Thread Rating:
  • 106 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) সমাপ্ত :---
কথায় আছে সবার দিন আসে। লাবনীরও দিন এলো। আর সেই দিনটা খুব শীঘ্রই চলে এলো । বলা ভালো সুচি নিজেই লাবনীকে আকাশের কাছে আসার সুযোগ করে দিল।

আর এক দেড় সপ্তাহ পর পূজার ছুটি পড়ে যাচ্ছে। কে কি কিনবে , কোথায় যাবে ? কার সাথে যাবে ? এই নিয়েই আলোচনা তুঙ্গে। কয়েক দিন পরেই পূজার ছুটি পড়বে তাই যেন সব প্রোফেসর একটু বেশি সময় ধরে লেকচার দিচ্ছে । শেষের ক্লাস করে সুচি এসে দেখলো পার্কিংয়ে আকাশ নেই। সুচি ভাবলো হয়তো আকাশেরও ক্লাস হচ্ছে তাই আকাশকে ফোন না করে সুচি আকাশের ক্লাসে চলে এলো। এসে দেখলো ক্লাসে একজনও নেই , পুরো ভো ভা । ‘ কোথায় গেল ছেলেটা ? , বলে খুঁজতে শুরু করলো। আকাশকে ফোন করার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বার করে দেখলো যে ফোনের ব্যাটারি ডেড , নাম্বারটাও মনে নেই যে বৈশাখীর ফোন দিয়ে ফোন করবে । কোন রাস্তা না পেয়ে সুচি উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিকে খুঁজতে শুরু করলো ।

সারা কলেজ খোঁজার পর সুচির দুঃশ্চিন্তা হতে শুরু করলো। বৈশাখীও এতক্ষণ সুচির সাথেই আকাশকে খুঁজছিল। সে বললো , “ ওখানে খুঁজেছিস ? „

সুচি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো , “ কোথায় ? „

“ যেখানে ইউনিয়নের ছেলে গুলো বসে থাকে আর আড্ডা মারে ! „

সুচির দৃঢ় বিশ্বাস যে আকাশ ওইরকম নোংরা জায়গায় কখনোই যাবে না , “ না , আকাশ ওখানে থাকবে না । „

“ তবুও একবার দেখতে দোষ কি ! „

“ চল । „

এই কলেজেই পিছনের দিকে একটা জায়গা আছে যেখানে ধেড়ে ছেলেরা বসে আড্ডা মারে আর সিগারেট খায়। বেশিরভাগ সময় কলেজের ইউনিয়নের ছেলে গুলোকেই ওখানে দেখা যায়। তাই অন্যান্য ছেলেরা ওখানে যেতে সাহস করে না। সুচির বিশ্বাস আকাশ ওখানে যাবে না। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলো কৃষ্ণের অ্যপাচি বাইকের উপর আকাশ বসে আছে। কৃষ্ণ আর প্রভাকর নিচে দাঁড়িয়ে আছে । আর প্রভাকরের বাইকের উপর লাবনী বসে আছে। কিন্তু যে বিষয়টা অবাক করলো সেটা হলো কৃষ্ণ , প্রভাকর আর লাবনীর সাথে আকাশও সিগারেট খাচ্ছে । সিগারেট খাওয়া একবারেই অপছন্দ সুচির। সিগারেটের ধোঁয়ায় বুক জ্বালা করে। সিগারেট খেলে ক্যানসার পর্যন্ত হয়।

দাঁড়িয়ে আকাশের সিগারেট খাওয়া দেখতে দেখতে রাগে জ্বলতে শুরু করলো সুচি। আকাশের সিগারেট খাওয়া দেখতে দেখতে লাবনীর কথায় সুচির চমক ভাঙলো। আকাশ একবার সিগারেটে টান দিয়ে খোক খোক করে কাশতে লাগলো। সেটা দেখে লাবনী বললো , “ আসতে খাও। প্রথম প্রথম একটু কাশি হবে। তারপর বিন্দাস . .....

আর দেখতে পারলো না সুচি। এগিয়ে গেল সামনের দলের দিকে। এতক্ষণ পর সবাই সুচি আর বৈশাখী কে খেয়াল করলো। আকাশ সঙ্গে সঙ্গে বাইক থেকে নেমে সিগারেট পিছনে ফেলে দিল। সুচি এগিয়ে এসে হয়তো চড় মারতো। কিন্তু এতোগুলো বন্ধুর সামনে চড় মারাটা উচিত হবে না। তাই আকাশের সামনে গিয়ে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে প্রায় চিল্লিয়ে বললো , “ খুব বড়ো হয়ে গেছিস তুই ? এখন সিগারেট খাচ্ছিস । কিছুদিন পর তো বারে , পাবে যাওয়া শুরু করবি । তারপর মেয়েবাজী করবি। ......

একটানা কথা গুলো বলে সুচি একটু থামলো। আকাশ ভদ্র ছেলের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুচি আবার বলতে শুরু করলো , “ ও তোকে তো কিছু বলাও যাবে না । তোকে বললে তো তুই রাগ করবি , খাবার ছুড়ে ফেলে দিবি .......

আকাশ চুপচাপ মাথা নিচু করে সুচির কথা শুনছিল। শেষের কথাটা শুনে বুঝতে পারলো না কি বলছে। তারপরেই মনে পড়লো রেগে গিয়ে বকফুল ফেলে দিয়েছিল। সেটার কথাই হয়তো সুচি বলছে।

এদিকে সুচি বলে চলেছে , “ তোর মতো জানোয়ার লম্পট ছেলে আমি আমার জীবনে দেখিনি ! „ কথাটা বলেই সুচি পিছন ঘুরে চলে আসতো লাগলো ।

আকাশও সঙ্গে সঙ্গে সুচির পিছনে আসতে আসতে বললো , “ প্লিজ মাকে বলিস না। লাবনী এতো করে বললো তাই এই প্রথমবার টেস্ট করার জন্য খেলাম .......

