04-01-2022, 08:44 PM
দরজা খুললাম, ছোটমা। চায়ের কাপ হাতে।
-লাইট জ্বেলে ঘুমোচ্ছিস। ভেতরে এলেন, কিরে এসব কি, বালতি মগ তেলের বাটি সাঁড়াসি, জলপট্টি।
ছোটমাকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। তারপর চা খেতে খেতে সব বললাম
-এই মাত্র চারটে নাগাদ ঘুম পাড়িয়েছি। ছোটমা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বড়মা, ছোটমা, মল্লিকদা, দাদা এসে হাজির। সবাই চুপচাপ। থম থমে মুখ। ছোটমা বললেন
-যা আমার ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে পর। দুরাত তোর ঘুম হলো না, শরীর খারাপ করবে।
দাদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ডাক্তারবাবুকে একবার ডাকো।
-দাঁড়া, আলো ফুটুক, ডাকছি।
ছোটমার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে একটু চা খাওয়াবে।
-চা কেনো, ছোটো ওকে একটু হরলিক্স করে দে। বড়মা বললেন।
ছোটমা বেরিয়ে গেলেন। দাদা ইজি চেয়ারে, আমি দাদার পাশে মাটিতে, বড়মা মিত্রার মাথার শিয়রে। মল্লিকদা চেয়ারে।
-মল্লিক আমার সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে আয় তো।
মল্লিকদা বেরিয়ে গেলেন। সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে এসে দাদাকে দিলেন। দাদা একটা সিগারেট ধরালেন।
-বুঝেছো।
-বলো।
-তোমরা কয়েকদিনের জন্য কোথাও ঘুরে এসো। আমি মল্লিক ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।
-সেই ভালো।
-কিরে মল্লিক পারবো না।
-খুব পারবো।
-কোথায় যাই বলোতো।
-অনির বাড়ি চলে যাও। মিত্রা ওখানে গিয়ে কয়েকদিন বেশ ফুরফুরে ছিলো লক্ষ্য করেছিলাম।
-কিরে অনি যাবি।
-যাওয়া যায় তবে আগে ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করো উনি কি বলেন।
-মেয়েটার নার্ভের ওপর খুব চাপ পরে গেছে। সহ্য করতে পারে নি।
-সামন্ত তাই বলছিলো, বিকেলে এসেছিলো দেখে বললো, মা তোমার চোখটা ভালো ঠেকছে না, ওষুধ লিখে দিলো। আমার দিকে তাকিয়ে বড়মা বললেন হ্যাঁরে ওষুধটা খাইয়েছিস।
-আমি মাথা দোলালাম।
-জ্বরটা কখন এলো।
-দেড়টা।
-ডাকলিনা কেনো।
-শুতে গেলে সাড়ে এগারোটা, ডাকি কি করে।
-পাকামো করিস না। একা একা সব করলি।
-কি করবো।
-মল্লিক তোরাও কিছু জানতে পারিস নি।
-হ্যাঁ বাথরুমে আওয়াজ হচ্ছিল, ভাবলাম কেউ বাথরুম ইউজ করছে। প্রায় দুটো পযর্ন্ত জেগেছি, ছোটো অনি আর মিত্রার সম্বন্ধে গল্প করছিলো।
ছোটমা চা হরলিক্স নিয়ে এলেন। সবাইকে চা দিলেন আমাকে হরলিক্সের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন।
-এখান থেকে দুটো বিস্কুট নে।
নিলাম।
-তোমায় বলছিলাম, দেখো বাখরুমে ঘট ঘট শব্দ হচ্ছে।
-হ্যাঁ।
-তখন অনি মিত্রার মাথায় জল ঢালছিলো, সাড়ে তিন জ্বর উঠেছিলো।
-সব্বনাশ।
-তুই কি করলি সেই সময়। দাদা বললো।
-আমি প্রথমে জল ঢাললাম মাথায়, তারপর আমার কাছে ক্যালপল ছিলো দিলাম, সারারাত জলপট্টি দিলাম, রান্নাঘর থেকে তেল গরম করে এনে মুখে কপালে, পায়ে পায়ের চেটো, আর হাতে মালিশ করলাম। এই তো ঘন্টা খানেক হলো ঘুমিয়েছে।
