08-05-2019, 05:11 PM
সকালবেলা ঘুম ভাঙল মোবাইলের শব্দে। আমি মুখ তুলে দেখলাম আমার মোবাইলে আলো জ্বলছে। আমি নেমে এলাম বিছানা থেকে। মোবাইলে দেখলাম মিতার দিদি।
কি ব্যাপার? এত সকালে দিদির ফোন? বাজতে বাজতে বন্ধও হয়ে গেল। আমি আস্তে করে সরে এলাম জানলার দিকে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। বুকটা দুরুদুরু
করে উঠলো। কোন খারাপ খবর নয় তো? খারাপ খবরই হবে নাহলে এতো সকালে দিদি কেন ফোন করবে?
আমি বিদিশাদের দিকে তাকালাম। সবাই ঘুমোচ্ছে। সব ল্যাংটো। নিকিতার মুখ হা হয়ে রয়েছে। তেমনি বিদিশারও। চিত্ত বিদিশার বুকে মুখ গুজে ঘুমোচ্ছে। ওদের এই
নগ্ন ভাব অন্য সময়ে হয়ত আমার লিঙ্গে তাপ আনত, কিন্তু এখন যে আমার কিছুই ভাল লাগছে না।
করবো কি ফোন? কাঁপা হাতে আমি মিস কলে গিয়ে দিদির নাম্বার দাবালাম। ফোন বেজে উঠতেই দিদি জেন ওয়েট করছিল আমার জন্য।
দিদির গলা ভেসে এলো, ‘কে গৌতম?’
আমি আস্তে করে উত্তর দিলাম যাতে বিদিশাদের ঘুম না ভাঙে, ‘হ্যাঁ গৌতম বলছি। কি ব্যাপার দিদি এতো সকালে ফোন?’
দিদি বলল, ‘না করে উপায় ছিল না গৌতম।‘
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন, কি হয়েছে? দাদা ঠিক আছে?’
দিদি বলল, ‘না দাদা না।‘
আমি আবার উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কে?’ বলে দিদির বাড়ির সবার নাম একে একে বলে গেলাম।
দিদি আবার বলল, ‘না গৌতম ওরাও না।‘
আমি একটু গলা তুলে বললাম, ‘তাহলে কে দিদি কে? মিতা?’
মিতার কথা শুনে দিদি হু হু করে কেঁদে ফেলল। আমি স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দিদি কাঁদুক, দিদি কথা বলার পর আমি জানি আমায় কাঁদতে হবে। আমি ধীরে ধীরে
রুমের বাইরে বেরিয়ে এলাম, দরজায় লক করে যাতে আপনা আপনি বন্ধ না হয়ে যায়। টেনে দিলাম দরজা। আমি চাই না বিদিশারা আমার কান্না দেখুক। আমাকে
কাঁদতে হবে একা নির্জনে।
দিদি বেশ কিছুক্ষণ পরে নাক টানতে টানতে বলল, ‘গৌতম আমাকে ক্ষমা কর গৌতম।‘
আমি বিরক্ত হলাম দিদির উপর। ও এতো ভনিতা করছে কেন? কেন বলছে না সোজা কথাটা? আমি তো জেনে গেছি এটা মিতা ছাড়া কেউ না। আর কেউ হতে পারে না।
কিন্তু কি হয়েছে ওর? আমি কেন এখানে?
দিদির গলা শুনতে পেলাম। দিদি বলছে, ‘গৌতম, কাল রাতে আমি মিতার কাছে ছিলাম। রাত এগারোটা নাগাদ মিতা হঠাৎ বলে উঠলো দিদি আমার মাথায় খুব ব্যাথা
হচ্ছে। যেন ছিঁড়ে পড়বে মনে হচ্ছে।‘ দিদি একটু থামল শ্বাস নিতে।
আমি বলে উঠলাম, ‘থামলেন কেন দিদি বলুন তারপর?’
আমার হাত ঘেমে উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন মোবাইলটা হাত থেকে খসে পরে যাবে। আমি শক্ত হাতে চেপে ধরলাম ফোন। কানে চেপে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিদি থেমে
থাকবেন না, বলুন।‘
দিদি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওকে কাল রাতেই হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ভর্তি করে দিয়েছি। কিন্তু রাতে কোন ডাক্তার ছিল না। হাসপাতাল সকালে আসতে বলেছে।
আমরা সবাই যাব। তুমি কি তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে?’
আমি বললাম, ‘আপনারা কি জানতে পারেন নি কি হয়েছে ওর? কিসের জন্য মাথাব্যাথা?’
দিদি জবাব দিল, ‘কিচ্ছু জানতে পারি নি বিশ্বাস করো, এই সকালে যাবো, তবে জানতে পারবো। আর বেশি কথা বললাম না, তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।‘
দিদি ফোনটা রেখে দিতেই আমি বুঝতে পারলাম আমার গা হাতপা থরথর করে কাঁপছে। এই সকালে কোথায় যাবো, কি করে যাবো, এদের নিয়ে কি করবো। কি বলব
সব চিন্তা মাথার মধ্যে এসে জমা হতে লাগলো। কিন্তু একটারও জবাব পেলাম না মনের থেকে।
মনের ভিতরটা দমকে উঠলো, আমি জানি যে এখন আমি কাঁদব, আর হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আমার মিতা হাসপাতালে শুয়ে আছে। আমি? আমার মনে হল সব কিছু
মিথ্যে। এই পৃথিবী, এই জীবন, এই সুখ সব সব। আমি করিডোরের এক কোনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তারপর মনে হল আমাকে যা কিছু হোক তাড়াতাড়ি
করতে হবে। আমি দৌড়ে নিচে গেলাম। একটা ছেলে রিসেপশনে আছে। আমাকে দেখে ‘গুড মর্নিং’ বলল।
আমি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভাই আমি খুব মুশকিলে পরে গেছি। যে করেই হোক আমাকে চারটে কোলকাতার টিকিট কেটে দিতে হবে প্লেনে।‘
ছেলেটা একটা কিছু দেখে বলল, ‘স্যার, কোলকাতার ফ্লাইট সকাল সাড়ে এগারোটায়। আশা করি ওতে পেয়ে যাবো। জানতে পারি কি স্যার কি প্রব্লেম?’
