Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
মায়াময় পৃথিবী !

তিন বছরের ছেলেটি সেদিন বাসে উঠেই আমাকে মা বলে  জড়িয়ে ধরেছিল।আমি তখন সীটে বসে।বাসে খুব একটা ভীড় না থাকলেও কোনো সীট ফাঁকা ছিল না।আমি সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাটিকে কোলে বসিয়ে নিই।আমি কোলে বসিয়ে নিতেই পাশ থেকে বছর সাতেকের মেয়েটি বলে উঠল,
"ভাই আন্টির কোলে চুপ করে বসে থাকবি।"
বুঝলাম ওরা ভাই বোন।মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর ভায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।দুই বাচ্চার খুনসুটি দেখে আমারও বেশ ভালো লাগছে।পাশেই ওদের বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।বাচ্চা দুটো বেশ মিষ্টি দেখতে।ভাবছি তখন এমন দুটো বাচ্চা পেয়ে ওদের মা বাবা তাহলে কত খুশিতে থাকে?নিজের মনটাই যেন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন।স্বামী,সংসার সন্তান কোন্ মেয়েটা না চায়?সবটাই কপাল।ঠিক কপাল বলব না।কিছু ভুল সিদ্ধান্ত জীবনকে ভুল পথে ঠেলে দেয়।
আমি মধুপর্ণা।আমিও চেয়েছিলাম একটা সুন্দর সংসার।স্বামী সন্তান নিয়ে আমিও একটা সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিলাম।বেশির ভাগ মেয়েদের স্বপ্ন গুলো স্বপ্নই থেকে যায়,সেগুলো কখনো পূরণ হয় না।
আমাকে নিয়ে আমার মায়ের দারুণ অহংকার ছিল কারণ আমি সুন্দরী।পাশের বাড়ির রুমকি,সম্পা,অর্পিতা ওদের থেকে যেহেতু আমি দেখতে সুন্দর ছিলাম আমার মা কিন্তু নানান কথার  প্রসঙ্গে ওদের মায়েদের কাছে আমার রূপের বড়াই করে বেড়াত।মা কথায় কথায় বলত,আমার মেয়ে সুন্দরী।বিয়েতে এক টাকাও পণ দেব না।এক দেখাতেই পছন্দ হবে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর পাশের বাড়ির রুমকির যেই বিয়ে হয়ে গেল আমার মাও এবার আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগল।বাবাকে বলতে শুরু করল,
"দেখো রুমকির বাবাকে।মেয়েকে তো ওই রকম দেখতে,তাও আবার ভালো একটা ছেলে জোগাড় করে ড্যাঙডেঙিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল চোখের সামনে।আর তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছো।"
এমনিতেই পাত্র পক্ষ প্রায়ই বাড়িতে আসে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।কিন্তু ভালো পয়সাওয়ালা ছেলে ছাড়া আমার বিয়ে দেবে না আমার মা।রুমকির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমার মা আমার বিয়েটা না দিতে পারলে যেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিল না।রুমকির বড়ো লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছে।তাই আরো বড় লোক ছেলের খোঁজ করতে শুরু করল।অবশেষে বড়ো ব্যবসাদার ছেলে আমাকে দেখতে এলো।অবস্থাপন্ন ঘর।মা তো এমন পাত্র হাত ছাড়া করবেই না।রুমকির বাবা মাকে দেখিয়ে দেবে নিজের মেয়েকে আরো বড় লোক বাড়িতে দিয়েছে।আমি সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন।পড়াশোনাকে গোল্লায় পাঠিয়ে দিয়ে জমি জায়গা বিক্রি করে আমার বিয়েটা দিয়ে দিল।বাবা অবশ্য বলেছিল,
---গ্রাজুয়েট হোক,তারপর ভাবব।এত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব?
