27-04-2019, 10:55 AM
[৩১]
বাসে উঠে বসার জায়গা পেয়ে গেল। রত্নাকরের ঘোর কাটে না। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী আম্মাজী। নিজেকে আগের মত অসহায় বোধ হয়না। ধ্যানে সব কিছু কি সত্যিই দেখা যায়? তাহলে ময়নাদের কথা জানলেন কি করে? আগে কখনো দেখেননি চেনেন না প্রথম দেখায় তাকে কেন সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেন? অলৌকিক ক্ষমতাবলে কি তিনি তাকে আগে থাকতেই চেনেন? কোনো প্রশ্নের উত্তর মীমাংসা করতে পারেনা। যত ভাবে ততই সব গোলমাল পাকিয়ে যায়। আম্মাজীর সঙ্গে যা করল তাতে তার কি কোনো পাপ হল? আম্মাজীই তো করতে বলল, পাপ হলে কি করাতেন? স্বপ্নের মত কেটে গেল সময়। পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা স্পর্শ করে বুঝতে পারে আগে যা যা ঘটেছে কোনো কিছুই স্বপ্ন নয়। মনে মনে স্থির করে ময়নার দেওয়া ভাত আর খাবেনা। ময়নাকে গোটা পঞ্চাশেক টাকা দিয়ে দেবে।
আন্না পিল্লাই সোসাইটির আম্মাজী গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। বাচ্চা চলে যাবার পর থেকেই মনটা উচাটন। যথেষ্ট উপার্জন হয়েছে। ব্যাঙ্কে যা টাকা আছে কয়েক পুরুষ দিব্যি চলে যাবে। মনিটরে দেখেই রত্নাকরকে ভাল লেগে যায়। কথা বলে আরও ভাল লাগে। ভদ্র বিনয়ী নির্মল মনের মানুষ। সিকদারবাবু এরকমই রিপোর্ট করেছে। মজুরদের সঙ্গে থাকে এখন। বাচ্চাকে দেখার পরে মনে হল যদি এইসব ছেড়েছুড়ে বাকী জীবনটা ওকে নিয়ে কাটাতে পারত বেশ হতো। সোসাইটির সর্বেসর্বা সবাই তার অঙুলি হেলনে চলে, এত প্রতাপ প্রতিপত্তি ক্ষমতার অধিকারী তবু এক জায়গায় বড় অসহায়। এত বড় কমপ্লেক্সের কোথায় কি ঘটছে পুংখ্যানুপুংখ্য আম্মাজীর নজরে আবার তার উপর রয়েছে অদৃশ্য শক্তির নজর। তিনি যেন লছমনের গণ্ডিতে আবদ্ধ সীতা মাইয়া। গণ্ডির বাইরে পা দিলেই সর্বনাশ, অন্য কিছু ভাবছেন ঘুণাক্ষরে প্রকাশ পেলেই ঠাই হবে জেলখানায়। ম্লান হাসি ফোটে ঠোটের কোলে। কানে বাজছে বাচ্চার "আম্মু-আম্মু" ডাক। যোনীতে তার রেশ রয়ে গেছে এখনো।
ভিজিটরস রুমে লোক জমতে শুরু করেছে। বিশ্রাম ঘরে মনিটরে দেখলেন, উপাসনা স্থলে একজন দুজন করে লোক আসছে। বাটন টিপে দু-একটা ইলাজ কক্ষে দেখলেন, কাজ হচ্ছে। যোণী দেখলে পুরুষ গুলো এমন করে যেন ক্ষুধার্ত বাঘ। এভাবে কি এরা সুস্থ হবে? সাময়িক একটু রিলিফ মিললেও রোগ এদের সারার নয়। বাচ্চা এসেছে পড়ার খরচ চালাবার জন্য। পারলে নিজের কাছে রেখে ওকে পড়াতো, এইসব কাজ ওকে করতে দিত না। সিকদার যা রিপোর্ট করেছে মা মারা যাবার পর ছেলেটা একেবারে একা। পাড়ায় সামাজিক কাজকর্ম করত। এখন প্রোমোটরের দেওয়া একটা ঘরে কুলিকামীনদের সঙ্গে থাকে। প্রোমোটর স্থানীয় মস্তান, সিকদারকে নজর রাখতে বলেছেন। টাকা দিল একবার খাম খুলেও দেখল না। অসুবিধেয় পড়লে যোগাযোগ করতে বলেছেন। মনে হয় না হাত পেতে চাইবে, ছেলেটা সেরকম নয়। অবশ্য অবস্থা বিপাকে মানুষ বদলে যায়।