আমি বললাম, ‘তুমি জানতে পারো, কিন্তু আমি বলতে পারি না। বললেই আমি দুর্বল হয়ে যাবো। তুমি ভাই প্লিস ব্যবস্থা করো।‘
আমি দৌড়ে উপরে এলাম। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দরজা খুলে গেল। মনে পরে গেল আমি দরজাটা জাস্ট ভেজিয়ে গিয়েছিলাম। দূর থেকে ওদের নগ্ন শরীর চোখে পড়লো।
ভাগ্যিস কেউ এসে যায় নি। দরজাটা বন্ধ করে আমি বিদিশার কাছে গেলাম। ও নগ্ন হয়ে দু পা ফাঁক করে শুয়ে রয়েছে। আমার নজর দেবার ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদের
ডাকতে হবে বলতে হবে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে।
যদি ওরা জিজ্ঞেস করে এতো তাড়াহুড়ো কিসের? তাহলে আমি কি জবাব দেব?
বলতে পারবো না মিতার কথা। আমার জন্য ওরা জীবনের সুখ নষ্ট করুক আমি চাই না। আমি জীবনের সুখের কিছু সময় নাহয় মিতার জন্য ব্যয় করবো। জানতে
পারলাম সুখের পিছনে দুঃখ লুকিয়ে থাকে আর একটা সময় সেটা বেরিয়ে আসে কান্না হয়ে।
বিদিশাকে ডেকে তুললাম। বিদিশা উঠে বসে আমাকে দেখে বলল, ‘গৌতম তোমাকে কেমন জানি উদভ্রান্তের মত লাগছে। রাতে ঘুম হয় নি?’
আমি বিদিশাকে বললাম, ‘না না বিদিশা তা নয়। আমাদের কোলকাতা পৌছতে হবে শীগগির। অফিসে একটা খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আমাদের কোম্পানি এতে প্রায়
একশ কোটি টাকা লস করতে পারে। আর আমি ছাড়া কেউ নেই। সকালে বসের ফোন এসেছিল। বলল তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমি নিচে প্লেনের টিকিট কাটতে বলে
দিয়েছি। সকাল সাড়ে এগারোটার প্লেন। আমাদের তৈরি হতে হবে তাড়াতাড়ি।‘ সব কিছু বলে ভাবলাম উফ ভগবান মিতার জন্য একটুও সত্যি কথা বলতে পারবো
না?
বিদিশা ধরফর করে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘উফ বাবা তোমাদের অফিস বটে। সব কাজ তোমাকেই করতে হবে নাকি? কথা নেই বার্তা নেই ডেকে
পাঠানো। একটা কাজে এসেছ তো নাকি? এবারে গিয়ে একটু বোলো। তুমি নরম বলে ওরা সব চেপে বসে তোমার উপর, যেন আর কেউ নেই।‘
আমি দাঁত মাজতে মাজতে ভাবলাম বিদিশা কি জানবে সত্যিটা কি। আমি যেটা বললাম তাতে ওর রিয়াকশন এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু যদি আমি মিতার কথা বলি
তাহলে জানি ওর কি হতে পারে।
বিদিশা বাকিদের মানে চিত্ত আর নিকিতাকে ডেকে তুলল। আমার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। কেউ আর কোন কথা না বলে তৈরি হয়ে নিল। নাস্তা জানি আমার মুখে
ঢুকবে না, তবু ওরা যাতে না খেয়ে থাকে তার জন্য আমাকেও খেতে হবে। নাস্তা নিয়ে এলাম। ওরা খেল সাথে আমিও। খাবার এতো যে বেস্বাদ লাগে এই প্রথম বুঝলাম।
কোনরকমে খেয়ে ফেললাম। ওদেরকে যে বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।
নিচের থেকে ফোন এলো যে টিকিট হয়ে গেছে। ভগবান আছেন জানতে পারলাম। একটু যেন সুখের ছোঁওয়া পেলাম মনের মধ্যে।
সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। এয়ারপোর্টে চলে এলাম হোটেলের গাড়ীতে। বোর্ডিং পাশ নিতে নিতে মনে মনে বললাম, ‘মিতা আরেকটু আপেক্ষা করো। আমি
আসছি।‘
সিকিউরিটি চেক করার সময় নিকিতা জিজ্ঞেস করলো, ‘গৌতম ব্যাপারটা সত্যি অফিসের তো? তোমার মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না।‘
বিদিশা কথাটা শুনে বলল, ‘মনে মনে আমিও তাই ভাবছিলাম। জিজ্ঞেস করবো ঠিক করছিলাম।‘
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম, ‘আমি জানি না তোমরা এইভাবে কেন জিজ্ঞেস করছো? অফিসের ব্যাপারই।‘ নিজেকে রোধ করলাম আর কিছু বলার
থেকে কারন আমার গলা ভেঙ্গে আসছিলো।
আমার কপালই এমন আমার দুটো ভালো বন্ধুকে আমি জানাতে পারছি না আমার কি হয়েছে। জীবনের সুখ যে ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার অধিকার আমার নেই।
প্লেনে বসে আমার চোখের সামনে মিতার মুখ ভাসতে লাগলো। মিতা হাসপাতালে বালিশের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। সেদিনের মত ওর চোখের দু কোল দিয়ে জল
গড়িয়ে পরছে। ঠাণ্ডা প্লেনে আমার এতো গরম লাগছে কেন? পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছলাম। আর সবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম। কেউ
আমাকে লক্ষ্য করছে না। বাঁচা গেছে। দেখলেই জিজ্ঞেস করতো এই গরমে আমি ঘামছি কেন।
প্লেন টেক অফ করলো। অন্যান্য সময় আমার এই সময়টা একটু ভয় করে। আজ শুধু মিতার মুখ ছাড়া অন্য কিছু অনুভব হল না। প্রায় পৌনে দু ঘণ্টা পর প্লেন ল্যান্ড
করলো। আমরা আস্তে করে বেড়িয়ে এলাম। এয়ারপোর্টের বাইরে বেড়িয়ে বিদিশাকে বললাম, ‘বিদিশা তোমাদের সাথে আজ যেতে পারলাম না। তোমরা একা যেতে
পারবে তো?’
বিদিশা বলল, ‘আরে কি বলছ? নিজের জায়গায় এসে বাড়ি যেতে পারবো না? তুমি এগোও। যে কাজই থাকুক ভালো হোক এটাই কামনা করি।‘
আমি আর কিছু না বলে হাত নাড়িয়ে চলে এলাম অন্য দিকে। ট্যাক্সি ধরে এগোতে লাগলাম। কিন্তু যাবোটা কোথায়? কোন হাসপাতালে রেখেছে তাই তো জানি না।
দিদিকে ফোন করলাম। একবার রিং বাজতেই দিদি তুলল।
দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় তুমি গৌতম?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি কোলকাতায়। যাবো কোন হাসপাতালে?’
