01-11-2021, 09:03 AM
Update 4
পুরী থেকে আসার দুই দিন পর , সুচি কলেজ থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে , খাটে শুয়ে ফোন ঘাটতে ঘাটতে বিশ্রাম নিতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর কোচিংয়ের জন্য যেতে হবে । সুচি আর সুমির ঘরটা বেশি বড়ো না। ঘরের একদম মাঝখানে তিন জন পাশাপাশি শুয়ে আরামে ঘুমানো যায় এমন একটা পুরনো আমলের সেগুন কাঠের খাট। খাটের ওই পাশে একটা পুরানো আমলের আলনায় দুই বোনের জামাকাপড় রাখা আছে। আলনার ঠিক পাশেই আছে পড়ার টেবিল। আর খাটের এই পাশে একটা আলমারি। আলমারির দরজায় বড়ো কাঁচ লাগানো আছে। আর আলমারির পাশে ছোট একটা টেবিলে মেকআপের জিনিসপত্র। ওটাই ড্রেসিংটেবিল হিসাবে ব্যাবহার করে দুই বোন।
কিছুক্ষণ পর সুমি অফিস থেকে ফিরে এলো। ফ্রেশ হয়ে খাটে বসে বোনকে জিজ্ঞাসা করলো “ দিন কেমন কাটলো ? „
এরকম প্রশ্ন সুমি কখনোই সুচি কে করেনি , তাই সুচি ভুরু কুঁচকে বললো “ তেমন কিছু না। রোজকার মতোই ! „
“ ও । „ বলে ড্রেসিংটেবিলে গিয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করলো ।
এবার সুচি দিদিকে জিজ্ঞাসা করলো “ হঠাৎ এই প্রশ্ন ! কখনো তো জিজ্ঞাসা করিস না ! „
“ না এমনি ! জানতে ইচ্ছা হলো তাই । কেন ! জিজ্ঞাসা করতে পারি না বুঝি ? „
দিদির কথায় সুচির মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল। একমনে দিদিকে দেখতে শুরু করলো সুচি। আজকে যেন একটু বেশিই সময় নিয়ে চুল আঁচড়িয়ে যাচ্ছে “ কি হয়েছে বলতো ? নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে । „
মুখে হাসি নিয়ে সুমি বললো “ কিছু হয়নি। কি আবার হবে ! „
“ না সত্যি বল ! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে ! কেউ কি তোকে প্রোপজ করেছে ? „ বলে সুচি খাট থেকে উঠে দিদিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ।
সুমি হেসে উঠে বললো “ প্রোপজ করে নি , তবে ডিনারের জন্য জিজ্ঞাসা করেছে একজন । „
কথাটা শোনার পরেই সুচির উৎসাহ দেখার মতো হয়ে উঠলো “ তুই কি বললি ? „
“ ডিনার তো করাই যায় । তাই হ্যাঁ বললাম। „
সুচি আরো ভালো করে দিদিকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো “ কে ? দেখা একবার জামাইবাবুর ফটো । „
“ এখনই জামাইবাবু বলে দিলি ! আগে ওর চরিত্র দেখবো। ভিতরটা পরিষ্কার কিনা দেখবো , তারপর এগিয়ে যাবো । „ বলে সুমি ফোন থেকে একটা গ্রুপ ফটো বার করে বোনকে দেখিয়ে বললো “ এই যে , এ । আমাদের অফিসেই কাজ করে । কৌশিক হালদার নাম । „
সুচি ঠোট বেকিয়ে বললো “ কালো আর একটু মোটা । „
বোনের কথা শুনে সুমি ঠোটে হাসি নিয়ে বললো “ আমি এমন একজনকে জীবনসঙ্গী বানাতে চাই যে আমাকে সম্মান দিয়ে ভালোবাসবে। ভালোবেসে দয়া করবে না। গায়ের রঙ নিয়ে আমি করবো ? আমিও তো কালো। „
