Thread Rating:
  • 106 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) সমাপ্ত :---
মিষ্টি মূহুর্ত 6

সুমি অনেক জোর করেও সুচিকে রাতে কিছু খাওয়াতে পারলো না । সুচি খাবার টেবিলে না আসায় সুচির বাবা বললেন , “ ইচ্ছা হলে খাবে। না হলে খেতে হবে না। পাড়ায় মুখ দেখাবো কিভাবে সেটাই ভাবছি ! „

বাবার রাগ দেখে সুমি কিছু বললো না । বাবার খাওয়া হয়ে গেলে সুমি আর সুমির মা খাবার নিয়ে সুচির ঘরে গেল। সুচি বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে । সোসাইটির পূজা মন্ডপের গান সুচির কানে যাচ্ছে না। চোখ দিয়ে বয়ে চলা নোনা জলে বালিশ ভিজে গেছে। সুমি গিয়ে বোনের পাশে বসে বললো , “ খেয়ে নে । খাবারের উপর রাগ করতে নেই ! „

ভেজা গলায় সুচি বললো , “ আমার খিদে নেই । „

“ খেয়ে নে । যা হওয়ার হয়ে গেছে...

দিদিকে কথা শেষ করতে দেওয়ার আগেই সুচি বললো , “ সব শেষ হয়ে গেছে দি। সব শেষ। „ এর উত্তরে সুমি কিছু বললো না। সুচির মা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুচি বললো , “ চলে যা তুই। আমি খাবো না । „

সুমি আর সুমির মা কথা বাড়াননি। সুমি মশারি খাটিয়ে বললো , “ শাড়িটা পাল্টে নে । „

সুচি কে নিরুত্তর দেখে সুমি লাইট বন্ধ করে দিয়ে খাটে এসে শুয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো , “ দেখ। তুই বড়ো হয়েছিস। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোদের সম্পর্ক কেউ মানবে না। move on কর। জানি খুব কষ্ট হবে। কষ্ট হচ্ছে। তবুও জীবন থেমে থাকে না। সবকিছু পিছনে ফেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়...... সুমি সুচিকে বোঝাতে বোঝাতে ঘুমিয়ে পড়লো। সুমি ঘুমালেও সুচি ঘুমাতে পারলো না।

সারারাত সুচির ঘুম হলো না। একটা শব্দ তার চোখের পাতা এক করতে দেয়নি। শব্দটা হলো মানসিক রুগী । ঘুম না হওয়ার জন্য চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেল। গতকাল যে হলুদ শাড়ি পড়ে ঠাকুর দেখতে গেছিল সেই শাড়ি এখনও পড়নে আছে।

সুমি ঘুম থেকে উঠে দেখলো তার বোন সেইভাবেই পাশ ফিরে শুয়ে আছে। মশারি খুলতে গিয়ে বোনের মুখটা দেখে সুমির বুক শুকিয়ে গেল। একরাতেই চোখ ঢুকে গেছে। চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেছে। কোন যান্ত্রিক মেশিনের মতো চোখের পাতা উপর নীচ হচ্ছে। এই চোখে কোন প্রানের ছোঁয়া নেই। পুরোটাই যান্ত্রিক।

সুমি মশারি খুলে জোর করে বোনকে তুলে বাথরুমে পাঠিয়ে দিল।  সুমি যখন ঠেলতে ঠেলতে তার বোনকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সুমির মনে হচ্ছিল কোন লাশকে সে নিয়ে যাচ্ছে।

সুচি বাথরুমে ঢুকে কয়েক মিনিট চুপচাপ মেঝেতে বসে রইলো। এই এক দুই মিনিট-ই  তার কাছে এক দুই ঘন্টার সমান মনে হলো। তারপর কলের নবের নিচে বালতি বসিয়ে নব ঘুরিয়ে দিল। কল থেকে জল পড়ছে কিন্তু তার শব্দ সুচির কানে পৌঁছাচ্ছে না। বালতি ভর্তি হয়ে গেলে নব ঘুরিয়ে কল বন্ধ করে দিল। দুই মগ জল মাথাতে ঢালতেই সারা রাতের জমে থাকা দুঃখ চোখের জলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো সুচি। কাঁদতে কাঁদতেই অগুনতিবার মগ থেকে জল মাথায় ঢালতে লাগলো।

দুই বালতি জলে স্নান করে একটা টপ আর হাফ প্যান্ট পড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। সব দুঃখ চোখের জলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সুমি একটা গামছা দিয়ে সুচির চুল মুছিয়ে দিল। চুল মোছা হয়ে গেলে সুচি আবার গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লো। কিছুতেই তাকে ব্রেকফাস্ট করানো গেল না। কিন্তু দুপুরে জোর করে কয়েক গাল ভাত খাইয়ে দিলেন তার মা।

এদিকে সকাল হতেই আকাশ সুচিকে মেসেজের পর মেসেজ করে যাচ্ছে। ফোনের পর ফোন করছে কিন্তু বারবার একই কথা ভেসে আসছে , আপনি যে ব্যাক্তির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছেন তার ফোন এখন সুইচড অফ আছে। কিছুক্ষণ পর চেষ্টা করুন। বারবার একই কথা শুনে আকাশ বিরক্ত হয়ে গেল। সুচির সাথে একবার কথা বলার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে উঠলো। আগের মতো হুট করে পাশের ফ্ল্যাটে ঢুকে যাবে তারও উপায় নেই। কোন একটা বাঁধা তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রেখেছে।