দিদি জানালো হাসপাতালের নাম। তার মানে ভুল দিকে যাচ্ছিলাম। ড্রাইভারকে বলতে ও একবার আমার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। আবার ভুল। দিদিকে
জিজ্ঞেস করাই হল না যে মিতা কেমন আছে।
দিদিকে আবার ফোন করলাম। হতাশ হলাম দিদির ফোন অন্য কলে ব্যস্ত। ছিঃ, কেন তখন জিজ্ঞেস করলাম না।
কিছু পরে প্রায় আধা ঘণ্টা হাসপাতালের সামনে এসে পৌছুলাম। ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে। কোথায় আছে কোথায় আছে করতে করতে দেখলাম
দিদিকে। প্রানে যেন জান এলো। দিদি আমাকে দেখতে পায় নি। দিদির হাত ধরে বললাম, ‘দিদি আমি এসে গেছি। কোথায় মিতা?’
দিদি আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি এসে গেছ গৌতম। ডাক্তার এখন মিতাকে চেক করছে। চল যাই।‘
আমি আর দিদি দোতালাতে উঠে এলাম। কেবিনের বাইরে থেকে দেখতে পেলাম একটা ভিড় মিতার বিছানা ঘিরে রয়েছে। সবার পরনে সাদা আপ্রন। মনে হয় সবাই
ডাক্তার। দিদিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতো ভিড় কেন?’ মিতার পাগুলো আমার চোখের সামনে। বাকি ভিড়ে ঢাকা।
দিদি বলল, ‘এখন কিছু জানি না গৌতম। এইবার জানতে পারবো। কাল রাতে প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হয়েছিল মিতার। কিভাবে রাত কাটিয়েছি বলতে পারবো না।
ঠাকুরকে ডাকছিলাম কোনরকমে সকালটা আসুক।‘
দাদাকে দেখলাম মানে মিতার জামাইবাবুকে। ছুটে গেলাম দাদার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনি বলতে পারবেন মিতার কি হয়েছে?’
দাদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ধৈর্য ধর। ডাক্তার দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরে জানতে পারবে।‘
আস্তে আস্তে সবাই আসতে শুরু করেছে। মিতার ভাইয়েরা, ওদের বউরা, মিতার মেজ বোন, মেজো জামাইবাবু। আমাদের আত্মীয়র অনেক ভিড় হয়ে গেল। ডাক্তাররা
দেখে বেড়িয়ে গেল। দিদি আমাকে ঠ্যালা দিয়ে একজন ডাক্তার দেখিয়ে বলল, ‘ইনি সবচেয়ে বড় ডাক্তার। এনাকে জিজ্ঞেস করো।‘
আমি কাছে গিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললাম, ‘ডাক্তারবাবু আমি পেশেন্টের স্বামী। বলবেন কি কি হয়েছে আমার স্ত্রীর?’
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন, বললেন, ‘আপনি তো বাইরে ছিলেন। ভালো হয়েছে এসে গেছেন। আসুন আমার চেম্বারে আসুন।‘
আমি বললাম, ‘আসছি ডাক্তারবাবু, একবার মিতাকে মানে আমার স্ত্রীকে দেখে আসি।‘
ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে আবার সবার সাথে আলোচনা করতে করতে হাঁটতে লাগলেন সামনের দিকে। আমি ভিতরে ঢুকলাম, মিতার পাশে দাঁড়ালাম। ইসস, একরাতে
মিতার চেহারা কি হয়ে গেছে। ও আসলে যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে একা থাকলে। আমি ছাড়া ওর কাছে অন্য কেউ থাকলেও ও নিজেকে খুব একা ফিল
করে। ওর তো চেহারা এরকম হবেই।
আমি মিতার মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘মিতা আমি এসে গেছি।‘
মিতা খুব কষ্ট করে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো, একটু হাসার চেষ্টা করলো। আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘তুমি এসে গেছ গৌতম। ভালো করেছ। এবার
আমি ঠিক হয়ে যাবো।‘
আমি মিতাকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললাম। বললাম, ‘এরকম বলছ কেন? তোমার কিছু হয় নি আমি জানি।‘
ও কাঁপা হাতে আমার চোখ মুছিয়ে বলল, ‘নাগো গৌতম এবারটা মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি হয়েছে। এতো মাথা যন্ত্রণা আমার আগে হয় নি।‘
মিতার মাইগ্রেন আছে। সিজিন চেঞ্জ হলেই মাথা যন্ত্রণা হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘না না এটা তো তোমার আগের মত। দেখবে
ঠিক হয়ে যাবে। আমি থাকলে কিছুতেই হাসপাতালে আনতাম না। আমি জানি যে আমার হাত পরলেই তোমার ঠিক হয়ে যায়।‘
মিতা আমার হাতটা চেপে ধরল। চোখ খুলে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বলল, ‘ডাক্তারের ওষুধে ব্যথাটা একটু কমেছিল। আবার যেন মনে হচ্ছে বাড়ছে। তুমি ট্যুর
থেকে ফিরলে না? দ্যাখো কি কষ্ট দিলাম তোমায়।‘
মনে হচ্ছে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠি। কিন্তু সবার সামনে করতে যে পারি না। মিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘তুমি একটু একা থাক। ডাক্তার কি দেখল জেনে আসি।‘
বেড়িয়ে যেতে যেতে মিতা বলল, ‘ডাক্তার সকালে আমার মাথা স্ক্যান করেছে। কিন্তু আমাকে কিছু বলে নি।‘
আমি ওখান থেকে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমাকে ডেকেছে। আমাকে বলবে বোধহয়। আমি আসছি।‘
আমি বেড়িয়ে গেলাম। মিতার বড় আর মেজো জামাইবাবু আমার সাথে বেড়িয়ে এলো। আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। কেবিনে যেতেই ডাক্তার আমাদের দেখে ডেকে
নিল ভিতরে। বসতে বলল। আমি কাঁপা পায়ে একটা চেয়ারে বসলাম। আমার পাশে বড় ভায়রা তার পাশে মেজো।
ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, ‘আজ সকালে আপনার স্ত্রীকে ভর্তি করে ভালই হয়েছে। সকাল সকাল স্ক্যানটা করে নিতে পারা গেছে।‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিতার অসুবিধেটা কি ডাক্তার? একটু খুলে বলবেন আমাদের?’
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্ক্যান রিপোর্ট দেখে আমি এখুনি কোন মতামত জানাবো না। তবে মিতার কেসটা কমপ্লিকেটেড। আমার সিনিওরের কাছে
রিপোর্ট পাঠিয়েছি। ওখান থেকে এলেই বলতে পারবো মিতার কি হয়েছে।‘
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু কোন অনুমান? আপনারা তো ডাক্তার, বুঝতে তো কিছু পারেন।‘
ডাক্তার কিছু একটা লিখতে লিখতে বললেন, ‘হ্যাঁ তা ঠিকই। তবে এই কেসে না বলাই ভালো।‘
ডাক্তার যত কথা বলছেন তত আমার উদ্বেগ বাড়ছে। কেন তিনি বলছেন না? তিনি জানেন না এটা হতেই পারে না। উনি কেন বললেন এই কেসে কিছু না বলাই ভালো।
আমি কি করবো ঠাকুর?
