20-12-2021, 09:30 AM
........ পরপর তিন সপ্তাহ অফিস করে সুচির বাবা বুঝলেন যে বাবাকে একা ঘরে ফেলে যাওয়া উচিত হচ্ছে না। সারাদিন রেডিও শুনেই সুচির ঠাকুর্দা দিন কাটিয়ে দেন। ছেলেকে নিজের অসুবিধার কথা কখনোই বলেন না। অসুবিধার কথা না বললেও সুচির বাবা ঠিক বুঝতে পারতেন সবকিছু। ‘ কি করা যায় ! , এটাই সুচির বাবা সারাদিন ভাবতেন। একদিন সুচির বাবার মুখ দেখে প্রভাস জিজ্ঞাসা করলো , “ এরকম মড়া মুখ করে থাকিস কেন ? „
সুচির বাবা বললেন , “ জানিস-ই তো আমি সকালে অফিস চলে যাই। আসি বিকালে। সারাদিন বাবাকে একা ঘরে ফেলে যেতে কেমন একটা লাগে। কি করবো সেটাই ভাবছি। একটা নার্স যে রাখবো তার টাকাও নেই। „
প্রভাস কৌতুক করে বললো , “ তাহলে ফ্রির নার্স রাখ । „
সুচির বাবা বুঝতে না পেরে বললেন , “ ফ্রির নার্স ! „
প্রভাস হেসে বললো , “ বউয়ের কথা বলছি । „
এতো ভালো আইডিয়া তার মাথাতে কেন এলো না সেটা ভেবেই সুচির বাবা অবাক হলেন। আইডিয়া টা যখন কেউ দিয়েই দিয়েছে তখন শুভস্য শীঘ্রম।
তারপর এদিক ওদিক পাত্রীর খোঁজ করতে লাগলেন সুচির বাবা। কয়েক দিনের মধ্যে পাত্রী পেয়েও গেলেন। নাম সুচেতা মন্ডল। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় ছোটমাকে নিয়ে যেতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল সুচির বাবার। কিন্তু কাকা খারাপ ভাববে এটা ভেবে ছোটমাকে নিয়ে যেতে পারলেন না। দুই জন বন্ধু আর হুইলচেয়ারে করে বাবাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলেন সুচির বাবা। পাকা কথা বলে , দিনখন ঠিক করার পর ফিরলেন সবাই।
বিয়ের তারিখ ফাইনাল হয়ে গেলেও পাত্রের পকেটে কানাকড়িও নেই। তাই কারোর কাছে টাকা ধার করার সিদ্ধান্ত নিলেন সুচির বাবা। প্রথমেই মাথাতে এলো ছোটমার কথা। মাথাতে আসতেই ছোটমার কাছে হাজির , “ আমার কিছু টাকা চাই । „
কোন কাজে লাগবে সেটা না জিজ্ঞাসা করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কত টাকা ? „
সুচির বাবা বললেন , “ দশ হাজার হলে হয়ে যাবে। আমি মিটিয়ে দেবো অল্প করে অল্প করে । „
কথাটা শুনে সুনীতা দেবীর মাতৃহৃদয় কেঁদে উঠলো। দশ হাজার কেন চাইছে সেটা তিনি জানেন। তার বড়ো ছেলে তাকে কিছু না বলেই পাত্রী দেখতে গেছিল সেটা তার কানেও এসছে। এখন সে বিয়ের জন্য টাকা ধার চাইতে এসছে এটা ভেবেই সুনীতা দেবীর চোখে জল চলে এলো। কোন রকমে চোখের জল আটকে তিনি নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
মা আর সুচির বাবার সব কথা আকাশের বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন । মা নিজের ঘরে ঢুকে গেলে আকাশের বাবাও মায়ের পিছন পিছন গিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আলমারি থেকে টাকা বার করে দেওয়ার সময় আকাশের বাবা স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে মা কাঁদছে । ঘরের বাইরে এসে আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে টাকা গুলো নিজের বড়ো ছেলের হাতে দিয়ে দিলেন।
সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার বললেন , “ আমি অল্প অল্প করে মিটিয়ে দেবো সব । „
সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই সুনীতা দেবীর চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। আর এই চোখের জলের একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলেন বাইশ তেইশ বছরের শুভাশীষ মিত্র। মায়ের চোখে জল দেখে যাকে এতদিন দাদা এবং বন্ধু ভেবে এসেছিল সেই সমুর উপর খুব রাগ হতে লাগলো।