সুচি লক্ষ্য করলো বাবা তার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। রাতে খাওয়ার সময় সে লক্ষ্য করলো বাবা তার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। পরের দিন সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সুচি দেখলো সুমি ফোনে কথা বলছে। সঙ্গে সঙ্গে সুচির মনে পড়লো ‘ ফোন ! ওই ঘটনার পর ফোনে তো হাত- ই দেয়নি সে। কোথায় আছে ফোনটা ? ‚ কিছুক্ষণ খোঁজার পর সুচি ফোনটা পেল তার হ্যান্ড ব্যাগের ভিতর। এই ব্যাগটাই কাঁধে ঝুলিয়ে অষ্টমীতে সে ঠাকুর দেখতে গেছিল। ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করার পর ফোনটাকে অন করার চেষ্টা করলো সুচি। কিন্তু ফোনটা অন হলো না। বুঝলো চার্জ শেষ। ফোনটাকে চার্জে বসিয়ে দিল।
ফুল চার্জ হওয়ার পর ফোনটা অন করে দেখলো বৈশাখী চার পাঁচবার মিসড কল করেছে আর কয়েকটা মেসেজ। কিন্তু যেটা সবথেকে বেশি চমকে দিল সেটা হলো আকাশ প্রায় ত্রিশ চল্লিশ বার ফোন করেছে। আর অজস্র মেসেজ। সুচি এখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে সে আকাশের সাথে কথাই বলবে না। তাই সে বৈশাখীর মেসেজ খুলে পড়তে শুরু করলো।

বৈশাখী --- কি হয়েছে রে ? গৌরব কি বলছে এসব ? তুই নাকি শুধু টাকা বুঝিস ! গৌরবের থেকে আকাশের টাকা বেশি। আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। তাই গৌরবকে ফোন করেছিলাম। ও বললো ‘ সেটা তোকেই জিজ্ঞাসা করতে , ।

তারপর টানা কয়েক ঘন্টা রিপ্লাই না পেয়ে বৈশাখী ফোন করেছিল। চিন্তা হচ্ছিল বলে মেসেজ করেছিল --- রিপ্লাই দিচ্ছিস না , ফোন করলে বলছে সুইচড অফ। কি হয়েছে বলতো ?

এইসব দেখে সুচি বৈশাখী কে একটা ফোন করলো। সুচি --- হ্যালো। হ্যাঁ বল !

বৈশাখী --- ফোন ধরছিলি না কেন ? আমার তো চিন্তা হচ্ছিল খুব।

সুচি --- শোন শোন উতলা হোস না। কিছু হয়নি। ফোনের ব্যাটারি.....

সুচিকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বৈশাখী বললো --- ওওও তাই বল। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল জানিস ! ও হ্যাঁ। গৌরব কিসব বলছিল। কি হয়েছে বলতো !

সুচি --- কি হয়েছে সেটা ওকেই জিজ্ঞাসা করছি। দাড়া।

বৈশাখীর গলায় বিস্ময় ঝড়ে পড়লো --- কি হয়েছে সেটা তুই জানিস না ! গৌরব বললো তুই জানিস। তোকেই জিজ্ঞাসা করতে।

সুচি --- বললাম না ব্যাটারী ডেড ছিল। আমি জানি না কিছু। ওকে ফোন করছি দাড়া।

সুচি বৈশাখীর ফোন কেটে দিয়ে গৌরবকে ফোন করলো। খুব রাগী স্বরে সুচি জিজ্ঞাসা করলো --- তুমি বৈশাখীকে কি বলেছো ওসব ?

গৌরব তার থেকেও বেশি রাগ দেখিয়ে বললো ---- রাগ দেখিয়ে কথা বলো না। তোমার মতো মেয়েদের আমি খুব ভালো করে চিনি।

সুচি বজ্রকঠিন গলায় বললো ---- কি উল্টোপাল্টা বলছো এসব ?

গৌরব এবার ব্যাঙ্গ করে বললো ---- বেশি ন্যাকামি করো না। শোন। আমি ওখানে দাড়িয়ে সব দেখেছি। তাই আমার সামনে আর ন্যাকামি মের না। তোমার মতো মেয়েরা শুধু টাকা চেনে। যেই দেখলে আকাশের বাবার কাছে আমাদের থেকে বেশি টাকা আছে ওমনি জিভটা লকলক করে উঠলো......

ফোনটা কেটে দিয়ে অবহেলায় খাটে ছুড়ে দিল সুচি। এতো অপমান কখনো কেউ তাকে করেনি। রাগ হচ্ছে খুব। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। রাগে ঘৃণায় অপমানে চোখে জল চলে এলো সুচির। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার সময় হয়ে এলো। চোখে মুখে জল দিয়ে খেতে বসে সুচি দেখলো আগের দিন রাতের মতোই বাবা তার দিকে তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে কিংবা বাইরের দিকে তাকিয়ে খেয়ে উঠে চলে গেলেন সুচির বাবা। সুচির মনে হলো এখন সবকিছু ভুলে বাবার রাগ ভাঙাতে হবে।

সবকিছু এক লহমায় কেমন পাল্টে গেল। সুস্থ সম্পর্ক আর সুস্থ নেই। বাবার মুখ ফিরিয়ে নেওয়া , গৌরবের কাছে অপমান , আকাশের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা , এতো কিছু সুচির মনটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে লাগলো ঠিক যেমন সমুদ্রের ঢেউ সমুদ্র তীরবর্তী পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে। দুই দিন টানা কয়েকবার চোখের জল ফেলে এখন মনে হয় চোখেও আর জল নেই।

