27-12-2021, 09:40 AM
এতোটা শোনার পরেই সুচি রেগে গেলো। ওই সঞ্জয় নামক লোকটার উপর তো ওর ছোটবেলা থেকে রাগ। সঞ্জয়ের জন্যেই দিম্মার মাথা নিচু হয়ে ছিল। তাতে সুচির হাত ছিল এটা সত্য। কিন্তু সুচি যা করেছিল তা ওই সঞ্জয়ের কীর্তিকলাপের জন্যেই। তাই আকাশের কথার মাঝে সে বিরক্ত হয়ে বললো , “ থাক । আর শুনতে চাই না । „
আকাশ বুঝতে পারলো না কিছু , “ কি হলো ? „
“ কিছু না । ছাড়। „ বলে আকাশের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে আসতেই সে আকাশের মায়ের মুখোমুখি হয়ে গেল। ‘ কাকি এখন তার হবু শাশুড়ি। , এটা মাথাতে আসতেই লজ্জায় সুচির গাল লাল হয়ে উঠলো। দৌড়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এলো।
সুচিকে ওইভাবে লজ্জা পেয়ে চলে যেতে দেখে স্নেহা দেবী বললেন “ বোকা মেয়ে একটা। „ কথাটা আকাশের বাবা ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না। তিনি তখন ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবে উঠেছেন।
ঘরের বাইরে যেতেই সুচি ভাবলো , ‘ আকাশ যে মিথ্যা বলছে না সেটা নিশ্চিত । কিন্তু আরও নিশ্চিত হতে হবে তাকে। কাকে জিজ্ঞাসা করা যায় ভাবতেই মাথাতে এলো নিজের মায়ের কথা। ,
এটা ভেবেই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে সুচি দেখলো যে তার মা বাবার খাওয়া এঁটো থালা ধুচ্ছে। সে পিছন থেকে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো , “ মা । „
সুচির মা প্রথমে চমকে গেছিলেন। কতদিন পর তার মেয়ে তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরলো। সুচির “ মা „ ডাকে যে একটা জিজ্ঞাসা আছে সেটা বুঝতে পেরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? „
সুচি ভীষণ লজ্জা পেতে লাগলো , “ কালকে তোমরা গেছিলে ? „
সুচির মা বুঝতে পারলেন যে মেয়ে কি জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু তিনি মেয়ের সাথে এতোদিন পর মজা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। তাই তিনি অবুঝের মতো জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোথায় ? „
কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো সুচির , “ আকাশের মা বাবার কাছে । „
“ হ্যাঁ গেছিলাম । কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছিস সেটা তো বল ? „
এতোটা শোনাই যথেষ্ট , “ না , কিছু না । „ বলে সুচি চলে যেতে চাইলো। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। নিজের মা কে কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে যে , ‘ তোমরা কি আমার বিয়ের কথা বলতে গিয়েছিলে ? ,
সুচির চলে যাওয়া দেখে সুচেতা দেবী বুঝলেন যে তার মেয়ে লজ্জা পেয়েছে। তাই তিনি সুচির হাত ধরে আঁটকালেন। সুচি তার দিকে ফিরলে তিনি সুচির কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন , “ ওরা রাজি হয়ে গেছে তোর বিয়ের জন্য। আজকে পুরোহিত আসবে তারিখ ঠিক করতে। „
সুচি আর থাকতে পারলো না। দৌড়ে নিজের ঘরে এসে খাটের উপর প্রায় আছড়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। তারপর বিছানার এদিক ওদিক করতে করতে লাগলো । নিজে থেকেই হেসে উঠে লজ্জা পেতে লাগলো।
হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল রাত পর্যন্ত তার জীবনে এক অমাবস্যার অন্ধকার গ্রাস করে ছিল। আজকে নতুন সূর্য উঠে তার জীবনের প্রতিটা কোনায় আলোর রশ্মি ছড়িয়ে দিল। একে এক সব কথা মনে করতে শুরু করলো সে। আকাশকে দিদির বোঝানো। তারপর কথা বন্ধ করে দেওয়া। কলেজের ফাংশনে গিয়ে পলাশের সাথে পরিচয়। তারপর গোধূলির আকাশকে গোলাপ দেওয়া। তাই রেগে গিয়ে পলাশের সাথে ডেটে যাওয়া। তারপর তো ....
আর ভাবতে পারলো না সুচি। পলাশের উপর রাগে মুখটা বজ্রের মতো শক্ত হয়ে উঠলো। আর সাথে আকাশের উপরও খুব রাগ হলো। কেন সে গোলাপটা নিতে গেল ? ওই জন্যেই তো সে পলাশের সাথে ডেটে গেছিল। এমনকি এক মূহুর্তের জন্য বিছানায় যেতে ...