বড় ভায়রা পাশ থেকে বললেন, ‘গৌতম রিপোর্ট আসতে দাও। ততক্ষণ আমরা ওয়েট করি।‘
আমি দাদার দিকে তাকালাম। ওয়েট করা, কতক্ষণ? মিতাকে কি বলব? নিজেকে কি জবাব দেব? আমার গলা ভীষণ শুকিয়ে গেছে। ডাক্তারের টেবিলের উপর রাখা
জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নিলাম। মেজদা বারন করতে গেছিলেন, ডাক্তার হাত তুলে না করলেন দেখলাম।
জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তারকে, ‘রিপোর্ট কখন আসবে ডাক্তারবাবু?’
উনি উত্তর দিলেন, ‘এসে যাবার তো কথা। এই দ্যাখো তো নিচে। আউট সেকশনে রিপোর্টটা এসেছে কিনা?’
একটা লোক রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার তিন মিনিট বাদে অন্য একজন ঢুকে ডাক্তারের হাতে একটা বড় ফোল্ডার দিল। ডাক্তার ওটা দেখে বলে উঠলেন, ‘এই তো
রিপোর্টটা। যাক এসে গেছে। গৌতম বাবু আপনারা এক্বটু বাইরে অপেক্ষা করুন। আপনাদের ডেকে পাঠাচ্ছি।‘
আমরা উঠে বাইরে চলে এলাম। বড়দাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, ডাক্তারটা কেমন? জানেন আপনি?’
বড়দা বললেন, ‘যা শুনেছি কোলকাতার একজন নামকরা সার্জন।‘
আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সার্জন? উনি কি করবেন? মিতার তো মাথা ব্যথা।‘
বড়দা উত্তর দিলেন, ‘কে জানে উনিই তো দেখছেন। দেখাই যাক না।‘
আমি মনে মনে আওরাতে লাগলাম। কি আশ্চর্য, মাথা ব্যথার জন্য সার্জন? কি যে হচ্ছে?
প্রায় দশ মিনিট বাদে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। আমরা আবার ঢুকে বসলাম চেয়ারে। ডাক্তার গলা সাফ করে বললেন, ‘হ্যাঁ আমি যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই ঠিক
গৌতম বাবু।‘
আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সন্দেহ করেছিলেন?’
ডাক্তার রিপোর্ট পড়তে পড়তে বললেন, ‘মিতা মানে আপনার স্ত্রীর ব্রেন টিউমার। আর এটা হঠাৎ নয়। আমার মনে হয় ছোটবেলা থেকে মিতার ছিল। এটা এখন বড়
হয়েছে।‘
আমার চোয়াল ঝুলে গেল। ব্রেন টিউমার? ডাক্তার বলেন কি? আমি দাদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘দাদা আমি যা শুনলাম আপনারা তাই শুনলেন?’
দাদা আমার কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল। আমি আবার ডাক্তারকে বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। মিতার মাইগ্রেন আছে। ওর টিউমার
থাকবে কি করে?’
ডাক্তার আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘গৌতম বাবু মাইগ্রেন একটা রোগের নাম। মাইগ্রেন আর টিউমার এক নয়।‘
আমি নাছোড়বান্দার মত বললাম, ‘কিন্তু ওর যে মাঝে মাঝে মাথা ব্যাথা হত, একটু হাত বুলালেই সেরে যেত।‘
ডাক্তার বললেন, ‘আপনাদের মনে হত সেরে যেত। কিন্তু ওটা থেকে যেত। আর সেটাই এখন বড় আকার নিয়েছে।‘
বড়দা আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে এখন কি হবে ডাক্তার বাবু?’
ডাক্তার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘অপারেশন ছাড়া কোন পথ নেই।‘
আমরা তিনজনে বলে উঠলাম, ‘অপারেশন?’
ডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে জানি না ঠিক হবে কিনা। টিউমার অপারেশনে কোনদিন ঠিক হয় না। সাময়িক রিলিফ হতে পারে। আর এই অপারেশন লিডস টু মোর
কমপ্লিকেশি। নাও ইউ ডিসাইড কি করবেন আপনারা?’
বড়দা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সাজেস্ট করেন ডাক্তার বাবু?’
ডাক্তার বললেন, ‘আমি অপারেশন সাজেস্ট করবো। যদি ঠিক হয়ে যায়।‘
আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, ‘আর যদি না ঠিক হয়…’ বাকিটা বলতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম ডাক্তারের সামনে।
মেজদা আমাকে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন। বলতে লাগলেন, ‘গৌতম তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি ভেঙ্গে পরলে মিতাকে কে সামলাবে? তুমি স্টেডি
হও।‘
আমাকে টেনে নিয়ে এলো নিচে ফাঁকা জায়গায়। আমি উপরে চোখ তুলে দেখলাম। নীল আকাশটা কেমন কালচে রঙের দেখাচ্ছে। রোদ যেন শীতল আগুন। আমার
চারপাশে সবাই ভিড় করছে। ওরা সব আলোচনা করছে। এতো ভিড়ে আমি একদম একা। কেউ নেই যেন আমার কাছে। মিতার কথা মনে আসছে।
বিয়ের পর কোন একসময় মিতা বলেছিল, ‘জানো গৌতম, আমার কি ইচ্ছে?’
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে, ‘কি ইচ্ছে বোলো দেখি।‘
মিতা আমার গালে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ইচ্ছে আমার যেন খুব বড় কোন রোগ হয়। তাহলে তুমি আমার পাশে থেকে সারাদিন সেবা করবে আমার। আমি কি
ভাগ্যবান স্ত্রী হব বলতো। ভাগ্যবান স্ত্রীই স্বামীর সেবা পায়।‘
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। কিছু বলি নি।
মিতা কষ্টে আছে। মিতার কি হবে আমি জানি না। আমার সারা গা হাতপা কাঁপছে। আমি ধীরে ধীরে ঘাসের উপর বসে পরলাম। কে যেন আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।
আমি উপরের দিকে তাকিয়ে ভগবানকে বললাম, ‘ঠাকুর, জীবনের সুখের পিছনে তুমি এই দুঃখ লুকিয়ে রেখেছিলে? আমাকে একবারও জানতে দাও নি। এখন আমি
কি করবো? তুমি বলে দেবে?’
