15-11-2021, 10:19 PM
বেশ কয়েকদিন মায়ের দোয়া হোটেল বন্ধ , নিজের রান্না করে খেতে হচ্ছে , অন্য হোটেল এর খাবার মুখে রুচলেও পেটে সয় না। রজব এর দোকানের খাবার যে খুব উন্নত মানের এমন নয় , হয়ত পেটে সয়ে গেছে । রান্না নিয়ে বেশি ঝামেলা করিনি , ইন্সটেন্ট নুডোলস , পাউরুটি এসব দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছি । বাসার নিচে একটা ডিমের দোকান আছে , সেখান থেকে মাঝে মাঝে সেদ্ধ ডিম নিয়ে আসি । অবশ্য খাওয়ার দুশ্চিন্তার চেয়ে রজব এর জন্য বেশি চিন্তা হচ্ছে , রজব কর্মঠ মানুষ । খুব বড় কিছু না হলে রজব দোকান বন্ধ রাখার লোক না । কিন্তু খবর নেয়ার কোন উপায় জানা নেই , আমি মোবাইল ফোন ব্যাবহার করি না । এছাড়া রজব এর বাড়ি ও আমি চিনি না । রজব বেশ কয়েকবার নিয়ে যাবে বলেও নিয়ে যায়নি ।
কিছুদিনের মাঝে বাড়ির কাজ শুরু হবে , আমাকে মাসে ১৫ হাজার করে টাকা দেয়া হবে অন্য বাসা ভাড়া বাবদ । মন্দ নয় ব্যাপারটা । আমার অবশ্য বাসা ভাড়া করতে হবে না , মেজো আপার বাসায় বন্দোবস্ত হয়েছে । আমি অবশ্য না করেছিলাম , অনেকদিন একা একা থকার ফলে আমাকে একলা রোগে ধরেছে । বেশি মানুষ জন দেখলে কেমন জানি দম বন্ধ লাগে । সেদিন গিয়েছিলাম বাড়ির টাকা বুঝে আনতে , ফেরার সময় যখন বাস স্ট্যান্ড এ দাড়িয়ে আছি । প্রচুর মানুষের ভির , হঠাত আমি খেয়াল করলাম আমি ভয় পাচ্ছি , মনে হচ্ছে আমি কোথায় সেটা মনে করতে পারছি না । মনে হচ্ছে এই মানুষের ভির আমাকে পদদলিত করে মেরে ফেলবে । কোন রকম ভির ঠেলে বেড়িয়ে এসেছি । একটা অটো নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম । এর পর থেকে দিনের বেলা বাসা থেকে বের হচ্ছি না ।
টাকাটা আমাকে আনতে যেতে হয়েছিলো কারন টাকার প্রতি এখন আর সাদিক এর তেমন টান নেই । সুমির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে । খুব মুষড়ে পড়েছে সাদিক আর সুমি , আমাকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো সুমি , হতবিহবল আমি তেমন সান্তনা দিতে পারিনি । তবে আশ্চর্যের বিষয় আমার তেমন দুঃখ হয়নি । যতটুকু দুঃখ হয়ে ছিলো সেটা সুমি আর সাদিক এর জন্য । একটা জীবন দুনিয়ার মুখ দেখতে দেখতেও দেখতে পেলো না , নিঃসন্দেহে এটা দুঃখের একটি ব্যাপার । এছাড়া ভূমিষ্ঠ হওয়া মানুষের মৃত্যুর চেয়ে এটা কোন অংশে কম নয় । কিন্তু একজন পাষাণ হৃদয় এর অধিকারীর মতো আমার মনে সেই ভূমিষ্ঠ না হওয়া মানুষটির জন্য একটুও মায়া অথবা দুঃখ হয়নি । অথচ সুমি আর সাদিক এমন ভাবে কাদছিলো যেন মৃত ভ্রুন টি ওদের সাথে কোনদিন বসবাস করেছে ।
