27-11-2021, 07:44 PM
(This post was last modified: 27-11-2021, 07:47 PM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পিতৃঋণ
ডেডবডি দেখে যে কোনো মানুষ তার উদ্দেশ্যে জুতো ছুড়তে পারে তা এই প্রথম দেখল সৌম্য ।রীতিমত চোর ডাকাত মারা গেলেও মৃত্যুর পর সকলে তার এক টুকরো ভালো গুন খোঁজার চেষ্টা করে থাকে ।আহা অমুক লোকটা খুনি হোক ,তবুও নিজের মাকে ভালোবেসেছিল গো !
এই ধরণের কথাই সাধারণত মৃতের উদ্দেশ্যে বলা হয় ।সেখানে সুখেন বাবুর মত নির্বিবাদী মানুষটা মারা যাবার পর তার দুই ছেলেই ফুলের বদলে মৃতদেহের ওপর জুতো ছুড়েছে ।
পোস্টমর্টেমের পর অনেকেই সেই দৃশ্য দেখেছে ।
সজল আর উজ্জ্বল দুই ভাই একমুখ থুথু ফেলে বলেছে ,শালা বাপটা মরেও শান্তি দিলো না ।এখন থানা পুলিশ দৌড়ে বেড়াও ।
অবশ্য যে বাসের সাথে ধাক্কা লেগে সুখেন বাবু মারা গেছেন সেই বাস মালিকের কাছে আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছেও ছুটেছে একভাই ।
বাবার মৃতদেহের বদলে টাকাটা তো সঠিক সময়েই নিতে হবে ।
সৌম্য সজলের ছোট বেলার বন্ধু ।তাই ওদের বাড়িতে সেই ছোট্ট থেকেই যাতায়াত ছিল ওর ।কতবার খেলতে এসে কাকিমার হাতের লুচি,ঘুগনি খেয়ে গেছে ও ।কাকুও মাঝে মাঝেই পিঠ চাপড়ে বলতো ,বড় হও ,মানুষ হও ।
কাকু রেলে চাকরি করতো ,সকালবেলা বেড়িয়ে যেত ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে । কাকু আর কাকিমার মধ্যে একটা অযথা দূরত্ব চোখে পড়েছিল সৌম্যর । কেমন দূরত্ব ,সঠিক ভাবে হয়তো বোঝাতে পারবে না সৌম্য,তবে এই অচেনা দূরত্বটা ওর বাবা-মা বা মাসি-মেসোর মধ্যে কোনোদিন দেখেই নি ।
অথচ রমলা কাকিমা মানে সজলের মা কিন্তু কাকুর অসম্ভব যত্ন করতো । কাকুও কাকিমাকে স্নেহের চোখেই দেখতেন তবুও ...ঐ খটকাটা সৌম্যর চোখে লাগতো ।কখনো সজলকে জিজ্ঞেস করেনি ,কারোর বাবা মা সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়াটা বড্ড অশোভন হয়ে যায়।
তবে মাঝে মাঝে কলেজে এসে সজল বলতো ,কপাল করেছি বটে !আমাদের প্রেমের বয়েসে এখন আমার বাপটা প্রেম মেরে বেড়াচ্ছে ,আর সে বুড়ি মাগীও বিয়ে থা না করে সুখেন দত্তর জন্য পসরা সাজিয়ে বসে আছে ।
সৌম্য বলেছিলো ,তুই চিনিস ভদ্রমহিলাকে ?
সজল বলেছিল , চিনি বলতে ,একদিনই দেখেছিলাম ...বাবার সাথে ।ফলো করে গিয়ে দেখি ,হাতিবাগানের একটা বাড়িতে থাকে ।সম্ভবত চাকরি করে বুঝলি ।
দুই ছেলের বাপ ,ঘরে বৌ আছে ,জেনেও যে কি করে মহিলা বাবাকে এখনো ...কোনোদিন কিছু বলিনি শুধু সমাজে আমার আর দাদার সম্মানের কথা ভেবেই ।
মুখটা কালো করে সজল মাটির দিকে চোখ নামিয়েছিলো ।সৌম্য বুঝতে পারছিল নিজের বাবার সম্পর্কে বন্ধুর কাছে এভাবে বলে ফেলে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে সজল ।ওকে স্বাভাবিক করার জন্যই বলেছিলো ,দেখ ,কাকু তো কোনোদিন তোদের যত্নের কোনো ত্রুটি করেননি ।তাছাড়া কাকিমারও কোনো অবহেলা করেন নি ,তাই থাক না গুরুজনের কাজের সমলোচনা নাই বা করলাম ।
তবুও মাঝে মাঝেই সজলের মধ্যে একটা আক্রমণাত্মক মুখ কাজ করতো ।
একদিন এসে বললো ,শালা যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর !মাকে বলতে গেলাম বাবার কীর্তির কথা... সবটা শুনে মা বললো ,তোমার বাবার নামে সমলোচনা করাও পাপ ।
ভারতীয় নারী ,পতিব্রতা নারী।
নীরব শ্রোতা হওয়া ছাড়া সৌম্যর আর কিছুই করার ছিল না এক্ষেত্রে ।
