Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
সাথি ! 

বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রিত হিসেবে আমিও তখন উপস্থিত।আমার দিদির ছোটো ননদের মেয়ের বিয়ে।আমি বর্ধমান থেকে গিয়েছি।খাওয়া দাওয়া পরেই করব।কারণ বাড়ি ফেরার তাড়া নেই।খাওয়া দাওয়া করে শীতের রাতে বেলঘরিয়া থেকে বর্ধমানে ফেরাটা একটু সমস্যাই বটে।দূরত্বটা তো কম নয়।আমি চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছি।তখন বরযাত্রীও এসে গেছে।আমার দিদি আমার কাছে এসে একবার বলে গেল,"ভাই খিদে পেলে খেয়ে নিস।" আমার পাশেই বসে আছে আরো দু তিনজন মেয়ে।ওরা নিজেদের মধ্যে বার্তা বলে চলেছে।হঠাৎ একটি কথা কানে এল।ওদের মধ্যে থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল,

--যত সব ঢঙ।আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে।
পাশ থেকে আর একটি মেয়ে বলে উঠল,
--দ্যাখ দ্যাখ ছেলেটার কোনো পার্সোনালিটিই নেই।বৌ একদিকে হুকুম করে যাচ্ছে আর ও সেটাই করছে।কেন একটু উঠে গিয়ে ফুচকাটা খেতে পারছে না? সুন্দরী বৌয়ের অর্ডার,শুনতে তো হবেই।....কথাগুলো বলেই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল সকলে।আমি কথাটা শুনেই সামনে তাকিয়ে দেখি,একটি ছেলে ফুচকার স্টল থেকে একটা একটা  করে ফুচকা নিয়ে এসে দিচ্ছে আর মেয়েটি চেয়ারে বসে সেটা খেয়ে চলেছে।দেখেই মনে হল নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের।
আমিও দেখে একটু অবাক হলাম।ফুচকার স্টল তো মুখের সামনেই।এই ভাবে একটা একটা করে  ফুচকা নিয়ে এসে দেওয়ার থেকে নিজে একটু উঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলেই তো পারে।তবে এটার মধ্যেও একটা ভালোবাসা আছে বটে।বৌয়ের আবদার রাখতেই হয়তো ছেলেটি এই ভাবে নিয়ে এসে দিচ্ছে।ব্যাপারটা দেখে আমার খারাপ লাগেনি,আর আদিখ্যেতা বলেও মনে হল না।যারা যেভাবে ভালো থাকতে চায় থাক না,সেটা দেখে বাজে মন্তব্য করাটা ঠিক নয়।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রেমটা যতদিন থাকবে ততদিন সম্পর্কটা মধুর থাকে।সম্পর্ক এক ঘেয়ে হওয়ার থেকে এই ছোটো ছোটো আবদার গুলো পূরণ করলে ভালোবাসা বরং বাড়েই।
কিছুক্ষণ পর আমার পাশে বসে থাকা মেয়ে গুলো উঠে গেল।আমি একাই বসে আছি।এদিকে দিদি জামাইবাবু ওরা সব যে যার কাজেই ব্যস্ত।বিয়ে বাড়িতে সেভাবে আমার পরিচিত কেউ নেই।দিদির বাড়ি হলেও কথা ছিল।এটা দিদির ননদের বাড়ি।যে ছেলেটি তার ওয়াইফকে ফুচকা নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছিল তারাও আমার পরিচিত নয়।ওদের দেখে বরপক্ষের লোক বলেই মনে হল।এদিকে ওদের ফুচকা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে তখন।মিনিট পনেরো পর দেখি,ওই ছেলেটি হন্তদন্ত হয়ে মেয়েটির কাছে এসে বলল,
--বিদিশা,এই ব্যাচেই তুমি খেয়ে নাও।মাকেও বললাম খেয়ে নিতে।মা বলল বৌমাকে ডেকে দে তাহলে।
--তুমি এখন খাবে না?
