29-11-2021, 12:09 PM
নারীপুরুষের সম্পর্কে কামনাবাসনা নিয়ে সারা পৃথিবীতে অজস্র লেখালিখি হয়েছে। সেই সব লেখার অনেকগুলিই ছাপা হওয়ার পর নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লেখককে ছুটতে হয়েছে থানা থেকে আদালত, উকিলের বাড়ি থেকে সাক্ষীর দরজায়। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘বিজয়িনী’ নিয়ে, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ গান নিয়ে চেঁচামেচির কথা আমরা জানি। কিন্তু বাংলায় এই ঝামেলা সবচেয়ে বেশি সামলাতে হয়েছে বুদ্ধদেব বসুকে। সারা জীবন। কলেজ ম্যাগাজ়িনে তাঁর একটি গল্পের দ্বিতীয় অংশ মাস্টারমশাই ছাপতে রাজি হননি অশ্লীল বলে। আঠারো বছর বয়সে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় তাঁর একটি গল্প বেরিয়েছিল, ‘রজনী হল উতলা’। গল্পটি পড়ে তখনকার দিনের নামী লেখক বীণাপাণি দেবী ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় লিখেই দিলেন, ‘এই লেখককে আঁতুড়েই নুন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল!’ আর এক জন মহিলা বলেছিলেন, ‘লেখক যদি বিয়ে না করে থাকে তবে যেন অবিলম্বে বিয়ে করে, আর বৌ যদি সম্প্রতি বাপের বাড়িতে থাকে তবে যেন আনিয়ে নেয় চটপট।’ কী ছিল সেই গল্পে যার জন্য এত ধমক, এত ধিক্কার? এখনকার কোনও পাঠক যদি গল্পটি পড়েন, তিনি হয়তো খুঁজেই পাবেন না ঠিক কোন শব্দের জন্য, কোন বর্ণনার জন্য তখন অশ্লীল বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল গল্পটিকে। শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, সেই সময়ের কিছু কবিতার বিরুদ্ধেও এই রকম অভিযোগ ছিল, যেগুলো পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল এই সব লেখা পড়লে এখন মনে হয় কোনও সংস্কৃত কবিতার অনুবাদ!
কিন্তু সদ্যযুবক বুদ্ধদেবের নিরীহ গল্পটি নিয়ে তখন তুলকালাম হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে আসরে নেমেছিলেন সজনীকান্ত দাস। গল্পটিকে ব্যঙ্গ করে একটি নাটক লিখলেন তিনি, আর তার পরে সোজা অভিযোগ জানালেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। বললেন, যে সব পারিবারিক সম্পর্ককে সম্মান করা হয় সমাজে, এই লেখায় সেই সব নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ জরুরি। রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন। লিখলেন যে তাঁরও মনে হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যে ‘হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে।’ মাস চারেকের মধ্যেই লিখলেন ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধটি। সেখানেও তিনি ‘ল্যাঙট-পরা গুলি-পাকানো ধুলোমাখা আধুনিকতা’র বিরুদ্ধেই কথা বললেন। ছেড়ে দিলেন না বুদ্ধদেব বসুও। রবীন্দ্রনাথসহ তাঁর বিরোধীদের কড়া আক্রমণ করলেন তিনি। আরও অনেক কথার সঙ্গে বললেন যে, ‘বেশ্যাবাড়ি নিয়েও যে ভালো গল্প লেখা যায়, এবং অতিপরম সতীসাধ্বী স্ত্রীর কথা নিয়েও যে খারাপ গল্প লেখা যায়’, এটাই কেউ বুঝতে চাইছেন না।
কয়েক বছর পর বেরোল বুদ্ধদেবের প্রথম উপন্যাস ‘সাড়া’। আবার একই অভিযোগ। কিন্তু তার তিন বছর পর বেরোনো ‘এরা আর ওরা এবং আরো অনেকে’ লেখাটির জন্য এই অভিযোগ গড়াল একেবারে আদালত থেকে পুলিশ পর্যন্ত। পুরো ব্যাপারটা দুঃখজনক তো বটেই, কৌতুককরও। পুলিশের দু’জন স্পাই বুদ্ধদেবের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বইটি কিনতে। স্বভাবতই ভয় পেলেন বুদ্ধদেব। কাঠগড়া, পাহারাওলার গুঁতো আর জেলখানার ঠান্ডা মেঝেয় কম্বলের বিছানার ভয়ঙ্কর ছবি মাথায় এল তাঁর। পুলিশের সঙ্গে রফা করলেন তিনি। যদিও প্রথমদিকে যুদ্ধ ঘোষণার একটা ভাব ছিল তাঁর। দিলীপকুমার রায় এক জন দুঁদে ব্যারিস্টারের সঙ্গে তাঁর কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে এবং তাঁর গলার আওয়াজ শুনে বুদ্ধদেবের মনে হয়েছিল তাঁর একটি হুঙ্কারে ‘হাইকোর্ট সুদ্ধ কেঁপে উঠবে’। কিন্তু বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর কয়েক মুহূর্তের বাক্যালাপে পুরো ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে গেল। বুদ্ধদেবেরই ভাড়া করা ট্যাক্সিতে লালবাজারের দিকে যেতে যেতে তিনি বুদ্ধদেবের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী লিখেছিলেন বলুন তো?’ প্রশ্নটা অদ্ভুত, কারণ বুদ্ধদেব এক কপি বই তাঁকে দিয়ে এসেছিলেন এবং ধরেই নিয়েছিলেন তিনি খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চয়ই বুদ্ধদেবের পক্ষে যুক্তি তৈরি করে রেখেছেন। যাই হোক, তাঁকে আশ্বাস দেওয়ার ধরনে বুদ্ধদেব জানালেন, ‘কিছু না— এই তরুণ তরুণীর প্রেমের কথা আর কী।’
কিন্তু সদ্যযুবক বুদ্ধদেবের নিরীহ গল্পটি নিয়ে তখন তুলকালাম হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে আসরে নেমেছিলেন সজনীকান্ত দাস। গল্পটিকে ব্যঙ্গ করে একটি নাটক লিখলেন তিনি, আর তার পরে সোজা অভিযোগ জানালেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। বললেন, যে সব পারিবারিক সম্পর্ককে সম্মান করা হয় সমাজে, এই লেখায় সেই সব নিয়ে নয়ছয় হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ জরুরি। রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন। লিখলেন যে তাঁরও মনে হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যে ‘হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে।’ মাস চারেকের মধ্যেই লিখলেন ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধটি। সেখানেও তিনি ‘ল্যাঙট-পরা গুলি-পাকানো ধুলোমাখা আধুনিকতা’র বিরুদ্ধেই কথা বললেন। ছেড়ে দিলেন না বুদ্ধদেব বসুও। রবীন্দ্রনাথসহ তাঁর বিরোধীদের কড়া আক্রমণ করলেন তিনি। আরও অনেক কথার সঙ্গে বললেন যে, ‘বেশ্যাবাড়ি নিয়েও যে ভালো গল্প লেখা যায়, এবং অতিপরম সতীসাধ্বী স্ত্রীর কথা নিয়েও যে খারাপ গল্প লেখা যায়’, এটাই কেউ বুঝতে চাইছেন না।
কয়েক বছর পর বেরোল বুদ্ধদেবের প্রথম উপন্যাস ‘সাড়া’। আবার একই অভিযোগ। কিন্তু তার তিন বছর পর বেরোনো ‘এরা আর ওরা এবং আরো অনেকে’ লেখাটির জন্য এই অভিযোগ গড়াল একেবারে আদালত থেকে পুলিশ পর্যন্ত। পুরো ব্যাপারটা দুঃখজনক তো বটেই, কৌতুককরও। পুলিশের দু’জন স্পাই বুদ্ধদেবের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বইটি কিনতে। স্বভাবতই ভয় পেলেন বুদ্ধদেব। কাঠগড়া, পাহারাওলার গুঁতো আর জেলখানার ঠান্ডা মেঝেয় কম্বলের বিছানার ভয়ঙ্কর ছবি মাথায় এল তাঁর। পুলিশের সঙ্গে রফা করলেন তিনি। যদিও প্রথমদিকে যুদ্ধ ঘোষণার একটা ভাব ছিল তাঁর। দিলীপকুমার রায় এক জন দুঁদে ব্যারিস্টারের সঙ্গে তাঁর কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে এবং তাঁর গলার আওয়াজ শুনে বুদ্ধদেবের মনে হয়েছিল তাঁর একটি হুঙ্কারে ‘হাইকোর্ট সুদ্ধ কেঁপে উঠবে’। কিন্তু বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁর কয়েক মুহূর্তের বাক্যালাপে পুরো ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে গেল। বুদ্ধদেবেরই ভাড়া করা ট্যাক্সিতে লালবাজারের দিকে যেতে যেতে তিনি বুদ্ধদেবের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী লিখেছিলেন বলুন তো?’ প্রশ্নটা অদ্ভুত, কারণ বুদ্ধদেব এক কপি বই তাঁকে দিয়ে এসেছিলেন এবং ধরেই নিয়েছিলেন তিনি খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চয়ই বুদ্ধদেবের পক্ষে যুক্তি তৈরি করে রেখেছেন। যাই হোক, তাঁকে আশ্বাস দেওয়ার ধরনে বুদ্ধদেব জানালেন, ‘কিছু না— এই তরুণ তরুণীর প্রেমের কথা আর কী।’