Thread Rating:
  • 106 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) সমাপ্ত :---
Update 3

প্রজ্ঞা জন্মানোর পর সুমি দুই তিন বার বাবার বাড়িতে এসেছিল কিন্তু কৌশিকের অফিসের জন্য বেশিদিন থাকতে পারে নি। সেই কয়দিন আকাশের খুব ইচ্ছা হতো প্রজ্ঞাকে আদর করার , কোলে নেওয়ার। কিন্তু সেই ইচ্ছা কখনোই পুরন হয়নি।

সুচি যে সারা সপ্তাহ অফিসে কাজ করে রবিবার সারাদিন দিদির বাড়িতে কাটায় এটা আকাশ সুচির ফেসবুকে পোস্ট দেখে জানে। আকাশ এমনিতেই সুচির কাছে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। তাই সে ঠিক করলো সামনের রবিবার সুচি আর ও একসাথে সুমির বাড়িতে যাবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। রবিবার সকাল দশটা বাজার আগেই স্নান করে খেয়ে দেয়ে ভালো জামা পড়ে বাইক নিয়ে সোসাইটির গেটের সামনে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো। মাকে বললো ‘ বন্ধুর জন্মদিন তাই আসতে রাত হবে। , আর সুচিকে আগে থেকে কিছুই জানায়নি কারন সুচি বেঁকে বসতে পারে।

প্রতি রবিবারের মতোই সুচি সাড়ে দশটার মধ্যে স্নান করে সকালের ব্রেকফাস্ট করে সোসাইটির বাইরে এলো অটো ধরবে বলে। সোসাইটির বড়ো লোহার গেটের বাইরে এসেই আকাশকে দেখে সুচি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো । কিছুক্ষণ বজ্রকঠিন মুখে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আকাশের এখানে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারন বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোন কারন সুচি বুঝতে পারলো না , তাই সে জিজ্ঞাসা করলো , “ এখানে কি করছিস ? „

আকাশ ভুরু কপালে তুলে বললো , “ তোর সাথে খিদিরপুর যাবো । „

সুচি আকাশের মুখভঙ্গি দেখে রেগে গিয়ে বললো , “ খিদিরপুরে তোর কি ? „

আকাশ ঠোঁটে হাসি নিয়ে ইয়ার্কি করে বললো , “ আমার ম্যামের বাড়ি ওখানে। তার মেয়েকে দেখতে যাবো। „

সুচি আকাশের কথা বুঝতে পারলো। এক সময় সুমি আকাশকে পড়াতো । সেই সূত্রে আকাশ সুমিকে ম্যাম বলছে । আকাশের কথা বুঝতে পেরে সুচির খুব হাসি পেল। কিন্তু আকাশ যে তার সাথে থাকার জন্যেই এরকম করছে সেটাও সুচি বুঝতে পারলো। তাই খুব কষ্টে হাসি চেপে রাগি স্বরে বললো , “ মানে ! „

“ প্রজ্ঞাকে দেখতে যাবো। কখনো কোলে নিই নি। কথা না বাড়িয়ে এবার ওঠ । দেরি হয়ে যাবে। „

সুচি তার কন্ঠে রাগ বজায় রেখে বললো , “ আমি তোর সাথে যাবো এটা ভাবলি কি করে তুই ! „

আকাশ খুব ভালো করে জানে সুচি কেন এরকম করছে । কিন্তু আকাশের কষ্টটা সুচি বুঝতে চাইছে না। তাই সে পাল্টা প্রশ্ন করলো , “ কেন ? আমার সাথে যেতে তোর কি অসুবিধা ? নাকি আমাকে তোর আদরের বোনঝির থেকে দূরে রাখতে চাইছিস ! „

আকাশের কথায় সুচি খুব রেগে গেল কিন্তু কিছু বললো না। আকাশ এখন সুচির পছন্দ মতো চাপদাড়ি রাখে। চওড়া মুখে চাপদাড়িতে আকাশকে খুব সুন্দর দেখতে লাগে। সেই সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সুচি কিছু একটা ভাবলো। তারপর কিছু না বলে আকাশের বাইকের পিছনের সিটে দুই দিকে পা দিয়ে বসে পড়লো ।

আকাশ ভাবেনি সুচি এত সহজে রাজি হয়ে যাবে। সুচি বাইকে বসতেই আকাশ মাথায় তার নিল হেলমেটটা গলিয়ে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল। বাইক ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চললো খিদিরপুরের দিকে। APC রোড হয়ে সোজা AJC রোডে উঠে ডান দিকে ঘুরে , বা দিকে চিড়িয়াখানা ফেলে খিদিরপুর বাজারে ঢুকে গেল আকাশ। তারপর সুচির নির্দেশ মত এগলি ওগলি করে একটা নির্জন গলির মধ্যে ঢুকে সুচি বললো , “ এখানে থামা । „

আকাশ দেখলো গলিটা পুরানো কলকাতার অলিগলির মতো সরু । রাস্তাটা পিচমোড়া। আর রাস্তার দুই পাশে বাড়ির সারি। দুরে একটা চাতালে দুজন আকাশের বয়সী ছেলে বসে গল্পো করছে । আকাশ আশেপাশের বাড়ি দেখতে দেখতে বললো “ এখানে ? „

সুচি বাইক থেমে নেমে সামনের সবুজ কাঠের দরজায় লাগানো শেকলে কড়া নেড়ে বললো , “ এটা দিদির শশুর বাড়ি । „