বাসের জানলা দিয়ে নেতাজীর স্ট্যাচু দেখে রত্নাকর ধড়ফড়িয়ে উঠে নেমে পড়ল। টাকা যখন পেয়েছে কিছু কেনাকাটা করা দরকার। একটা লুঙ্গি এক প্রস্ত জামা প্যাণ্ট কিনতে চারশো টাকা খরচ হয়ে গেল। কিন্তু এগুলো কেনা জরুরী ছিল। ময়না শাড়িটা ফেরৎ নেয়নি। আম্মু ঠিকই বলেছেন, ময়নার সঙ্গে দুরত্ব বাড়াতে হবে। কেন যেন মনে হল, পাড়া হয়ে গেলে কেমন হয়? অনেককাল ওদের সঙ্গে দেখা হয়না। ওরা খোজ নেয়নি কিন্তু সেও কি খোজ নিয়েছে? সন্ধ্যের মুখে পাড়ায় ঢুকে নজরে পড়ল তাদের যেখানে বাড়ি ছিল সেখানে উঠেছে মস্ত মস্ত পিলার। মায়ের কথা মনে পড়তে চোখের পাতা ভিজে গেল। মা যেখানে আছে সেখান থেকে কি সব জানতে পারছে রতি এখন কি করছে কোথায় আছে?
আরে রতি না?
ঘুরে তাকাতে দেখল বঙ্কিম। রত্নাকর হেসে জিজ্ঞেস করল, ভাল আছিস?
তোর কি খবর? তুই তো একেবারে ডূমুরের ফুল হয়ে গেছিস? চল পঞ্চাদার দোকানে সবাই আছে।
রতিকে দেখে হোই-হোই করে উঠল সবাই। ভাল লাগে রত্নাকরের সব অভিমান দূর হয়ে গেল। উমাদা বলল, একটা খবর দিয়ে যাবিনা? সবাই এদিকে আমার কাছে খোজ খবর নিচ্ছে?
রত্নাকর জিজ্ঞেস করল, কে আবার আমার খোজ করল?
বেলাবৌদি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। একবার দেখা করিস।
আজ হবেনা। অন্যদিন যাবো। আমি থাকি সেই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। বেশি রাত করলে অটো বন্ধ হয়ে যাবে। আর সব খবর বলো।
খবর আর কি? চ্যারিটি শালা বুড়োরা দখল করে নিয়েছে। বঙ্কা বলল।
দখল মানে?
অফিসে সব সময় বুড়োদের গ্যাঞ্জাম।
রত্নাকর হাসল। সবাই একটা জায়গা চায় মনের কথা বিনিময় করার জন্য। এতকাল উপায় ছিলনা, অফিস হওয়ায় সেই সুযোগ খুলে দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে ঘরকুনো মানুষগুলো ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছেন।
পুলিন ভৌমিক মারা গেছে শুনেছিস? উমাদা জিজ্ঞেস করল।
রত্নাকর ভ্রু কুচকে তাকায়। উমাদা বলল, পাড়ার এককোনে পড়েছিলেন, ছেলেরা বাপকে ফেলে চলে গেল। পাড়ার লোকজনও ভুলতে বসেছিল।
রত্নাকর বলল, না ভুলিনি মনে আছে। একবার ওনার গাছের পেয়ারা পাড়তে গেছিলাম, মনে আছে হিমু লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলেন।
আর মুখ খিস্তি? হে-হে-হে। হিমেশ মনে করিয়ে দিল।
হেবভি কিচাইন। ছেরাদ্দ মিটতে না মিটতেই সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে তিন ছেলের কেচ্ছা। চ্যারিটী পর্যন্ত গড়ায়। বঙ্কা বলল।
এখানে চ্যারিটির কি করার আছে?
কে শোনে সে কথা। বুড়োরা খবরদারি করার সুযোগ ছাড়বে কেন?
মাঝখান থেকে বেলাবৌদির সঙ্গে বিজুদার কেচাইন।
পঞ্চাদা চা এগিয়ে দিল, নে চা খা।
বেলা বৌদি?
