06-11-2021, 08:39 PM
#ফ্ল্যাটবাড়ি
#মৌমিতা_ঘোষ
|| ১ ||
"তুমি কি পাগল হলে? এই এতবড় বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দেবে? এলো কি কিরে এরকম ভাবনা তোমার মনে?" - খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে রে রে করে তেড়ে আসেন পরমা দেবী, সৌভিকবাবুর বাইশ বছরের সহধর্মিনী |
"শোনো পরমা, উত্তেজিত হয়ো না | উত্তেজনা কোনো সমাধান নয় | তুমি কি ভাবো আমার পিতৃপুরুষের ভিটের ওপর আমার কোনো টান নেই? এমনি এমনি এরকম একটা মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আমি?" - একটু রেগেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়ে দেন সৌভিক বাবু |
বাইরে থেকে ঘুরে এসে বারান্দায় রাখা বাবার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে সবে বলেছিলেন, "ভাবছি বাড়িটা এবার প্রোমোটারকে দিয়ে দেবো"| আর তাতেই বিস্ফোরক হয়ে ওঠেন পরমা দেবী | চৈত্রের ঠা ঠা রোদ্দুরের তাপে ঘামে ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে সৌভিকবাবুর আদ্দির পাঞ্জাবীটা | সেটা খুলে ইজিচেয়ারের হাতলে রেখে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে আবার বললেন,
"সারাজীবন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করলাম, আর ক’দিন পর রিটায়ার করবো | আমাদের পেনশন বলতে কিছু নেই | ছেলেটা বড় হচ্ছে, আজ বাদে কাল চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবে| ভেবে দেখেছো রিটায়ারমেন্টের ওই ক’টা টাকায় তখন আমাদের কিভাবে চলবে? এই এতো বড় বাড়িতে চারিদিকে ফাটল, কোথায় ভেঙে পড়ছে, কোথায় বট অশ্বত্থের চারা ! মেন্টেন করবে কিভাবে? বাড়ির ইঁট বেচে ভাত রাঁধবো? "
"কেন? বাবুয়া আমাদের দেখবে না? " - ব্যকুলতা স্পষ্ট পরমা দেবীর গলায় |
"তোমার কথাটা বলতে লজ্জা হলো না? আজকালকার দিনের একজন মা হয়ে ছেলের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবে তুমি? ওকে বড় করে কি ধন্য করে দিয়েছি আমরা যে সারাজীবন আমাদের খোরপোষ দেবে? খালি স্বার্থ আর স্বার্থ ! ছেলে বলে বাবা-মাকে দেখতেই হবে? আজ যদি বাবুয়া মেয়ে হতো এই এক্সপেক্টেশন রাখতে পারতে? ছিঃ, ! আর দ্বিতীয়দিন আমার সামনে এসব বলবে না বলে দিলাম | বাবুয়া নিজের জীবন শান্তিতে কাটাবে | কোনো বোঝা চাপাবে না ওর ওপরে |" - স্ত্রীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাথরুমে ঢুকে যান সৌভিকবাবু |
|| ২ ||
"বাবা, তুমি নাকি মাকে বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছো? " - আচমকা ঘরে ঢুকে সোজাসুজি প্রশ্ন করে বাবুয়া |
সৌভিকবাবু খাওয়াদাওয়ার পর সবে একটু শুয়েছিলেন | এই রবিবার দুপুরটা একটু না গড়িয়ে নিলে মনে হয় যেন কি একটা হয়নি ! আজ শুয়ে শুয়েও মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা যেন কিলবিল করছে | তার মধ্যেই বাবুয়ার এরকম প্রশ্নে আচমকা চিন্তার জটটা ছিঁড়ে গেল|
"আয়, বোস" - উঠে বসে বাবুয়াকে বসার জন্যে বিছানায় জায়গা করে দেন উনি |
"কেন বাবা, কেন করছ এমনটা? আমার ওপর কি তোমার একটুও ভরসা নেই? তোমার মনে হয় যে আমি তোমাদের দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত নই?" - বাবুয়ার চোখের কোনটা চিকচিক করছে, দেখেও না দেখার ভান করেন সৌভিকবাবু | ছেলেটা যে তাঁর প্রাণ | ওর কষ্ট উনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না | তবে সাথে এটাও চান না যে তাঁর জন্যে বাবুয়ার ওপর কোনো বোঝা চেপে থাকুক | বাবুয়া হয়তো আরো পড়াশুনো করতে বা চাকরি সূত্রে বাইরে যাবে | শুধু নিজের স্বার্থের কারণে ওনার কোনো অধিকার নেই ছেলেটাকে আটকে রাখার | আজ ছেলেটার আবেগ বড় বেশী, হয়ত বা বয়সের কারণেই | কিন্তু যেদিন ও বাস্তবের মুখোমুখি হবে, বাবা - মাকে দেওয়া কথার জন্যে হয়ত ওকে একটা ভালো সুযোগ ছেড়ে দিতে হবে | সেটা সহ্য করতে পারবেন না সৌভিকবাবু | পরমা ছেলেকে কাছে রেখে দিতে পারলেই মহা খুশি | কিন্তু সৌভিকবাবু বাবা হয়ে পারবেন না সেটা |
"তুই যে আমার কত বড় ভরসা, সেটা কি আমি তোকে বলে বোঝাবো? কিন্তু বাবুয়া, আমি আর তোর মা একা একা এই এত বড় বাড়িতে কি করবো বল তো? তুই আমাদের দেখবি আমি জানি | কিন্তু তুই যখন চাকরি করবি, তোর পক্ষে তো সম্ভব হবে না সবসময় এখানে থাকা | আমাদেরও বয়স বাড়বে | কে দেখবে বল এখানে আমাদের? সেখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে কত লোক !"