ভাবতেই রাগ আরও বেড়ে গেল । সব হয়েছে আকাশের জন্য । গোলাপটা না নিতেই পারতো। সে আকাশকে একটা শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। , ‘ ওকে শাস্তি দিতে হবে। কি দেওয়া যায় ? কি দেওয়া যায় ? হ্যাঁ... ও গোলাপ নিয়েছিল। আজকে আমাকে গোলাপ দিয়েই প্রোপজ করতে হবে। তাও অফিসের সবার সামনে। ,
এটা ভাবতেই সঙ্গে সঙ্গে আকাশকে ফোন করতে গেল । এতদিন ধরে আকাশকে ফোন না করার জন্য কললিস্টের একদম নিচে আকাশের নাম্বার চলে গেছে । কললিস্টে খোঁজার পর ডাইরেক্ট কনটেক্ট লিস্ট গিয়ে প্রথমেই আকাশের নাম্বার দেখতে পেল। আকাশের নাম A দিয়ে শুরু হওয়ায় ওর নাম্বারটাই প্রথমে আছে।
আকাশ তখন জামা আর ফুল প্যান্ট খুলে স্নানে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। ফোন বেজে উঠতেই ফোনটা হাতে নিয়ে সে সুচির নামটা দেখতে পেলো। ফোনটা তুলে কলটা রিসিভ করে জিজ্ঞাসা করলো , “ বল। „
সুচি সরসরি বললো , “ তোকে আজ আমাকে প্রোপজ করতে হবে । „
আকাশ মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না , “ মানে ? „
“ মানে টানে কিছু জানি না । তুই ওই মেয়েটার কাছ থেকে গোলাপ নিয়েছিলি , তাই এটা তোর শাস্তি। আজ তুই আমাকে প্রোপজ করবি। তাও আবার অফিসের সবার সামনে। „
আকাশ বুঝতে পারলো না যে এখন প্রোপজের কি দরকার ? বাবা মা জেঠা জেঠি সবাই তো বিয়ের জন্য রাজি। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ এটার আবার কি দরকার ? সবাই তো রাজি হয়ে গেছে । „
“ রাজি হলে হলো। তুই প্রোপজ করবি। ব্যাস। „ বলে ফোনটা কেটে দিয়ে সুচি আবার বিছানার এপাশ ওপাশ করতে লাগলো । কিছুক্ষণ পর অফিস যেতে হবে এটা মাথাতে আসতেই সে স্নানে চলে গেল ।
এদিকে আকাশ ফোনটা হাতে নিয়েই খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লো। এ কেমন মেয়ে ? এতদিন পর যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তখন প্রোপজের কি দরকার ? সবাইকে কি জানাতে চায় যে আমাদের বিয়ে হচ্ছে ? শুধু একটা গোলাপ নিয়েছি বলে এতো বড়ো একটা শাস্তি দেবে ? গোলাপ নেওয়ার কারন তো বলেছি। তবে এইসবের কি দরকার ?
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রোপজ করতেই হবে , এছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। সেটা আকাশ বুঝতে পারলো। তাই সে প্রোপজ করার পদ্ধতি ভাবতে লাগলো , ‘ প্রোপজ করার জন্য কি বলবো ? প্রথমে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া কিংবা আংটি হাতে নিয়ে একটা হাটু ভেঙে মাটিতে রেখে বলতে হবে.... কি বলতে হবে ? প্রথমে আংটি দরকার। ,
“ হ্যাঁ , ওই আংটি। মনে পড়েছে । „ বলে ড্রয়ার থেকে সেই মেলায় কেনা আংটিটা বার করলো। আংটি হাতে নিয়ে কতো কিছু ভাবতে শুরু করলো সে। তারপর খালি গায়ে কি বলে প্রোপজ করবে । সেটাই লিখতে বসলো।
এদিকে আকাশের বাবা খেয়ে দেয়ে অফিসের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসে আকাশের ঘরে উকি মেরে দেখলেন যে আকাশ খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পড়ে কিছু একটা লিখতে ব্যাস্ত , “ অফিস যাবি না ? „
আকাশ খাতার পাতা থেকে মুখ না তুলেই বললো , “ আমি বাইকে যাবো। তুমি চলে যাও গাড়ি নিয়ে । „
ছেলের কথা শুনে তিনি সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলেন। জাগুয়ারটা নিচেই পার্ক করা আছে। তাতে চড়ে বসে স্টার্ট দিয়ে সোসাইটির বাইরে চলে এলেন। কিছুদূর আসতেই দেখতে পেলেন সুচির বাবা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চিন্তিত মুখে একটা গলি থেকে বার হচ্ছে । কাঁধে তার অফিস ব্যাগ আর টিফিন কৌটো। তিনি গাড়িটা সুচির বাবার সামনে থামিয়ে , মুখটা কচ্ছপের মতো জানালা থেকে বার করে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এখন কোথায় গেছিলি ? „
আকাশের বাবাকে দেখে সুচির বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এতক্ষণ যে চিন্তার ছাপ তার মুখে ছিল সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে গিয়ে , সামনের সিটের দরজা খুলে আকাশের বাবার পাশে বসে পড়লেন। তারপর গলার স্বরে চরম ব্যাস্ততা ফুটিয়ে তুলে বললেন , “ চল , চালা । আজ ড্রপ করে দে আমায় । না হলে দেরি হয়ে যাবে। „
আকাশের বাবা গাড়ি চালিয়ে দিয়ে বললেন , “ কোথায় গেছিলি সেটা এখনও বললি না । „
“ রাধানাথদার কাছে। আজ সন্ধ্যায় আসতে বলেছি বিয়ের দিনখন ঠিক করার জন্য। „