মা তো এমন কথায় রেগে আগুন।বাবাকে বলে,
---তুমি পুরুষ মানুষ কি বুঝবে?বাড়িতে মেয়ে থাকলে কি যে চিন্তা হয় সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার হয় নি।একটা সমর্থ মেয়ে,তার ওপর সুন্দর দেখতে‌।কখন যে কার কু নজর পড়বে তার ঠিক নেই।তাই বিয়ে দেওয়াটাই শান্তির জায়গা।
আমার বিয়ে হলো কিন্তু বিয়ের পর সংসার হলো না।এক দেড় বছর যেতে না যেতেই আমি ফিরে এলাম বাপের বাড়িতে।বড়োলোক বাড়ির ছেলে।বড়ো ব্যবসা।টাকা পয়সার অভাব নেই।কিন্তু নেশায় আসক্ত।প্রতিদিন রাতে মদের নেশায় চূড় হয়ে থাকে। কিছু বলতে গেলেই অশান্তি।অবশেষে মারধোর অত্যাচার।দিনের আলোয় কিছু মানুষ থাকে ঝাঁ চকচকে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা হয়ে ওঠে হিংস্র।কত দিন আর সহ্য করব?শাশুড়িকে বললাম সব কথা।শাশুড়ি ভীষণ ভালো মানুষ।শাশুড়ি বললেন,
--এই বাড়িতে মেয়েদের কোনো কথাই টেকে না।আমাকে তো আর বিয়ের কথা বার্তা বলতে নিয়েও যায় নি।আমি কখনোই চাইনি কোনো মেয়ের জীবনটা নষ্ট হোক।তুমি এ বাড়িতে থাকলে একদিন মরেই যাবে।পারলে চলে যেও।অনেক যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছি।তুমি পারবে না।
বুঝলাম শাশুড়ি আমার ভালোই চান।ভালো মানুষরা কখনো কারো খারাপ চায় না।শেষমেষ ডিভোর্স হয়ে বাপের বাড়ি চলে আসি।যখন বাপের বাড়িতে চলে আসছিলাম,আমার শাশুড়ি বলেছিলেন,
"স্বামী মানুষটা ভালো হলে কুঁড়ে ঘরে থেকেও সুখ।আমার ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারি নি।তাই ভালো মা হতে পারিনি।সংসারের মানুষরা ভালো না হলে সে সংসারে মেয়েরা কখনো মূল্য পায় না।আমি তো এ জন্মে আর বেরোতেই পারলাম না।তুমি বেরিয়ে গিয়ে নিজের মতো করে বাঁচো।
আমি বাঁচব বললেই তো বাঁচা যায় না।মানুষ খেতে পরতে পেলেই বেঁচে থাকে না।মানুষ বাঁচে আনন্দে।মানুষ বাঁচে ভালোবাসায়।একটা কথা সব থেকে বড়ো সত্যি মেয়েরা বিয়ের পর শুধুই শ্বশুরবাড়িতেই অত্যাচারিত হয় তা নয়, বিবাহিত মেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এলে তার যে কি অবস্থা হয় সেটা বলে বোঝানো যাবে না হয়তো।
বাপের বাড়িতে আসার পর থেকে আমি আরো অসহায় হয়ে পড়লাম।আমাকে ভালো চোখে দেখল না আমার মা।আমার জন্য কোনো সহানভৃতি তো নেই,উল্টে আমাকে দোষারোপ করতে শুরু করল।আমি নাকি সংসার করতে পারিনি।মা কথায় কথায় বলতে শুরু করল,
"নিজের সংসার ভেঙে আমার সংসারে জ্বালাতে এসেছিস?দেখ গিয়ে সম্পা রুমকিকে, কেমন সুন্দর করে সংসার করছে।আর তুই এসে পড়লি আমাদের ঘাড়ে।জমি জায়গা বিক্রি করে বিয়ে দিয়েছিলাম আমার ঘরে বসে থাকার জন্য?শ্বশুর বাড়িতে অনেক কিছু হবে।সে গুলো সহ্য করতে হয়।"
উঠতে বসতে আমাকে খোঁটা দিতে শুরু করল।একটু কিছু হলেই বলত,
