22-11-2021, 12:36 PM
ঝুমুর ভাবতেও পারেনি, গল্পের দ্বিতীয়ার্ধ এত দ্রুত তার সামনে এসে যাবে। জীবন মাঝে মাঝে এমন সব সমাপতন সাজিয়ে দেয় যে কল্পনাও হার মেনে যায়।
মাসখানেক পরের কথা।
সন্ধেবেলা ঝুমুর টিভি দেখছিল, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “মা, মা, এই দেখো, কাল সন্ধেয় টিভিতে আন্তরিক বসুর ইন্টারভিউ। এই প্রথম উনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন।”
শুনে ভ্রমর বলেন, “বাঃ, তা হলে তো ভালই হয়, এই যে উনি ওঁর সমস্ত বই হৃদয়বতী নামের কোনও এক জনকে উৎসর্গ করেন, তার কারণটাও হয়তো জানা যাবে।”
আন্তরিক বসুর সমস্ত বইয়ের ভেতরে উৎসর্গপত্রে লেখা থাকে ‘হৃদয়বতীকে’। উনি কি হৃদয়বতীকে নিয়ে সত্যিই কিছু বলবেন? আচ্ছা, কে ইনি? হৃদয়বতী দেখতে কেমন? তিনি ওঁর কে হন?
পরের দিন সন্ধে হতে না হতেই মা, মেয়ে টিভির সামনে বসে পড়ল। ঝুমুর দেখল, মাকে যেন একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
যথাসময়ে দেখা গেল, আন্তরিক আর এই সময়ের ছোট পর্দার জনপ্রিয় নায়িকা শাওন মুখোমুখি বসে। ফেডেড জিনসের উপর একটা আকাশি পাঞ্জাবি পরেছে আন্তরিক।
শাওন শুরু করে, “আন্তরিকদা, চ্যানেল থেকে যখন আমায় এই ইন্টারভিউটা নিতে বলা হল, আমি আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট শুটিং ক্যানসেল করে দিয়েছি। অনেকের মতো আমিও আপনার বিগ ফ্যান।”
“ধন্যবাদ শাওন, তোমাদের মতো যারা আমার লেখা পছন্দ করে, তাদের কাছে আমি গভীর ভাবে কৃতজ্ঞ,” মৃদু হেসে বলে আন্তরিক।
“আন্তরিকদা, আজ আমি কিছুই আপনাকে জিজ্ঞেস করব না। এই প্রথম আপনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন, আপনিই শুরু করুন...”
“শাওন, তোমরা দেখেছ যে, আমার প্রত্যেকটা বই আমি ‘হৃদয়বতী’কে উৎসর্গ করি। এটা নিয়ে পাঠকদের মনে প্রচণ্ড কৌতূহল। মনে হল এ বার সব কিছু সকলকে পরিষ্কার করে বলা দরকার। হৃদয়বতী কে, সেটা আমারও জানা নেই। আমিও তাকে খুঁজি। সে কিন্তু কাল্পনিক চরিত্র নয়, বাস্তবের এক ফ্রক করা কিশোরী। আমার জন্ম হৃদয়পুর নামের এক মফস্সলে। গল্পের বই পড়ার নেশা আমার চিরকালের। আর সেই কারণেই ওখানকার পাবলিক লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছিলাম। যে রাস্তা দিয়ে রোজ বিকেলে লাইব্রেরি যেতাম, সেই রাস্তার পাশেই শিশিরকুঞ্জ নামে একটি বাড়ি ছিল, সেই বাড়ির ব্যালকনিতেই...”