তারপর তো কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর ।সজল আর সৌম্য দুজনেই এখন চাকুরী জীবী ।
সজলের দাদা উজ্জ্বলদার বিয়ে ঠিক হয়েছে ।আর দুমাস বাকি । সজল একদিন সৌম্যর বাড়িতে এসে বলে গিয়েছিলো , দাদার বিয়েতে সাতদিন ধরে আমাদের বাড়িতেই তুই থাকবি ।আমি একা সামলাতে পারবো না ।
সৌম্য বলেছিলো , নিশ্চয় ।উজ্জ্বলদা তো আমারও দাদা রে । অনেকদিন পর দুই বন্ধু প্রাণ খুলে গল্প করেছিল ।
শুধু যখন সৌম্য জিজ্ঞেস করেছিল সুখেন কাকু কেমন আছে রে ।তখনি সজলের চোখে দেখেছিল একরাশ ঘৃণা।
ভালোই বলে প্রসঙ্গ পাল্টে ছিলো ।
উজ্জ্বলদার বিয়ের আগেই ঘটে গেল এমন দুর্ঘটনা ।
সুখেন কাকু মাত্র মাসখানেক আগে রিটায়ার করেছেন ।অফিস সংক্রান্ত কোনো কাজেই বোধহয় অফিসে যাচ্ছিলেন ,রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় ...ইন্টারন্যাল হ্যামারেজ বোধহয় ।শরীরটা ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ।
কাকিমা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কাকুর মৃতদেহের একপাশে ।
সুখেন কাকু চরিত্রহীন হতে পারেন কিন্তু অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন বলে পাড়ায় কখনো কারোর সাথে ঝগড়া হয়নি ।পাড়ার অনেক ছেলেই এসেছে শবযাত্রী হিসাবে ।
উজ্জ্বলদা এই মাত্র ইনসুরেন্সের লোকেদের সাথে কথা বলে ,বাড়িতে ঢুকলো ।
ঢুকেই ভাইকে বললো ,বেওয়ারিশ লাশ বলে ফেলে দিয়ে এলি না কেন ?বেঁচে থাকতে তো ওনার কথায় চলতে হয়েছে আমাদের ।
তাহলে অবশ্য ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যেত না ।তাহলে ফিক্সট ডিপোজিট ,আরো টাকা পয়সা পাওয়ার সমস্যা হত ।
রমলা কাকিমা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ,আরেকজন কোথায় ??
সে না এলে ওর মুখে অগ্নিসংযোগ হবে না যে ।
সজল ,উজ্জ্বলদা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে ।তারা দুই ছেলেই তো বর্তমান ।তাহলে মা আবার কার কথা বলছে ?
তারমানে কি ঐ মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কের জেরে সুখেন কাকুর কোনো অবৈধ সন্তান আছে নাকি ? কাকিমা হয়তো তার অস্তিত্বের কথা জানেন ,তাই আজ কাকুর মৃতদেহের সামনে তাকে আনতে চাইছেন!!
উজ্জ্বলদা বললো ,ওহ শুধু প্রেমিকা নয় আবার ছেলেও আছে বুঝি বাবার ?
রমলা কাকিমা হাত নেড়ে সৌম্যকে ডাকলেন ।
খুব ধীরে ধীরে যে ঠিকানাটা বললেন সেটা হাতিবাগানের কোনো একটা বাড়ির ।
সজল আর উজ্জ্বলদা তাড়া দিচ্ছে সুখেন কাকুর মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে যেতে চায় ।কিছুতেই বাবার সম্পত্তির তৃতীয় ভাগীদারকে প্রবেশ করতে দেবে না ওরা ।
শান্ত রমলা কাকিমার উগ্র মূর্তি দেখে দুই ছেলেই একটু ঘাবড়ে গেছে । রমলা কাকিমা বললেন ,সৌম্য ফেরার আগে ওনার দেহ এবাড়িতেই থাকবে ।
সৌম্য ততক্ষনে বাইকে স্টার্ট দিয়েছে ।
হাতিবাগানের একটা গলির মধ্যে দোতলা বাড়ির একতলার ঠিকানায় পৌঁছে গেছে সৌম্য ।
কলিং বেল বাজতেই একজন মহিলা দরজা খুলল । কাঁচাপাকা চুল ,পরনে সুবুজ সাদার একটা জামদানী ,চোখে হাই পাওয়ারের চশমা ।কানে দুটো ছোট্ট কানফুল । হাতে একজোড়া সোনার বালা ।
এটুকু সাজে যে কোনো মহিলাকে এতোটা সুন্দর লাগতে পারে সেটা সৌম্য এই প্রথম দেখলো ।গাম্ভীর্যের আবরণে একটা কোমল চোখের চাহনি।
অষ্টাদশীর গলায় ঐ পঞ্চাশোর্ধ মহিলা বললেন ,কাকে চান ?
সৌম্য বললো ,আপনিই মানসী দেবী ?
