01-11-2021, 09:07 AM
এখন সুচি সবকিছু ভুলে আবার আকাশের সাথে মিশতে শুরু করেছে । নিজেকে বুঝিয়েছে বেস্টফ্রেন্ড ছাড়া কিছু না । পরের বছরের শুরুতেই কলেজের ফাংশনের জন্য সুচি পার্লারে যাবে ঠিক করলো। দুপুরের দিকে পার্লার একটু ফাঁকা থাকে তাই দুপুরে আকাশের ঘরে এসে খাটের উপর উল্টে পড়ে থাকা আকাশকে টেনে তুলে বললো “ চল আমার সাথে পার্লারে । „
দুপুরবেলা একি হাঙ্গামা আবার “ আমি পার্লারে যাবো কেন ? „
সুচি ভুরু নাচিয়ে বললো “ আমি একা একা যাবো না তাই । „
সুচির আবার আগের স্বভাব ফিরে পেতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এই সময়টা আকাশের জীবনে ছিল স্বাধীনতা। মুক্তো সে। কিন্তু হঠাৎ আবার পুরানো সুচিকে ফিরে পেয়ে আকাশ কোথাও যেন খুশি হলো। স্বাভাবিক জীবনের মজাই আলাদা। তাই সুচি যখন টেনে খাট থেকে তাকে নামালো তখন আবার সেই আগের মতো বিরক্তি মিশিয়ে আকাশ বললো “ প্যান্টটা তো পড়তে দে । নাকি হাফ প্যান্টে যাবো ? „
“ পড়ে নে । „ বলে সুচি খাটের উপরেই বসে পড়লো।
আকাশ দিদিমার ব্যাবহার করা পুরানো আমলের আলনা থেকে একটা ফুল প্যান্ট পড়ে , বেল্ট পড়ে নিতেই সুচি আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পনেরো মিনিট মতো স্কুটি চালিয়ে একটা ভালো ইউনিসেক্স পার্লারের সামনে স্কুটিটাকে দাড় করালো সুচি। এখানে ছেলেদের জন্য ওয়েটিং রুমে বসার বন্দোবস্ত করা আছে। ভিতরে ঢুকে ওয়েটিং রুমে বসে পড়লো দুজনে । আকাশ সুচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কতক্ষণ লাগবে ? „
“ আধঘন্টা মতো । বেশি না । „
দুই মিনিট পরেই সুচি উঠে চলে গেল। এতক্ষণ পর আকাশ খেয়াল করলো ছোট্ট ওয়েটিং রুমে আরও একজন ছেলে বসে আছে । বয়স তেইশ চব্বিশ হবে। একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটা কৌতুকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো “ এই প্রথম ? „
আকাশ প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আকাশের মুখের ভাব বুঝতে পেরে ছেলেটা একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলো “ গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এই প্রথম পার্লারে এলে ? „
আকাশ বুঝলো যে ছেলেটা তাকে আর সুচিকে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ভাবছে । আর এমনিতেও আকাশের উচ্চতা আর মুখের কঠিনতা দেখে অনেকেই তার বয়স বুঝতে পারে না। ক্লাসের বন্ধুরা এমনকি টিচাররাও কয়েকবার বুঝতে পারে নি আকাশের বয়স। আকাশ এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে “ হ্যাঁ এই প্রথম। জোর করে ধরে এনেছে । „
ছেলেটা মুখের হাসি বজায় রেখে বললো “ দেখে বোঝা যাচ্ছে । এখন বসে থাকো কয়েক ঘন্টা । „
আকাশ ছেলেটার মুখে সময় শুনে আকাশ থেকে পড়লো “ কয়েক ঘন্টা ! „
“ আমি তো দেড় ঘন্টা হলো বসে আছি । তুমি চাইলে ম্যাগাজিন পড়তে পারো। সময় কাটবে । „
আকাশ উঠে ছেলেটার পাশ থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল । ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন চুলের স্টাইল দেখতে লাগলো। বিভিন্ন পোজে মডেলদের ফটো আছে। তারপর ফোন বার করে গেম খেলতে শুরু করলো। গড়ানোর ব্যাবস্থা থাকলে একটু গড়িয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সেই ব্যাবস্থা নেই দেখে আকাশ আবার ম্যাগাজিন তুলে ফটো গুলো দেখতে লাগলো । ঠিক তখনই সুচি সামনে এসে বললো “ তোকে চাপদাড়িতে ভালো মানাবে । „
আকাশ মাথা তুলে দেখলো সুচি দাড়িয়ে আছে। সুচির কথাটা শুনে আকাশ ম্যাগাজিনে দেখলো একটা মডেলের চাপ দাড়ির দিকেই ইঙ্গিত করছে সুচি। ফটোটা দেখে , ম্যাগাজিন টা রেখে , পার্লারের বাইরে চলে এলো। সুচিত্রা বাইরে এসে স্কুটিটাকে ঠেলে রাস্তায় আনতে লাগলো। তখন আকাশ মজা করে বললো “ ভিতরে যে দাদাটা বসে আছে , সে কি ভাবছিল জানিস ! আমাদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ভাবছিল। „