খাটের উপর বসে বসে নিজের দুঃখ কষ্টের তল খুঁজতে খুঁজতে কখন যে অন্ধকার হয়ে এলো সেটা সুচি বুঝতে পারলো না। বাইরে ঢাকের উপর কাঠি পড়ার আওয়াজ হতেই সুচির হুশ ফিরলো। আজ তো বিজয়া দশমী। সবাই নিশ্চয়ই সিঁদুর খেলছে। প্রতিবার সুচিও খেলে । এবার আর খেলার ইচ্ছা নেই। কোন কিছুই করতে আর ইচ্ছা নেই।

এদিকে ঢাকের আওয়াজ শুনে আকাশ নিচে নেমে এলো এই আশায় যে হয়তো সুচি সিঁদুর খেলতে নামবে। কিন্তু আধঘন্টা অপেক্ষা করে চারিদিকে খুঁজে সুচির দেখা পেল না। উদাস মনে আবার উঠে আসতে লাগলো।

ঢাকের আওয়াজ কয়েকবার শুনেই সুচির বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা হলো খুব। সুচি উঠে বাইরে এসে নিচে নামতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর পিছন ফিরে উপরে ছাদে ওঠার সিড়িতে পা দিল। ঠিক সেই সময় আকাশ উপরে উঠে এসে সুচির পিঠ দেখতে পেল। বুঝতে পারলো যে সুচি উপরে উঠছে। সুচিকে দেখেই আকাশের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। এখন তো আর ওরা বন্ধু নয়। এখন ওরা প্রেমিক প্রেমিকা। দুই দিন আগেই সুচি তার ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছে । এখন ছাদে গিয়ে সুচির সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলো খুব। কিন্তু কি দিয়ে শুরু করবে ? কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে ভালোবাসার কথা সত্যি কি না। তারপর নিজেও স্বীকার করবে। এইসব ভাবতে ভাবতে আকাশ ছাদে উঠে এলো।

সুচি ছাদে উঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচের সবার সিঁদুর খেলা দেখতে দেখতে খেয়ালই করতে পারলো না যে আকাশ তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশ চুপচাপ এসে সুচির পাশে দাঁড়িয়ে সিঁদুর খেলা দেখতে লাগলো। কি বলে কথা শুরু করবে সেটাই আকাশ ভেবে পেল না। সুচির সাথে কথা বলার জন্য একদিন তাকে এতো লজ্জা পেতে হবে সেটা আকাশ কখনো ভাবেনি।

আকাশ যখন সুচির পাশে দাঁড়ালো তখন সুচি আকাশকে দেখতে পেলো। আকাশের দিকে না তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিচে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ঘুরে নিচে চলে যেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ সুচির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। এতক্ষণ লজ্জায় কিছু না বলতে পারলেও এখন সুচির হঠাৎ চলে যাওয়া দেখে আকাশ সুচির হাত ধরে কথাটা বলেই ফেললো , “ তুই আমাকে ভালোবাসিস ? „

গম্ভীর দৃঢ়কন্ঠে সুচি বললো , “ না। হাত ছাড় আমার । „

আকাশ সুচির হাত না ছেড়ে বললো , “ আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দে । „

সুচির চোখে আবার জল চলে এলো, “ বললাম তো না। আমার হাত ছাড় । „

আকাশ দৃঢ়কন্ঠে বললো, “ আমার চোখে চোখ রেখে বল । „

কিছুক্ষণ ছাদের মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সুচি পিছন ঘুরে আকাশের দিকে তাকালো। চোখে জল টলটল করছে , “ আমি তোর মতো ছেলেকে ভালোবাসি না। ছাড় আমায় । „ বলে নিজের হাতটাকে জোর করে ছাড়িয়ে নিচে দৌড়ে চলে গেল। চোখের মধ্যে টলটল করতে থাকা অশ্রুবিন্দু হাওয়ায় ভেসে মহাকাশের  কোন উজ্জ্বল তারার মতো চকচক করে উঠলো। নিচে নেমে ঘরে ঢুকে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। শুকিয়ে যাওয়া চোখে আবার বাঁধ ভেঙে জল বেরিয়ে এসে বালিশ ভিজিয়ে দিতে লাগলো ।

সুচির চলে যাওয়ার পর আকাশ চুপচাপ ছাদে দাঁড়িয়ে রইলো। একা ছাদে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো ‘ সুচি যে মিথ্যা কথা বলছে সেটা ওর চোখের জল দেখে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মিথ্যা বললো কেন ? জেঠুর ভয়ে ? ,  নিজেকে প্রশ্ন করে কোন উত্তর খুঁজে পেল না আকাশ । ঠিক কি কারনে এখন অস্বিকার করছে সেটা কথা বলে জিজ্ঞাসা করারও উপায় নেই। সুচি তার ফোন ধরছে না আর মেসেজের উত্তরও দিচ্ছে না। ঘরে ফিরে আকাশ ভাবতে লাগলো কিভাবে সুচির সাথে একাকী কথা বলা যায় ? আগের মতো এখন আর সরাসরি যখন তখন জেঠুর ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারবে না। কোন এক নাম না জানা অদৃশ্য দেওয়াল ওই ফ্ল্যাটে ঢুকতে বাঁধা দিচ্ছে। আকাশ জানে না এই দেওয়াল ঠিক কতোটা শক্তিশালী। আকাশ এটাও জানে না যে এই দেওয়াল কার তৈরি ?