ঘাড় নেড়ে বললেন হ্যাঁ ।কিন্তু এই মুহূর্তে তো আমি আর টিউসুনি করছি না ।বয়েস হয়েছে ,কলেজের চাকরিটাই ছাড়তে পারলে বাঁচি ।
ভদ্রমহিলা সম্ভবত সৌম্যকে কোনো কোচিং সেন্টারের হেড ভেবেছেন ।
সৌম্য ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে বললো , আমি এসেছি সুখেন কাকুর বাড়ি থেকে । আমাকে রমলা কাকিমা পাঠিয়েছেন ।
সৌম্য স্পষ্ট দেখলো চমকে উঠলেন মানসীদেবী ।
ধীরে ধীরে বললেন ,আমি একা মানুষ জুনিয়র হাই কলেজে টিচারী করি ।বাকি জীবনটা আমার নিজের জমানো টাকায় চলে যাবে বাবা । রমলাকে গিয়ে বলো ,মানসী বলছে ,সুখেনের কোনো সম্পত্তি আমি নেবো না । সুখেনকে গিয়ে বলো ,ওদের নামেই যেন সব লিখে দেয় ।
সৌম্য বললো ,আপনাকে একবার অন্তত ওবাড়িতে যেতে বলে দিয়েছেন কাকিমা ।মানসী দেবী হেসে বললেন ,সই করতে হবে ...
সুখেন খুব চিন্তা করছিলো ,দুই ছেলেই নাকি বাপের সম্পত্তি নিয়ে মারামারি করবে ,রমলাকে কিছুই দেবে না ।এর মধ্যে আবার আমি ঢুকলাম কি করে !!আমার তো কোনো দাবি নেই ওর সম্পত্তিতে !!
কাকিমা বারবার সৌম্যকে বলে দিয়েছেন ,হাই প্রেশারের রুগী মানসীদেবীকে যেন কোনো ভাবেই ওর বাড়িতে সুখেন কাকুর মৃত্যু সংবাদ দেওয়া না হয় ।
এদিকে মহিলা সম্পত্তির কেচ্ছা ভেবে কোনোমতেই যেতে চাইছেন না !!
শেষে সৌম্য বললো ,আসলে সুখেন কাকু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ।আপনাকে একবার দেখতে চেয়েছেন ।
কথায় কাজ হলো মনে হচ্ছে ।
এক সেকেন্ড দেরি না করে মানসীদেবী ঘরে চাবি ঝুলিয়ে সৌম্যর বাইকে এসে বসলেন ।
খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন , বেঁচে আছে তো ?সেরিব্রাল নাকি ?তারপরের কথাগুলো স্বগতোক্তি । এতো বলতাম চিন্তা করো না। তবুও দুশ্চিন্তা করে যেত ,শুধু বলতো ও চলে গেলে নাকি রমলাকে ছেলেরা দেখবে না !!
ভাবতে ভাবতে শেষে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লো ।
বাড়ির সামনে তখন অনেক লোক ।
বুদ্ধিমতী মহিলা মানসী দেবী ।
সৌম্যকে বললেন , কখন হলো ?
সৌম্য বললো ,বাস একসিডেন্ট!!
বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই রমলা কাকিমা এসে জড়িয়ে ধরলো মানসী দেবীকে ।
সাধারণত এই ধরণের সম্পর্কে স্বামীর অবৈধ প্রেমিকাকে তার স্ত্রীরা গালাগাল দেয় ,খারাপ নজরে দেখে ।এক্ষত্রে তো রমলা কাকিমাকে অত্যন্ত আধুনিক ভাবতে হবে ।
মানসী দেবীর দুচোখে জল ।
রমলা কাকিমা প্রলাপ বকছেন ,তোমাকে ফাঁকি দিয়েছিলাম আমি তাই আজ আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো ও ।
মানসী দেবী কাকিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন ,এই সময় তোমাকে শক্ত থাকতে হবে রমলা ।সুখেন নেই ,তোমাকেই তো দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের বিয়ে দিতে হবে।
সৌম্য শুধু অবাক হয়ে দেখছে ,শুধু সৌম্য নয় ... দুই ভাই এতদিন ধরে যারা ওনাকে অনেক নোংরা কথা বলেছে তারাও হাতের কাছে মানসীদেবীকে পেয়েও সামনে কিছুই বলতে পারছেনা ।
মানসী দেবী সুখেন কাকুর পায়ের কাছে এসে বসলেন ।নিজের আঁচল দিয়ে ওনার পাটা মুছিয়ে দিলেন যেন ।মাথায় ছোঁয়ালেন হাত টা ।
তারপর নিজের হাত থেকে আংটিটা খুলে সুখেন কাকুর পায়ের কাছে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ।
নির্দেশের গলায় বললেন ,চুল্লীতে ভরে দিও না ওকে। ওর ঐ ঘরটায় বড্ড ভয় ছিল ।কাঠের চিতা সাজিয়ে ওকে দাহ করো ।
শেষের দিকে গলাটা ধরে এসেছিলো ওনার ।
হঠাৎ রমলা কাকিমা সুখেন কাকুর উদ্দেশ্যে বললেন ,আজ তুমি চলে গেছো তাই তোমার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙলেও আর তোমার কোনো ক্ষতি হবে না নিশ্চয় ,আজ তোমার সামনেই আমাকে বলতে হবে সবটুকু ।
ত্রিশ বছরের সব গোপন কথা ।
মানসীদেবী বললেন ,থাক না রমলা ।এই অবস্থায় ওসব কথা নাইবা বললে ,তাছাড়া পুরোনো কথা গোপন থাকাই ভালো !