কথাটা শুনেই সুচির বুকটা ধড়াস করে উঠলো। সুচির মনে হতে লাগলো যতো দ্রুত সম্ভব এখান থেকে যাওয়া দরকার । সঙ্গে সঙ্গে স্কুটিতে বসে পড়লো সুচি । আকাশ হাসতে হাসতে সুচির পিছনে বসে পড়লো “ কি করালি ? „
নিচু স্বরে সুচি বললো “ বেশি কিছু না । শুধু ফেসিয়াল আর ভুরু ফিলাপ করালাম । „
“ এদিকে ঘোর । „
সুচি পিছন দিকে মুখটা ঘোরাতেই আকাশ সুচির মুখের উপর মুখটা এনে সুচির ভুরু দেখতে শুরু করলো। আকাশের নাকের গরম নিশ্বাস সুচি নিজের মুখের উপর অনুভব করতে শুরু করলো। আকাশের ঠোটটা আর একটু দুরে আছে। সুচির হৃদপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড ভুরু দেখে আকাশ বললো “ হ্যাঁ আগের থেকে একটু বেশি কালো দেখাচ্ছে । „
সুচি সঙ্গে সঙ্গে সামনে মুখ ঘুরিয়ে আনলো। কেউ একজন সুচির ভিতর থেকে বলতে শুরু করলো “ তুই এই ছেলেটাকে ভালোবাসিস। „ আবার সেই মনের দ্বন্দ্ব শুরু হতেই সুচি স্কুটিটাকে স্পিডে চালিয়ে দিল।
এতদিনে অনেক কষ্টে সুচি নিজেকে বুঝিয়েছে । কিন্তু এখন নিজেকে যতো বোঝাচ্ছে ততো যেন কষ্ট বাড়ছে । ওই প্রশ্নটা আর নিজের ভেতর থেকে আসা উত্তরটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। বিকালে কলেজ ফাংশনে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা নাচ গান করে নটার আগে বাড়ি ফিরলো সুচি। এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে।
পরবর্তী কয়েক মাস মাঝেমাঝে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ওই প্রশ্নটা ফিরে আসছে । আগের থেকে সুচি অনেক শান্ত হয়ে এসছে। একটা প্রশ্ন যে তাকে এইভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে সেটা কখনোই ভাবে নি সুচি। কিন্তু আবার নিজেকে বোঝাচ্ছে এরকম কিছুই না , আকাশ শুধু বন্ধু। নিজেকে বারবার মিথ্যা বলার পর একটা কষ্ট হতে শুরু করলো সুচির। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। ভিতরে যাই হোক বাইরে সেটা কাউকে লক্ষ্য করতে দিচ্ছে না সুচি।
আকাশ ক্লাস ইলেভেনে খুব ভালো নাম্বারে পাস করে ক্লাস টুয়েলভে উঠলো । আগের মতোই সপ্তাহে এক দুবার সুমির কাছে পড়তে আসতে লাগলো আকাশ। একদিন ঘরে ঢুকে বই খাতা বার করার পর সুচি আর সুমি দুজনেই আকাশের ডান কাঁধের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করলো । মনে হলো যেন ডান কাঁধে ব্যাথার কারনে ডান হাতটা আসতে আসতে নাড়াচাড়া করছে সে ।
“ কি হয়েছে কাঁধে ? „ প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলো না সুচি।
আকাশ স্বর নামিয়ে বললো “ চুপপপ আস্তে । „
“ কি হয়েছে কাঁধে সেটা বলবি তো । „ খুব রাগী আর গম্ভীর স্বরে সুচি জিজ্ঞাসা করলো ।
আকাশ নিরুপায় হয়ে বললো “ মাকে বলবি না বল । „
“ না , বলবো না । তুই বল কাঁধে কি হয়েছে । কেউ মেরছে ? „
আকাশ হেসে বললো “ আমাকে মারবে এমন সাহস কারোর নেই। বাইক থেকে পড়ে গিয়েছিলাম । „
ভুরু কুঁচকে মুখে হাজার প্রশ্নের চিহ্ন ফুটিয়ে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ বাইক থেকে ! কার বাইক ? কখন ? কিভাবে পড়লি ? „
আকাশ বলতে শুরু করলো------- আজকে আমাদের এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল । তাই ঠিক করেছিলাম কলেজ থেকে ফেরার পর রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেলিব্রেট করবো। সেই মতো কলেজ থেকে ফিরে বাড়ি এসে চলে গেছিলাম বন্ধুর বাড়ি। ওর বাইক আছে কিন্তু লাইসেন্স হয়নি। তাই ওর বাইকেই চড়ে অলিগলি দিয়ে যাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্টে। মাঝপথে একটা বেশ পাঁচ ছয় ফুট সরু গলির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটা বিড়াল সামনে চলে এলো। আমার বন্ধু স্পিডে চালাচ্ছিল। হঠাৎ ব্রেক চাপতে বাইকটা তো পড়লোই তার সাথে আমিও রাস্তায় ডান কাঁধের উপর ভর করে পড়লাম । রাস্তায় পড়ে ছয় সাত দূরে গড়িয়ে গেলাম ।