"এখানেও তো পাড়ার লোক আছে বাবা !"
"একটা বাড়ির মধ্যে পাশের ঘরের লোককে ডাকা আর পাশের বাড়ির লোককে ডাকার মধ্যে তফাৎ আছে বাবু | আরও বয়স হলে এখানে আমাদের নিরাপত্তা খুব কম বিশ্বাস কর"|
কোনোরকমে ছেলেকে বুঝিয়ে ঘরে পাঠান সৌভিকবাবু |
এই বাড়ির ইঁট, কাঠ, পাথরে জড়িয়ে আছে তাঁর ছেলেবেলা, পূর্বপুরুষ | তবে সেই সবকিছুর ওপরে তাঁর সন্তানের ভালো থাকা, সুস্থ থাকা | সৌভিকবাবুর কেবল মনে হচ্ছে এই বাড়িটা রাখলে বাবুয়ার ওপর এক মারাত্মক চাপ বাড়বে বই কমবে না ! আর তিনি বেঁচে থাকতে সেটা সহ্য করতে পারবেন না |
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্ল্যাটের কাজ শুরু করে দিতে হবে |
|| ৩ ।।
এক সপ্তাহ হল নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করেছেন সৌভিকবাবু। যতদিন ফ্ল্যাটটা তৈরীর কাজ হচ্ছিল, একটু দূরে অন্য একটা ফ্ল্যাটে থাকছিলেন ওনারা। প্রোমোটারই ঠিক করে দিয়েছিল। যখন তাঁর প্রাণের বাড়িটাকে একটু একটু করে ভাঙ্গছিল ওরা, প্রতিটা হাতুড়ির ঘা যেন সৌভিকবাবুর বুকের ভেতরে এসে লাগত। রোজ সকালে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির সামনে, মিস্ত্রীদের কাজ দেখতেন। ভাঙ্গাভাঙ্গির সময় মিস্ত্রীরা বারণ করত ওনাকে কাছে আসতে। পুরোনো দিনের বাড়ি, বলা তো যায়না কখন কোথা থেকে কি ভেঙ্গে পড়ে! বয়স্ক মানুষ, লেগে-টেগে গিলে আরেক বিপদ। প্রোমোটার মুকেশ বোধহয় এই লাইনে নতুন। এখনও মায়া-মমতা আছে শরীরে।
সৌভিকবাবুর সাথে দেখা হলেই বলতেন,
“চিন্তা করছেন কেন দাদা, ফ্ল্যাটে ভাবুন তো কত লোক আসবে, কত পরিচিতি হবে আপনার! আপনার এত বড় বাড়িতে মাত্র তিনজনে থাকতেন, আজ সেখানে আপনার বাড়িটা কতজনকে থাকার জায়গা করে দেবে! নিজের একটা ঠিকানা দেবে!”
মুকেশের সাথে কথা বলে বেশ ভাল লাগত সৌভিকবাবুর। বেশ সুন্দর করে ভাবতে পারে ছেলেটা। ভালই লাগত ওর মত করে ভাবতে। তবে এই ফ্ল্যাটে আসার পর সব হিসেব যেন গুলিয়ে গেল। এত লোক, তাও যেন কেমন খাঁ খাঁ করছে সবসময়। বারবার মনে হচ্ছিল ওইখানে তুলসীমঞ্চ ছিল, ওইখানে পাতকুয়ো, পিছনদিকে কতগুলো ফুলের গাছ বসিয়েছিলেন পরমা ...
এই ফ্ল্যাটেও একটা তুলসীমঞ্চ আছে বটে, তবে সৌভিকবাবুর মনে হচ্ছে ওতে যেন ঠিক প্রাণ নেই। ওখানে পরমা সন্ধেবেলা ধূপ দিচ্ছে বা শাঁখ বাজাচ্ছে ভাবতে কেমন যেন কষ্ট হয়!
