Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
(17-11-2021, 11:09 AM)dada_of_india Wrote: #হিসেব_না_মেলা_অঙ্ক( নতুন গল্প)

#অর্পিতা_সরকার

মা শুনেছো আল্পনা কাকিমা তো মারা গেছে! আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে শুনে এলাম। আমায় অনুপমদা বললো। ওরা বোধহয় কাল রাতে বুকে ব্যথা ওঠায় নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল, স্ট্রোক নাকি কে জানে? মা অনুপমদা এখন কোথায় খাবে? 
হাতের কাজ সারতে সারতে রেবতী বললো, তুই হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস টুয়া। আল্পনাকে এনেছে নাকি বাড়িতে?
অনুপমের ওপরে সব দায়িত্ব পড়বে। তোর থেকে বছর খানেকের তো বড়। কথাটা বলতে বলতেই রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো রেবতী। সারাটা জীবন মানুষের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখতে দেখতে ইদানিং আর অবাক হয় না। ওটির নার্স হওয়ার সুবাদে জন্ম আর মৃত্যুকে পাল্লা দিয়ে উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছেন ভগবান। তাই জন্মের সময় যেমন সদ্যোজাতের চিল-চিৎকারের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চারে নরম হাসি ফোটে ঠোঁটে তেমনই অনেকক্ষণ লড়াই করার পরে যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের দৃশ্যটা দেখে রেবতী তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ইদানিং আর কিছুই হয় না। হতো এককালে। যখন মাত্র চব্বিশ বছরে হসপিটালে ঢুকেছিলো নার্স হিসাবে তখন কারোর মৃত্যু দেখলেই কেঁদে ফেলতো ও। মনের মত চোখের ভিতরের শিরাগুলোও তখন ছিল বড্ড স্পর্শকাতর। 
টুয়া খেতে খেতেই বললো, জানো মা সুদীপকাকু পরশু রাতেও মদ খেয়ে এসে চেঁচাচ্ছিলো। আল্পনা কাকিমা তাড়াতাড়ি ওদের বাড়ির দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করতে ব্যস্ত ছিল। যাতে বাইরে আওয়াজ না বেরোয়। কেন মা? আল্পনা কাকিমা কেন এত কষ্ট সহ্য করে ছিলো?
সুদীপকাকুর অসভ্যতামি লোককে লুকিয়ে কি লাভ হতো? রেবতী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নিজের ঘরের আওয়াজ অনেকে বাড়ির বাইরে চর্চা করতে পছন্দ করে না রে। সবাই তো আর পা ছড়িয়ে নিজের দুর্দশার কথা লোককে বলে বেড়াতে পারে না! আল্পনাও চাইত না, পাড়ার লোক ওদের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে অভাবের কারণটাও জানুক। টুয়া বলল, মা আল্পনা কাকিমার সেলাই করে রোজগার করা সব টাকায় সুদীপকাকু মদ খেতো জানো?
রেবতী কাজ সারতে সারতে বলল, জানি। আল্পনা মরেছে বেঁচে গেছে। কিছু কিছু জীবন বয়ে চলা বড্ড কষ্টকর। মুক্তি পেয়েছে। 
সন্ধের দিকে সৈকত অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই রেবতী বললো, সুদীপ মিস্ত্রির স্ত্রী মারা গেছে জানো তো?
সৈকত ক্লান্ত স্বরে বলল, হ্যাঁ শুনলাম অনুপমের মা মারা গেছে। ওদের বাড়ির সামনে জটলা রয়েছে। 
রেবতী বলল, তুমি খেয়ে রেস্ট নিয়ে নাও। যাবে তো শ্মশানে নাকি?