কয়েক সেকেন্ড পড়েই সুমি প্রজ্ঞাকে কোলে করে নিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। সুমি দরজা খুলে দিলে সুচি বললো , “ বাইকটা ভিতরে রাখ । „

আকাশ বাইকটা সেই সবুজ দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেখলো সরু করিডোরের মত উঠোন। তার মাঝে আছে একটা বাধানো তুলসী গাছ। আকাশ সেই তুলসীতলার পাশেই বাইকটা রেখে দিল।

আকাশকে দেখেই সুমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। সুমি একবার সুচির দিকে তাকিয়ে আকাশের এখানে আসার কারন জিজ্ঞাসা করলো। সুচি চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে দিল , “ পরে বলছি । „

বোনের ইশারা বুঝতে পেরে সুমি আকাশকে জিজ্ঞাসা করলো , “ কেমন আছি ? „

আকাশ বাইক থেকে চাবি খুলে নিয়ে বললো , “ আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ? „

“ আমিও ভালো আছি । আয় , ভিতরে এসে বোস । „ বলে একটা ঘরে ঢুকে গেল সুমি।

সুমির পিছন পিছন সুচি আর আকাশ সেই ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে দেখলো এটা লিভিংরুম সাথে ডাইনিং রুম-ও। ঘরের একদিকের দেওয়ালের গা ঘেসে একটা টেবিল আছে। টেবিলের উপর বাক্স টিভি বসানো। তিনটে সোফা টিভির দিকেই ঘোরানো। সোফার থেকে কিছু দূরেই আছে ডাইনিং টেবিল। দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের কারুকার্য করা পেন্টিং , মুখোশ , কাঠের জিনিস সাজানো আছে। আকাশ গিয়ে সোফায় বসে পড়লো। ঠিক তখনই কৌশিক চশমা জামায় মুছতে মুছতে ঘরে  ঢুকলো । আকাশ সোফায় বসলে সুমি বললো , “ তুই কৌশিকের সাথে কথা বল । আমি তোদের খাবারের ব্যাবস্থা করছি। „

কৌশিক চশমাটা পড়ে নিয়ে দেখলো আকাশ সোফায় বসে আছে। হাসি মুখে আকাশের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসতে বসতে বললো , “ কেমন আছো ? „

সুমি আকাশকে বসতে বলে প্রজ্ঞাকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সুচিও পিছন পিছন গিয়ে ঢুকলো রান্নাঘরে। সুমি প্রজ্ঞাকে বোনের কোলে দিয়ে গ্যাসের নব ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ ওকে এখানে আনলি কেন ? বাবা জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখেছিস ? „

সুচি বোনঝির গালে একটা চুমু দিয়ে বললো , “ আমি কি ইচ্ছা করে এনেছি ওকে ! ওই জোর করলো। „ তারপর কিছুক্ষণ থেমে প্রজ্ঞার নাকে নাক ঘসে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো , “ ওকে তুই এবার বোঝা । আমার কোন কথাই ও শুনছে না। „

সুমি গ্যাসের উপর চা করার কেটলিটা বসিয়ে দিয়ে বোনের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলো , “ কোন কথা ? „

“ ও আমার কোন কথাই বুঝতে চাইছে না। বারবার অবুঝের মতো কাজ করছে । „ কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় সুচির মাথা কাটা গেল ।

সুমি বুঝলো কথাটা কিন্তু কিছু বললো না। সে সবার জন্য চা করে বিস্কুট সহযোগে ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে সোফার সামনে রাখা ছোট টেবিলে এনে রাখলো। টেবিলে ট্রে রাখার সময় আকাশ আর কৌশিকের কথাবার্তা সুমির কানে এলো । আকাশের পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারের কথা বলছে দুজনে। সুমি বললো , “ চা নাও । „

কৌশিক একটা পেয়ালা আকাশের দিকে এগিয়ে দিল। আকাশ সেটা তুলে নিল। কৌশিক জিজ্ঞাসা করলো , “ দুপুরে খেয়ে যাবে তো ? „

আকাশ পেয়ালা থেকে এক চুমুক চা খেয়ে পেয়ালাটা আবার টেবিলে রেখে বললো , “ হ্যাঁ ।  অনেক দিন সুমিদির হাতে খাওয়া হয়নি। খেয়ে একেবারে বিকালে যাবো । „

কৌশিক বললো , “ তাহলে বাজার করে আনি। তোমার দিদি খাসির মাংস খুব ভালো রান্না করে । „

তারপর আরও কিছু কথা বলতে বলতে চা শেষ করে , বাজারের থলি হাতে নিয়ে , কৌশিক চলে গেল বাজারে। কৌশিক চলে গেলে সুমি বাইরের দরজা ভেতর দিয়ে বন্ধ করে এসে আকাশের পাশে বসলো , “ কাকি জানে তুই এখানে এসছিস ? „

আকাশ পাশের সোফায় বসে থাকা সুচি আর প্রজ্ঞার খুনসুটি আর প্রজ্ঞার খিলখিলিয়ে হাসি দেখতে দেখতে বললো , “ না । „

সুমি একবার বোন আর মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ তাহলে কি বলে এসছিস ? „

আকাশ তার দৃষ্টি সুচির দিকে রেখেই বললো , “ আমার বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছি বলে এসছি। „

সুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পলক না ফেলে বললো, “ যখন মিথ্যা কথা বলতে হলো ! তখন এলি কেন ? „