দিদির কথায় সুচি দমে গেল “ ওসব ঠিক আছে । বলছি কালকে একটু সেজেগুজে যাস। এইভাবে যাস না। „
সুমি এবার স্বরটা একটু গম্ভীর করে বললো “ আমার দ্বারা ওটা হবে না। আমি তোর মতো ফর্সা নই , হয়তো তোর মতো সুন্দরও নই । আমি কালো। আর এটাই ওকেও মেনে নিতে হবে , যেমন আমি মেনে নিয়েছি । „
দিদির এই সাহসি চরিত্রটাই তো সুচির ভালো লাগে। সুমি মনে করে ওর সৌন্দর্য হলো ওর ইন্টেলিজেন্স , সৎ নির্ভিক বচনভঙ্গি । এটাই তো সুচির গর্ভ। শুধু সুচির নয় সাথে সুচির মা বাবারও গর্ভ । দিদির মুখে এইসব শুনে সুচি ভালো করে সুমিকে জড়িয়ে ধরে বললো “ আমি সাজিয়ে দেবো তোকে। না করলে আলাদা ঘরে শুবি এবার থেকে । „
বোনের হুমকি শুনে সুমি রাজি না হয়ে পারলো না “ আচ্ছা ঠিক আছে। সাজিয়ে দিস তোর ইচ্ছা মতো। „
এর ঠিক দুই দিন পর সকালে , আকাশের লিভিংরুমে ঢুকে সোফায় বসে থাকা আকাশের চোখের সামনে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা নাচিয়ে সুচি বললো “ যাবি ঘুরতে ? „
আকাশ মজা করে বললো “ তোর বিশ্বাস নেই ! ফেলে দিবি । „
“ তোর কি মনে হয় ! আমি এটা ঘুষ দিয়ে বানিয়েছি ? „
“ তোর বিশ্বাস নেই। করতেই পারিস । „
কিছুক্ষণ আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সুচি বললো “ একবার চল আমার সাথে ! তাহলেই বুঝতে পারবি আমি ঘুষ দিয়ে পেয়েছি নাকি নিজের যোগ্যতায় । „ তারপর মিচকি হেসে বললো “ সত্যি কথাটা বলা না যে একটা মেয়ের পিছনে বসতে লজ্জা পাচ্ছিস । „
এই শেষ কথাটায় আকাশের ইগোতে লাগলো “ ঠিক আছে দেখবো কেমন ভালো চালাস ! এখন যাবি নাকি ? „
“ এখন কেন হাঁদারাম ! বিকালে যাবো । বিকালে রেডি হয়ে থাকিস। „ কথাটা বলে সুচি নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল।
বিকাল হতেই সুচি আকাশের ঘরে হাজির হলো। খোলা চুল , পড়নে আছে তার চিরাচরিত সালোয়ার আর লেগিন্স , কাঁধে লম্বা স্ট্রাপের ছোট একটা হ্যান্ড ব্যাগ আর হাতে একটা হেলমেট। ঘরে ঢুকেই দেখলো আকাশ তার আপেলের ল্যাপটপে কোন একটা সিনেমা দেখছে “ চল । আর দেখতে হবে না । এসে দেখবি। এখন না বেরলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে । „
আকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কোথায় যাবি ? „
“ এখনও ঠিক করিনি । আশেপাশেই কোথাও যাই চল । „
আকাশ সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ shutdown করে গেঞ্জির উপর একটা কালো শার্ট আর একটা জিন্স পড়ে চুল আঁচড়িয়ে ঘরের বাইরে চলে এলো। এতো সেজেগুজে দুজনকে বার হতে দেখে স্নেহা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন “ কোথায় চললি তোরা ? „
আকাশ মায়ের কথায় ইয়ার্কি করে বললো “ আজকে লাইসেন্স পেয়েছে। তাই কেমন চালায় সেটাই দেখাতে চাইছে । „
ছেলের কথায় স্নেহা দেবী হাসতে হাসতে সুচিকে বললেন “ সাবধানে চালাবি আর সন্ধ্যার আগে ফিরবি । „