সৈকত একটু ইতস্তত করে বলল, আমি? আমি কেন যাবো? আমার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। তাই শ্মশানে যাবো না ভাবছি। অনুপমের বন্ধুরা, পাড়ার ছেলেরা সব এসেছে তো। 
রেবতী ফোনে কাউকে বলছিলো, নীলিমা আজ নাইট ডিউটিটা একটু ম্যানেজ করে নেবে গো? আজ আমার পাড়ায় একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। তাই যেতে পারবো না ডিউটিতে। 
সৈকত নিজের মনেই হাসলো। মনে পড়ে গেলো আগেকার একটা কথা। যখন এই রেবতীই সৈকতকে বলেছিলো আল্পনাদের গলির রাস্তাটা না ধরে ও যেন প্রাইমারি কলেজের পাশের রাস্তাটা ধরে যায়। 
আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর ধরে আল্পনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে যায় না সৈকত। হাজার তাড়াহুড়ো থাকলেও নয়। 
আজ মোড়ের মাথায় আসতেই চায়ের দোকানের শিবু জানালো, দাদা তোমাদের পাড়ার সুদীপ মিস্ত্রির বউটা মারা গেছে তো দুপুরবেলা। নার্সিংহোমে না হসপিটালে জানি না। তবে শুনলাম সুদীপ মানে ওর মাতাল বরটা নাকি খুব কাঁদছিলো। সৈকত শুধু অস্ফুটে বলেছিল, ওর নাম আল্পনা, আল্পনা শীল। 
আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর পরে আল্পনাদের বাড়ির গেটের সামনে একটুখানি দাঁড়িয়ে ছিলো সৈকত। ভিতরে ঢোকেনি অবশ্য। 
রেবতী বিয়ের চারমাসের মধ্যেই বলেছিল, সৈকত আমার একটা কথা তোমায় রাখতে হবে। আমি তোমার মায়ের দেখাশোনা করি। তোমার সবকিছু করে দিই, এর বিনিময়েই ধরো একটা কথা তোমায় রাখতে হবে। আরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও সৈকত এই কয়েকমাসে বেশ বুঝেছিল রেবতী অত্যন্ত শান্ত ভদ্র মেয়ে। চাঁদ চাইবে না এটুকু বুঝেই নির্দ্বিধায় কথা দিয়েছিল, হ্যাঁ রাখবো। 
রেবতী সুন্দরী শিক্ষিতা, চাকুরীরতা মেয়ে। অত্যন্ত শিক্ষিত পরিবেশে বড় হয়েছে। কথা বলার ভঙ্গিমাটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রেবতী দৃঢ় অথচ অনুনয়ের ভঙ্গিমায় বলেছিল, তুমি সুদীপ মিস্ত্রীদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে অফিস যেও না আজ থেকে। প্রাইমারি কলেজের সামনে রাস্তা দিয়ে স্টেশন চলে যেও। হয়তো মিনিট দুয়েক ঘুরপথ হবে। সে হোক, ওখান দিয়েই যেও। 
সৈকত অবাক হয়ে বলেছিল, কারণটা জানতে পারি?
রেবতী অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, শুনেছি ওর স্ত্রী নাকি দুশ্চরিত্রা। আল্পনার নাকি স্বভাব খারাপ। আমি চাই না, তুমি ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাও। সৈকত নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, আমার স্বভাব তো খারাপ নয় রেবতী, তাহলে?
রেবতী হেসে বলেছিল, তুমি কথা দিয়েছিলে রাখবে। যদি না রাখো তাহলে জোর করবো না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়েছিল রেবতী। আর কখনও কিছু বলেনি, এদিকে সৈকতও রেবতীর কথা মত নিজের রাস্তা পাল্টে নিয়েছিল। 
আল্পনার ছেলে হয়েছে শুনেছিলো রেবতীর মুখেই। টুয়ার থেকে বছর খানেকের বড় হবে অনুপম। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে রাস্তার মোড়ে দেখেওছে সুদীপের সঙ্গে। 
সুদীপের হাতের কাঠের কাজ দেখার মত। মোড়ের মাথায় চালু দোকান ছিল ফার্নিচারের। বিয়ের অর্ডার পেতো খুব। সুদীপ এমনিতে ছেলে খারাপ ছিল না, কিন্তু অল্প বয়েস থেকে মদের নেশায় পড়ে টাকা পয়সা পকেটে টিকতো না মোটেও। 
ছেলেটার মুখটা আল্পনা বসানো ছিল। ছেলেটা লেখাপড়া তেও খুব ভালো শুনেছে লোকমুখে। 
সৈকতের মা যতদিন বেঁচেছিলো ততদিন পর্যন্ত এ বাড়ির সমস্ত কিছু মায়ের নির্দেশ মতোই হতো। 
রেবতীকে হসপিটাল থেকে ফিরে শুধু স্নান করলেই চলতো না, গায়ে গঙ্গাজল ছেটাতে হতো। নাহলেই মা অশান্তির চূড়ান্ত করতো। 
নীচু জাত, ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার ছিল মায়ের মারাত্মক। মা মারা যেতে সংসারের হাল ধরেছিল রেবতী। তখন টুয়ার বয়েস বছর ছয়েক। 
তখনই একদিন অফিস বেরোনোর আগে দেখেছিলো, টুয়া আর অনুপম ওদের উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলছে। আর রেবতী রান্নাঘর থেকে হাঁক পারছে, তোদের দুটোকে কি কান ধরে টেনে আনতে হবে ...নাকি এসে জলখাবার খাবি?