সুচির বাবা নিজের বিয়েতে ছোটমাকে নেমন্তন্ন করার ইচ্ছা থাকলেও কাকার কারনে করতে পারলেন না। আশেপাশের প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন বন্ধুবান্ধব কে নেমন্তন্ন করলেও এতদিন যাকে ভাই হিসাবে ভেবে এসছে সেই শুভাশীষ কেও নেমন্তন্ন করতে পারলেন না সুচির বাবা।
দুই দিন পর যখন প্রভাসের মায়ের সাথে সুনীতা দেবী কথা বলছিলেন তখন প্রভাসের মা জিজ্ঞেস করলেন , “ হ্যাঁ বৌমা , তোমরা নেমন্তন্ন পাওনি ? আমার ছেলেটাকে তো সমু বিয়েতে নেমন্তন্ন করলো। „
সুনীতা দেবী বাড়ির কথা বাড়িতেই রাখতে চান। বিয়েতে তার যাওয়ার ইচ্ছা খুব। কিন্তু সেই ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার স্বামী দেবাশীষ মিত্র রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন , “ নেমন্তন্ন যখন করেনি তখন কোন মুখ নিয়ে যাবে শুনি ! যেতে হবে না কারোর। „
এইসব কথা তিনি বাইরে জানাতে অনিচ্ছুক। তাই তিনি প্রভাসের মাকে বললেন , “ হ্যাঁ করেছে তো। বিয়ের দিন একটা কাজ আছে তাই যেতে পারবো না । „
প্রভাসের মা বুড়ি হয়ে গেছেন। অকপটে সব বলে দেন। এখনও বললেন , “ কেমন মা তুমি ! নিজের ছেলের বিয়েতে যাবে না ....
আজ তার মাতৃত্বের উপর কেউ কথা বললো। একটা মায়ের কাছে কথাটা যে কতটা পীড়াদায়ক সেটা সুনীতা দেবী খুব ভালো করে বুঝতে পারলেন । কথাটা শুনে বুকটা ফেটে গেল তার। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো।
ঠিক তখনই আকাশের বাবা এসে মাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সুনীতা দেবী সেই যে চোখের জল ফেলা শুরু করলেন তা আর থামল না। আমৃত্যু তিনি চোখের জল ফেলেছেন। আর এইসব চোখের জলের সাক্ষী হয়েছেন একমাত্র আকাশের বাবা। মায়ের চোখের জল দেখতে দেখতে একসময় সমুর উপর ঘৃণা হতে শুরু করেছিল আকাশের বাবার।
এতোটা বলে থামলেন আকাশের বাবা। তার চোখে অশ্রুর ফোটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে সুচির বাবা সোফায় বসে পড়েছিলেন। এতক্ষণ পর সবাই সুচির বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছেন। তিনি যে মাকে এতোটা কষ্ট দিয়েছেন সেটা তিনি জানতেন না। টাকা চাওয়ার পর মা কেঁদেছিল এটাও তিনি জানতেন না। এখন যখন জানতে পারলেন তখন বুকের পাঁজর ভেঙে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো “ মাগো , এ আমি কি করলাম মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মা। তোমাকে আমি কতো কাঁদিয়েছি । কাকার উপর রাগ করে আমি তোমার সাথেও কথা বন্ধ করে দিয়েছিল মাগো। এ আমি কি করলাম মা। এ আমি কি করলাম। „ অবশ্য এই আর্তনাদ কেউই শুনতে পাল না।
কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। যখন কোন ছেলে না বুঝে তার মা কে কাঁদায় তখন ছেলেটারও চোখের জল বার হয় বৈকি। এখন যেমন সুচির বাবার চোখের জল বেরিয়ে আসছে।
এদিকে সবকিছু শুনতে শুনতে সুচির মাও কাঁদতে লাগলেন। স্বামীর চোখের জল দেখে তার আরও কান্না পেল। কিন্তু তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য আকাশের মা আছেন। আকাশের মা সবকিছু শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছু যে এতো ব্যাথা , যন্ত্রনাদায়ক হবে সেটা তিনি ভাবতে পারেন নি। এই ব্যাথার কথা কখনো তার শাশুড়ি তাকে বলেন নি। এখন যে তারও চোখে জল চলে এসছে। বুকটা হাহাকার করছে।