কালকে পাকাপাকি কথা হলো আর আজকেই পুরহিত ডাকাও হয়ে গেল। এতো তাড়া দেখে আকাশের বাবা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এতোক্ষণ কি করছিলি ? „
“ আর বলিস না । গেছিলাম প্রায় আধঘন্টা আগে। গিয়ে বসতেই চা খেতে দিল। তারপর শুরু করলো নিজের দুঃখের কাহিনী। ওর একমাত্র ছেলে পূজা করে না। তাই নিয়ে আধা ঘন্টা কথা বললো। আমিও আর উঠলাম না । বুড়ো হয়ে গেছে। কথা বলার লোক চাই। ভাবছিলাম আজ অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে। তোকে পেয়ে গেলাম । চিনিস তো আমার অফিসের রাস্তা ? „
আকাশের বাবা চুপচাপ সব শুনে বললেন , “ চিনি। হ্যাঁ বুড়ো হয়ে গেছেন । „ তারপর তিনি দেখলেন যে সুচির বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন । সুচির বাবার হাসি দেখে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? হাসছিস কেন ? „
ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমির হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সুচির বাবা বললেন , “ তোর জুলফি। চুল। সাদা হতে শুরু করেছে। „
“ আমার চুলের রং না দেখে নিজের দেখ। তোর মাথাতে তো ফুটবল খেলা যাবে । কটা চুল আছে তা গুনে বলা যাবে। „
সুচির বাবা বললেন , “ সময় কতো তাড়াতাড়ি চলে গেল। „
কথাটা শুনে আকাশের বাবা গুম মেরে গেলেন। সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। একটা ভুল বোঝাবুঝি তাদের সবার জীবন থেকে কতগুলো বছর কেড়ে নিয়ে চলে গেল। কালো জাদু করেও সেই বছর গুলো ফিরিয়ে আনা যাবে না। সত্যি বলতে কি কেউ সেই বছর গুলো ফিরে পেতে চায় ও না। তাহলে যে আকাশ সুচির সুন্দর মিষ্টি ছোটবেলা টা তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হবে।
সুচি স্নান করে , খেয়ে দেয়ে , মেকআপ করে একটা জিন্স আর একটা সাদা শার্ট পড়ে আকাশকে ফোন করলো। আজ নিজের স্কুটিতে না গিয়ে আকাশের বাইকেই যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠলো।
আকাশ আধ ঘন্টা ধরে কিভাবে প্রোপজ করা যায় সেটা কাগজে লিখছিল । এর মাঝে বারকয়েক আকাশের মা এসে আকাশকে স্নানে যেতে বলায় সে বাধ্য হয়ে স্নান করে এসে , খেয়ে দেয়ে , জামা প্যান্ট পড়ে আবার লিখতে বসলো। বেশি বড়ো না আবার ছোটও না। কয়েক লাইনে কবিতার মতো কিছু একটা বলে প্রোপজ করতে হবে। বেশি লম্বা হলে সেটা বোরিং হয়ে যাবে। আবার ছোট হলে দায় সারা দেখাবে। তাই ছয় সাত লাইনের মধ্যে যা বলার তা বলতে হবে। আর এটা লিখতেই যে তাকে এতো কষ্ট করতে হবে সেটা সে ভাবে নি।
সুচির ফোন আসতে তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। ফোনটা ধরে সে বললো , “ বল । „
সুচি --- কোথায় তুই ? অফিস চলে গেছিস নাকি ?
আকাশ --- না কেন ?
সুচি --- আজ তোর বাইকে যাবো তাই। বার হ তাড়াতাড়ি।
আকাশ --- আমার হয়ে গেছে। তুই নিচে দাড়া। আমি আসছি এক্ষুনি।
সুচি --- ঠিক আছে। বলে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো।
আকাশও তড়িঘড়ি কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে নিচে নেমে এলো। সুচিকে দেখে বললো , “ আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে । „
“ ও। অন্য দিন খারাপ দেখতে লাগে বুঝি । „
“ অন্য দিনের কথা জানি না। কিন্তু আজ তুই আমার হবু বউ। তাই একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তোকে । „
সুচি দাঁতে দাঁত পিষে নিজের হাসি সংবরণ করলো। সাথে লজ্জা পেল সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো , “ থাক । অনেক হয়েছে। প্রোপজ করার কথা মনে আছে তো ! „
“ হ্যাঁ । এইদেখ। „ বলে পকেট থেকে একটা ভাজ করা পৃষ্ঠা বার করে সুচিকে দেখালো।
সুচি বুঝতে পারলো যে সে লিখে এনেছে। তাই পৃষ্ঠাটা ছিড়ে ফেলার ইচ্ছা হলো। ‘ একবার প্রোপজ করবে আর হাবভাব যেন বাঘ শিকার করতে যাচ্ছে ! , কিন্তু নিজেকে সামলে পৃষ্ঠাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে সে বললো , “ নিজে থেকে বলবি। কোন কাগজ দেখা চলবে না । „
আকাশ অবাক হয়ে রেগে গিয়ে বললো , “ ওটা আমিই লিখেছিলাম । „ এতো কষ্ট করে লেখা । এইভাবে জলে যাবে সবকিছু সেটা সে ভাবেনি।
“ হ্যাঁ , তুই নিজেই তো বলবি। যা মনে আছে তাই বলবি। কিন্তু ওখানে গিয়ে কোন কাগজ দেখা চলবে না। চল , চল , কথা বাড়াস না। দেরি হয়ে যাবে। „
আকাশ পরাজয় স্বীকার করে বাইকে উঠে , মাথায় হেলমেট গলিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দিল। সুচি বাইকে উঠে আকাশকে জড়িয়ে ধরতেই আকাশ আস্তে করে ক্লাচ ছেড়ে দিল।
