড পাতে পড়ার পরে আঙুলে ভেঙে যখন মুখে তুলছি ততক্ষনে মাঠে রসগোল্লা এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে। ১১ পিস খেয়েছিলাম মনে আছে। হাতে মিষ্টিপান নিয়ে খাবার আসর ছেড়ে যখন কলতলার দিকে এগোই হাত ধোবার জন্য, তখন বিয়েবাড়ীকে যথেষ্টই ম্লান লাগতে শুরু করেছে। গৃহকর্তা কৃতজ্ঞচিত্তে বাবাকে অনুষ্ঠানে আসার জন্য ধন্যবাদ দেন, মা চলে আসার আগে আর একবার নুতন বৌকে দেখতে যান, আর আমার চোখ চলে যায় প্যান্ডেল আলো করে বসে থাকা কিশোরীদের দিকে। এক অজানা ভালোলাগা থাকে সেই দেখার মধ্যে।
লেখাটা ছোট বেলার কথা মনে পড়িয়ে দিলো
সংগৃহীত ...