পরের দিন বিকাল বিকাল কৌশিক তার বৃদ্ধা মা কে নিয়ে চলে এলো। বেশ বয়স হয়েছে কৌশিকের মায়ের। তিন তলা সিড়ি ভাঙতেই তার হাটু খুলে যাওয়ার জোগাড়। কৌশিক তার মাকে নিয়ে সুমির ফ্লাটে ঢুকলে খাতির যত্নের কোন ত্রুটি হলো না। সুচি নিজে দিদিকে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে আনলো। কৌশিকের বৃদ্ধা মা সুমিকে দেখে বললেন , “ তোমার কথা ছোটুর কাছে অনেক শুনেছি মা। তোমার ফটোও ছোটুর ফোনে দেখেছি। আমার ছোটুর পছন্দ আছে বলতে হয় । „

এতক্ষণ ধরে সুচির বাবা যে প্রশ্নটা করবো না করবো না করে উশখুশ করছিলেন সেটা করেই ফেললেন , “ আপনারা আর কাউকে নিয়ে আসেন নি ? „

কৌশিকের মা বললেন, “ এই বুড়ির দুঃখের কথা কি আর বলবো  । আমার দুই ছেলে। বড়ো ছেলে কমলেশ চাকরি করতে বিদেশে গেছিল। সেখানেই এক সাদা চামড়ার মেয়েকে বিয়ে করে । আর সে এই মুখো হয়নি। আমার ছোট ছেলে কৌশিক-ই আমার দেখভাল করে। „

কৌশিকের মায়ের কথা শুনে সুমির বাবার মনটা ভরে এলো। কৌশিকের মা সাদা চামড়া কথাটা যে ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বললেন সেটা তিনি বুঝতে পারলেন । ওদিকে কৌশিকের মা বলে চলেছেন , “ আমার খুব শখ ছিল এক মেয়ে হবে। কিন্তু আমার পোড়া কপালে মেয়ের সৌভাগ্য লেখা নেই। তোমার মেয়েকে আমি নিজের মেয়ের মতো রাখবো । তুমি চিন্তা করো না ......

সুমির বাবা পাত্রপক্ষের পরিবার সম্মন্ধে আগেই খোঁজ খবর নিয়েছিলেন। কৌশিকের বাড়ি খিদিরপুরে। মায়ের সাথেই থাকে। কোন বদ অভ্যাস নেই। কৌশিক সুমির মতোই ভদ্র মেধাবী এবং এক শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারী।

কৌশিকের বৃদ্ধা মা দেখলেন যে কৌশিক সুমির দিকে তাকিয়ে আছে। একটু হেসে বললেন, “ তুমি এই বিয়েতে রাজি থাকলে আমি তারিখ বলতে পারি। „

বিয়ের তারিখ শুনে সমরেশ বাবু থতমত খেয়ে গেলেন। কৌশিকের মা বললেন , “ দুই মাস পর একটা ভালো তারিখ আছে। আমি বাড়ি থেকে দেখেই এসছি । „

“ দুই মাস পর ! এত তাড়াতাড়ি ! আমাদের আয়োজন করতেই তো অনেক সময় লাগবে ! „

“ আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সুমি কে আমার মেয়ে করে নিয়ে যেতে চাই। না করো না ! „

কৌশিকের মা এইভাবে রিকোয়েস্ট করায় সুচির বাবা একটু হেসে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সুচির মা এমন ভাব করলো যেন স্বামীর সিদ্ধান্তোই তার সিদ্ধান্ত। স্ত্রীর সম্মতি দেখে সুমির বাবা রাজি হয়ে গেলেন।

বিয়ের পাকা কথা বলে কৌশিকের মা আর কৌশিক চলে গেল। কৌশিকের মাকে ছাড়তে সোসাইটির গেট পর্যন্ত সুমির বাবা গেলেন।

সুমি ঘরে আসতেই সুচি দিদিকে জড়িয়ে ধরলো। এই দুঃখ কষ্টের মধ্যে একমাত্র দিদিই তার পাশে আছে। এখন সেও চলে যাবে দুই মাস পর। সুমি সেটা বুঝতে পেরে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ শোন। আমাকে কিন্তু তোকেই সাজিয়ে দিতে হবে। „

“ আমি তো কখনো কণে সাজে কাউকে সাজাইনি ......

বোনের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বললো , “ আমি চাই তুই সুখে থাক । „ তারপর মেকআপের দিকে তাকিয়ে বললো , “ দু দিনেই এগুলোতে ধুলো পড়তে শুরু করেছে। আমি বুঝি তোর কষ্ট । আমাকে তুই যেভাবেই সাজাবি আমি সে ভাবেই বিয়ে করবো । „

নাছোড়বান্দা দিদির কথা শুনে সুচি বললো , “ কিন্তু আমার কাছে অনেক জিনিস নেই। ফাউন্ডেশন নেই। তোর স্কিন ম্যাচ করে এমন মেকআপ ও নেই ! „

“ কতো লাগবে কিনতে ? „

“ আমি ঠিক জানিনা। তবে পনের কুড়ি হাজারের মধ্যে সব এসে যাবে । „ সঙ্গে সঙ্গে সুমি আলমারি খুলে গুনে গুনে কুড়ি হাজার টাকা বার করে দিল।

বিয়ে হবে ডিসেম্বরে। মোটামুটি দুই মাস সময় আছে হাতে। বিয়ের খবর পেতেই সুমির মামাতো ভাইবোন , মামা মামি চলে এলো সাহায্য করতে। আকাশ যে একটু নিরিবিলি দেখে সুচি কে একটা কোনায় টেনে নিয়ে গিয়ে কথা বলবে সেটা আরও কঠিন হয়ে উঠলো। সব সময় কেউ না কেউ ওই বাড়িতে আছে। সুচির মামাতো ভাইবোন আকাশকে চেনে। সুচির সাথে অনেকবার কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু এখন যে কথা আকাশ বলতে চায় সেটা কারোর সামনেই বলা যায় না।