কাকির কথায় সুচি বললো “ এই আশেপাশেই যাবো । বেশিক্ষণ লাগবে না । „
তারপর দুজনেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। পিছন থেকে দুজনেই শুনলো স্নেহা দেবী “ দুগ্গা দুগ্গা „ বললেন ।
নিচে নেমে বিল্ডিংয়ের সামনেই দাড় করিয়ে রাখা স্কুটির উপর উঠে সুচি হেলমেট পড়ে নিল। স্কুটি স্টার্ট দিলে আকাশ পিছনে বসে পড়লো “ কোথায় যাবি ? „
একটু ভেবে নিয়ে সুচি বললো “ গঙ্গায় যাবি ? বিকালে খুব সুন্দর মিষ্টি হাওয়া বয় ওখানে । „
সুচির প্রস্তাবে আকাশ বললো “ গঙ্গার ঘাট ! তাহলে প্রিন্সেপ ঘাট চল । „
গন্তব্য স্থান ঠিক হতেই সুচি স্কুটি চালিয়ে দিল। রাস্তা ফাকা এখন , তাই কুড়ি পচিশ মিনিটেই দুজনে প্রিন্সেপ ঘাপ পৌছে গেল। প্রিন্সেপ ঘাট পৌঁছে একটা ফাকা জায়গা দেখে সুচি স্কুটি স্ট্যান্ড করে দিল “ কেমন চালাই বল ? „
একজন পরিদর্শক এর মতো করে সুচিকে নাম্বার দেওয়ার ভঙ্গি করে আকাশ বললো “ দুটো সিগন্যালে দেরিতে ব্রেক চেপেছিস আর তিনটে গাড্ডায় স্পিডে চালিয়েছিস বাকি ঠিক আছে । „
কি বলবে এই খচ্চরটাকে সেটাই ভেবে পেল না সুচি ! তাই প্রসঙ্গ পাল্টে সুচি জিজ্ঞাসা করলো “ খাবি কিছু ? „
“ হ্যাঁ , তবে আগে একটু বসে হাওয়া খেয়ে নিই তারপর খাবার খাবো । „
তারপর দুজনেই গঙ্গার ঘাটে এসে বসলো। দুপুর পড়ে গিয়ে বিকাল হয়ে এসছে আর গঙ্গার হাওয়া শীতল হয়ে এসছে। শীতল হাওয়া দুজনের মুখের উপর পড়তেই দুজনের মনকে ঠান্ডা করে দিল । তাকিয়ে দেখলো মাঝ গঙ্গায় একটা নৌকায় একটা মেয়ে বসে আছে। আর তার বয়ফ্রেন্ড ডিএসএলআর দিয়ে ফটো তুলে দিচ্ছে। আরও কয়েকটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে এদিক ওদিক। আর সেইসব নৌকার মাঝিরা দাড় টেনে যাচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রমে। আর গঙ্গার ওইপাড়ের আকাশটা কমলা রঙ ধরে নিয়েছে। সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। এইসব দেখতে দেখতে দুজনের সময় কাটতে লাগলো। প্রায় আধঘন্টা কেটে যাওয়া পর সুচি বললো “ ওঠ এবার । „
আকাশ পকেট থেকে ফোন বার করে দেখলে আধঘন্টা হতে যায় “ চল ঝালমুড়ি খাই । „
দুজনেই ঝালমুড়ির ঠেলা গাড়ির সামনে এলো। সুচি বললো “ দু জায়গায় দাও । ঝাল একটু বেশি করে দেবে । „
ঝালমুড়ি নিয়ে দুজনে প্রিন্সেপ ঘাটের বিখ্যাত স্ট্রাকচারের ভিতর এসে একটা বেঞ্চের কাছে এলো । বেঞ্চের বেশির ভাগ জায়গায় পাখিরা হেগে রেখেছে। একটা ভালো জায়গা দেখে দুজনে গায়গায়ে বসে ঝালমুড়ি খেতে লাগলো। হঠাৎ আকাশ ঝালমুড়ি খাওয়া বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে কিছু দূরের একটা বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইলো। সুচিও সেদিকে তাকাতে দেখলো একটা বেঞ্চের উপর একটা ছেলে বসে আছে। আর ছেলেটার কোলের উপর একটা মেয়ে বসে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না দুজনের। কারন মেয়েটার চুলে দুজনের মাথাটা ঢাকা আছে। বোঝাই যাচ্ছে দুজনে কিস করছে। আকাশ সেই দৃশ্য এক দৃষ্টিতে উপভোগ করছে দেখে সুচি রেগে গিয়ে ঝাঝিয়ে উঠে বললো “ অসভ্য। তোর মতো লম্পটের সাথে দেখছি কোথাও যাওয়া যাবে না । „