রমলা কাকিমা দুদিকে ঘাড় নেড়ে বললেন ,তুমি আমাকে অনেক দিন চুপ করিয়ে রেখেছো ,দুই ছেলের চোখে ঐ ভগবানের মত মানুষটার জন্য শুধুই ঘৃণা দেখেছি তবুও শুধু তোমার আর ওনার কথা শুনে আমি ছেলেদের কাছ থেকে সবটুকু আড়াল করেছি ।আজ বলতে দাও ।
পাড়ার প্রচুর লোক জমে গেছে ।মৃতদেহের চরিত্রএর সদগুন বদগুন শোনার লোকের অভাব নেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই যে মানুষটা ছাইভস্মে পরিণত হয়ে যাবে তাকেও সমাজের কাছে নিজের চরিত্রের দোষ স্খলন করে যেতে হচ্ছে ।
খুব ধীরে ধীরে রমলা কাকিমা বলতে শুরু করেছেন ।
যেন স্মৃতির একেকটি পাতার ধুলো ঝাড়ছেন সযত্নে ।
চোখদুটো মাঝে মাঝেই বন্ধ করে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখে নিচ্ছেন ত্রিশ বছর আগের বৃষ্টি ভেজা এক সন্ধ্যেকে ।
রেল লাইন ধরে পাগলের মত ছুটছে রমলা ।
কোলে একটা বছর দুয়েকের ছেলে আর পেটে আট মাসের সন্তান । তিনজনেরই মৃত্যু কাম্য । স্বামীর মারধোর সহ্য করাটা তখন রমলার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো ।কিন্তু নিজের গর্ভবতী স্ত্রীর ঘরে পরপুরুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো রমলার স্বামী ।
ওর ব্যবসার উন্নতির জন্য ।আর সহ্য করতে পারেনি রমলা ,সন্তানদের নিয়েই তাই মৃত্যু চেয়েছিলো সেদিন।
ট্রেনটা আসছিলো ধেয়ে এমন সময় একটা লোক এসে টেনে নিয়েছিল ওদের ।জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলো রমলা আর ওর কোলের সন্তানের ।
সেই রাতে ওকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল মানুষটা ।
কোলে সন্তান নিয়ে গর্ভবতী একজন মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিলো,সুখেনের লুকিয়ে রাখা স্ত্রী আর সন্তান এসেছে ।সুখেনের দাদারা মেনে নেয়নি ওর জন্য পরিবারের বদনাম হোক ।
গৃহ ছাড়া হয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে এনে তুলেছিল ওদের। দুটো দিন যেতে না যেতেই বাড়িওলা লোক ডেকে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয় । সুখেনের কোনো কথাই তখন কেউ শুনতে নারাজ ।
বিয়ের কদিনের মধ্যেই রমলা জানতে পারে সুখেন আর মানসীর কলেজ লাইফ থেকে প্রেমের কথা ,ওদের আংটি বদলের কথা ।মানসীর দিদির বিয়ে হয়ে গেলেই ওদের বিয়ে হবার কথা ছিলো ।
সেদিন থেকে মানসীর কাছে অপরাধী হয়েছে রমলা ।সুখেন অনেক বুঝিয়েছে মানসীকে ,সংসার পাততে বলেছে অন্য কোথাও ।কিন্তু মানসীর এতটাই জেদ যে কোনোভাবেই বিয়ে করেনি ।দাদাদের সংসার থেকে চলে এসে ঘর ভাড়া করে কাটিয়ে দিলো জীবনটা ।শুধু সুখেনকে ভালোবেসে ।
সজলের জন্মের পর রমলা চলে যেতে চেয়েছিলো অন্য কোথাও ।মানসীই জোর করে যেতে দেয়নি ওকে ।দুই সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরতে দেয় নি রমলাকে ।তাই কোনো রকম শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াই ও আর সুখেন স্বামী -স্ত্রীর জীবন কাটিয়েছে দিনের পর দিন । সুখেন বলেছিলো ,দুটো ছোট্ট ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুর চোখে নাইবা তাদের আসল বাবার পরিচয়টা প্রকট হলো !! আমিই ওদের বাবা । প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল রমলা ,কোনোদিন সজল আর উজ্জ্বল জানবে না ওদের আসল বাবার পরিচয় ।
ওদের জন্মদাতা তার কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন বিয়ে করে সংসার বসিয়েছিল ,সে খবরও রমলার কানে এসেছিলো ।
মানসী প্রতি পুজোয় সজল আর উজ্জলের জন্য জামা কিনে পাঠাতো সুখেনের হাত দিয়ে ।বলতো ওদের বলো ,ওদের মাসীমনি পাঠিয়েছে ।
শব যাত্রীরা এগিয়ে চলেছে ,দুই দিকে দুই ছেলের কাঁধে চড়ে চলছে মান-অপমানের ঊর্ধ্বে থাকা একজন মানুষ ।যার পরিচয় ছিল সজল-উজ্জলের বাবা ।
এই প্রথম দুই ভাইয়ের চোখের জলে ভাসতে ভাসতে তাদের বাবা চলছে মহাপ্রস্থানের পথে। পালিত পিতার ঋণ হয়তো তারা এ জীবনে শোধ করতেও পারবে না ।
পিছনে দুজন মহিয়সী মহিলা ...একজন তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছে সারাজীবন, আরেকজন মানবরূপী ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করে গেছেন। সৌম্য সুখেন কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল ...একটা পরিতৃপ্তির হাসি যেন বিরাজ করছে গোটা মুখ জুড়ে ।নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে খুশি করার গর্বেই হয়তো এই তৃপ্তি।
লেখিকা অর্পিতা সরকার
আমি কারুর গল্প নিজের নামে চালাই না ! লেখক বা লেখিকাকে সম্মান দিতে জানি !