আল্পনার বাড়ির রাস্তায় যাওয়া নিষেধ ছিল সৈকতের অথচ আল্পনার ছেলেকে এবাড়িতে ডেকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় রেবতী? অদ্ভুত তো। রেবতী অবশ্য সত্যিই বড্ড অদ্ভুত। ওর মুখ দেখে আজ অবধি মনের গভীরের তল খুঁজে পেলো না সৈকত। এক সঙ্গে ছাব্বিশ বছর একই ছাদের নিচে কাটিয়েও ঠিক চিনতে পারলো না রেবতীকে।

 অনুপম ছেলেটিকে সৈকতের বেশ ভালো লাগতো। বাবার মত রগচটা নয়। অত্যন্ত ভদ্র, মিশুকে ছেলে। পাড়ার কারোর কিছু প্রয়োজনে দাঁড়াতেও দেখেছে অনুপমকে। পড়াশোনাতেও খুব ভালো। বাবার ওই চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেই এত ভালো রেজাল্ট করেছে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলো সৈকত। রেবতী যদি কিছু ভাবে বলেই খুব ইচ্ছে থাকলেও অনুপমের হাতে কখনও একশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলতে পারেনি, মিষ্টি খেও। আবার যদি রেবতী ভাবে আল্পনার ছেলের সঙ্গে অত গল্প করার দরকার নেই, বড্ড মানে লাগবে সৈকতের। তাই ওই কখনও মুখোমুখি হলে, পড়াশোনা কেমন চলছে... এর বাইরে কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। চোখের সামনে অনুপমকে অভাব অনটন আর নোংরা পরিবেশের মধ্যেই বড় হতে দেখলো সৈকত। টুয়ার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব বলেই হয়তো টুয়া এখনও ওকে দরকারে অদরকারে ডাকে। কিন্তু দুজনেই আর ছোট নেই। টুয়ার কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, অনুপমও থার্ড ইয়ারে পড়ে। এখনও কেন মাঝে মাঝেই অনুপমকে এ বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে সৈকত কে জানে! রেবতীকে একদিন নিজের আশঙ্কার কথা বলেছিলো সৈকত, মেয়েটা তো বড় হচ্ছে? পাড়া প্রতিবেশী আবার কিছু যদি বলে?
রেবতী অজানার ভান করে বলেছিল ঠিক কি বিষয়ে বলতো? অনুপম আর টুয়ার মেশা নিয়ে? ওরা তো ছোট থেকে বন্ধু। আজ আবার নতুন করে লোকে কি দেখবে? না পাত্তা দেয়নি সৈকতের কথায়। সৈকত মনে মনে ভেবেছিল, তাহলে ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে বারণ করে অপমান শুধু ওকেই করেছে রেবতী!
যদিও এই নিয়ে কথা বলা হয়নি কখনও সৈকতের। এরমধ্যে কারণ একটা অবশ্যই আছে। সেটা অবশ্য রেবতীর জানার কথা নয়। 

ইজি চেয়ারে বসে বাঁশিটাতে একবার হাত বোলালো সৈকত। বাজানো হয় না বহুদিন। রেবতী বিয়ের পর উৎসাহের সঙ্গেই বলেছিল, তুমি বাজাতে পারো? তাহলে বাজাও না কেন? বাজাও আমি শুনবো। না ইচ্ছে করেনি সৈকতের। বাঁশি বাজানোর অনুপ্রেরণা রেবতী কোনদিনই হতে পারেনি হয়তো। অথবা সৈকতেরই আর সুর তুলতে ইচ্ছে করেনি। কিছু জিনিস ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কষ্টর সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা তৃপ্তিও কাজ করে। মনে হয় থাকুক না। ঠিক যেমন মা মারা যাবার পরে বারো দিন হবিশ্যি করার সময়। আমিষ ছাড়া যার মুখে ভাত ওঠে না সেই সৈকতের একদিনের জন্যও মাছ-মাংস খেতে ইচ্ছে করেনি। বারবার মনে হচ্ছিল, মাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এটুকু ত্যাগস্বীকার করার মধ্যে অনেকটা তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে। 
মনে হয় মানুষটা তো অনেক করেছে একদিন আমার জন্য, সে চলে যাবার পরে এটুকু নাহয় করলাম তার জন্য। বাঁশিটাও কি এমনই একটা ত্যাগ সৈকতের কাছে?