একটু ভুল বললাম মৃত ভ্রূণটি অবশ্যই সুমির সাথে বসবাস করেছে । গত পাঁচ মাস যাবত সুমির পুরোটা সত্ত্বা জুড়েই ছিলো সেই অসম্পূর্ণ মানুষ টি । কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম একজন মা পেটে বাচ্চা আসার সাথে সাথে মা হয়ে যায় , কিন্তু পিতার পিতা হয়ে ওঠা হয় যখন সে সন্তান কে প্রথমবার কোলে নেয় । আমার দুঃখ না লাগার কারন আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে দুনিয়ায় মায়ের মতো আর কেউ নেই , আমার তো মনে হয় , একজন মেয়ে জন্ম থেকেই মা হয়ে জন্ম নেয় , মা হওয়ার জন্য তার গর্ভে সন্তান আসার দরকার হয় না ।
সাদিক এর অনিচ্ছার কারনে তাই আমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে । আর তখনি মেজো আপার আগমন , সাথে দুলাভাই ।
“সৌরভ তুই এমন একটা কাজ করতে পারলি” এসেই প্রথম এই কথাটা বলছিলো মেজো আপা , দুলাভাই কিছু না বললেও ওনার মুখের অভিবেক্তি দেখে মনে হচ্ছে আমি যাই করে থাকি না কেনো উনিও সেটা মেনে নিতে পাড়ছেন না । অবশ্য আমার কিছু জিজ্ঞাস করতে হলো না , মেজো আপা নিজেই আমার সেই গুরতর অপরাধ এর কথা তুলে ধরলেন “ বাড়িটা বিল্ডার দের দিয়ে দিলি কাউকে কিছু জিজ্ঞাস ও করলি না , হতে পারে আমারা আমাদের ভাগ সুমির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি , কিন্তু বাপের বাড়ি তো , সুমি না বললে তো শেষ দেখাটাও দেখা হতো না”
“ আমি এতো কিছু চিন্তা করিনি রে আপা , আর সুমি তো বলেছে ই , এখন দেখ” কিন্তু মেজো আপা কে থামানো যায় না , অনেক কিছু বলার পর শেষে আসল পয়েন্টে এলো , বলল “তোর দুলাভাই এর সাথে একবার আলাপ তো করে নিবি”
এর পর দুলাভাই মুখ খুললেন , উনি এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন , “ কত দিচ্ছে ওরা?” ওনার স্বভাব সুলভ চালিয়াতি দৃষ্টি আমার দিকে তাক করলেন , আমি টাকার অঙ্ক বলতেই ওনার চোখ কপালে উঠলো , তারপর আপার দিকে তাকিয়ে বললেন “ দেখেছো আমি বলেছিলাম , একেবারে ঠকিয়েছে”
“ হু কোম্পানি ঠকিয়েছে না কে ঠকিয়েছে গিয়ে দেখো?” মেজ আপার ইংগিত আমি বুঝতে পারলাম , তবে আমি জানি সাদিক এমন করার মানুষ না । “ হুম্মম্মম্ম” সব্জান্তার ভাব এসে ভর করলো দুলাভাই এর উপর । তারপর জিজ্ঞাস করলেন “ফ্লাট কেমন দিচ্ছে?”
“৬০/৪০”
“ হুম্মম……… এটা ঠিক আছে , তবে টাকায় খুব ঠকিয়েছে তোকে”
“সুনলাম টাকা নাকি সব দিয়ে দিচ্ছিস সুমির জামাই কে?” মেজো আপা দ্রুত জিজ্ঞাস করলেন ,
“ সাদিক এর টাকার দরকার , আমি টাকা দিয়ে কি করবো”
“ তোর আর দুনিয়ায় কেউ নাই বুঝি? এই যে ভাগ্নি একটা বড় হচ্ছে , ওকেও তো কিছু দিতে পারতি”
এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা ছিলো না , তবে মনে মনে ঠিক করলাম , আমি যে ছটা ফ্ল্যাট পাবো তার মাঝে একটা তিতলির নামে আর দুটো বড় আপার দুই ছেলে মেয়ের নামে করে দেবো । বাকি তিনটা দিয়ে কি করবো কে জানে । সেদিন রাতে মেজো আপা থেকে সত্যি সত্যি থেকে গেলো । দুলাভাই অবশ্য থাকলো না , তিতলি বাড়িতে একা থাকবে এই জন্য । হোটেল এর খাবার আপা খাবে না , তাই বাজার করতে হলো , আপা সেই বাজার রান্না করে দুলাভাই কে খাইয়ে দিলো , আর তিতলির জন্য দিয়ে দিলো বাটি করে ।