আত্মীয়দের মাঝে থেকে বিভিন্ন কেনাকাটা করতে করতে সুচির একাকিত্ব কাটলো। কিন্তু অনুষ্ঠান বাড়ির কোন উৎসাহ সুচির মনে দেখা দিল না। এই দুই মাস আকাশের অবস্থা জলহীন মাছের মতো হয়ে দাড়ালো। বারবার মেসেজ করছে কিন্তু কোন উত্তর নেই। সুচি যখন কেনাকাটা করতে যায় তখন আকাশ তাকিয়ে থাকে। যতোই আকাশের সাথে কথা না বলার এমনকি আকাশের দিকে না তাকানোর সিদ্ধান্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হোক ! সুচিও আড়চোখে আকাশকে দেখা থেকে আটকাতে পারে না।

আগে সুচির বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে সবার প্রথম সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতেন আকাশের মা। কিন্তু এবার তিনি কোন সাহায্য-ই করতে পারলেন না। আকাশের মা ভাবলেন ‘ সাহায্য করলে যদি আকাশের বাবা রেগে যায় ! ‚ ।

এদিকে আকাশের মায়ের কাছ থেকে কোন রকম সাহায্য না পেয়ে সুচেতা দেবী ভাবলেন ‘ আকাশকে মারার জন্য আকাশের মা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ‚

নেমন্তন্ন করার সময় সুচির বাবা প্রথম আকাশের পরিবারকে দিয়েই আমন্ত্রণ করা শুরু করলেন। বিয়েতে বেশি কাউকে আমন্ত্রণ করা গেল না। কারন সুচির বাবার তিন কূলে কেউ নেই। সুচির মায়ের তিন ভাই ছাড়া আর আপন কেউ নেই। আর কৌশিকের প্রতিবেশী ছাড়া কেউ নেই। তাই বিয়েতে দুশোর বেশি লোক হলো না। সুমি আগে থেকে বলে রেখেছিল সুচিই তাকে কণে সাজে সাজাবে। বিয়ের দিন সুচিই তার দিদিকে সাজিয়ে দিল।

বিয়েতে সুচি একটা নীল লেহেঙ্গা , নীল ব্লাউজ আর একটা ওড়না পড়লো। এই প্রথম আকাশ সুচির থেকে চোখ ফেরাতে পারলো না। এতো সুন্দর কখনো লাগেনি। হয়তো এখন দৃষ্টি আলাদা। সুচি যখন বন্ধু ছিল তখন বন্ধুর দৃষ্টি আর এখন প্রেয়সী হয়ে ওঠায় প্রেমিকার দৃষ্টি। দুটোর পার্থক্য খুব ভালো ভাবে বুঝলো আকাশ।

বিয়ে হচ্ছে সোসাইটির কমিউনিটি হলে । বিয়ের সাজে সেজে উঠেছে সোসাইটি। বিয়ের সময় নেমন্তন্নের সবাই এলো শুধু আকাশের বাবা বাদে। লোকজন যখন গিফ্টের বাক্স দিচ্ছিল তখন সুচেতা দেবী সুচিকে বললেন , “ এখানে এগুলো রাখা ঠিক না। তুই ঘরে গিয়ে রেখে দিয়ে আয়। „

সুচি কয়েকটা গিফ্টের বাক্স নিয়ে নিল। আকাশ ঠিক এই সুযোগটাই খুঁজছিল। এখন সুচির বাড়িতে কেউ নেই ভেবে নিয়ে সেও তিনটে বাক্স হাতে নিয়ে সুচির পিছন পিছন চলে এলো। সুচির ঠিক পিছনে সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আকাশ জিজ্ঞাসা করলো , “ তুই মিথ্যা কথা কেন বলছিস ? „

সুচি আকাশের গলা শুনেই দুদ্দাড় করে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলো। আকাশও সঙ্গে সঙ্গে উপরে এলো। আকাশ ভেবেছিল ঘরে কেউ নেই। কিন্তু লিভিংরুমে বসে কয়েকজন গল্প করছে। সুচি নিজের ঘরে খাটে গিয়ে গিফ্ট গুলো রাখতেই আকাশ এসে খাটে গিফ্ট গুলো রেখে দিল। সুচি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই আকাশ দরজার সামনে গিয়ে সুচিকে ঘরের বাইরে যেতে বাধা দিল। সুচি বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আকাশ এগিয়ে আসতে লাগলো সুচির দিকে , “ তুই মিথ্যা কেন বলছিস ? জেঠু কিছু বলেছে ? „

মুখটা পাথরের মতো শক্ত করে সুচি বললো , “ আমার কাছে আসবি না। আর কাছে আসার চেষ্টা করিস না.....

সুচির কথা শুনে আকাশের গলার স্বর কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল “ এখন কেন ধরা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিস ? „

“ আজেবাজে কথা বলিস না। সরে যা সামনে থেকে । „

“ দুই মাস তোর সাথে কথা বলতে না পেরে আমার কি অবস্থা হয়েছে জানিস তুই ? একবার তোর দেখা পাওয়ার জন্য কতো কষ্ট পেয়েছি জানিস তুই ? „

আকাশের কষ্ট হচ্ছে শুনে সুচির চোখটা ভিজে গেল। অশ্রুসিক্ত চোখে বললো , “ প্লিজ সরে যা। আমার আর কাছে আসিস না । „

এর উত্তরে আকাশ কিছু বলার আগেই সুচির ফোনে কেউ একজন ফোন করলো। ফোনটা ধরেই সুচি বললো , “ হ্যাঁ আসছি আমি। „ বলে আকাশকে ঢেলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল । আকাশ সুচির চোখে জল দেখে বুঝতে পারলো সেও কষ্ট পাচ্ছে। কোন একটা কারনে সে মিথ্যা কথা বলছে।