আকাশ এবার সুমির দিকে তাকিয়ে বললো , “ তোমার বাড়িতে আমি আসবো না ! „

“ অবশ্যই আসবি। একশোবার আসবি। কিন্তু কাকা কাকিকে সত্যিটা বলে আসবি । „

আকাশ সুমির থেকে চোখ সরিয়ে মেঝেতে তাকিয়ে বললো , “ মা কি বলবে জানি না। হয়তো আসতে দেবে না । „

“ তাহলে নিজেই বুঝতে পারছিস যে তোর আর বোনের সম্পর্ক কাকা কাকি মানছে না। তাহলে কেন বোনকে কষ্ট দিচ্ছিস ? „

“ তুমিও এই কথা বলছো ? „

“ হ্যাঁ আমিও এই কথা বলছি কারন তুই বুঝছিস না। তুই যে এখানে এসছিস সেটা যদি আমার মা বাবা জানতে পারে তাহলে কি হবে ভেবেছিস ! „

তারপর কিছুক্ষণ থেমে নিশ্বাস নিয়ে সুমি আবার বললো , “ বড়ো হয়েছিস। ম্যাচিউর হয়ে গেছিস। সবকিছু বুঝতে শিখেছিস । তবুও তুই সুচিকে বারবার পালিয়ে যেতে বলছিস। একবারও ভেবেছিস তুই পালিয়ে গেলে কাকা কাকির কি হবে ! তুই ছাড়া কাকা কাকির আর কে আছে বলতো আমাকে ! „

সুমির কথা থেকে আকাশ বুঝতে পারলো যে সুচি সুমিদিকে সব খুলে বলে দিয়েছে। আর সুচি এই কারনেই ওকে এখানে এনেছে সেটাও আকাশ বুঝতে পারলো। সুমি এদিকে আকাশকে উদ্দেশ্যে করে বলে চলেছে , “ আগে একটা বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে আর কোন ঘটনা তোরা ঘটাস না । মা বাবা , কাকা কাকি কেউ আর নিতে পারবে না। „

যা বোঝার আকাশ বুঝে গেছে। এতদিন যে পালানোর চিন্তা সে করছিল সেটা যে কতো বড়ো মূর্খের সিদ্ধান্ত সেটা আকাশ বুঝলো। পালানোর সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়াতে এখন আরও একটা রাস্তা আপনাআপনি আকাশের সামনে খুলে গেল। সেটা হলো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মা বাবাকে যেকোন প্রকারে রাজি করিয়ে সুচিকে বিয়ে করা। কিন্তু এরজন্য তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

এইসব ভাবতে ভাবতেই আকাশ সুমির কথা শুনছিল। কিছুক্ষণ পর কৌশিক খাসির মাংস নিয়ে চলে এলো। তারপর কৌশিক আকাশকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের বাড়ি দেখাতে শুরু করলো। বাড়িটা দুতলা। নিচের তলায় দুটো ঘর , একটা লিভিংরুম , বাথরুম আর রান্নাঘর। নিচেই সুমিরা থাকে। উপরে দুটো ঘর। কৌশিকের দাদা যখন আসে তখন উপরতলায় থাকে। বাড়ি দেখতে আকাশের আর কোন আগ্রহ নেই। দুপুরে খাবার সময়েও আকাশ রুচি পেল না।

খেয়ে দেয়ে কৌশিক সুমিকে নিয়ে আকাশের সাথে গপ্পো করতে বসলো। আকাশ-সুচি ছোটবেলায় কত দুষ্টু ছিল। এই পাড়ায় কে কেমন ?  কৌশিকদের এটা পৈতৃক বাড়ি। কৌশিকের দাদার ফটো। আরও নানা রাজ্যের কথা।

সুচির সেসব শুনতে আগ্রহ নেই কারন সে আগেই এসব শুনেছে। সুচি প্রজ্ঞার সাথে খেলতে শুরু করলো। নিজের ফোনটা বার করে গ্যালারি থেকে প্রজ্ঞার ফটো বার করে সুচি বললো , “ এটা কে বলোতো ? „

প্রজ্ঞা একভাবে মাসির ফোনের ফটোর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে এখনও বুঝতে শেখেনি। সুচি বললো , “ এটা আমার দিদির মেয়ে । তোমার থেকে অনেক সুন্দর দেখতে। „

প্রজ্ঞার বয়স দেড় বছর হয়ে গেছে। সে তার কথা বুঝলো কি না সুচি বুঝতে পারলো না। কিন্তু প্রজ্ঞা একভাবে মাসির ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। সুচি বললো , “ ফোন নেবে ? „

কথাটা বলে সুচি ফোনটা দুরে রেখে দিল। প্রজ্ঞা হামাগুড়ি দিয়ে ফোনটা নিতে গেল। ফোনটা ধরার আগেই সুচি প্রজ্ঞাকে কোলে তুলে নিল । তারপর ফোনটা নিয়ে ক্যামেরা অন করে ভিডিও করতে শুরু করলো। ভিডিওতে সুচি জিভ ভেঙাতে শুরু করলো। মাসির দেখাদেখি প্রজ্ঞাও জিভ ভাঙাতে শুরু করলো। প্রজ্ঞাকে দেখে সুচিও বিভিন্ন মুখভঙ্গি করতে শুরু করলো। ভিডিও হয়ে গেলে সেটা ফেসবুকে ছেড়ে দিল।

সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবতে শুরু করলে আকাশ আর সুচি সবাইকে বিদায় জানিয়ে আর প্রজ্ঞাকে টাটা করে বাড়ির রাস্তা ধরলো। আসার সময় আকাশ খুব কথা বললেও বাড়ি ফেরার সময় আর একটাও কথা বললো না।

রাতে খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে শান্ত মস্তিষ্কে আকাশ ভাবতে শুরু করলো। অতীতের দিনগুলোর কথা মনে করতে লাগলো। একসাথে ভুতের সিনেমা দেখা। কলেজ থেকে ফেরার পথে আচার কিনে খাওয়া। দিদিমার লুকিয়ে সুচির জন্য আচার রেখে দেওয়া। কারনে অকারনে মারপিট করা। তারপর মা জেঠিমা আর দিদিমার ঠেকানো। কি সুন্দর ছিল দিনগুলো। আর তার কারন হলো সুচি। সুচি ছিল বলেই তার অতীত এতো সুন্দর ভাবে কেটেছে। আকাশ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো ------  ‘ বর্তমান যাই হোক যেমনই হোক ! অতীতের মত ভবিষ্যতকেও সুন্দর করতে হবে। যাই হোক করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মা বাবা , জেঠুকে রাজি করাতে হবে। আর যদি রাজি না হয় তাহলে সে দেখে নেবে কে এই বাড়ি থেকে সুচিকে বিয়ে করে নিয়ে যায় ! ,

সেদিনের পর থেকে আকাশ রাতে একবার ফোন করা আর তারপর গুড নাইট মেসেজ করা বন্ধ করে দিল। এই ঘটনায় সুচির মুখে যা-একটু হাসি অবশিষ্ট ছিল সেটাও মুছে গেল। সুচি রোজ অপেক্ষা করে থাকে একবার হয়তো ফোন আসবে , একবার হয়তো গুড নাইট & গুড মর্নিং মেসেজ আসবে। কিন্তু আসে না।

কয়েক মাস পর একদিন সকালে সুচি ঘুম থেকে উঠে দেখলো বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির আওয়াজে সুচির মনটা নেচে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বাসি মুখে ছাদে চলে এলো। দুই হাত মেলে ধরে মুখে বৃষ্টির ফোটা অনুভব করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই সুচি খেয়াল করলো নিচে মাঠে সিরাজ কাকার মেয়ে আমিনা জল কাদায় খেলছে। আমিনার খেলা দেখতে দেখতে সুচির নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। একসময় বাদশা , আকাশ আর সুচিও এইভাবে জল কাদায় লাফালাফি করতো। বাদশা এখন আর নেই। আকাশ সত্যিটা মেনে নিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবতেই সুচির বুকটা মুচড়ে উঠলো। চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রুবিন্দু বেরিয়ে আসতে লাগলো। আকাশের বৃষ্টির জল সুচির চোখের জল বারবার ধুয়ে দেওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করতে লাগলো। ছাদে বসে দুই হাটুর মধ্যে কপাল ঠেকিয়ে সুচি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। চোখের জলের মধ্যে দিয়ে সব সম্পর্ক , সব অনুভূতি , সব কষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা ধুয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। সেদিন আর সুচি অফিস গেল না।

সুমির কথায় আকাশ যে আর সুচির সাথে কথা বলছে না সেটা সুচি দিদিকে বললো। সুমি সবকিছু শুনে বললো , “ তাহলে নতুন করে জীবন শুরু করে। আগের মতো আবার নাচ শুরু কর । তিন বছর ধরে তোকে নাচতে দেখছি না। এবার পুজাতে বাড়ি গিয়ে তোর নাচ দেখতে চাই আমি। মনে রাখবি কথাটা। „ শেষের কথাটা আদেশের সুরেই বললো সুমি।

সুমির কথায় সুচি আবার নাচের অভ্যাস শুরু করলো। দীর্ঘ তিন বছর পর সুচি আবার সোসাইটির নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলো। তিন বছর আগের মতো আবার সুচিকে কেউ হারাতে পারলো না। প্রজ্ঞা মাসির নাচ দেখে হাততালি দিল। সুচির নাচ আকাশ প্রথম সারির বেঞ্চে বসে দেখলো। সেটা সুচির চোখ এড়ালো না।

এরপরের বছরেই আকাশের কলেজের ইউনিয়নের ভোট হলো। নতুন পদপ্রার্থীর নাম পলাশ সহায়। আকাশদের ওয়ার্ডের বিধায়ক পঙ্কজ সহায়ের ছোট ছেলে হলো এই পলাশ সহায়। হলুদ পার্টির যুব নেতা হিসাবে খুব নাম করেছে এই পলাশ।

ভোটে জয়ী হলো পলাশ। ভোটে জেতার জন্য নিজে থেকে একটা পার্টি দিতে চাইলো সে। একটা বড়ো করে ফাংশন হবে। ফাংশন হবে MBA ফাইনাল সেমেষ্টারের পরিক্ষা হওয়ার পর । ফাংশনে টলিউডের নাম করা দুজন অভিনেত্রী আসবে। এই নিয়েই কলেজ মশগুল।

আরও কে কে নাচবে এই নিয়ে কলেজের ইউনিয়ন রুমে বসে কথা হচ্ছিল। একজন বললো , “ অঞ্জলি কে নাচতে বলো। ফিগারটা দারুণ। „