রাতে আপা অনেক্ষন ধরে হিন্দি সিরিয়াল দেখলো , সাথে আমাকেও বসে থাকতে হলো । একা একা সিরিয়াল ও দেখতে পারে না, সিরিয়ালে একটা একটা গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা ঘটে আর আপা আমাকে এর পেছনের কারন খুলে বলে । রাত শোয়া এগারটা পর্যন্ত সিরিয়াল দেখে সেদিন ঘুমাতে গেলাম । ততক্ষনে আমার ঘুম চলে গেছে । আমি দশটায় ঘুমানোর লোক । দশটা যদি কোন রকমে সাড়ে দশটা হয় সে রাতে ঘুম হয় না ।
সেদিন ও ঘুম আসছিলো না , বিছানায় শুয়ে এপাশ , ওপাশ করছিলাম । হঠাত দেখি উঠানে কে জানি হাঁটছে । আমার ঘর যেটা এক সময় বাবা মায়ের ঘর ছিলো , আগুন্তুক এদিকেই এগিয়ে আসছে । একটু পরে আওয়াজ আরও স্পষ্ট হলো , ভাবলাম চোর টোর হবে , তাই সিদ্ধান্ত নিলাম শুয়ে থাকবো মটকা মেরে যা হওয়ার হোক । কিন্তু কৌতূহল বড় শক্ত জিনিস , কিশোর বয়সে অতি প্রাকিত কিছু দেখার বাসনা আমার ছিলো , চেষ্টাও করেছিলাম, দেখা মেলেনি কোনদিন । একটা মৃদু সম্ভাবনা সেদিন আবার সেই ইচ্ছা আমার ভেতর জাগিয়ে তুলেছিলো , জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই আমার হৃদ পিণ্ড ধক করে উঠেছিলো , কয়েক সেকেন্ড এর জন্য মনে হয়েছিলো সত্যি অতি প্রাকিত কিছু দেখেছি । একজন মহিলা , এলো করে সাড়ি পরা , হাঁটছে , ঠিক এলো মেলো হাটা নয় , তার নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে বলে মনে হলো । আমাদের বাড়ির একেবারে শেষের কোন হচ্ছে তার গন্তব্য ।
ভেবেছিলাম হতেই পারে , বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হবে তাই হয়ত এই বাড়ির সাথে জড়িত অশরীর কেউ এসেছেন , শেষ কটা দিন এর জন্য । প্রাথমে ভাবলাম আমার দাদি হবেন , এই বাড়ির প্রতি অগাধ টান ছিলো ওনার , ছোট বেলায় দেখেছি কোথাও গিয়ে দুটো দিন থাকতে চাইতেন না । স্বামীর ভিটে স্বামীর ভিটে বলে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইতেন । কিন্তু সম্ভাবনা নাকচ করে দিলাম, কারন আমার দাদি ছিলো বেটে খাটো মহিলা । ভাবলাম মা নয়ত ? একদম মায়ের মতো কাপড় পড়েছে , কিন্তু মায়ের তো এই বাড়ির জন্য তেমন কোন বাড়তি টান দেখিনি যে শেষ বার দেখতে আসবেন, বরং মাঝে মাঝে মনে হতো মা এই বাড়ি থেকে দুদিন এর জন্য অন্য কোথাও গেলে খুব খুশি হতেন। একবার আমরা সবাই মিলে কক্সবাজার গিয়েছিলাম , সেবার মা ভীষণ খুশি হয়েছিলো। আমার মনে আছে , বিচে বসে বাবার সাথে এমন করে কথা বলছিলো যেন নতুন বিয়ে হয়েছে দুজনের, তখন বুঝতে পারিনি তবে অনেক পরে যখন সেই দৃশ্য আনমনে চোখে ভেসে উঠেছিলো তখন এমনটাই মনে হয়েছিলো। তাই মায়ের আসার কথা নয় । কিন্তু ওই হাঁটার ভঙ্গি , ওই এক রকম দৈহিক গঠন।