পরমাদেবী বুঝতে পারছিলেন যে ভেতরে ভতরে গুমরোচ্ছে মানুষটা। কম দিন তো হল না একসাথে, লোকটা ভাংবে তবু মচকাবে না। পরমাদেবী জানতেন যে বাড়িটা ফ্ল্যাট হয়ে গেলে ও পারবে না সহ্য করতে। অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাই আটকাতে। কিন্তু যা জেদী মানুষ! নিজের মুখ দিয়ে যখন বলেছেন, করেই ছাড়লেন ফ্ল্যাটটা। আর এখন কষ্টটা নিজের স্ত্রীর সাথেও ভাগ করে নেন না।
এই ফ্ল্যাটবাড়িতে দোতলায় একটা বারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট পেয়েছেন ওনারা, আর সঙ্গে বেশ ভাল অঙ্কের একটা টাকা। ডাইনিং –এর একফালি জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে কেমন যেন উদাস দৃষ্টিতে প্রায় সময়ই চেয়ে থাকেন সৌভিকবাবু। বড় ভয় করে পরমাদেবীর। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটাও বড্ড অচেনা হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
বাবুয়া এক সপ্তাহের জন্যে ট্রেনিং-এ দক্ষিণ ভারত গেছে। মাঝরাত্রে পরমাদেবীর হঠাত ঘুম ভাঙ্গল সৌভিকবাবুর ধাক্কায়। বুকের বাঁ দিকটা চেপে ধরে আছেন উনি। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। একটাও কথা বলতে পারছেন না। এমনিতেই নার্ভাস পরমাদেবীর মনে হচ্ছিল পায়ের তলায় আর মাটি নেই। দরজাটা খুলে তাড়াতাড়ি বেল বাজান পাশের ফ্ল্যাটে। সঞ্জু আর কাকলি থাকে ওটায়। নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের, চাকরিসূত্রে তাই কোলকাতায় খেলাঘর পেতেছে দু’জন। সঞ্জু না থাকলে কি যে হত তখন! পনেরো মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে ফেলে সঞ্জু। তারপর ফ্ল্যাটের সবাই মিলে আধঘন্টার মধ্যেই বাড়ির কাছের নার্সিংহোমে আই সি ইউ-তে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল সৌভিকবাবুকে। ডাক্তার বললেন আর একটুও দেরী হলে ভয়ানক কিছু একটা হয়ে যেতে পারত। হার্টে বেশ বড়সড় সমস্যা বাঁধিয়ে বসেছেন ভদ্রলোক। বাইপাস করতেই হবে। বেশ কয়েকদিন অবজার্ভেশনে রাখার পর অপারেশন হবে ঠিক হল।
এত কিছু ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল, পরমা দেবীর ধাতস্থ হতেই বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছিল। সঞ্জু না থাকলে সেদিন যে কি হত! ভাবলেও এখন শিউরে উঠছেন উনি। বাবুয়াকে খবর পাঠানো হয়েছে। তবে সঞ্জু এটাও বলেছে ওকে, যে এক্ষুনি তো অপারেশন হচ্ছে না, কাজেই বাবুয়ার এক্ষুনি হুড়মুড়িয়ে আসার দরকার নেই। ও আর কয়েকদিনের ট্রেনিং শেষ করেই আসুক। এদিকটা ওরা সামলে নেবে। একটু বোধহয় স্বস্তি পেয়েছিল বাবুয়া।
কিন্তু আসল সমস্যাটা হল অপারেশনের দিন। ওটি তে ঢোকানোর পর ডাক্তার হঠাত বললেন দু’ইউনিট রক্ত লাগবে, এমার্জেন্সি। কিন্তু সৌভিকবাবুর বম্বে ব্লাড গ্রুপ। এত সহজে ওই গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায় না। পাগলের মত এক নার্সিংহোম থেকে অন্য নার্সিংহোমে, ব্লাড ব্যাঙ্কে ছোটাছুটি করছিল বাবুয়া। সঞ্জুর সেদিন অফিসের একটা কাজ ছিল জরুরী, ওকে তাই কিছু জানানো হয়নি। শেষে আর থাকতে না পেরে বাধ্য হয়েই ওকে ফোন করেছিল বাবুয়া। যদি ওর কিছু জানাশোনা থাকে।
“তুই আমায় এতক্ষণ জানাতে পারিসনি? আমার তো বম্বে ব্লাড গ্রুপ! আমি এক্ষুনি আসছি” – বলেছিল সঞ্জু।
“আমি জানতাম না তো দাদা! তোমার যে আজ ইম্পর্টেন্ট মিটিং ছিল” – খড়কুটোড় মত সঞ্জুকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল বাবুয়া।
“আমার মিটিংয়ের থেকে কাকুর প্রাণটা বেশী জরুরী বাবুয়া। তুই ফোন রাখ, আমি আসছি”।
এরপর বাকি গল্পটা রূপকথার মতন। সঞ্জুর দেওয়া রক্তে সুস্থ হয়ে সাকসেসফুল অপারেশনের পর বাড়ি, অর্থাৎ তাঁর নতুন ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন সৌভিকবাবু। তবে বাড়ি আসার পর একটা জিনিস খেয়াল করলেন পরমা দেবী, সৌভিকবাবুর মধ্যে সেই মনমরা ভাবটা আর নেই। বরং এখন যেন আগের থেকেও বেশী চনমনে। নিজের বয়সী বন্ধু যোগাড় করে ফেলেছেন ফ্ল্যাটেই জনা চারেক, সবাইকে নিয়ে সন্ধেবেলা তাস খেলা হয় ওনাদেরই ড্রয়িংরুমে। এখন আবার সৌভিকবাবুরই উৎসাহে ফ্ল্যাট সোশালের আয়োজন করছে সবাই। ওনার উৎসাহ দেখে কিনা জানা নেই, তবে ফ্ল্যাটের সবার সিদ্ধান্তে সৌভিকবাবুই প্রেসিডেন্ট।
ফ্ল্যাট সোশ্যাল নিয়ে মেতে উঠেছে বাচ্চা থেকে বুড়ো প্রত্যেকে। সৌভিকবাবুর কড়া হুকুম, সক্কলকে কিছু না কিছু করতেই হবে। পরমাদেবীর প্রতিবাদ এক্ষেত্রে ধোপে টেকেনি। উনি বলতে চেষ্টা করেছিলেন, “আমি তো নাচ, গান, কবিতা কিছুই পারি না। এই বুড়ো বয়সে কি তাহলে রঙ মেখে সং সাজবো?”