আর একজন এর প্রতিবাদ করে বললো , “ অঞ্জলির আবার ফিগার ! চোখে কি ন্যাবা হয়েছে তোর ! ফিগার ছিল সুচিদির। যখন নাচতো তখন স্টেজ কাঁপিয়ে দিত । „

পলাশ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো , “ সুচি কে? „

“ আমাদের কলেজেই পড়তো। প্রাক্তনী। খুব ভালো নাচতো। „

মেজাজ হারিয়ে তিরিক্ষি গলায় পলাশ বললো , “ ফটো টটো থাকলে দেখা। অতো কথা বলছিস কেন ! „

ছেলেটা ফোন বার করে ফেসবুক খুলে সুচির নাচের একটা ভিডিও দেখালো । পলাশ মন দিয়ে পুরো নাচের ভিডিওটা দেখলো। একবার ঠোঁট চেটে নিয়ে মনে মনে ভাবলো ‘ এইবার দাদাকে একটা বড়ো কম্পিটিশন দেওয়া যাবে। , কিন্তু মুখে বললো , “ একে নাচের ইনভিটেশন দিয়ে দে। বলবি ওকে গেস্ট ডান্সার হিসাবে আনা হয়েছে । „

পলাশের কথা মতো সুচির বাড়িতে একটা ইনভিটেশন এর চিঠি চলে গেল। তাতে খুব বিনয়ের সাথে সুচিকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। চিঠিতে দেওয়া ফোন নাম্বারে ফোন করলো সুচি। একজন মেয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ আমার বাড়িতে একটা চিঠি এসছে.....

সুচির কথা শেষ হওয়ার আগে মেয়েটা বললো , “ হ্যাঁ দিদি। আমাদের কলেজে এবার ফাংশনে আপনাকে গেস্ট হিসাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। „

“ আমাকেই কেন ? আর এই সময় তো কলেজে কোন ফাংশন হয় না । „

মেয়েটা বললো , “ আসলে এবছর আমাদের কলেজের ভোটে যিনি জিতেছেন তার পক্ষ থেকে এই ফাংশন। আর আমরা কলেজের নিজের একজন ডান্সার চাইছিলাম। আর আপনিই আমাদের কলেজের সর্বকালের সেরা পারফর্মার ছিলেন। প্লিজ না করবেন না । „

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুচি বললো , “ ঠিক আছে আমি ভেবে বলছি । „

“ কাইন্ডলি প্লিজ । „ বলে মেয়েটা ফোন রেখে দিল।

রাতের বেলা সুচি দিদিকে ফোন করে সব কথা বললো। সুমি বললো , “ তোর কলেজে তোকে গেস্ট হিসাবে নিয়ে যেতে চাইছে। আর তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করছিস ! যা তুই। মন ভালো থাকবে । „

সুচি পরের দিন মেয়েটাকে ফোন করে বলেদিল সে যেতে রাজি। মেয়েটা বললো , “ দিদি আমি আপনাকে মেসেজে আপনার গান গুলো লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি। „

কিছুক্ষণ পর সুচির ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেসেজটা খুলে গান গুলো দেখলো সুচি। মোট তিনটে গান। প্রথমটা হলো জিতের বচ্চন সিনেমার গান ‘ লাটাই। , দ্বিতীয়টা হলো ঋত্বিক রোশন এর আগনিপাথ সিনেমার গান ‘ চিকনি চামেলী। , আর তৃতীয় টা হলো শাহরুখ খানের হ্যাপি নিউ ইয়ার সিনেমার গান ‘ লাভলি। ‚

নামগুলো পড়ার পর সুচি মনে মনে বললো , ‘ স্টুডেন্ট দের ফাংশনে আর কোন ধরনের নাচ হবে ! ,

এরপর সুচি সারাদিন অফিসে কাজ করে বিকালে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে তিনটে গানের নাচের অভ্যাস শুরু করলো। সুচি যে ফাংশনের একজন গেস্ট ডান্সার হয়ে নাচবে সেটা আকাশের কানে গেল। মনে মনে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে এই ফাংশনে সে যাবেই।

MBA পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই ফাংশনের দিন এগিয়ে এলো। ফাংশনের একদিন আগেই আকাশের ধুম জ্বর হলো। স্নেহা দেবী আকাশকে বিছানা থেকে উঠতেই দিলেন না।

একটা কালো টপের উপর লাল রঙের ভেস্ট কোট আর জিন্স পড়ে ফাংশনে পরপর তিনটে গানে নাচলো সুচি। প্রথম সারির দর্শকদের মধ্যে পলাশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলো এবং ভিডিও করলো। নাচ শেষে সুচি বাড়ি ফেরার সময় পলাশ গিয়ে আলাপ করলো , “ হায় আমি পলাশ। সরি আসলে আপনার সাথে ফাংশন শুরু হওয়ার আগে আলাপ করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ট্রাফিকের জন্য আসতে দেরি হয়ে গেল । „

“ না না ইটস্ ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। „ কথাটা বলে সুচি পলাশকে দেখলো। বয়স খুব জোর 27-28 হবে। দুই গালে ব্রণের দাগ স্পষ্ট। আর মুখের যে জিনিস টা সবথেকে বেশি দৃষ্টি টানে সেটা হলো ওর জোড়া ভুরু।

“ আমিই এবছর ইলেকশনে জিতেছি ......

