01-11-2021, 05:34 PM
ঝিমলি চলে গেল পরের দিন, এর পর কাজ আর কাজ। কাগজের অফিসে কাজ করা তো নয়, ঘন ঘন ফোন, নানারকমের ফাই ফরমাস, আরো কতো কি। যাক এই কদিনে চুটিয়ে কাজ করলাম, যাওয়ার দিন ঝিমলি একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, আমি ওর জীবনে তৃতীয় পুরুষ, তবে আগের কোন পুরুষকেই ও এইভাবে সুযোগ দেয় নি। যতটা আমাকে দিয়েছিল, শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছিল কিন্তু আমিও তো ধোয়া তুলসী পাতা নয়, তাহলে আর মন খারাপ করে লাভ কি, পথে আলাপ পথেই শেষ, মনকে বোঝালাম, অনি তুই তো কখনো এরকম ছিলি না, তবে আস্তে আস্তে এরকম হয়ে যাচ্ছিস কেন, তোর কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই, নিজের মনে নিজে হাসলাম। গ্রামের একটা সাঁওতাল মেয়ে সেও একদিন আমাকে ইনসাল্ট করেছিল, বলেছিল অনিদার দ্বারা কিছু হবে না।
সত্যি আমার দ্বারা যে এই রকম কিছু হতে পারে তা সত্যি কল্পনা করতে পারি নি। শৈশব কৈশোর কেটেছে গ্রামের পাঠশালা আর কলেজে, এরপর কলকাতায় চলে আসি, কলেজ লাইফ আর ইউনিভার্সিটি লাইফ কেটেছে কলকাতায়, তারপর চাকরি জীবন, অনেকটা ভাসমান নাবিকের মতো, আমি এখনো ভাসছি ভেসে বেড়াচ্ছি।
গ্রামে উনা মাস্টারের কাছে টিউশন পরতে যেতাম, আমাদের গ্রামের থেকে সেটা প্রায় ২ মাইল দূরে, প্রত্যেক দিন হেঁটে যাওয়া আসা করতে হতো, আমাদের গ্রাম থেকে আমরা দুজন যেতাম আমি আর ভানু, ভানু চারবার ফেল করে এখন আমার সঙ্গে একসঙ্গে মাধ্যমিক দেবে, স্বভাবতই ও আমার বস, আমার থেকে অনেক কিছু ও বেশি জানে, তাছাড়া বিড়ি খায়, বাবার বিড়ির বান্ডিল থেকে প্রত্যেক দিন ও দু-তিনটে করে বিড়ি গেঁড়াবেই গেঁড়াবে, আর আমাদের বন্ধুদের সামনে এমন করে খাবে যে আমরাও ওর কথাবার্তায় মোহিত হয়ে যেতাম। ও আমাদের দলের পালের গোদা, দেখবেন সকলের কলেজ জীবনেই এরকম একজন করে থাকে, আমাদের ছিল ভানু।
আমি মাঝে মাঝে ওর ফাই-ফরমাশ খাটতাম। মনা মাস্টার আমার গার্জেন, মাঝে মাঝে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতো ভানুর সঙ্গে বেশি মিশিস না ছেলেটা ভালো নয়। আমি মাথা নীচু করে থাকতাম, একদিনের অভিজ্ঞতা আপনাদের বলি, না বললে ঠিক জমবে না।
সেদিন উনা মাস্টারের কাছে পড়তে যাওয়ার কথা, সকাল ৬টার সময়, আমি রেডি হয়ে ভানুর বাড়িতে গেছি। ভানুর মা বলল, ভানু চলে গেছে। অগত্যা আমি একা একাই গেলাম উনা মাস্টারের কাছে, গিয়ে দেখি সকলেই এসেছে, কিন্তু ভানু নেই। কেমন যেন লাগলো, সৌমিলি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে পূর্ণিমাকে বললো, পুনি দেখ বাবু আজ একা একা জোড়িদার নেই, আমি এমনিতে খুব কম কথা বলি, মেয়েদের সঙ্গে তো কথাই বলতাম না। ওদের দিকে তাকালাম, ওরা এমন ভাবে আমাকে চোখ মারলো যে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। উনা মাস্টার আমার দিকে তাকাল, আর একটা হনুমান গেল কোথায় অনি, আমি মাথা নীচু করে বললাম জানিনা।
-মিথ্যা কথা বলছিস।
-না, সত্যি বলছি, ভানুর মা বললো ও আমার আগে চলে এসেছে।
-ও। দেখ গিয়ে কার বাড়ির আঁখ ক্ষেতে গিয়ে ধ্বংস করছে।
গুড বয় বলে আমার একটা সুনাম ছিল, তাই মাঝে মাঝে পাল্লায় পরে দোষ করলেও সাত খুন মাপ। অনি এটা করতেই পারে না।
পরতে পরতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। বই-খাতা গুছিয়ে বেরোতেই দেখি বাঁশঝাড়ের কাছে পুকুর পারে সৌমি আর পুনি দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই সৌমি বললো, কোন দিক দিয়ে যাবি অনি।
-দীঘা আড়ি দিয়ে যাব।
দীঘা আড়ি, আমাদের দুটো গ্রামের মাঝে একটা বিরাট ঝিল, মাঝে মাঝে আমি একা একা ওখানে গিয়ে বসি, কতো পাখি আসে ওই ঝিলে, আমি বসে বসে দেখি। চারিদিকে গাছ গাছ আর গাছ জঙ্গলে ভর্তি, তার পাশে একটা শ্মশান, লোকে ভয়ে ঐ পাশে যায় না। বলে ভূততলা ওখানে নাকি ভূতেরা খেলা করে, আমি বহুদিন একা একা ঐ খানে গিয়ে বসেছি, কিন্তু ভূত দেখতে পাই নি। তাই আমাকে অনেকে সাহসী বলেও ডাকে, বাড়ির সকলে জানে কোথাও না পেলেও অনিকে ভূততলায় পাওয়া যাবেই। আমাদের গ্রামে যারা মারা যান, তাদের ঐ শ্মশানে পোড়নো হয়। আমার মা-বাবাকেও ওখানে পোড়ানো হয়েছিল।
-বোঁচকুল খাবি। পুনি বললো।
-না।
-আমাদের সঙ্গে আজ বাঁধে বাঁধে চল না।