--আগে তোমরা খেয়ে নাও।আমি পরের ব্যাচে বসব।বিয়ে না মিটলে তো যেতেও পারব না কেউই।
--বেশ ঠিক আছে।তাহলে খেয়ে নিই।হাতটা ধরো একটু। বলেই মেয়েটি হাতটা বাড়িয়ে দিতেই,ছেলেটি বলল,
--সাবধানে।আমাকে ভালো করে ধরো।
তারপর মেয়েটি চেয়ার থেকে উঠে ছেলেটির কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল।ছেলেটিও অত্যন্ত যত্ন সহকারে মেয়েটিকে নিয়ে গেল।মেয়েটি হাঁটা চলা স্বাভাবিক বলে মনে হল না।ভালো রকম অসুবিধা আছে।পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটির ডান পা টা নকল।অবাক হলাম।বুঝতে পারলাম তখন ছেলেটি কেন ফুচকা নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছিল।শারীরিক প্রতিবন্ধী একটা মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করাটা অনেক বড়ো মনের পরিচয়।কথা গুলো আমি তখন ভাবছি।কিছুক্ষণ পর দেখি ছেলেটি ওয়াইফকে পৌঁছে দিয়ে এসে আমার ঠিক পাশে এসেই বসল।ছেলেটি নিজে থেকেই আলাপ জমালো।এদিকে আমিও কথা বলার জন্য আগ্রহী হয়েই ছিলাম।খানিকটা পরিচয় হয়ে যাওয়াতে  জানতে পারলাম ছেলেটির পিসতুতো দাদার বিয়ে।কথা বলতে বলতেই জিজ্ঞেস করলাম,
--আপনি খেতে বসলেন না?দেখলাম তো বৌদিকে নিয়ে গেলেন।
ছেলেটি হেসে বলল,
--আপনি লক্ষ্য করেছেন তাহলে!
--লক্ষ্য তো তখন থেকেই করছি যখন দেখলাম বৌদিকে ফুচকা নিয়ে এসে খাইয়ে দিচ্ছিলেন।দেখে বেশ ভালো লাগলো আপনাদের এই সুন্দর ভালোবাসা দেখে।রিসেন্ট বিয়ে হয়েছে মনে হয় আপনাদের।নিশ্চয়ই প্রেম করে বিয়ে?
--ঠিকই ধরেছেন রিসেন্ট বিয়ে হয়েছে।তবে ঠিক প্রেম করে  আমাদের বিয়েটা হয়নি।বিদিশা আমাকে বিয়ে করতে প্রথমে রাজী হয়ে ছিল না,পরে অবশ্য মত চেঞ্জ করেছে।
এমন কথা শোনার পর  আমার মধ্যে আরো কৌতূহল জন্মালো।বিয়েটা যখন প্রেম করেই নয়,তাহলে  তো দেখাশোনা করেই।আমাকে আর জিজ্ঞেস করতে হয়নি।তারপর ছেলেটি নিজে থেকেই বলতে শুরু করল সে কথা...
বছর তিনেক আগের ঘটনা।আমরা দু ভাই।আমি তখন রিসেন্ট জব পেয়েছি সরকারীতে।আমার দাদার বিয়ে হলো।দাদা তখন বেসরকারী কোম্পানিতে চাকরি করে।দাদার বিয়েটা দেখাশোনা করেই।বিয়ের  পাঁচ মাস পর দাদা বৌদিকে নিয়ে ঘুরতে গেল নৈনিতাল।বৌদির ইচ্ছে ছিল সমুদ্রে যাওয়ার।দাদা বলল পাহাড়ে যাবে। এদিকে সমুদ্রে যাবার ইচ্ছে দাদার নেই।দাদা ছোটো থেকেই পাহাড় ভালোবাসে।আবার বৌদি জেদ ধরে বসে আছে পাহাড়ে যাবে না।বাড়িতে আমার মা  তখন বৌদিকে বুঝিয়ে বলল,
"নৈনিতাল ঘুরে এসো।তোমার খারাপ লাগবে না।নতুন বিয়ে হয়েছে কত নতুন নতুন জায়গায় ঘুরবে তোমরা।অমিত যখন বলছে নৈনিতাল যাবে,তখন যাও না।পরের বছর রণিতের বিয়ে দিয়ে দেব।তারপর তোমরা দুই বৌ মিলে প্ল্যান করবে।" রণিত মানে আমি। দাদার বিয়ের পর থেকে  আমার মা বাবা দেখাশোনা শুরু করে দিয়েছিল আমার বিয়ের জন্য।মা তো আমাদের প্রায়ই বলত,তোরা  দুই ভাই কোনো কাজের নয়।একটা প্রেম করতেও পারলি না।যাইহোক দাদা বৌদি চলে গেল নৈনিতাল।আট দিনের ট্যুর।ফেরার ঠিক  আগের দিনের ঘটনা।আমি তখন অফিসে।বাবা ফোন করে বলল,তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।বড়ো বিপদ।ভাবিনি এমন খবর শুনব।নৈনিতাল থেকে ফেরার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।প্রচণ্ড কুয়াশা ছিল তখন।গাড়ি পাহাড় থেকে খাদে পড়ে যায়।বৌদি প্রাণে বাঁচলেও দাদা বাঁচতে পারে নি।বৌদি গুরুতর আহত অবস্থায় তিনমাস হসপিটালে ভর্তি ছিল।তারপর আমরা বাড়ি নিয়ে আসি।আর আজ যাকে আমার ওয়াইফ হিসেবে দেখলেন,বিদিশা আসলে আমার বৌদিই।