লাবনীকে শুরু থেকেই সুচির অপছন্দ। এখন লাবনীর অনুরোধে আকাশ সিগারেট খেয়েছে শুনে সে আরও রেগে গিয়ে বললো , “ টেস্ট করার জন্য ! টেস্ট করার জন্য তুই মদ গাঁজাও খাবি তাহলে ......

সুচির রাগ দেখে আকাশ খুব ভয় পেয়ে গেল , “ প্লিজ এমন করিস না। আর কিছু খাবো না , কখনোই খাবো না। এই দেখ কান ধরছি ! „ বলে আকাশ কান ধরলো ।

সুচি সেদিকে না তাকিয়ে হন হন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে পার্কিংয়ে চলে এলো। তারপর পার্কিংয়ে রাখা স্কুটিটাকে স্ট্রার্ট দিয়ে বসে পড়লো। আকাশও নিজের ব্যাগ নিয়ে সুচির পিছনে বসে পড়লো। আকাশকে পিছনে বসতে দেখে সুচি বললো , “ তোর সাহস কি করে হলো আমার স্কুটিতে বসার। নাম বলছি ! „

“ প্লিজ এমন করিস না। প্লিজ তোর পায়ে পড়ি .......

সুচি আর এই অসভ্য ছেলেটার সাথে কথা বলতে চাইলো না। বলার ইচ্ছা নেই আর। তাই সে স্কুটি চালিয়ে দিল। আকাশের সন্দেহ ছিল সুচি যেন মা কে না বলে দেয়। তাই সে পুরো রাস্তা এটাই বলে গেল যে , “ প্লিজ মাকে বলবি না। আর কখনো খাবো না। মায়ের দিব্যি করে বলছি। প্লিজ তুই মাকে বলিস না। তাহলে মা আর আমাকে আস্ত রাখবে না ........

না । সুচি আকাশের মাকে কথাটা জানালো না। কিন্তু লাবনী যে সুযোগটা খুঁজছিল সেটা সে পেয়ে গেল। লাবনী এতদিন আকাশের থেকে সুচিকে কিভাবে দূরে সরানো যায় সেটাই ভাবছিল। সবার সামনে সুচি আকাশকে বকায় লাবনী এই সুযোগটা পেয়ে গেল ।

পরের দিন আকাশ কলেজে এলে লাবনী জিজ্ঞাসা করলো , “ সুচিদি তোমার কে হয় ? „

“ কেন ? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন ? বলেছিলাম তো ও আর আমি একসাথে বড় হয়েছি। বন্ধু আমরা .......

“ বন্ধু বন্ধুর মতো থাকবে। গার্ডিয়ান হতে যায় কেন ? „

“ মানে ? „

“ ও তোমার দিদি তো নয় যে তুমি কি খাও , কি পড়ো সেটা ঠিক করে দেবে। আর এতোগুলো বন্ধুর সামনে তোমাকে বকবেই বা কেন ? „

সুচির বিরুদ্ধে কথা শুনে আকাশ রেগে গেল। লাবনী আকাশের মুখ দেখেই সেটা বুঝতে পারলো। তাই কথা ঘুরিয়ে বললো , “ দেখো ! এই বয়সে সবাই একটু আধটু সিগারেট খায় কিংবা ড্রিংকস করে। এতে সমস্যা কোথায় ! এই বয়সে কতো টেনশন হয়ে তুমি তো জানো । পড়াশোনার চিন্তা , কেরিয়ারের চিন্তা , একটা ভালো জায়গায় স্টেবলিশ হওয়ার চিন্তা। আর এইসব চিন্তা দূর করার জন্য কেউ যদি সিগারেট খায় তাহলে দোষ কোথায় ? „

একটানা কথাগুলো বলে লাবনী থামলো। আকাশের মুখ দেখে লাবনী বুঝলো যে ডোজে কাজ হচ্ছে। এবার একটু ধীরে ধীরে বলতে হবে। তাই সে আবার বলতে শুরু করলো , “ দেখো আকাশ , আমি স্পষ্ট বক্তা এটা তুমি জানো। সোজাসুজি বলছি। একটা সিগারেট খাওয়ার জন্য এতোগুলো বন্ধুর সামনে ওই ভাবে হেনস্থা করা উচিত হয়নি ......

এই কথাগুলো বলতে বলতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। ক্লাসের ফাকে যখনই লাবনী সুযোগ পেয়েছে তখনই সুচির বিরুদ্ধে আকাশকে বলেছে। কলেজ শেষ হলে লাবনী আর আকাশ পার্কিংয়ে এলো। সুচির স্কুটির পাশে এসে লাবনী বললো , “ এখন তো দেখছি তুমি তোমার জীবনের কোনও ডিসিশন-ই নিজে নাওনি । সবই ওই তোমার সুচি নিয়েছে। তোমাকে আটকে রেখেছে ও , নিজের মর্জি মতো তোমাকে চালিয়েছে .....

লাবনীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সুচি চলে এলো। আকাশের সাথে এই মেয়েটাকে দেখে সুচি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। আকাশকে কিছু না বলে সুচি স্কুটি স্ট্রার্ট দিয়ে দিল। আকাশ পিছনে বসে লাবনীকে বায় বললো। সুচি সেটা গম্ভীর মুখ করে দেখলো কিন্তু কিছু বললো না।

স্কুটি চালিয়ে কিছু দূর আসার পর সুচি গার্ডিয়ানের মতো আদেশ করার সুরে বললো , “ এই মেয়েটার সাথে মেশার পর থেকেই তুই এইরকম আচরণ করছিস। ওর সাথে আর মেশার দরকার নেই । „

আকাশ সুচির গলার সুর শুনে লাবনীর কথা মনে পড়লো। ও বলেছিল ‘ বন্ধু বন্ধুর মতো থাকবে। গার্ডিয়ান কেন সাজতে আসছে। , লাবনীর কথাটা মাথাতে আসতেই আকাশ গম্ভীর হয়ে বললো , “ আমি বুঝতে পেরেছি তুই কি চাইছিস ! তুই চাস না আমি প্রেম করি তাই লাবনী আর আমরা মেলামেশা তোর কাছে বাধছে । .......