-অনেক ঘোরা পথ হয়ে যাবে।
-তাতে কি হয়েছে, একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাবো।
ওরা থাকে আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাশে কাজলদীঘি বলে একটা গ্রামে। ঐ গ্রামের সকলেই বেশ পয়সাওয়ালা লোক। সৌমি আগে আমি মাঝখানে পুনি পেছনে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছিল। তুই একটা গবেট বুঝলি অনি।
-কেনো।
-তুই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে জানিস না।
আমি চুপ করে থাকলাম।
-ভানুকে দেখেছিস, আজকে একটা মেয়েকে পটাচ্ছে, আবার কালকে আর একটা মেয়েকে পটাচ্ছে, আর তুই ওর সঙ্গে থেকে কি শিখলি।
-ভানু ভাল ছেলে।
-এঃ । ভানুর কলাটা দেখেছিস।
-ভানু কি কলা গাছ যে ওর কলা থাকবে।
-তুই সত্যি একটা গাধা।
-যা তোদের সঙ্গে আমি যাবনা। আমি ফিরে দাঁড়ালাম।
পুনি, সৌমি দুজনে আমার দুহাত ধরলো।
-আচ্ছা আচ্ছা তোকে গাধা বলবো না। কিন্তু গাধী বললে রাগ করবি না।
আমি সৌমির দিকে তাকালাম। ওর চোখের ভাষা সেই বয়সে বুঝতে পারি নি, কিন্তু ছবির মতো আমার চোখে লেগে আছে, এখন এই ভরা যৌবনে আমি চোখ বন্ধ করে একমনে চিন্তা করলেই সেই চোখ দেখতে পাই, ভাষাও বুঝতে পারি।
তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গ্রামের শেষ প্রান্তে এলাম, সামনে বড় মাঠটাকে কাশিঘরের ডাঙা বলে, ওটা পেরলেই সৌমিদের বাড়ি আর আমাকে ডানদিক দিয়ে আবার কিছুটা হেঁটে নদী পেরিয়ে আসতে হবে।
সামনে বিশাল বাঁশবন, এই দিনের বেলাতেও সেখানে শেয়ালের আনাগোনা।
-এই পুনি তুই বলনা অনিকে।
-আমি ! না না তুই বল।
-কেন আমি কি শুধু একা করবো নাকি তুই করবি না।
-আমিতো ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে এলাম এ পাশ দিয়ে আসার জন্য তুই এবার বল।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি বলছে ঠিক মাথায় ঢুকছে না। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আমরা এখন বাঁশবনের ভেতরে। চারিদিকে বাঁশ গাছ ছাড়াও অনেক গাছ আছে। তাল, তমাল, শিরিষ, সেগুন, বট, অশ্বত্থ, আরো কত কি। হাওয়ার স্পর্শে বাঁস গাছগুলো একপাশ থেকে আর এক পাশে হেলে যাচ্ছে, কেঁচর কেঁচর করে একটা আওয়াজ, আমি প্রায়ই একা থাকলে এরকম নির্জনে চলে আসি, ঘন্টার পর ঘন্টা একলা বসে থাকি। ভীষণ ভাল লাগে। এই আওয়াজ শুনতে শুনতে মনে হয় বাঁশ গাছগুলো যেন একে অপরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলছে। আমরা কেউই ওদের শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ বুঝি না, কিন্তু ওরা ওদের ভাষা বোঝে। আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একফালি সূর্যের রোদ গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে নিচে আসার জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে, কিন্তু আর একটা গাছ তাকে কিছুতেই নিচে আসতে দেবে না। এ যেন আলো ছায়ার খেলা। আমি নিজের মধ্যে নিজে যেন হারিয়ে গেছিলাম।
-অনি!
সৌমিলির গলা শুনে চোখ নামাতেই দেখি দুজনের কেউ নেই। একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
-অনি
এদিক ওদিক তাকালাম। না, কেউ কোথাও নেই।
-অনি।
এবার বুঝতে পারলাম। ঐ বাঁশ ঝাড়টার পেছন থেকে আওয়াজ আসছে।
-কি হলো, তোরা ওখানে কি করছিস, যাবি না। আমার কিন্তু ভীষণ দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-একবার এদিকে আয় একটা জিনিষ দেখাবো।
আমি একটা হেলে পরা বাঁশের তলা দিয়ে মাথাটা নীচু করে ও পাশে গেলাম।
-কোথায়?
-এই তো এখানে, আয়।
আমি কাছে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম, একটু ভয়ও পেয়ে গেলাম। পুনি, সৌমি দুজনেই উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
-করবি।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেই যে ওখান থেকে দৌড় লাগালাম সোজা চলে এলাম দীঘা আরি, দীঘির পারে বইখাতা রেখে, ঝিলের জলে চোখ মুখ ধুলাম, পেট ভর্তি করে জল খেলাম, তারপর আমার পরিচিত সেই ঝোপটার কাছে গিয়ে বসলাম, সরাল পাখিগুলো একবার দীঘির জলে ডুব মারছে আবার ভেসে উঠছে, সামনেই কোথাও একটা ঘু ঘু পাখি ডাকছে, ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ, আমি আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।