রেবতীর গলা শোনা যাচ্ছে। টুয়া, ছুটে গিয়ে একবার অনুপমকে ডেকে নিয়ে আয় তো। না খেয়েই বেরিয়ে গেল নাকি কে জানে? আর আল্পনাকে আনা হলো কিনা দেখে আয়। আমার কয়েকটা কাজ আছে, যেতে হবে আল্পনার বাড়ি। 
সৈকত অবাক হয়ে শুনছিলো রেবতীর বলা কথাগুলো। আচমকা রেবতীর এত আল্পনা প্রীতি হলো কেন? মারা গেছে বলে? বেঁচে থাকতে তো তাকে দুশ্চরিত্রা বলতে মুখে বাঁধেনি। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তো বদনাম দিয়ে দিয়েছিল। আল্পনা তো কোনদিনই পাড়ায় চড়ে বেড়ানো মেয়েও ছিল না, গৃহবন্ধি রাখতেই পছন্দ করতো নিজেকে। 
তারপরেও তার নামে এমন একটা বদনাম দিয়েছিল রেবতী। 

টুয়া এসে খবর দিলো মা, আল্পনা কাকিমাকে নিয়ে এসেছে এই মাত্র। আর অনুপমদা আসছে এখুনি। 
সৈকত কানটা খাড়া করে রেখেছে। এই রেবতীকে ও চেনে না। অদ্ভুত রকমের আচরণ করছে রেবতী আজকে। অনুপম আসতেই সৈকত নিজের ঘরের লাইট নিভিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ও পাচ্ছে সবাইকে। 
রেবতী খুব অভ্যস্ত ঢঙে বলল, আগে খেতে বস। সারারাত খাওয়া হবে না। অনুপমের মুখটা থমথম করছে। ধরা গলায় বলল, কাকিমা মাকে বাঁচাতে পারলাম না। রেবতী অনুপমের সামনে খাবার ধরে দিয়ে বলল, তোর মা বাঁচতে চায়নি যে। দিনের পর দিন বারণ সত্ত্বেও মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খেয়েছে হতভাগী। তাতেও কি চোখে ঘুম নেমেছিল নাকি? ধীরে ধীরে হার্টে এফেক্ট হলো। শোন, বাবার ওপরে এখন চেঁচাস না। পাঁচটা লোক আছে দেখবে। তাছাড়া তোর মা বাড়ির অশান্তির কথা সবসময় ঢেকে রাখতে চেয়েছিল। 
অনুপমের খাওয়া শেষ হবার আগেই রেবতী এদিকওদিক তাকিয়ে ওর হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ঘাট খরচ ভালো করে করবি। আমি তোর কাকুকে পাঠাচ্ছি। তোর পাশে থাকবে। অনুপম জল খেতে খেতে বলল, তুমি আর কত দেবে বলতো? আমার পড়ার খরচও তো তুমিই দিয়ে আসছো সেই কবে থেকে। রেবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই আর টুয়া কি আলাদা আমার কাছে? আল্পনা না থাকলে টুয়াকে হয়তো বাঁচাতেই পারতাম না রে। তোর মায়ের কাছে আমার ঋণ কি কিছু কম?