আকাশের কথা শুনে সুচির মনে হলো কেউ যে তার বুকে কাঁটা লাগানো চাবুক মারলো। সেই চাবুক রক্তাক্ত করে দিচ্ছে তার অন্তর। আকাশের কথা শুনে সুচির গলা বসে এলো , “ তুই কি কিছুই বুঝতে পারিস না ! „

সুচির স্কুটিতে বসে রাস্তার লোকজন, বাস দেখতে দেখতে আকাশ বললো , “ এতে বোঝার কি আছে ? খুব কম লোক জানে যে মা আমার বিয়ে তেইশ বছর বয়সে দিয়ে দেবে। আর এখন যদি আমি লাবনীর সাথে প্রেম করি তাহলে ওর সাথেই আমার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর তুই লাবনীকে একদম সহ্য করতে পারিস না সেটা তোর কথা থেকে বোঝা যায়.......

সুচি বুঝতে পারলো যে লাবনী আকাশের কান ভরেছে তাই আকাশ এই কথা গুলো বলছে। লাবনীর শেখানো কথা আকাশকে আওড়াতে দেখে সুচির বুকটা মুচড়ে উঠলো। লাবনী যেন তার হৃদয়ের যে স্থানে আকাশ আছে সেই স্থানে পা দিয়ে লাফিয়ে জায়গাটাকে নোংরা করেছে যাতে সেখানে আকাশ আর না থাকতে পারে। আর ঠিক এই কাজটা সে আকাশের হৃদয়েও করেছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে আকাশ সুচির বিয়ে হওয়া নিয়ে চিন্তায় ছিল , সুচির বিয়ের পর তাদের আর দেখা হবে না ভেবে কষ্ট পেয়েছিল , আজ সেই আকাশ নিজের বিয়ের কথা ভাবছে ।

সুচি যে কতোটা কষ্টে আছে সেটা কেউ বুঝতে পারে না। সুচি যে আকাশকে ভালোবাসে সেটা কাউকে না বলতে পারার যন্ত্রণা। আকাশ যে তার জীবনের কতোটা অংশ জুড়ে আছে সেটা আকাশকে না বলতে পারার ব্যাথা। আর এখন লাবনীর কথায় আকাশকে উঠবোস করতে দেখা। সব মিশে সুচির অন্তরটা চিল্লিয়ে কেঁদে উঠলো। এই দুঃখ , কষ্ট , জ্বালা , যন্ত্রণা কিছুতেই আর সহ্য হতে চাইছে না। সুচির মনে হলো সামনে বড়ো বড়ো বাসের নিচে স্কুটিটাকে ঢুকিয়ে দিই। মরলে দুজনেই একসাথে মরবো। সব জ্বালা যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়ে যাবো তখন।

আত্মহত্যা করার প্রবল ইচ্ছা হলেও সুচি কিছু করলো না। হেলমেটের ভিতর দিয়েই অনবরত চোখের জল বার হতে লাগলো। কেউ খেয়াল-ই করতে পারলো না। যার খেয়াল করার কথা সেও দেখতে পেল না।

বাড়ি ফিরে চোখে মুখে জল দিয়ে সুচি চুপচাপ খাটের উপর বসে রইলো। সুমি অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই সুচি দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সব বললো। লাবনীর কথা, লাবনীর সাথে বসে সিগারেট খাওয়ার কথা , এমনকি আজকে আকাশের বলা কথা গুলো। সবকিছু বলে মনটাকে হাল্কা করে সুচি খাটে শুয়ে রইলো।

এখন নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে সুচির। কেন সে ওই ছ্যাচড়া ছেলেটাকে ভালোবাসলো ? কিভাবে ভালোবাসলো ওই জানোয়ারটাকে ? শুধু কি একসাথে বড়ো হয়েছে সেইজন্য ! নাকি সময়ে অসময়ে তার খেয়াল রেখেছে তাই জন্য ! নাকি সুচির পছন্দ অপছন্দ আকাশ জানে তাই সে তাকে ভালোবেসেছে ! এইসব প্রশ্নের উত্তর সুচি খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোন উত্তর সে পেল না।

রাতে বোনের পাশে শুয়ে সুমি বললো , “ তোকে এতদিন ধরে যেটা বলতে পারিনি এখন সেটা বলছি। এখন বলাটা দরকার। খুব দরকার .......

কি এমন কথা যা এতদিন বলেনি কিন্তু আজ বলছে ! কি এমন কথা যা বলাটা খুব দরকার ! এইগুলো ভাবতে ভাবতে সুচি দিদির দিকে পাশ ফিরে শুলো । সুমিও বোনের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে বললো, “ তুই তো বলেছিলি গৌরব তোকে পছন্দ করে। তাহলে ওর সাথেই রিলেশনে যা....

দিদির কথা শুনে সুচির বুকটা মুচড়ে উঠলো , “ আমি পারবো না দি ! আমি পারবো না । „ বলতে বলতে চোখে জল চলে এলো সুচির।

সুমি আর কথা বাড়ালো না। পরের দিন থেকে সুচি আর কলেজ গেল না। আর যেতে ইচ্ছা করছে না ওখানে। বিশেষ করে লাবনীর মুখটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

সুচি কলেজ না যাওয়ায় পরপর দুই দিন আকাশও কলেজ গেল না । লাবনী মেসেজে লিখলো ---- কলেজে এলে না যে !

