24-12-2021, 05:43 PM
মাথাটা কোনো কাজ করছে না। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। মিত্রা আমার খুব ক্লোজ, কিন্তু আমি অনেক কিছু এখনো জানি না। মিত্রা আমার কাছে কি চায়। শুধু শরীর, না আরো কিছু। মায়ের চেনটা ওকে পরাতে গেছিলাম, ও ফিরিয়ে দিয়েছিলো। ওকে সেদিন বুঝতে দিই নি, তবে খটকা একটা আমার মনে লেগেছিলো। সত্যি যদি মিত্রা আমাকে ভালোবাসে, তাহলে সেদিন ওটা ও গ্রহণ করলো না কেনো! ও বলেছিলো মিঃ ব্যানার্জী একটা বাস্টার্ড। সে ওর জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। তাহলে আজ মিঃ ব্যানার্জীর কাছে ও গেলো কেনো। কিসের তাগিদে। মিত্রা বলেছিলো, মিঃ ব্যানার্জী এখানে থাকেন না। রবীন যা বললো, তাতে মিঃ ব্যানার্জী কলকাতায় থাকেন। নার্সিংহোমের মালিক কে মিত্রা বলেছিলো, মিঃ ব্যানার্জী পঞ্চাশ শতাংশের মালিক। কিন্তু রবিন উল্টো কথা বলছে। একাকিত্ব মিত্রার বিগড়ে যাওয়ার একটা মূল কারণ। এছাড়া আর কোনো কারণ! কলেজ লাইফে মিত্রাদের বাড়ি গেছি। ওদের পয়সা ছিলো, কিন্তু কত পয়সা ছিলো, যাতে মিত্রা এরকম একটা কাগজের পঁচাত্তর শতাংশের মালিক হয়ে যেতে পারে। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
এখন কি করবো। মিত্রার বাড়ি যাবো, না বাড়ি ফিরে যাবো। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম। একটা উত্তরই আমার কাছে ভেসে আসছে। ও আমাকে এতো কোটি টাকার মালিক বানিয়েছে। অনেকে চেয়ে পায় না, আমি অনাহূতের মতো তা পেয়েছি। হয়তো এর মধ্যে দিয়ে ওর কিছু উদ্দেশ্য সিদ্ধি হতে পারে, তবু আমার কাছে এটা অনেক, এই কারণেই ওর পাশে আমার দাঁড়ানো উচিত।
আমি একটা ট্যাক্সি ধরলাম, সোজা চলে এলাম মিত্রার বাড়িতে। গেট দিয়ে ঢুকতেই দারোয়ান এগিয়ে এলো। -ও অনিবাবু, মা তো ফেরেন নি।
-কে আছে ভেতরে।
-বুড়িমাসি আছে।
-ও।
গট গট করে ভেতরে চলে এলাম। শুনশান। ভুতুরে বাড়ির মতো মনে হচ্ছে। চারিদিকে লাইট জ্বলে আছে, তবু কেমন অন্ধকার অন্ধকার। পোর্টিকোর নীচে এসে দাঁড়াতেই বুড়িমাসি এগিয়ে এলো।
-তুই কখন এলি।
-এই তো এখুনি। মিত্রা কোথায়।
-কোথায় আবার। যেখানে যাবার সেখানে গেছে। মেয়েটা এই করতে করতেই একদিন শেষ হয়ে যাবে।
মাথা নীচু করলাম।
-তুইতো ওর বন্ধু শোধরাতে পারিস না। বড়লোকের যত সব…….
-কি হয়েছে কি আমাকে খুলে বলো।
-কি বলবো। ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, তাই ছেড়ে যেতে পারছি না।
-তুমি আমায় আগে দেখো নি।
-দেখেছি, মনে থাকে কখনো। কতদিন আগের কথা। চা খাবি।
-দাও।
বুড়িমাসি চলে গেলো। আমি নিচের হলঘরে সেন্টার টেবিলের চারধারে রাখা সোফার একটা দখল করে বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম, দশটা বাজে।
বুড়িমাসি চা নিয়ে এলো।
-ওরা কখন ফিরবে।
-ঠিক আছে নাকি। একটা, দেড়টা, দুটো কখন ফেরে।
চায়ে চুমুক দিলাম।
-এই মেয়েটা কতো ভালো ছিল, কত হাসি খুসি, এখন দেখ। মায়া পরে গেছে, আর কত্তাবাবুর জন্য রয়েছি, না হলে কবে ছেড়ে চলে যেতাম, ঝাঁটা মারো ওরকম কাজে।
-তুমি রাগ করছো কেনো। ওর হয়তো কোনো কাজ থাকতে পারে।
-ছাই কাজ আছে, মদ গিলতে গেছে, আমাদের বস্তির গুলো ধেনো খায়, ওরা একটু দামি খায়, সব এক।
-তোমায় কে বললো।
-ওই তো মর্কট রবীন। ও ও একটা তেঁয়েটে।
-কেনো গো।
-আর বলিস কেনো, ওপর থেকে মায়ের বোতল চুরি করে এনে খায়।
-তুমি কিছু বলো না।
-অনেক আছে একটু আধটু নিলে ক্ষতি নেই। খাক, কি করবে। বউটা মরে গেলো। বাচ্চাটা দাদু দিদার কাছে থাকে।
-আবার বিয়ে করলো না কেনো।
-বিয়ে করলে এখানে ঝি গুলোর সঙ্গে ফস্টি নস্টি করবে কি করে।
-মিত্রা জানে না।
-মা আমার সাক্ষাত দেবী। ওই একটু খারাপ রোগে ধরেছে, মদ খাওয়া। তুই তো ওর বন্ধু পারিস না এই রোগটা ছাড়াতে।
-তুমি তো বললে ছোট থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছো। তুমিও তো বলতে পারো।
-বলে বলে থুতুতে আঁঠা জম্মেছে, বরটাই তো ওকে সব্বনাশের পথে নিয়ে গেলো।
-সেটা আবার কে।
-ওই যে গো ডাক্তার।
-যাঃ, তুমি বাজে কথা বলছো, ডাক্তার ভালো মানুষ। মিত্রা আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছে।
-ভালো মানুষ, নষ্ট চরিত্রি। একটা বউ থাকতে আর একটা বিয়ে করে। মা আমার লক্ষ্মী প্রতিমে। তাও ঘর করছিলো, তারপর সব নিয়ে, দিলে তাড়িয়ে।
আমি চুপচাপ। বুড়ীমাসির দিকে তাকিয়ে রয়েছি।
-সে অবস্থাতো তুমি দেখো নি, মা ঠাকরনের জন্য সব হয়েছে।
-কেনো।
-মা ঠাকরনের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, বড় ডাক্তার, বিদেশে থাকতো, অনেক পয়সা, তাই বিয়ে দিয়েছিলো। কত্তাবাবু কত বারণ করেছিলো, কে জানতো দোজ বরে। ওর একটা মেম বউ আছে, যখন জানা জানি হলো, তখন ডাক্তার গুছিয়ে নিয়েছে। মা তো আমার একবার বিদেশে গেছিলো, সেখানেই তো সব নিজের চোখে দেখে এসেছে।
-ডাক্তারের বয়স ওর থেকে বেশি।
-হবে না লোভ, সম্পত্তি পাবে না। বাবুর একমাত্র মেয়ে অগাধ সম্পত্তি। সেই জন্য বুড়ো বয়েসে এখানে এসে একটা বিয়ে করলে। বউ থাকতেও।
-এখন থাকে কোথায়।
-সিঁথিতে।
-মেমকে নিয়ে।
-না না ওটাকে ছেড়ে দিয়েছে।
-তাহলে তো মিত্রার সঙ্গে থাকতে পারে।