সুচির নতুন স্কুটি বোবা হয়ে দেখতে লাগলো কিভাবে তার মালকিন ওই ছেলেটার বাইকে উঠে , ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে , তাকে একা ফেলে দিয়ে চলে গেল।
কিছুদূর যাওয়ার আকাশ অফিস যাওয়ার রাস্তা না ধরে আর একটা রাস্তা ধরলো। সেটা দেখে সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ কোথায় যাচ্ছিস ? অফিস তো উল্টো দিকে। „
“ হ্যাঁ জানি। আগে একটা জায়গায় যাবো। „
“ কোথায় ? „
“ গেলেই বুঝবি । „
সুচি চুপ মেরে গেল। কিন্তু কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা দোকানের সামনে থামতেই সুচি দেখলো যে সেটা একটা গয়নার দোকান। উপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে বাংলায় লেখা “ গীতাঞ্জলি জুয়েলার্স। „ আকাশ রাস্তার এক ধারে বাইক পার্ক করতেই সুচি নেমে গেল। আকাশও চাবি খুলে বাইক থেকে নেমে গেল। আকাশ নামতেই সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ এখানে কি ? „
“ চল না। „ বলে দরজা ঢেলে ভিতরে ঢুকে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে একজন নমস্কার করে অভ্যর্থনা জানালো। তারপর একটা কাউন্টারে গিয়ে আকাশ এক শাড়ি পরিহিত মহিলাকে বললো , “ আংটি দেখান । „
তারপর মহিলা আকাশকে জিজ্ঞাসা করে তার পছন্দ জানতে চাইলে আকাশ সুচির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো , “ তোর কেমন পছন্দ ? „
সুচি অবাক হয়ে থতমত খেয়ে বললো , “ আমার । „
“ তোর জন্যেই তো কিনছি । আর হ্যাঁ ..... বলে পকেট থেকে সেই মেলায় কিনে দেওয়া আংটিটা বার করে , সুচির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “ একটা নতুন কিনে দিবি। এটা আর পড়া যায় না। ছোট হয়ে গেছে। „
আংটিটা দেখে এবং চিনতে পেরে সুচির চোখে জল চলে এলো। এটা সেই আংটি যেটা মেলায় সে আকাশকে পছন্দ করে দিয়েছিল। সেই আংটিটা এখনও আকাশ সামলে সযত্নে রেখে দিয়েছে দেখে সুচির একটা আলাদা ভালোলাগা পেয়ে বসলো। এরকম অনুভূতি কতো বছর ধরে হয়নি সেটা সুচি গোনেনি। আগে যখন আকাশ তার জন্মদিনে কিছু একটা কিনে দিতো তখন এইরকম অনুভূতি হতো। আর আজকে হচ্ছে। নতুন করে জীবনের মিষ্টি সৌন্দর্য উপভোগ করতে শুরু করলো সুচি।
মনে হচ্ছে যেন এখানেই আকাশকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে নিতে। কিন্তু আর না। নিজের অনুভূতি গুলো নিজেকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এইসব অনুভূতি গুলোর অত্যাধিক বা বাঁধন ছাড়া বহিঃপ্রকাশ-ই তার জীবনের সর্বনাশের কারন হয়েছে এটা সুচির কাছে স্পষ্ট। তাই চোখের কোনায় লেগে থাকা জল মুছে নিয়ে আকাশের বাড়িয়ে দেওয়া আংটিটা নিয়ে নিল। তারপর মনে মনে বললো , ‘ হ্যাঁ। নিজের টাকায় তোকে এর থেকেও সুন্দর আসল সোনার আংটি কিনে দেবো। ‚ তারপর কাউন্টারের মহিলার উদ্দেশ্যে বললো , “ বেশি মোটা না। হাল্কা সরু। „ তারপর নিচের বাক্সের বিভিন্ন আংটির মধ্যে থেকে একটা আংটি দেখিয়ে বললো , “ এরকম । „
আকাশ জিজ্ঞাসা করলো , “ এটা তোর পছন্দ ? „
“ হ্যাঁ , এটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। „
আকাশ একবার আংটিটা দেখলো। সরু আর মাথায় একটা ছোট ফুলের মতো ডিজাইন। তাতে চারটে ফুলের পাপড়িও আছে। আংটি দেখে কাউন্টারের মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলো , “ কত দাম ? „
মহিলা বললো , “ এটার দাম স্যার আজকের মার্কেট অনুযায়ী বারো হাজার পাঁচশো নিরানব্বই । আজকে পঞ্চাশ টাকা কমে গেছে। তাই আপনারা খুব সস্তায় পেয়ে যাচ্ছেন . ....
মহিলার কথার মাঝে আকাশ বললো , “ ওকে। একবার এর আঙুলের সাইজে হচ্ছে কি না দেখে নিন । „
সুচি অশ্রুসিক্ত নয়নে আঙুল বাড়িয়ে দিলে মহিলা তার অনামিকাতে আংটি পড়াতে চেষ্টা করলো। প্রথম চেষ্টাতেই ঢুকে গেল। পুরো পার্ফেক্ট সাইজ।
আকাশ বললো , “ তাহলে দিয়ে দিন। „
আংটি কিনে চেক-এ পেমেন্ট করে দিল সে। তারপর বাইরে বার হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ কাঁদছিলি কেন ? „
“ কিছু না । তুই বুঝবি না। „
আকাশ কিছুক্ষণ উদাসীন দৃষ্টিতে সুচির দিকে তাকিয়ে থেকে বাইকে উঠে পড়লো। এই মেয়েটার সাথে ছোটবেলা থেকে একসাথে আছে। তবুও এই মেয়েটার মন সে বুঝতে পারলো না। আর কখনো বুঝতে পারবে কি না সেটাই সন্দেহ।