সুচি নিচে কমিউনিটি হলে চলে এলো। বিয়ে হয়েই গেছিল। এখন বিদায় পর্ব। সব হয়ে গেছে। পিছন ফিরে সুচেতা দেবীর আঁচলে চাল ঢেলে তোমার সব ঋণ শোধ করে দিলাম মা ।  সেটাও বলা হয়ে গেছে । সুমির বিদায় নেওয়ার সময় সমরেশ বাবুর চোখে জল চলে এলো। এইতো সেদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় সুমি ঘুমন্ত বাবার পেটের উপর উঠে বলতো “ বাবা আমাকে কলেজে নিয়ে যাবে না। ওঠো। „ এই তো সেদিন কলেজে নিয়ে যাওয়ার সময় এই সোসাইটির বাইরে বার হলেই সুমি আবদার করতো “ বাবা কোলে নাও। পা ব্যাথা করছে । „

এইসব চোখের সামনে দেখতে পেয়ে সুমির বাবার চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। অনেক কষ্টে চোখের জল আবার চোখের ভিতরে পাঠিয়ে দিলেন। বাবাকে কাঁদতে দেখলে যে সুমি আরও কাঁদবে। বিয়ের সাজে সোসাইটি আলোকিত হলেও সোসাইটির কিছু জায়গায় এখনও অন্ধকার হয়ে আছে। ঠিক সেইরকম একটা অন্ধকার বেছে নিয়ে সেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে একটা লম্বা ছায়ামূর্তি অনেকক্ষন ধরে সুমির বিদায় দেখছিল। চোখের জলে সবাইকে ভাসিয়ে দিয়ে যখন সুমি চলে যাচ্ছে তখন সেই ছায়ামূর্তি সুমিকে প্রান ভরে আশীর্বাদ করলো , “ সুখে থাক । „

গাড়িতে ওঠার আগে বোনকে জড়িয়ে ধরে সুমি বললো , “ বাবা মায়ের খেয়াল রাখিস। পড়াশোনা করবি ঠিক মতো। আমি ফোন করবো। „  কথা গুলো শুনতে শুনতে সুচি আরো ডুকরে কেঁদে ফেললো।

বিয়ে হয়ে গেছে দুই দিন হলো। সুমির অনুপস্থিতি এখন সুচিকে অনেক কষ্ট দেয়। সুচির ঘরের চার দেওয়াল সুমির স্পর্শ চায় কিন্তু পায় না। সুমির মা বাবা এখন আগের থেকে অনেক শান্ত হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন চার জনের জায়গায় তিন জনের জন্য চাল হাড়িতে দেওয়া হয়। কিন্তু দু বার সুচেতা দেবী ভুল করে চার জনের চাল হাড়িতে দিয়ে ফুটিয়ে দিলেন। ভাত দেখে যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন তখন চোখের জল আর বাঁধ মানে না। সুমির বাবা একটা কাজের জন্য ভুল করে সুমি বলে ডেকে বসলেন। সুমির জায়গায় যখন সুচি বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরে এলো তখন সমরেশ বাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরে বুকে একটা ব্যাথা অনুভব করলেন। সুমি মাঝেমাঝেই ফোন করে নিজের সুখে থাকার কথা জানান দিচ্ছে। এতেই সুমির মা বাবা সুখী।

বিয়ের দিন দুই পরেও সুচি কলেজ গেল না। আকাশ ভেবেছিল বিয়ে হয়ে গেছে তাই সুচি এবার নিয়মিত কলেজ যাবে। কিন্তু কলেজ গিয়ে সুচির দেখা না পেয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি আসতে আসতে অন্ধকার হয়ে এলো। বাড়ি ফিরেই আকাশ আর থাকতে না পেরে সুচিকে ফোন করতে শুরু করলো। সুচি সোফায় বসে মায়ের সাথে গল্প করছিল। আকাশের ফোন দেখে বারবার কেটে দিচ্ছিল। আরও কয়েকবার ফোন করার পর সুচির মা বললেন , “ কার ফোন ? „

“ কলেজের এক বন্ধুর । „

“ ফোনটা ধর। দরকারী কথা থাকতে পারে তো। অনেক দিন কলেজ যাচ্ছিস না . ....

মায়ের কথাতেও সুচি ফোন ফরলো না। আরও দশ এগারো বার ফোন করার পর সুচি ফোনটা ধরতেই আকাশ বললো , “ একবার ছাদে আয় । কথা আছে । „

প্রায় আট নয় মিনিট উশখুশ করার পর কোনো এক তীব্র আকর্ষণে সুচি উপরে ছাদে উঠে এলো । কালো আকাশে তারার মিটমিটে আলো আর বাকা চাঁদের উপস্থিতি সুচির মনটাকে আরও বেশি কোমল দূর্বল করে তুললো। আকাশ আগে থেকে আকাশের দিকে উদাস মনে তাকিয়ে তারার ঝিকমিক আলো উপভোগ করছিল। সুচি এসে দাঁড়াতে আকাশের হুশ ফিরলো। সুচি কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করলো , “ কি বলবি বল ? „

আকাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ আমি শুধু একটা কথা জানতে চাই। তুই এখন কেন অস্বীকার করছিস ? নিজে কষ্ট পাচ্ছিস আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছিস । আমি আর পারছি না থাকতে ! „

কর্কশ স্বর বজায় রেখে সুচি বললো, “ অস্বীকার করার মত কিছু নেই আকাশ। আমি আগেও বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি না। „

আকাশ রেগে গিয়ে বললো, “ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল । „

মনটাকে শক্ত করে আকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে সুচি বললো , “ আমি তোকে ভালোবাসি না কতবার বলবো । „

আকাশ এবার কাছে এসে সুচির হাতের মুঠো নিজের হাতের তালুর মধ্যে বন্দি করে বললো , “ সে তোর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুই সত্যি বলছিস কি মিথ্যা বলছিস ......

