Thread Rating:
  • 9 Vote(s) - 3.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
জীবনের অন্য পৃষ্ঠা - কামদেব
#24
[২২]

গলির মুখে মেয়েদের জটলা, পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কানে এল, মালতীর নাগর। হি-হি-হি। গলি থেকে রাজপথে নেমে মাথা উচু করে দেখল, তারা ঝলমল পরিষ্কার আকাশ। কোথাও এক ছিটে মেঘের কলঙ্ক নেই। হাতে ধরা দোমড়ানো পাঁচশো টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে চোখ ছল ছল করে ওঠে। পাড়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে সেই কবে, তাহলে কেন দিল টাকা? পরকালের পারানির কড়ি? বাস আসতে উঠে পড়ল। এতদিন কত ভুল ধারণা বয়ে বেড়িয়েছে ভেবে অনুশোচনা হয়। বিশাল এই পৃথিবীতে কে কোথায় কোন প্রান্তে কীভাবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তার কতটুকু খবর কজন জানে। সেই তুলনায় রত্নাকর তো ভালই আছে। নিজের মধ্যে যেন লড়াইয়ের শক্তি ফিরে পায়।
চারতলা বাড়ীর নীচে পুলিশের জিপ এসে দাড়ালো। বড়বাবু চোখ তুলে তাকালো, জ্বলজ্বল করছে লেখাটাদি রিলিফ। দারোয়ান গেট খুলে দিতে গাড়ী ঢুকে গেল। নীচটা পুরোটাই পার্কিং প্লেস। সারি সারি গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। সিড়ী দিয়ে দোতলায় উঠে এল স্থানীয় থানার ওসি সিকদারবাবু। এখানে নিত্য যাতায়াত আছে বোঝা যায়। দোতলা পুরোটাই হল ঘর। একপাশে বেদীতে এক মহিলা সন্ন্যাসীর ছবি হাতে জপমালা। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। বেশকিছু নারী পুরুষ চোখ বুজে ধ্যান করছে। সবই অভিজাত পরিবারের দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়না। হলের পাশ দিয়ে সরু প্যাসেজ চলে গেছে। প্যাসেজের পাশে ছোটো ছোটো ঘর। শেষ ঘরের কাছে সিকদার বাবু দাড়ালেন। রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন।
দরজায় টোকা দিতে ভিতর থেকে নারী কণ্ঠ শোনা গেল, কামিং।
সিকাদারবাবু ভিতরে ঢূকলেন। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল, টেবিলে ল্যাপটপ জলের গেলাস। অন্যদিকে মাথায় কাপড় জড়ানো সন্ন্যাসিনী মত দেখে বয়স অনুমান করা কঠিন। তিরিশও হতে পারে আবার পঞ্চাশ হওয়াও সম্ভব। ইঙ্গিতে সিকদারবাবুকে বসতে বললেন। মহিলার চেহারায় একটা সম্মোহনী ভাব।
নমস্তে আম্মাজি। সিকদার বাবু বসলেন।
নমস্তে। আম্মাজী হাসলেন।
এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম আম্মাজীর সঙ্গে দেখা করে যাই।
একটা রিকোয়েস্ট করবো? আপনি সব সময় স্বাগত কিন্তু ইউনিফর্মে আসলে সবাই প্যানিকি হয়ে পড়ে।
হে-হে-হে। সিকদার দাত কেলিয়ে দিল।
টাকা পয়সা।
না না ওসব ঠিক আছে আম্মাজী। আপনি থাকতে ওসব নিয়ে চিন্তা করিনা। আচ্ছা এরপর সিভিল ড্রেসেই আসবো।
সব খবর ভাল আছেতো?
আপনার আশির্বাদ।
নিতিয়ানন্দকে বলবেন দেখা করতে।
ঘোষবাবু? কেন কিছু গড়বড় করেছে?
দাওয়াই দিতে হবে।
হে-হে-হে। সিকদার বিগলিত হাসে।
বোকাচোদা ঘোষ খুব বেড়েছে। সবে ইন্সপেক্টর হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এসপি সাহেব একবার বাচিয়েছিল, এবার দেখি তোর কোন বাপ বাচায়।
বাস থেকে নেমে ভাবে পঞ্চাদার দোকানে যাবে কিনা? মোবাইলে সময় দেখল, সোয়া-নটা। ওরা কি পঞ্চাদার দোকানে আছে নাকি ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছে? দোকানে থাকলে একটু বসে যাবে। একটা পরীক্ষা বাকী, হয়ে গেলে নিশ্চিন্তি। মনে পড়ল বিজুদা দেখা করতে বলেছিল। কোর্ট থেকে এতক্ষনে বাসায় ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই। ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। গ্রিলে ঘেরা বারান্দায় বসে আছে বেলাবৌদি। রতিকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কালেকশন শেষ?
