16-11-2021, 05:52 PM
সকাল থেকে মামির মুখ গোমড়া। মেল ট্রেনের মতো ফ্ল্যাট জুড়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। পিছনে মামা। পরনে তোয়ালে। মুখে সাবান।
দাড়িটা এখনও কেটে উঠতে পারেননি। বলে চলেছেন, “লক্ষ্মীটি, একটু বোঝার চেষ্টা করো। সব ওই আবিরের জন্য…”
“খবরদার,” বাজ পড়ল, “ওর ওপর একদম দোষ চাপানোর চেষ্টা করবে না।”
সাড়ে নটার মধ্যে ভাগ্নেমণ্ডলী ফোন পেয়ে চলে এল। এসেই পল্লব কম্পিউটারে বসে গিয়েছে। বংশী বলছে, “আশ্চর্য! আবার শুরু?”
ফটিক পাদপূরণ করছে, “হ্যাঁ, তিনশো তিয়াত্তর নম্বর মেল যাচ্ছে।”
আবির মাথা চুলকে বলছে, “এ ভাবে হবে না। সাইবার সেলে জানাতে হবে। পরিস্থিতি খুবই বিচ্ছিরি জায়গায় চলে যাচ্ছে।”
মামা তখন বিলাপ করছেন, “সঞ্চয় গেল, চাকরি গেল, সংসার গেল। আমায় কেউ একটা ল্যাঙট দে… ওরে কেউ আমায়…”
মামি ব্যাগ গুছোচ্ছেন। মামা কাতর কণ্ঠে বলতে চেষ্টা করছেন, “আরে উত্তরপাড়া সঙ্গীত সম্মেলনে আলাপ। তুমিও তো ছিলে। এ স্বরলিপি ওই-ই তো পাঠিয়েছিল, আমি চেয়েছিলাম বলে। সেটা মেলে রয়ে গেছে। আবার কাল রাত্তিরে ওর কাছেই চলে গেছে। তা, এতে আমি কী করতে পারি বলো…”
“কোনও কৈফিয়ত...” মামির কথায় বাধা পড়ল।
বেল বাজছে। মামা খুলে দেখলেন একটি যুবক। বললেন, “আরে অতনু, এসো এসো।”
ছোকরার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। ঢুকেই ঢিপ করে একটা প্রণাম। রানামামা অপ্রস্তুত, “আরে আরে…”
পাড়ার ছেলে। ক্লাস টুয়েলভে তাকে পলিটিক্যাল সায়েন্সটা মামা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ছোকরা রানামামাকে ‘মাস্টারমশাই’ বলে ডাকে। বলল, “কাল রাতে গঙ্গায় গেছিলাম, মাস্টারমশাই।”
“কেন বাবা?”
“ফেলে দেব বলে।”
“কাকে… না মানে কী?”