মাথায় হেলমেট গলানোর আগে সুচির নরম কোমল ঠোঁটের স্পর্শ নিজের গালে অনুভব করলো। পিছনে ঘুরে তাকানোর আগে সুচি তাকে জড়িয়ে ধরে বললো , “ চল। অফিস যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। „
“ সে তো এমনিতেও হয়েছে। „ বলে হেসে নিয়ে বাইক চালিয়ে দিল। বাইক কেনার পর আজ প্রথম সুচি ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছে। আর কোন বাধা নেই ওদের মধ্যে । এখন সুচি আকাশের। আকাশ সুচির। আকাশ নিজের পিঠে সুচির কোমল শরীরের ছোঁয়া নিয়ে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিয়ে অফিসের দিকে চললো।
মাঝ রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে সুচি আকাশের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ তুই কাকার ছেলে । এটা কি তোর যোগ্যতা ? নাকি তোর কলেজের MBA ডিগ্রিটা তোর যোগ্যতা ? কোনটাকে তুই নিজের যোগ্যতা বলে মনে করিস ? „
আকাশ বুঝতে পারলো না কিছু , “ কি হলো ? „
“ কিছু না । ছাড়। „ বলে আকাশের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে আসতেই সে আকাশের মায়ের মুখোমুখি হয়ে গেল। ‘ কাকি এখন তার হবু শাশুড়ি। , এটা মাথাতে আসতেই লজ্জায় সুচির গাল লাল হয়ে উঠলো। দৌড়ে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে এলো।
সুচিকে ওইভাবে লজ্জা পেয়ে চলে যেতে দেখে স্নেহা দেবী বললেন “ বোকা মেয়ে একটা। „ কথাটা আকাশের বাবা ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না। তিনি তখন ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবে উঠেছেন।
ঘরের বাইরে যেতেই সুচি ভাবলো , ‘ আকাশ যে মিথ্যা বলছে না সেটা নিশ্চিত । কিন্তু আরও নিশ্চিত হতে হবে তাকে। কাকে জিজ্ঞাসা করা যায় ভাবতেই মাথাতে এলো নিজের মায়ের কথা। ,
এটা ভেবেই নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে সুচি দেখলো যে তার মা বাবার খাওয়া এঁটো থালা ধুচ্ছে। সে পিছন থেকে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো , “ মা । „
সুচির মা প্রথমে চমকে গেছিলেন। কতদিন পর তার মেয়ে তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরলো। সুচির “ মা „ ডাকে যে একটা জিজ্ঞাসা আছে সেটা বুঝতে পেরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? „
সুচি ভীষণ লজ্জা পেতে লাগলো , “ কালকে তোমরা গেছিলে ? „
সুচির মা বুঝতে পারলেন যে মেয়ে কি জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু তিনি মেয়ের সাথে এতোদিন পর মজা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। তাই তিনি অবুঝের মতো জিজ্ঞাসা করলেন , “ কোথায় ? „
কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো সুচির , “ আকাশের মা বাবার কাছে । „
“ হ্যাঁ গেছিলাম । কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছিস সেটা তো বল ? „
এতোটা শোনাই যথেষ্ট , “ না , কিছু না । „ বলে সুচি চলে যেতে চাইলো। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। নিজের মা কে কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে যে , ‘ তোমরা কি আমার বিয়ের কথা বলতে গিয়েছিলে ? ,
সুচির চলে যাওয়া দেখে সুচেতা দেবী বুঝলেন যে তার মেয়ে লজ্জা পেয়েছে। তাই তিনি সুচির হাত ধরে আঁটকালেন। সুচি তার দিকে ফিরলে তিনি সুচির কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন , “ ওরা রাজি হয়ে গেছে তোর বিয়ের জন্য। আজকে পুরোহিত আসবে তারিখ ঠিক করতে। „
সুচি আর থাকতে পারলো না। দৌড়ে নিজের ঘরে এসে খাটের উপর প্রায় আছড়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। তারপর বিছানার এদিক ওদিক করতে করতে লাগলো । নিজে থেকেই হেসে উঠে লজ্জা পেতে লাগলো।
হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল রাত পর্যন্ত তার জীবনে এক অমাবস্যার অন্ধকার গ্রাস করে ছিল। আজকে নতুন সূর্য উঠে তার জীবনের প্রতিটা কোনায় আলোর রশ্মি ছড়িয়ে দিল। একে এক সব কথা মনে করতে শুরু করলো সে। আকাশকে দিদির বোঝানো। তারপর কথা বন্ধ করে দেওয়া। কলেজের ফাংশনে গিয়ে পলাশের সাথে পরিচয়। তারপর গোধূলির আকাশকে গোলাপ দেওয়া। তাই রেগে গিয়ে পলাশের সাথে ডেটে যাওয়া। তারপর তো ....
আর ভাবতে পারলো না সুচি। পলাশের উপর রাগে মুখটা বজ্রের মতো শক্ত হয়ে উঠলো। আর সাথে আকাশের উপরও খুব রাগ হলো। কেন সে গোলাপটা নিতে গেল ? ওই জন্যেই তো সে পলাশের সাথে ডেটে গেছিল। এমনকি এক মূহুর্তের জন্য বিছানায় যেতে ...