ভয় আমি পাইনি , তবে আমার মস্তিস্ক ডাবল টাইম কাজ করছিলো , কে হতে পারে এই মহিলা , কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না। অনেক সময় মস্তিস্ক অতিরিক্ত কাজ করলে শরীর ঘেমে ওঠে আমার একটু ঘাম হয়েছিলো । রহসসময় সেই নারীর গন্তব্বে আমার জানালার পাশ দিয়েই যেত হতো , তাই যখন আরও কাছে চলে এলো , তখন আমার মস্তিস্ক একটু সময় এর জন্য শান্ত হলো , কারন ওই নারী আর কেউ নয় , মেজো আপা , একদম মায়ের মতই লাগছিলো ওকে । কিন্তু এতো রাতে মেজো আপা এখান দিয়ে যাচ্ছে কেনো ? ওর তো পোকার ভয় অনেক , আর বাড়ির পেছনের এই জায়গাটা পরিস্কার করা হয় না অনেক বছর , পোকা মাকড় তো থাকবেই , সাপ থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই । আর সেই পথেই কিনা আপা এমন করে হেঁটে যাচ্ছে তাও রাত দুপুরে ।
আপার কি সত্যি বাড়িটার জন্য এতো মায়া!!! , কই কোনদিন তো মনে হয়নি । আমার অন্য বোনদের তুলনায় মেজো আপা কেই আমি সবচেয়ে বেশি জানি , কোনদিন আমার মনে হয়নি এই বাড়ির প্রতি ওর টান আছে । উল্টো বাড়িটার প্রতি ওর অভিযোগ ছিলো প্রচুর , দেয়াল স্যাঁতসেঁতে , হাই কমোড নেই (তখন ছিলো না)। ভুত আছে এই বাড়িতে এসব কত কথা বলতো । আসলে মানুষের মন বোঝা বড় দায় , কেউ যদি বলে আমি একজন মানুষ কে খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি , তাহলে সে ডাহা মিত্থা বলছে এতে কোন সন্দেহ নেই । কেউ কোনদিন চিন্তাই করতে পারবে না মেজো আপা রাত বিরাতে জুঙ্গুলে এই বাড়ির পেছন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ।
আমার অনুমান সত্যি করে দিয়ে মেজো আপা বাড়ির শেষ কোনায় গিয়ে দাড়িয়ে পড়ল , তারপর এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে উবু হলো । আমি আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলেছিলাম , কিন্তু মেজো আপার কর্ম কলাপ আমাকে আবারো আগ্রহি করে তুলল। আসলে আমি একটু লজ্জা ও পাচ্ছিলাম , কারো গোপন কাজ দেখা আমার স্বভাব নয় । কিন্তু সেদিন আমার কৌতূহল আমাকে ভালো ভাবেই কুপোকাত করেছিলো ।
কিছুক্ষন খোঁড়াখুঁড়ির পর মেজো আপা একটা প্লাস্টিকের ময়লা ব্যাগ বের করে আনলো । কি আছে সেই ব্যাগে , আর এই জিনিস মেজো আপা কতদিন আগে রেখেছিলো এই যায়গায় ? প্রচণ্ড কৌতূহল সে রাতে আমাকে মেজো আপার উপর সাপাইং করতে বাধ্য করেছিলো । ঘরের ভেতর ঢুকে মেজো আপা যখন সোজা রান্না ঘোরে গিয়ে চুলা জ্বালাল আমি চুপি চুপি তখন রান্না ঘোরে উঁকি দিয়ে । সেই ছোট বেলার মতো মেজো আপা পড়তে বসেছে আমি চোরা চোখে ওকে দেখছি আর ভাবছি একে আমি বিয়ে করবো । মেজো আপার হাতে কিছু খাম , একটা পেন্সিল বক্স , একটা সুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ফুলের ডাঁটা , কিছু ভেঙ্গে যাওয়া চুড়ি । মেজো আপা কিছুক্ষন সেই জিনিস গুলির দিকে তাকিয়ে রইলো , তারপর একটা পাতিল নিয়ে সগুলি সেখানে রেখে আগুন ধরিয়ে দিলো । এদের শেষ ঠিকানা এখন হুমকির মুখে তাই এদের অস্তিত্ব ও আর থাকবে না । মেজো আপার না জানি কত দিনের লুকিয়ে রাখা সেই অপ্রয়োজনীয় সম্পদ গুলি নিজেদের আশ্রয় হাড়িয়ে চিতায় পুরতে লাগলো ।
আমি আর দাড়াই নি চলে এসেছিলাম , শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম , একটা বাড়ি না জানি কত মানুষের কত গোপন আড়াল করে রাখে । না জানি কত সৃতি নিজের গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখে । আচ্ছা আমার কি এমন কোন সৃতি লুকায়িত আছে? প্রশ্ন এসেছিলো আমার মনে , অনেক চিন্তা করেও কিছু বের করতে পারিনি ।
কিছুদিনের মাঝে বাড়ির কাজ শুরু হবে , আমাকে মাসে ১৫ হাজার করে টাকা দেয়া হবে অন্য বাসা ভাড়া বাবদ । মন্দ নয় ব্যাপারটা । আমার অবশ্য বাসা ভাড়া করতে হবে না , মেজো আপার বাসায় বন্দোবস্ত হয়েছে । আমি অবশ্য না করেছিলাম , অনেকদিন একা একা থকার ফলে আমাকে একলা রোগে ধরেছে । বেশি মানুষ জন দেখলে কেমন জানি দম বন্ধ লাগে । সেদিন গিয়েছিলাম বাড়ির টাকা বুঝে আনতে , ফেরার সময় যখন বাস স্ট্যান্ড এ দাড়িয়ে আছি । প্রচুর মানুষের ভির , হঠাত আমি খেয়াল করলাম আমি ভয় পাচ্ছি , মনে হচ্ছে আমি কোথায় সেটা মনে করতে পারছি না । মনে হচ্ছে এই মানুষের ভির আমাকে পদদলিত করে মেরে ফেলবে । কোন রকম ভির ঠেলে বেড়িয়ে এসেছি । একটা অটো নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম । এর পর থেকে দিনের বেলা বাসা থেকে বের হচ্ছি না ।
টাকাটা আমাকে আনতে যেতে হয়েছিলো কারন টাকার প্রতি এখন আর সাদিক এর তেমন টান নেই । সুমির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে । খুব মুষড়ে পড়েছে সাদিক আর সুমি , আমাকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো সুমি , হতবিহবল আমি তেমন সান্তনা দিতে পারিনি । তবে আশ্চর্যের বিষয় আমার তেমন দুঃখ হয়নি । যতটুকু দুঃখ হয়ে ছিলো সেটা সুমি আর সাদিক এর জন্য । একটা জীবন দুনিয়ার মুখ দেখতে দেখতেও দেখতে পেলো না , নিঃসন্দেহে এটা দুঃখের একটি ব্যাপার । এছাড়া ভূমিষ্ঠ হওয়া মানুষের মৃত্যুর চেয়ে এটা কোন অংশে কম নয় । কিন্তু একজন পাষাণ হৃদয় এর অধিকারীর মতো আমার মনে সেই ভূমিষ্ঠ না হওয়া মানুষটির জন্য একটুও মায়া অথবা দুঃখ হয়নি । অথচ সুমি আর সাদিক এমন ভাবে কাদছিলো যেন মৃত ভ্রুন টি ওদের সাথে কোনদিন বসবাস করেছে ।
একটু ভুল বললাম মৃত ভ্রূণটি অবশ্যই সুমির সাথে বসবাস করেছে । গত পাঁচ মাস যাবত সুমির পুরোটা সত্ত্বা জুড়েই ছিলো সেই অসম্পূর্ণ মানুষ টি । কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম একজন মা পেটে বাচ্চা আসার সাথে সাথে মা হয়ে যায় , কিন্তু পিতার পিতা হয়ে ওঠা হয় যখন সে সন্তান কে প্রথমবার কোলে নেয় । আমার দুঃখ না লাগার কারন আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম। আসলে দুনিয়ায় মায়ের মতো আর কেউ নেই , আমার তো মনে হয় , একজন মেয়ে জন্ম থেকেই মা হয়ে জন্ম নেয় , মা হওয়ার জন্য তার গর্ভে সন্তান আসার দরকার হয় না ।