ডেডবডি দেখে যে কোনো মানুষ তার উদ্দেশ্যে জুতো ছুড়তে পারে তা এই প্রথম দেখল সৌম্য ।রীতিমত চোর ডাকাত মারা গেলেও মৃত্যুর পর সকলে তার এক টুকরো ভালো গুন খোঁজার চেষ্টা করে থাকে ।আহা অমুক লোকটা খুনি হোক ,তবুও নিজের মাকে ভালোবেসেছিল গো !
এই ধরণের কথাই সাধারণত মৃতের উদ্দেশ্যে বলা হয় ।সেখানে সুখেন বাবুর মত নির্বিবাদী মানুষটা মারা যাবার পর তার দুই ছেলেই ফুলের বদলে মৃতদেহের ওপর জুতো ছুড়েছে ।
পোস্টমর্টেমের পর অনেকেই সেই দৃশ্য দেখেছে ।
সজল আর উজ্জ্বল দুই ভাই একমুখ থুথু ফেলে বলেছে ,শালা বাপটা মরেও শান্তি দিলো না ।এখন থানা পুলিশ দৌড়ে বেড়াও ।
অবশ্য যে বাসের সাথে ধাক্কা লেগে সুখেন বাবু মারা গেছেন সেই বাস মালিকের কাছে আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছেও ছুটেছে একভাই ।
বাবার মৃতদেহের বদলে টাকাটা তো সঠিক সময়েই নিতে হবে ।
সৌম্য সজলের ছোট বেলার বন্ধু ।তাই ওদের বাড়িতে সেই ছোট্ট থেকেই যাতায়াত ছিল ওর ।কতবার খেলতে এসে কাকিমার হাতের লুচি,ঘুগনি খেয়ে গেছে ও ।কাকুও মাঝে মাঝেই পিঠ চাপড়ে বলতো ,বড় হও ,মানুষ হও ।
কাকু রেলে চাকরি করতো ,সকালবেলা বেড়িয়ে যেত ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে । কাকু আর কাকিমার মধ্যে একটা অযথা দূরত্ব চোখে পড়েছিল সৌম্যর । কেমন দূরত্ব ,সঠিক ভাবে হয়তো বোঝাতে পারবে না সৌম্য,তবে এই অচেনা দূরত্বটা ওর বাবা-মা বা মাসি-মেসোর মধ্যে কোনোদিন দেখেই নি ।
অথচ রমলা কাকিমা মানে সজলের মা কিন্তু কাকুর অসম্ভব যত্ন করতো । কাকুও কাকিমাকে স্নেহের চোখেই দেখতেন তবুও ...ঐ খটকাটা সৌম্যর চোখে লাগতো ।কখনো সজলকে জিজ্ঞেস করেনি ,কারোর বাবা মা সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়াটা বড্ড অশোভন হয়ে যায়।
তবে মাঝে মাঝে কলেজে এসে সজল বলতো ,কপাল করেছি বটে !আমাদের প্রেমের বয়েসে এখন আমার বাপটা প্রেম মেরে বেড়াচ্ছে ,আর সে বুড়ি মাগীও বিয়ে থা না করে সুখেন দত্তর জন্য পসরা সাজিয়ে বসে আছে ।
সৌম্য বলেছিলো ,তুই চিনিস ভদ্রমহিলাকে ?
সজল বলেছিল , চিনি বলতে ,একদিনই দেখেছিলাম ...বাবার সাথে ।ফলো করে গিয়ে দেখি ,হাতিবাগানের একটা বাড়িতে থাকে ।সম্ভবত চাকরি করে বুঝলি ।
দুই ছেলের বাপ ,ঘরে বৌ আছে ,জেনেও যে কি করে মহিলা বাবাকে এখনো ...কোনোদিন কিছু বলিনি শুধু সমাজে আমার আর দাদার সম্মানের কথা ভেবেই ।
মুখটা কালো করে সজল মাটির দিকে চোখ নামিয়েছিলো ।সৌম্য বুঝতে পারছিল নিজের বাবার সম্পর্কে বন্ধুর কাছে এভাবে বলে ফেলে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে সজল ।ওকে স্বাভাবিক করার জন্যই বলেছিলো ,দেখ ,কাকু তো কোনোদিন তোদের যত্নের কোনো ত্রুটি করেননি ।তাছাড়া কাকিমারও কোনো অবহেলা করেন নি ,তাই থাক না গুরুজনের কাজের সমলোচনা নাই বা করলাম ।
তবুও মাঝে মাঝেই সজলের মধ্যে একটা আক্রমণাত্মক মুখ কাজ করতো ।
একদিন এসে বললো ,শালা যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর !মাকে বলতে গেলাম বাবার কীর্তির কথা... সবটা শুনে মা বললো ,তোমার বাবার নামে সমলোচনা করাও পাপ ।
ভারতীয় নারী ,পতিব্রতা নারী।
নীরব শ্রোতা হওয়া ছাড়া সৌম্যর আর কিছুই করার ছিল না এক্ষেত্রে ।
তারপর তো কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর ।সজল আর সৌম্য দুজনেই এখন চাকুরী জীবী ।
সজলের দাদা উজ্জ্বলদার বিয়ে ঠিক হয়েছে ।আর দুমাস বাকি । সজল একদিন সৌম্যর বাড়িতে এসে বলে গিয়েছিলো , দাদার বিয়েতে সাতদিন ধরে আমাদের বাড়িতেই তুই থাকবি ।আমি একা সামলাতে পারবো না ।
সৌম্য বলেছিলো , নিশ্চয় ।উজ্জ্বলদা তো আমারও দাদা রে । অনেকদিন পর দুই বন্ধু প্রাণ খুলে গল্প করেছিল ।