আমি যাইনি অন্য কাজ ছিল। বৌদি বিজুদা নেই?
আয় ভিতরে আয়। এইমাত্র বাথরুমে গেল।
রত্নাকর গ্রিল ঠেলে ভিতরে ঢুকল। একটা বেতের চেয়ার টেনে বসল। বেলাবৌদি বলল, বিজুদা এলে একসঙ্গে চা করবো।
বিজুদা আমাকে দেখা করতে বলেছিল। তুমি কিছু জানো কি ব্যাপার?
দিবাকর তোদের খোজ খবর নেয়না?
আসে তবে খুব কম। নিজের সংসার সামলে আসাও অনেক ঝামেলা।
তোর যে কি হবে তাই ভাবছি। বেলাবৌদি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে।
বিজুদা লুঙ্গি পরে তোয়ালে গায়ে এসে বসল। বেলাবৌদি উঠে চলে গেল। রতিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছিস?
রত্নাকর বুঝতে পারে এটা ভুমিকা। বিজুদা বলল, দিবাটা অনেক বদলে গেছে। রত্নাকর ভাবে তাহলে কি দাদার সম্পর্কে কিছু বলবে? বিজুদা জিজ্ঞেস করল, হ্যারে দিবা মাসীমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনা?
আসে খুব কম।
বেলাবৌদি তিনকাপ চা নিয়ে ঢুকল। বিজুদা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, বাড়ীটা দিবা প্রোমোটারকে দেবার চেষ্টা করছে জানিস?
রত্নাকর হাসল, এ আর নতুন কথা কি? বলল, এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে। মা বলে দিয়েছে বেঁচে থাকতে এবাড়ীতে কাউকে হাত দিতে দেবেনা।
ও এতদুর গড়িয়েছে? পরামর্শের জন্য এসেছিল আমার কাছে। বাড়ি মাসীমার নামে তোর কিছু করার নেই ওকে বলেছি। একটাই মুস্কিল চিরকাল তো কেউ থাকবেনা।
বিজুদা কি বলতে চায় বুঝতে অসুবিধে হয়না। মা না থাকলে দাদা তাকে বঞ্চিত করতে পারে? করলে করবে। চা শেষ করে বিজুদা বলল, বেলি আমি যাই, তুমি গল্প করো।
বেলাবৌদিকে বিজুদা বেলি বলে? বেলা বলতে অসুবিধে কোথায়? বেলাকে বেলি বললে আরো কাছের মনে হয় হয়তো। লক্ষ্য করছে বেলাবৌদি তাকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করছে। রত্নাকর বুঝেও রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
লেখকরা সব সময় কি ভাবে বলতো?
বেলাবৌদির প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকালো রতি। বলল, ভাবনা-চিন্তা হীন মস্তিষ্ক হয় না। লেখক কেন সবাই সব সময় কিছু না কিছু ভাবে।
যা জিজ্ঞেস করছি বুঝতে পারিস নি? সবাই কি একরকম ভাবে?
রত্নাকর হেসে ফেলে বলল, তুমি বলছো আমি কি ভাবি বা কেমনভাবে ভাবি? একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবে। ধরো তোমার সঙ্গে কথা বলছি, বলতে বলতে মনীষাবৌদির কথা ভাবি। কোথায় মিল কোথায় দুজনার অমিল বোঝার চেষ্টা করি।
তোর দাদার উপর রাগ হয়না?
রাগ হবে কেন বরং একটা কারণে কষ্ট হয়।
কষ্ট হয়?
দাদার একটা ছেলে আছে, শুনেছি সে নাকি এখন কলেজে যায়। অথচ তাকে একদিনও চোখে দেখিনি। সেও কি জানে তার একজন কাকু আছে? রত্নাকরের চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
যাদের এরকম চোখে জল এসে যায় তাদের মনটা খুব নরম।
তুমি তো সাইকোলজির ছাত্রী। নরম মন কি খারাপ?