ভাবতেই রাগ আরও বেড়ে গেল । সব হয়েছে আকাশের জন্য । গোলাপটা না নিতেই পারতো। সে আকাশকে একটা শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। , ‘ ওকে শাস্তি দিতে হবে। কি দেওয়া যায় ? কি দেওয়া যায় ? হ্যাঁ... ও গোলাপ নিয়েছিল। আজকে আমাকে গোলাপ দিয়েই প্রোপজ করতে হবে। তাও অফিসের সবার সামনে। ,
এটা ভাবতেই সঙ্গে সঙ্গে আকাশকে ফোন করতে গেল । এতদিন ধরে আকাশকে ফোন না করার জন্য কললিস্টের একদম নিচে আকাশের নাম্বার চলে গেছে । কললিস্টে খোঁজার পর ডাইরেক্ট কনটেক্ট লিস্ট গিয়ে প্রথমেই আকাশের নাম্বার দেখতে পেল। আকাশের নাম A দিয়ে শুরু হওয়ায় ওর নাম্বারটাই প্রথমে আছে।
আকাশ তখন জামা আর ফুল প্যান্ট খুলে স্নানে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। ফোন বেজে উঠতেই ফোনটা হাতে নিয়ে সে সুচির নামটা দেখতে পেলো। ফোনটা তুলে কলটা রিসিভ করে জিজ্ঞাসা করলো , “ বল। „
সুচি সরসরি বললো , “ তোকে আজ আমাকে প্রোপজ করতে হবে । „
আকাশ মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না , “ মানে ? „
“ মানে টানে কিছু জানি না । তুই ওই মেয়েটার কাছ থেকে গোলাপ নিয়েছিলি , তাই এটা তোর শাস্তি। আজ তুই আমাকে প্রোপজ করবি। তাও আবার অফিসের সবার সামনে। „
আকাশ বুঝতে পারলো না যে এখন প্রোপজের কি দরকার ? বাবা মা জেঠা জেঠি সবাই তো বিয়ের জন্য রাজি। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ এটার আবার কি দরকার ? সবাই তো রাজি হয়ে গেছে । „
“ রাজি হলে হলো। তুই প্রোপজ করবি। ব্যাস। „ বলে ফোনটা কেটে দিয়ে সুচি আবার বিছানার এপাশ ওপাশ করতে লাগলো । কিছুক্ষণ পর অফিস যেতে হবে এটা মাথাতে আসতেই সে স্নানে চলে গেল ।
এদিকে আকাশ ফোনটা হাতে নিয়েই খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লো। এ কেমন মেয়ে ? এতদিন পর যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তখন প্রোপজের কি দরকার ? সবাইকে কি জানাতে চায় যে আমাদের বিয়ে হচ্ছে ? শুধু একটা গোলাপ নিয়েছি বলে এতো বড়ো একটা শাস্তি দেবে ? গোলাপ নেওয়ার কারন তো বলেছি। তবে এইসবের কি দরকার ?
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রোপজ করতেই হবে , এছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। সেটা আকাশ বুঝতে পারলো। তাই সে প্রোপজ করার পদ্ধতি ভাবতে লাগলো , ‘ প্রোপজ করার জন্য কি বলবো ? প্রথমে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া কিংবা আংটি হাতে নিয়ে একটা হাটু ভেঙে মাটিতে রেখে বলতে হবে.... কি বলতে হবে ? প্রথমে আংটি দরকার। ,
“ হ্যাঁ , ওই আংটি। মনে পড়েছে । „ বলে ড্রয়ার থেকে সেই মেলায় কেনা আংটিটা বার করলো। আংটি হাতে নিয়ে কতো কিছু ভাবতে শুরু করলো সে। তারপর খালি গায়ে কি বলে প্রোপজ করবে । সেটাই লিখতে বসলো।
এদিকে আকাশের বাবা খেয়ে দেয়ে অফিসের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসে আকাশের ঘরে উকি মেরে দেখলেন যে আকাশ খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পড়ে কিছু একটা লিখতে ব্যাস্ত , “ অফিস যাবি না ? „
আকাশ খাতার পাতা থেকে মুখ না তুলেই বললো , “ আমি বাইকে যাবো। তুমি চলে যাও গাড়ি নিয়ে । „
ছেলের কথা শুনে তিনি সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলেন। জাগুয়ারটা নিচেই পার্ক করা আছে। তাতে চড়ে বসে স্টার্ট দিয়ে সোসাইটির বাইরে চলে এলেন। কিছুদূর আসতেই দেখতে পেলেন সুচির বাবা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চিন্তিত মুখে একটা গলি থেকে বার হচ্ছে । কাঁধে তার অফিস ব্যাগ আর টিফিন কৌটো। তিনি গাড়িটা সুচির বাবার সামনে থামিয়ে , মুখটা কচ্ছপের মতো জানালা থেকে বার করে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এখন কোথায় গেছিলি ? „
আকাশের বাবাকে দেখে সুচির বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এতক্ষণ যে চিন্তার ছাপ তার মুখে ছিল সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে গিয়ে , সামনের সিটের দরজা খুলে আকাশের বাবার পাশে বসে পড়লেন। তারপর গলার স্বরে চরম ব্যাস্ততা ফুটিয়ে তুলে বললেন , “ চল , চালা । আজ ড্রপ করে দে আমায় । না হলে দেরি হয়ে যাবে। „
আকাশের বাবা গাড়ি চালিয়ে দিয়ে বললেন , “ কোথায় গেছিলি সেটা এখনও বললি না । „
“ রাধানাথদার কাছে। আজ সন্ধ্যায় আসতে বলেছি বিয়ের দিনখন ঠিক করার জন্য। „
কালকে পাকাপাকি কথা হলো আর আজকেই পুরহিত ডাকাও হয়ে গেল। এতো তাড়া দেখে আকাশের বাবা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন , “ এতোক্ষণ কি করছিলি ? „