শুধু যখন সৌম্য জিজ্ঞেস করেছিল সুখেন কাকু কেমন আছে রে ।তখনি সজলের চোখে দেখেছিল একরাশ ঘৃণা।
ভালোই বলে প্রসঙ্গ পাল্টে ছিলো ।
উজ্জ্বলদার বিয়ের আগেই ঘটে গেল এমন দুর্ঘটনা ।
সুখেন কাকু মাত্র মাসখানেক আগে রিটায়ার করেছেন ।অফিস সংক্রান্ত কোনো কাজেই বোধহয় অফিসে যাচ্ছিলেন ,রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের ধাক্কায় ...ইন্টারন্যাল হ্যামারেজ বোধহয় ।শরীরটা ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ।
কাকিমা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কাকুর মৃতদেহের একপাশে ।
সুখেন কাকু চরিত্রহীন হতে পারেন কিন্তু অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন বলে পাড়ায় কখনো কারোর সাথে ঝগড়া হয়নি ।পাড়ার অনেক ছেলেই এসেছে শবযাত্রী হিসাবে ।
উজ্জ্বলদা এই মাত্র ইনসুরেন্সের লোকেদের সাথে কথা বলে ,বাড়িতে ঢুকলো ।
ঢুকেই ভাইকে বললো ,বেওয়ারিশ লাশ বলে ফেলে দিয়ে এলি না কেন ?বেঁচে থাকতে তো ওনার কথায় চলতে হয়েছে আমাদের ।
তাহলে অবশ্য ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যেত না ।তাহলে ফিক্সট ডিপোজিট ,আরো টাকা পয়সা পাওয়ার সমস্যা হত ।
রমলা কাকিমা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ,আরেকজন কোথায় ??
সে না এলে ওর মুখে অগ্নিসংযোগ হবে না যে ।
সজল ,উজ্জ্বলদা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে ।তারা দুই ছেলেই তো বর্তমান ।তাহলে মা আবার কার কথা বলছে ?
তারমানে কি ঐ মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কের জেরে সুখেন কাকুর কোনো অবৈধ সন্তান আছে নাকি ? কাকিমা হয়তো তার অস্তিত্বের কথা জানেন ,তাই আজ কাকুর মৃতদেহের সামনে তাকে আনতে চাইছেন!!
উজ্জ্বলদা বললো ,ওহ শুধু প্রেমিকা নয় আবার ছেলেও আছে বুঝি বাবার ?
রমলা কাকিমা হাত নেড়ে সৌম্যকে ডাকলেন ।
খুব ধীরে ধীরে যে ঠিকানাটা বললেন সেটা হাতিবাগানের কোনো একটা বাড়ির ।
সজল আর উজ্জ্বলদা তাড়া দিচ্ছে সুখেন কাকুর মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে যেতে চায় ।কিছুতেই বাবার সম্পত্তির তৃতীয় ভাগীদারকে প্রবেশ করতে দেবে না ওরা ।
শান্ত রমলা কাকিমার উগ্র মূর্তি দেখে দুই ছেলেই একটু ঘাবড়ে গেছে । রমলা কাকিমা বললেন ,সৌম্য ফেরার আগে ওনার দেহ এবাড়িতেই থাকবে ।
সৌম্য ততক্ষনে বাইকে স্টার্ট দিয়েছে ।
হাতিবাগানের একটা গলির মধ্যে দোতলা বাড়ির একতলার ঠিকানায় পৌঁছে গেছে সৌম্য ।
কলিং বেল বাজতেই একজন মহিলা দরজা খুলল । কাঁচাপাকা চুল ,পরনে সুবুজ সাদার একটা জামদানী ,চোখে হাই পাওয়ারের চশমা ।কানে দুটো ছোট্ট কানফুল । হাতে একজোড়া সোনার বালা ।
এটুকু সাজে যে কোনো মহিলাকে এতোটা সুন্দর লাগতে পারে সেটা সৌম্য এই প্রথম দেখলো ।গাম্ভীর্যের আবরণে একটা কোমল চোখের চাহনি।
অষ্টাদশীর গলায় ঐ পঞ্চাশোর্ধ মহিলা বললেন ,কাকে চান ?
সৌম্য বললো ,আপনিই মানসী দেবী ?
ঘাড় নেড়ে বললেন হ্যাঁ ।কিন্তু এই মুহূর্তে তো আমি আর টিউসুনি করছি না ।বয়েস হয়েছে ,কলেজের চাকরিটাই ছাড়তে পারলে বাঁচি ।
ভদ্রমহিলা সম্ভবত সৌম্যকে কোনো কোচিং সেন্টারের হেড ভেবেছেন ।
সৌম্য ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে বললো , আমি এসেছি সুখেন কাকুর বাড়ি থেকে । আমাকে রমলা কাকিমা পাঠিয়েছেন ।
সৌম্য স্পষ্ট দেখলো চমকে উঠলেন মানসীদেবী ।
ধীরে ধীরে বললেন ,আমি একা মানুষ জুনিয়র হাই কলেজে টিচারী করি ।বাকি জীবনটা আমার নিজের জমানো টাকায় চলে যাবে বাবা । রমলাকে গিয়ে বলো ,মানসী বলছে ,সুখেনের কোনো সম্পত্তি আমি নেবো না । সুখেনকে গিয়ে বলো ,ওদের নামেই যেন সব লিখে দেয় ।
সৌম্য বললো ,আপনাকে একবার অন্তত ওবাড়িতে যেতে বলে দিয়েছেন কাকিমা ।মানসী দেবী হেসে বললেন ,সই করতে হবে ...