আকাশ ---- সুচির কলেজ যেতে ভালো লাগছে না তাই !

লাবনী ---- কেন ? সুচি দি কলেজ আসছে না কেন ?

আকাশ ---- জানিনা। সেদিন বাড়িতে আসার সময় ওকে বলেছিলাম ওই কথা গুলো। তারপর থেকে আর কথা বলছে না আমার সাথে ঠিক করে।

লাবনী ---- কথা বলবে কি করে ? ওর তো মুখোশ খুলে গেছে। মুখ দেখানোর মতো আর আছে নাকি কিছু।

আকাশ এর উত্তরে মেসেজে কিছু লিখলো না। আকাশের রিপ্লাই না পেয়ে লাবনী লিখলো ---- মনে আছে তো ! কালকে আমরা শপিংয়ে যাচ্ছি । আর অষ্টমীতে ঠাকুর দেখতে যাবো।

আকাশ --- হ্যাঁ মনে আছে।

এক সপ্তাহ পরেই মহালয়া চলে এলো। এবছর একটা কাজ থাকায় আকাশের মামা মামি এলো না। মহালয়ার পর দেখতে দেখতে অষ্টমী চলে এলো। সুচি একবারও ঘর থেকে বার হলো না। সুমি রেগে গিয়ে বললো, “ এইভাবে ঘরে পড়ে থাকলে তো আরও মন খারাপ করবে। একটু বাইরে যা ঘোর। এবছর ঠাকুর দেখতে যাবি না তোরা ? „

সুচি উদাস মনে বললো, “ প্ল্যান তো আছে। কিন্তু আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। „

সুমি এবার বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ শোন আমার কথা। এমন করিস না। বাইরে গিয়ে সবার সাথে ঘোর। মনটা হাল্কা হবে। আর গৌরবের কথা ভেবে দেখিস....

“ ভাবার মত কিছু নেই দি। আমি পারবো না। „

“ তাহলে ঠাকুর দেখতে যা। ওঠ । „

দিদির জেদের কাছে সুচি হার মানলো। একটা মেসেজ করে বৈশাখীকে বলে দিল যে সেও যাচ্ছে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে সাজার পর বৈশাখীর মেসেজ পেল। ওরা বাইরে অপেক্ষা করছে।

ফ্ল্যাটের বাইরে এসে সুচির মনে হলো ‘ আকাশকে একবার নিজের সাজ দেখাই। , তাই সে আকাশের ফ্ল্যাটের বেল বাজালো । স্নেহা দেবী দরজা খুলে হলুদ শাড়ী পরিহিত মাথায় খোপা দেওয়া সুচিকে দেখে বললেন , “ ও মা ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে । ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিস বুঝি ! „

“ হ্যাঁ কাকি। ওই বন্ধুদের সাথে যাচ্ছি । সন্ধ্যায় নাচের আগেই ফিরে আসবো। বলছি আকাশ কোথায় ? „

“ আকাশ তো এই কিছুক্ষণ আগে ঠাকুর দেখতে চলে গেল । „

“ ও। আমি আসছি কাকি। „ বলে সুচি সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলো।

“ হ্যাঁ আয় । দুগ্গা দুগ্গা । „ বলে স্নেহা দেবী দরজা দিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তাকে সোসাইটির প্যান্ডেলে গিয়ে দেখতে হবে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না।

সুচি সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বুঝতে পারলো যে ‘ আকাশ হোক না হোক লাবনীর সাথেই ঠাকুর দেখতে গেছে। , লাবনীর কথা মাথাতে আসতেই মুখটা তেতো হয়ে গেল সুচির । বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে পাথরের ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে সোসাইটির বাইরে আসতে লাগলো। সোসাইটির গেটে গৌরব বোলেরে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে সোসাইটির ভিতরে তাকিয়ে দেখলো যে সুচি আসছে। সুচির রুপ দেখে গৌরবের চোখের পলক পড়লো না। একটা হলুদ শাড়ি আর হলুদ ব্লাউজ। শাড়িতে বিভিন্ন ফুল আঁকা। বরাবরের মতোই কাজল টানা কালো হরিন চোখ। ঠোঁটে একদম হালকা গোলাপি লিপস্টিক মাখা। গৌরবের মনে হলো ‘ এই ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট না বসালে জীবনটাই বৃথা। ‚ সুচির মাথার চুল কিছুটা খুলে রাখা আর কিছুটা খোপা বাঁধা। হাই হিল জুতোয় সুচিকে আরও লম্বা দেখাচ্ছে । হাতে আছে দুটো সোনার বালা আর কয়েকটা কাঁচের চুড়ি। আর গলায় একটা সিটি গোল্ডের হার।

সুচি সোসাইটির বাইরে এসে দেখলো গৌরব তার বোলেরো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে বৈশাখীর সাথে আরো দুজন মেয়ে বন্ধু আছে। তারা সবাই পিছনে বসেছে তাই সুচি সামনে গৌরবের পাশে বসতে বসতে বললো , “ আমাকে কিন্তু সাতটার আগে ফিরতে হবে । „

পিছনের সিট থেকে বৈশাখী বললো , “ জানি বাবা জানি। চাপ নিস না। তোর নাচ আছে বলেই আমরা সেইভাবে প্ল্যানটাকে ঘুরিয়েছি । „

সুচির সৌন্দর্য কিছুক্ষণ উপভোগ করে গৌরব গাড়ি চালিয়ে দিল। এদিকে আকাশ আর লাবনী বেশ কয়েকটা ঠাকুর দেখে নিল। আকাশের মনে হতে লাগলো ‘ এতদিন যে প্রেমিকার সন্ধান সে করেছে আজ সেই প্রেমিকাকে সে পেয়ে গেছে। ‚ ছটা বাজতেই আকাশ লাবনীকে বললো , “ এবার আমার যেতে হবে লাবনী। না হলে সুচি খুব রাগ করবে। „

