Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
*কলকাতার কচুরি বৃত্তান্ত*

 
সকাল সাড়ে আটটা হলুদ রোদ মাখা শ্যামবাজার মোড় থেকে ট্রামগাড়ি বাঁক নিচ্ছে ছায়াঝরা বিধান সরনীর দিকে কর্চরিকার দেখা পেতে হলে, এটাই সেরা সময়
 
কর্চরিকা আদি নাম আর এখন, কচুরি যার গল্প শুরু করতে হলে, উত্তরের কলকাতায় পা রাখতেই হবে
 
*হরিদাস মোদক*
 
শ্যামবাজার মোড়েই পাশাপাশি দুই হরিদাস মোদকের দোকান তার মধ্যে যে দোকানটা একটু পুরনো দেখতে, সেখানে একবার ঢুকে পড়লেই, কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায় চারপাশ কাঠের বেঞ্চ-টেবিল রঙচটা দেয়ালে মহাপুরুষদের বাঁধান ছবি, রজনীগন্ধার সরু মালা ঝুলছে সেখানে কলকাতার আকাশ যখন আরো একটু নীল ছিল, ধুতি পরা যুবকের দিকে যখন কেউ অবাক হয়ে ঘুরে তাকাতো না, যেন সেই হাওয়া বাতাস আজো থমকে আছে এখানে আর, আধো আবছায়া থেকে ঝুড়ি হাতে একজন এগিয়ে আসছে আপনার দিকে সবুজ কলাপাতায় ঘিয়েরঙা দুটি কচুরি থিতু হল তারপর তার সঙ্গে হাতা ভরা ছোলার ডাল নাহলে খোসা সমেত আলুর তরকারি রসিক মাত্রেই জানেন, শ্রীরাধিকা যেমন বৃন্দাবনচন্দ্রের হ্লাদিনীশক্তি, কচুরির সঙ্গে ডাল বা তরকারির সম্পর্কও ঠিক তাই আমরা যুগল বড় ভালবাসি
 
সে যাই হোক, এই দোকানে কচুরি মিলবে শুধু সকালে তারপর লুচি পাশের দোকানে বিকেলবেলাতেও পাওয়া যায়
 
অভিধান বলছে, ডালের পুর দেয়া ভাজা খাবারই হল কচুরি সেভাবে দেখলে, ছোলার ডালের পুরীকেও কচুরি বলতে হবে
 
*কিন্তু না খাঁটি কচুরিতে কাঁচা বিউলির ডাল আর হিঙের পুর ছাড়া অন্য কিছু চলবে না*
 
আবার একই পুর যখন পাঁচফোড়ন দিয়ে ভাজা হয়ে ময়দার লেচিতে ভরা হবে, তখন তার নাম *রাধাবল্লভী* শীতের কথা আলাদা তখন কড়াইশুঁটির পালা
 
এসব কথার ফাঁকে, পাঁচমাথার মোড় ছেড়ে পানসি ভিড়েছে বাগবাজারে, *পটলার ঘাটে* চলুন, নেমে পড়া যাক
 
বাগবাজারে যখনই ঢুকেছি, রাস্তার দুপাশে সাজানো থরে থরে কচুরি দেখে একটাই কথা মনে হয়েছে, এত কচুরি খায় কারা! উত্তর মেলেনা শুধু ভোজবাজির মতো খালি হয়ে যায় ঝুড়ির পর ঝুড়ি কিন্তু, এই ভিড়েও পটলার কচুরির হিসেবনিকেশ আলাদা সে অটল হিমাদ্রীসম দেখতে দেখতে তিরানব্বই বছর পার করে দিল এই ছোট্ট দোকান! কাচের শো কেসের ওপারে, বাবু হয়ে বসে আছেন দিব্যেন্দু সেন এখনকার মালিক
 
চোখে ঋত্বিক ঘটকের সেই কালো ফ্রেমের চশমা
-‘কে শুরু করেছিলেন দোকান?’
-‘আমার ঠাকুরদা, শশীভূষণ সেন
-‘তিনিই কি পটলা?’
-না পটলা তাঁর ছেলে আমার কাকা ভালো নাম কার্তিক সেন
টুকরোটাকরা কথার ফাঁকে হাত চলছে সেনবাবুর কচুরী আর ছোট আলুর তরকারি, শালপাতার বাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে হাতে হাতে বিকেলে এখানে রাধাবল্লভী পাবেন দুটি বল্লভী, দুটুকরো আলুর দম
 
পাকা খদ্দের ভুলেও কোনোদিন একটুকরো আলু বেশি চাইবেনা চাওয়াটা ভব্যতা নয় যা দেওয়া হয়েছে, একেবারে ঠিকঠাক আলুরদম বাজার খুঁজেও পাওয়া যাবেনা
 
