Thread Rating:
  • 63 Vote(s) - 2.92 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কাজলদীঘি শ্মশান/পীরবাবার থান--মামনজাফরান (জ্যোতি বন্দোপাধ্যায়)
#49
আমি বললাম চলুন, মিত্রা আমার দিকে একবার তাকাল, ওর চোরা চোখের চাহুনি কিছু বলতে চায়, আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। পায়ে পায়ে ওপরের ঘরে উঠে এলাম, মিঃ ব্যানার্জী, আমার পেছন পেছন এলেন।
-অনিন্দ তোমার এখানে এ্যাসট্রে আছে।
-না।
-তুমি সিগারেট খাও না।
-খাই, তবে ইচ্ছে হলে।
-বাঃ। খুব ভাল হ্যাবিট।
-আজ কি আমার সঙ্গে একটা খাবে।
-দিন।
আমি আমার টেবিলের তলা থেকে একটা ভাঁড় বার করলাম, মিঃ ব্যানার্জী, ইজি চেয়ারে বসলেন, আমি আমার চেয়ারে। উনি একাট সিগারেট আমাকে দিলেন, আর একটা নিজে ধরালেন। দু চারবার সুখটান দেবার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, অনিন্দ আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।
-আপনাকে! আমি।
-হ্যাঁ।
-আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই করবো।
-আমি তোমাকে অসাধ্য সাধন করতে বলবো না। তবে বিশ্বাস করি তুমি পারবে।
-বলুন।
-মিত্রা তোমার খুব ভাল বন্ধু।
-হ্যাঁ।
-মিত্রাকে তুমি একটু সঙ্গ দাও।
-সে তো দিচ্ছি। ওর যখনই অসুবিধা হবে আমি ওর পাশে থাকবো।
-না অফিসায়ালি নয়, আন অফিসায়ালি।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর চোখে চোখ রাখলাম, মনে মনে বললাম ডাক্তার তুমি বড় খেলোয়াড় হতে পার, আমি ছোট খেলোয়াড় এটা ভাবছ কেনো।
-আমি আপনার কথাটা ঠিক ধরতে পারছি না।
-তুমি সেদিন আমাদের বাড়িতে গেছিলে, মিত্রা আমায় বলেছে, তাছাড়া সেদিন থেকে মিত্রা একটা জিনিষ ছেড়ে দিয়েছে, যা আমি বিগত দেড় বছরে চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারিনি।
-কি ?
-ও সেদিন থেকে আর ড্রিংক করে না।
-বাঃ এটা খুব ভাল খবর।
-শুধু ভাল খবর নয়, ও তোমার সান্নিধ্যে এসে অনেক বদলে গেছে। ওর চাল চলন কথাবার্তা।
-এটা আপনি বাড়িয়ে বলছেন, মিত্রা বরাবরই ভাল মেয়ে।
-আমি অস্বীকার করতে পারি না। তবে কি জানো অনিন্দ তুমি আমার থেকে অনেক ছোট, আজ তোমার কাছে আমি অকপটে স্বীকার করছি, আমি ওকে আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারি নি। সে অনেক কথা, সময় সুযোগ হলে তোমায় বলবো। আজ মনে হচ্ছে তোমাদের এখানে এসে আমি একটা দিশা খুঁজে পাচ্ছি।
 
আমি মিঃ ব্যানার্জীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। একটা সিগারেট শেষে দ্বিতীয়টা ধরেছেন।
-অর্থ বাদ দিলে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কিছু কর্তব্য থাকে, আমি তার কোনটাই পালন করতে পারি নি। তুমি হয়তো প্রশ্ন করবে কেনো। ওই যে বললাম সে অনেক কথা। আমি তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তোমার কথা ওর মুখ থেকে বহুবার শুনেছি। কাকতালীয় ভাবে তুমি যে আমাদের হাউসেই কাজ করো তা জানতাম না। ক্লাবে তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়, সেদিনই তোমায় আমি মার্ক করেছি। তবে তুমি এর মধ্যে কোন যোগাযোগ রাখনি মিত্রার সঙ্গে, তুমি ভাইজ্যাক গেছো সেও আমি জানতাম। তুমি এ বাড়িতে থাকো না, তাও আমি জানি। তবে মিত্রা কিছু এ ব্যাপারে আমাকে বলে নি। আমি নিজের ইন্টারেস্টে তোমার খোঁজ খবর নিয়েছি।
 
আমি মিঃ ব্যানার্জীর দিকে তাকিয়ে আছি, উনি ভাবলেশহীনভাবে ওনার কথা বলে চলেছেন।
-তুমি তো আমার বয়েসটা দেখছো, মিত্রার পাশে আমায় মানায় না।
আমার কানের লতি গরম হয়ে যাচ্ছে।
-কোন একটা কারণে মিত্রাকে আমি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। সেটাও তোমাকে আমি একদিন বলবো।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর কথায় অবাক হলাম, উনি কি নিজের কথা বলছেন, না বানিয়ে বানিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করছেন।
-আমি তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করবো, মিঃ ব্যানার্জী ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার হাত দুটো ধরলেন, ওর সঙ্গে কলেজ লাইফে তুমি যে ভাবে মিশতে ঠিক তেমনি ভাবে মেশো, আমার কোন আপত্তি নেই।
আমি মিঃ ব্যানার্জীর চোখে চোখ রাখলাম, চোখ দুটো কেমন হতাশ, এতো বড় একজন ডাক্তার আমার সামনে কেমন যেন হয়ে পরেছেন। সত্যি বলছি অনিন্দ তুমি যদি ওর বেড পার্টনারও হও তাতেও আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আমি ওকে ভীষণ হাসি খুশি দেখতে চাই। ওর মধ্যে যে প্রাণটা হারিয়ে গেছিলো, তুমি কয়েকদিনের মধ্যে তা ফিরিয়ে দিয়েছো।
 