পলাশের কথা শেষ করতে দেওয়ার আগেই সুচি বললো , “ কংগ্রেজুলেশন। সরি , আমার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছা ছিল কিন্তু....

“ না না সে ঠিক আছে। আলাপ হতে থাকবে। আপনি প্লিজ ! „ পলাশের কথায় সুচি চলে যেতে লাগলো। আর পলাশ পিছন থেকে সুচির হাটা দেখতে লাগলো।

বাড়ি ফিরে , ফ্রেশ হয়ে , ডিনার খেয়ে , বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে ফোনটা খুলে সুচি দেখলো একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। সুচি মেসেজটা খুলে দেখলো ডিপিতে পলাশের ফটো দেওয়া। পলাশের মেসেজটা পড়লো সুচি ।

পলাশ লিখেছে ---- আজকে যারা টলি পাড়া থেকে এসছিল তাদের থেকেও ভালো পারফর্ম করেছেন আপনি। তারাও আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

সুচি একটা thank you লিখে দিল।

জ্বর থেকে উঠেই আকাশ মাকে বললো , “ এবার তো অফিসে যেতে দাও নাকি এরপর আরও পড়তে হবে ! „

আকাশের বাবা বললেন , “ কাল থেকে আমার সাথে চল। „

রাতে আকাশের ঘুম হলো না। এতদিন যে জন্য অপেক্ষা করেছিল সেটা কালকে সফল হবে। সুচিকে নিজের পার্সোনাল এসিস্টেন্ট বানিয়ে সবসময় নিজের চোখের সামনে রাখবে।

সকালে বাবার সাথে অফিসে যেতে যেতে আকাশ জিজ্ঞাসা করলো , “ আমাকে কি কাজ দেবে ? সুপারভাইজার খুব ভালো হবে। ম্যানেজার হলে তো আরও ভালো । „

আকাশের বাবা মিচকি হেসে বললেন , “ অফিসে চল বলছি। „

অফিসে ঢুকতেই আকাশের বাবাকে দেখে সব এমপ্লয়িরা দাঁড়িয়ে পড়লো। আকাশের বাবা আকাশের পিঠে হাত দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন , “ এ হলো আমার একমাত্র ছেলে আকাশ। আজ থেকে তোমাদের সাথেই কাজ করবে। তোমাদের ফাইল পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে । সবাই একে সহযোগিতা করো। „

কথাটা বলেই আকাশের বাবা নিজের কেবিনের দিকে চলে গেলেন। আকাশ সহ বাকিরা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। কোম্পানির মালিকের ছেলে যে ভবিষ্যতে মালিক হবে সে কেরানীর কাজ করবে !

আকাশ কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকলো। বাবা যে তাকে অপমান করছে সেটা বুঝতে পেরেই সে বাবার কেবিনের দিকে চলে গেল। বাবার কেবিনের ঢুকে বললো , “ আমি ফাইল এদিক ওদিক করবো ! মানে আমি পিওনের কাজ করবো ? „

আকাশের বাবা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন , “ অসুবিধা কোথায় ? „

আকাশ ভুরু কুঁচকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো , “ আমি তোমার ছেলে হয়ে এই কাজ করবো ? „

“ তুই আমার ছেলে তাতে অসুবিধা নাকি এই ফাইল এদিক ওদিক করা এটাতে তোর অসুবিধা ? „

আকাশ দুই দিকে মাথা নেড়ে বললো , “ আমি এ কাজ করতে পারবো না । „

“ বুঝেছি। তুই এই কাজটাকে ছোট বলছিস। তোর হয়তো মনে নেই যে সুচির বাবা সরকারি অফিসে ঠিক এই কাজটাই করে। আর তুই সেই কাজটাকেই অপমান করছিস ? „

এই কথাতেই সঞ্জীবনী ওষুধের মত কাজ হলো। সমরেশ জেঠু যে এই কাজটাই করে সেটা আকাশ ভুলে গেছিল। এখন মনে পড়তেই মাথাটা নিচু হয়ে গেল। এই কারণে নয় যে সে এই কাজটাকে অপমান করছে। বরং এই করনে যে সে সুচির বাবাকে অপমান করছে।

আকাশকে চুপ মেরে যেতে দেখে শুভাশীষ বাবু বললেন , “ আর কিছু বলবি ? „

আকাশ দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে ‘ না , বলে বাইরে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর সঞ্জয় অফিসে ঢুকে আকাশকে দেখে অবাক হলো , “ ইয়াং ম্যান। এখানে কি মনে করে ! „

আকাশের এখনও ব্যাপারটা ঠিক হজম হয়নি। এতদিনে যে পরিকল্পনা মত সে চলছিল সেটা এই ভাবে ভেস্তে যাবে সেটা আকাশ বুঝতে পারে নি। এখন সে কি করবে সেটাই ভাবছিল। সঞ্জয়ের কথায় হুশ ফিরলো। সঞ্জয়কে দেখে বললো , “ আজ থেকে অফিসে জয়েন করলাম। „

কথাটা শুনেই সঞ্জয়ের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো , “ তা এখানে বসে কেন ? তোমার বাবার কেবিনে চলো । „

“ এটাই আমার কেবিন। পিওন হিসাবে কাজ করছি। „ কথাটা বলতে হাল্কা লজ্জা লাগলো আকাশের।

কথাটা শুনেই সঞ্জয়ের ভুরু কপালে উঠে এলো , “ বলো কি ! তোমার বাবার সাথে তো কথা বলতে হচ্ছে । „