এই ঘটনা এই ফ্ল্যাটে উপস্থিত সকলের চোখ থেকে বেদনার জল বার করে দিল। আকাশের বাবার সাথে পাশের ঘরে শুয়ে থাকা আকাশেরও চোখে জল চলে এসছিল। ঠাকুমাকে কখনো দেখেনি সে। দিদিমাকেই দেখে বড়ো হয়েছে। ঠাকুমার মুখটা কেমন দেখতে ছিল সেটাও সে জানে না। এখন সেই মহিলাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তার। দিদিমার মতো ঠাকুমাকেও জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে তার। মায়ের মুখে সে শুনেছিল যে ঠাকুমার খুব ইচ্ছা ছিল তাকে আদর করার। কিন্তু সে যখন মায়ের পেটে তখন এক্সিডেন্টে ঠাকুমা মারা যায়। তাই আকাশের মুখ ঠাকুমা দেখতে পায় নি। এখন সেই জন্য আকাশের বুকটা কেপে উঠতে লাগলো। যাকে কখনো দেখেনি , তার দুঃখ সে অনুভব করতে পারলো।
কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ থাকার পর সুচির বাবা নিস্তব্ধ ভঙ্গ করে বললেন , “ আমি কি করবো তখন ? বাবার ওই দূর্ঘটনার চিকিৎসার জন্য জমানো সব টাকা খরচ হয়ে গেছিল। কাকাও এগিয়ে আসে নি চিকিৎসার জন্য। কাকা চাইলেই আমার বাবাকে বড়ো হসপিটালে চিকিৎসা করিয়ে ঠিক করিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু কাকা এটাকে বেকার অর্থ ব্যায় বলেছিল। তারপরেই কাকার আমার উপর দয়া দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। আমি রেগে গিয়ে চাকরি নিই নি। তারপরেই তুইও অহংকার দেখাতে শুরু করলি। চারিদিকে অন্ধকার দেখছিলাম আমি। তখন প্রভাস বললো বিয়ে করে বউ আন। বিয়ে করবো কিন্তু টাকা ছিল না তাই আমি ছোটমার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম । „
আকাশের বাবা একটা ব্যাঙ্গ করে বললেন , “ ধার ! নিজের মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার করলি আর সেটা মাসে মাসে মিটিয়েও দিলি। মেয়ের সাথে ব্যাবসা শুরু করেছিলি বুঝি ! „
আকাশের বাবার ব্যাঙ্গ গায়ে না মেখে সুচির বাবা বললেন , “ কাকা চাইতো না আমি তোদের সাথে মিশি । „
“ অন্তত বিয়েতে মাকে নিয়ে যেতে পারতিস । „
“ কতোবার বলবো কাকা চাইতো না এসব। আর কাকা চাইতো না বলেই আমি তোর বিয়েতেও আসতে পারিনি। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে তুই ছোট মাকে এখানে আনলি না কেন ? সোজা নিমতলা নিয়ে গেছিলি কেন ? „
আবার আকাশের বাবা ব্যাঙ্গ করে বললেন , “ ও , তখনও বুঝি তোকে নেমন্তন্ন করতে হতো ! এসো দেখে যা মায়ের মড়া মুখ । „ তারপর শান্ত স্বরে বললেন , “ গাড়ি দুর্ঘটনায় আমি নিজেই মায়ের মুখ দেখতে পারছিলাম না । „
হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিয়ে সুচির বাবা বললেন “ আমি তো তোকে সুমির বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিলাম তুই আসিস নি কেন ? „
চুরি করার পর চোর ধরা পড়েলে যেমন মুখ করে ঠিক সেইরকম মুখ করে আকাশের বাবা বললেন , “ আমি এসছিলাম । „
সুচির বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কখন ? আমি তো তোকে একবারও দেখিনি ! „
তিনি যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সুমিকে আশীর্বাদ করেছিলেন সেটা তিনি কাউকে জানতে জিতে চান না তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললেন , “ তুই আমার ছেলের অন্নপ্রাশনে আসিস নি কেন ? „
এখন এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন দুজনেই নিজের শরীরে লেগে থাকা কাদা অপরের গায়ে ছুড়ে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু একটা সময়ের পর দেখা গেল যে সুচির বাবার গায়ের কাদার পরিমান অনেক বেশি তাই তিনি চুপ মেরে গেলেন।