“ ছাড় আমায় । „ বলে সঙ্গে সঙ্গে সুচি আকাশের হাতের মধ্যে থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।

সুচির কাছ থেকে বাধা পেয়ে আকাশের জেদ চেপে গেল। সুচিকে এবার কোমড়ের পিছন দিয়ে বেড় দিয়ে , সুচির শরীরকে কাছে টেনে নিয়ে , মাথাটাকে একটু ঝুকিয়ে সুচির ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিল। জীবনের প্রথম চুম্বন এইভাবে হবে সেটা কেউ ভাবে নি। প্রথম চুমু হয় ভালোবাসার মানুষের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মানের ফল। কিন্তু এখানে এদের প্রথম চুম্বন হলো আকাশের জেদের ফল।

প্রথমে একটু বাঁধা দিলেও আকাশের পুরু ঠোঁট নিজের কোমল পেলব ঠোঁটের মধ্যে অনুভব করতে পেরে সুচি আকাশের বাহুপাশে বন্দী হয়ে গেল। প্রেমিকের চওড়া কঠিন বুকে নিজেকে সঁপে দিল । দুই হাত দিয়ে আকাশের মাথাটাকে ধরে তার প্রেমিকের শুষ্ক ওষ্ঠ্য নিজের মুখের ভিতর নিয়ে খেলতে লাগলো। সবকিছু ভুলে গেল সুচি। প্রথম চুম্বন তাদের সামাজিক মানসিক অবস্থা ভুলিয়ে দিল।

সুচির কাছ থেকে বাঁধা না পেয়ে আকাশ সুচির শরীরটাকে এক হাতে পালকের মতো তুলে নিল । আর একহাতে সুচির মাথার পিছনে হাত দিয়ে প্রেয়সীর মাখনের মতো সরু ওষ্ঠ্যদ্বয় নিজের মুখের ভিতর অনুভব করতে লাগলো। এখন সুচির পা মাটিতে নেই। সুচির মনে হলো সে সুখের স্বর্গে ভাসতে ভাসতে তার প্রেমিকের ওষ্ঠ্য নিজের মুখে নিয়ে আছে। আকাশের মনে হলো সুচির ঠোঁট ওর মুখের মধ্যে মাখনের মতো গলে যাবে। দুজনের বুকে দামামা বাজতে শুরু করলো। এতো ভালো কখনো লাগেনি দুজনের।

দীর্ঘ চুম্বনের পর যখন আকাশ সুচিকে ছাড়লো তখন সুচি একদৃষ্টিতে আকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁট কাঁপছে সুচির । কিছুক্ষণ তাকিয়ে আকাশের দিকে থাকার পরেই সুচির চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো । ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছাদে বসে পড়লো। সুচিকে এইভাবে কাঁদতে দেখে আকাশও মেঝেতে বসে পড়লো , “ কি হয়েছে ? কাঁদছিস কেন ? „

প্রথম চুম্বনের স্বাদ পেয়ে সুচি এতোটাই কোমল আর দূর্বল হয়ে উঠলো যে , এতদিন যেকথাটা তাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছে সেই কথাটা সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললো , “ আমি একজন মানসিক রোগী আকাশ। আমি শুধু তোর ক্ষতি করেছি.....

আকাশ সুচির কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না , “ কি বলছিস এসব। কে বলেছে তোকে তুই মানসিক রোগী ? „

চোখের জলে দুই গাল ভাসিয়ে সুচি বললো, “ যেই বলুক ।  কিন্তু এটাই সত্যি। আমি তোকে মারি। তোর উপর অত্যাচার করি .......

সুচির কথার রেশ ধরে আকাশ বললো, “ তুই যেমন তেমন-ই আমি তোকে ভালোবাসি। আমি চাই তুই আমাকে শাসন কর। চড় মার। আমি তোর ফিলিংস বুঝতে পারি নি। মার আমায় .......

এর আগে কখনো সুচি নিজেকে এতোটা দুর্বল অনুভব করেনি  , “ আমি পারছি না আকাশ । আমি আর পারছি না । চলে যা তুই। „

সুচির কোমল মুখটা দুই হাতের তালুতে বন্দি করে বুড়ো আঙুল দিয়ে সুচির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো, “ কি হয়েছে সেটাতো বল ? কি জন্য তুই এখন আমাকে দুরে সরে যেতে বলছিস ? „

“ আমাদের সম্পর্ক কেউ মানবে না। না আমার মা বাবা মানবে , না কাকা কাকি মানবে । প্লিজ তুই চলে যা। আমার কাছে আর আসিস না। প্লিজ ........

এতদিন পর আকাশ জানতে পারলো কেন সুচি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এখন যখন সে কারনটা জানতে পারলো তখন কি বলবে সেটাই ভেবে পেল না, “ তাহলে চল কোথাও চলে যাই। তুই সাবালক আর আমিও কয়েকমাস পরেই সাবালক হয়ে যাবো। তখন কেউ কিছু করতে পারবে না .......