আকাশ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো “ আমি কি করলাম ? ওরা খুল্লাম খুল্লা করছে তাতে দোষ নেই আর আমি দেখলেই দোষ ? আমিই অসভ্য ? „
“ তোকে নিয়ে বার হওয়াই আমার দোষ হয়েছে । „ কথাটা বলে রেগে লম্বা লম্বা পা ফেলে সুচি যেখানে স্কুটি স্ট্যান্ড করে রাখা আছে সেখানে হাটা দিল। আকাশও সঙ্গে সঙ্গে সুচির পিছন নিল। সুচি স্কুটি স্ট্রার্ট করার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ লাফিয়ে পিছনের সিটে বসে পড়লো। সুচি একটা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্কুটি চালিয়ে দিল।
আসার সময় যে রাস্তা অতিক্রম করতে কুড়ি পচিশ মিনিট লেগেছিল এখন অফিস আওয়ার শেষ হতে সেই রাস্তা দিয়ে আসতে এক ঘন্টা লেগে গেল। সোসাইটিতে পৌছনোর আগেই দুজনের মুখ গাড়ির নোংরা ধোয়ায় কালো হয়ে চ্যাটচ্যাটে হয়ে উঠলো। সোসাইটি পৌছে বিল্ডিংয়ের নিচে স্কুটি দাড় করাতেই আকাশ নেমে উপরে উঠে গেল। সুচি স্কুটি বন্ধ করে স্ট্যান্ড করতেই দেখলো বাবা অফিস থেকে ফিরে এসছে। সুচি বাবার অফিস ব্যাগটা নিয়ে নিল। দুজনেই উপরে উঠতে উঠতে সিড়িতে সুচির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন “ কোথায় গেছিলি দুজনে ? „
“ ওই প্রিন্সেপ ঘাটে গেছিলাম ঘুরতে । „
মেয়ের মুখে সব শুনে সমরেশ বাবু চুপ মেরে গেলেন। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে খবর দেখতে দেখতে চা খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে ডাকলেন “ সুমি । „
নিজের ঘর থেকে সুমি বললো “ হ্যাঁ বাবা আসছি । „
কিছুক্ষণ পর সুমি এসে ঘরের চৌকাঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ কিছু বলবে বাবা ? „
সুমির বাবা খাটের খালি অংশ দেখিয়ে বললেন “ বস । „
সুমি গিয়ে বাবার পাশে বসতে সমরেশ বাবু বললেন “ সুচি তো তোর সাথে সব কথা শেয়ার করে । তোর কথা শোনেও। তুই একটু বোঝা ওকে ....
এতোটা বলে সুচির বাবা থেমে গেলেন। সুমি বুঝতে পারলো যে বাবা কিছু একটা বলতে গিয়ে সঙ্কোচে আর বলতে পারছে না “ কি বোঝাবো বাবা ? „
কিছুক্ষন পর সমরেশ বাবু আবার বলতে শুরু করলেন “ আমি ওকে সেই ছোট থেকে বোঝাচ্ছি কিন্তু ও বুঝতে চাইছে না ! তোর বোন যে পরিবারের সাথে ঘোরে ! তারা পরিবার , সম্পর্ক , ভালোবাসার থেকে অর্থ , যশ , সম্পত্তিকে এগিয়ে রাখে । ওদের কাছে সম্পর্কের কোন মূল্য নেই । আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ আমাদের সাথে ওদের যায় না। কোন ধরনের সম্পর্ক হয় না ওদের সাথে আমাদের......