ঝুমুর দেখল, হঠাৎ করেই মায়ের মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কপালে একটু একটু ঘাম জমেছে। শক্ত করে মায়ের হাত দুটো চেপে ধরল ঝুমুর।
আন্তরিক বলে চলে, “সেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকত ফ্রক পরা এক কিশোরী। প্রথম যে দিন আমি ওকে দেখি, আমার চোখে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। আমি তখন ক্লাস টুয়েলভ। খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম। কোনও দিন মুখ ফুটে তাকে কিছু বলতে পারিনি। টানা দু’বছর ওই রাস্তা দিয়ে আমি গেছি। এক পলকের একটু দেখাই আমার সারা দিনের এনার্জি বাড়িয়ে দিত। বারো ক্লাসের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন পরই বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। দাদু-দিদিমাকে, আমাকে আর মাকে তাঁদের কাছে নিয়ে গেলেন। আমাদের হৃদয়পুরের বাড়িটা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রইল। কলকাতায় এসে মা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে প্রায় মাসছয়েক আমি আর হৃদয়পুরে যেতে পারিনি। যখন সেখানে ফিরে গেলাম, তখন শূন্য ব্যালকনি। প্রথম কয়েক দিন বুঝতে পারিনি, ভেবেছিলাম শরীর খারাপ বা কোথাও ঘুরতে গেছে। তার পর খবর নিয়ে জানলাম, ওরা আর এখানে থাকে না। ওকে আর ওই ব্যালকনিটায় দেখতে পাব না এই চিন্তাটা যখন আমার মাথায় ঢুকে গেল, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল যে দিন দেখলাম, ওই বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে। ব্যালকনিটাও আর রইল না।
“ওই দিকে কোথাও গেলে এখনও আমি গাড়িটাকে ওই রাস্তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাই। খুব মিস করি ব্যালকনিটাকে, এক ধরনের বিষণ্ণতা এত বছর বাদেও গ্রাস করে আমাকে।
“এত বছর তাকে দেখিনি ঠিকই, কিন্তু মনে তার একটা জায়গা রয়ে গেছে। অনেকের কাছে ছেলেমানুষি মনে হতে পারে। এত দিনে সে হয়তো কোনও জমজমাট সংসারের অলরাউন্ডার গিন্নি, বা বড় চাকরি করছে। কিন্তু মনে হয়, এক বার অন্তত তার সঙ্গে দেখা হলে খুব ভাল হত। তার নামটা মনে মনে ‘হৃদয়বতী’ রেখেছিলাম এই কারণেই যে, মনে হয়েছিল তার হৃদয়টা খুব সুন্দর।
“জানি না, হৃদয়বতী বই পড়তে ভালবাসে কি না, কিংবা আজকের এই ইন্টারভিউটা যে আদৌ দেখছে কি না, তবুও আপনাদের চ্যানেলে যদি সে যোগাযোগ করে, তা হলে আমি তার সঙ্গে এক বার দেখা করতে চাই। একটাই তো জীবন, কোনও অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে চলে যেতে চাই না।”
আন্তরিকের গলাটা ধরে এল। শাওনকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল লেখকের আবেগ। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে অনুষ্ঠানকে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল।মাথাটা কেমন ঘুরছিল ভ্রমরের। ঝুমুরের সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনে বিষণ্ণ গলায় শুধু বললেন, “বইয়ে ছবি দেখে প্রথম থেকেই ওকে আমি চিনতে পেরেছিলাম। চেহারা একটু বদলেছে, কিন্তু ওর গভীর সমুদ্রের মতো চোখ দুটো আজও একই রকম।”
মায়ের দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ঝুমুর বলে, “আমি কিন্তু চ্যানেলের ফোন নম্বরটা লিখে রেখেছি মা...”
মাসখানেক পরের কথা।
সন্ধেবেলা ঝুমুর টিভি দেখছিল, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “মা, মা, এই দেখো, কাল সন্ধেয় টিভিতে আন্তরিক বসুর ইন্টারভিউ। এই প্রথম উনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন।”
শুনে ভ্রমর বলেন, “বাঃ, তা হলে তো ভালই হয়, এই যে উনি ওঁর সমস্ত বই হৃদয়বতী নামের কোনও এক জনকে উৎসর্গ করেন, তার কারণটাও হয়তো জানা যাবে।”
আন্তরিক বসুর সমস্ত বইয়ের ভেতরে উৎসর্গপত্রে লেখা থাকে ‘হৃদয়বতীকে’। উনি কি হৃদয়বতীকে নিয়ে সত্যিই কিছু বলবেন? আচ্ছা, কে ইনি? হৃদয়বতী দেখতে কেমন? তিনি ওঁর কে হন?
পরের দিন সন্ধে হতে না হতেই মা, মেয়ে টিভির সামনে বসে পড়ল। ঝুমুর দেখল, মাকে যেন একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
যথাসময়ে দেখা গেল, আন্তরিক আর এই সময়ের ছোট পর্দার জনপ্রিয় নায়িকা শাওন মুখোমুখি বসে। ফেডেড জিনসের উপর একটা আকাশি পাঞ্জাবি পরেছে আন্তরিক।
শাওন শুরু করে, “আন্তরিকদা, চ্যানেল থেকে যখন আমায় এই ইন্টারভিউটা নিতে বলা হল, আমি আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট শুটিং ক্যানসেল করে দিয়েছি। অনেকের মতো আমিও আপনার বিগ ফ্যান।”
“ধন্যবাদ শাওন, তোমাদের মতো যারা আমার লেখা পছন্দ করে, তাদের কাছে আমি গভীর ভাবে কৃতজ্ঞ,” মৃদু হেসে বলে আন্তরিক।
“আন্তরিকদা, আজ আমি কিছুই আপনাকে জিজ্ঞেস করব না। এই প্রথম আপনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন, আপনিই শুরু করুন...”