“কাকিমা তুমি আমাদের সাথে গ্রুপ সং-এ থেকো। গ্রুপের মধ্যে আলাদা করে গলা বোঝা যাবে না। আমি তোমাকে রিহার্সাল করিয়ে নেব” – বলেছিল মিতালী।
আর অবশেষে এল সেই সোশ্যালের দিন। সবাই মোটামুটি রেডি। স্টেজে উঠলেন সৌভিকবাবু। সভাপতির ভাষণ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হবে। একটু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন সভাপতি,
“অল্প কথায় আমার বক্তব্য সারার চেষ্টা করছি। তবু যে কথাগুলো না বললেই নয়, সেগুলোই আজ আপনাদের বলতে চাই। আমার পৈতৃক বাড়ি ভেঙ্গে এই ফ্ল্যাট হয়েছে। আমার পরিবারের সাথে তর্ক করে, একরকম জেদ করেই আমি এই বাড়ি ফ্ল্যাটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বাড়িটা ভাঙ্গা শুরু হল, মনে হত আমার হৃৎপিণ্ডটাকে কেউ যেন উপড়ে নিচ্ছে। এই বাড়ির প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথরের সাথে জড়িয়ে আমার ছেলেবেলা, পূর্বপুরুষ। তখন খুব মনে হত আমি ভুল করেছি, নিজের জেদের জন্যে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মনে হত এর থেকে মরে যাওয়া ভাল ছিল” – একটু থামলেন সৌভিকবাবু। গলা ধরে এসেছে।
তারপর আবার শুরু করলেন,
“যাই হোক, তারপর নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করলাম আমরা। আমার ‘মা ভবন’ নাম পাল্টে হয়ে গেল ‘পরিজন অ্যাপার্টমেন্ট’। সত্যি বলছি, এই বদলটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বুঝতে পারছিলাম যে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আর তারপরেই তো সেই ঘটনা ঘটল, যেটা আপনারা সবাই জানেন। সত্যি বলছি, যা হয় বোধহয় ভালর জন্যেই হয়। ওই ঘটনাটা না হলে আমি জানতেই পারতাম না যে আমার একটা এত বড় পরিবার আছে। বাবুয়া আমার সন্তান, আর সঞ্জুর সাথে আমি রক্তের বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম। ও কি আমার সন্তানের চেয়ে কম কিছু? আপনারাই বলুন? ওই সময়টায় আপনারা যেভাবে আমার পরিবারের পাশে থেকেছেন, আপনারা কি আমার আত্মীয় নন? আমার অসুস্থতা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আজ আমি নিশ্চিন্ত, আমার যদি কিছু হয়েও যায়, পরমা আর বাবুয়া ভেসে যাবে না। আপনারা সবাই আছেন। আর যে বাড়িতে আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এতদিন থাকতাম, সেখানে আজ আমি আমার এতজন পরিজন নিয়ে থাকি। এরকম সৌভাগ্য কতজন মানুষের হয় বলুন দেখি? যাক গে, আর বেশী সময় নষ্ট করব না, সবাই সেজেগুজে অপেক্ষা করছে অনুষ্ঠানের জন্যে । বুড়ো হলে এই হয় জানেন তো, বড্ড বেশী বকবক করে ফেলি”।
মাইক থেকে সরলেন সৌভিকবাবু। সামনে বসে থাকা সবাই তখন চোখের জল মুছছে। এতদিন তো ফ্ল্যাটবাড়ির খারাপ দিকটাই সবাই বলেছে। ফ্ল্যাট নাকি বড়লোকদের বস্তি! কই, এভাবে তো কেউ কখনো ভাবে নি! পরমাদেবী আজ বড় নিশ্চিন্ত। মানুষটা ভাল আছেন। এর চেয়ে শান্তির আর কি হতে পারে তাঁর কাছে!