-সবচেয়ে অবাক কথা কি জানো অনিন্দ, আমার কথায় অভিমানে ওর চোখে কোন দিন জল দেখি নি, আজ প্রথম ওর চোখে জল দেখলাম। আমি জানি ও তোমাকে ভীষণ ভালবাসে। আমি সেই মুহূর্তে ডিসিশন নিয়েছিলাম, তোমাকে আমি সব বলবো। আশা রাখি তুমি আমার এই অনুরোধটুকু রাখবে
-এ আপনি কি বলছেন!
-আমি ঠিক বলছি, আমি স্ব-জ্ঞানে তোমাকে বলছি, এটা আমার কোন অভিনয় নয়। এটা আমার পরাজয়, তবু এ পরাজয়ের মধ্যে আনন্দ আছে। সে তুমি বুঝবে না। তোমাকে আমি বলবো, সব বলবো। বলো তুমি এ উপকারটুকু করবে
-আমি কথা দিতে পারবো না। তবে চেষ্টা করবো।
-কি হলো এবার যেতে হবে তো। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েছো, কটা বাজে। দেখলাম ছোটমা, বড়মা, মিত্রা আমার ঘরের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে। মিত্রা আমার দিকে বিস্ময় চোখে তাকালো, মিঃ ব্যানার্জী চশমাটা চোখ থেকে খুলে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন।


চার বছর পর আমার নিজের গ্রামে পা রাখলাম। দেখতে দেখতে চার চারটে বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে জানি না। বাস থেকে চকে (গ্রাম্য ভাষায় বাস স্ট্যান্ডকে চক বলে) নামতেই সবাই কেমন উতসুখ হয়ে আমার দিকে তাকাল। এখান থেকে আমায় ১০ কিলো মিটার হেঁটে যেতে হবে। প্রায় আড়াই ঘন্টার রাস্তা, একটা সময় সাইকেল নিয়ে এসব রাস্তায় কত ঘোরা ঘুরি করেছি। আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে।

সূর্যিমামা এখন মধ্যগগনেআগে এই চকে যে কয়টা দোকান দেখে গেছিলাম, এখন তার থেকে কয়েকটা বেড়েছে। পরিচিত যারা ছিলেন তাদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না, হয়তো চিনতে পারছি না। আমরা যে চায়ের দোকানে এসে আড্ডা মারতাম সেই দোকানে ঢুকলাম, একটা বছর কুড়ির ছেলে বসে বসে চা বানাচ্ছে, আরো অনেকে বসে আছেন। আমি চায়ের কথা বলতে ছেলেটি একটু অবাক হয়ে তাকালো। এটা পরিতোষদার চায়ের দোকান, পরিতোষদার কথা বলতেই ছেলেটি কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকালো, তারপর আস্তে করে বললো বাব বাড়িতে আছেন। চা দিতে একটু দেরি হবে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম ঠিক আছে, তুমি করে দাও। আমি একটু বসছি। আমি জানি এই দুপুর রোদে এখানে কেউ চা খায় না। তাই চায়ের সরঞ্জাম সব ধোয়া হয়ে গেছে, আমার জন্য আবার নতুন করে বানাতে হবে তাই দেরি হবে।