“শাওন, তোমরা দেখেছ যে, আমার প্রত্যেকটা বই আমি ‘হৃদয়বতী’কে উৎসর্গ করি। এটা নিয়ে পাঠকদের মনে প্রচণ্ড কৌতূহল। মনে হল এ বার সব কিছু সকলকে পরিষ্কার করে বলা দরকার। হৃদয়বতী কে, সেটা আমারও জানা নেই। আমিও তাকে খুঁজি। সে কিন্তু কাল্পনিক চরিত্র নয়, বাস্তবের এক ফ্রক করা কিশোরী। আমার জন্ম হৃদয়পুর নামের এক মফস্সলে। গল্পের বই পড়ার নেশা আমার চিরকালের। আর সেই কারণেই ওখানকার পাবলিক লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছিলাম। যে রাস্তা দিয়ে রোজ বিকেলে লাইব্রেরি যেতাম, সেই রাস্তার পাশেই শিশিরকুঞ্জ নামে একটি বাড়ি ছিল, সেই বাড়ির ব্যালকনিতেই...”
ঝুমুর দেখল, হঠাৎ করেই মায়ের মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কপালে একটু একটু ঘাম জমেছে। শক্ত করে মায়ের হাত দুটো চেপে ধরল ঝুমুর।
আন্তরিক বলে চলে, “সেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকত ফ্রক পরা এক কিশোরী। প্রথম যে দিন আমি ওকে দেখি, আমার চোখে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। আমি তখন ক্লাস টুয়েলভ। খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম। কোনও দিন মুখ ফুটে তাকে কিছু বলতে পারিনি। টানা দু’বছর ওই রাস্তা দিয়ে আমি গেছি। এক পলকের একটু দেখাই আমার সারা দিনের এনার্জি বাড়িয়ে দিত। বারো ক্লাসের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন পরই বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। দাদু-দিদিমাকে, আমাকে আর মাকে তাঁদের কাছে নিয়ে গেলেন। আমাদের হৃদয়পুরের বাড়িটা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রইল। কলকাতায় এসে মা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে প্রায় মাসছয়েক আমি আর হৃদয়পুরে যেতে পারিনি। যখন সেখানে ফিরে গেলাম, তখন শূন্য ব্যালকনি। প্রথম কয়েক দিন বুঝতে পারিনি, ভেবেছিলাম শরীর খারাপ বা কোথাও ঘুরতে গেছে। তার পর খবর নিয়ে জানলাম, ওরা আর এখানে থাকে না। ওকে আর ওই ব্যালকনিটায় দেখতে পাব না এই চিন্তাটা যখন আমার মাথায় ঢুকে গেল, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল যে দিন দেখলাম, ওই বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে। ব্যালকনিটাও আর রইল না।
“ওই দিকে কোথাও গেলে এখনও আমি গাড়িটাকে ওই রাস্তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাই। খুব মিস করি ব্যালকনিটাকে, এক ধরনের বিষণ্ণতা এত বছর বাদেও গ্রাস করে আমাকে।
“এত বছর তাকে দেখিনি ঠিকই, কিন্তু মনে তার একটা জায়গা রয়ে গেছে। অনেকের কাছে ছেলেমানুষি মনে হতে পারে। এত দিনে সে হয়তো কোনও জমজমাট সংসারের অলরাউন্ডার গিন্নি, বা বড় চাকরি করছে। কিন্তু মনে হয়, এক বার অন্তত তার সঙ্গে দেখা হলে খুব ভাল হত। তার নামটা মনে মনে ‘হৃদয়বতী’ রেখেছিলাম এই কারণেই যে, মনে হয়েছিল তার হৃদয়টা খুব সুন্দর।
“জানি না, হৃদয়বতী বই পড়তে ভালবাসে কি না, কিংবা আজকের এই ইন্টারভিউটা যে আদৌ দেখছে কি না, তবুও আপনাদের চ্যানেলে যদি সে যোগাযোগ করে, তা হলে আমি তার সঙ্গে এক বার দেখা করতে চাই। একটাই তো জীবন, কোনও অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে চলে যেতে চাই না।”
আন্তরিকের গলাটা ধরে এল। শাওনকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল লেখকের আবেগ। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে অনুষ্ঠানকে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল।মাথাটা কেমন ঘুরছিল ভ্রমরের। ঝুমুরের সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনে বিষণ্ণ গলায় শুধু বললেন, “বইয়ে ছবি দেখে প্রথম থেকেই ওকে আমি চিনতে পেরেছিলাম। চেহারা একটু বদলেছে, কিন্তু ওর গভীর সমুদ্রের মতো চোখ দুটো আজও একই রকম।”
মায়ের দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ঝুমুর বলে, “আমি কিন্তু চ্যানেলের ফোন নম্বরটা লিখে রেখেছি মা...”