সাদিক এর অনিচ্ছার কারনে তাই আমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে । আর তখনি মেজো আপার আগমন , সাথে দুলাভাই ।
“সৌরভ তুই এমন একটা কাজ করতে পারলি” এসেই প্রথম এই কথাটা বলছিলো মেজো আপা , দুলাভাই কিছু না বললেও ওনার মুখের অভিবেক্তি দেখে মনে হচ্ছে আমি যাই করে থাকি না কেনো উনিও সেটা মেনে নিতে পাড়ছেন না । অবশ্য আমার কিছু জিজ্ঞাস করতে হলো না , মেজো আপা নিজেই আমার সেই গুরতর অপরাধ এর কথা তুলে ধরলেন “ বাড়িটা বিল্ডার দের দিয়ে দিলি কাউকে কিছু জিজ্ঞাস ও করলি না , হতে পারে আমারা আমাদের ভাগ সুমির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি , কিন্তু বাপের বাড়ি তো , সুমি না বললে তো শেষ দেখাটাও দেখা হতো না”
“ আমি এতো কিছু চিন্তা করিনি রে আপা , আর সুমি তো বলেছে ই , এখন দেখ” কিন্তু মেজো আপা কে থামানো যায় না , অনেক কিছু বলার পর শেষে আসল পয়েন্টে এলো , বলল “তোর দুলাভাই এর সাথে একবার আলাপ তো করে নিবি”
এর পর দুলাভাই মুখ খুললেন , উনি এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন , “ কত দিচ্ছে ওরা?” ওনার স্বভাব সুলভ চালিয়াতি দৃষ্টি আমার দিকে তাক করলেন , আমি টাকার অঙ্ক বলতেই ওনার চোখ কপালে উঠলো , তারপর আপার দিকে তাকিয়ে বললেন “ দেখেছো আমি বলেছিলাম , একেবারে ঠকিয়েছে”
“ হু কোম্পানি ঠকিয়েছে না কে ঠকিয়েছে গিয়ে দেখো?” মেজ আপার ইংগিত আমি বুঝতে পারলাম , তবে আমি জানি সাদিক এমন করার মানুষ না । “ হুম্মম্মম্ম” সব্জান্তার ভাব এসে ভর করলো দুলাভাই এর উপর । তারপর জিজ্ঞাস করলেন “ফ্লাট কেমন দিচ্ছে?”
“৬০/৪০”
“ হুম্মম……… এটা ঠিক আছে , তবে টাকায় খুব ঠকিয়েছে তোকে”
“সুনলাম টাকা নাকি সব দিয়ে দিচ্ছিস সুমির জামাই কে?” মেজো আপা দ্রুত জিজ্ঞাস করলেন ,
“ সাদিক এর টাকার দরকার , আমি টাকা দিয়ে কি করবো”
“ তোর আর দুনিয়ায় কেউ নাই বুঝি? এই যে ভাগ্নি একটা বড় হচ্ছে , ওকেও তো কিছু দিতে পারতি”
এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা ছিলো না , তবে মনে মনে ঠিক করলাম , আমি যে ছটা ফ্ল্যাট পাবো তার মাঝে একটা তিতলির নামে আর দুটো বড় আপার দুই ছেলে মেয়ের নামে করে দেবো । বাকি তিনটা দিয়ে কি করবো কে জানে । সেদিন রাতে মেজো আপা থেকে সত্যি সত্যি থেকে গেলো । দুলাভাই অবশ্য থাকলো না , তিতলি বাড়িতে একা থাকবে এই জন্য । হোটেল এর খাবার আপা খাবে না , তাই বাজার করতে হলো , আপা সেই বাজার রান্না করে দুলাভাই কে খাইয়ে দিলো , আর তিতলির জন্য দিয়ে দিলো বাটি করে ।
রাতে আপা অনেক্ষন ধরে হিন্দি সিরিয়াল দেখলো , সাথে আমাকেও বসে থাকতে হলো । একা একা সিরিয়াল ও দেখতে পারে না, সিরিয়ালে একটা একটা গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা ঘটে আর আপা আমাকে এর পেছনের কারন খুলে বলে । রাত শোয়া এগারটা পর্যন্ত সিরিয়াল দেখে সেদিন ঘুমাতে গেলাম । ততক্ষনে আমার ঘুম চলে গেছে । আমি দশটায় ঘুমানোর লোক । দশটা যদি কোন রকমে সাড়ে দশটা হয় সে রাতে ঘুম হয় না ।