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। এই রঙ্গিন পৃথিবী আমার চোখে কেমন ঝাপসা হয়ে উঠলো। কাছের জিনিস সব একে একে হারিয়ে যেতে লাগলো ওই ঝাপসা দৃষ্টির
সামনে।
(সমাপ্ত)
কি ব্যাপার? এত সকালে দিদির ফোন? বাজতে বাজতে বন্ধও হয়ে গেল। আমি আস্তে করে সরে এলাম জানলার দিকে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। বুকটা দুরুদুরু
করে উঠলো। কোন খারাপ খবর নয় তো? খারাপ খবরই হবে নাহলে এতো সকালে দিদি কেন ফোন করবে?
আমি বিদিশাদের দিকে তাকালাম। সবাই ঘুমোচ্ছে। সব ল্যাংটো। নিকিতার মুখ হা হয়ে রয়েছে। তেমনি বিদিশারও। চিত্ত বিদিশার বুকে মুখ গুজে ঘুমোচ্ছে। ওদের এই
নগ্ন ভাব অন্য সময়ে হয়ত আমার লিঙ্গে তাপ আনত, কিন্তু এখন যে আমার কিছুই ভাল লাগছে না।
করবো কি ফোন? কাঁপা হাতে আমি মিস কলে গিয়ে দিদির নাম্বার দাবালাম। ফোন বেজে উঠতেই দিদি জেন ওয়েট করছিল আমার জন্য।
দিদির গলা ভেসে এলো, ‘কে গৌতম?’
আমি আস্তে করে উত্তর দিলাম যাতে বিদিশাদের ঘুম না ভাঙে, ‘হ্যাঁ গৌতম বলছি। কি ব্যাপার দিদি এতো সকালে ফোন?’
দিদি বলল, ‘না করে উপায় ছিল না গৌতম।‘
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন, কি হয়েছে? দাদা ঠিক আছে?’
দিদি বলল, ‘না দাদা না।‘
আমি আবার উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কে?’ বলে দিদির বাড়ির সবার নাম একে একে বলে গেলাম।
দিদি আবার বলল, ‘না গৌতম ওরাও না।‘
আমি একটু গলা তুলে বললাম, ‘তাহলে কে দিদি কে? মিতা?’
মিতার কথা শুনে দিদি হু হু করে কেঁদে ফেলল। আমি স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দিদি কাঁদুক, দিদি কথা বলার পর আমি জানি আমায় কাঁদতে হবে। আমি ধীরে ধীরে
রুমের বাইরে বেরিয়ে এলাম, দরজায় লক করে যাতে আপনা আপনি বন্ধ না হয়ে যায়। টেনে দিলাম দরজা। আমি চাই না বিদিশারা আমার কান্না দেখুক। আমাকে
কাঁদতে হবে একা নির্জনে।
দিদি বেশ কিছুক্ষণ পরে নাক টানতে টানতে বলল, ‘গৌতম আমাকে ক্ষমা কর গৌতম।‘
আমি বিরক্ত হলাম দিদির উপর। ও এতো ভনিতা করছে কেন? কেন বলছে না সোজা কথাটা? আমি তো জেনে গেছি এটা মিতা ছাড়া কেউ না। আর কেউ হতে পারে না।
কিন্তু কি হয়েছে ওর? আমি কেন এখানে?
দিদির গলা শুনতে পেলাম। দিদি বলছে, ‘গৌতম, কাল রাতে আমি মিতার কাছে ছিলাম। রাত এগারোটা নাগাদ মিতা হঠাৎ বলে উঠলো দিদি আমার মাথায় খুব ব্যাথা
হচ্ছে। যেন ছিঁড়ে পড়বে মনে হচ্ছে।‘ দিদি একটু থামল শ্বাস নিতে।
আমি বলে উঠলাম, ‘থামলেন কেন দিদি বলুন তারপর?’
আমার হাত ঘেমে উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন মোবাইলটা হাত থেকে খসে পরে যাবে। আমি শক্ত হাতে চেপে ধরলাম ফোন। কানে চেপে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিদি থেমে
থাকবেন না, বলুন।‘
দিদি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওকে কাল রাতেই হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ভর্তি করে দিয়েছি। কিন্তু রাতে কোন ডাক্তার ছিল না। হাসপাতাল সকালে আসতে বলেছে।
আমরা সবাই যাব। তুমি কি তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে?’
আমি বললাম, ‘আপনারা কি জানতে পারেন নি কি হয়েছে ওর? কিসের জন্য মাথাব্যাথা?’
দিদি জবাব দিল, ‘কিচ্ছু জানতে পারি নি বিশ্বাস করো, এই সকালে যাবো, তবে জানতে পারবো। আর বেশি কথা বললাম না, তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।‘
দিদি ফোনটা রেখে দিতেই আমি বুঝতে পারলাম আমার গা হাতপা থরথর করে কাঁপছে। এই সকালে কোথায় যাবো, কি করে যাবো, এদের নিয়ে কি করবো। কি বলব
সব চিন্তা মাথার মধ্যে এসে জমা হতে লাগলো। কিন্তু একটারও জবাব পেলাম না মনের থেকে।
মনের ভিতরটা দমকে উঠলো, আমি জানি যে এখন আমি কাঁদব, আর হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আমার মিতা হাসপাতালে শুয়ে আছে। আমি? আমার মনে হল সব কিছু
মিথ্যে। এই পৃথিবী, এই জীবন, এই সুখ সব সব। আমি করিডোরের এক কোনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তারপর মনে হল আমাকে যা কিছু হোক তাড়াতাড়ি
করতে হবে। আমি দৌড়ে নিচে গেলাম। একটা ছেলে রিসেপশনে আছে। আমাকে দেখে ‘গুড মর্নিং’ বলল।
আমি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভাই আমি খুব মুশকিলে পরে গেছি। যে করেই হোক আমাকে চারটে কোলকাতার টিকিট কেটে দিতে হবে প্লেনে।‘
ছেলেটা একটা কিছু দেখে বলল, ‘স্যার, কোলকাতার ফ্লাইট সকাল সাড়ে এগারোটায়। আশা করি ওতে পেয়ে যাবো। জানতে পারি কি স্যার কি প্রব্লেম?’
আমি বললাম, ‘তুমি জানতে পারো, কিন্তু আমি বলতে পারি না। বললেই আমি দুর্বল হয়ে যাবো। তুমি ভাই প্লিস ব্যবস্থা করো।‘
আমি দৌড়ে উপরে এলাম। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দরজা খুলে গেল। মনে পরে গেল আমি দরজাটা জাস্ট ভেজিয়ে গিয়েছিলাম। দূর থেকে ওদের নগ্ন শরীর চোখে পড়লো।
ভাগ্যিস কেউ এসে যায় নি। দরজাটা বন্ধ করে আমি বিদিশার কাছে গেলাম। ও নগ্ন হয়ে দু পা ফাঁক করে শুয়ে রয়েছে। আমার নজর দেবার ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদের
ডাকতে হবে বলতে হবে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে।
যদি ওরা জিজ্ঞেস করে এতো তাড়াহুড়ো কিসের? তাহলে আমি কি জবাব দেব?