“কবিতার ডায়রিগুলো…” মামা জানেন অতনু কবিতা লেখে। আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
“কেউ তো আজ অবধি একটাও ছাপল না। আর কাল একটা লিটল ম্যাগাজ়িনের সম্পাদক যে ভাষায় রিফিউজ় করল, তাই আর লিখব না ভেবেছিলাম…”
ঘরে সবাই চুপ। অতনু বলে চলেছে, “এমন সময় আপনার একটা মেল ঢুকল ফোনে। তাতে দেখি ড্রাইভে একটা সিনেমা পাঠিয়েছেন। লাভিং ভিনসেন্ট।”
রান্নাঘরে কাপ-ডিশের খটখটানি বন্ধ হয়ে গেছে। অতনু বলে চলেছে, “ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে সেই অসাধারণ অ্যানিমেটেড ছবি। কী মনে করে জানি না, গঙ্গার ঘাটে বসেই পুরো সিনেমাটা মোবাইলে দেখে ফেললাম। জানেন মাস্টারমশাই, এর পর আর কবিতার ডায়রিগুলো ফেলা হল না। আপনি বাঁচিয়ে দিলেন…”
ছেলেটার গলা কাঁপছে, “অত বড় এক জন শিল্পীর সারা জীবনে একটা মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। তাও তো সে এঁকে গিয়েছে…”
রানামামার চোখ ছলছলে। অতনু বলছে, “যে সময়টা, ঠিক যে সময়টা আমি হেরে যাচ্ছিলাম, পড়ে যাচ্ছিলাম— আপনি হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে আমায় তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন।”
মামির মুখ ঢলঢলে। পুরো ফ্ল্যাট নিশ্চুপ। শুধু ভিতরের ঘর থেকে পল্লবের কি-বোর্ডে খটখট করার আওয়াজ আসছে।
অতনু ‘হা কৃষ্ণ’ গোছের মুখ করে রানামামার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলছে, “কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়— এ কথা আপনার মতো করে আর কে বোঝাতে পারত? হলামই না হয় অ্যাপার্টমেন্টের সিকিয়োরিটি। দেখবেন, আমার কবিতা এক দিন ছেপে বেরোবেই। মানুষ এক দিন…” অতনুর গলা ধরে আসছে, “আর আমার প্রথম কবিতার বই আমি আপনাকে…”
বাকি কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রানামামা অতনুকে জড়িয়ে ধরলেন। দাড়িটা কোনও মতে কেটে উঠতে পারলেও তোয়ালেটা এখনও ছাড়তে পারেননি। এক হাতে সেটার গিঁট চেপে ধরে আর-এক হাতে অতনুকে ধরে রয়েছেন। কাঁপা গলায় বিড়বিড় করছেন, “চা খেয়ে যাবে, চা খেয়ে যাবে।”
রান্নাঘরের দরজায় মামি আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।
ফটিক বলছে, “ব্র্যাভো!”
আবির বলছে, “সাবাশ!”
বাইরের রাস্তায় রোববার সকালের কোলাহল বাড়ছে। রোদ্দুর কমলা হয়ে উঠছে।
ভিতরের ঘর থেকে পল্লবের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, “পেয়েছি…পেয়ে গেছি…”
++++++++++++++++++
দাড়িটা এখনও কেটে উঠতে পারেননি। বলে চলেছেন, “লক্ষ্মীটি, একটু বোঝার চেষ্টা করো। সব ওই আবিরের জন্য…”
“খবরদার,” বাজ পড়ল, “ওর ওপর একদম দোষ চাপানোর চেষ্টা করবে না।”
সাড়ে নটার মধ্যে ভাগ্নেমণ্ডলী ফোন পেয়ে চলে এল। এসেই পল্লব কম্পিউটারে বসে গিয়েছে। বংশী বলছে, “আশ্চর্য! আবার শুরু?”
ফটিক পাদপূরণ করছে, “হ্যাঁ, তিনশো তিয়াত্তর নম্বর মেল যাচ্ছে।”
আবির মাথা চুলকে বলছে, “এ ভাবে হবে না। সাইবার সেলে জানাতে হবে। পরিস্থিতি খুবই বিচ্ছিরি জায়গায় চলে যাচ্ছে।”
মামা তখন বিলাপ করছেন, “সঞ্চয় গেল, চাকরি গেল, সংসার গেল। আমায় কেউ একটা ল্যাঙট দে… ওরে কেউ আমায়…”
মামি ব্যাগ গুছোচ্ছেন। মামা কাতর কণ্ঠে বলতে চেষ্টা করছেন, “আরে উত্তরপাড়া সঙ্গীত সম্মেলনে আলাপ। তুমিও তো ছিলে। এ স্বরলিপি ওই-ই তো পাঠিয়েছিল, আমি চেয়েছিলাম বলে। সেটা মেলে রয়ে গেছে। আবার কাল রাত্তিরে ওর কাছেই চলে গেছে। তা, এতে আমি কী করতে পারি বলো…”
“কোনও কৈফিয়ত...” মামির কথায় বাধা পড়ল।
বেল বাজছে। মামা খুলে দেখলেন একটি যুবক। বললেন, “আরে অতনু, এসো এসো।”
ছোকরার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। ঢুকেই ঢিপ করে একটা প্রণাম। রানামামা অপ্রস্তুত, “আরে আরে…”
পাড়ার ছেলে। ক্লাস টুয়েলভে তাকে পলিটিক্যাল সায়েন্সটা মামা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ছোকরা রানামামাকে ‘মাস্টারমশাই’ বলে ডাকে। বলল, “কাল রাতে গঙ্গায় গেছিলাম, মাস্টারমশাই।”
“কেন বাবা?”