আমরা কখনো ভাবিনি এমন ভয়াবহ পরিণতি হবে।দাদার চলে যাওয়াটা অনেক বড়ো ধাক্কা আমাদের কাছে,বিশেষ করে বৌদির কাছে।সুস্থ সুন্দর একটা জীবন থেকে একটা মেয়ের জীবনে এমন পরিণতি সত্যি কষ্টদায়ক।ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বৌদির ডান পা টা হাঁটু থেকে বাদ দিতে হয়।সেই সঙ্গে ডাক্তার জানিয়ে দেয় বৌদি কখনো মা হতেও পারবে না।কারণ জরায়ুতে গুরুতর আঘাত।
বৌদিকে যখন হসপিটাল থেকে বাড়ি আনা হয়,বৌদি তখন স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে অনেক দূরে।শারীরিক ও মানসিক ভাবে বৌদি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।এই সময় একটা মেয়ের পাশে থাকা যে কতটা জরুরী ছিল সেটা বৌদিকে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।বৌদিকে সুস্থ জীবনে ফেরাতেই হবে এই জেদ নিয়ে চলতে শুরু করলাম আমার মা বাবা আর আমি।দেড় বছর পর বৌদি যখন অনেকটাই স্বাভাবিক হলো বৌদির বাবা মা বৌদিকে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।বৌদি নিজে থেকে যায়নি,সব থেকে বড় কথা  আমার মা বাবাও পাঠাতে চায়নি।আমার মা বৌদির বাবাকে ডেকে বললেন,
"দাদা, আমার  বড় ছেলেকে কখনই আমি ফিরে পাব না।কিন্তু মেয়েকে আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে যাবেন না।আমি আমার ছোটো ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে চাই।"
কেন জানিনা আমিও বৌদিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে গিয়ে বৌদিকে ভালোবেসে ফেললাম।বৌদি কিন্তু এমন প্রস্তাবে রাজী হতে চায় নি।আমাকে ডেকে একদিন বলল,
--তোমার সুস্থ সুন্দর জীবনে আমি বোঝা হতে চাই না।শারীরিক প্রতিবন্ধী একটা মেয়ের থেকে পাওয়ার কিছু নেই।আমি যে কখনো মা হতেও পারব না।
--আমি তোমার সব টুকু জেনেই তো তোমার পাশে থাকতে চাই।তোমার ভালো থাকাতেই এখন আমার ভালো থাকা।
বৌদি আরো ছ'মাস টাইম নেয়।অবেশেষে আমাদের দুই বাড়ির সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এক বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়।বিদিশা স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরতে পেরেছে এর থেকে বড়ো কথা আর কী হতে পারে।বিদিশা নিজেও খুশি।বিদিশা এখন মাকে বলে,"তোমাদের মত মা বাবা যেন প্রত্যেক মেয়ে পায়।এত কিছুর পরেও জীবনে যে নতুন করে বাঁচা যায় তোমরা সাথে না থাকলে আমি হয়তো বাঁচতেই পারতাম না।"
তবে বিদিশা সত্যিই খুব ভালো মনের মেয়ে।আমি ওকে খুব ভালোবাসি।জীবনে চলার জন্য একটা পা না থাকাটা বড়ো কথা নয়।দরকার একটা সাথীর।বিদিশাকে নিয়ে চলতে আমার অসুবিধা হয় না।এখন এমন হয়েছে ও সাথে না থাকলেই আমি চলতে পারি না,ও যে আমার জীবন সাথী।
-:সমাপ্ত:-
কলমে:সরজিৎ ঘোষ
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by dada_of_india - 04-12-2021, 11:06 AM



Users browsing this thread: 21 Guest(s)