-তুই তো ট্রেন্ড নার্স ।
ছোটমা মুখ টিপে হাসলো।
বড়মা দাদার দিকে তাকিয়ে বললো মস্করা হচ্ছে।
-তুমিই বলো বড়, ওই সময় মাথা ঠিক রেখে অনি ঠিক ঠিক কাজ করেছে কিনা।
-তোমার মতো তো নয় কিছু হলেই দশবার পায়খানায় দৌড়বে। ও ছোট আর আমার ছেলে।
মিত্রা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
-মেয়েটা জেগে গেলে ঘাড় মটকাবো।
-যাই ডাক্তারকে ধরে নিয়ে আসি।
দাদা চলে গেলেন। ছোটমা ইজি চেয়ারে বসলেন। আমি ছোটমার কোলে মাথা দিলাম, ছোটমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
-যা না অনি, আমরা তো আছি, ছোটোর ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে নে। বড়মা বললেন।
-না ঘুম পাচ্ছে না।
-থাক। ছোটমা বললেন।
-কি বিপদে ফেললে বলতো মেয়েটা। বড়মা ছোটোর দিকে তাকিয়ে বললো।
-সবই ওপর ওয়ালার ইচ্ছে, না হলে আমাদের কাছেই বা আসবে কেনো।
-ঠিক বলেছিস, কাল থেকে যেন একটা ঝড় যাচ্ছে।
অমিতাভদা, ডাক্তারবাবুর গলা পেলাম।
-কি অনিবাবু ধূম জ্বর এসেছিলো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, ছোটমা ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, ডাক্তারবাবু ইজি চেয়ারে বসলেন। মল্লিকদা চেয়ারটা দাদার দিকে এগিয়ে দিলেন, ওরা দুজনে মিত্রার পায়ের দিকে বসলো।
-বলোতো কি কি হয়েছিলো, আমি একটু মিলিয়ে নিই আমার সঙ্গে।
আমি পঙ্খানুপুঙ্খরূপে যা হয়েছিলো, তাই বললাম।
-তুমি কি ওর বুকে পিঠে তেল মালিশ করেছিলে।
মাথা নীচু করলাম।
-লজ্জার কিছু নেই তখন তুমি নার্স।
মাথা দেলালাম।
-দ্যাটস গুড।
-এমনি তেল না গরম তেল।
বললাম তেল গরম করে মালিশ করেছি।
-ওঃ ওয়ান্ডারফুল। ঝড়টা কাটলো। বুঝলে এডিটর।
-মস্করা রেখে আসল ব্যাপারটা বলো তো সামন্ত। বড়মা বললেন।
-কি হয়েছিলো জানো। ওর নার্ভগুলো হঠাত ক্র্যাম্প ধরে গেছিলো, তাই ও অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলো। ওটা কিন্তু ও করে নি, ওর নার্ভগুলো করেছিলো। কাল আমি একটা ইঞ্জেকশন দিলাম, নার্ভগুলোকে জাগাবার জন্য আর একটা দিলাম ঘুমোবার জন্য, তাহলে নার্ভগুলো তাড়াতাড়ি সতেজ হবে। বিকেলে যে ট্যাবলেটটা দিলাম, সেটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য, কিন্তু নার্ভগুলো ঘুমিয়ে পরেছিলো, যখন জাগতে আরম্ভ করলো, তখন আড়মোড়া ভাঙলো, জ্বর এলো, ধুম জ্বর। সেই সময় যা যা করার দরকার অনিবাবু তা করেছে। আজ দেখবে ও অনেক সতেজ থাকবে। কিন্তু একটা কথা এখান থেকে নড়ানো যাবে না। সাতদিন। তারপর তোমরা যেখানে যাবার যাও। তখন ঝড় একেবারে কেটে যাবে, ভবিষ্যতে ওকে একেবারে বেশি স্ট্রেইন দেওয়া যাবে না। একবার ব্রেকডাউন করলেই, পঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা। ছোট এবার একটু চা হোক। তারপর মাকে দেখছি। ছোটমা বেরিয়ে গেলেন।
-তুমি আগে একবার দেখো, তারপর চা খাবে। বড়মা বললেন।
-আর একটা ব্যাপার এর মধ্যে ঘটেছে। আমি বললাম।
-বলো।
-কালকে ও ক্লাবে গেছিলো……..