সুখেন খুব চিন্তা করছিলো ,দুই ছেলেই নাকি বাপের সম্পত্তি নিয়ে মারামারি করবে ,রমলাকে কিছুই দেবে না ।এর মধ্যে আবার আমি ঢুকলাম কি করে !!আমার তো কোনো দাবি নেই ওর সম্পত্তিতে !!
কাকিমা বারবার সৌম্যকে বলে দিয়েছেন ,হাই প্রেশারের রুগী মানসীদেবীকে যেন কোনো ভাবেই ওর বাড়িতে সুখেন কাকুর মৃত্যু সংবাদ দেওয়া না হয় ।
এদিকে মহিলা সম্পত্তির কেচ্ছা ভেবে কোনোমতেই যেতে চাইছেন না !!
শেষে সৌম্য বললো ,আসলে সুখেন কাকু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ।আপনাকে একবার দেখতে চেয়েছেন ।
কথায় কাজ হলো মনে হচ্ছে ।
এক সেকেন্ড দেরি না করে মানসীদেবী ঘরে চাবি ঝুলিয়ে সৌম্যর বাইকে এসে বসলেন ।
খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন , বেঁচে আছে তো ?সেরিব্রাল নাকি ?তারপরের কথাগুলো স্বগতোক্তি । এতো বলতাম চিন্তা করো না। তবুও দুশ্চিন্তা করে যেত ,শুধু বলতো ও চলে গেলে নাকি রমলাকে ছেলেরা দেখবে না !!
ভাবতে ভাবতে শেষে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লো ।
বাড়ির সামনে তখন অনেক লোক ।
বুদ্ধিমতী মহিলা মানসী দেবী ।
সৌম্যকে বললেন , কখন হলো ?
সৌম্য বললো ,বাস একসিডেন্ট!!
বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই রমলা কাকিমা এসে জড়িয়ে ধরলো মানসী দেবীকে ।
সাধারণত এই ধরণের সম্পর্কে স্বামীর অবৈধ প্রেমিকাকে তার স্ত্রীরা গালাগাল দেয় ,খারাপ নজরে দেখে ।এক্ষত্রে তো রমলা কাকিমাকে অত্যন্ত আধুনিক ভাবতে হবে ।
মানসী দেবীর দুচোখে জল ।
রমলা কাকিমা প্রলাপ বকছেন ,তোমাকে ফাঁকি দিয়েছিলাম আমি তাই আজ আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো ও ।
মানসী দেবী কাকিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন ,এই সময় তোমাকে শক্ত থাকতে হবে রমলা ।সুখেন নেই ,তোমাকেই তো দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের বিয়ে দিতে হবে।
সৌম্য শুধু অবাক হয়ে দেখছে ,শুধু সৌম্য নয় ... দুই ভাই এতদিন ধরে যারা ওনাকে অনেক নোংরা কথা বলেছে তারাও হাতের কাছে মানসীদেবীকে পেয়েও সামনে কিছুই বলতে পারছেনা ।
মানসী দেবী সুখেন কাকুর পায়ের কাছে এসে বসলেন ।নিজের আঁচল দিয়ে ওনার পাটা মুছিয়ে দিলেন যেন ।মাথায় ছোঁয়ালেন হাত টা ।
তারপর নিজের হাত থেকে আংটিটা খুলে সুখেন কাকুর পায়ের কাছে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ।
নির্দেশের গলায় বললেন ,চুল্লীতে ভরে দিও না ওকে। ওর ঐ ঘরটায় বড্ড ভয় ছিল ।কাঠের চিতা সাজিয়ে ওকে দাহ করো ।
শেষের দিকে গলাটা ধরে এসেছিলো ওনার ।
হঠাৎ রমলা কাকিমা সুখেন কাকুর উদ্দেশ্যে বললেন ,আজ তুমি চলে গেছো তাই তোমার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙলেও আর তোমার কোনো ক্ষতি হবে না নিশ্চয় ,আজ তোমার সামনেই আমাকে বলতে হবে সবটুকু ।
ত্রিশ বছরের সব গোপন কথা ।
মানসীদেবী বললেন ,থাক না রমলা ।এই অবস্থায় ওসব কথা নাইবা বললে ,তাছাড়া পুরোনো কথা গোপন থাকাই ভালো !