সৈকত চমকে যাচ্ছে রেবতী কথা শুনে। ঋণ? আল্পনা না থাকলে টুয়া বাঁচতো না? অনুপমের পড়াশোনার খরচ রেবতী দেয়? ছাব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে একই বাড়িতে থেকে এত কিছু জানে না ও! আশ্চর্য লাগছে। 
অনুপমকে টুয়া বলল, অনুপমদা আমি বিকাশদাকে বলে দিয়েছি রে তোর কাছা কিনে রাখতে। গঙ্গায় স্নান করে ওটা পরতে হয়। টুয়ার দিকে তাকিয়ে অনুপম বলল, তুইও কত বড় হয়ে গেলি। 
সৈকত নিজের ঘরে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। এ রহস্যের সমাধান করতে পারছে না কিছুতেই। রেবতী যদি আল্পনাকে ঘৃণাই না করবে তাহলে ঐ পথ দিয়ে ওর যাওয়া-আসা বন্ধ করেছিল কেন? 
প্রশ্নগুলো আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। 
রেবতী ঘরে এসে বিছানায় একটা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর তোয়ালে রেখে বলল, রেডি হয়ে নাও। অনুপমের সঙ্গে শ্মশানে যাবে। 
সৈকতের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমনিতেই মনটা ভালো নেই। তারপর রেবতীর এত গোপন তথ্য জেনে মেজাজটাই খিঁচিয়ে গেছে। 
একটু গলাটা চড়িয়েই বলল, তোমার কথা মত আমায় চলতে হবে নাকি? আল্পনাদের সঙ্গে যখন এতই ভাব রেখেছিলে তখন আমায় কেন বলেছিলে ও পথ যেন না মাড়াই? মানুষ যে কি করে এত হিপোক্রিট হতে পারে কে জানে! 
রেবতী হিমশীতল গলায় বলল, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে যদি এভাবে গলা তুলে কথা বলতে পারতে সৈকত তাহলে আজ মিসেস সৈকত মুখার্জী বোধহয় আল্পনা হতো তাই না। তুমি ওকে আল্পনা নয় বরং সুদীপ মিস্ত্রির স্ত্রী বলে ডাকো। আল্পনা ডাকার অধিকার তুমি সেদিন হারিয়ে ফেলেছিলে, যেদিন একটা মেয়ের স্বপ্নকে দু পায়ে থেঁতলে দিয়ে মায়ের কথায় ', মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। তুমি আল্পনা ডাকার অধিকার সেদিন হারিয়ে ফেলেছো যেদিন তোমার সামনে দিয়ে ওর বাবা ওর মতের বিরুদ্ধে মদ্যপ সুদীপের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল আর তুমি ঘরের মধ্যে লাইট নিভিয়ে বসে ছিলে। তাই চিৎকার করে কথা বলো না সৈকত। চিৎকারটা সেদিন করা উচিত ছিল। 
সৈকত বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়ে বলেছিল, তুমি কি করে জানলে আমার আর আল্পনার কথা?
রেবতী নরম হেসে বলল, বিয়ের পর পর তুমি বেরিয়ে গেলেই আমি ছাদে উঠতাম জানো। যতদূর তোমায় দেখা যায় দেখবো বলে। সৈকত আনমনে কেমন হাঁটে দেখতে ইচ্ছে করতো তখন। তুমি আস্তে আস্তে দূরে চলে যেতে ছোট হয়ে যেতো তোমার অবয়ব, আমিও চলে যেতাম ডিউটিতে। একদিন দেখলাম, আমি যেমন তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পরে হাত জোর করে দুগ্গা দুগ্গা বলি, আরেকজনও গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে। না, তুমি তাকে দেখতে পাও না। কিন্তু সে তোমার উদ্দেশ্যেই ঈশ্বরকে ডাকে। রোজই দেখছিলাম ব্যাপারটা। একদিন তুমিও বেরোলে আমিও প্রায় তোমার পিছু পিছুই গেলাম।
দেখলাম, শ্যামলা রোগা রোগা মিষ্টি মুখের মেয়েটা একটা নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরে অগোছালো চুলেই সংসারের যাবতীয় কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে পড়িমরি করে বেরিয়ে এসেছে তোমায় পিছন থেকে এক পলক দেখবে বলে। মেয়েটা বাড়িতে ঢুকতেই তার স্বামী চিৎকার করে বলছে, দুশ্চরিত্রা, লজ্জা করে না তোর। রোজ এ সময় ছুটে কেন দরজায় গিয়ে দাঁড়াস আমি জানি না বুঝি? ওকেই যদি এত ভালোবাসিস তাহলে বিয়ে কেন করেছিলিস আমায়? দু চার ঘা পড়লোও হয়তো পিঠে। মেয়েটা তাড়াতাড়ি দরজা, জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত। সে যে অত্যাচারিত হয় স্বামীর হাতে, এ কথা যেন পাড়ার লোক টের না পায়। আরও দু এক দিন দেখার পরে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওই বাড়িটা কাদের? ওখানে যে বউটা থাকে তার নাম কী?