ছেলেরা বোনকে ভাগ দেবে না। বেলাবৌদি রুখে দাড়ালো সুমিতাদিকেও সমান ভাগ দিতে হবে। বিজুদা বলল, তোমার সব ব্যাপারে যাওয়ার কি দরকার? বেলাবৌদি জিদ ধরে বসল, না পুলিনবাবুর চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগ করতে হবে। বিজুদা খচে লাল।
কি হোল?
কি আবার? বেলাবৌদির কথা মত সুমিতাদিকেও ভাগ দিতে হল। বিজুদা বেলাবৌদিও ভাগাভাগি হয়ে গেল।
ভাগাভাগি মানে?
একেবারে ভাগাভাগি নয়, মতান্তর থেকে মনান্তর। দুজনের আগের মত মিল নেই শুনেছি।
বিজুদা সম্পর্কে বেলাবৌদির উষ্মা আগেও লক্ষ্য করেছে রত্নাকর কিন্তু সেটা এতদুর গড়িয়েছে জানতো না। সরদারপাড়া অনেকদুর আর দেরী করা ঠিক হবেনা। চা খেয়ে বলল, আজ আসি?
উমানাথ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে বলল, ট্যুইশনি করবি?
পরীক্ষা এসে গেছে, এখন থাক। রত্নাকর বলল।
এখন তার আর টিউশনি করার দরকার হবেনা মনে মনে ভাবে রত্নাকর। কিন্তু সেসব কথা উমাদাকে বলা যাবেনা। বিদায় নিয়ে অটোস্ট্যাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল। দুটোমাত্র অটো দাঁড়িয়ে কিন্তু চালক নেই। যাবেনা নাকি? খোজ করে জানলো হোটেলে খেতে গেছে। তাই তো খাওয়ার কথা খেয়ালই ছিলনা। পকেটে টাকা আছে মনে পড়তে রত্নাকর হোটেলের দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার ধারে দর্মায় ঘেরা হোটেল, সামনে ফুটপাথে কয়েকটা বেঞ্চ পাতা। রত্নাকর ফরমাশ করে বেঞ্চে জায়গা করে নিল। দ্রুত খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে দেখল অটো চালকরা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। ভাই যাবেতো? রত্নাকর প্রশ্ন করতে ইশারায় অটোতে বসতে বলল। আজ নিজেকে কেমন অন্যরকম লাগছে। বগলে জামা কাপড়ের ব্যাগ, পেট ভর্তি ভাত। পকেটে পয়সা থাকলে মেজাজটাই বদলে যায়। অটোতে উঠতে যাবে এমন সময় একটি বাচ্চা খালি গা পরণে ধুলি ধুষরিত প্যাণ্ট তার জামা ধরে টানল। তাকিয়ে দেখল মুখে কোনো কথা নেই শীর্ণ হাতটি মেলে দাঁড়িয়ে আছে। রত্নাকরের চোখে জল চলে আসে। পকেট হাতড়ে কিছু খুচরো যা ছিল ছেলেটির হাতে তুলে দিল। পয়সা হাতে পেয়ে ছেলেটি ছুট্টে অদুরে বসে একটি মহিলার কাছে চলে গেল। মহিলাটি সম্ভবত ওর মা। ছেলেটি ভিক্ষার্জিত অর্থে মাকে সাহায্য করছে। রত্নাকর মায়ের জন্য কিছুই করতে পারেনি। আম্মুর কথা মনে পড়ল। বয়সে তার চেয়ে বছর পনেরো বড় হলেও কথায় ব্যবহারে মমতার পরশ হৃদয় ছুয়ে যায়। ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন যাত্রী এসে গেছে। অটো ছেড়ে দিল। কিছুটা যেতেই খোয়ার রাস্তা দু পাশে সারি দিয়ে গাছ। এলোমেলো কয়েকটা বাড়ী। আস্তে আস্তে একদিন ঘন বসতিপুর্ণ হয়ে যাবে এই অঞ্চল।
মেয়েদের ভগবান অন্য ধাতুতে গড়েছে। বাবা মা-র আদরে এক পরিবেশে বড় হয়ে একদিন সব ছেড়ে চলে যায় শ্বশুরবাড়ী। সেখানে অন্য পরিবেশ নানা ভাব নানা মতের মানুষ অনায়াসে সবার সঙ্গে কেমন খাপ খাইয়ে নেয়। একজন পুরুষ কি পারবে এতটা এ্যাডজাস্ট করে চলতে? মনীষাবৌদিকে দেখে বোঝাই যায়না অন্য বাড়ীর থেকে এসেছে। কত সহজে উমাদাকে প্রায় নিজের ভাইয়ের মত কাছে টেনে নিয়েছে।
ফ্লাটের সামনে নামতে দেখল সুনসান কেউ কোথাও নেই। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে হাতের প্যাকেট নামিয়ে রেখে দেখল কোল্কুজো হয়ে শুয়ে আছে ময়না। কাপড় হাটুর উপর উঠে গেছে। বিরক্তিতে ধ্নুকের মত বেকে যায় ঠোট। কড়া করে বলতে হবে আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবেনা। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে দেখল উঠে বসেছে ময়না। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ময়না বলল, এতক্ষনে আসলি? তুর জন্য শুতে যেতে পারছিনা।
আমার জন্য কেন? রুক্ষস্বরে বলল রত্নাকর।
বারে ভাত লিয়ে এসেছি, তুই খাবি না?