মনটাকে শক্ত করতে হবে। নরম মনের মানুষরা সহজে অপরের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। মানুষ নরম মনের সুযোগ নেয়।
মন শক্ত করব কি করে? কোনো ওষুধ আছে নাকি?
বেলি একবার আসবে? ভিতর থেকে ডাক এল। বেলাবৌদি বলল, তোকে একটা বই দেবো। যোগ সাধনার বই, পড়ে দেখিস।
রত্নাকর কিছুক্ষন বসে বেরিয়ে পড়ল। পঞ্চাদার দোকানে যাবার ইচ্ছে নেই। কিছুক্ষন পর খেয়াল হয় অন্যপথে চলে এসেছে। পথ ভুল হোল কেন? কি ভাবছে সে মনে করার চেষ্টা করে। পিছন থেকে কে যেন ডাকছে মনে হল। পিছন ফিরে তাকাতে দেখল উমাদা হনহন করে আসছে। কাছে এসে বলল, কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাস না? এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
আসলে কি একটা যেন ভাবছিলাম তাই শুনতে পাইনি। তোমাদের কালেকশন শেষ?
হ্যা অনেক্ষন আগে। জাস্টিস আঙ্কেলের বাসায় গেছিলাম। বৌদি বলল, তোকে একটা বই দেবে, এসে দেখে তুই নেই, বলে আসবি তো?
রত্নাকর বোকার মত হাসল। উমাদা জিজ্ঞেস করে, তুই কখন এসেছিস?
আমি এসে বিজুদার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। উমানাথ লক্ষ্য করে রতি যেন কি ভাবছে। বিজুদার সঙ্গে কি কথা হয়েছে? খারাপ কিছু? বেলাবৌদি এই বইটা রতিকে দিল কেন?
উমাদা তোমার ছবিদিকে মনে আছে?
উমানাথের কানে নামটা যেতেই চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করে, কোন ছবিদি?
ওইযে রমেশদার দিদি?
চিন্তিতভাবে উমা বলল, ও হ্যা বাড়ী থেকে পালিয়ে গেছিল?
পালিয়ে গেছিল তুমি কি করে জানলে?
অত জানিনা, শুনেছি খারাপ লাইনে গেছে। উমা ভাবে এতদিন পর রতি ছবিদির কথা কেন তুলল? আড়চোখে রতিকে দেখে বইটা এগিয়ে দিয়ে বলল, বেলাবৌদি এটা তোকে দিতে বলেছে।
রতি বইটা হাতে নিয়ে দেখল, ইংরেজি বই-" How to control your mind", লেখক বিদেশী। পকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোটটা বের করে উমাদার হাতে দিয়ে বলল, ছবিদি ফাণ্ডে দিয়েছে।
উমানাথ তড়িদাহতের মত হাতটা সরিয়ে নিল। রতি অবাক গলায় বলে, কি হল?
ছবিদির টাকা? মানে তুই তো জানিস ছবিদি এখন খারাপ লাইনে নেমেছে?
টাকার কি দোষ? যত টাকা কালেকশন হয়েছে তুমি নিশ্চিত সব সৎপথে উপার্জিত? ছবিদির রক্ত জলকরা এই টাকা।
উমানাথ বিস্মিত চোখ মেলে রতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হেসে বলল, তোর সঙ্গে দেখা হোল কোথায়?
রতি বিস্তারিত বলল উমাদাকে। উমা বলল, আমার সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। আমি এড়িয়ে গেছি। তুই যা বললি এসব কিছুই জানতাম না। খুব অন্যায় হয়েছে ছবিদির উপর। শোন রতি এসব আর কাউকে বলবি না, তারা অন্য অর্থ করবে। কিন্তু আমি ভাবছি টাকাটা নিলে সবাই জানতে পারবে, ছবিদিকে নিয়ে বিচ্ছিরি আলোচনা শুরু হয়ে যাবে।
সেটা ঠিক বলেছো। মালতির নামে জমা করে নেও। ছবিদি এখন মালতি কেউ চিনতে পারবে না। রতি দেখল উমাদা কেমন অন্য মনস্ক, জিজ্ঞেস করে, কি ভাবছো?
উমানাথ হেসে বলল, ভাবছি তোর কথা। তুই আমার থেকে ছোটো কিন্তু তোর মন অনেক বড়। বৌদি ঠিক বলে।
কে বৌদি?