-থাকবে কি করে, সে তো জজসাহেবের কাছে লিখে দিয়ে এসেছে। থাকবে না বলে।
-মিত্রা যে মাথায় সিঁদুর দেয়।
-মা এখনো বিশ্বাস করে ডাক্তার তার স্বামী। প্রথম বিয়ে তো। ভুলতে পারে না। তাছাড় কি জানো তো, গায়ে হলুদ মাখলে আর কুমীরে ধরে না।
আমি চুপ।
-তুমি দেখো তো ওকে একটু ভালো করতে পারো কিনা।
-আমি কি ভগবান।
-তোমার দেশের বাড়িতে গেছিলো। এসে কত গল্প করলো। সেই আগের মাকে যেন ফিরে পাচ্ছিলাম, আমাকে বললো তোমায় একবার নিয়ে যাবো বুড়ীমাসি। তা আমি বললুম বেশ নিয়ে যাস, যাবো খোন। বেশ কয়েক দিন ভালো ছিল। আবার শুরু করলে।
খুব উতসুক হচ্ছিলো বুড়ী মাসিকে নার্সিংহোমের কথাটা জিজ্ঞাসা করতে, কিন্তু বুড়ীমাসি যদি সন্দেহ করে, কিন্তু আমার মনের বাঁধ ভেঙে পরলো, এ সুযোগ আর আসবে না। আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো অনি এ সুযোগ তুই ছাড়িস না।
বুড়ীমাসি কাঁদছিলো, কাপরের খুঁট দিয়ে চোখের কোন মুছছিলো। আমি সোফা থেকে নীচে বুড়ীমাসির কাছে গিয়ে বসলাম
-তুমি কাঁদছো কেনো।
-জানো, মা আমার সাতদিন ঠিকমতো খেতে পারে না, শুতে পারে না, অফিসে নাকি গন্ডগোল কাকে নিয়ে।
-অফিসে গন্ডগোল, কই জানিনা তো।
-তুমি জানবে কি করে। ওই মিনসের একটা ভাগ্নে ওখানে আছে, সেই গন্ডগোল করেছে। মা আমার বার বার তার কাছে গেছিলো, বলেছে আমার দ্বারা কিছু হবে না।
-তোমাকে অফিসের কথা সব বলে না।
-বলে । যখন মন ভালো থাকে।
-তুমিতো ওর কাছে থাকতে পারো রাতে।
-থাকি তো, আমারওতো সংসার আছে। সেখানে সাতটা পোষ্য।
-ডাক্তারের তো নার্সিংহোম আছে, আরো টাকার কি দরকার।
-রাখো তোমার নার্সিংহোম। ওটা ডাক্তারের ছেলের নামে, সে বিদেশে থাকে, ডাক্তার দেখাশোনা করে, সে বলেছে মাকে বিয়ে করবে।
-ডাক্তারের ছেলে!
-হ্যাঁ গো, প্রথম পক্ষের সেই মেমসাহেবের ছেলে।
-মিত্রা কি বলে।
-আমরা মেয়ে মানুষেরা তা পারি সম্পর্কে ছেলের সঙ্গে বিয়ে করতে। যতই ছাড়াছাড়ি হোক।
-ডাক্তার কি বলে।
-তার তো ভারি মজা, সম্পত্তি পাবে। সম্পত্তি নয়তো বিষ।
-এই বাড়িটা কাদের? এটা তো মিত্রাদের নয়, আমি তো ওই বাড়িতে গেছিলাম।
-হ্যাঁ, আনন্দ চ্যাটার্জী লেনে। ওটা বড়বাবু নিয়েছেন, বাবুকে কাগজের ভাগ দিয়েছেন, আর এটা মা ঠাকরনের বাপের বাড়ির ভাগ। সেই নিয়েই তো মাঠাকরনের এত দেমাক।
-তোমার বাড়িটা যেনো এখানে কোথায়।
-মদনমোহনতলা, হেঁটে গেলে দশ মিনিট।
-তুমি বাড়ি যাও না।
-যাই তো, সকাল সকাল আসি, মার দেখা শোনা করি, তারপর মা বেরিয়ে গেলে চলে যাই আবার বৈকালের দিকে আসি। রাত পযর্ন্ত থেকে চলে যাই।
-আমার সম্বন্ধে মিত্রা তোমায় কিছু বলে নি।
-খারাপ কিছু বললে তোমায় এতো কথা বলি।
বাইরের গেটে হর্ন বেজে উঠলো। বুড়ীমাসি উঠে দাঁড়ালো, এলেন রাজ্য জয় করে।
ঘড়ির দিকে তাকালাম, সাড়ে বারোটা বাজে।
আমি সোফায় বসলাম।