“ আর বলিস না । গেছিলাম প্রায় আধঘন্টা আগে। গিয়ে বসতেই চা খেতে দিল। তারপর শুরু করলো নিজের দুঃখের কাহিনী। ওর একমাত্র ছেলে পূজা করে না। তাই নিয়ে আধা ঘন্টা কথা বললো। আমিও আর উঠলাম না । বুড়ো হয়ে গেছে। কথা বলার লোক চাই। ভাবছিলাম আজ অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে। তোকে পেয়ে গেলাম । চিনিস তো আমার অফিসের রাস্তা ? „
আকাশের বাবা চুপচাপ সব শুনে বললেন , “ চিনি। হ্যাঁ বুড়ো হয়ে গেছেন । „ তারপর তিনি দেখলেন যে সুচির বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন । সুচির বাবার হাসি দেখে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? হাসছিস কেন ? „
ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমির হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সুচির বাবা বললেন , “ তোর জুলফি। চুল। সাদা হতে শুরু করেছে। „
“ আমার চুলের রং না দেখে নিজের দেখ। তোর মাথাতে তো ফুটবল খেলা যাবে । কটা চুল আছে তা গুনে বলা যাবে। „
সুচির বাবা বললেন , “ সময় কতো তাড়াতাড়ি চলে গেল। „
কথাটা শুনে আকাশের বাবা গুম মেরে গেলেন। সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। একটা ভুল বোঝাবুঝি তাদের সবার জীবন থেকে কতগুলো বছর কেড়ে নিয়ে চলে গেল। কালো জাদু করেও সেই বছর গুলো ফিরিয়ে আনা যাবে না। সত্যি বলতে কি কেউ সেই বছর গুলো ফিরে পেতে চায় ও না। তাহলে যে আকাশ সুচির সুন্দর মিষ্টি ছোটবেলা টা তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হবে।
সুচি স্নান করে , খেয়ে দেয়ে , মেকআপ করে একটা জিন্স আর একটা সাদা শার্ট পড়ে আকাশকে ফোন করলো। আজ নিজের স্কুটিতে না গিয়ে আকাশের বাইকেই যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠলো।
আকাশ আধ ঘন্টা ধরে কিভাবে প্রোপজ করা যায় সেটা কাগজে লিখছিল । এর মাঝে বারকয়েক আকাশের মা এসে আকাশকে স্নানে যেতে বলায় সে বাধ্য হয়ে স্নান করে এসে , খেয়ে দেয়ে , জামা প্যান্ট পড়ে আবার লিখতে বসলো। বেশি বড়ো না আবার ছোটও না। কয়েক লাইনে কবিতার মতো কিছু একটা বলে প্রোপজ করতে হবে। বেশি লম্বা হলে সেটা বোরিং হয়ে যাবে। আবার ছোট হলে দায় সারা দেখাবে। তাই ছয় সাত লাইনের মধ্যে যা বলার তা বলতে হবে। আর এটা লিখতেই যে তাকে এতো কষ্ট করতে হবে সেটা সে ভাবে নি।
সুচির ফোন আসতে তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। ফোনটা ধরে সে বললো , “ বল । „
সুচি --- কোথায় তুই ? অফিস চলে গেছিস নাকি ?
আকাশ --- না কেন ?
সুচি --- আজ তোর বাইকে যাবো তাই। বার হ তাড়াতাড়ি।
আকাশ --- আমার হয়ে গেছে। তুই নিচে দাড়া। আমি আসছি এক্ষুনি।
সুচি --- ঠিক আছে। বলে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো।
আকাশও তড়িঘড়ি কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে নিচে নেমে এলো। সুচিকে দেখে বললো , “ আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে । „
“ ও। অন্য দিন খারাপ দেখতে লাগে বুঝি । „
“ অন্য দিনের কথা জানি না। কিন্তু আজ তুই আমার হবু বউ। তাই একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তোকে । „
সুচি দাঁতে দাঁত পিষে নিজের হাসি সংবরণ করলো। সাথে লজ্জা পেল সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো , “ থাক । অনেক হয়েছে। প্রোপজ করার কথা মনে আছে তো ! „
“ হ্যাঁ । এইদেখ। „ বলে পকেট থেকে একটা ভাজ করা পৃষ্ঠা বার করে সুচিকে দেখালো।
সুচি বুঝতে পারলো যে সে লিখে এনেছে। তাই পৃষ্ঠাটা ছিড়ে ফেলার ইচ্ছা হলো। ‘ একবার প্রোপজ করবে আর হাবভাব যেন বাঘ শিকার করতে যাচ্ছে ! , কিন্তু নিজেকে সামলে পৃষ্ঠাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে সে বললো , “ নিজে থেকে বলবি। কোন কাগজ দেখা চলবে না । „
আকাশ অবাক হয়ে রেগে গিয়ে বললো , “ ওটা আমিই লিখেছিলাম । „ এতো কষ্ট করে লেখা । এইভাবে জলে যাবে সবকিছু সেটা সে ভাবেনি।
“ হ্যাঁ , তুই নিজেই তো বলবি। যা মনে আছে তাই বলবি। কিন্তু ওখানে গিয়ে কোন কাগজ দেখা চলবে না। চল , চল , কথা বাড়াস না। দেরি হয়ে যাবে। „
আকাশ পরাজয় স্বীকার করে বাইকে উঠে , মাথায় হেলমেট গলিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দিল। সুচি বাইকে উঠে আকাশকে জড়িয়ে ধরতেই আকাশ আস্তে করে ক্লাচ ছেড়ে দিল।
সুচির নতুন স্কুটি বোবা হয়ে দেখতে লাগলো কিভাবে তার মালকিন ওই ছেলেটার বাইকে উঠে , ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে , তাকে একা ফেলে দিয়ে চলে গেল।
কিছুদূর যাওয়ার আকাশ অফিস যাওয়ার রাস্তা না ধরে আর একটা রাস্তা ধরলো। সেটা দেখে সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ কোথায় যাচ্ছিস ? অফিস তো উল্টো দিকে। „
“ হ্যাঁ জানি। আগে একটা জায়গায় যাবো। „
“ কোথায় ? „