আমার বৌদি।
মনীষাবোদি আমাকে খুব ভালবাসে। কি বলছিল বৌদি?
তুই খুব আবেগ প্রবন, গতিবেগ মাত্রা ছাড়ালে নিয়ন্ত্রণ হারাবার সম্ভাবনা ভুলে যাস না।
বাড়ি ঢুকতে মনোরমা বলল, আমার পেটে কি করে এমন ছেলে জন্মালো তাই ভাবি? রত্নাকর ভাবে তাকে জন্ম দিয়ে মায়ের মনে আক্ষেপ? মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরক্ষণে মা বলল, মানুষ এত স্বার্থপর হয় কিভাবে বুঝিনা। এবার মনে হল মা হয়তো দাদার কথা ভেবে বলছে। মায়ের কাছে শুনল দাদা এসেছিল। ছেলে বড় হচ্ছে, ঘর দরকার। বাড়ীটা পুরানো হয়ে গেছে। এখন নতুন প্লানে বাড়ি হচ্ছে মাকে বুঝিয়েছে। নতুন প্লানে বাড়ী কর কে মানা করেছে? মা নাকি বলেছিল, রতির কথাটা ভাববি না? দাদা উত্তর দিয়েছে, তুমি এমনভাবে বলছো যেন আমার অঢেল রোজগার। তাছাড়া যখন ফ্লাট হবে ও সমান ভাগ পাবে।
ডায়েরী লিখতে বসে একটা প্রশ্ন প্রথমেই মনে হল। ছবিদি ইজ্জত বাচাবার জন্য ঘর ছেড়ে এপথে গেল কেন? এখন তাকে কতজনের মনোরঞ্জন করতে হচ্ছে। এমন কি সেই বৌদির ভাইয়ের সঙ্গেও মিলিত হয়েছে স্বেচ্ছায়। ছবিদির কাছে দেহের সুচিতার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল আত্মমর্যাদা প্রশ্ন। শ্বশুরবাড়ীতে আত্মমর্যাদা রক্ষা করে থাকা সম্ভব হয়নি। রত্নাকর কখনো এভাবে ভাবেনি। কত বিশাল ভাবনার জগত, যত জানছে পুরানো ধ্যান -ধারণা চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। পুথি পড়ে এসব শিক্ষা হয়না। যতদিন যাচ্ছে মনের অহংকার কর্পুরের মত উবে যাচ্ছে। কত কি জানার আছে কতটকুই বা জানে তার?

[২৩]

চ্যারিটি ফাউণ্ডেশন। নামটা জাস্টিস রমেন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর দেওয়া, সকলের পছন্দ। কেউ কেউ বলছিল বাংলা নাম হলে ভাল হত। রত্নাকর বলল, শব্দটা ইংরেজি হলেও চ্যারিটি বাংলায় ঢুকে গেছে। মনে করিয়ে দিল বাঙালী মাড়োয়ারী পাঞ্জাবী সবাইকে নিয়ে কমিটি হয়েছে। ডাক্তার শরদিন্দু ব্যানার্জি সবাইকে চমকে দিয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি সব মিটিং-এ থাকতে পারবেন না কিন্তু প্রতিদিনের একটি পেশেণ্টের ফিজ তিনি দান করবেন তহবিলে। জাস্টিস চৌধুরী সভাপতি এবং উমানাথ ঘোষ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হল। কেউ কেউ উমাদার সঙ্গে একজন মহিলাকে নিয়ে যুগ্ম সম্পাদকের কথা বললেও প্রস্তাবটি তেমন সাড়া পায়নি।
পরীক্ষা শেষ, ফল প্রকাশের অপেক্ষা। দিন কয়েক পরে রেজাল্ট বেরোবে শোনা যাচ্ছে। পঞ্চাদার দোকানে নিয়মিত আড্ডা চলছে। একদিন উমাদা আড়ালে ডেকে নিয়ে শ-পাচেক টাকা হাতে দিয়ে রতিকে বলল, স্যার বলেছে তোকে আর পড়াতে যেতে হবেনা।
রত্নাকর হতাশ দৃষ্টি মেলে তাকায়। উমাদা অপরাধীর গলায় বলল, শালা বড়লোকের খেয়াল। রতি তোকে আরও ভাল টিউশনির ব্যবস্থা করে দেব।
রত্নাকর মনে মনে হাসে। গুণে দেখল একশো টাকার পাঁচটা নোট, হেসে বলল, এতটাকা তো পাওনা নয়।
ছাড়তো, ওদের অনেক টাকা।
না উমাদা ওদের টাকা ওদেরই থাক। তুমি এই তিনশো টাকা ফিরিয়ে দিও।
উমানাথ ফ্যাসাদে পড়ে যায়, স্যারকে টাকাটা ফেরৎ দেবে কিভাবে? রতি ভীষণ জেদি একবার যখন বলেছে নেবেনা কিছুতেই নেবেনা। অগত্যা পকেটে রেখে দিল। রত্নাকর দোকানে এসে বসল। দাদা প্রায়ই এসে গোলমাল করছে, পাশ করলে কলেজের মাইনে দিতে হবে, এর মধ্যে টিউশনিটা চলে গেল। রোজ রাতে বুড়িমাগীটা ফোন করে তাগাদা দেয়। ভয়ে ঐ রাস্তা এড়িয়ে চলে। সমস্যার পর সমস্যা। মি.গুপ্ত ছাড়িয়ে দিল কেন? স্যাণ্ডি কিছু বলেছে মনে হয়না। তবে ওর মাসী রঞ্জনার হাবভাব কেমন যেন। সুদীপকে চুপচাপ দেখে রত্নাকর বলল, কিরে কি ভাবছিস?