এতক্ষণ শুনেই সুচি প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো “ আর যাবি না ওর বাইকে । ঠিক মতো চালাতে পারে না ! উঠিস কেন ওদের বাইকে ? „ কথাটা বলেই সুচি সুমির দিকে তাকালো। সুচি দিদির দিকে তাকিয়েই চোখ নিচে নামিয়ে নিল। সুমি এক দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
আকাশ সুচির রাগকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বললো “ ও ভালোই চালাতে পারে। দূর্ঘটনা তো যে কারোর সাথেই ঘটতে পারে। ওই বিড়ালটা হঠাৎ লাফিয়ে সামনে চলে এসছিল তাই। মাকে বলবি না কিন্তু। „
তারপর প্রায় আধঘন্টা পড়ে আকাশ চলে গেল । আকাশ চলে যেতেই সুমি বললো “ এখনও সময় আছে সুচি ! স্বীকার করে নে। ও যখন ওই দূর্ঘটনার কথা বলছিল তখন আমি তোর চোখে ভয় দেখেছি। স্বীকার করে নে বোন আমার । „
সুচি শান্ত স্বরে বললো “ স্বীকার করার কিছু নেই দি। ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই ভয় পেয়েছিলাম। „
সুমি সুচিকে আরও চেপে ধরলো “ নিজেকে মিথ্যা বলিস না। শোন আমার কথা। স্বীকার করে নে । হয়তো কষ্ট পাবি কিন্তু একটু কম কষ্ট হবে , চোখের জল একটু কম পড়বে, দুঃখ একটু কম পাবি। স্বীকার করে নে। „
সুচি এবার রাগি আর বিরক্তি মিশিয়ে বললো “ তোর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। বাবা তোকে ভাংচুং বুঝিয়েছে । আর তুইও বাবার কথায় নাঁচছিস । „ কথাটা বলে সুচি মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন ঘাটতে শুরু করলো ।
এতো লুকোচুরি খেলার পরেও শেষ রেহাই হলো না আকাশের। ডানহাতি হওয়ার জন্য রাতে ডিনার খাওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। বাবা মা দুজনেই লক্ষ্য করে বললেন “ কি হয়েছে কাঁধে ? „
আকাশ একটু ভয় পেয়ে বললো “ ও কিছু না । একটু লেগেছে। „
আকাশের মা সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে আকাশের জামা খুলে দেখলেন কাঁধে বেশ কিছুটা ছড়ে গেছে “ এটাকে একটু লেগেছে বলে ! „ তারপর আকাশের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “ দেখো তুমি কতোটা ছড়ে গেছে । „
তারপর আবার আকাশের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন “ সত্যি বল কার সাথে মারপিট করে এসছিস ? „
আকাশ জামাটা ঠিক করতে করতে বললো “ মারপিট করতে যাবো কেন ? ওই বিকালে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম । তখন লেগেছে। ও তুমি বেশি চিন্ত করো না তো । „
স্নেহা দেবী আরও রেগে গিয়ে বললেন “ চিন্তা করো না ! খুব বড়ো হয়ে গেছিস , তাইতো ! „
এখন আর আগের মতো বকাঝকা করাও যায় না , আর মারাও যায় না। সত্যি আকাশ বড়ো হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ষোল সতেরো বয়স তো হয়ে গেল। পরম যত্নে ঘায়ে মলম লাগিয়ে তারপর খেতে বসলেন স্নেহা দেবী ।
সবকিছু আগের মতো চললেও সুচির ভিতরটা আর আগের মতো নেই। সুচি নিজের জন্মদিনে কলেজ গেল না। বাড়িতেই কাটালো দিনটা। সুমি গতকাল অফিসের কাজে দুদিনের জন্য নদীয়া গেছে। জন্মদিনে দিদি অনুপস্থিত তাই সুচির একদম ভালো লাগছিল না। বিকাল বেলা কলেজ থেকে ফিরে ভালো জামা কাপড় পড়ে আকাশ সুচির ফ্ল্যাটে হাজির হলো । সুচিকে উদাস মনে টিভি দেখতে দেখে আকাশ বললো “ তুই এখনও তৈরি হোস নি ! „
“ আমার আজ ভালো লাগছে না। দিদি নেই। „
“ ওইসব বললে তো চলবে না। বিপ্লব আর জয়শ্রী দি অপেক্ষা করছে। তৈরি হয়ে নে । আমি অপেক্ষা করছি। „