বলতে পারবো না মিতার কথা। আমার জন্য ওরা জীবনের সুখ নষ্ট করুক আমি চাই না। আমি জীবনের সুখের কিছু সময় নাহয় মিতার জন্য ব্যয় করবো। জানতে
পারলাম সুখের পিছনে দুঃখ লুকিয়ে থাকে আর একটা সময় সেটা বেরিয়ে আসে কান্না হয়ে।
বিদিশাকে ডেকে তুললাম। বিদিশা উঠে বসে আমাকে দেখে বলল, ‘গৌতম তোমাকে কেমন জানি উদভ্রান্তের মত লাগছে। রাতে ঘুম হয় নি?’
আমি বিদিশাকে বললাম, ‘না না বিদিশা তা নয়। আমাদের কোলকাতা পৌছতে হবে শীগগির। অফিসে একটা খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আমাদের কোম্পানি এতে প্রায়
একশ কোটি টাকা লস করতে পারে। আর আমি ছাড়া কেউ নেই। সকালে বসের ফোন এসেছিল। বলল তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমি নিচে প্লেনের টিকিট কাটতে বলে
দিয়েছি। সকাল সাড়ে এগারোটার প্লেন। আমাদের তৈরি হতে হবে তাড়াতাড়ি।‘ সব কিছু বলে ভাবলাম উফ ভগবান মিতার জন্য একটুও সত্যি কথা বলতে পারবো
না?
বিদিশা ধরফর করে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘উফ বাবা তোমাদের অফিস বটে। সব কাজ তোমাকেই করতে হবে নাকি? কথা নেই বার্তা নেই ডেকে
পাঠানো। একটা কাজে এসেছ তো নাকি? এবারে গিয়ে একটু বোলো। তুমি নরম বলে ওরা সব চেপে বসে তোমার উপর, যেন আর কেউ নেই।‘
আমি দাঁত মাজতে মাজতে ভাবলাম বিদিশা কি জানবে সত্যিটা কি। আমি যেটা বললাম তাতে ওর রিয়াকশন এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু যদি আমি মিতার কথা বলি
তাহলে জানি ওর কি হতে পারে।
বিদিশা বাকিদের মানে চিত্ত আর নিকিতাকে ডেকে তুলল। আমার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। কেউ আর কোন কথা না বলে তৈরি হয়ে নিল। নাস্তা জানি আমার মুখে
ঢুকবে না, তবু ওরা যাতে না খেয়ে থাকে তার জন্য আমাকেও খেতে হবে। নাস্তা নিয়ে এলাম। ওরা খেল সাথে আমিও। খাবার এতো যে বেস্বাদ লাগে এই প্রথম বুঝলাম।
কোনরকমে খেয়ে ফেললাম। ওদেরকে যে বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।
নিচের থেকে ফোন এলো যে টিকিট হয়ে গেছে। ভগবান আছেন জানতে পারলাম। একটু যেন সুখের ছোঁওয়া পেলাম মনের মধ্যে।
সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। এয়ারপোর্টে চলে এলাম হোটেলের গাড়ীতে। বোর্ডিং পাশ নিতে নিতে মনে মনে বললাম, ‘মিতা আরেকটু আপেক্ষা করো। আমি
আসছি।‘
সিকিউরিটি চেক করার সময় নিকিতা জিজ্ঞেস করলো, ‘গৌতম ব্যাপারটা সত্যি অফিসের তো? তোমার মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না।‘
বিদিশা কথাটা শুনে বলল, ‘মনে মনে আমিও তাই ভাবছিলাম। জিজ্ঞেস করবো ঠিক করছিলাম।‘
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম, ‘আমি জানি না তোমরা এইভাবে কেন জিজ্ঞেস করছো? অফিসের ব্যাপারই।‘ নিজেকে রোধ করলাম আর কিছু বলার
থেকে কারন আমার গলা ভেঙ্গে আসছিলো।
আমার কপালই এমন আমার দুটো ভালো বন্ধুকে আমি জানাতে পারছি না আমার কি হয়েছে। জীবনের সুখ যে ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার অধিকার আমার নেই।
প্লেনে বসে আমার চোখের সামনে মিতার মুখ ভাসতে লাগলো। মিতা হাসপাতালে বালিশের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। সেদিনের মত ওর চোখের দু কোল দিয়ে জল
গড়িয়ে পরছে। ঠাণ্ডা প্লেনে আমার এতো গরম লাগছে কেন? পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছলাম। আর সবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম। কেউ
আমাকে লক্ষ্য করছে না। বাঁচা গেছে। দেখলেই জিজ্ঞেস করতো এই গরমে আমি ঘামছি কেন।
প্লেন টেক অফ করলো। অন্যান্য সময় আমার এই সময়টা একটু ভয় করে। আজ শুধু মিতার মুখ ছাড়া অন্য কিছু অনুভব হল না। প্রায় পৌনে দু ঘণ্টা পর প্লেন ল্যান্ড
করলো। আমরা আস্তে করে বেড়িয়ে এলাম। এয়ারপোর্টের বাইরে বেড়িয়ে বিদিশাকে বললাম, ‘বিদিশা তোমাদের সাথে আজ যেতে পারলাম না। তোমরা একা যেতে
পারবে তো?’
বিদিশা বলল, ‘আরে কি বলছ? নিজের জায়গায় এসে বাড়ি যেতে পারবো না? তুমি এগোও। যে কাজই থাকুক ভালো হোক এটাই কামনা করি।‘
আমি আর কিছু না বলে হাত নাড়িয়ে চলে এলাম অন্য দিকে। ট্যাক্সি ধরে এগোতে লাগলাম। কিন্তু যাবোটা কোথায়? কোন হাসপাতালে রেখেছে তাই তো জানি না।
দিদিকে ফোন করলাম। একবার রিং বাজতেই দিদি তুলল।
দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় তুমি গৌতম?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি কোলকাতায়। যাবো কোন হাসপাতালে?’