সুদীপ হাসল, মুখে কিছু বলল না।
উমাদা বলল, আমি একটু অফিস থেকে ঘুরে আসি, রতি যাবি নাকি?
রত্নাকর বেরিয়ে পড়তে বঙ্কাও সঙ্গী হল। ফিসফিস করে বলল বঙ্কা, সুদীপ ঝামেলায় পড়ে গেছে। তনিমা বলেছে পাস নাকরলে আর দেখা হবেনা।
পাস করবেনা ধরে নিচ্ছে কেন?
পাস-ফেল কথা নয় আসলে তনিমা নাকি কেটে পড়ার অছিলা খুজছে।
রত্নাকর অবাক হয়। পাস-ফেলের সঙ্গে প্রেমের কি সম্পর্ক? সুদীপকে ছেড়ে একা একা খারাপ লাগবেনা? নাকি অন্য আরেকজন জুটিয়ে নেবে?
বিজুদা বড় রাস্তায় চেম্বার করেছে। আগে বাড়ীতেই ছিল। বিজুদার বাড়ীর চেম্বার এখন চ্যারিটি ফাউণ্ডেশনের অফিস। বেলা বৌদি চাবি খুলে দিয়ে বলল, রতি তুই এদিকে আয়।
উমাদা বঙ্কাকে নিয়ে অফিসে গিয়ে বসল। রত্নাকর বারান্দায় গিয়ে বসতে বেলাবৌদি জিজ্ঞেস করে, বইটা পড়ছিস?
রত্নাকর মেডিটেশন চ্যাপ্টারটা একটু পড়েছে, ভাল করে পড়ার সুযোগ হয়নি। ধ্যান সম্পর্কে নীরেনদার ক্লাসে কিছুটা শিখেছিল। বলল, সবে শুরু করেছি।
তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। সত্যি করে বলবি। কোনো বয়স্ক মহিলার সঙ্গে তোর পরিচয় আছে?
রত্নাকর চমকে ওঠে, ডেকে নিয়ে এসে এ কেমন প্রশ্ন? জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছো?
ঝরা পাতার কান্না গল্পটা পড়লাম। বেলাবৌদি বলল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রত্নাকর। ভীষণ চমকে গেছিল। গল্পটা ছাপা হয়েছে রত্নাকর জানেনা। আসলে নতুন লেখকদের বেশি পাত্তা দেয়না। ছেপেই কৃতার্থ করে। বেলাবৌদি অন্য কোনো কারণে নয় গল্পটা পড়ে মনে হয়েছে।
আচ্ছা রতি তুই অত কথা জানলি কি করে? তুই তো কারো সঙ্গে প্রেম করিস নি। মেয়েদের জানতে প্রেম করতে হবে? প্রেম করেও অনেকে তার প্রেমিকাকেও জেনে উঠতে পারে না। তাছাড়া বৌদি কোনো নির্দিষ্ট মহিলা নয়, নানা জনের সঙ্গে মিশে একটু-এক্টু করে নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে গল্পটা লিখেছি। রত্নাকরের কথায় কিছুটা সত্যির সঙ্গে মিথ্যের মিশেল আছে।
খুব অবাক লেগেছে। এই অল্প বয়সে এত কথা জানলি কি করে? বোস চা করে আনছি।
বেলাবৌদি চলে গেল। রত্নাকর ভাবে বৌদি তুমিও খুব সুখে নেই। একটা সন্তান থাকলে সেই ফাক হয়তো পূরণ হতো। বেলাবৌদি রতিকে এককাপ চা দিয়ে বলল, দেখে আয়তো কজন আছে?