কথাগুলো বলতে বলতে সুমির বাবা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এতক্ষণে সুমি বুঝলো বাবা কি বলতে চাইছে। ঠিক এই ভয়টাই তো দুদিন আগে পেয়েছিল সে “ তুমি শান্ত হও বাবা। আমি বোনকে বুঝিয়ে বলবো । ও ঠিক বুঝবে । „
“ বুঝলে ভালো। না হলে ...... আর বলতে পারলেন না সুচির বাবা ।
বাবাকে শান্ত করে সুমি নিজের ঘরে চলে এলো। ঘরে এসে দেখলো সুচি খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কানে হেডফোন দিয়ে ফোন ঘাটছে। কিছুক্ষণ বোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুমি। কিভাবে বলবে ? কিভাবে বোঝাবে ওকে সেটাই ভেবে পেল না সুমি। কিছুক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর নিশ্বাস ছেড়ে সুমি বললো “ আকাশ কোন স্ট্রিম নিয়ে ভর্তি হবে কিছু বলেছে তোকে ? „
সুচি অবজ্ঞার সুরে বললো “ না । ওর ওইসবে হুশ নেই । „
সুচির কথা শেষ হতে না হতেই আকাশ ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসে পড়লো “ কার হুশ নেই ? „
“ তোর হুশ নেই ! কোন স্ট্রিম নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হবি সেটা ভেবেছিস ? „ সুচির গলার স্বরে আকাশের জন্য ওর চিন্তা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেল।
আকাশ ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে বললো “ ওটা নিয়ে আর ভাবনার কি আছে ! সাইন্স নিয়ে ভর্তি হবো । „
আকাশের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে সুমি আর চুপ থাকতে পারলো না “ এখন যে স্ট্রিম নিয়ে ভর্তি হবি , সেই স্ট্রিমের বিষয় নিয়েই কিন্তু কলেজে পড়তে পারবি । তাই ঠান্ডা মাথায় ভাব কলেজে কি নিয়ে পড়বি । „
আকাশ তার ডোন্ট কেয়ার ভাবটা বজায় রেখে বললো “ আমার তো জন্মের পরেই সব ঠিক করে দেওয়া আছে। কলেজ শেষ করে বাবার ব্যাবসা দেখবো । তাই MBA নিয়েই পড়বো । „
আকাশের কথা শুনে সুমি বুঝলো যে সত্যি আকাশের কাছে আর কোন অপশন নেই “ তাহলে যে কোন স্ট্রিম নিয়েই পড় । কোন অসুবিধা হবে না। „
সুমির কথা শেষ হতেই আকাশ সুচির দিকে ফিরে আফসোস করে বললো “ তোর জন্য আজ ফুচকা খাওয়া হলো না ! „
কয়েক সপ্তাহ পরে আকাশ একটা সরকারি কলেজে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয়ে গেল। আকাশকে কোন কলেজে ভর্তি করা যায় সেই প্রসঙ্গ উঠলে আকাশের বাবা বললেন “ এখন আর সরকারি কলেজে তেমন পড়া হয়না। ইংলিশ মিডিয়াম-ই ভালো । „
আকাশের মা ব্যাঙ্গ করে বললেন “ সারাজীবন বাংলা মিডিয়ামে পড়ে এখন শেষ বেলা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে ! বুদ্ধি কোথায় রেখে এসছো তুমি ? বোর্ড আলাদা , পড়াশোনার ধরন আলাদা , কিভাবে করবে ও ? „
স্ত্রীর ব্যাঙ্গ গায়ে মেখে আকাশের বাবা বললেন “ এই জন্যেই আমি ক্লাস ফাইভে ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি হতে বলেছিলাম । তোমার ছেলেই জেদ ধরেছিল সুচির কলেজে পড়বে । আর মাও ওর জেদে সায় দিয়েছিল । „
মায়ের কথা উঠতে স্নেহা দেবী রেগে গেলেন “ ওওওও । এখন মায়ের দোষ হয়ে গেল .......
ঝগড়া আরও কিছুক্ষণ চললো কিন্তু আকাশ আর শুনলো না ।
কয়েক দিন পরেই কাধের এক দিকে ব্যাগ ঝুলিয়ে , মাথায় জেল মেখে চুল ব্যাক ব্রাশ করে , পারফিউম মেখে কলেজে চলে গেল। দুই দিন পর সুচি কলেজ যেতে গিয়ে আকাশের সাথে দেখা হলো। আকাশের রুপ লক্ষ্য করে সুচি বললো “ এতো সেজেগুজে কলেজে পড়তে যাচ্ছিস ! নাকি কলেজে আড্ডা দিতে ? „