লাবনী ভেবেছিল আজ সে আর আকাশ হোলনাইট ঠাকুর দেখবে। হঠাৎ আকাশ চলে যেতে চাইলে লাবনী রেগে গেল, “ কেন ? ও রাগ করবে কেন ? „

“ প্রত্যেক বছর সুচি আমাদের সোসাইটির ফাংশনে নাচে। আর ওর নাচ না দেখলে চন্ডীর রূপ ধারন করবে । „

“ এতো ভয় পাও কেন ওকে ? „

“ ঠিক ভয় পাই না। আসলে ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে বড়ো হয়েছি। আর ওর নাচ যদি আমি না দেখি তাহলে ও খুব কষ্ট পাবে। ওকে কষ্ট দিতে আমি চাই না । „

আকাশের কথায় লাবনী বুঝলো যে আকাশের মন থেকে সুচিকে সরাতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। তার জন্য দরকার ধৈর্য্য আর সময়। আসতে আসতে এগিয়ে যেতে হবে । কোন তাড়াহুড়ো করলে চলবে না , “ ঠিক আছে। এসো । „ বলে আকাশের গালে একটা চুমু খেলো।

এই প্রথম কেউ আকাশের গালে চুমু খেল। আকাশের কি যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝানোর নয়। লাবনীকে বায় বলে আকাশ একটা অটো ধরলো।

সাড়ে ছটার মধ্যে বেশ কয়েকটা বিখ্যাত ঠাকুর দেখে সুচি বাড়ির দিকে রওনা দিল। রাস্তায় বৈশাখী আর আরও দুইজন নেমে গেছে। সোসাইটির সামনে গৌরব গাড়ি দাড় করালো। আজকে সুচির রুপ দেখে গৌরব মনে মনে ভেবে নিয়েছে যে সে বড়ো কোন পদক্ষেপ নেবেই ।

সোসাইটির সামনে গাড়ি দাড় করিয়ে গৌরব আসতে আসতে নিজের মুখটা এগিয়ে আনলো সুচির মুখের দিকে। সুচি বুঝলো গৌরব তাকে চুমু খেতে চাইছে। ঠাটিয়ে একটা চড় কষাতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু তখনই দিদির কথা মনে পড়ে গেল । তাই সে আর চড় মারলো না। গৌরবকে কিছু বলবে বলে ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে দেখল ঠিক তাদের পাশেই একটা অটো থামলো। অটো থেকে পাঞ্জাবি পড়ে আকাশ নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। তারপর হন হন করে সোসাইটির গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

সাদার উপর সোনালী রঙের সুতোর কারুকার্য করা পাঞ্জবী পরিহিত আকাশকে দেখে সুচির বেহায়া মন সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রেমের রসে ভরে উঠলো। গৌরবের উপর রাগটা নিমেষে জল হয়ে গেল। আজ এই তিন ঘন্টা ঠাকুর দেখার সময় সুচির মনটা তার প্রেমিক আকাশের সঙ্গ চাইছিল খুব। সেটা সুচি খুব ভালো করে বুঝতে পারছিল। সুচির মনে হচ্ছিল যেন এই বন্ধু বান্ধবদের ভিড়ের মধ্যে থেকেও একা। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে সোসাইটির ভিতর ঢুকে পড়লো সে । আর গাড়ির ভিতর গৌরব কিছু না বুঝে উঠতে পেরে হতভম্বের মতো বসে রইলো।

গৌরব হতভম্বের মতো বসে রইলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো ‘ একটা পদক্ষেপ ব্যার্থ হয়েছে তো কি হয়েছে ? আরও একটা আছে। সুচি ওকে তার নাচ দেখার জন্য ইনভাইট না করলেও গৌরব আজ সুচির নাচ দেখবেই। ‚ কথাটা ভেবে নিয়ে সে গাড়িটা বাইরের রাস্তায় পার্ক করে সোসাইটির ভিতরে ঢুকলো।

অন্ধকার হয়ে গেছে। সোসাইটির রাস্তা টুনি লাইটের আলোয় ভরে গেছে। চারিদিকে লাল , নীল , হলুদ , সবুজ আলো ঝিকমিক করছে। বাচ্চারা এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। কেউ খেলনার বন্দুক নিয়ে কাউকে গুলি করার অভিনয় করছে। আর বড়োরা একে অপরের সাথে গল্প করছে। গাড়ি থেকে নেমে সুচি এগিয়ে গেল আকাশের দিকে। আকাশের পাশে এসে দাড়িয়ে বললো , “ ঠাকুর দেখতে গেছিলি ? „

সুচিকে দেখে আকাশ খুব খুশি হলো। গত এক সপ্তাহ ঠিক মতো কথা বলতে পারে নি। এখন দেখা পেয়ে আকাশের মনটা খুশিতে ভরে উঠলো , “ হ্যাঁ ওই বন্ধুদের সাথে গেছিলাম। „

বন্ধুদের সাথে মানেই লাবনীর সাথে গেছিল । কিন্তু এখন কেন চলে এলো আকাশ ? এটা ভেবেই সুচি জিজ্ঞাসা করলো , “ এখন চলে এলি ? „

আকাশ বললো , “ তোর নাচ আছে না আজকে। তোর নাচ আমি দেখবো না তা কখনো হয়েছে ! „

সুচি খুব খুশি হলো আকাশের কথা শুনে। আকাশ তার সব বন্ধুদের ছেড়ে এমনকি ওই লাবনীকে পর্যন্ত রাস্তায় রেখে দিয়ে আকাশ এখন বাড়ি চলে এসেছে শুধু সুচির নাচ দেখবে বলে। মুখে হাসি নিয়ে সুচি বললো , “ এই পাঞ্জাবিতে তোকে দারুণ দেখাচ্ছে। „

“ থ্যাংকস , তবে ধন্যবাদটা লাবনীর প্রাপ্য। ওই এই পাঞ্জাবিটা পছন্দ করে দিয়েছে । „

লাবনীর পছন্দ করে দেওয়া শুনে নিমেষেই সুচির মুখটা তেতো হয়ে বুকটা বিষিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো , “ আমাকে কেমন দেখাচ্ছে ? „

আকাশ মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুচিকে দেখতে দেখতে বললো , “ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে। হলুদে তোকে খুব ভালো.......