তোমার মা অত্যন্ত অশ্রদ্ধা আর বিরক্তি মিশিয়ে বলেছিলেন, ওর নাম আল্পনা। অল্পবয়েসে মাকে খেয়েছে। পাশের পাড়ায় বাড়ি ছিল। মরতে এখন এ পাড়ার চোখের সামনে বিয়ে করে এসেছে। বাচাল অসভ্য মেয়ে। চাঁদ ছোঁয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, আমার ছেলের দিকে নজর দিয়েছিল। তারপর দিলাম ওর বাপটাকে বলে। সুদীপ মিস্ত্রির সঙ্গে বিয়ে হলো। 
জানো সৈকত খুব ইচ্ছে হয়েছিল মেয়েটার সঙ্গে একদিন পরিচয় করতে। মেয়েটা কি একাই ভালোবেসেছিল নাকি তুমিও....
একদিন গেলাম আল্পনার বাড়িতে। সে তো অবাক। আমায় কোথায় বসাবে ঠিক করতে পারছে না। পারলে মাথায় বসায় যেন। সম্ভ্রমের গলায় বলল, বৌদি আপনি যদি ভেবে থাকেন সৈকতদার দোষ তাহলে ভুল ভাবছেন। আমিই বোকার মত এমন অবাস্তব কল্পনা করেছিলাম। সৈকতদা খুব ভালোমানুষ। অবাক হয়েছিলাম জানো! এমন মেয়েও আছে? নিজের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবার পরেও এমনভাবে তোমার সম্মান রক্ষা করতে ব্যস্ত? ভারী লক্ষ্মীশ্রী মুখ আল্পনার। 
আস্তে আস্তে সব জানলাম। তোমাদের প্রেম, তোমার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া, তারপর তোমার মায়ের অমত। ওর বাবাকে ধমকি...পাড়া ছাড়া করার, সব শুনলাম আমি। তোমাদের চৈত্রমাসের মেলা থেকে ও তোমায় একটা বাঁশি কিনে দিয়েছিল। তুমি ভাল বাঁশি বাজাও বলে। আল্পনাই ছিল তোমার একনিষ্ঠ শ্রোতা। কথা বলতে বলতে দু চোখ জলে ভরে গিয়েছিল আল্পনার। তবুও সে হতভাগী বলে কিনা, সৈকতদা নির্দোষ। মায়ের অমতে ও কি করে বিয়ে করবে বলো বৌদি? তাছাড়া তুমিই ওই বাড়ির যোগ্য বউ। আমি তোমায় রোজ দেখি। কী সুন্দরী তুমি, কত শিক্ষিতা, চাকরি করো, তুমি খুব ভালো। 
আমি অবাক হয়েছিলাম সৈকত। যে ওর ভালোবাসাকে কেড়ে নিলো, যে ওর স্থান দখল করে নিলো তার প্রতি ওর রাগ নেই। বরং ও আমায় ভালোবেসে দেখে। আল্পনারা শুধু ভালোবাসতে জানে জানো। নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে ভালোবাসতে জানে। 
আমি বলেছিলাম, তুমি যে রোজ সৈকত অফিস যাওয়ার সময় বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, তোমার বর তো মারে। কেন যাও? 