সেদিন ও ঘুম আসছিলো না , বিছানায় শুয়ে এপাশ , ওপাশ করছিলাম । হঠাত দেখি উঠানে কে জানি হাঁটছে । আমার ঘর যেটা এক সময় বাবা মায়ের ঘর ছিলো , আগুন্তুক এদিকেই এগিয়ে আসছে । একটু পরে আওয়াজ আরও স্পষ্ট হলো , ভাবলাম চোর টোর হবে , তাই সিদ্ধান্ত নিলাম শুয়ে থাকবো মটকা মেরে যা হওয়ার হোক । কিন্তু কৌতূহল বড় শক্ত জিনিস , কিশোর বয়সে অতি প্রাকিত কিছু দেখার বাসনা আমার ছিলো , চেষ্টাও করেছিলাম, দেখা মেলেনি কোনদিন । একটা মৃদু সম্ভাবনা সেদিন আবার সেই ইচ্ছা আমার ভেতর জাগিয়ে তুলেছিলো , জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই আমার হৃদ পিণ্ড ধক করে উঠেছিলো , কয়েক সেকেন্ড এর জন্য মনে হয়েছিলো সত্যি অতি প্রাকিত কিছু দেখেছি । একজন মহিলা , এলো করে সাড়ি পরা , হাঁটছে , ঠিক এলো মেলো হাটা নয় , তার নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে বলে মনে হলো । আমাদের বাড়ির একেবারে শেষের কোন হচ্ছে তার গন্তব্য ।
ভেবেছিলাম হতেই পারে , বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলা হবে তাই হয়ত এই বাড়ির সাথে জড়িত অশরীর কেউ এসেছেন , শেষ কটা দিন এর জন্য । প্রাথমে ভাবলাম আমার দাদি হবেন , এই বাড়ির প্রতি অগাধ টান ছিলো ওনার , ছোট বেলায় দেখেছি কোথাও গিয়ে দুটো দিন থাকতে চাইতেন না । স্বামীর ভিটে স্বামীর ভিটে বলে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইতেন । কিন্তু সম্ভাবনা নাকচ করে দিলাম, কারন আমার দাদি ছিলো বেটে খাটো মহিলা । ভাবলাম মা নয়ত ? একদম মায়ের মতো কাপড় পড়েছে , কিন্তু মায়ের তো এই বাড়ির জন্য তেমন কোন বাড়তি টান দেখিনি যে শেষ বার দেখতে আসবেন, বরং মাঝে মাঝে মনে হতো মা এই বাড়ি থেকে দুদিন এর জন্য অন্য কোথাও গেলে খুব খুশি হতেন। একবার আমরা সবাই মিলে কক্সবাজার গিয়েছিলাম , সেবার মা ভীষণ খুশি হয়েছিলো। আমার মনে আছে , বিচে বসে বাবার সাথে এমন করে কথা বলছিলো যেন নতুন বিয়ে হয়েছে দুজনের, তখন বুঝতে পারিনি তবে অনেক পরে যখন সেই দৃশ্য আনমনে চোখে ভেসে উঠেছিলো তখন এমনটাই মনে হয়েছিলো। তাই মায়ের আসার কথা নয় । কিন্তু ওই হাঁটার ভঙ্গি , ওই এক রকম দৈহিক গঠন।
ভয় আমি পাইনি , তবে আমার মস্তিস্ক ডাবল টাইম কাজ করছিলো , কে হতে পারে এই মহিলা , কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না। অনেক সময় মস্তিস্ক অতিরিক্ত কাজ করলে শরীর ঘেমে ওঠে আমার একটু ঘাম হয়েছিলো । রহসসময় সেই নারীর গন্তব্বে আমার জানালার পাশ দিয়েই যেত হতো , তাই যখন আরও কাছে চলে এলো , তখন আমার মস্তিস্ক একটু সময় এর জন্য শান্ত হলো , কারন ওই নারী আর কেউ নয় , মেজো আপা , একদম মায়ের মতই লাগছিলো ওকে । কিন্তু এতো রাতে মেজো আপা এখান দিয়ে যাচ্ছে কেনো ? ওর তো পোকার ভয় অনেক , আর বাড়ির পেছনের এই জায়গাটা পরিস্কার করা হয় না অনেক বছর , পোকা মাকড় তো থাকবেই , সাপ থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই । আর সেই পথেই কিনা আপা এমন করে হেঁটে যাচ্ছে তাও রাত দুপুরে ।