কথাটা বলেই সঞ্জয় আকাশের বাবার কেবিনের দিকে চললো। কেবিনে ঢুকে গুড মর্নিং জানিয়ে সঞ্জয় বললো , “ বাইরে আকাশকে দেখলাম। আপনি ওকে পিওনের কাজ দিয়েছেন ? „

আকাশের বাবা জানতেন যে তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেকে কথা বলবে। তাই তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন , “ হ্যাঁ। ওর এখন ট্রেনিং পর্ব চলছে। „

সঞ্জয় আকাশের বাবার কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। এতে তার কিছুই যায় আসে না। সে এখন চিন্তা করছে এবার গোধূলিকে অফিসে আনতে হবে। তারপর এই কোম্পানির মালিক তিনি।

সারাদিন ওই চেয়ারে বসে ফোন ঘেটেই আকাশের দিন চলে গেল। টিফিন ব্রেকে বাবার সাথে টিফিন করে আবার সেই চেয়ারে বসে রইলো। কোন অফিস এমপ্লয়ি ভয়তে আকাশকে দিয়ে কোন কাজ করালো না। এমন একটা মুখরোচক খবর বিদ্যুতের গতিতে উপর নিচ কর্মরত সবার কানে চলে গেল। সুচিও বাদ গেল না।

আকাশ অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে স্নেহা দেবী হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কেমন কাটলো অফিসের প্রথম দিন ? „

আকাশ লজ্জা পেলেও মাকে সব বলে দিল। সব শুনে আকাশের মা রাগে চন্ডী রুপ ধরলেন। স্বামীর দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বললেন , “ তুমি আমার ছেলেকে দিয়ে পিওনের কাজ করাচ্ছো । „

শান্ত নির্বিকার ভাবে আকাশের বাবা বললেন , “ তুমি যেটাকে ছোট কাজ বলছো সেই কাজের থেকেও ছোট কাজ আমি করেছি। „

স্নেহা দেবী স্বামীর কথায় চুপ মেরে গেলেন। দীর্ঘ তেইশ চব্বিশ বছরের সংসার জীবনে তিনি বহুবার স্বামীকে তার কলেজ জীবন , ছোটবেলার কথা জিজ্ঞাসা করেছেন । কখনোই আকাশের বাবা কিছুই খুলে বলেন নি। আজও বলবেন না সেটা আকাশের মা ভালোমতো জানেন । তাই তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না।

রাতে বিছানাতে শুয়ে তিনি বললেন , “ আমি এটা মানতে পারছি না। „

স্ত্রীর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে বললেন , “ ওর এখনও শিক্ষা পুরো হয়নি। „

এরপর আর স্নেহা দেবী কিছু বললেন না। সুচি ডিনার করে প্রতিদিনের মতো দিদিকে ফোন করলো। আজকের তাজা মুখরোচক খবরটা দিদিকে বলে দিল। সবকিছু শুনে সুমি বুঝলো যে সুচি এখনও আকাশকে ভুলতে পারে নি। ভোলা সম্ভব-ও না। যার সাথে পুরো আঠারো উনিশ বছর কেটেছে তাকে কিভাবে ভালো যায়। সবকিছু বুঝে সুমি জিজ্ঞাসা করলো , “ ওই পলাশের কি খবর ? কিছু এগিয়েছে ? „

সুচি বললো , “ ও বিধায়কের ছেলে। নিজেও পার্টি করে। শুনেছি ওদের অনেক খারাপ ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে। „

“ সেটা ওর সাথে না মিশলে বুঝবি কিভাবে ? আগে মিশে দেখ , যদি খারাপ কিছু শুনতে পাস তখন সরে আসবি।  „ তারপর হেসে বললো “ তারপর বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে করবি। „

সুচি কপট রাগ দেখিয়ে বললো , “ আমার বয়স কতো রে যে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে ? „

“ মায়ের বিয়ে হয়েছিল বাইশ তেইশ বছর বয়সে। আমার বিয়ে হয়ে ছিল ছাব্বিশ সায়ত্রিশ বছর বয়সে । তোর এখন ছাব্বিশ চলছে....

দিদির হিসাব শাস্ত্র সুচি আর শুনতে পারলো না , “ আমার ঘুম পেয়েছে আমি রাখছি । „ বলে ফোনটা কেটে দিয়ে সুচি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু পারলো না। সুচি নিজেই হিসাব করতে বসলো ‘ এক মাস পরেই ও সাতাশ বছরে পড়বে। পরের বছরেই আকাশের তেইশ হবে। তারপর কাকি ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগবে। , এই কথাটা সুচির চোখের ঘুম কেড়ে নিল।

প্রথম তিন চার দিন কেউই কোম্পানির মালিকের ছেলেকে দিয়ে এই পিওনের কাজ করাতে চাইলো না। কিন্তু আকাশের বাবার দ্বিতীয় বার বলাতে সবাই আকাশকে দিয়ে নিচ তলা থেকে উপর তলায় , এই টেবিল থেকে ওই টেবিল ফাইল আনাতে শুরু করলো।

আকাশ ভেবেছিল সে অফিসের বস হয়ে সুচিকে এমন একটা কাজ দেবে যে সুচি সবসময় তার চোখের সামনে থাকে। কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। ফাইল আনতে যখন নিচ তলায় যায় তখনই সুচিকে চোখের এক পলক দেখে আবার চলে আসে। সুচিও আকাশকে চোখের ওই এক পলক দেখেই আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।