নাছোড়বান্দা আকাশের হাবভাব দেখে সুচি ঘরে গিয়ে একটা জিন্স আর টপ পড়ে ঘরের বাইরে এলো। তারপর আকাশ কে নিয়ে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে পৌছল। প্রতিবছর আলাদা আলাদা রেস্টুরেন্ট সুচির জন্মদিন সেলিব্রেট করা হয়। কিন্তু লোক সংখ্যা পাঁচ জনের বেশি কখনোই হয় না। সুচি, সুমি, বিপ্লব, জয়শ্রী আর আকাশ। এই সেলিব্রেট মূলত আকাশের উৎসাহেই করা হয়। রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলো একটা ছোট গোল টেবিলে জয়শ্রী আর বিপ্লব বিচ্ছু একটা 2 pound এর কেক সাজিয়ে বসে আছে। আলো পাশে আরও অনেকে বসে আছে। কিন্তু তারা সবাই নিজেদের মধ্যেই ব্যাস্ত । সুচি চেয়ারে বসতেই বিপ্লব বিচ্ছু একটা ব্লাস্টার ফাটিয়ে বললো “ happy birthday সুচিদি। „
সুচি “ থ্যাঙ্ক ইউ „ বলে কেক কাটতে শুরু করলো। সবাই happy birthday গানটা গেয়ে সুচিকে উইশ করলো। কেক কাটার পরেই প্রথম টুকরোটা অটোমেটিক বাঁদিকে বসে থাকা আকাশের মুখের দিকে বাড়িয়ে দিল সুচি। তারপর গিফ্ট দেওয়ার পালা এলো। জয়শ্রী একটা বই উপহার দিল। বিপ্লব বিচ্ছু একটা দামী পেন উপহার দিল। আর আকাশ দিল কয়েক হাজারের একটা দামী বিদেশী কোম্পানির mackup kit । উপহারটা দেখে সুচির ডান দিকে বসে থাকা জয়শ্রী সুচির কানে কানে বললো “ খুব ভাগ্য করে এমন একটা বন্ধু পেয়েছিস। আমি কিংবা বিপ্লবও ওর বন্ধু। কিন্তু আমাদের জন্য কখনো ও এতো খরচ করে না। খুব lucky তুই । „
জয়শ্রীর কথাটা যে সুচি আগে কখনো শোনে নি এমন নয়। কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল আর এখন আলাদা। সর্বপরি তখন সুমির করা প্রশ্নটা ছিল না। এখন আছে। সুমি প্রশ্নটা করার পর থেকে সুচির মনে হতে শুরু করেছিল যেন আশেপাশের সবাই তাকে এটাই বোঝাতে চাইছে যে তুই ওই 5'9 ইঞ্চির আকাশ নামের ছেলেটাকে ভালোবাসিস। যাকে তুই মাঝেমাঝেই অসভ্য , লম্পট , চিড়িয়াখানার জন্তু বলে সম্বোধন করিস তাকে তুই ভালোবাসিস।
সুচির কলেজ কোচিং , আকাশের কলেজ আর কোচিংয়ের মধ্যে দিয়ে বছর পার হয়ে গেল। সুচি নিজেকে বুঝিয়ে রেখেছে যে বাবা দিদি ভুল ভাবছে। পরের বছর আকাশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হলে সুমির দৌলতে কলেজে দশের মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলো আকাশ। আর এদিকে সুচিও খুব ভালো গ্রেড পেয়ে B.Com পাস করলো। পরিক্ষায় এতো ভালো নাম্বার পেয়ে আকাশ বায়না করলো যে একটা বাইক কিনে দিতে। ছেলের আবদার শুনেই স্নেহা দেবী রেগে গিয়ে বললেন “ না , ওই দু চাকা চালাতে হবে না। খুব দূর্ঘটনা ঘটে ওতে। „
মায়ের রাগী স্বর শুনে আকাশ আর আকাশের আবদার মিইয়ে গেল। কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা উঠলে সবাই ভাবতে শুরু করলো কোথায় ভর্তি করা যায়। অফিসে শুভাশীষ বাবুর চিন্তিত মুখ দেখে সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো “ কি এতো ভাবছেন বলুন তো সকাল থেকে? „
“ ওই আকাশকে কোন কলেজে ভর্তি করাবো সেটাই ভাবছি। „
“ তা বেশ তো লন্ডনে পাঠিয়ে দিন। আমিও তো আমার মেয়েকে ওখান থেকেই পড়াচ্ছি । এই পোড়া দেশের সার্টিফিকেটের দাম নেই। „
কথাটা ভালো লাগলো আকাশের বাবার। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে কথাটা বললেন। আকাশের মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন “ তুমি তো সারাদিন অফিসে কাজ করে দূরে থাকো। বাড়িতে আমি আর আমার ছেলে থাকি। ছেলেটাকেও আমার কাছ থেকে দূর পাঠিয়ে দেবে । „
কথাটা এমন ভাবে আকাশের মা বললেন যেন তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে । তাই আকাশের বাবা আর কিছু বললেন না। আঠারো উনিশ বছর সাংসারিক জীবন করেও আকাশের বাবা এখনও এই মহিলাকে বুঝতে পারেন নি। আকাশের মা কখন কোন কথায় কিভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা একটা বড়ো ধাঁধা আকাশের বাবার কাছে।