বোকার মত হেসে বলেছিল, হ্যাঁ ও বলে আমি নাকি দুশ্চরিত্রা। ধুর, সৈকতদা ছাড়া আমি কোনদিন কারোর দিকে তাকালামই না। 
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাকে সম্মান দিয়ে ঘরে আনোনি তাকে রোজ রোজ তোমার কারণে মার খেতে দেব না। তাই তোমায় ও পথ দিয়ে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি হয়তো ভাবছো আমি নিষ্ঠুর। অভাগীর একপলক দেখার সৌভাগ্যটুকুও কেড়ে নিলাম। কিন্তু কি বলতো সৈকত, এতে সুদীপ মিস্ত্রি ওকে মারত, আর পাড়ার লোকে খারাপ বলতো, লাভ কিছুই হতো না। 
কি করে যেন ওই অল্পশিক্ষিতা, অত্যন্ত সাধাসিধে মেয়েটা আমার বন্ধু হয়ে গেলো। অনুপম জন্মানোর আগে আমায় বলছিল, বৌদি আমার খুব ভয় করছে। যদি আমার সন্তান সুদীপের মতোই রগচটা মদ্যপ হয়? আমি বলেছিলাম, ধুর বোকা, মায়ের মত হবে। আমিই ওকে আমার হসপিটালের আউটডোরে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। অনুপম জন্মের সময় আমিই ছিলাম ওটিতে। আল্পনা নয় আমিই অনুপমকে প্রথম ছুঁয়েছি। 
সৈকত দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই বলল, তুমি যে বললে আল্পনা ছাড়া টুয়াকে বাঁচাতে পারতে না, কেন? 
রেবতী ধরা গলায় বলল, মনে আছে টুয়া জন্মাবার পরেই জন্ডিস হয়েছিল। অথচ আমার ব্রেস্টমিল্ক ছিল না। তখন টানা দু মাস আমি ডিউটিতে যাবার সময় আল্পনার কাছে টুয়াকে দিয়ে যেতাম। ওই বুকের দুধ খাইয়ে টুয়াকে বড় করেছে। অনুপম যে বছর দুয়েক পর্যন্ত ব্রেস্টমিল্ক খেয়েছিল, তাই টুয়াকে খাওয়াতে ওর অসুবিধা হয়নি। 
দুদিন ফল, দুধ কিনে দিয়েছিলাম বলে বলেছিল, বৌদি বুকের দুধের দাম দিও না এভাবে, নিতে পারবো না। তোমার মা জানতেন আমি টুয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সুদীপ মিস্ত্রি একটু ভয় পেতো আমায়। আমি বলেছিলাম, আর যদি কখনও আল্পনাকে মারতে দেখেছি তাহলে পুলিশে খবর দেব। তারপর থেকেই মারের মাত্রা কমেছিলো। 
টুয়া আর অনুপমকে ঘিরে আমাদের অনেক কথা হতো। আল্পনা বলেছিল, ওরা যেন দুই ভাইবোন। আমিই অনুপমের লেখাপড়ার ভার নিয়েছিলাম। 
দেরি হচ্ছে সৈকত, রেডি হয়ে নাও। একসঙ্গেই যাবো আল্পনাদের বাড়ি।
সৈকত রেবতীর হাত দুটো ধরে বলল, সময়ে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারিনি গো। আমার জন্যই হয়তো আল্পনাকে আজীবন এত কষ্ট পেতে হলো। তাড়াহুড়ো করে ওর বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো সুদীপের সঙ্গে। আল্পনা লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। তারপর ওর বাবাটাই আর পড়ালো না। 
রেবতী বলল, আল্পনার অনেক গুন ছিল জানো। সে ভালো রান্না করতে পারতো। সে ভালো সেলাই জানতো। সব থেকে বড় গুন ছিল, ও কখনও কারোর নিন্দে করতে জানতো না। যেন পৃথিবীর সবাই ভালো ছিলো ওর চোখে। সৈকত, আল্পনার মত মেয়েরা নিঃস্বার্থে ভালোবাসতে পারে। অনুপম হয়েছে মায়ের মতোই ধৈর্য্যশীল ছেলে। এত কম বয়েসের ছেলে যে এত দায়িত্ববান ভাবা যায় না। 
বেরোনোর আগে আলমারি খুলে একটা গোলাপি রঙের নতুন শাড়ি বের করলো রেবতী। 
সৈকত বলল, এটা কি?