পরের মাসেই সুচির জন্মদিনে রাত বারোটায় পলাশ সুচিকে ফোন করে হ্যাপি বার্থডে উইশ করলো। সুচিও থ্যাঙ্ক ইউ বললো।

পলাশ এগিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু সুচির কোথাও একটা বাঁধা লাগছে। পরের বছরেই কাকি আকাশের বিয়ে দিয়ে দেবে এটা ভেবে সুচি , আর এতদিনের পরিকল্পনা এইভাবে ব্যার্থ হয়ে যাওয়ায় আকাশ , দুজনেই  জ্যান্ত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবন যে কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মতো বা একটা বাঁধা ছকে চলে না সেটা দুজনেই বুঝতে পারলো। জীবনকে আমরা চালনা করতে পারি না। জীবন আমাদেরকে চালনা করে। জীবনে গূঢ় তত্ত্বটা দুজনেই নিজেদের জীবনের বর্তমান পরিস্থিতি দিয়ে উপলব্ধি করলো।

কোন কিছুতেই সুচির আর রুচি নেই। পলাশের সাথে রিলেশনে যেতেও রুচি নেই। শুধু পলাশ কেন ! কারোর সাথেই আর রিলেশনে যেতে সুচির ইচ্ছা নেই। ইচ্ছা মারা গেছে অনেক আগে। আর আকাশ এখন ভেবে চলেছে ‘ কি করা যায়। কিভাবে মা কে বললে মা রাজী হবে। তারপর বাবাকেও রাজি করাতে হবে। এইসব ভেবে চলেছে দিনরাত। কিন্তু কিছুই মাথাতে আসছে না। ,

আরও এক মাস কাটলো। এই ফাইল এদিক ওদিকের কাজ করায় আকাশ জানতে পারলো যে , কোথায় কোথায় তাদের নিজস্ব হোটেল আছে। কোথায় কোথায় হোটেল লিজ নেওয়া আছে। কোন কোন দেশে ব্যাবসা ছড়ানোর কথা চলছে। কোন কোন কোম্পানি পুরানো গ্রাহক। কোন কোম্পানি পেমেন্ট করতে বেশি দেরি করে আর কে সঙ্গে সঙ্গে পেমেন্ট করে দেয়। শুধু এতোটাই না ! সাথে এই কোম্পানির কোন এমপ্লয়ির কিরকম ব্যাবহার সেটাও আকাশ জানতে পারলো। এটাও সে চাক্ষুষ করলো যে , এই কোম্পানির যে সবথেকে অভদ্র লোক সে সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও আকাশের সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার করে না। সবসময় তুমি তুমি করে কথা বলে।

একদিন টিফিন ব্রেকে আকাশের খাওয়া শেষ হতে যায় এমন সময় আকাশের বাবার ফোনে একটা ফোন এলো। আকাশ ফোনের ওপ্রান্তের কথা শুনতে না পেলেও বাবার কথা শুনতে পেল।

আকাশের বাবা --- হ্যালো , হ্যা , বলুন মি . গুছাইত । অনেক দিন পর মনে পড়লো....... কোথায় নিয়ে যেতে হবে ?..... মালদা.... তা আপনি আমাকে ফোন না করে ক্ষুদিরাম কেই তো ফোন করতে পারতেন.... ও বুঝেছি । ঠিক আছে। আমি বলছি.... পরশু তো ! ... হ্যাঁ হয়ে যাবে ।

কথা গুলো বলে আকাশের বাবা ফোন রাখলেন । ফোনটা রাখতেই আকাশ বললো , “ কোন গুছাইত ? „

“ অধিকরণ গুছাইত। „

“ গুছাইতের সাথে ব্যাবসা করো কেন ? সামান্য কয়েকটা টাকা মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখে। আর আমাদেরই পেউ পেউ করে টাকা চাইতে হয়। „

“ ডিলটা নেবো না বলছিস ! „

“ যেখানে নিজেদের হেনস্থা হতে হয় সেখানে তুমি কন্ট্রাক্ট নিতে পারো কিন্তু আমি নেবো না। „ কথাটা বলে আকাশ উঠে হাত ধুতে চলে গেল।

ছেলের কথা শুনে আকাশের বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সেদিন রাতেই বিছানায় স্নেহা দেবী বললেন , “ শুনছো। „

“ বলো । „

“ ওর তো তেইশ হতে যায়। পাত্রী দেখতে হবে তো । „

পাত্রীর কথাতে সঞ্জয়কে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে গেল , “ সঞ্জয়ের সাথে কথা বলবো ? ওর মেয়ে গোধূলির ব্যাপারে । „

“ গোধূলি তো শুনেছি বিদেশে পড়ে। আগে আমি ওর স্বভাব চরিত্র দেখবো। তারপর ....

“ ঠিক আছে। „

পরের দিন অফিসে সঞ্জয়কে কথাটা বলার আগেই সঞ্জয় আকাশের বাবার কেবিনে ঢুকে চেয়ারে বসে বললো , “ একটা সুখবর আছে। পরের সপ্তাহে আমার মেয়ে ফিরছে। „
[Image: 20220401-214720.png]
[+] 14 users Like Bichitro's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) চলছে :--- - by Bichitro - 06-12-2021, 09:30 AM



Users browsing this thread: 161 Guest(s)