কয়েক দিন পর সকালে আকাশ সুচির ঘরে ঢুকে ঘাটের উপর গড়িয়ে বললো “ তোর কলেজে ভর্তি নিয়েছি । আজকে বাবা গেছে ডোনেশন আর ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে । BBA নিয়ে ভর্তি হচ্ছি। তোর স্কুটিতে যাবো একসাথে আগের মতো । „
দুপুরবেলা একি হাঙ্গামা আবার “ আমি পার্লারে যাবো কেন ? „
সুচি ভুরু নাচিয়ে বললো “ আমি একা একা যাবো না তাই । „
সুচির আবার আগের স্বভাব ফিরে পেতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এই সময়টা আকাশের জীবনে ছিল স্বাধীনতা। মুক্তো সে। কিন্তু হঠাৎ আবার পুরানো সুচিকে ফিরে পেয়ে আকাশ কোথাও যেন খুশি হলো। স্বাভাবিক জীবনের মজাই আলাদা। তাই সুচি যখন টেনে খাট থেকে তাকে নামালো তখন আবার সেই আগের মতো বিরক্তি মিশিয়ে আকাশ বললো “ প্যান্টটা তো পড়তে দে । নাকি হাফ প্যান্টে যাবো ? „
“ পড়ে নে । „ বলে সুচি খাটের উপরেই বসে পড়লো।
আকাশ দিদিমার ব্যাবহার করা পুরানো আমলের আলনা থেকে একটা ফুল প্যান্ট পড়ে , বেল্ট পড়ে নিতেই সুচি আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। পনেরো মিনিট মতো স্কুটি চালিয়ে একটা ভালো ইউনিসেক্স পার্লারের সামনে স্কুটিটাকে দাড় করালো সুচি। এখানে ছেলেদের জন্য ওয়েটিং রুমে বসার বন্দোবস্ত করা আছে। ভিতরে ঢুকে ওয়েটিং রুমে বসে পড়লো দুজনে । আকাশ সুচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কতক্ষণ লাগবে ? „
“ আধঘন্টা মতো । বেশি না । „
দুই মিনিট পরেই সুচি উঠে চলে গেল। এতক্ষণ পর আকাশ খেয়াল করলো ছোট্ট ওয়েটিং রুমে আরও একজন ছেলে বসে আছে । বয়স তেইশ চব্বিশ হবে। একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটা কৌতুকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো “ এই প্রথম ? „
আকাশ প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আকাশের মুখের ভাব বুঝতে পেরে ছেলেটা একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলো “ গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এই প্রথম পার্লারে এলে ? „
আকাশ বুঝলো যে ছেলেটা তাকে আর সুচিকে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ভাবছে । আর এমনিতেও আকাশের উচ্চতা আর মুখের কঠিনতা দেখে অনেকেই তার বয়স বুঝতে পারে না। ক্লাসের বন্ধুরা এমনকি টিচাররাও কয়েকবার বুঝতে পারে নি আকাশের বয়স। আকাশ এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে “ হ্যাঁ এই প্রথম। জোর করে ধরে এনেছে । „
ছেলেটা মুখের হাসি বজায় রেখে বললো “ দেখে বোঝা যাচ্ছে । এখন বসে থাকো কয়েক ঘন্টা । „
আকাশ ছেলেটার মুখে সময় শুনে আকাশ থেকে পড়লো “ কয়েক ঘন্টা ! „
“ আমি তো দেড় ঘন্টা হলো বসে আছি । তুমি চাইলে ম্যাগাজিন পড়তে পারো। সময় কাটবে । „
আকাশ উঠে ছেলেটার পাশ থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল । ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন চুলের স্টাইল দেখতে লাগলো। বিভিন্ন পোজে মডেলদের ফটো আছে। তারপর ফোন বার করে গেম খেলতে শুরু করলো। গড়ানোর ব্যাবস্থা থাকলে একটু গড়িয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু সেই ব্যাবস্থা নেই দেখে আকাশ আবার ম্যাগাজিন তুলে ফটো গুলো দেখতে লাগলো । ঠিক তখনই সুচি সামনে এসে বললো “ তোকে চাপদাড়িতে ভালো মানাবে । „
আকাশ মাথা তুলে দেখলো সুচি দাড়িয়ে আছে। সুচির কথাটা শুনে আকাশ ম্যাগাজিনে দেখলো একটা মডেলের চাপ দাড়ির দিকেই ইঙ্গিত করছে সুচি। ফটোটা দেখে , ম্যাগাজিন টা রেখে , পার্লারের বাইরে চলে এলো। সুচিত্রা বাইরে এসে স্কুটিটাকে ঠেলে রাস্তায় আনতে লাগলো। তখন আকাশ মজা করে বললো “ ভিতরে যে দাদাটা বসে আছে , সে কি ভাবছিল জানিস ! আমাদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ভাবছিল। „