"চার বেলা  গিলছিস,বাপের জমিদারি আছে নাকি যে তোকে বসে বসে খাওয়াবে?রাস্তা দেখ।এখানে ওসব চলবে না।"
বুঝলাম আমি গলগ্রহ।একবার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে বাপের বাড়ির প্রতি তার কোনো অধিকার থাকে না।আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে মানে নিজের বাপের  বাড়ির  প্রতি অধিকার হারানো।সত্যিই তো সংসার তো মায়ের।মায়ের সংসারে থাকা মানেই একটা বাড়তি বোঝা।আসলে সংসারের কর্তৃত্ব কেউই ছাড়তে চায় না।সে শাশুড়িই হোক,আর নিজের মা-ই হোক।আমি ভাবলাম এই সব কিছুর জন্য আমিই কি দায়ী?আমার দোষটা কোথায়?আমাকে পড়াশোনা করতে দেওয়া হলো না‌।আমাকে জোর করেই বিয়েটা দেওয়া হল।বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে অত্যাচারিত হলে সব সময় শাশুড়ির দোষ দিই।কিন্তু নিজের মা?মেয়েরা  বিয়ের পর বাপের বাড়িতে ফিরে এলে আরো নিপীড়িত হয় মায়ের দ্বারা।নিজের মা তখন শাশুড়ির থেকে বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।যেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ছিলাম সেদিন আমার শাশুড়ি বলেছিল,
"বৌমা,এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের মত করে বাঁচো।অন্তত শান্তিতে থাকবে।অন্তত তোমার পরের জীবনটা ভালো করে কাটবে এই আশীর্বাদ করি তোমায়।"
বাপের বাড়িতে ফেরার পর মনে হয়েছিল সেদিন শাশুড়ি মা আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল এসব বলে।ভালো তো হলই না।বরং আরো খারাপ হল।পরে বুঝেছিলাম আমাকে উনি আশীর্বাদই করেছিলেন।জীবনে আমার মায়ের থেকে আমি সেভাবে ভালোবাসা পাইনি।কিন্তু এই শাশুড়িমা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন।এখনো ওনার সাথে আমি যোগাযোগ রেখেছি।মাঝে মধ্যে উনি আমার বাড়িতে আসেন।একটা মায়া কাজ করে বই কি!
এখন আমার ভরা সংসার।ছেলে মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে ভালো আছি।সাত বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে। স্বামী ব্যাঙ্কে চাকরি করেন।ভাবিনি কখনো এমন একটা ভালো মানুষকে জীবনে পাব।আমার জীবনের স্বপ্নটা সার্থক হয়েছে।একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা আজ পেয়েছি।
সেই পাওয়ার গল্পটা না বললে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যায়।আসলে নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বাসের সেই ঘটনাটা বলতে বাকি রয়ে গেছে।সেদিন বাসে বাচ্চা ছেলেটি আমার কোলে আর মেয়েটির সাথে আমি কথা বলতে শুরু করলাম।জিজ্ঞেস করলাম,
--কী নাম তোমার?
--মৌমণি।তারপর মেয়েটি নিজে থেকেই বলল,
--আমার ভায়ের নাম ময়ূখ।
--কি মিষ্টি নাম।তা কোথায় গিয়েছিলে?
–-মামার বাড়িতে ছিলাম।এবার বাবার সাথে বাড়ি যাচ্ছি।
--তা তোমার মা আসেনি?
---আন্টি আমার মা তো নেই।কথাটা বলেই  মেয়েটির মুখটা কেমন ছোট হয়ে গেল।মুখের হাসিটাও মিলিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওর বাবা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চটজলদি পকেট থেকে লজেন্স বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে,
---মণি ভাইয়ের হাতে একটা দাও,আর একটা তুমি খাও।
বুঝলাম প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার জন্যই এই পদক্ষেপ।যতই হোক,বাবা তো।বুঝতে পেরেছিলাম ওনার মনের অবস্থা।তাই খারাপ লাগছিল।আমিও ভদ্রলোককে সরি বলতেই উনি বললেন,
--ইটস ওকে।
--আসলে বুঝতে পারিনি।
--না না ঠিক আছে।
এরপর আমার বাস থেকে নামার সময় হলো।আমি উঠে দাঁড়াতেই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনা।বাচ্চা ছেলেটি কিছুতেই আমাকে ছাড়ছে না।শাড়ির আঁচলটা টেনে ধরে রেখেছে।আর মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদছে।বাসের সব লোক তো তখন তাকিয়েই আছে।কোনো ভাবেই ছাড়তে রাজি নয়।এদিকে ওর বাবা বোঝানোর চেষ্টা করছে।কিছুতেই কিছু না।আরো চিৎকার করে কাঁদছে বরং।এদিকে আমার স্টপেজ চলে এসেছে।হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটি বলে ওঠে,
---আন্টি ভাই যখন ছাড়ছেই না চলো না আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি।তুমি আমার মায়ের মতো দেখতে।
এই একটা কথাতেই আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল সেদিন।আমার স্টপেজ ফেলে আমি চলে এসেছি অনেকটাই।সেদিন আমি যেন দুটি বাচ্চার  মা ডাকটা শুনতে পেয়েছিলাম আমার হৃদয়ে।পারিনি মাতৃহারা ওই দুটি বাচ্চাকে দূরে সরিয়ে রেখে নেমে যেতে।কেন জানিনা সেদিন চলেই গিয়েছিলাম ওনার বাড়ি পর্যন্ত।ভদ্রলোকও আমাকে না করেনি।আমার আর কমপিউটার ক্লাসে যাওয়া হয়নি সেদিন।আসলে কমপিউটার সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলাম।ভেবেছিলাম একটা চাকরি করব।তাই কমপিউটার শেখাটা জরুরি ছিল।বাড়িতে যেভাবে মায়ের থেকে কথা শুনছিলাম তাতে আর বাড়িতে থাকতে পারছিলাম না।সেদিন ওই ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি ওনার স্ত্রী তিন মাস আগে মারা গেছেন।হঠাৎ করেই জ্বর হয়।সেই অজানা জ্বরেই মারা যান।বাচ্চা দুটো সেই থেকেই মামার বাড়িতে ছিল।কিন্তু ওখানে ওদের বেশিদিন রাখতে চাইছে না বলেই নিয়ে চলে এসেছেন।বাড়িতে নিয়ে এসেও সেভাবে দেখার লোক নেই।কারণ ভদ্রলোকের বাবা মা অনেক কাল আগেই মারা গেছেন।পিসির কাছে উনি মানুষ।সবটা শুনে খারাপ লেগেছিল আমার।ওনার বাড়ি থেকে আমি যখন চলে আসছিলাম ছেলেটি কাঁদছিল খুব।মেয়েটি বলছিল,
"কাল আসবে তো আবার।"
তারপর থেকে আমি নিজেই ওদের সাথে জড়িয়ে যাই।একটা মায়া পড়ে যায়।কমপিউটার ক্লাসে না গিয়ে ওখানে চলে যেতাম রোজ।যদিও বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য উনি অবশ্য লোক রেখেছিলেন।ভদ্রলোকের ব্যবহার আমাকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করত।আমি যখন যেতাম তখন উনি থাকতেন না।যেহেতু ব্যাঙ্কে জব করতেন তাই সকালের দিকে বেরিয়ে যেতেন।ওনার সাথে ফোনে কথা বলতাম।আস্তে আস্তে ওনাকেও ভালোবেসে ফেললাম।অবশ্য তার আগে আমার অতীতটা জানিয়ে দিয়েছিলাম।
তারপর আর কি!সাত বছর কেটে গেছে।মৌমণি আর ময়ূখ আমার দুই সন্তান।আমার হ্যাজব্যাণ্ড বলে,নিজে কিছু একটা করো।প্রতিটা মেয়ের সাবলম্বী হওয়া দরকার।বিউটিশিয়ান কোর্স করে নিজের একটা বিউটি পার্লার খুলেছি।ভালো লাগে এই ভেবে যে একজন ভালো মানুষকে পাশে পেয়েছি।নিজের মতো করে বাঁচতে পেরেছি।
-:সমাপ্ত:-
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by dada_of_india - 09-11-2021, 08:09 PM



Users browsing this thread: 17 Guest(s)