দিদি জানালো হাসপাতালের নাম। তার মানে ভুল দিকে যাচ্ছিলাম। ড্রাইভারকে বলতে ও একবার আমার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। আবার ভুল। দিদিকে
জিজ্ঞেস করাই হল না যে মিতা কেমন আছে।
দিদিকে আবার ফোন করলাম। হতাশ হলাম দিদির ফোন অন্য কলে ব্যস্ত। ছিঃ, কেন তখন জিজ্ঞেস করলাম না।
কিছু পরে প্রায় আধা ঘণ্টা হাসপাতালের সামনে এসে পৌছুলাম। ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে। কোথায় আছে কোথায় আছে করতে করতে দেখলাম
দিদিকে। প্রানে যেন জান এলো। দিদি আমাকে দেখতে পায় নি। দিদির হাত ধরে বললাম, ‘দিদি আমি এসে গেছি। কোথায় মিতা?’
দিদি আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি এসে গেছ গৌতম। ডাক্তার এখন মিতাকে চেক করছে। চল যাই।‘
আমি আর দিদি দোতালাতে উঠে এলাম। কেবিনের বাইরে থেকে দেখতে পেলাম একটা ভিড় মিতার বিছানা ঘিরে রয়েছে। সবার পরনে সাদা আপ্রন। মনে হয় সবাই
ডাক্তার। দিদিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতো ভিড় কেন?’ মিতার পাগুলো আমার চোখের সামনে। বাকি ভিড়ে ঢাকা।
দিদি বলল, ‘এখন কিছু জানি না গৌতম। এইবার জানতে পারবো। কাল রাতে প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হয়েছিল মিতার। কিভাবে রাত কাটিয়েছি বলতে পারবো না।
ঠাকুরকে ডাকছিলাম কোনরকমে সকালটা আসুক।‘
দাদাকে দেখলাম মানে মিতার জামাইবাবুকে। ছুটে গেলাম দাদার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনি বলতে পারবেন মিতার কি হয়েছে?’
দাদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ধৈর্য ধর। ডাক্তার দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরে জানতে পারবে।‘
আস্তে আস্তে সবাই আসতে শুরু করেছে। মিতার ভাইয়েরা, ওদের বউরা, মিতার মেজ বোন, মেজো জামাইবাবু। আমাদের আত্মীয়র অনেক ভিড় হয়ে গেল। ডাক্তাররা
দেখে বেড়িয়ে গেল। দিদি আমাকে ঠ্যালা দিয়ে একজন ডাক্তার দেখিয়ে বলল, ‘ইনি সবচেয়ে বড় ডাক্তার। এনাকে জিজ্ঞেস করো।‘
আমি কাছে গিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললাম, ‘ডাক্তারবাবু আমি পেশেন্টের স্বামী। বলবেন কি কি হয়েছে আমার স্ত্রীর?’
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন, বললেন, ‘আপনি তো বাইরে ছিলেন। ভালো হয়েছে এসে গেছেন। আসুন আমার চেম্বারে আসুন।‘
আমি বললাম, ‘আসছি ডাক্তারবাবু, একবার মিতাকে মানে আমার স্ত্রীকে দেখে আসি।‘
ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে আবার সবার সাথে আলোচনা করতে করতে হাঁটতে লাগলেন সামনের দিকে। আমি ভিতরে ঢুকলাম, মিতার পাশে দাঁড়ালাম। ইসস, একরাতে
মিতার চেহারা কি হয়ে গেছে। ও আসলে যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে একা থাকলে। আমি ছাড়া ওর কাছে অন্য কেউ থাকলেও ও নিজেকে খুব একা ফিল
করে। ওর তো চেহারা এরকম হবেই।
আমি মিতার মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘মিতা আমি এসে গেছি।‘
মিতা খুব কষ্ট করে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো, একটু হাসার চেষ্টা করলো। আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘তুমি এসে গেছ গৌতম। ভালো করেছ। এবার
আমি ঠিক হয়ে যাবো।‘
আমি মিতাকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললাম। বললাম, ‘এরকম বলছ কেন? তোমার কিছু হয় নি আমি জানি।‘
ও কাঁপা হাতে আমার চোখ মুছিয়ে বলল, ‘নাগো গৌতম এবারটা মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি হয়েছে। এতো মাথা যন্ত্রণা আমার আগে হয় নি।‘
মিতার মাইগ্রেন আছে। সিজিন চেঞ্জ হলেই মাথা যন্ত্রণা হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘না না এটা তো তোমার আগের মত। দেখবে
ঠিক হয়ে যাবে। আমি থাকলে কিছুতেই হাসপাতালে আনতাম না। আমি জানি যে আমার হাত পরলেই তোমার ঠিক হয়ে যায়।‘
মিতা আমার হাতটা চেপে ধরল। চোখ খুলে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বলল, ‘ডাক্তারের ওষুধে ব্যথাটা একটু কমেছিল। আবার যেন মনে হচ্ছে বাড়ছে। তুমি ট্যুর
থেকে ফিরলে না? দ্যাখো কি কষ্ট দিলাম তোমায়।‘
মনে হচ্ছে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠি। কিন্তু সবার সামনে করতে যে পারি না। মিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘তুমি একটু একা থাক। ডাক্তার কি দেখল জেনে আসি।‘
বেড়িয়ে যেতে যেতে মিতা বলল, ‘ডাক্তার সকালে আমার মাথা স্ক্যান করেছে। কিন্তু আমাকে কিছু বলে নি।‘
আমি ওখান থেকে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমাকে ডেকেছে। আমাকে বলবে বোধহয়। আমি আসছি।‘
আমি বেড়িয়ে গেলাম। মিতার বড় আর মেজো জামাইবাবু আমার সাথে বেড়িয়ে এলো। আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। কেবিনে যেতেই ডাক্তার আমাদের দেখে ডেকে
নিল ভিতরে। বসতে বলল। আমি কাঁপা পায়ে একটা চেয়ারে বসলাম। আমার পাশে বড় ভায়রা তার পাশে মেজো।
ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, ‘আজ সকালে আপনার স্ত্রীকে ভর্তি করে ভালই হয়েছে। সকাল সকাল স্ক্যানটা করে নিতে পারা গেছে।‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিতার অসুবিধেটা কি ডাক্তার? একটু খুলে বলবেন আমাদের?’
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্ক্যান রিপোর্ট দেখে আমি এখুনি কোন মতামত জানাবো না। তবে মিতার কেসটা কমপ্লিকেটেড। আমার সিনিওরের কাছে
রিপোর্ট পাঠিয়েছি। ওখান থেকে এলেই বলতে পারবো মিতার কি হয়েছে।‘
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু কোন অনুমান? আপনারা তো ডাক্তার, বুঝতে তো কিছু পারেন।‘
ডাক্তার কিছু একটা লিখতে লিখতে বললেন, ‘হ্যাঁ তা ঠিকই। তবে এই কেসে না বলাই ভালো।‘
ডাক্তার যত কথা বলছেন তত আমার উদ্বেগ বাড়ছে। কেন তিনি বলছেন না? তিনি জানেন না এটা হতেই পারে না। উনি কেন বললেন এই কেসে কিছু না বলাই ভালো।
আমি কি করবো ঠাকুর?