রত্নাকর ঠেক খায়। মুখে কথা যোগায় না। কিছুক্ষন পর বলল, আমি খেয়ে এসেছি।
তুই খেয়ে এসেছিস? ম্লান হয়ে গেল ময়নার মুখ।
আমার জন্য আর ভাত রান্না করবি না। আমি অন্য জায়গায় খাব।
জানতাম বেশিদিন তুর এ ভাত রুচবেক নাই। একপাশে রাখা ভাতের থালা তুলে ময়না উঠে পড়ল।
রত্নাকর বলল, তুমি এই টাকাটা রেখে দাও।
হাতে ধরা টাকা চোখ তুলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। রত্নাকর দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ময়না বলল, দেনা চুকায়ে দিলি?
ময়না চলে গেল। রত্নাকরের চোখ জলে ভরে যায়। মনে মনে বলে, পুরুষরা বড় স্বার্থপর। ময়না পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো।
বাসে উঠে বসার জায়গা পেয়ে গেল। রত্নাকরের ঘোর কাটে না। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী আম্মাজী। নিজেকে আগের মত অসহায় বোধ হয়না। ধ্যানে সব কিছু কি সত্যিই দেখা যায়? তাহলে ময়নাদের কথা জানলেন কি করে? আগে কখনো দেখেননি চেনেন না প্রথম দেখায় তাকে কেন সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেন? অলৌকিক ক্ষমতাবলে কি তিনি তাকে আগে থাকতেই চেনেন? কোনো প্রশ্নের উত্তর মীমাংসা করতে পারেনা। যত ভাবে ততই সব গোলমাল পাকিয়ে যায়। আম্মাজীর সঙ্গে যা করল তাতে তার কি কোনো পাপ হল? আম্মাজীই তো করতে বলল, পাপ হলে কি করাতেন? স্বপ্নের মত কেটে গেল সময়। পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা স্পর্শ করে বুঝতে পারে আগে যা যা ঘটেছে কোনো কিছুই স্বপ্ন নয়। মনে মনে স্থির করে ময়নার দেওয়া ভাত আর খাবেনা। ময়নাকে গোটা পঞ্চাশেক টাকা দিয়ে দেবে।
আন্না পিল্লাই সোসাইটির আম্মাজী গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। বাচ্চা চলে যাবার পর থেকেই মনটা উচাটন। যথেষ্ট উপার্জন হয়েছে। ব্যাঙ্কে যা টাকা আছে কয়েক পুরুষ দিব্যি চলে যাবে। মনিটরে দেখেই রত্নাকরকে ভাল লেগে যায়। কথা বলে আরও ভাল লাগে। ভদ্র বিনয়ী নির্মল মনের মানুষ। সিকদারবাবু এরকমই রিপোর্ট করেছে। মজুরদের সঙ্গে থাকে এখন। বাচ্চাকে দেখার পরে মনে হল যদি এইসব ছেড়েছুড়ে বাকী জীবনটা ওকে নিয়ে কাটাতে পারত বেশ হতো। সোসাইটির সর্বেসর্বা সবাই তার অঙুলি হেলনে চলে, এত প্রতাপ প্রতিপত্তি ক্ষমতার অধিকারী তবু এক জায়গায় বড় অসহায়। এত বড় কমপ্লেক্সের কোথায় কি ঘটছে পুংখ্যানুপুংখ্য আম্মাজীর নজরে আবার তার উপর রয়েছে অদৃশ্য শক্তির নজর। তিনি যেন লছমনের গণ্ডিতে আবদ্ধ সীতা মাইয়া। গণ্ডির বাইরে পা দিলেই সর্বনাশ, অন্য কিছু ভাবছেন ঘুণাক্ষরে প্রকাশ পেলেই ঠাই হবে জেলখানায়। ম্লান হাসি ফোটে ঠোটের কোলে। কানে বাজছে বাচ্চার "আম্মু-আম্মু" ডাক। যোনীতে তার রেশ রয়ে গেছে এখনো।
ভিজিটরস রুমে লোক জমতে শুরু করেছে। বিশ্রাম ঘরে মনিটরে দেখলেন, উপাসনা স্থলে একজন দুজন করে লোক আসছে। বাটন টিপে দু-একটা ইলাজ কক্ষে দেখলেন, কাজ হচ্ছে। যোণী দেখলে পুরুষ গুলো এমন করে যেন ক্ষুধার্ত বাঘ। এভাবে কি এরা সুস্থ হবে? সাময়িক একটু রিলিফ মিললেও রোগ এদের সারার নয়। বাচ্চা এসেছে পড়ার খরচ চালাবার জন্য। পারলে নিজের কাছে রেখে ওকে পড়াতো, এইসব কাজ ওকে করতে দিত না। সিকদার যা রিপোর্ট করেছে মা মারা যাবার পর ছেলেটা একেবারে একা। পাড়ায় সামাজিক কাজকর্ম করত। এখন প্রোমোটরের দেওয়া একটা ঘরে কুলিকামীনদের সঙ্গে থাকে। প্রোমোটর স্থানীয় মস্তান, সিকদারকে নজর রাখতে বলেছেন। টাকা দিল একবার খাম খুলেও দেখল না। অসুবিধেয় পড়লে যোগাযোগ করতে বলেছেন। মনে হয় না হাত পেতে চাইবে, ছেলেটা সেরকম নয়। অবশ্য অবস্থা বিপাকে মানুষ বদলে যায়।
বাসের জানলা দিয়ে নেতাজীর স্ট্যাচু দেখে রত্নাকর ধড়ফড়িয়ে উঠে নেমে পড়ল। টাকা যখন পেয়েছে কিছু কেনাকাটা করা দরকার। একটা লুঙ্গি এক প্রস্ত জামা প্যাণ্ট কিনতে চারশো টাকা খরচ হয়ে গেল। কিন্তু এগুলো কেনা জরুরী ছিল। ময়না শাড়িটা ফেরৎ নেয়নি। আম্মু ঠিকই বলেছেন, ময়নার সঙ্গে দুরত্ব বাড়াতে হবে। কেন যেন মনে হল, পাড়া হয়ে গেলে কেমন হয়? অনেককাল ওদের সঙ্গে দেখা হয়না। ওরা খোজ নেয়নি কিন্তু সেও কি খোজ নিয়েছে? সন্ধ্যের মুখে পাড়ায় ঢুকে নজরে পড়ল তাদের যেখানে বাড়ি ছিল সেখানে উঠেছে মস্ত মস্ত পিলার। মায়ের কথা মনে পড়তে চোখের পাতা ভিজে গেল। মা যেখানে আছে সেখান থেকে কি সব জানতে পারছে রতি এখন কি করছে কোথায় আছে?
আরে রতি না?
ঘুরে তাকাতে দেখল বঙ্কিম। রত্নাকর হেসে জিজ্ঞেস করল, ভাল আছিস?
তোর কি খবর? তুই তো একেবারে ডূমুরের ফুল হয়ে গেছিস? চল পঞ্চাদার দোকানে সবাই আছে।
রতিকে দেখে হোই-হোই করে উঠল সবাই। ভাল লাগে রত্নাকরের সব অভিমান দূর হয়ে গেল। উমাদা বলল, একটা খবর দিয়ে যাবিনা? সবাই এদিকে আমার কাছে খোজ খবর নিচ্ছে?
রত্নাকর জিজ্ঞেস করল, কে আবার আমার খোজ করল?
বেলাবৌদি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। একবার দেখা করিস।
আজ হবেনা। অন্যদিন যাবো। আমি থাকি সেই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। বেশি রাত করলে অটো বন্ধ হয়ে যাবে। আর সব খবর বলো।
খবর আর কি? চ্যারিটি শালা বুড়োরা দখল করে নিয়েছে। বঙ্কা বলল।
দখল মানে?
অফিসে সব সময় বুড়োদের গ্যাঞ্জাম।
রত্নাকর হাসল। সবাই একটা জায়গা চায় মনের কথা বিনিময় করার জন্য। এতকাল উপায় ছিলনা, অফিস হওয়ায় সেই সুযোগ খুলে দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে ঘরকুনো মানুষগুলো ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছেন।
পুলিন ভৌমিক মারা গেছে শুনেছিস? উমাদা জিজ্ঞেস করল।
রত্নাকর ভ্রু কুচকে তাকায়। উমাদা বলল, পাড়ার এককোনে পড়েছিলেন, ছেলেরা বাপকে ফেলে চলে গেল। পাড়ার লোকজনও ভুলতে বসেছিল।
রত্নাকর বলল, না ভুলিনি মনে আছে। একবার ওনার গাছের পেয়ারা পাড়তে গেছিলাম, মনে আছে হিমু লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলেন।
আর মুখ খিস্তি? হে-হে-হে। হিমেশ মনে করিয়ে দিল।
হেবভি কিচাইন। ছেরাদ্দ মিটতে না মিটতেই সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে তিন ছেলের কেচ্ছা। চ্যারিটী পর্যন্ত গড়ায়। বঙ্কা বলল।
এখানে চ্যারিটির কি করার আছে?
কে শোনে সে কথা। বুড়োরা খবরদারি করার সুযোগ ছাড়বে কেন?
মাঝখান থেকে বেলাবৌদির সঙ্গে বিজুদার কেচাইন।
পঞ্চাদা চা এগিয়ে দিল, নে চা খা।
বেলা বৌদি?
ছেলেরা বোনকে ভাগ দেবে না। বেলাবৌদি রুখে দাড়ালো সুমিতাদিকেও সমান ভাগ দিতে হবে। বিজুদা বলল, তোমার সব ব্যাপারে যাওয়ার কি দরকার? বেলাবৌদি জিদ ধরে বসল, না পুলিনবাবুর চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগ করতে হবে। বিজুদা খচে লাল।
কি হোল?
কি আবার? বেলাবৌদির কথা মত সুমিতাদিকেও ভাগ দিতে হল। বিজুদা বেলাবৌদিও ভাগাভাগি হয়ে গেল।
ভাগাভাগি মানে?
একেবারে ভাগাভাগি নয়, মতান্তর থেকে মনান্তর। দুজনের আগের মত মিল নেই শুনেছি।
বিজুদা সম্পর্কে বেলাবৌদির উষ্মা আগেও লক্ষ্য করেছে রত্নাকর কিন্তু সেটা এতদুর গড়িয়েছে জানতো না। সরদারপাড়া অনেকদুর আর দেরী করা ঠিক হবেনা। চা খেয়ে বলল, আজ আসি?
উমানাথ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে বলল, ট্যুইশনি করবি?
পরীক্ষা এসে গেছে, এখন থাক। রত্নাকর বলল।
এখন তার আর টিউশনি করার দরকার হবেনা মনে মনে ভাবে রত্নাকর। কিন্তু সেসব কথা উমাদাকে বলা যাবেনা। বিদায় নিয়ে অটোস্ট্যাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল। দুটোমাত্র অটো দাঁড়িয়ে কিন্তু চালক নেই। যাবেনা নাকি? খোজ করে জানলো হোটেলে খেতে গেছে। তাই তো খাওয়ার কথা খেয়ালই ছিলনা। পকেটে টাকা আছে মনে পড়তে রত্নাকর হোটেলের দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার ধারে দর্মায় ঘেরা হোটেল, সামনে ফুটপাথে কয়েকটা বেঞ্চ পাতা। রত্নাকর ফরমাশ করে বেঞ্চে জায়গা করে নিল। দ্রুত খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে দেখল অটো চালকরা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। ভাই যাবেতো? রত্নাকর প্রশ্ন করতে ইশারায় অটোতে বসতে বলল। আজ নিজেকে কেমন অন্যরকম লাগছে। বগলে জামা কাপড়ের ব্যাগ, পেট ভর্তি ভাত। পকেটে পয়সা থাকলে মেজাজটাই বদলে যায়। অটোতে উঠতে যাবে এমন সময় একটি বাচ্চা খালি গা পরণে ধুলি ধুষরিত প্যাণ্ট তার জামা ধরে টানল। তাকিয়ে দেখল মুখে কোনো কথা নেই শীর্ণ হাতটি মেলে দাঁড়িয়ে আছে। রত্নাকরের চোখে জল চলে আসে। পকেট হাতড়ে কিছু খুচরো যা ছিল ছেলেটির হাতে তুলে দিল। পয়সা হাতে পেয়ে ছেলেটি ছুট্টে অদুরে বসে একটি মহিলার কাছে চলে গেল। মহিলাটি সম্ভবত ওর মা। ছেলেটি ভিক্ষার্জিত অর্থে মাকে সাহায্য করছে। রত্নাকর মায়ের জন্য কিছুই করতে পারেনি। আম্মুর কথা মনে পড়ল। বয়সে তার চেয়ে বছর পনেরো বড় হলেও কথায় ব্যবহারে মমতার পরশ হৃদয় ছুয়ে যায়। ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন যাত্রী এসে গেছে। অটো ছেড়ে দিল। কিছুটা যেতেই খোয়ার রাস্তা দু পাশে সারি দিয়ে গাছ। এলোমেলো কয়েকটা বাড়ী। আস্তে আস্তে একদিন ঘন বসতিপুর্ণ হয়ে যাবে এই অঞ্চল।
মেয়েদের ভগবান অন্য ধাতুতে গড়েছে। বাবা মা-র আদরে এক পরিবেশে বড় হয়ে একদিন সব ছেড়ে চলে যায় শ্বশুরবাড়ী। সেখানে অন্য পরিবেশ নানা ভাব নানা মতের মানুষ অনায়াসে সবার সঙ্গে কেমন খাপ খাইয়ে নেয়। একজন পুরুষ কি পারবে এতটা এ্যাডজাস্ট করে চলতে? মনীষাবৌদিকে দেখে বোঝাই যায়না অন্য বাড়ীর থেকে এসেছে। কত সহজে উমাদাকে প্রায় নিজের ভাইয়ের মত কাছে টেনে নিয়েছে।
ফ্লাটের সামনে নামতে দেখল সুনসান কেউ কোথাও নেই। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে হাতের প্যাকেট নামিয়ে রেখে দেখল কোল্কুজো হয়ে শুয়ে আছে ময়না। কাপড় হাটুর উপর উঠে গেছে। বিরক্তিতে ধ্নুকের মত বেকে যায় ঠোট। কড়া করে বলতে হবে আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবেনা। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে দেখল উঠে বসেছে ময়না। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ময়না বলল, এতক্ষনে আসলি? তুর জন্য শুতে যেতে পারছিনা।
আমার জন্য কেন? রুক্ষস্বরে বলল রত্নাকর।
বারে ভাত লিয়ে এসেছি, তুই খাবি না?
রত্নাকর ঠেক খায়। মুখে কথা যোগায় না। কিছুক্ষন পর বলল, আমি খেয়ে এসেছি।
তুই খেয়ে এসেছিস? ম্লান হয়ে গেল ময়নার মুখ।
আমার জন্য আর ভাত রান্না করবি না। আমি অন্য জায়গায় খাব।
জানতাম বেশিদিন তুর এ ভাত রুচবেক নাই। একপাশে রাখা ভাতের থালা তুলে ময়না উঠে পড়ল।
রত্নাকর বলল, তুমি এই টাকাটা রেখে দাও।
হাতে ধরা টাকা চোখ তুলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। রত্নাকর দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ময়না বলল, দেনা চুকায়ে দিলি?
ময়না চলে গেল। রত্নাকরের চোখ জলে ভরে যায়। মনে মনে বলে, পুরুষরা বড় স্বার্থপর। ময়না পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো।
All the contents posted by me have been downloaded from the internet. Credit goes to the original uploaders. Anyone having any issues with pictures posted, please message for removal.