কে কি করেনি ? কে কার কোন অনুষ্ঠানে আসেনি ? এইসব হিসাব করার পর আকাশের বাবা এতদিন জমে থাকা কথা গুলো বলতে শুরু করলেন। যে ব্যাক্তিকে কথা গুলো বলা দরকার সেই ব্যাক্তিই সামনে চুপচাপ বসে আছে। তাই সুযোগ পেয়ে তিনিও মন হাল্কা করতে লাগলেন। কতো কষ্টের কথা , একাকিত্বের কথা , সব বলে আজ তিনি শান্ত হতে যান। তাই তিনি একের পর এক বলে চললেন , “ একবার তুই যদি বাবার কথা মাকে বলতিস তাহলে মাকে এতো কষ্ট পেতে হতো না সমু । „
--- তুই জানিস ? তুই যখন অফিস যেতিস তখন মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতো শুধু একবার তোর মুখ থেকে ‘ আসছি মা , শুনবে বলে । তারপর সুচির মায়ের দিকে ফিরে আকাশের বাবা বললেন , “ জানো বৌদি ! তোমার বিয়েতে তোমাকে প্রান ভরে আশীর্বাদ করার ইচ্ছা ছিল মায়ের । এ সেটাও হতে দেয়নি। সেই সুখটাও এ মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। „
তখনও সুচির মা কেঁদে যাচ্ছে। এ ইতিহাস জানার থেকে অজানাই যে ভালো ছিল। সুনীতা দেবী তাকে স্নেহ করতো খুব। আকাশের বাবা , ঠাকুর্দা আর তার স্বামী সমরেশ তালুকদার অফিস চলে যাওয়ার পর ঘন্টার পর ঘন্টা একে অপরের সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিতেন তারা । সুমি জন্মানোর পর কেন সুনীতা দেবী তাকে কোল ছাড়া করতে রাজি ছিলেন না সেটাও এখন জলের মতো স্পষ্ট তার কাছে। ছোট্ট সুমিকে কতোই না আদর করতো সুনীতা দেবী। কিন্তু কখনোই এইসব কথা সুনীতা দেবী সুচির মাকে বলেন নি। কেন বলেননি সেটা আজ সুচির মায়ের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুনীতা দেবী তার বড়ো ছেলেকে কষ্ট পেতে দিতে চাননি। যে কষ্ট এখন সোফায় বসে সুচির বাবা পাচ্ছেন সেই কষ্ট সুনীতা দেবী দিতে চান নি। কিন্তু এক না একদিন আসল ঘটনা চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আজকেও এসে দাঁড়িয়েছে। আর সুচির বাবাকে কাঁদিয়ে চলেছে।
এদিকে আকাশের বাবা মন শান্ত করতে ব্যাস্ত , “ তুই অন্তত আমাকে তো বলতে পারতিস বাবার কথা। তুই তারপর মায়ের সাথে কথা বন্ধ করে দেওয়ায় মা কাঁদতো খুব। আর সেটা দেখে তোর উপর আমার রাগ বেড়েই যেত। মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুই যখন দশ হাজার টাকার কিস্তি মেটাতে আসতিস সেদিন রাতে মা ঘুমাতে পারতো না। চোখের জল ফেলতো শুধু। মা শুধু একবার তোর কাছ থেকে বাবা কি বলেছিল সেটা শুনতে চেয়েছিল । „
----- তোর কথা বন্ধ করে দেওয়ায় আমি আমার সবকিছু হারালাম। একসাথে বড়ো হয়েছি আমরা। একসাথে কলেজে গেছি , একসাথে কত খেলাধুলা করেছি। সুচিকে যেমন আমার ছেলে জন্মের দিন থেকে পাশে পেয়েছে তেমন তোকেও আমি জন্মের দিন থেকেই পাশে পেয়েছিলাম। তোকে দাদা মানতাম আমি। বন্ধু হিসাবে চলতাম বলে কখনো তুমি করে কথা বলিনি তোর সাথে। কিন্তু তুই যখন আমার সাথে তুমি করে কথা বলতে শুরু করলি তখন তোকে খুব পর লাগতে শুরু করেছিল। নিজের একমাত্র বন্ধুকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম। তোর বিয়ের পরেই আমি অফিসে কাজ করতে শুরু করি তারপর আর কোন কিছু স্বাভাবিক ছিল না সমু। খুব ইচ্ছা করতো তোর সাথে কথা বলি , আগের মতো দুজনে দাবার বোর্ডের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিই । কিন্তু তখনই মায়ের চোখের জলের কথা মনে পড়তো। „ এটা বলে নিজের চোখের কোনায় লেগে থাকা অশ্রু মুছে নিলেন আকাশের বাবা।
--- একবার যদি তুই মাকে কিংবা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতিস তাহলে আজকে নিজের ভাইয়ের সামনে তোকে হাত জোড় করতে হতো না সমু ......