আকাশ হাটতে হাটতে বললো “ মায়ের মতো কথা বলিস না তো ! এখন সবাই এইভাবেই কলেজে যায় । „
কলেজ যাওয়ার তাড়াহুড়োতে আর কথা এগোলে না , কিন্তু সারাদিন সুচির মনটা খচখচ করতে লাগলো ‘ নিশ্চয়ই মেয়ে বন্ধু বানিয়েছে অনেক । কলেজে যাওয়ার নাম করে নিশ্চয়ই তাদের সাথেই ফূর্তি করছে । ‚ সুচি এইসব ভাবতে লাগলো কলেজে বসে ।
বিকালে একেবারে কোচিং করে বাড়ি ফিরলো সুচি। এসে দেখলো সুমি চলে এসছে। ফ্রেশ হয়ে খাটে শুয়ে ফেসবুক খুলে আকাশের ফ্রেন্ডলিস্ট দেখতে বসলো। বেশ কয়েকটা মেয়ের প্রোফাইল দেখলো। সদ্য ফ্রেন্ড হয়েছে। আর সবার বায়োতে আকাশের কলেজের নাম লেখা আছে। মানে আকাশের কলেজেই পড়ে এই মেয়েগুলো। আর থাকতে পারলো না সুচি। দিদিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলো “ আকাশের অবস্থা দেখেছিস ! এমন সেজেগুজে কলেজে যায় যেন কলেজ না কোন ম্যাগাজিনের ফটোশুটে যাচ্ছে ! আর তিন দিনেই কতোগুলো বান্ধবী বানিয়েছে দেখ ! „
কয়েকদিন আগে সমরেশ বাবু সুমিকে বোনকে বোঝানোর জন্য যে কথাগুলো বলেছিল , আজ বোনের কথা শুনতে শুনতে ওর উৎসাহ আর হাল্কা ঈর্ষা দেখে সেই কথা গুলোই সুমির মাথাতে বারবার আঘাত করতে শুরু করলো। সেদিন কথাগুলো না বলতে পারলেও আজকে যেন সুচি নিজেই সুমিকে কথাটা বলার সুযোগ করে দিল “ তুই কি ওকে ভালোবাসিস ? „
দিদির প্রশ্ন শুনে প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুমির দিকে তাকিয়ে থাকার পর হো হো করে সুচির অট্টহাস্যের শব্দে ঘরটা কেঁপে উঠলো “ কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছিস ! „
বোনের অট্টহাসিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে গম্ভীর স্বরেই সুমি জিজ্ঞাসা করলো “ তাহলে ওকে স্টক করছিস কেন ? আর ওর সবকিছুতে ওকে এতো কন্ট্রোল করিস কেন ? „
“ আমি কোথায় ওকে স্টক করছি ! আমিতো শুধু...... আর কিছু বলতে পারলো না সুচি । কারন আর কিছু নেই বলার মত ।
বোনের হঠাৎ চুপ করে যাওয়া দেখে সুমি এবার খাটের উপর এসে সুচির পাশে বসলো “ তিন চারদিন আগে বাবা আমাকে ডেকে তোকে বোঝাতে বলেছিল । কি বোঝাতে বলেছিল জানিস ? „
সুমি নিজেই প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিতে শুরু করলো “ বলেছিল তোকে ছোটবেলা থেকে বোঝাচ্ছে যে ওই পরিবারের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ না হতে । কিন্তু তুই শুনিস নি। ওই পরিবারের লোক সম্পর্ক , ভালোবাসা , পরিবারের থেকে টাকা , যশ আর খ্যাতিকে বেশি প্রায়োরিটি দেয়। ওদের সাথে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের কোন ধরনের সম্পর্ক হয় না। তুই কিন্তু আর বাচ্চা না ! কলেজে পড়িস। ম্যাচিউর হয়ে গেছিস । তাই বলছি তুই কি ওকে ভালোবাসিস ? „
সুচি এবার একটু জোড় করে মুখে হাসি এনে বললো “ বাজে কথা বলিস না। কাকি মোটেও ওরকম না । আর আমি কেন ওই ছ্যাচড়া ছোট লোকটাকে ভালোবাসতে যাবো । ওকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না । এক নম্বরের জন্তু । „
বোনের কথা শুনে সুমি বললো “ তুই আমাকে মিথ্যা বলছিস ঠিক আছে কিন্তু নিজেকে তো সত্যিটা বল । „
সুচি এবার রেগে গিয়ে বললো “ সত্যি একটাই , তুই বাজে বকছিস । „ বলে খাট থেকে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল ।