দুটো মিষ্টি চেয়ে নিলাম, না মিষ্টির স্বাদ সেরকমই আছে, জলের স্বাদও একই রকম, যাক এত পরিবর্তনের মধ্যেও এই দুটোর স্বাদ এখনো ঠিক আছে। চা খেলাম, কথা বলতে বলতে জানলাম, এখন আর হেঁটে যাবার দরকার নেই চাইলে ট্রলি পাওয়া যায়, লোক যদি বেশি হয় তাহলে পয়সা কম লাগে না হলে পয়সা একটু বেশি লাগে, চা খেতে খেতে আমাদের হাউসের কাগজটায় একটু চোখ বোলালাম, আমার একটা লেখা বেরিয়েছে দেখছি, এ লেখাটাতো অনেক দিন আগের লেখা, অমিতাভদা সরিয়ে রেখে ছিলেন, মনে মনে হাসলাম।
-বাবু আপনি কি যাবেন নাকি ?
-হ্যাঁ।
-কোথায় যাবেন ?
গ্রামের নাম বলতেই আশেপাশের অনেক লোক আমার দিকে তাকালেন।
-কার ঘর যাবেন ?
-মনা মাস্টার।
এবার সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন।
-আপনি কে হন ?
আমি ওনার ছাত্র।
-ও। তা বাবু আপনি কোথা থেকে আসছেন।
-কলকাতা থেকে।
-ওনার এক আত্মীয়ও কলকাতা থাকে। কাগজে কাজ করে। বিরাট সাংবাদিক।
হাসলাম।
-তুমি থাকো কোথায়?
-মনা মাস্টারের পাশের গ্রাম।
-ও।
-চলো তাহলে।
ওর ট্রলিতে চেপে বসলাম। মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগলো যেতে, যেতে অনেক কথা বললাম, ট্রলিওয়ালার সঙ্গে, গ্রামের খোঁজ খবর নিলাম, কয়েকজনের নাম বলতেই, ও কেমন সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালো, বললো, আপনি এঁদের চেনেন নাকি।
বললাম হ্যাঁ অনেক দিন আগে একবার এসেছিলাম, তখন তোমাদের এই রাস্তাটা তৈরি হয় নি,
-হ্যাঁ বাবু এতো বছর খানেক হলো, তাও আবার বর্ষার সময় মোরাম ধুয়ে যায়।
-যাক রাস্তাটা মোরাম হয়েছে বলে তোমাদেরও কিছু রোজগার হচ্ছে বলো।
সামনের দিকে তাকালাম, সেই বিশাল মাঠ, এখানে আমার কতো স্মৃতি লুকিয়ে আছে, ঐ দূরে দেখা যায় উনা মাস্টারের বাড়ি, ঐ বাঁধের ওপাশ দিয়ে গেলেই সৌমি পূর্নিমাদের বাড়ি, ঐ দূরে দেখা যায় শ্মশানটা, না যেমন দেখেগেছিলাম, ঠিক তেমনি আছে, মাঠে এখন চাষ চলছে, সবুজ গালিচার মতো, যেদিকে তাকাও খালি সবুজ সবুজ একটু আনমনা হয়ে পরেছিলাম।
-আরে কে যায় অনি না।
ট্রলিটা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমি ট্রলিওয়ালাকে থামাতে বললাম, ও ট্রলি থামালো, ছুটে কাছে এলাম, উনা মাস্টার, নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম,
-থাক থাক। আমার থুতনি ধরে চুমু খেলেন।
-তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস।
-না স্যার, আপনার কাছে এখনো আমি অনিই আছি।
-তোর লেখাগুলো পরি। আজও তোর লেখাটা পরেছি। তোর লেখার হাতটা বড়ো ভালো।
-না স্যার। মাথা নীচু করলাম।
তোর লেখাগুলো এখনকার ছেলেগুলোকে পড়াই বুঝলি ওদের বলি, আনিও তোদের মতো আমার কাছে পড়েছে, কিন্তু তোদের মতো এতো বখাটে ছিলো না। ও আমাদের গ্রামের গর্ব।
 
এত প্রশংসা আমি আগে কখনো শুনিনি লজ্জায় আমার মাথা আর উঠছে না। খালি মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে স্যার স্যার বেরিয়ে আসছে। সত্যি গ্রামের মানুষগুলো এতো সাধাসিধে হয় যে তাদের কোন তুলনা হয় না।
-কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে।
-হ্যাঁ।
-কয়দিন থাকবি তো।
-হ্যাঁ।
-মনার আবার শরীরটা খারাপ হয়েছে। বয়স হচ্ছে তো।
উনা মাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম।
-যা, পারলে একবার আসিস।
-ঠিক আছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো, মনা কাকার শরীর খারাপ। কি হয়েছে। ধীরে ধীরে ট্রলিতে উঠে বসলাম, আর একটু খানি, তারপর নদী পেরিয়ে আমার স্বর্গের সিঁড়ি।
-বাবু আপনি চকে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলেছেন।
-আমি, কই নাতো।
-ঐ যে আপনার পরিচয় দেন নি। আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছি
-তুমি আমাকে চেনো।
-হ্যাঁ বাবু, আমি বিজয়।
-কুইল্যা ঘরের বিজয়।
-হ্যাঁ।
-হাঁড়ি পাড়ায় থাকো।
-হ্যাঁ বাবু, আমি তো আপনাদের ক্ষেতটা ভাগে চাষ করছি। মনা মাস্টার দিয়েছেন।
আমি অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকালাম।
নদী ঘাটের কাছে এসে বিজয় ট্রলি থামালো। আমি নামলাম, বাঁশের সাঁকোটা এখনো সেই জায়গাতেই আছে, না কোন পরিবর্তন নেই।
বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কতো দেবো।
-না বাবু আপনার কাছ থেকে পয়সা নিতে পারবনা।
-কেনো। তুমি এতটা পথ এলে।
-সে বৈকালে যখন আপনার ঘর যাব তখন দিবেন।
-না না তুমি এখন নাও।
-না।
বিজয় চলে গেলো।
[+] 2 users Like MNHabib's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কাজলদীঘির শ্মশান/পীর সাহেবের থান--মামনজাফরান (জ্যোতি বন্দোপা্ধ্যায়)) - by MNHabib - 06-11-2021, 01:55 PM



Users browsing this thread: