Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
টক ঝাল মিষ্টি

♥♥♥♥♥♥
 
বছর সত্তরের ভদ্রলোকটি আমার মতোই কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন , পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি , তার উপর জহর কোট চাপানো , কম্বলটাকে পায়ের উপর জড়িয়ে বাবু হয়ে বসে এক মনে মোবাইলে টাইপ করে চলেছেন ...মাঝে মাঝে ফিক ফিক করে হাসছেন বেশ কয়েকবার আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখলেন আবার মোবাইলে মনোনিবেশ করলেন কেন জানি না সেদিন 2nd AC ওই কামরাটি বেশ ফাঁকাই ছিল , ঠান্ডাটা একটু বেশিই লাগছিলো
রাত তখন এগারোটা হবে বাকিরা সবাই মোটামুটি ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে বা দেবে দেবে করছে রাত একটার আগে আমার ঘুম  আসবে না তাই আমি চাদরটাকে সারা গায়ে জড়িয়ে মোবাইলটাকে নাড়াচাড়া করছিলাম ভদ্রলোকটি চোখ থেকে হাই পাওয়ারের চশমাটা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কি ঠান্ডা লাগছে my son ..?
ভদ্রলোকটিকে দেখে আমার শিক্ষক বা প্রফেসর মনে হচ্ছিল .... বেশ একটা পারসোনালিটি তার সারা শরীরের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল , তার উপর ওনার মুখে my son কথাটি শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম, বললাম তা একটু লাগছে ভদ্রলোকটি বললেন এক্ষুনি লাস্ট কফিওয়ালা উঠবে একটু কফি খেয়ে নাও দেখবে ভালো লাগবে ঠিক তাই দুজনেই কফি নিয়ে বসলাম , একে একে ধেয়ে এলো অতি পরিচিত কিছু প্রশ্ন ---কোথায় থাকোকি করা হয় ? সন্তান কটি ? তারা কিসে পড়ে ? কথায় কথায় ভদ্রলোকটি বললেন উনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির বাংলার প্রফেসর ছিলেন কিছুক্ষন দুজনেই চুপ, তারপর ভদ্রলোকটি শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন কেমন লাগছে জীবনের স্বাদ ? বাড়িতে সময় দেওয়া হয় ? আমি কি বলবো তা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না ভদ্রলোকটি আমাকে একটু আস্বস্ত করে বললেন আমি জানতে চাইছি জীবনটাকে মিষ্টি লাগছে না তেতো ?
আমি হাসতে হাসতে বললাম টক ঝাল মিষ্টি ...
সকালে নয়টায় অফিস, তারপর  ফিরতে ফিরতে সেই রাত আটটা বাকি সময়টুকু হয় আমার সাথে বউয়ের ঝামেলা নয়তো মেয়ের সাথে মেয়ের মায়ের ...সকালে ঘুম থেকে দেরি করে কেন ওঠা থেকে শুরু , homework কেন হয়নি ? খাবার কেন থালায় পড়ে ? কলেজের ব্যাগ কেন গোছাওনি ? খাটের চাদর কেন লন্ড ভন্ড ? বইগুলো ঠিক জায়গায় নেই কেন ? পা না ধুয়ে কেন খাটে উঠেছ ? কত TV দেখবে ? একটা না একটা বিষয় নিয়ে লেগেই আছে , মাঝে মাঝে অতিষ্ট হয়ে মেজাজ যায় হারিয়ে ....
 
ভদ্রলোকটি ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কম্বলটি বুকের উপর তুলে বলল এটাই তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ...এটাকে অবহেলা কোরো না ....টক ঝাল মিষ্টির এই অতুলনীয় স্বাদটাকে কব্জি ডুবিয়ে চেটেপুটে খাও একেবারে হাতের নখ থেকে কুনুই পর্যন্ত একটা সময় আসবে যখন ঘরে ঢুকে দেখবে চারিদিক নিঃশব্দ , বিছানার চাদরটা টান টান করে পাতা , মা-মেয়ের প্রতিদিনের খন্ডযুদ্ধ কোনো এক অলৌকিক ইশারায় চিরতরে অবসান ঘটেছে , মনে হবে চাদরটা দু হাত দিয়ে আবার লণ্ডভণ্ড করে অপূর্ণ যুদ্ধের দামামা বাজাই ...বইয়ের তাকটা পরিপাটি করে সাজানো হালকা সাদা ধুলোর আস্তরণ বইগুলোতে লেপ্টে আছে ...মনে হবে সব বইগুলো পরিষ্কার টেবিলটার উপর আছড়ে ফেলে অসমাপ্ত অঙ্ক গুলোকে ছোটো ছোটো হাত দুটো ধরে আর একবার কষাই ...সব কিছু ঠিকঠাক কিন্তু চারিদিক মরুভূমির নিঃসঙ্গতাসন্তানের পরিচিত গন্ধকে একটিবার পাওয়ার আশায় এঘর ওঘর শুধু ঘুরপাক খাওয়া , বাড়ি থেকে বেরোবার সময় পেছনে নড়বে না কোনো আদুল হাতের টাটা , TVটা আপন মনেই চলতে থাকে কেউ কেড়ে নেয় না রিমোট টা অযথা বাহানায় , খাবার টেবিলেই শুকোতে থাকে এঁটো হাত, কেউ ছোবল দেয় না আর ডিমের কুসুমে , মোবাইলের ওপারে আদুরে আওয়াজ প্রতিদিন থেকে প্রতি সপ্তাহে, প্রতি সপ্তাহে থেকে প্রতি মাসে গিয়ে ঠেকবে , দুদিনের জন্য আসবে, যাবার সময় ব্যাগের ভিতর নিয়ে যাবে হাটি হাটি পা পা থেকে একটু একটু করে গড়ে তোলা সব স্বপ্ন ....দৃষ্টি শক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাবে , বাড়বে শুধু ওষুধের সংখ্যা , অনিদ্রায় চোখ দুটো হয়ে উঠবে আরো নিশাচর ......
 
ভদ্রলোকটির প্রতিটি কথা ট্রেনের বিকট আওয়াজ পেরিয়ে বুকের ভিতর যেন তীরের মতো বিঁধছিল , আমি বললাম তাহলে বাঁচার উপায়ভদ্রলোকটি একটু ধরা গলায় বললেন শীতের ঝরা পাতার মতো যদি ঝরে পড়ো তবে কেউ ফিরেও তাকাবে না ... উপরে সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অচিরে বিলীন হবে মাটির বুকে ...সবুজ পাতার মতো ফুটে উঠতে হবে ওই জীর্ণ বট বৃক্ষে পুরোনো বন্ধুদের সান্নিধ্যের আগুনে মনটাকে সেকতে হবে ঠিক যেমন কনকনে শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে এক টুকরো আগুনকে ঘিরে ধরে একটু ভালো লাগার উষ্ণতা সারা শরীরে মাখতে ইচ্ছা করে...
একমাত্র বন্ধুই পারে তোমার ক্ষয়ে যাওয়া জীবনে অফুরন্ত হাসির ফোয়ারা প্রলেপ লাগাতে , তাইতো আমি সময় অসময় চোখ রাখি ওই মোবাইলের ছোটো জানালায় ...তাতে ভেসে ওঠা পুরোনো বন্ধুর এক একটা শব্দ সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসা এক একটি সূর্যরশ্মি সযত্নে আগলে রেখো পুরোনো বন্ধুত্বকে আজকের প্রতিদিনের কর্মযুদ্ধে হারিয়ে ফেলো না তাদের বন্ধুত্বের হাতছানি আমি আজ যাচ্ছি আমাদের বন্ধুদের মিলন সমারোহে ....তিন মাস অন্তর অন্তর আমরা মিট  করি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গান , বাজনা , হাসির কোলাহলে ডুবে থাকি দুদিন ...খুঁজে পাই বেঁচে থাকার অক্সিজেন .... 
 
পরদিন ভোর বেলায় যখন ভুবনেশ্বর স্টেশনে নামলাম দেখলাম গোটা পনেরো সত্তর বছরের যুবক ভদ্রলোকটিকে ঘিরে ধরেছে ....হাসতে হাসতে তারা এগিয়ে চলেছে নতুন ভুবন গড়তে ...আমাকে দেখে ভদ্রলোকটি হাত নেড়ে বললো look my son এরাই আমার এক একটি সবুজ পাতা .....
 
জানি না ২০ বছর পর আমাদের ভবিষ্যৎ কি হবে ? জানি না মোবাইলে টাইপ করার শক্তি হাতে মজুত থাকবে কি না ? হয়তো ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে আসবে ...গ্রুপের গানের আসর হয়তো তখনো একই রকম ভাবে জমে উঠবে কিন্তু হঠাৎ করেই বেইমান হয়ে উঠবে শ্রবণ শক্তি , আস্তে আস্তে শিথিল হবে   স্মৃতিশক্তির বাঁধন ....তবু থেমে যেন না যায় বন্ধুত্ব...
 
তাই বন্ধু চাই, ভাল বন্ধু, যে স্বার্থহীন ভাবে সুখে-দুখে তোমার পাশে থাকবে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে না চাইলেও একদিন তো চলে যেতেই হবে
তাই যতদিন বাঁচো প্রান খুলে হাসো জীবনে চাওয়া  পাওয়ার সংকীর্ণতা ভুলে শেষের দিনগুলি আনন্দেতে বাঁচো
জীবনের হাসিকান্নার এই রঙ্গশালায়......
The show must go on .......
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 04-11-2021, 11:56 AM



Users browsing this thread: 16 Guest(s)