“কাকিমা চলো, এবার আমাদের গান” – মিতালীর তাড়ায় খোঁপায় ফুলটা দিয়ে স্টেজের দিকে পা বাড়ান পরমাদেবী।
© মৌমিতা ঘোষ
#মৌমিতা_ঘোষ
|| ১ ||
"তুমি কি পাগল হলে? এই এতবড় বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দেবে? এলো কি কিরে এরকম ভাবনা তোমার মনে?" - খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে রে রে করে তেড়ে আসেন পরমা দেবী, সৌভিকবাবুর বাইশ বছরের সহধর্মিনী |
"শোনো পরমা, উত্তেজিত হয়ো না | উত্তেজনা কোনো সমাধান নয় | তুমি কি ভাবো আমার পিতৃপুরুষের ভিটের ওপর আমার কোনো টান নেই? এমনি এমনি এরকম একটা মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আমি?" - একটু রেগেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়ে দেন সৌভিক বাবু |
বাইরে থেকে ঘুরে এসে বারান্দায় রাখা বাবার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে সবে বলেছিলেন, "ভাবছি বাড়িটা এবার প্রোমোটারকে দিয়ে দেবো"| আর তাতেই বিস্ফোরক হয়ে ওঠেন পরমা দেবী | চৈত্রের ঠা ঠা রোদ্দুরের তাপে ঘামে ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে সৌভিকবাবুর আদ্দির পাঞ্জাবীটা | সেটা খুলে ইজিচেয়ারের হাতলে রেখে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে আবার বললেন,
"সারাজীবন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করলাম, আর ক’দিন পর রিটায়ার করবো | আমাদের পেনশন বলতে কিছু নেই | ছেলেটা বড় হচ্ছে, আজ বাদে কাল চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবে| ভেবে দেখেছো রিটায়ারমেন্টের ওই ক’টা টাকায় তখন আমাদের কিভাবে চলবে? এই এতো বড় বাড়িতে চারিদিকে ফাটল, কোথায় ভেঙে পড়ছে, কোথায় বট অশ্বত্থের চারা ! মেন্টেন করবে কিভাবে? বাড়ির ইঁট বেচে ভাত রাঁধবো? "
"কেন? বাবুয়া আমাদের দেখবে না? " - ব্যকুলতা স্পষ্ট পরমা দেবীর গলায় |
"তোমার কথাটা বলতে লজ্জা হলো না? আজকালকার দিনের একজন মা হয়ে ছেলের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবে তুমি? ওকে বড় করে কি ধন্য করে দিয়েছি আমরা যে সারাজীবন আমাদের খোরপোষ দেবে? খালি স্বার্থ আর স্বার্থ ! ছেলে বলে বাবা-মাকে দেখতেই হবে? আজ যদি বাবুয়া মেয়ে হতো এই এক্সপেক্টেশন রাখতে পারতে? ছিঃ, ! আর দ্বিতীয়দিন আমার সামনে এসব বলবে না বলে দিলাম | বাবুয়া নিজের জীবন শান্তিতে কাটাবে | কোনো বোঝা চাপাবে না ওর ওপরে |" - স্ত্রীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাথরুমে ঢুকে যান সৌভিকবাবু |
|| ২ ||
"বাবা, তুমি নাকি মাকে বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছো? " - আচমকা ঘরে ঢুকে সোজাসুজি প্রশ্ন করে বাবুয়া |
সৌভিকবাবু খাওয়াদাওয়ার পর সবে একটু শুয়েছিলেন | এই রবিবার দুপুরটা একটু না গড়িয়ে নিলে মনে হয় যেন কি একটা হয়নি ! আজ শুয়ে শুয়েও মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা যেন কিলবিল করছে | তার মধ্যেই বাবুয়ার এরকম প্রশ্নে আচমকা চিন্তার জটটা ছিঁড়ে গেল|
"আয়, বোস" - উঠে বসে বাবুয়াকে বসার জন্যে বিছানায় জায়গা করে দেন উনি |
"কেন বাবা, কেন করছ এমনটা? আমার ওপর কি তোমার একটুও ভরসা নেই? তোমার মনে হয় যে আমি তোমাদের দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত নই?" - বাবুয়ার চোখের কোনটা চিকচিক করছে, দেখেও না দেখার ভান করেন সৌভিকবাবু | ছেলেটা যে তাঁর প্রাণ | ওর কষ্ট উনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না | তবে সাথে এটাও চান না যে তাঁর জন্যে বাবুয়ার ওপর কোনো বোঝা চেপে থাকুক | বাবুয়া হয়তো আরো পড়াশুনো করতে বা চাকরি সূত্রে বাইরে যাবে | শুধু নিজের স্বার্থের কারণে ওনার কোনো অধিকার নেই ছেলেটাকে আটকে রাখার | আজ ছেলেটার আবেগ বড় বেশী, হয়ত বা বয়সের কারণেই | কিন্তু যেদিন ও বাস্তবের মুখোমুখি হবে, বাবা - মাকে দেওয়া কথার জন্যে হয়ত ওকে একটা ভালো সুযোগ ছেড়ে দিতে হবে | সেটা সহ্য করতে পারবেন না সৌভিকবাবু | পরমা ছেলেকে কাছে রেখে দিতে পারলেই মহা খুশি | কিন্তু সৌভিকবাবু বাবা হয়ে পারবেন না সেটা |
"তুই যে আমার কত বড় ভরসা, সেটা কি আমি তোকে বলে বোঝাবো? কিন্তু বাবুয়া, আমি আর তোর মা একা একা এই এত বড় বাড়িতে কি করবো বল তো? তুই আমাদের দেখবি আমি জানি | কিন্তু তুই যখন চাকরি করবি, তোর পক্ষে তো সম্ভব হবে না সবসময় এখানে থাকা | আমাদেরও বয়স বাড়বে | কে দেখবে বল এখানে আমাদের? সেখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে কত লোক !"
"এখানেও তো পাড়ার লোক আছে বাবা !"
"একটা বাড়ির মধ্যে পাশের ঘরের লোককে ডাকা আর পাশের বাড়ির লোককে ডাকার মধ্যে তফাৎ আছে বাবু | আরও বয়স হলে এখানে আমাদের নিরাপত্তা খুব কম বিশ্বাস কর"|
কোনোরকমে ছেলেকে বুঝিয়ে ঘরে পাঠান সৌভিকবাবু |
এই বাড়ির ইঁট, কাঠ, পাথরে জড়িয়ে আছে তাঁর ছেলেবেলা, পূর্বপুরুষ | তবে সেই সবকিছুর ওপরে তাঁর সন্তানের ভালো থাকা, সুস্থ থাকা | সৌভিকবাবুর কেবল মনে হচ্ছে এই বাড়িটা রাখলে বাবুয়ার ওপর এক মারাত্মক চাপ বাড়বে বই কমবে না ! আর তিনি বেঁচে থাকতে সেটা সহ্য করতে পারবেন না |
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্ল্যাটের কাজ শুরু করে দিতে হবে |
|| ৩ ।।
এক সপ্তাহ হল নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করেছেন সৌভিকবাবু। যতদিন ফ্ল্যাটটা তৈরীর কাজ হচ্ছিল, একটু দূরে অন্য একটা ফ্ল্যাটে থাকছিলেন ওনারা। প্রোমোটারই ঠিক করে দিয়েছিল। যখন তাঁর প্রাণের বাড়িটাকে একটু একটু করে ভাঙ্গছিল ওরা, প্রতিটা হাতুড়ির ঘা যেন সৌভিকবাবুর বুকের ভেতরে এসে লাগত। রোজ সকালে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির সামনে, মিস্ত্রীদের কাজ দেখতেন। ভাঙ্গাভাঙ্গির সময় মিস্ত্রীরা বারণ করত ওনাকে কাছে আসতে। পুরোনো দিনের বাড়ি, বলা তো যায়না কখন কোথা থেকে কি ভেঙ্গে পড়ে! বয়স্ক মানুষ, লেগে-টেগে গিলে আরেক বিপদ। প্রোমোটার মুকেশ বোধহয় এই লাইনে নতুন। এখনও মায়া-মমতা আছে শরীরে।
সৌভিকবাবুর সাথে দেখা হলেই বলতেন,
“চিন্তা করছেন কেন দাদা, ফ্ল্যাটে ভাবুন তো কত লোক আসবে, কত পরিচিতি হবে আপনার! আপনার এত বড় বাড়িতে মাত্র তিনজনে থাকতেন, আজ সেখানে আপনার বাড়িটা কতজনকে থাকার জায়গা করে দেবে! নিজের একটা ঠিকানা দেবে!”
মুকেশের সাথে কথা বলে বেশ ভাল লাগত সৌভিকবাবুর। বেশ সুন্দর করে ভাবতে পারে ছেলেটা। ভালই লাগত ওর মত করে ভাবতে। তবে এই ফ্ল্যাটে আসার পর সব হিসেব যেন গুলিয়ে গেল। এত লোক, তাও যেন কেমন খাঁ খাঁ করছে সবসময়। বারবার মনে হচ্ছিল ওইখানে তুলসীমঞ্চ ছিল, ওইখানে পাতকুয়ো, পিছনদিকে কতগুলো ফুলের গাছ বসিয়েছিলেন পরমা ...
এই ফ্ল্যাটেও একটা তুলসীমঞ্চ আছে বটে, তবে সৌভিকবাবুর মনে হচ্ছে ওতে যেন ঠিক প্রাণ নেই। ওখানে পরমা সন্ধেবেলা ধূপ দিচ্ছে বা শাঁখ বাজাচ্ছে ভাবতে কেমন যেন কষ্ট হয়!
পরমাদেবী বুঝতে পারছিলেন যে ভেতরে ভতরে গুমরোচ্ছে মানুষটা। কম দিন তো হল না একসাথে, লোকটা ভাংবে তবু মচকাবে না। পরমাদেবী জানতেন যে বাড়িটা ফ্ল্যাট হয়ে গেলে ও পারবে না সহ্য করতে। অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাই আটকাতে। কিন্তু যা জেদী মানুষ! নিজের মুখ দিয়ে যখন বলেছেন, করেই ছাড়লেন ফ্ল্যাটটা। আর এখন কষ্টটা নিজের স্ত্রীর সাথেও ভাগ করে নেন না।
এই ফ্ল্যাটবাড়িতে দোতলায় একটা বারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট পেয়েছেন ওনারা, আর সঙ্গে বেশ ভাল অঙ্কের একটা টাকা। ডাইনিং –এর একফালি জানলা দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের দিকে কেমন যেন উদাস দৃষ্টিতে প্রায় সময়ই চেয়ে থাকেন সৌভিকবাবু। বড় ভয় করে পরমাদেবীর। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটাও বড্ড অচেনা হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
বাবুয়া এক সপ্তাহের জন্যে ট্রেনিং-এ দক্ষিণ ভারত গেছে। মাঝরাত্রে পরমাদেবীর হঠাত ঘুম ভাঙ্গল সৌভিকবাবুর ধাক্কায়। বুকের বাঁ দিকটা চেপে ধরে আছেন উনি। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। একটাও কথা বলতে পারছেন না। এমনিতেই নার্ভাস পরমাদেবীর মনে হচ্ছিল পায়ের তলায় আর মাটি নেই। দরজাটা খুলে তাড়াতাড়ি বেল বাজান পাশের ফ্ল্যাটে। সঞ্জু আর কাকলি থাকে ওটায়। নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের, চাকরিসূত্রে তাই কোলকাতায় খেলাঘর পেতেছে দু’জন। সঞ্জু না থাকলে কি যে হত তখন! পনেরো মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে ফেলে সঞ্জু। তারপর ফ্ল্যাটের সবাই মিলে আধঘন্টার মধ্যেই বাড়ির কাছের নার্সিংহোমে আই সি ইউ-তে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল সৌভিকবাবুকে। ডাক্তার বললেন আর একটুও দেরী হলে ভয়ানক কিছু একটা হয়ে যেতে পারত। হার্টে বেশ বড়সড় সমস্যা বাঁধিয়ে বসেছেন ভদ্রলোক। বাইপাস করতেই হবে। বেশ কয়েকদিন অবজার্ভেশনে রাখার পর অপারেশন হবে ঠিক হল।
এত কিছু ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল, পরমা দেবীর ধাতস্থ হতেই বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছিল। সঞ্জু না থাকলে সেদিন যে কি হত! ভাবলেও এখন শিউরে উঠছেন উনি। বাবুয়াকে খবর পাঠানো হয়েছে। তবে সঞ্জু এটাও বলেছে ওকে, যে এক্ষুনি তো অপারেশন হচ্ছে না, কাজেই বাবুয়ার এক্ষুনি হুড়মুড়িয়ে আসার দরকার নেই। ও আর কয়েকদিনের ট্রেনিং শেষ করেই আসুক। এদিকটা ওরা সামলে নেবে। একটু বোধহয় স্বস্তি পেয়েছিল বাবুয়া।
কিন্তু আসল সমস্যাটা হল অপারেশনের দিন। ওটি তে ঢোকানোর পর ডাক্তার হঠাত বললেন দু’ইউনিট রক্ত লাগবে, এমার্জেন্সি। কিন্তু সৌভিকবাবুর বম্বে ব্লাড গ্রুপ। এত সহজে ওই গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায় না। পাগলের মত এক নার্সিংহোম থেকে অন্য নার্সিংহোমে, ব্লাড ব্যাঙ্কে ছোটাছুটি করছিল বাবুয়া। সঞ্জুর সেদিন অফিসের একটা কাজ ছিল জরুরী, ওকে তাই কিছু জানানো হয়নি। শেষে আর থাকতে না পেরে বাধ্য হয়েই ওকে ফোন করেছিল বাবুয়া। যদি ওর কিছু জানাশোনা থাকে।
“তুই আমায় এতক্ষণ জানাতে পারিসনি? আমার তো বম্বে ব্লাড গ্রুপ! আমি এক্ষুনি আসছি” – বলেছিল সঞ্জু।
“আমি জানতাম না তো দাদা! তোমার যে আজ ইম্পর্টেন্ট মিটিং ছিল” – খড়কুটোড় মত সঞ্জুকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল বাবুয়া।
“আমার মিটিংয়ের থেকে কাকুর প্রাণটা বেশী জরুরী বাবুয়া। তুই ফোন রাখ, আমি আসছি”।
এরপর বাকি গল্পটা রূপকথার মতন। সঞ্জুর দেওয়া রক্তে সুস্থ হয়ে সাকসেসফুল অপারেশনের পর বাড়ি, অর্থাৎ তাঁর নতুন ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন সৌভিকবাবু। তবে বাড়ি আসার পর একটা জিনিস খেয়াল করলেন পরমা দেবী, সৌভিকবাবুর মধ্যে সেই মনমরা ভাবটা আর নেই। বরং এখন যেন আগের থেকেও বেশী চনমনে। নিজের বয়সী বন্ধু যোগাড় করে ফেলেছেন ফ্ল্যাটেই জনা চারেক, সবাইকে নিয়ে সন্ধেবেলা তাস খেলা হয় ওনাদেরই ড্রয়িংরুমে। এখন আবার সৌভিকবাবুরই উৎসাহে ফ্ল্যাট সোশালের আয়োজন করছে সবাই। ওনার উৎসাহ দেখে কিনা জানা নেই, তবে ফ্ল্যাটের সবার সিদ্ধান্তে সৌভিকবাবুই প্রেসিডেন্ট।
ফ্ল্যাট সোশ্যাল নিয়ে মেতে উঠেছে বাচ্চা থেকে বুড়ো প্রত্যেকে। সৌভিকবাবুর কড়া হুকুম, সক্কলকে কিছু না কিছু করতেই হবে। পরমাদেবীর প্রতিবাদ এক্ষেত্রে ধোপে টেকেনি। উনি বলতে চেষ্টা করেছিলেন, “আমি তো নাচ, গান, কবিতা কিছুই পারি না। এই বুড়ো বয়সে কি তাহলে রঙ মেখে সং সাজবো?”