রেবতী হেসে বলল, তোমার গোলাপি রং পছন্দ ছিল বলে বাবার কাছে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি কেনার জন্য বায়না করেছিল ও। ওর বাবা রেগে গিয়ে পিঠে খুন্তি দিয়ে মেরেছিলো জানো। সে দাগ এখনও ছিল। হেসে বলেছিল, এটা বায়না করার দাগ। মেয়েটার যেন অদ্ভুত এক শক্তি ছিল। সব সহ্য করার শক্তি। নিজেকে ক্ষয় করে হাসি মুখে থাকার শক্তি। 
এটা আজ পরিয়ে দেব ওকে। 

আল্পনা ঘুমাচ্ছে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। প্রায় বছর ছাব্বিশ, সাতাশ পরে আবার ওকে দেখলো সৈকত। এত রোগা হয়ে গিয়েছিল? 
মেলা থেকে বাঁশিটা কিনে এনে বলেছিল, এই নাও সৈকতদা তুমি বাজাবে। কেউ যদি না শোনে আমি শুনবো। তুমি একদন সন্ধেবেলা তোমাদের ছাদে বাজাচ্ছিলে আমি শুনেছি। 
 সৈকতকে দেখলেই লজ্জা পেতো ও। সৈকত বলেছিল, ভালোবাসো আমায় আল্পনা?
আল্পনা চোখ নামিয়ে বলেছিল, শুধু তোমাকেই বাসি। তোমায় আমায় ভালোবাসতে হবে না, আমি একলাই বাসবো। সৈকত বলেছিল, বিয়ে করবে আমায়?
আল্পনা মুখ নীচু করে বলেছিল, করবো। সৈকত ওর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, ওর শ্যামলা রঙে একমুঠো আবীর রঙের মাখামাখি। 
সৈকত প্রথম চাকরি পেয়ে ওকে একটা হাতঘড়ি উপহার দিয়ে বলেছিল, সময়টা খেয়াল রেখো। বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে যখন ফিরবো তখন যেন রাস্তার মোড়ে তোমায় দেখি। আল্পনার বাড়িতে যত কাজই থাক, ও ঠিক সৈকতের জন্য অপেক্ষা করতো রাস্তার মোড়ে। ওই দূর থেকে একটু দেখা এটুকুই প্রাপ্তি ছিল। তখনও আল্পনারা এ পাড়ার বাসিন্দা ছিল না। 
রেবতী আল্পনার গায়ের ওপরে গোলাপি শাড়িটা দিয়ে ঢেকে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, দেখো তোমার সৈকতদা এসেছে। সৈকত কাঁদছে আল্পনা তোমার জন্য। চিন্তা করো না, আজ থেকে আমি অনুপমের মা। ওর সব দায়িত্ব আমার। 
অনুপম, সৈকত আর পাড়ার দুজনের কাঁধে চেপে আল্পনা চললো স্বর্গের পথে। 
ফিরে আসছিল রেবতী, সুদীপ আস্তে করে বলল, এত মেরেছি তবুও কোনোদিন বলাতে পারিনি সৈকত মুখার্জী খুব খারাপ লোক। মার সহ্য করেছে তবুও বলেছে, সৈকত ভালো লোক। আমার ওপরে কর্তব্যের কখনও ত্রুটি করেনি। তবুও কোথায় যেন .....
সুদীপের কথাগুলো আর না শুনেই বাড়ি ফিরে এলো রেবতী। ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সৈকতের কাঁধে চেপে আল্পনা চলেছে স্বর্গযাত্রায়। কিছু কিছু হিসাব এমন অমিলই রয়ে যায় জীবনে। যেমন আল্পনার একনিষ্ঠ ভালোবাসা, যেমন সৈকতের ভীরু স্বভাব, যেমন সুদীপের অকারণ আক্রোশ, যেমন রেবতীর প্রতি আল্পনার টান আর আল্পনার সঙ্গে রেবতীর লুকানো বন্ধুত্ব.... এমন কত হিসেব মেলে না কিছুতেই..মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেও কিছু হিসেব কোনোদিন মেলাতে পারলো না রেবতী।

কলমে- অর্পিতা সরকার
সমাপ্ত

এক নাগাড়ে পুরোটা পড়া যায় না এই গল্প! এতোই হৃদয়বিদারক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এই গল্প। চোখে জল চলে এলো। ধন্যবাদ লেখিকা অর্পিতা সরকার কে এবং যিনি আমাদের পড়ার সুযোগ দিয়েছেন! দাদা অফ ইন্ডিয়া কে।



Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by Jupiter10 - 17-11-2021, 12:08 PM



Users browsing this thread: 23 Guest(s)