রমলা কাকিমা দুদিকে ঘাড় নেড়ে বললেন ,তুমি আমাকে অনেক দিন চুপ করিয়ে রেখেছো ,দুই ছেলের চোখে ঐ ভগবানের মত মানুষটার জন্য শুধুই ঘৃণা দেখেছি তবুও শুধু তোমার আর ওনার কথা শুনে আমি ছেলেদের কাছ থেকে সবটুকু আড়াল করেছি ।আজ বলতে দাও ।
পাড়ার প্রচুর লোক জমে গেছে ।মৃতদেহের চরিত্রএর সদগুন বদগুন শোনার লোকের অভাব নেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই যে মানুষটা ছাইভস্মে পরিণত হয়ে যাবে তাকেও সমাজের কাছে নিজের চরিত্রের দোষ স্খলন করে যেতে হচ্ছে ।
খুব ধীরে ধীরে রমলা কাকিমা বলতে শুরু করেছেন ।
যেন স্মৃতির একেকটি পাতার ধুলো ঝাড়ছেন সযত্নে ।
চোখদুটো মাঝে মাঝেই বন্ধ করে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখে নিচ্ছেন ত্রিশ বছর আগের বৃষ্টি ভেজা এক সন্ধ্যেকে ।
রেল লাইন ধরে পাগলের মত ছুটছে রমলা ।
কোলে একটা বছর দুয়েকের ছেলে আর পেটে আট মাসের সন্তান । তিনজনেরই মৃত্যু কাম্য । স্বামীর মারধোর সহ্য করাটা তখন রমলার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো ।কিন্তু নিজের গর্ভবতী স্ত্রীর ঘরে পরপুরুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো রমলার স্বামী ।
ওর ব্যবসার উন্নতির জন্য ।আর সহ্য করতে পারেনি রমলা ,সন্তানদের নিয়েই তাই মৃত্যু চেয়েছিলো সেদিন।
ট্রেনটা আসছিলো ধেয়ে এমন সময় একটা লোক এসে টেনে নিয়েছিল ওদের ।জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলো রমলা আর ওর কোলের সন্তানের ।
সেই রাতে ওকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল মানুষটা ।
কোলে সন্তান নিয়ে গর্ভবতী একজন মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিলো,সুখেনের লুকিয়ে রাখা স্ত্রী আর সন্তান এসেছে ।সুখেনের দাদারা মেনে নেয়নি ওর জন্য পরিবারের বদনাম হোক ।
গৃহ ছাড়া হয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে এনে তুলেছিল ওদের। দুটো দিন যেতে না যেতেই বাড়িওলা লোক ডেকে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয় । সুখেনের কোনো কথাই তখন কেউ শুনতে নারাজ ।
বিয়ের কদিনের মধ্যেই রমলা জানতে পারে সুখেন আর মানসীর কলেজ লাইফ থেকে প্রেমের কথা ,ওদের আংটি বদলের কথা ।মানসীর দিদির বিয়ে হয়ে গেলেই ওদের বিয়ে হবার কথা ছিলো ।
সেদিন থেকে মানসীর কাছে অপরাধী হয়েছে রমলা ।সুখেন অনেক বুঝিয়েছে মানসীকে ,সংসার পাততে বলেছে অন্য কোথাও ।কিন্তু মানসীর এতটাই জেদ যে কোনোভাবেই বিয়ে করেনি ।দাদাদের সংসার থেকে চলে এসে ঘর ভাড়া করে কাটিয়ে দিলো জীবনটা ।শুধু সুখেনকে ভালোবেসে ।
সজলের জন্মের পর রমলা চলে যেতে চেয়েছিলো অন্য কোথাও ।মানসীই জোর করে যেতে দেয়নি ওকে ।দুই সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরতে দেয় নি রমলাকে ।তাই কোনো রকম শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াই ও আর সুখেন স্বামী -স্ত্রীর জীবন কাটিয়েছে দিনের পর দিন । সুখেন বলেছিলো ,দুটো ছোট্ট ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুর চোখে নাইবা তাদের আসল বাবার পরিচয়টা প্রকট হলো !! আমিই ওদের বাবা । প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল রমলা ,কোনোদিন সজল আর উজ্জ্বল জানবে না ওদের আসল বাবার পরিচয় ।
ওদের জন্মদাতা তার কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন বিয়ে করে সংসার বসিয়েছিল ,সে খবরও রমলার কানে এসেছিলো ।
মানসী প্রতি পুজোয় সজল আর উজ্জলের জন্য জামা কিনে পাঠাতো সুখেনের হাত দিয়ে ।বলতো ওদের বলো ,ওদের মাসীমনি পাঠিয়েছে ।
শব যাত্রীরা এগিয়ে চলেছে ,দুই দিকে দুই ছেলের কাঁধে চড়ে চলছে মান-অপমানের ঊর্ধ্বে থাকা একজন মানুষ ।যার পরিচয় ছিল সজল-উজ্জলের বাবা ।
এই প্রথম দুই ভাইয়ের চোখের জলে ভাসতে ভাসতে তাদের বাবা চলছে মহাপ্রস্থানের পথে। পালিত পিতার ঋণ হয়তো তারা এ জীবনে শোধ করতেও পারবে না ।
পিছনে দুজন মহিয়সী মহিলা ...একজন তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছে সারাজীবন, আরেকজন মানবরূপী ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করে গেছেন। সৌম্য সুখেন কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল ...একটা পরিতৃপ্তির হাসি যেন বিরাজ করছে গোটা মুখ জুড়ে ।নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে খুশি করার গর্বেই হয়তো এই তৃপ্তি।
লেখিকা অর্পিতা সরকার
আমি কারুর গল্প নিজের নামে চালাই না ! লেখক বা লেখিকাকে সম্মান দিতে জানি !