কথাটা শুনেই সুচির বুকটা ধড়াস করে উঠলো। সুচির মনে হতে লাগলো যতো দ্রুত সম্ভব এখান থেকে যাওয়া দরকার । সঙ্গে সঙ্গে স্কুটিতে বসে পড়লো সুচি । আকাশ হাসতে হাসতে সুচির পিছনে বসে পড়লো “ কি করালি ? „
নিচু স্বরে সুচি বললো “ বেশি কিছু না । শুধু ফেসিয়াল আর ভুরু ফিলাপ করালাম । „
“ এদিকে ঘোর । „
সুচি পিছন দিকে মুখটা ঘোরাতেই আকাশ সুচির মুখের উপর মুখটা এনে সুচির ভুরু দেখতে শুরু করলো। আকাশের নাকের গরম নিশ্বাস সুচি নিজের মুখের উপর অনুভব করতে শুরু করলো। আকাশের ঠোটটা আর একটু দুরে আছে। সুচির হৃদপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড ভুরু দেখে আকাশ বললো “ হ্যাঁ আগের থেকে একটু বেশি কালো দেখাচ্ছে । „
সুচি সঙ্গে সঙ্গে সামনে মুখ ঘুরিয়ে আনলো। কেউ একজন সুচির ভিতর থেকে বলতে শুরু করলো “ তুই এই ছেলেটাকে ভালোবাসিস। „ আবার সেই মনের দ্বন্দ্ব শুরু হতেই সুচি স্কুটিটাকে স্পিডে চালিয়ে দিল।
এতদিনে অনেক কষ্টে সুচি নিজেকে বুঝিয়েছে । কিন্তু এখন নিজেকে যতো বোঝাচ্ছে ততো যেন কষ্ট বাড়ছে । ওই প্রশ্নটা আর নিজের ভেতর থেকে আসা উত্তরটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। বিকালে কলেজ ফাংশনে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা নাচ গান করে নটার আগে বাড়ি ফিরলো সুচি। এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে।
পরবর্তী কয়েক মাস মাঝেমাঝে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে ওই প্রশ্নটা ফিরে আসছে । আগের থেকে সুচি অনেক শান্ত হয়ে এসছে। একটা প্রশ্ন যে তাকে এইভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে সেটা কখনোই ভাবে নি সুচি। কিন্তু আবার নিজেকে বোঝাচ্ছে এরকম কিছুই না , আকাশ শুধু বন্ধু। নিজেকে বারবার মিথ্যা বলার পর একটা কষ্ট হতে শুরু করলো সুচির। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। ভিতরে যাই হোক বাইরে সেটা কাউকে লক্ষ্য করতে দিচ্ছে না সুচি।
আকাশ ক্লাস ইলেভেনে খুব ভালো নাম্বারে পাস করে ক্লাস টুয়েলভে উঠলো । আগের মতোই সপ্তাহে এক দুবার সুমির কাছে পড়তে আসতে লাগলো আকাশ। একদিন ঘরে ঢুকে বই খাতা বার করার পর সুচি আর সুমি দুজনেই আকাশের ডান কাঁধের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করলো । মনে হলো যেন ডান কাঁধে ব্যাথার কারনে ডান হাতটা আসতে আসতে নাড়াচাড়া করছে সে ।
“ কি হয়েছে কাঁধে ? „ প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলো না সুচি।
আকাশ স্বর নামিয়ে বললো “ চুপপপ আস্তে । „
“ কি হয়েছে কাঁধে সেটা বলবি তো । „ খুব রাগী আর গম্ভীর স্বরে সুচি জিজ্ঞাসা করলো ।
আকাশ নিরুপায় হয়ে বললো “ মাকে বলবি না বল । „
“ না , বলবো না । তুই বল কাঁধে কি হয়েছে । কেউ মেরছে ? „
আকাশ হেসে বললো “ আমাকে মারবে এমন সাহস কারোর নেই। বাইক থেকে পড়ে গিয়েছিলাম । „
ভুরু কুঁচকে মুখে হাজার প্রশ্নের চিহ্ন ফুটিয়ে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ বাইক থেকে ! কার বাইক ? কখন ? কিভাবে পড়লি ? „
আকাশ বলতে শুরু করলো------- আজকে আমাদের এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল । তাই ঠিক করেছিলাম কলেজ থেকে ফেরার পর রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেলিব্রেট করবো। সেই মতো কলেজ থেকে ফিরে বাড়ি এসে চলে গেছিলাম বন্ধুর বাড়ি। ওর বাইক আছে কিন্তু লাইসেন্স হয়নি। তাই ওর বাইকেই চড়ে অলিগলি দিয়ে যাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্টে। মাঝপথে একটা বেশ পাঁচ ছয় ফুট সরু গলির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটা বিড়াল সামনে চলে এলো। আমার বন্ধু স্পিডে চালাচ্ছিল। হঠাৎ ব্রেক চাপতে বাইকটা তো পড়লোই তার সাথে আমিও রাস্তায় ডান কাঁধের উপর ভর করে পড়লাম । রাস্তায় পড়ে ছয় সাত দূরে গড়িয়ে গেলাম ।