এইভাবে হঠাৎ এরকম একটা কথা উঠে আসবে সেটা সুচি ভাবেনি। হয়তো জীবনের সবথেকে বড়ো সত্যি কথাটা এইভাবে কেউ জিজ্ঞাসা করবে সেটা সুচির মন ভাবেনি। মনের সবথেকে প্রিয় ও ভালোলাগার বিষয় নিয়ে এই ভাবে মুখোমুখি সম্মুখীন হয়ে সুচি এখন অপ্রস্তুত। তাই অপ্রস্তুত হয়ে একটাই প্রশ্ন বুকের মধ্যে নিয়ে লিভিংরুমের সোফায় গিয়ে বসলো সুচি। বারবার একটা কথা নিজেকে বলতে লাগলো , নিজের মনকে বোঝাতে লাগলো ‘ এরকম কোন ব্যাপার নেই। আকাশ আমার শুধু বন্ধু। ওর সাথে ঘুরতে ভালো লাগে । কথা বলতে ভালো লাগে । একসাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে । ব্যাস এর বেশি কিছু না। ‚ কিন্তু সুচির মন বারবার বলতে লাগলো ‘ তুই মিথ্যা বলছিস । ‚
পরবর্তী কয়েকটা দিন মাথার মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো । সুমির করা প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু । এই মন আর মাথার দ্বন্দ্বে সুচি খিটখেট আর চুপচাপ স্বভাবের হয়ে গেল। গালে গর্ত হয়ে টোল পড়ে সেই হাসিটার জৌলুস কোথাও যেন হারিয়ে গেল। আগের মতো হুটহাট আকাশের ঘরে এমনকি আকাশদের ফ্ল্যাটে যাওয়া বন্ধ করে দিল। বাবা মা মনে করলেন যে এটা হয়তো পড়ার চাপে হচ্ছে। আকাশ সুচির এই পরিবর্তনে খুব খুশি হলো। আর কোন কৈফিয়ত দিতে হয় না , কোনকিছুতে বাঁধা আসে না।
আরও কয়েক সপ্তাহ পর পূজা শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছরের মতো আকাশের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো সুচি। নিজেকে এতো বোঝানোর পরেও কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করলো সুচি। সেই প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবে আর আকাশের সাথে মিশতে দিচ্ছে না। পূজা শেষ হতেই একদিন রাতে আকাশ এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই সুমি কে উদ্দেশ্য করে বললো “ তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট রাখতে হবে সুমিদি । „
সুমি আকাশের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো। ভুরু কুঁচকে বললো “ রিকোয়েস্ট ! „
“ আমাকে পড়াতে হবে । „
সুমি মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে বললো “ না ! না ! একদম না । আমার সময় নেই । আমাকে রেহাই দে । „
আকাশ করুন সুরে বললো “ প্লিজ , প্লিজ , এরকম করো না। দেখো ! কোচিংয়ে কোন পড়া হয়না , শুধু নোটস দিয়ে খালাস । এই কয় মাসে একটাও চ্যাপ্টার বুঝতে পারিনি । „
“ তাহলে অন্য টিচার দেখ । „
আকাশ গলায় সেই করুন সুরটা বজায় রেখে বললো “ সব টিচারই এরকম করছে । ফিজিক্স এর টিচার 1200 নিচ্ছে , বাংলা আর ইংলিশের টিচার 900 করে নিচ্ছে , ম্যাথ আর কেমিস্ট্রির টিচার ও 1200 নিচ্ছে । কিন্তু বোঝানোর বেলায় নোটস দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে । প্লিজ তুমি এরকম করো না। প্রতিদিন পড়াতে হবে না । মাঝে মাঝে যে চ্যাপ্টার বুঝতে পারবো না , সেটাই বুঝিয়ে দেবে। একমাত্র তুমিই ভরসা । „
নাছোড়বান্দা আকাশের কথা শুনে সুমি বললো “ ঠিক আছে। তবে কয়েকটা শর্ত আছে ! „
সুমির রাজি হওয়াতে আকাশ খুব খুশি হলো। চোখে মুখে খুশি ফুটিয়ে তুলে, ঠোটে হাসি নিয়ে বললো “ সব শর্তে রাজি । „
আকাশের অবস্থা দেখে সুমি না হেসে পারলো না “ আগে শর্ত গুলো তো শোন । „
“ বলো । „
সুমি কিছুক্ষণ ভেবে নিজের শর্ত গুলো বলতে শুরু করলো “ আমি কোন ফিজ নেবো না । মাঝে মাঝেই রাজ্যের নানা প্রান্তে যেতে হয় তাই কোন রুটিন মেনে পড়াতে পারবো না। আর কাউকে বলতে পারবিনা যে আমি তোকে পড়াচ্ছি । „
আকাশ সম্মতিসূচক একটা মাথা নেড়ে বললো “ ok. „