আরো অনেক কথা হয়তো বলতেন আকাশের বাবা । কিন্তু এ অভিযোগ , এ ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছে সুচির বাবার কাছে। তাই তিনি আর থাকতে না পেরে সোফা থেকে উঠে এসে আকাশের বাবাকে আলিঙ্গন করলেন। হঠাৎ করে সুচির বাবা গলা মেলাতে আকাশের বাবা থেমে গেলেন। কিছু বললেন না আর। যদিও সুচির বাবা উচ্চতায় একটু ছোট তবুও আকাশের বাবা একটু ঝুকে যেতে দুজনেই অপরের হৃদস্পন্দন নিজের বুকে অনুভব করতে লাগলেন। কতক্ষণ তারা এইভাবে ছিলেন সেটা জানা নেই । কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর আকাশের বাবা বললেন , “ একটা সমস্যা আছে । „
ভাইকে বুকে নিয়েই সুচির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? „
“ আমি সঞ্জয় কে কথা দিয়েছি যে ওর মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেবো । „
ফিক করে হেসে সুচির বাবা বললেন , “ সে তো তুই হরেন-কেও কথা দিয়েছিলি যে ওকে তুই তোর কোম্পানির ম্যানেজার বানাবি । „
পুরানো কথা মনে পড়তে দুজনেই হেসে উঠলো।
সুচির বাবা বললেন , “ জানিস-ই তো আমি সকালে অফিস চলে যাই। আসি বিকালে। সারাদিন বাবাকে একা ঘরে ফেলে যেতে কেমন একটা লাগে। কি করবো সেটাই ভাবছি। একটা নার্স যে রাখবো তার টাকাও নেই। „
প্রভাস কৌতুক করে বললো , “ তাহলে ফ্রির নার্স রাখ । „
সুচির বাবা বুঝতে না পেরে বললেন , “ ফ্রির নার্স ! „
প্রভাস হেসে বললো , “ বউয়ের কথা বলছি । „
এতো ভালো আইডিয়া তার মাথাতে কেন এলো না সেটা ভেবেই সুচির বাবা অবাক হলেন। আইডিয়া টা যখন কেউ দিয়েই দিয়েছে তখন শুভস্য শীঘ্রম।
তারপর এদিক ওদিক পাত্রীর খোঁজ করতে লাগলেন সুচির বাবা। কয়েক দিনের মধ্যে পাত্রী পেয়েও গেলেন। নাম সুচেতা মন্ডল। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় ছোটমাকে নিয়ে যেতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল সুচির বাবার। কিন্তু কাকা খারাপ ভাববে এটা ভেবে ছোটমাকে নিয়ে যেতে পারলেন না। দুই জন বন্ধু আর হুইলচেয়ারে করে বাবাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলেন সুচির বাবা। পাকা কথা বলে , দিনখন ঠিক করার পর ফিরলেন সবাই।
বিয়ের তারিখ ফাইনাল হয়ে গেলেও পাত্রের পকেটে কানাকড়িও নেই। তাই কারোর কাছে টাকা ধার করার সিদ্ধান্ত নিলেন সুচির বাবা। প্রথমেই মাথাতে এলো ছোটমার কথা। মাথাতে আসতেই ছোটমার কাছে হাজির , “ আমার কিছু টাকা চাই । „
কোন কাজে লাগবে সেটা না জিজ্ঞাসা করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , “ কত টাকা ? „
সুচির বাবা বললেন , “ দশ হাজার হলে হয়ে যাবে। আমি মিটিয়ে দেবো অল্প করে অল্প করে । „
কথাটা শুনে সুনীতা দেবীর মাতৃহৃদয় কেঁদে উঠলো। দশ হাজার কেন চাইছে সেটা তিনি জানেন। তার বড়ো ছেলে তাকে কিছু না বলেই পাত্রী দেখতে গেছিল সেটা তার কানেও এসছে। এখন সে বিয়ের জন্য টাকা ধার চাইতে এসছে এটা ভেবেই সুনীতা দেবীর চোখে জল চলে এলো। কোন রকমে চোখের জল আটকে তিনি নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
মা আর সুচির বাবার সব কথা আকাশের বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন । মা নিজের ঘরে ঢুকে গেলে আকাশের বাবাও মায়ের পিছন পিছন গিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আলমারি থেকে টাকা বার করে দেওয়ার সময় আকাশের বাবা স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে মা কাঁদছে । ঘরের বাইরে এসে আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে টাকা গুলো নিজের বড়ো ছেলের হাতে দিয়ে দিলেন।
সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার বললেন , “ আমি অল্প অল্প করে মিটিয়ে দেবো সব । „
সুচির বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই সুনীতা দেবীর চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। আর এই চোখের জলের একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলেন বাইশ তেইশ বছরের শুভাশীষ মিত্র। মায়ের চোখে জল দেখে যাকে এতদিন দাদা এবং বন্ধু ভেবে এসেছিল সেই সমুর উপর খুব রাগ হতে লাগলো।
সুচির বাবা নিজের বিয়েতে ছোটমাকে নেমন্তন্ন করার ইচ্ছা থাকলেও কাকার কারনে করতে পারলেন না। আশেপাশের প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন বন্ধুবান্ধব কে নেমন্তন্ন করলেও এতদিন যাকে ভাই হিসাবে ভেবে এসছে সেই শুভাশীষ কেও নেমন্তন্ন করতে পারলেন না সুচির বাবা।
দুই দিন পর যখন প্রভাসের মায়ের সাথে সুনীতা দেবী কথা বলছিলেন তখন প্রভাসের মা জিজ্ঞেস করলেন , “ হ্যাঁ বৌমা , তোমরা নেমন্তন্ন পাওনি ? আমার ছেলেটাকে তো সমু বিয়েতে নেমন্তন্ন করলো। „
সুনীতা দেবী বাড়ির কথা বাড়িতেই রাখতে চান। বিয়েতে তার যাওয়ার ইচ্ছা খুব। কিন্তু সেই ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার স্বামী দেবাশীষ মিত্র রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন , “ নেমন্তন্ন যখন করেনি তখন কোন মুখ নিয়ে যাবে শুনি ! যেতে হবে না কারোর। „
এইসব কথা তিনি বাইরে জানাতে অনিচ্ছুক। তাই তিনি প্রভাসের মাকে বললেন , “ হ্যাঁ করেছে তো। বিয়ের দিন একটা কাজ আছে তাই যেতে পারবো না । „
প্রভাসের মা বুড়ি হয়ে গেছেন। অকপটে সব বলে দেন। এখনও বললেন , “ কেমন মা তুমি ! নিজের ছেলের বিয়েতে যাবে না ....