“ফেলে দেব বলে।”
“কাকে… না মানে কী?”
“কবিতার ডায়রিগুলো…” মামা জানেন অতনু কবিতা লেখে। আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
“কেউ তো আজ অবধি একটাও ছাপল না। আর কাল একটা লিটল ম্যাগাজ়িনের সম্পাদক যে ভাষায় রিফিউজ় করল, তাই আর লিখব না ভেবেছিলাম…”
ঘরে সবাই চুপ। অতনু বলে চলেছে, “এমন সময় আপনার একটা মেল ঢুকল ফোনে। তাতে দেখি ড্রাইভে একটা সিনেমা পাঠিয়েছেন। লাভিং ভিনসেন্ট।”
রান্নাঘরে কাপ-ডিশের খটখটানি বন্ধ হয়ে গেছে। অতনু বলে চলেছে, “ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে সেই অসাধারণ অ্যানিমেটেড ছবি। কী মনে করে জানি না, গঙ্গার ঘাটে বসেই পুরো সিনেমাটা মোবাইলে দেখে ফেললাম। জানেন মাস্টারমশাই, এর পর আর কবিতার ডায়রিগুলো ফেলা হল না। আপনি বাঁচিয়ে দিলেন…”
ছেলেটার গলা কাঁপছে, “অত বড় এক জন শিল্পীর সারা জীবনে একটা মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। তাও তো সে এঁকে গিয়েছে…”
রানামামার চোখ ছলছলে। অতনু বলছে, “যে সময়টা, ঠিক যে সময়টা আমি হেরে যাচ্ছিলাম, পড়ে যাচ্ছিলাম— আপনি হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে আমায় তুলে দাঁড় করিয়ে দিলেন।”
মামির মুখ ঢলঢলে। পুরো ফ্ল্যাট নিশ্চুপ। শুধু ভিতরের ঘর থেকে পল্লবের কি-বোর্ডে খটখট করার আওয়াজ আসছে।
অতনু ‘হা কৃষ্ণ’ গোছের মুখ করে রানামামার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বলছে, “কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়— এ কথা আপনার মতো করে আর কে বোঝাতে পারত? হলামই না হয় অ্যাপার্টমেন্টের সিকিয়োরিটি। দেখবেন, আমার কবিতা এক দিন ছেপে বেরোবেই। মানুষ এক দিন…” অতনুর গলা ধরে আসছে, “আর আমার প্রথম কবিতার বই আমি আপনাকে…”
বাকি কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রানামামা অতনুকে জড়িয়ে ধরলেন। দাড়িটা কোনও মতে কেটে উঠতে পারলেও তোয়ালেটা এখনও ছাড়তে পারেননি। এক হাতে সেটার গিঁট চেপে ধরে আর-এক হাতে অতনুকে ধরে রয়েছেন। কাঁপা গলায় বিড়বিড় করছেন, “চা খেয়ে যাবে, চা খেয়ে যাবে।”
রান্নাঘরের দরজায় মামি আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।
ফটিক বলছে, “ব্র্যাভো!”
আবির বলছে, “সাবাশ!”
বাইরের রাস্তায় রোববার সকালের কোলাহল বাড়ছে। রোদ্দুর কমলা হয়ে উঠছে।
ভিতরের ঘর থেকে পল্লবের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, “পেয়েছি…পেয়ে গেছি…”
++++++++++++++++++