আপার কি সত্যি বাড়িটার জন্য এতো মায়া!!! , কই কোনদিন তো মনে হয়নি । আমার অন্য বোনদের তুলনায় মেজো আপা কেই আমি সবচেয়ে বেশি জানি , কোনদিন আমার মনে হয়নি এই বাড়ির প্রতি ওর টান আছে । উল্টো বাড়িটার প্রতি ওর অভিযোগ ছিলো প্রচুর , দেয়াল স্যাঁতসেঁতে , হাই কমোড নেই (তখন ছিলো না)। ভুত আছে এই বাড়িতে এসব কত কথা বলতো । আসলে মানুষের মন বোঝা বড় দায় , কেউ যদি বলে আমি একজন মানুষ কে খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি , তাহলে সে ডাহা মিত্থা বলছে এতে কোন সন্দেহ নেই । কেউ কোনদিন চিন্তাই করতে পারবে না মেজো আপা রাত বিরাতে জুঙ্গুলে এই বাড়ির পেছন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ।
আমার অনুমান সত্যি করে দিয়ে মেজো আপা বাড়ির শেষ কোনায় গিয়ে দাড়িয়ে পড়ল , তারপর এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে উবু হলো । আমি আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলেছিলাম , কিন্তু মেজো আপার কর্ম কলাপ আমাকে আবারো আগ্রহি করে তুলল। আসলে আমি একটু লজ্জা ও পাচ্ছিলাম , কারো গোপন কাজ দেখা আমার স্বভাব নয় । কিন্তু সেদিন আমার কৌতূহল আমাকে ভালো ভাবেই কুপোকাত করেছিলো ।
কিছুক্ষন খোঁড়াখুঁড়ির পর মেজো আপা একটা প্লাস্টিকের ময়লা ব্যাগ বের করে আনলো । কি আছে সেই ব্যাগে , আর এই জিনিস মেজো আপা কতদিন আগে রেখেছিলো এই যায়গায় ? প্রচণ্ড কৌতূহল সে রাতে আমাকে মেজো আপার উপর সাপাইং করতে বাধ্য করেছিলো । ঘরের ভেতর ঢুকে মেজো আপা যখন সোজা রান্না ঘোরে গিয়ে চুলা জ্বালাল আমি চুপি চুপি তখন রান্না ঘোরে উঁকি দিয়ে । সেই ছোট বেলার মতো মেজো আপা পড়তে বসেছে আমি চোরা চোখে ওকে দেখছি আর ভাবছি একে আমি বিয়ে করবো । মেজো আপার হাতে কিছু খাম , একটা পেন্সিল বক্স , একটা সুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ফুলের ডাঁটা , কিছু ভেঙ্গে যাওয়া চুড়ি । মেজো আপা কিছুক্ষন সেই জিনিস গুলির দিকে তাকিয়ে রইলো , তারপর একটা পাতিল নিয়ে সগুলি সেখানে রেখে আগুন ধরিয়ে দিলো । এদের শেষ ঠিকানা এখন হুমকির মুখে তাই এদের অস্তিত্ব ও আর থাকবে না । মেজো আপার না জানি কত দিনের লুকিয়ে রাখা সেই অপ্রয়োজনীয় সম্পদ গুলি নিজেদের আশ্রয় হাড়িয়ে চিতায় পুরতে লাগলো ।
আমি আর দাড়াই নি চলে এসেছিলাম , শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম , একটা বাড়ি না জানি কত মানুষের কত গোপন আড়াল করে রাখে । না জানি কত সৃতি নিজের গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখে । আচ্ছা আমার কি এমন কোন সৃতি লুকায়িত আছে? প্রশ্ন এসেছিলো আমার মনে , অনেক চিন্তা করেও কিছু বের করতে পারিনি ।