আজ তার মাতৃত্বের উপর কেউ কথা বললো। একটা মায়ের কাছে কথাটা যে কতটা পীড়াদায়ক সেটা সুনীতা দেবী খুব ভালো করে বুঝতে পারলেন । কথাটা শুনে বুকটা ফেটে গেল তার। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো।
ঠিক তখনই আকাশের বাবা এসে মাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সুনীতা দেবী সেই যে চোখের জল ফেলা শুরু করলেন তা আর থামল না। আমৃত্যু তিনি চোখের জল ফেলেছেন। আর এইসব চোখের জলের সাক্ষী হয়েছেন একমাত্র আকাশের বাবা। মায়ের চোখের জল দেখতে দেখতে একসময় সমুর উপর ঘৃণা হতে শুরু করেছিল আকাশের বাবার।
এতোটা বলে থামলেন আকাশের বাবা। তার চোখে অশ্রুর ফোটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে সুচির বাবা সোফায় বসে পড়েছিলেন। এতক্ষণ পর সবাই সুচির বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছেন। তিনি যে মাকে এতোটা কষ্ট দিয়েছেন সেটা তিনি জানতেন না। টাকা চাওয়ার পর মা কেঁদেছিল এটাও তিনি জানতেন না। এখন যখন জানতে পারলেন তখন বুকের পাঁজর ভেঙে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো “ মাগো , এ আমি কি করলাম মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মা। তোমাকে আমি কতো কাঁদিয়েছি । কাকার উপর রাগ করে আমি তোমার সাথেও কথা বন্ধ করে দিয়েছিল মাগো। এ আমি কি করলাম মা। এ আমি কি করলাম। „ অবশ্য এই আর্তনাদ কেউই শুনতে পাল না।
কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। যখন কোন ছেলে না বুঝে তার মা কে কাঁদায় তখন ছেলেটারও চোখের জল বার হয় বৈকি। এখন যেমন সুচির বাবার চোখের জল বেরিয়ে আসছে।
এদিকে সবকিছু শুনতে শুনতে সুচির মাও কাঁদতে লাগলেন। স্বামীর চোখের জল দেখে তার আরও কান্না পেল। কিন্তু তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য আকাশের মা আছেন। আকাশের মা সবকিছু শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবকিছু যে এতো ব্যাথা , যন্ত্রনাদায়ক হবে সেটা তিনি ভাবতে পারেন নি। এই ব্যাথার কথা কখনো তার শাশুড়ি তাকে বলেন নি। এখন যে তারও চোখে জল চলে এসছে। বুকটা হাহাকার করছে।
এই ঘটনা এই ফ্ল্যাটে উপস্থিত সকলের চোখ থেকে বেদনার জল বার করে দিল। আকাশের বাবার সাথে পাশের ঘরে শুয়ে থাকা আকাশেরও চোখে জল চলে এসছিল। ঠাকুমাকে কখনো দেখেনি সে। দিদিমাকেই দেখে বড়ো হয়েছে। ঠাকুমার মুখটা কেমন দেখতে ছিল সেটাও সে জানে না। এখন সেই মহিলাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তার। দিদিমার মতো ঠাকুমাকেও জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে তার। মায়ের মুখে সে শুনেছিল যে ঠাকুমার খুব ইচ্ছা ছিল তাকে আদর করার। কিন্তু সে যখন মায়ের পেটে তখন এক্সিডেন্টে ঠাকুমা মারা যায়। তাই আকাশের মুখ ঠাকুমা দেখতে পায় নি। এখন সেই জন্য আকাশের বুকটা কেপে উঠতে লাগলো। যাকে কখনো দেখেনি , তার দুঃখ সে অনুভব করতে পারলো।
কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ থাকার পর সুচির বাবা নিস্তব্ধ ভঙ্গ করে বললেন , “ আমি কি করবো তখন ? বাবার ওই দূর্ঘটনার চিকিৎসার জন্য জমানো সব টাকা খরচ হয়ে গেছিল। কাকাও এগিয়ে আসে নি চিকিৎসার জন্য। কাকা চাইলেই আমার বাবাকে বড়ো হসপিটালে চিকিৎসা করিয়ে ঠিক করিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু কাকা এটাকে বেকার অর্থ ব্যায় বলেছিল। তারপরেই কাকার আমার উপর দয়া দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। আমি রেগে গিয়ে চাকরি নিই নি। তারপরেই তুইও অহংকার দেখাতে শুরু করলি। চারিদিকে অন্ধকার দেখছিলাম আমি। তখন প্রভাস বললো বিয়ে করে বউ আন। বিয়ে করবো কিন্তু টাকা ছিল না তাই আমি ছোটমার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম । „
আকাশের বাবা একটা ব্যাঙ্গ করে বললেন , “ ধার ! নিজের মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার করলি আর সেটা মাসে মাসে মিটিয়েও দিলি। মেয়ের সাথে ব্যাবসা শুরু করেছিলি বুঝি ! „
আকাশের বাবার ব্যাঙ্গ গায়ে না মেখে সুচির বাবা বললেন , “ কাকা চাইতো না আমি তোদের সাথে মিশি । „
“ অন্তত বিয়েতে মাকে নিয়ে যেতে পারতিস । „
“ কতোবার বলবো কাকা চাইতো না এসব। আর কাকা চাইতো না বলেই আমি তোর বিয়েতেও আসতে পারিনি। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে তুই ছোট মাকে এখানে আনলি না কেন ? সোজা নিমতলা নিয়ে গেছিলি কেন ? „
আবার আকাশের বাবা ব্যাঙ্গ করে বললেন , “ ও , তখনও বুঝি তোকে নেমন্তন্ন করতে হতো ! এসো দেখে যা মায়ের মড়া মুখ । „ তারপর শান্ত স্বরে বললেন , “ গাড়ি দুর্ঘটনায় আমি নিজেই মায়ের মুখ দেখতে পারছিলাম না । „
হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিয়ে সুচির বাবা বললেন “ আমি তো তোকে সুমির বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিলাম তুই আসিস নি কেন ? „
চুরি করার পর চোর ধরা পড়েলে যেমন মুখ করে ঠিক সেইরকম মুখ করে আকাশের বাবা বললেন , “ আমি এসছিলাম । „
সুচির বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কখন ? আমি তো তোকে একবারও দেখিনি ! „
তিনি যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সুমিকে আশীর্বাদ করেছিলেন সেটা তিনি কাউকে জানতে জিতে চান না তাই কথা ঘোরানোর জন্য বললেন , “ তুই আমার ছেলের অন্নপ্রাশনে আসিস নি কেন ? „
এখন এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন দুজনেই নিজের শরীরে লেগে থাকা কাদা অপরের গায়ে ছুড়ে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু একটা সময়ের পর দেখা গেল যে সুচির বাবার গায়ের কাদার পরিমান অনেক বেশি তাই তিনি চুপ মেরে গেলেন।
কে কি করেনি ? কে কার কোন অনুষ্ঠানে আসেনি ? এইসব হিসাব করার পর আকাশের বাবা এতদিন জমে থাকা কথা গুলো বলতে শুরু করলেন। যে ব্যাক্তিকে কথা গুলো বলা দরকার সেই ব্যাক্তিই সামনে চুপচাপ বসে আছে। তাই সুযোগ পেয়ে তিনিও মন হাল্কা করতে লাগলেন। কতো কষ্টের কথা , একাকিত্বের কথা , সব বলে আজ তিনি শান্ত হতে যান। তাই তিনি একের পর এক বলে চললেন , “ একবার তুই যদি বাবার কথা মাকে বলতিস তাহলে মাকে এতো কষ্ট পেতে হতো না সমু । „
--- তুই জানিস ? তুই যখন অফিস যেতিস তখন মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতো শুধু একবার তোর মুখ থেকে ‘ আসছি মা , শুনবে বলে । তারপর সুচির মায়ের দিকে ফিরে আকাশের বাবা বললেন , “ জানো বৌদি ! তোমার বিয়েতে তোমাকে প্রান ভরে আশীর্বাদ করার ইচ্ছা ছিল মায়ের । এ সেটাও হতে দেয়নি। সেই সুখটাও এ মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। „