এতক্ষণ শুনেই সুচি প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো “ আর যাবি না ওর বাইকে । ঠিক মতো চালাতে পারে না ! উঠিস কেন ওদের বাইকে ? „ কথাটা বলেই সুচি সুমির দিকে তাকালো। সুচি দিদির দিকে তাকিয়েই চোখ নিচে নামিয়ে নিল। সুমি এক দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
আকাশ সুচির রাগকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বললো “ ও ভালোই চালাতে পারে। দূর্ঘটনা তো যে কারোর সাথেই ঘটতে পারে। ওই বিড়ালটা হঠাৎ লাফিয়ে সামনে চলে এসছিল তাই। মাকে বলবি না কিন্তু। „
তারপর প্রায় আধঘন্টা পড়ে আকাশ চলে গেল । আকাশ চলে যেতেই সুমি বললো “ এখনও সময় আছে সুচি ! স্বীকার করে নে। ও যখন ওই দূর্ঘটনার কথা বলছিল তখন আমি তোর চোখে ভয় দেখেছি। স্বীকার করে নে বোন আমার । „
সুচি শান্ত স্বরে বললো “ স্বীকার করার কিছু নেই দি। ওর এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই ভয় পেয়েছিলাম। „
সুমি সুচিকে আরও চেপে ধরলো “ নিজেকে মিথ্যা বলিস না। শোন আমার কথা। স্বীকার করে নে । হয়তো কষ্ট পাবি কিন্তু একটু কম কষ্ট হবে , চোখের জল একটু কম পড়বে, দুঃখ একটু কম পাবি। স্বীকার করে নে। „
সুচি এবার রাগি আর বিরক্তি মিশিয়ে বললো “ তোর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। বাবা তোকে ভাংচুং বুঝিয়েছে । আর তুইও বাবার কথায় নাঁচছিস । „ কথাটা বলে সুচি মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন ঘাটতে শুরু করলো ।
এতো লুকোচুরি খেলার পরেও শেষ রেহাই হলো না আকাশের। ডানহাতি হওয়ার জন্য রাতে ডিনার খাওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। বাবা মা দুজনেই লক্ষ্য করে বললেন “ কি হয়েছে কাঁধে ? „
আকাশ একটু ভয় পেয়ে বললো “ ও কিছু না । একটু লেগেছে। „
আকাশের মা সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে আকাশের জামা খুলে দেখলেন কাঁধে বেশ কিছুটা ছড়ে গেছে “ এটাকে একটু লেগেছে বলে ! „ তারপর আকাশের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “ দেখো তুমি কতোটা ছড়ে গেছে । „
তারপর আবার আকাশের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন “ সত্যি বল কার সাথে মারপিট করে এসছিস ? „
আকাশ জামাটা ঠিক করতে করতে বললো “ মারপিট করতে যাবো কেন ? ওই বিকালে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম । তখন লেগেছে। ও তুমি বেশি চিন্ত করো না তো । „
স্নেহা দেবী আরও রেগে গিয়ে বললেন “ চিন্তা করো না ! খুব বড়ো হয়ে গেছিস , তাইতো ! „
এখন আর আগের মতো বকাঝকা করাও যায় না , আর মারাও যায় না। সত্যি আকাশ বড়ো হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ষোল সতেরো বয়স তো হয়ে গেল। পরম যত্নে ঘায়ে মলম লাগিয়ে তারপর খেতে বসলেন স্নেহা দেবী ।
সবকিছু আগের মতো চললেও সুচির ভিতরটা আর আগের মতো নেই। সুচি নিজের জন্মদিনে কলেজ গেল না। বাড়িতেই কাটালো দিনটা। সুমি গতকাল অফিসের কাজে দুদিনের জন্য নদীয়া গেছে। জন্মদিনে দিদি অনুপস্থিত তাই সুচির একদম ভালো লাগছিল না। বিকাল বেলা কলেজ থেকে ফিরে ভালো জামা কাপড় পড়ে আকাশ সুচির ফ্ল্যাটে হাজির হলো । সুচিকে উদাস মনে টিভি দেখতে দেখে আকাশ বললো “ তুই এখনও তৈরি হোস নি ! „
“ আমার আজ ভালো লাগছে না। দিদি নেই। „
“ ওইসব বললে তো চলবে না। বিপ্লব আর জয়শ্রী দি অপেক্ষা করছে। তৈরি হয়ে নে । আমি অপেক্ষা করছি। „