এবার সুকিয়া স্ট্রিট মোড় থেকে কয়েক পা এগোলেই, *গীতিকা* সরু একফালি দোকানে, কাঠের পাটাতনে বসে একটানা কচুরি বেলে চলেছেন একজন পাশেই ময়দার তাল ঠাসা চলছে এখানে কচুরি পাওয়া যায় যেকোন সময় হিঙের কচুরি আলুর তরকারি আর চাটনি মাখিয়ে মুখে দিলে কী হবে, বলি কেমনে! এই দোকান শুরু করেছিলেন গনেশ দলুই মুড়ি, বাতাসা, তেলেভাজা আর কচুরি এখন দোকান শঙ্কর দলুইয়ের হাতে কণ্ঠি পরা শ্যামল মানুষটি
 
ঝকঝকে কথাবার্তা ভুরু একটু কুঁচকেই বলেছিলাম, ’হিঙের দাম তো অনেক দিচ্ছেন কীভাবে?’ মিডল স্ট্যাম্প ছিটকে গেল আমার *‘না দিলে হিঙের কচুরি হবে কী করে!’*
 
হাসছেন শঙ্কর দলুই গনেশ দলুইয়ের নাতির নাতি শিক্ষা আমার পুরো হয়নি এখনো, বললাম, ‘কতদিনের দোকান? একশো বছর হবে?’ আবার সেই হাসি, ‘আমারই তো পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল…’
 
পরের দিন সোজা কলেজ স্ট্রিট *পুঁটিরামের* দোকানে এখানে বলে রাখি, কচুরি আর রাধাবল্লভীর তফাৎটা আমায় জানিয়েছিলেন পুঁটিরামের ইন্দ্রজিৎ মোদক কচুরির থালা হাতে খোঁজখবর শুরু করতেই বললেন, ‘আগে খেয়ে নিন পরে রহস্যভেদ
 
দশটার পর এখানে রাধাবল্লভীর পালা সঙ্গে কাঁচা সোনার ছোঁয়া লাগা ছোলার ডাল হালকা একটু আদা ফোঁড়নের গন্ধ, মন ছুঁয়ে যাবে বারবার খাওয়া শেষ আমার
 
কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ইন্দ্রজিৎবাবু
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর ভক্ত ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ মোদক পুঁটিরাম মোদক তাঁর পিসেমশাই নিজের হাতে ভিত খুঁড়ে, জিতেন্দ্রনাথের জন্য এই দোকান চালু করেন কুলদানন্দসেই যে চালালেন, আজো চলছে’, একগাল হাসলেন ইন্দ্রজিৎবাবু হাতজোড় করে আবার বললেন, ‘গুরুদেবেরই দোকান আমরা সব এমনিই আছি
 
*কলকাতায় কচুরির খোঁজ সাঙ্গ করা, আর পিছনদিক করে এভারেস্টে ওঠা, দুটোই একরকম*
 
তবু এই ঝাঁকি দর্শনে, একটু অন্যরকম স্বাদের কথা বলতে ইচ্ছে করছে এবার
 
ধর্মতলায়, কর্পোরেশন আর চাঁদনির ক্রসিঙে থমকে দাঁড়িয়েছি বারবার
 
পাশাপাশি দুটো অবাঙালি কচুরির দোকান যেকোনো একটায় ঢুকে পড়লেই হল তবে এখানে কচুরির থেকেও টানটা বেশি কাঁচা লঙ্কার আচারের দরুন ঘন সবুজ এই আচারের মোহে পড়েছিল কলকাতার নব্বই দশকের কবিরা তারা এর নাম দিয়েছিল, *শয়তানের কচুরি*
 
এখানকার আমআদার চাটনিটিও মন্দ নয় হিঙের কচুরি, চাটনি, আচার আর তরকারি ফুরিয়ে এলেই, বাটি ভরে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে আবার যাকে বলে ভরপেট খাওয়া
 
কচুরির কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার করে জানানোর দরকার কলকাতার নামকরা বহু মিষ্টির দোকানেই কচুরি পাওয়া যায় আমার- আপনার পাড়ার দোকানেও যায় নামডাক সব ক্ষেত্রেই অল্পবিস্তর রয়েছে কিন্তু এখানে আমরা খোঁজ করছি সেইসব দোকানের, যাদের তেলেভাজা বা মিষ্টির চাহিদা থাকলেও, লোকে তাদের চেনে কচুরি দুনিয়ার নক্ষত্র বলে
 
এরকমই একটা দোকান হল *ভবানীপুরের শ্রীহরি* এটাসেটা মিষ্টি আছে হরেকরকম কিন্তু ভিড়টা হল কচুরি আর রাধাবল্লভীর শ্রীহরি কখনো ফাঁকা দেখেছি, এরকমটা ঠিক মনে পড়েনা এখানেও আসল চাহিদাটা বোধহয় ছোলার ডালের ১৯১২ সালে এই দোকান শুরু করেছিলেন সন্তোষকুমার গুঁই
 
কিছু বলা হল আর বাকি থেকে গেল অনেকটাই শ্যামবাজারের *দ্বারিক*, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে *মহারানি*, বা খিদিরপুরের বহু পুরনো অবাঙালি কচুরির দোকান কলকাতার আঁকাবাঁকা গলির আবছায়ায় লুকিয়ে থাকল কতজন আর তাছাড়া, রুচিভেদ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে

Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 15-12-2021, 01:11 PM



Users browsing this thread: 20 Guest(s)