“কাকিমা তুমি আমাদের সাথে গ্রুপ সং-এ থেকো। গ্রুপের মধ্যে আলাদা করে গলা বোঝা যাবে না। আমি তোমাকে রিহার্সাল করিয়ে নেব” – বলেছিল মিতালী।
আর অবশেষে এল সেই সোশ্যালের দিন। সবাই মোটামুটি রেডি। স্টেজে উঠলেন সৌভিকবাবু। সভাপতির ভাষণ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হবে। একটু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন সভাপতি,
“অল্প কথায় আমার বক্তব্য সারার চেষ্টা করছি। তবু যে কথাগুলো না বললেই নয়, সেগুলোই আজ আপনাদের বলতে চাই। আমার পৈতৃক বাড়ি ভেঙ্গে এই ফ্ল্যাট হয়েছে। আমার পরিবারের সাথে তর্ক করে, একরকম জেদ করেই আমি এই বাড়ি ফ্ল্যাটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বাড়িটা ভাঙ্গা শুরু হল, মনে হত আমার হৃৎপিণ্ডটাকে কেউ যেন উপড়ে নিচ্ছে। এই বাড়ির প্রতিটা ইট, কাঠ, পাথরের সাথে জড়িয়ে আমার ছেলেবেলা, পূর্বপুরুষ। তখন খুব মনে হত আমি ভুল করেছি, নিজের জেদের জন্যে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মনে হত এর থেকে মরে যাওয়া ভাল ছিল” – একটু থামলেন সৌভিকবাবু। গলা ধরে এসেছে।
তারপর আবার শুরু করলেন,
“যাই হোক, তারপর নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করলাম আমরা। আমার ‘মা ভবন’ নাম পাল্টে হয়ে গেল ‘পরিজন অ্যাপার্টমেন্ট’। সত্যি বলছি, এই বদলটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বুঝতে পারছিলাম যে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আর তারপরেই তো সেই ঘটনা ঘটল, যেটা আপনারা সবাই জানেন। সত্যি বলছি, যা হয় বোধহয় ভালর জন্যেই হয়। ওই ঘটনাটা না হলে আমি জানতেই পারতাম না যে আমার একটা এত বড় পরিবার আছে। বাবুয়া আমার সন্তান, আর সঞ্জুর সাথে আমি রক্তের বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম। ও কি আমার সন্তানের চেয়ে কম কিছু? আপনারাই বলুন? ওই সময়টায় আপনারা যেভাবে আমার পরিবারের পাশে থেকেছেন, আপনারা কি আমার আত্মীয় নন? আমার অসুস্থতা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আজ আমি নিশ্চিন্ত, আমার যদি কিছু হয়েও যায়, পরমা আর বাবুয়া ভেসে যাবে না। আপনারা সবাই আছেন। আর যে বাড়িতে আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এতদিন থাকতাম, সেখানে আজ আমি আমার এতজন পরিজন নিয়ে থাকি। এরকম সৌভাগ্য কতজন মানুষের হয় বলুন দেখি? যাক গে, আর বেশী সময় নষ্ট করব না, সবাই সেজেগুজে অপেক্ষা করছে অনুষ্ঠানের জন্যে । বুড়ো হলে এই হয় জানেন তো, বড্ড বেশী বকবক করে ফেলি”।
মাইক থেকে সরলেন সৌভিকবাবু। সামনে বসে থাকা সবাই তখন চোখের জল মুছছে। এতদিন তো ফ্ল্যাটবাড়ির খারাপ দিকটাই সবাই বলেছে। ফ্ল্যাট নাকি বড়লোকদের বস্তি! কই, এভাবে তো কেউ কখনো ভাবে নি! পরমাদেবী আজ বড় নিশ্চিন্ত। মানুষটা ভাল আছেন। এর চেয়ে শান্তির আর কি হতে পারে তাঁর কাছে!
“কাকিমা চলো, এবার আমাদের গান” – মিতালীর তাড়ায় খোঁপায় ফুলটা দিয়ে স্টেজের দিকে পা বাড়ান পরমাদেবী।
© মৌমিতা ঘোষ