নাছোড়বান্দা আকাশের হাবভাব দেখে সুচি ঘরে গিয়ে একটা জিন্স আর টপ পড়ে ঘরের বাইরে এলো। তারপর আকাশ কে নিয়ে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে পৌছল। প্রতিবছর আলাদা আলাদা রেস্টুরেন্ট সুচির জন্মদিন সেলিব্রেট করা হয়। কিন্তু লোক সংখ্যা পাঁচ জনের বেশি কখনোই হয় না। সুচি, সুমি, বিপ্লব, জয়শ্রী আর আকাশ। এই সেলিব্রেট মূলত আকাশের উৎসাহেই করা হয়। রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলো একটা ছোট গোল টেবিলে জয়শ্রী আর বিপ্লব বিচ্ছু একটা 2 pound এর কেক সাজিয়ে বসে আছে। আলো পাশে আরও অনেকে বসে আছে। কিন্তু তারা সবাই নিজেদের মধ্যেই ব্যাস্ত । সুচি চেয়ারে বসতেই বিপ্লব বিচ্ছু একটা ব্লাস্টার ফাটিয়ে বললো “ happy birthday সুচিদি। „
সুচি “ থ্যাঙ্ক ইউ „ বলে কেক কাটতে শুরু করলো। সবাই happy birthday গানটা গেয়ে সুচিকে উইশ করলো। কেক কাটার পরেই প্রথম টুকরোটা অটোমেটিক বাঁদিকে বসে থাকা আকাশের মুখের দিকে বাড়িয়ে দিল সুচি। তারপর গিফ্ট দেওয়ার পালা এলো। জয়শ্রী একটা বই উপহার দিল। বিপ্লব বিচ্ছু একটা দামী পেন উপহার দিল। আর আকাশ দিল কয়েক হাজারের একটা দামী বিদেশী কোম্পানির mackup kit । উপহারটা দেখে সুচির ডান দিকে বসে থাকা জয়শ্রী সুচির কানে কানে বললো “ খুব ভাগ্য করে এমন একটা বন্ধু পেয়েছিস। আমি কিংবা বিপ্লবও ওর বন্ধু। কিন্তু আমাদের জন্য কখনো ও এতো খরচ করে না। খুব lucky তুই । „
জয়শ্রীর কথাটা যে সুচি আগে কখনো শোনে নি এমন নয়। কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল আর এখন আলাদা। সর্বপরি তখন সুমির করা প্রশ্নটা ছিল না। এখন আছে। সুমি প্রশ্নটা করার পর থেকে সুচির মনে হতে শুরু করেছিল যেন আশেপাশের সবাই তাকে এটাই বোঝাতে চাইছে যে তুই ওই 5'9 ইঞ্চির আকাশ নামের ছেলেটাকে ভালোবাসিস। যাকে তুই মাঝেমাঝেই অসভ্য , লম্পট , চিড়িয়াখানার জন্তু বলে সম্বোধন করিস তাকে তুই ভালোবাসিস।
সুচির কলেজ কোচিং , আকাশের কলেজ আর কোচিংয়ের মধ্যে দিয়ে বছর পার হয়ে গেল। সুচি নিজেকে বুঝিয়ে রেখেছে যে বাবা দিদি ভুল ভাবছে। পরের বছর আকাশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হলে সুমির দৌলতে কলেজে দশের মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলো আকাশ। আর এদিকে সুচিও খুব ভালো গ্রেড পেয়ে B.Com পাস করলো। পরিক্ষায় এতো ভালো নাম্বার পেয়ে আকাশ বায়না করলো যে একটা বাইক কিনে দিতে। ছেলের আবদার শুনেই স্নেহা দেবী রেগে গিয়ে বললেন “ না , ওই দু চাকা চালাতে হবে না। খুব দূর্ঘটনা ঘটে ওতে। „
মায়ের রাগী স্বর শুনে আকাশ আর আকাশের আবদার মিইয়ে গেল। কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা উঠলে সবাই ভাবতে শুরু করলো কোথায় ভর্তি করা যায়। অফিসে শুভাশীষ বাবুর চিন্তিত মুখ দেখে সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো “ কি এতো ভাবছেন বলুন তো সকাল থেকে? „
“ ওই আকাশকে কোন কলেজে ভর্তি করাবো সেটাই ভাবছি। „
“ তা বেশ তো লন্ডনে পাঠিয়ে দিন। আমিও তো আমার মেয়েকে ওখান থেকেই পড়াচ্ছি । এই পোড়া দেশের সার্টিফিকেটের দাম নেই। „
কথাটা ভালো লাগলো আকাশের বাবার। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে কথাটা বললেন। আকাশের মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন “ তুমি তো সারাদিন অফিসে কাজ করে দূরে থাকো। বাড়িতে আমি আর আমার ছেলে থাকি। ছেলেটাকেও আমার কাছ থেকে দূর পাঠিয়ে দেবে । „
কথাটা এমন ভাবে আকাশের মা বললেন যেন তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে । তাই আকাশের বাবা আর কিছু বললেন না। আঠারো উনিশ বছর সাংসারিক জীবন করেও আকাশের বাবা এখনও এই মহিলাকে বুঝতে পারেন নি। আকাশের মা কখন কোন কথায় কিভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা একটা বড়ো ধাঁধা আকাশের বাবার কাছে।
কয়েক দিন পর সকালে আকাশ সুচির ঘরে ঢুকে ঘাটের উপর গড়িয়ে বললো “ তোর কলেজে ভর্তি নিয়েছি । আজকে বাবা গেছে ডোনেশন আর ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে । BBA নিয়ে ভর্তি হচ্ছি। তোর স্কুটিতে যাবো একসাথে আগের মতো । „