আরও দু-জন এসেছে। বেলাবৌদি ট্রেতে চারকাপ চা দিয়ে বলল, ওদের দিয়ে আয়। রোজ রোজ দিতে পারবো না।
রত্নাকর চা দিয়ে ফিরে আসতে দেখল বৌদি একমনে চা-এর কাপ নিয়ে উদাস হয়ে বসে আছেন। রত্নাকর বলল, বৌদি চুপ করে কি ভাবছো?
তোর লেখাটা ভাল হয়েছে। তুই মানুষকে দেখে বোঝার চেষ্টা করিস?
সে তো সবাই করে। নতুন লোক দেখলে তুমি ভাবো না, কেমন হতে পারে লোকটা?
বেলাবৌদি হাসল। হাসিটা কেমন নিষ্প্রাণ মনে হল। বেলাবৌদির কি মন খারাপ?
আচ্ছা রতি আমাকে তোর কেমন মনে হয়?
তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগে।
তোর কেমন লাগে শুনতে চাইনি। তোর কি মনে হয় আমি খুব ভাল আছি?
রত্নাকর হোচট খায়, কি বলবে? বেলাবৌদি জিজ্ঞেস করে, কিরে বল?
দেখো বৌদি কৃত্রিম কেনা গাছে পাতা গজায় না। কিন্তু এমনি গাছে পাতা গজায় পাতা ঝরে ফুল হয় ফল হয়। জীবনও সেই রকম, প্রতিনিয়ত বদলে বদলে নিতে হয়।
বেলাবৌদি অপলক তাকিয়ে রতিকে দেখে। রত্নাকর বলল, যদি রাগ না করো তাহলে বলি।
রাগ করব কেন তুই বল।
বিয়ের পর তোমার মন যেমন ছিল এখনো তাই থাকবে আশা করা ভুল। বয়স বাড়ছে সময় বদলাচ্ছে আর মন একই রকম থাকবে তাকি হয়? বিজুদার বাবা কত বড় মানুষ অথচ সে তুলনায় সাধারণ উকিল বিজুদার মনে হতাশা আসতেই পারে। সংসারে নতুন অতিথি এলে না হয় তাকে নিয়ে মেতে থাকা যেতো।
বেলাবৌদির মুখ লাল হয়। ফিক করে হেসে বলল, তুই খুব ফোক্কড় হয়েছিস।
এইজন্যই বলতে চাইছিলাম না।
ঠিক আছে-ঠিক আছে। এসব আবার কাউকে বলতে যাস না। ওদিকে দেখ কি নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে।
নাগবাবু আর নরেশদা কি নিয়ে তর্ক শুরু করেছে। কিছুক্ষন শোনার পর বোঝা গেল, নাগবাবু বলছেন, অসম্মান অবহেলা মানুষকে বিপথে ঠেলে দেয়, নরেশদার বক্তব্য যে যেমন সে তেমন পথ বেছে নেয়। উমাদা ইশারায় নিষেধ করল, রতি যেন কোনো কথা না বলে। নিষেধ না করলেও রত্নাকর বড়দের কথায় কথা বলত না। নতুন গড়ে ওঠা চ্যারিটি ফাউণ্ডেশন শুরুতেই চিতপাত হয়ে যাবে। ছবিদির কথা মনে পড়ল। ছবিদির বড়দা এই নরেশদা।
বৌদির সঙ্গে এতক্ষণ কি গপ্পো করছিলি? উমাদা জিজ্ঞেস করল।
জানো উমাদা আমার গল্পটা ছাপা হয়েছে। বেলাবৌদি গল্পটা পড়েছে। পত্রিকা থেকে আমাকে কিছুই জানায়নি।
কি বলছিল বৌদি?