“ প্লিজ এমন কথা বলিস না। আমি কাকিকে কষ্ট দিতে পারবো না । „

আকাশ নিজে যা বলছে সেটা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এখন এই দুই মাসের বিচ্ছেদের কষ্ট তাকে পাগল করে তুলেছে , “ আর তুই নিজে যে কষ্ট পাচ্ছিস সেটা কে দেখছে ? আমি যে কষ্ট পাচ্ছি সেটা কে দেখছে ? „

যতোই আকাশ সুচির চোখের জল মুছিয়ে দিক, সুচির চোখের জল এখন বাঁধ মানছে না, “ আমি পারবো না আকাশ। আমি পারবো না। „

“ নিজের কষ্টটা বোঝ। একবার শুধু বল। দূরে কোথাও চলে যাই । „

“ ছেলেমানুষি করিস না আকাশ। আমি মা বাবা কাকা কাকির মাথা নিচু করতে পারবো না । বোঝার চেষ্টা কর ......

কিছুক্ষণ চুপ থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর সুচির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আকাশ বললো , “ তোর কাছে তোর কষ্টের কোন দাম নেই ! আমার কষ্টেরও কোন দাম নেই ? „

“ ওরা আমাদের জন্ম দিয়েছে। ছোট থেকে কতো কষ্ট করে , কতো ত্যাগ করে বড়ো করেছে। পড়িয়েছে খাইয়েছে । আমাদের সব শখ পূরণ করেছে। ওরা আমাদের মা বাবা । আমি কিভাবে ওদের মাথা নিচু করবো ! আমরা পালিয়ে গেলে ওরা মুখ দেখাতে পারবে না . ....

ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে সেটা ভেবেই আকাশের চোখ কপাল নাক  ব্যাথায় কুঁচকে গেল “ ঠিক আছে। সারা জীবন তোর কথাই শেষ কথা হয়েছে। এখনও তাই হবে। আমি অপেক্ষা করবো তোর হ্যাঁয়ের। যদিন বলবি সেদিনকেই তোকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। „ বলে আকাশ উঠে দাড়ালো।

আকাশের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে সুচি ছাদ থেকে নামতে শুরু করলো। আকাশ তখন সুচির পিঠ দেখে বলে যাচ্ছে , “ আমি জানি তুই থাকতে পারবি না। একদিন তুই নিজে এসে বলবি ‘ আমাকে নিয়ে চল আমি আর পারছি না। , আমি অপেক্ষা করছি সেদিনের......

সুচি আর কিছু শুনতে পারলো না। দুদ্দাড় করে সিড়ি ভেঙে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। ঘরে ঢুকে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানার চাদর চোখের জলে ভিজে লাগলো।

আকাশ ছাদ থেকে নেমে এসে নিজের ঘরের খাটে এসে শুয়ে অতীতের সুবর্ণ দিন গুলোর কথা মনে করতে লাগলো। বর্তমান ওকে কষ্ট দিচ্ছে কিন্তু অতীত তাকে ব্যাথা দিতে শুরু করলো। যদি তখন জানতাম যে এরকম একটা দিন আসবে তাহলে সুচিকে আকড়ে ধরে রাখতাম। কি সুন্দর ছিল সেইদিন গুলো, এক সাথে সিনেমা দেখা, হাতে হাত ধরে কলেজে যাওয়া, অকারনে ঝগড়া মারপিট করা , একসাথে মেলায় যাওয়া।

নিজের মনে হেসে নিয়ে আকাশ ভাবলো মেলায় গিয়ে একসাথে নাগরদোলনা চড়ার সময় সুচি ওকে কিভাবে জড়িয়ে ধরেছিল। নিজের ঠোঁটে সদ্য সুচির নরম কোমল ঠোঁটের স্পর্শ আর সেদিনের জড়িয়ে ধরা মিলে মিশে আকাশকে  এক তীব্র যন্ত্রনার অনুভূতি দিল।

হ্যাঁ মেলায় গিয়ে তো সুচি তাকে একটা আংটি পছন্দ করে দিয়েছিল। পর্ণ দেখতে গিয়ে ধরা পড়ায় রাগে আংটিটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে খাট থেকে উঠে বসলো। নিজের মনেই বললো ‘ না আমি ফেলি নি। পরে আলমারির কোথাও একটা রেখেছিলাম। ,

কথাটা মনে পড়তেই আকাশ আলমারি খুলে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো। সব জামা কাপড় লেপ কম্বল খাটে বিছিয়ে দিল। আলমারি লন্ডভন্ড করার পর একটা কোনায় সে আংটিটা পেল।

আংটিটা পেয়ে আকাশের মনে হলো যেন সে পুরানো হারিয়ে যাওয়া প্রেম খুঁজে পেয়ে গেছে। আংটিটা সোনার নয়। স্টিলের উপর সোনালী রঙ করা। এখন সেই রঙ অনেক উঠে গেছে। কিন্তু আবছা বোঝা যাচ্ছে যে আংটিটা সোনালী রঙের ছিল। আংটিটা হাতে নিয়ে লেপ কম্বল জামা প্যান্ট বিছানো খাটের উপর বসলো। আংটিটা তার ডান হাতের অনামিকাতে গলানোর চেষ্টা করলো। হলো না। আঙুল মোটা আর বড়ো হয়ে গেছে। অনামিকাতে ব্যার্থ হয়ে কনিষ্ঠা আর তর্জনী তে পড়ার চেষ্টা করলো। বার বার চেষ্টা করেও কোন আঙুলেই আর আংটিটা ঢুকলো না। আংটিটা বড্ড ছোট হয়ে গেছে। না ! আংটি ছোট হয়নি। আকাশ বড় হয়ে গেছে।
[Image: 20220401-214720.png]
[+] 13 users Like Bichitro's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) চলছে :--- - by Bichitro - 22-11-2021, 09:37 AM



Users browsing this thread: 154 Guest(s)