বড় ভায়রা পাশ থেকে বললেন, ‘গৌতম রিপোর্ট আসতে দাও। ততক্ষণ আমরা ওয়েট করি।‘
আমি দাদার দিকে তাকালাম। ওয়েট করা, কতক্ষণ? মিতাকে কি বলব? নিজেকে কি জবাব দেব? আমার গলা ভীষণ শুকিয়ে গেছে। ডাক্তারের টেবিলের উপর রাখা
জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নিলাম। মেজদা বারন করতে গেছিলেন, ডাক্তার হাত তুলে না করলেন দেখলাম।
জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তারকে, ‘রিপোর্ট কখন আসবে ডাক্তারবাবু?’
উনি উত্তর দিলেন, ‘এসে যাবার তো কথা। এই দ্যাখো তো নিচে। আউট সেকশনে রিপোর্টটা এসেছে কিনা?’
একটা লোক রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার তিন মিনিট বাদে অন্য একজন ঢুকে ডাক্তারের হাতে একটা বড় ফোল্ডার দিল। ডাক্তার ওটা দেখে বলে উঠলেন, ‘এই তো
রিপোর্টটা। যাক এসে গেছে। গৌতম বাবু আপনারা এক্বটু বাইরে অপেক্ষা করুন। আপনাদের ডেকে পাঠাচ্ছি।‘
আমরা উঠে বাইরে চলে এলাম। বড়দাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, ডাক্তারটা কেমন? জানেন আপনি?’
বড়দা বললেন, ‘যা শুনেছি কোলকাতার একজন নামকরা সার্জন।‘
আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সার্জন? উনি কি করবেন? মিতার তো মাথা ব্যথা।‘
বড়দা উত্তর দিলেন, ‘কে জানে উনিই তো দেখছেন। দেখাই যাক না।‘
আমি মনে মনে আওরাতে লাগলাম। কি আশ্চর্য, মাথা ব্যথার জন্য সার্জন? কি যে হচ্ছে?
প্রায় দশ মিনিট বাদে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। আমরা আবার ঢুকে বসলাম চেয়ারে। ডাক্তার গলা সাফ করে বললেন, ‘হ্যাঁ আমি যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই ঠিক
গৌতম বাবু।‘
আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সন্দেহ করেছিলেন?’
ডাক্তার রিপোর্ট পড়তে পড়তে বললেন, ‘মিতা মানে আপনার স্ত্রীর ব্রেন টিউমার। আর এটা হঠাৎ নয়। আমার মনে হয় ছোটবেলা থেকে মিতার ছিল। এটা এখন বড়
হয়েছে।‘
আমার চোয়াল ঝুলে গেল। ব্রেন টিউমার? ডাক্তার বলেন কি? আমি দাদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘দাদা আমি যা শুনলাম আপনারা তাই শুনলেন?’
দাদা আমার কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল। আমি আবার ডাক্তারকে বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। মিতার মাইগ্রেন আছে। ওর টিউমার
থাকবে কি করে?’
ডাক্তার আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘গৌতম বাবু মাইগ্রেন একটা রোগের নাম। মাইগ্রেন আর টিউমার এক নয়।‘
আমি নাছোড়বান্দার মত বললাম, ‘কিন্তু ওর যে মাঝে মাঝে মাথা ব্যাথা হত, একটু হাত বুলালেই সেরে যেত।‘
ডাক্তার বললেন, ‘আপনাদের মনে হত সেরে যেত। কিন্তু ওটা থেকে যেত। আর সেটাই এখন বড় আকার নিয়েছে।‘
বড়দা আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে এখন কি হবে ডাক্তার বাবু?’
ডাক্তার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘অপারেশন ছাড়া কোন পথ নেই।‘
আমরা তিনজনে বলে উঠলাম, ‘অপারেশন?’
ডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে জানি না ঠিক হবে কিনা। টিউমার অপারেশনে কোনদিন ঠিক হয় না। সাময়িক রিলিফ হতে পারে। আর এই অপারেশন লিডস টু মোর
কমপ্লিকেশি। নাও ইউ ডিসাইড কি করবেন আপনারা?’
বড়দা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সাজেস্ট করেন ডাক্তার বাবু?’
ডাক্তার বললেন, ‘আমি অপারেশন সাজেস্ট করবো। যদি ঠিক হয়ে যায়।‘
আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, ‘আর যদি না ঠিক হয়…’ বাকিটা বলতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম ডাক্তারের সামনে।
মেজদা আমাকে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন। বলতে লাগলেন, ‘গৌতম তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি ভেঙ্গে পরলে মিতাকে কে সামলাবে? তুমি স্টেডি
হও।‘
আমাকে টেনে নিয়ে এলো নিচে ফাঁকা জায়গায়। আমি উপরে চোখ তুলে দেখলাম। নীল আকাশটা কেমন কালচে রঙের দেখাচ্ছে। রোদ যেন শীতল আগুন। আমার
চারপাশে সবাই ভিড় করছে। ওরা সব আলোচনা করছে। এতো ভিড়ে আমি একদম একা। কেউ নেই যেন আমার কাছে। মিতার কথা মনে আসছে।
বিয়ের পর কোন একসময় মিতা বলেছিল, ‘জানো গৌতম, আমার কি ইচ্ছে?’
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে, ‘কি ইচ্ছে বোলো দেখি।‘
মিতা আমার গালে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ইচ্ছে আমার যেন খুব বড় কোন রোগ হয়। তাহলে তুমি আমার পাশে থেকে সারাদিন সেবা করবে আমার। আমি কি
ভাগ্যবান স্ত্রী হব বলতো। ভাগ্যবান স্ত্রীই স্বামীর সেবা পায়।‘
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। কিছু বলি নি।
মিতা কষ্টে আছে। মিতার কি হবে আমি জানি না। আমার সারা গা হাতপা কাঁপছে। আমি ধীরে ধীরে ঘাসের উপর বসে পরলাম। কে যেন আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।
আমি উপরের দিকে তাকিয়ে ভগবানকে বললাম, ‘ঠাকুর, জীবনের সুখের পিছনে তুমি এই দুঃখ লুকিয়ে রেখেছিলে? আমাকে একবারও জানতে দাও নি। এখন আমি
কি করবো? তুমি বলে দেবে?’
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। এই রঙ্গিন পৃথিবী আমার চোখে কেমন ঝাপসা হয়ে উঠলো। কাছের জিনিস সব একে একে হারিয়ে যেতে লাগলো ওই ঝাপসা দৃষ্টির
সামনে।
(সমাপ্ত)