তখনও সুচির মা কেঁদে যাচ্ছে। এ ইতিহাস জানার থেকে অজানাই যে ভালো ছিল। সুনীতা দেবী তাকে স্নেহ করতো খুব। আকাশের বাবা , ঠাকুর্দা আর তার স্বামী সমরেশ তালুকদার অফিস চলে যাওয়ার পর ঘন্টার পর ঘন্টা একে অপরের সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিতেন তারা । সুমি জন্মানোর পর কেন সুনীতা দেবী তাকে কোল ছাড়া করতে রাজি ছিলেন না সেটাও এখন জলের মতো স্পষ্ট তার কাছে। ছোট্ট সুমিকে কতোই না আদর করতো সুনীতা দেবী। কিন্তু কখনোই এইসব কথা সুনীতা দেবী সুচির মাকে বলেন নি। কেন বলেননি সেটা আজ সুচির মায়ের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুনীতা দেবী তার বড়ো ছেলেকে কষ্ট পেতে দিতে চাননি। যে কষ্ট এখন সোফায় বসে সুচির বাবা পাচ্ছেন সেই কষ্ট সুনীতা দেবী দিতে চান নি। কিন্তু এক না একদিন আসল ঘটনা চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। আজকেও এসে দাঁড়িয়েছে। আর সুচির বাবাকে কাঁদিয়ে চলেছে।
এদিকে আকাশের বাবা মন শান্ত করতে ব্যাস্ত , “ তুই অন্তত আমাকে তো বলতে পারতিস বাবার কথা। তুই তারপর মায়ের সাথে কথা বন্ধ করে দেওয়ায় মা কাঁদতো খুব। আর সেটা দেখে তোর উপর আমার রাগ বেড়েই যেত। মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুই যখন দশ হাজার টাকার কিস্তি মেটাতে আসতিস সেদিন রাতে মা ঘুমাতে পারতো না। চোখের জল ফেলতো শুধু। মা শুধু একবার তোর কাছ থেকে বাবা কি বলেছিল সেটা শুনতে চেয়েছিল । „
----- তোর কথা বন্ধ করে দেওয়ায় আমি আমার সবকিছু হারালাম। একসাথে বড়ো হয়েছি আমরা। একসাথে কলেজে গেছি , একসাথে কত খেলাধুলা করেছি। সুচিকে যেমন আমার ছেলে জন্মের দিন থেকে পাশে পেয়েছে তেমন তোকেও আমি জন্মের দিন থেকেই পাশে পেয়েছিলাম। তোকে দাদা মানতাম আমি। বন্ধু হিসাবে চলতাম বলে কখনো তুমি করে কথা বলিনি তোর সাথে। কিন্তু তুই যখন আমার সাথে তুমি করে কথা বলতে শুরু করলি তখন তোকে খুব পর লাগতে শুরু করেছিল। নিজের একমাত্র বন্ধুকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম। তোর বিয়ের পরেই আমি অফিসে কাজ করতে শুরু করি তারপর আর কোন কিছু স্বাভাবিক ছিল না সমু। খুব ইচ্ছা করতো তোর সাথে কথা বলি , আগের মতো দুজনে দাবার বোর্ডের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিই । কিন্তু তখনই মায়ের চোখের জলের কথা মনে পড়তো। „ এটা বলে নিজের চোখের কোনায় লেগে থাকা অশ্রু মুছে নিলেন আকাশের বাবা।
--- একবার যদি তুই মাকে কিংবা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতিস তাহলে আজকে নিজের ভাইয়ের সামনে তোকে হাত জোড় করতে হতো না সমু ......
আরো অনেক কথা হয়তো বলতেন আকাশের বাবা । কিন্তু এ অভিযোগ , এ ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছে সুচির বাবার কাছে। তাই তিনি আর থাকতে না পেরে সোফা থেকে উঠে এসে আকাশের বাবাকে আলিঙ্গন করলেন। হঠাৎ করে সুচির বাবা গলা মেলাতে আকাশের বাবা থেমে গেলেন। কিছু বললেন না আর। যদিও সুচির বাবা উচ্চতায় একটু ছোট তবুও আকাশের বাবা একটু ঝুকে যেতে দুজনেই অপরের হৃদস্পন্দন নিজের বুকে অনুভব করতে লাগলেন। কতক্ষণ তারা এইভাবে ছিলেন সেটা জানা নেই । কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর আকাশের বাবা বললেন , “ একটা সমস্যা আছে । „
ভাইকে বুকে নিয়েই সুচির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি ? „
“ আমি সঞ্জয় কে কথা দিয়েছি যে ওর মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেবো । „
ফিক করে হেসে সুচির বাবা বললেন , “ সে তো তুই হরেন-কেও কথা দিয়েছিলি যে ওকে তুই তোর কোম্পানির ম্যানেজার বানাবি । „
পুরানো কথা মনে পড়তে দুজনেই হেসে উঠলো।