প্রশংসা করছিল, বৌদির ভাল লেগেছে।
উমাদা উদাসভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। বঙ্কা বলল, মেয়েদের মধ্যে লেখকের হেভি খাতির।
কি হচ্ছে কি আস্তে। উমাদা ধমক দিল বঙ্কাকে তারপর বলল, রতি তুই লেখাটা ছাড়িস না। যত ঝামেলা আসুক লেখালিখি চালিয়ে যাবি। উমাদা বলল।
উমাদার গলায় কষ্টের সুর। আমি জানি উমাদা আমাকে খুব ভালবাসে। আমার অবস্থার কথা ভেবেই কথাগুলো বলল।
সন্ধ্যবেলা টিভির খবর শুনেছেন? ঢুকতে ঢুকতে দেব আঙ্কল বললেন।
কোন খবরের কথা বলছেন? সবাই সজাগ হয়। নাগবাবু বললেন, সবাই সিরিয়াল নিয়ে বসে গেছে। খবর শুনব তার উপায় নেই।
ঠিক বলেছেন, টিভি-ই ছেলেমেয়েদের মাথাটা খেল।
কি খবর বলছিলেন? নরেশদা জিজ্ঞেস করে।
বিএ বিএসসি পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বের হবে কাল। মেয়েটা পরীক্ষা দিয়েছে, কি করবে কে জানে? চিন্তিত মুখে বললেন দেব আঙ্কল বললেন। নরেশদা নিষ্পৃহ, তার বাড়ীতে কেউ পরীক্ষা দেয়নি।
দেব আঙ্কলের মেয়ে রোজি। রত্নাকর আর বঙ্কা চোখাচুখি করে। দুজনেই পরীক্ষা দিয়েছে।
উমাদা আমি আসি। বঙ্কা চলে গেল।
আপনারা বসবেন? চাবিটা দিয়ে গেলাম। উমাদা চাবি টেবিলের উপর রেখে বলল, চল রতি।
উমানাথ রত্নাকর বেরিয়ে পড়ল। মুহূর্তে পরিবেশ বদলে গেল। পরীক্ষা খারাপ হয়নি তাহলেও এখন কেমন যেন লাগছে। মায়ের কথা ভেবে রত্নাকরের চিন্তা, তার থেকে মায়ের চিন্তা বেশি। চোখে জল চলে এল। পথে শুভর সঙ্গে দেখা হতে উমাদা বলল, শুনেছিস?
রেজাল্ট তো? হ্যা রোজি ফোন করেছিল। শুভ ফ্যাকাসে হেসে বলল।
চলে যাচ্ছিস?
হ্যা ভাল লাগছে না।
রত্নাকর মনে করার চেষ্টা করে পরীক্ষা কেমন দিয়েছিল। মনে করতে পারেনা, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। পাস করলে হাতি-ঘোড়া কিছু হবেনা কিন্তু মা খুশি হবে। মা ইদানীং চোখে কম দেখছে। কতদিন ভেবেছে চোখ দেখিয়ে চশমা করিয়ে দেবে। কিন্তু ভাবনাই সার কিছু করে উঠতে পারেনি।
খেতে বসে মাকে বলল, টিভিতে নাকি বলেছে, কাল রেজাল্ট বেরোবে।
কলেজে গিয়ে খোজ নিয়ে আয়।
সেতো যাবো। ভাবছি কি হবে?
ভাবার সময় ভাবতে হয়। এখন ভেবে কি হবে?
রাতে ডায়েরী নিয়ে বসতে স্যাণ্ডির কথা মনে পড়ল। ও বলেছিল গডের কাছে প্রেয়ার করেছে। মেয়েটার মধ্যে হিপোক্রাইসি নেই। যা বলার স্পষ্ট বলে দেয়। পাস করেছে শুনলে খুশি হবে। পর মুহূর্তে খেয়াল হয় ওর বাবা তাকে যেতে নিষেধ করেছে। স্যাণ্ডির সঙ্গে তার আর দেখা হবে না। মোবাইল বাজতে দেখল, জনা। বিরক্তিতে মিউট করে দিল। নিজেকে ভীষণ একা মনে হয়। স্যাণ্ডির সঙ্গে দেখা হবেনা এই ভেবে কি?
All the contents posted by me have been downloaded from the internet. Credit goes to the original uploaders. Anyone having any issues with pictures posted, please message for removal.
Like Reply


Messages In This Thread
RE: জীবনের অন্য পৃষ্ঠা - কামদেব - by stallionblack7 - 26-04-2019, 08:45 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)