আকাশের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাসসসসসস করে একটা আওয়াজ হলো।

আকাশ যখন মুখমন্ডল ঘুরিয়ে সুচিকে দেখছিল তখন সোসাইটির চমকপ্রদ ঝিকমিক লাইটের আলোয় আকাশের গালে ঠোটের আকৃতির লাল রঙের লিপস্টিকের দাগ চকচক করে উঠলো । আকাশের বাঁ গালে কেউ একজন চুমু খেয়েছে। নিশ্চয়ই লাবনী। আর সহ্য করতে পারলো না সুচি ! ঠাস ঠাস করে তিন চারটে চড় বসিয়ে দিল আকাশের গালে।

সুচির বজ্রকঠিন মুখে দুই চোখের জল বয়ে যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষের গালে অন্য কোন মেয়ের চুম্বনের দাগ দেখলে একটা মেয়ের কতোটা কষ্ট হয় তা বোঝানোর জন্য কোন ভাষাই পর্যাপ্ত নয়। আজ আকাশের গালে লাবনীর ঠোঁটের চিহ্ন দেখে সুচির বুকে কতোটা আঘাত লাগলো তা বোঝাতে কোন কাব্যই যথেষ্ট নয়। এতোটা যন্ত্রণা কখনো হয়নি সুচির। রাগে উল্টোপাল্টা গালাগালি দিতে দিতে সুচি বললো , “ বেহায়া , নির্লজ্জ ছেলে মেয়েবাজী করে এসছিস তুই। তোর সাহস কি করে হলো এইসব করার ? „ বলে আরও একটা চড় আকাশের গালে বসিয়ে দিতে যাচ্ছিল।

আর না। সুচির দাদাগিরি অনেক সহ্য করেছে। কিন্তু আর না। সুচির হাতটা ধরে ফেললো আকাশ।

সুচির প্রথম চড়ের আওয়াজেই সোসাইটি গমগম করে উঠলো। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে এদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর পরপর তিন চারটে চড়ে সবাই এগিয়ে এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এদিকে গৌরব প্রথম থেকেই সুচি আর আকাশের কথা শুনছিল। এখন সেও পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ দাড়িয়ে দেখতে লাগলো। আর সুচির কথাগুলো শুনতে লাগলো।

আকাশ সুচির ডান হাত ধরতেই বাম হাত দিয়ে একটা চড় কষিয়ে বললো , “ তোর সাহস কি করে হলো আমার হাত ধরার। লম্পট চরিত্রহীন ছেলে তোকে ভালোবাসাই আমার ভুল হয়েছে .......

শেষের কথাটা শুনেই আকাশ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো। ঠিক শুনলাম তো ! সুচি আমাকে ভালোবাসে ! নাকি ভুল শুনলাম। এইসব ভাবতে ভাবতে আকাশ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

এদিকে সুচি আরও দুটো চড় মেরে হাতের চুড়ি ভেঙে ফেললো। সেই চুড়ি ফুটে গিয়ে আকাশের গাল কেটে গিয়ে রক্ত বার হতে লাগলো । আশেপাশে যে লোক জমা হয়ে দেখছে সেদিকে সুচির খেয়াল নেই । আকাশের মা নিচেই পুজার কাজ দেখছিলেন। তিনিও ছুটে এসে দেখলেন সুচি আকাশকে মারছে। সুচির চুড়িতে তার একমাত্র ছেলের গাল কেটে রক্ত বার হচ্ছে। তিনি থামাতে গেলেন কিন্তু তার আগেই তিনি শুনলেন ...

আকাশের রক্তাক্ত গালে এলোপাতাড়ি চড় মারতে লাগলো সুচি। আজ আকাশের গালে লাবনীর ঠোঁটের দাগ দেখে যতোটা কষ্ট হলো ততোটা আর কখনো হয়নি। সবকিছু ভুলে গেছে সে। ভাঙা হৃদয় এখন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। দিদির কাছে সবকিছু স্বীকার করার পরে এখন ব্যাথা গুলোও যেন আরও বেশি ব্যাথা দেয়। সুচির মন এখন শুধু নিজের ভালোবাসা চায়। আজ সুচি এতোটাই কষ্ট পেলো যে ! যে কথাটা মেয়েরা কখনোই বলতে চায়না সেই কথাটাই সুচি বলে ফেললো। সবকিছু ভুলে গিয়ে সুচি আকাশকে মারতে মারতে বললো , “ তুই শুধু আমার। শুধু আমার .....

এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্নেহা দেবী দাঁড়িয়ে পড়লেন। কি হলো ব্যাপারটা ? ঠিক শুনলেন তো !