“ গেলেই বুঝবি । „
সুচি চুপ মেরে গেল। কিন্তু কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা দোকানের সামনে থামতেই সুচি দেখলো যে সেটা একটা গয়নার দোকান। উপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে বাংলায় লেখা “ গীতাঞ্জলি জুয়েলার্স। „ আকাশ রাস্তার এক ধারে বাইক পার্ক করতেই সুচি নেমে গেল। আকাশও চাবি খুলে বাইক থেকে নেমে গেল। আকাশ নামতেই সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ এখানে কি ? „
“ চল না। „ বলে দরজা ঢেলে ভিতরে ঢুকে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে একজন নমস্কার করে অভ্যর্থনা জানালো। তারপর একটা কাউন্টারে গিয়ে আকাশ এক শাড়ি পরিহিত মহিলাকে বললো , “ আংটি দেখান । „
তারপর মহিলা আকাশকে জিজ্ঞাসা করে তার পছন্দ জানতে চাইলে আকাশ সুচির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো , “ তোর কেমন পছন্দ ? „
সুচি অবাক হয়ে থতমত খেয়ে বললো , “ আমার । „
“ তোর জন্যেই তো কিনছি । আর হ্যাঁ ..... বলে পকেট থেকে সেই মেলায় কিনে দেওয়া আংটিটা বার করে , সুচির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “ একটা নতুন কিনে দিবি। এটা আর পড়া যায় না। ছোট হয়ে গেছে। „
আংটিটা দেখে এবং চিনতে পেরে সুচির চোখে জল চলে এলো। এটা সেই আংটি যেটা মেলায় সে আকাশকে পছন্দ করে দিয়েছিল। সেই আংটিটা এখনও আকাশ সামলে সযত্নে রেখে দিয়েছে দেখে সুচির একটা আলাদা ভালোলাগা পেয়ে বসলো। এরকম অনুভূতি কতো বছর ধরে হয়নি সেটা সুচি গোনেনি। আগে যখন আকাশ তার জন্মদিনে কিছু একটা কিনে দিতো তখন এইরকম অনুভূতি হতো। আর আজকে হচ্ছে। নতুন করে জীবনের মিষ্টি সৌন্দর্য উপভোগ করতে শুরু করলো সুচি।
মনে হচ্ছে যেন এখানেই আকাশকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে নিতে। কিন্তু আর না। নিজের অনুভূতি গুলো নিজেকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এইসব অনুভূতি গুলোর অত্যাধিক বা বাঁধন ছাড়া বহিঃপ্রকাশ-ই তার জীবনের সর্বনাশের কারন হয়েছে এটা সুচির কাছে স্পষ্ট। তাই চোখের কোনায় লেগে থাকা জল মুছে নিয়ে আকাশের বাড়িয়ে দেওয়া আংটিটা নিয়ে নিল। তারপর মনে মনে বললো , ‘ হ্যাঁ। নিজের টাকায় তোকে এর থেকেও সুন্দর আসল সোনার আংটি কিনে দেবো। ‚ তারপর কাউন্টারের মহিলার উদ্দেশ্যে বললো , “ বেশি মোটা না। হাল্কা সরু। „ তারপর নিচের বাক্সের বিভিন্ন আংটির মধ্যে থেকে একটা আংটি দেখিয়ে বললো , “ এরকম । „
আকাশ জিজ্ঞাসা করলো , “ এটা তোর পছন্দ ? „
“ হ্যাঁ , এটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। „
আকাশ একবার আংটিটা দেখলো। সরু আর মাথায় একটা ছোট ফুলের মতো ডিজাইন। তাতে চারটে ফুলের পাপড়িও আছে। আংটি দেখে কাউন্টারের মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলো , “ কত দাম ? „
মহিলা বললো , “ এটার দাম স্যার আজকের মার্কেট অনুযায়ী বারো হাজার পাঁচশো নিরানব্বই । আজকে পঞ্চাশ টাকা কমে গেছে। তাই আপনারা খুব সস্তায় পেয়ে যাচ্ছেন . ....
মহিলার কথার মাঝে আকাশ বললো , “ ওকে। একবার এর আঙুলের সাইজে হচ্ছে কি না দেখে নিন । „
সুচি অশ্রুসিক্ত নয়নে আঙুল বাড়িয়ে দিলে মহিলা তার অনামিকাতে আংটি পড়াতে চেষ্টা করলো। প্রথম চেষ্টাতেই ঢুকে গেল। পুরো পার্ফেক্ট সাইজ।
আকাশ বললো , “ তাহলে দিয়ে দিন। „
আংটি কিনে চেক-এ পেমেন্ট করে দিল সে। তারপর বাইরে বার হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ কাঁদছিলি কেন ? „
“ কিছু না । তুই বুঝবি না। „
আকাশ কিছুক্ষণ উদাসীন দৃষ্টিতে সুচির দিকে তাকিয়ে থেকে বাইকে উঠে পড়লো। এই মেয়েটার সাথে ছোটবেলা থেকে একসাথে আছে। তবুও এই মেয়েটার মন সে বুঝতে পারলো না। আর কখনো বুঝতে পারবে কি না সেটাই সন্দেহ।
মাথায় হেলমেট গলানোর আগে সুচির নরম কোমল ঠোঁটের স্পর্শ নিজের গালে অনুভব করলো। পিছনে ঘুরে তাকানোর আগে সুচি তাকে জড়িয়ে ধরে বললো , “ চল। অফিস যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। „
“ সে তো এমনিতেও হয়েছে। „ বলে হেসে নিয়ে বাইক চালিয়ে দিল। বাইক কেনার পর আজ প্রথম সুচি ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছে। আর কোন বাধা নেই ওদের মধ্যে । এখন সুচি আকাশের। আকাশ সুচির। আকাশ নিজের পিঠে সুচির কোমল শরীরের ছোঁয়া নিয়ে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিয়ে অফিসের দিকে চললো।
মাঝ রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে সুচি আকাশের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ তুই কাকার ছেলে । এটা কি তোর যোগ্যতা ? নাকি তোর কলেজের MBA ডিগ্রিটা তোর যোগ্যতা ? কোনটাকে তুই নিজের যোগ্যতা বলে মনে করিস ? „