-হ্যাঁ তোমার ছোটমা আমাকে বৈকালে ঘটনাটা বলেছেন। ওটাও তুমি ভালো কাজ করেছো। সবই ফাস্ট্রেশন বুঝলে অনিবাবু। কখনো হতাশায় ভুগবে না, ভুগলেই বিপদ। কি থেকে কি হয় বলা মুস্কিল। আমরা পযর্বেক্ষণ করে যতটা পারি ওষুধ দিই।
ছোটমা চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে কম করে দিলাম, দুরাত তোর জাগা হয়ে গেলো।
-তাতে কিছু হবে না। ও খুব স্ট্রং ম্যান।
-থামো তুমি। ছেলেটাকে পিষে মেরে দিলে এরা। বড়মা বললেন।
-বুবুন। মিত্রা চোখ চাইলো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মিত্রা আমার দিকে তাকালো।
বড়মা মিত্রার মাথায় হাত রাখলো। তোকে চিন্তা করতে হবে না আমরা সবাই আছি।
ডাক্তার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বুবুন কে।
বড়মা বললেন, অনির আর এক নাম। মিত্রা ওকে বুবুন বলে ডাকে।
-বাঃ বেশ মিষ্টি তো নামটা, অনি এ নামটা তোমার কে রেখেছিলো।
-আমার মা।
-ও।
মিত্রার চোখ দুটো ছল ছলে।
-কাঁদছিস কেনো। বড়মা ওর কপালে চুমু খেলেন।
-তোমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছি।
-মেলা বকিস না আর। একবার পাঁঠাটাকে জোর করে ডাকতে বলতে পারতিস। তাহলে এতোটা কষ্ট হতো না।
মিত্রা হেসে ফেললো।
-কি কষ্ট হচ্ছে মা।
মিত্রা শুয়ে শুয়ে কাপেলের দিকে চোখ তুলে, ডাক্তার বাবুর দিকে তাকালো। না কষ্ট হচ্ছে না।
ডাক্তারবাবু এগিয়ে গেলেন।
স্টেথো দিয়ে বুকটা দেখলেন। একটু কফ হয়েছে বুকে, আমি একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। হাত পায় যন্ত্রণা করছে।
-করছিলো কাল রাতে, এখন করছে না।
-ঠিক আছে, স্নানের আগে ভালো করে তেল মেখে স্নান করবে, গরমজল ঠান্ডাজল মিশিয়ে। নর্মাল ডায়েট। পারলে একটু দুধ খাওয়াতে পারবে।
-এখানে গোয়াল ঘর পাই কোথায় বলতো।
-সেও ঠিক। আমাদের বাজারে যে দুধ পাওয়া যায় তাই দাও।
অমিতাভদার ফোনটা বেজে উঠলো।
-আরে আপনি আর ফোন করার সময় পেলেন না, এই সাত সকালে। ধরুন যে লিখেছে তার সঙ্গে কথা বলুন।
অমিতাভদা ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন
-হ্যালো।
-শোনো তোমার মতো দু’টাকার সাংবাদিককে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আমি রাখি, আজই লেখাটার সম্বন্ধে একটা অবজেকশন পাঠাচ্ছি, অমিতাভকে বলে ছেপে দেবে।
মাথাটা গরম হয়ে গেলো
-শোনেন আপনার মতো মন্ত্রীকে আমি জন্ম দিই, আপনার নাম করে এবার সিরিয়াল লিখবো, দেখি আপনার চেয়ারটা আপনি কি করে ধরে রাখেন, সাতদিনের মধ্যে আপনাকে রিজাইন দিতে বাধ্য করাবো, তখন লালবাতি নিয়ে ঘোরা বেরিয়ে যাবে, আর কালকের সকালের কাগজে আপনার ছেলের মধুচক্রের ব্যাপারটা ছাপবো উইথ ফটো, দেখি আপনার কেমন ক্ষমতা, আপনার দম থাকলে আপনি আমাকে আটকান। আর একটা কথা শুনে রাখুন যার কাছে নাম লিখিয়ে আপনি মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন, ওই লিস্টে সবার প্রথম আমার নামটা আছে, একটু ভালো করে জেনে নেবেন। ফোনটা কেটে দিলাম।