14-11-2021, 08:11 PM
সকালে মিত্রার ডাকে ঘুম ভাঙলো, সেই এক চিত্র, মিত্রা ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়েছে, সেই লালপাড় শাড়ি, মাথায় একগাদা সিঁদুর, মা মা, ঘরের গৃহিণী ভাব। আমি উঠে বসে রেডি হয়ে পরলাম, তাড়াতাড়ি। দুজনে সেই লুচি বাটি চড়চড়ি খেয়ে বেরিয়ে পরলাম।
হিমাংশুর অফিসে এলাম সাড়ে দশটা নাগাদ, অমিতাভদা, মল্লিকদা, মিত্রা আমার হয়ে স্বাক্ষী দিলেন, ওখানে এক ঘন্টার কাজ ছিল। কাজ শেষে, হিমাংশুকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, আমাকে একটা আছোলা বাঁশ দিলি, বেশ চলছিলো, কিন্তু তুই থামিয়ে দিলি। হিমাংশু হেসে বললো, সব ভালো যার শেষ ভালো। তোকে মিত্রার সঙ্গে জুড়ে দিলাম, না হলে মিত্রার একার পক্ষে কন্ট্রোল করা সম্ভব হতো না।
ওর দিকে তাকালাম। ও আমার মিত্রার সম্বন্ধে কোন আঁচ করতে পেরেছে কিনা। ওর চোখ সেই কথা বলছে না।
-এরপর আমার করণীয় কি আছে।
-খাতা পত্রগুলো সাজিয়ে নিই। আর একজন যে ডিরেক্টর আছে, তাকে জানাতে হবে। এখন আমার অনেক কাজ।
-তোর কাজ কবে শেষ হবে।
-আগামী সপ্তাহে কমপ্লিট করে ফেলবো ভাবছি।
-শেষ কর আমি তোর সঙ্গে বসবো, কতগুলো স্ট্রাটিজি নিয়ে।
-ঠিক আছে। তুই কবে যাচ্ছিস।
-তোর এখান থেকে বেরিয়ে বড়মার সঙ্গে একবার দেখা করবো, তারপর চলে যাবো।
-ফিরবি কবে।
-তুই অফিসের সম্বন্ধে সব জানিস তো।
-হ্যাঁ, মিত্রা কিছু কিছু বলেছে, তুই ঠিক ডিসিশন নিচ্ছিস।
-মিত্রা একা পরে গেছে।
-বুঝতে পেরেছি। তুই ওদিকটা সামলা আমি এদিকটা সামলে দেবো।
-এখন যারা আছে, সব বিষ মাল।
-জানি, খালি ধান্দাবাজি। তবে ঘুঘুর বাসা পরিষ্কার করতে তোকে হিমশিম খেতে হবে।
-জানি, তবে ওটা সামলাতে আমার বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।
-ঠিক আছে, তোর সময় নষ্ট করবো না। তুই যা এখন, কলকাতায় ফিরলে আমায় একবার নক করিস।
-ঠিক আছে।
হিমাংশুর ওখান থেকে বেরিয়ে এসে, বড়মার কাছে এলাম। মিত্রা আসতে চাইছিল না। আমিই ওকে জোর করে নিয়ে এলাম। বড়মা প্রথমে মিত্রাকে দেখে একটু অবাক হয়েছিলো, ছোটমা ক্যাজুয়াল। সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম, তারপর আমরা চারজনে মিলে ঠিক করলাম পরবর্তী স্ট্রাটেজি, অমিতাভদার পাকা মাথা কয়েকটা ভাল ডিসিশন নিলো, আমি সেগুলো মেনে নিলাম। বুঝলাম মেইন অপারেটর হবে সনাতন ঘরুই। দাদা সেরকমই ছক করলো, মিত্রা আমি সেগুলো মেনে নিলাম, আমি একটা খালি প্রস্তাব রাখলাম, আমি যেমন আছি তেমনই থাকবো, আমার কোন জায়গা পরিবর্তন হবে না। মিত্রা প্রথমে মানতে চাইছিল না, ওকে ব্যাপারটা বোঝালাম, ও বুঝতে পারলো, ফাইন্যাল ডিসিশন হলো, আগামী সপ্তাহে শুক্রবার মিটিং কল হবে, সেখানে মিঃ সনাতনের হাত দিয়েই সকলকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সাইনিং অথরিটি এই মুহূর্তে মিত্রার হাতেই থাকবে। মিত্রাই সোল পাওয়ারের অধিকারী। মিত্রা মেনে নিলো। এ কদিন মিত্রা দাদার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলবে, প্রয়োজন পরলে আমায় ডাকবে। আমি চলে আসবো। আমার দেখা মিলবে সেই শুক্রবার।
মল্লিকদা, ছোটমা, বড়মা এতক্ষণ নিরব দর্শক ছিল, কথা শেষ হতে ছোটমা বললেন, হ্যাঁরে অনি, তোর মা-বাবার কোন ছবি তোর কাছে নেই।
ছোটমা এ ভাবে কোনদিন কথা বলেন নি, আমি স্থির দৃষ্টি নিয়ে ছোটমার দিকে তাকালাম।
-আছে।
-তোর মনে পড়ে ওনাদের।
-না। আবঝা আবঝা।
-আমাকে ছবিটা দিবি।
-কেনো।
-আমি বাঁধিয়ে ঠাকুর ঘরে রাখবো।
হাসলাম।
-তোর মতো ছেলের যিনি জন্ম দেন তিনি মহাপ্রাণ।
খাওয়ার টেবিলে সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
-ঠিক আছে তোমায় দেবো।