“ তুই শুধু আমার। „ কথাটা বলার পরেই সুচির হুশ ফিরলো। আশেপাশের লোক জড়ো হয়ে তামাশা দেখছে সেটা খেয়াল হতেই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল। আকাশ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এলো।

সুচি কাঁদতে কাঁদতে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকলো। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। বালিশ ভিজে যেতে লাগলো সুচির চোখের জলে । সুমি আর সুমির মা লিভিংরুমেই বসে ছিল। সুচিকে এইভাবে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকতে তারা খুব অবাক হলেন। সুমি উঠে গিয়ে সুচিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। সুচি কাঁদতে কাঁদতে বললো, “ সব শেষ দিদি। সব শেষ। „

আকাশের মা উপরে উঠে এসে দেখলেন আকাশ খাটে শুয়ে আছে। তিনি বাথরুম থেকে সেভলন এনে তুলোয় লাগিয়ে ছেলের মুখে চুড়ির আঁচড়ে লাগিয়ে দিতে লাগলেন। সেভলন লাগানোর সময় তিনি বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে লজ্জা পেয়ে হাসছে। অন্য সময় হলে হয়তো আকাশের মাও হেসে ফেলতেন। কিন্তু তিনি হাসতে পারলেন না। কারন আকাশের বাবা এসে সব শুনে কি করবেন সেটাই তিনি জানেন না। তাই আকাশের মা ভয় পেতে লাগলেন।

অফিসের সবাইকে মহালয়ার আগেই ছুটি দিয়েছিলেন আকাশের বাবা। দারোয়ান থাকলেও এক দুই দিন অন্তর অন্তর অফিস গিয়ে একবার দেখে আসেন তিনি। আজকেও তিনি অফিসের চক্কর মারতে গেছিলেন। দেখতে গেছিলেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। অফিসের চক্কর মেরে এসে গাড়িটা বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড় করিয়ে গাড়ির বাইরে আসতেই সোসাইটির তিন চারজন লোক আকাশের বাবার দিকে এগিয়ে এলো। আকাশের বাবা ওদের দেখে খুশি মনে বললেন , “ শুভ মহা অষ্টমী। „

ওরাও শুভ মহা অষ্টমী বলে আকাশের বাবাকে শুভেচ্ছা দিলেন। তারপরও তারা গেল না। উশখুশ করতে লাগলো সবাই। আকাশের বাবা সেটা লক্ষ্য করে বললেন , “ কিছু বলবে ? „

প্রত্যেক পাড়ায় বা সোসাইটিতে এমন কিছু মানুষের দেখা পাওয়া যায় যারা এর কথা ওর কাছে বলে মজা পায়। আকাশের বাবার সামনে যে তিন চার জন দাঁড়িয়ে তারাও এই দলের। আকাশের বাবার জিজ্ঞাসায় একজন সাহস করে বলেই ফেললো, “ ওই মেয়েটা মানসিক রোগী। কি মারটাই না মারলো আপনার ছেলেকে । „

আকাশকে কোন এক মানসিক রোগগ্রস্ত মেয়ে বা মহিলা মেরেছে। কথাটা বুঝতে পেরে আকাশের বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভীষণ রেখে গিয়ে রাগি স্বরে বললেন , “ কে মেরেছে আমার ছেলেকে ? „

“ ওই সমরেশদার ছোট মেয়ে। দেখেই তো মনে হয় মানসিক রোগী। কিভাবে মারলো আপনার ছেলেকে। মুখ কেটে রক্ত বার হচ্ছিল। „

সুচির নাম শুনেই আকাশের বাবা ধন্দে পড়ে গেলেন , “ কেন ! মারলো কেন ? „

“ সে আপনি বৌদির কাছে জানবেন। বৌদিও তো ছিল ওখানেই। „

আকাশের বাবা আর কিছু শুনতে পারলেন না। অতো ধৈর্য্য নেই ওনার। প্রায় দৌড়ে উপরে উঠে ঘরের বেল বাজালেন। স্নেহা দেবী দরজা খুলে আকাশের বাবার রাগী মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। কাঁপা এবং ভীত কন্ঠে বলতে শুরু করলেন , “ দেখো মাথা ঠান্ডা করো রাগ করো না। „

আকাশের বাবা ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, “ আকাশকে মারলো আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে ? কিছু বললে না । „

আকাশের মা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। কিন্তু তিনি এটা জানেন যে প্রথম তাকে তার স্বামীকে শান্ত করাতে হবে , “ শোন , শান্ত হও। রাগ করো না ......

আকাশের বাবা আরও রেগে গেলেন , “ তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো কি করে ? আর নিজেও শান্ত আছো কি করে ? „

“ শোন , তুমি বসো। এখানে বসো । „ বলে সোফায় টেনে নিয়ে গিয়ে বসালেন।

“ বলো কি হয়েছিল । „ আকাশের বাবা এবার শান্ত হলেন। তিনি আসল কারনটা জানতে চান।

স্নেহা দেবী সব বললেন এবং এও বললেন যে তিনি কিছু না করে দাঁড়িয়ে কেন গেছিলেন। সব শুনে আকাশের বাবার রাগ গলে জল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর জিজ্ঞাসা করলেন , “ আর একবার বলো তো ঠিক কি বলেছিল সুচি ? „

আকাশের মা খুব লজ্জা পেলেন। মাথা নিচু করে বললেন, “ ও বলেছিল তুই শুধু আমার । তোকে ভালোবাসা-ই আমার ভুল হয়েছে। „

কথাটা শুনে আকাশের মতো আকাশের বাবার ঠোটেও হাসি দেখা দিল। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে তিনি বললেন , “ আকাশ কোথায় ? „

“ ঘরে শুয়ে আছে। আমি সেভলন লাগিয়ে ব্যান্ডেট লাগিয়ে দিয়েছি .....