-তুই ওই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দে।
-কেনো।
-এখানে চলে আয়। এতো বড় বাড়ি এতো গুলো ঘর।
আবার তাকালাম ছোটমার দিকে।
-তোকে নিয়ে এ কদিন আমি আর দিদি খালি ভেবেছি।
-আমিও কি মহাপ্রাণ।
এমন ভাবে কথাটা বললাম, সবাই হেসে ফেললো, মল্লিকদা চেঁচিয়ে উঠলেন, কি, বলছিলাম না, অনির বিকল্প অনি নিজেই। ওর মাথার মধ্যে আর একটা মাথা আছে।
-এই শুরু করলে।
-না না।
-বলবো ছোটমাকে।
-এই তো তোর সঙ্গে কি আমার কোন প্রাইভেট টক থাকতে পারে না।
-তাহলে এখন শুধু চিংড়ি মাছের কালিয়া খেয়ে যেতে হবে।
মল্লিকদা হো হো করে হেসে বলে উঠলেন ঠিক ঠিক, কি হে দাও।
ছোটমা মৃদু হেসে বললেন, তোমার ভাগেরটা শেষ হয়ে গেছে, খালি আনি আর মিত্রার ভাগেরটা আছে।
বড়মা ছোটমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যা না, ও বেলার জন্য রাখতে হবে না।
ছোটমা রান্নাঘরের দিকে গেলেন, বড়মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কবে আসবি।
-কেনো। বৃহস্পতিবার রাতে।
-এতদিন কি করবি।
-অনেকগুলো কাজ আছে, একেবারে শেষ করে আসবো।
বড়মা চুপ করে রইলেন, আমি উঠে গেলাম বড়মার কাছে, বড় , মিত্রা পাশাপাশি বসে আছে, আমি বড়মার গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিস ফিস করে বললাম, কেনো মিত্রাকে তো রেখে যাচ্ছি। মিত্রা আমার কথা শুনতে পেয়েছে, আর কেউ শুনতে পায় নি। বড়মা আমার দিকে তাকালেন, চোখ দুটো জলে ভোরে উঠেছে।
ছোটমার আনা চিংড়িমাছ, সকলে ভাগ করে খেলাম। খাওয়া শেষ হতে বড়মার ঘরে গিয়ে বললাম, টাকা দাও। বড়মা আমার দিকে তাকালেন, এই প্রথম বড়মার কাছে টাকা চাইলাম। বড়মা আমাকে বুকে টেনে নিলেন, আমার শান্তির নীড়, জীবনে প্রথম বড়মার কাছে মুখ ফুটে টাকার কথা বললাম, বড়মা আলমারি খুলে টাকা দিলেন, সেদিন নিয়ে গেছিলাম, তুই রাগ করবি বলে তোকে দিতে সাহস পাই নি, তাই নিয়ে তোর দাদা বাড়িতে এসে আমার ওপর কি হম্বি তম্বি। ছোটও নিয়ে গেছিলো। আমি হাসলাম। কখন যে ছোটমা পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল জানি না। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
-কি বাবু সাহেব মচকেছেন না ভেঙেছেন।
ছোটমার কাছে এগিয়ে এলাম, দুটো কাঁধে হাত রাখলাম, কোনটা হলে তোমার ভালো লাগবে।
-দুটোই।
-ঠিক আছে। এবার থেকে তাই হবে।
ছোটমার চোখ দুটো টল টল করছে।
-তোমরা সবাই এরকম করলে আমার পক্ষে লড়াই করা মুস্কিল হয়ে পরবে।
-না রে অনি আমরা সবাই এতোদিন মাঝ সমুদ্রে ভাসছিলাম, এখন একটা নৌকায় উঠতে পেরেছি, সেটাও যদি ফুটো হয়ে যায়, সেই ভয়ে আমরা সব….।
নীচু হয়ে ছোটমার বুকে মাথা রাখলাম, অনি সেই অন্যায় কোন দিন করবে না।
-জানি বলেই তো হারাবার ভয়টা বেশি।
-কিচ্ছু হারাবে না।
-ওই মেয়েটার চোখ দুটো দেখেছিস।
-দেখেছি।
-সব তোমায় বলবো, সময় আসুক।
-তুই কি বলবি আমি জানি।
ছোটমার চোখে চোখ রাখলাম।
-সবাই আশ্রয় চাইবে, তুই আশ্রয় দিতে পারবি না, থাকার জায়গা দিবি এই তো।
-হয়তোবা তোমার কথা ঠিক, হয়তোবা নয়। ঠিক আছে, আমায় এখন যেতে হবে, না হলে অনেক রাত হবে পৌঁছতে।
ছোটমা বড়মাকে প্রণাম করে বাইরে এলাম, মল্লিকদা, অমিতাভদা, মিত্রা বসে কথা বলছে।
আমি প্রণাম করলাম, মিত্রাকে বললাম, আমাকে একটু স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দে।
ও উঠে দাঁড়ালো।
বড়মা এগিয়ে গেলেন মিত্রার দিকে, এ কদিন তুমি একবার করে এসো না। ভাল লাগবে।
মিত্রা আমার দিকে তাকালো। আমার চোখের ইশারা ও বুঝতে পেরেছে। ও নীচু হয়ে বড়মা, ছোটমাকে প্রণাম করলো, অমিতাভদাকে, মল্লিকদাকে প্রণাম করলো, ওরা আজ কোন বাধা দিলো না।