স্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার আগেই শুভাশীষ বাবু উঠে শাশুড়ির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। এটাই তো এখন আকাশের ঘর। আকাশের বাবা ঘরের দরজা ঢেলে ভিতরে দেখলেন আকাশ শুয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে আকাশের পাশে বসলেন। আকাশ বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসে রইলো। শুভাশীষ বাবু ছেলের মুখে দেখলেন চার জায়গায় ব্যান্ডেট লাগানো তবুও কয়েকটা জায়গায় চুড়ির আঁচড় বোঝা যাচ্ছে , “ জ্বালা করছে ? „

“ না তেমন না। তুমি প্লিজ জেঠুকে কিছু বলো না । „ আকাশের এখন চিন্তা হতে লাগলো যে বাবা যেন জেঠুকে কিছু না বলে।

শুভাশীষ বাবু কিছু না বলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। আকাশ খুব কম বাবার সাথে কথা বলে। আর এইভাবে তো কখনোই কথা বলে না। আজ যেন ছেলেকে একটু বেশিই সাহসী দেখলো। মনে মনে খুশি হয়ে তিনি উঠে চলে এলেন। তারপর পুরো রাতে মাঝেমাঝেই আকাশের বাবার ঠোঁটে হাসি দেখা দিল। স্ত্রী যদি দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে তাই খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলাচ্ছেন।

এদিকে কিছুক্ষণ পর সমরেশ বাবু সোসাইটিতে ঢুকতেই কয়েকজন এসে বলতে শুরু করলো , “ মেয়েকে একটা ভালো ডাক্তার দেখান। বলা নেই ! কওয়া নেই যাকে তাকে মারছে। „

সুচির বাবা আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি এদের কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না , “ কি বলছো কি তোমরা । „

“ ঠিক বলছি। আপনার ওই মানসিক রোগগ্রস্ত মেয়েকে সামলান। বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াচ্ছে । „

আর শুনতে পারলেন না সমরেশ বাবু। এতো অপমানিত তিনি কখনো হননি। সোজা উপরে উঠে এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ কি করেছে তোমার মেয়ে ? সোসাইটির লোক ওকে মানসিক রোগগ্রস্ত বলছে কেন ? „

স্বামীকে এতো রেগে যেতে সুচেতা দেবী কখনোই দেখেন নি। তিনি ভয় পেয়ে বললেন , “ আকাশকে মেরেছে.....

আর কিছু শুনলেন না সুচির বাবা। সুচি কেন আকাশকে মেরেছে সেটা জানতে চাইলেন না। “ কোথায় তোমার মেয়ে ? „ বলে সুচির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সুচি সুমি কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে । শাড়ি তার আলুথালু অবস্থা। চোখের জলে মেকআপ ধুয়ে গেছে অনেক আগে। চোখের জলে কাজল ধুয়ে গিয়ে কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছে। চুল অগোছালো উন্মাদিনীর মতো। হাতের চুড়ি ভেঙে আকাশের গালের সাথে নিজের হাতটাকেও ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করেছে।

ঘরে ঢুকে মেয়েকে একটা চড় মারলেন। তারপর সেই রাগী গলায় বললেন “ তোকে সবাই নিচে মানসিক রোগগ্রস্ত বলছে। তোর জন্য আজ আমি একজন মানসিক রোগগ্রস্ত মেয়ের বাবা। তোর জন্য আমি সোসাইটিতে আর মুখ দেখাতে পারবো না । তোর জন্য আমাকে আজ এতো অপমানিত হতে হলো। কতবার বারন করেছি ওই ছেলেটার সাথে মিশিস না .......

সুচি খাট থেকে নেমে বাবার পা জড়িয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো “ বাবা , আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা । আমি আর এমন কখনো করবো না। কখনো আকাশের কাছে যাবো না .......

“ যাবি তো তখন যখন আমরা এখানে থাকবো। তোর জন্য কি আর আমরা এই সোসাইটিতে থাকতে পারবো.....

কান্নার জন্য সুচির হেচকি উঠতে শুরু করলো। “ বাবা তুমি এমন করো না বাবা। আমি মাড়া যাবো বাবা.....

বাড়ি বদলানোর কথা তো তিনি বললেন। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। কারন বিজয়া দশমীর দিন দুই পরেই কৌশিক আর তার মা সুমিকে দেখতে আসছে। যদি বিয়ের পাকাপাকি কথা হয়ে যায় তাহলে তো অনেক খরচা। বড় মেয়ের বিয়ের কথা মাথাতে আসতেই সুচির বাবার রাগটা কমতে লাগলো , “ আর কোনদিনও যদি মিশতে দেখেছি ওর সাথে সেদিন তোকে ত্যাজ্যপুত্র করবো আমি । „ বলে তিনি চলে গেলেন

কিছুক্ষণ পর মাইকে নাম ঘোষণা হলো ---- সুচিত্রা তালুকদার তুমি যেখানেই থাকো মঞ্চে চলে আসো। আর কিছুক্ষণ পরেই তোমার নাচ শুরু হবে । তুমি যেখানেই থাকো মঞ্চে চলে আসো। পরপর চারবার নাম ডাকার পর আর নাম ডাকলো না। এই প্রথম সুচি হেরে গেল।

সারারাত দিদিকে জড়িয়ে ধরে সুচি কাঁদলো । আকাশ খাটে শুয়েই ঠোঁটে হাসি নিয়ে সুচির বলা কথাটা ‘ তুই শুধু আমার ‚ ভাবতে ভাবতে লাজুক হাসি হাসতে হাসতে খাটের এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। মনে মনে লাবনীকে অজস্র ধন্যবাদ দিতে লাগলো। আজ লাবনীর জন্যেই সুচি তাকে ভালোবাসার কথা বলেছে।

এদিকে শুভাশীষ বাবু যতোই নিজেকে সংযমে রাখার চেষ্টা করুক না কেন মাঝে মাঝেই তিনি হেসে ফেলছেন। স্নেহা দেবী স্বামীর হাসি দেখে কোন কারন খুঁজে পেলেন না। কিন্তু স্বামীর চরিত্র ভেবে নিয়ে তিনি মনে করলেন এটা ব্যাঙ্গের হাসি ।
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মিষ্টি মূহুর্ত ( উপন্যাস) চলছে :--- - by Bichitro - 16-11-2021, 09:04 AM



Users browsing this thread: 125 Guest(s)