26-04-2019, 08:24 PM
[১৬]
সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল। রাস্তায় এসে দেখল বাতি স্তম্ভে আলো জ্বলছে। দুপুর বেলা ঝলমলে রোদ ছিল, কখন সন্ধ্যে নেমেছে বুঝতেই পারেনি। উপর দিকে তাকালো না, হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে জনা। ফোন করছিল কে? মেয়েলি গলা, নাম বলল না, কে হতে পারে? পাড়ার পথ ধরল রত্নাকর। কিছুটা এগোতেই দেবযানী আণ্টি পথ আগলে জিজ্ঞেস করেন, হ্যারে রতি তুই কি বাস রাস্তা থেকে আসছিস?
হ্যা কেন?
না মানে তুই রোজিকে ওদিকে দেখলি?
রোজি? না ওকে তো দেখিনি। কেন আণ্টি?
না এমনি, ঠিক আছে তুই যা।
আণ্টি বাস রাস্তার দিকে চলে গেল। শুভর সঙ্গে কোথাও যায়নি তো? বিরক্ত হয় রত্নাকর, এত কি প্রেমের কথা যে এত রাত হয়ে যাবে। বাড়িতে চিন্তা হবে স্বাভাবিক। পঞ্চাদার দোকানে জমজমাট আড্ডা। বিষয় কালকের খাওয়া-দাওয়া। বঙ্কা খবর এনেছে, মেনু-ফ্রায়েড রাইস মাংস। শুভকে দেখে অবাক হল। বাইরে ডেকে শুভকে সবকথা বলল, রত্নাকর। শুভকে বেশ চিন্তিত মনে হল। শুভ বলল, তুই কাউকে বলিস না। আমি ঘুরে আসছি। মনে হল শুভ বাস রাস্তার দিকে গেল।
রোজির উপর খুব ঝামেলা হচ্ছে। কিছু করে ফেলা বিচিত্র নয়। তাকে তো কিছু বলেনি। শুভর হাত পা ঘামতে শুরু করল। কোথায় যেতে পারে? একবার কোচিং ঘুরে গেলে হয়। রাস্তার স্বল্প আলোয় দুটো মেয়েকে আসতে দেখে শুভ এগিয়ে যায়, হ্যা রোজিই তো। শুভকে দেখে রোজি বলল, না এখন না।
কোথায় গেছিলে তুমি? আণ্টি খুজতে বেরিয়েছেন।
কে মা? বিশ্বাস করো, বীনাদের বাসায় গেছিলাম। এ্যাই ঝর্ণা বলনা?
হ্যা আমরা কোচিং থেকে বীনাদের বাসায় গেছিলাম। ঝর্ণা বলল।
আমাকে বলে কি হবে আণ্টিকে বলো। রতির কাছে শুনে উফস কি ভয় পেয়ে গেছিলাম।
রতি তোমাকে বলেছে? কি মিথ্যে কথা বলে। এ্যাই ঝর্ণা রতির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে তুই বল? রোজি বলল।
আচ্ছা ঠিক আছে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। ঝর্ণাকে নিয়ে যাও, আণ্টিকে বলবে কোথায় গেছিলে? এত রাতে বীনাদের বাসায় কি দরকার? তোমার একটা আক্কেল নেই?
রোজি মনে মনে হাসে নিজে যখন দেরী করাও তখন আক্কেলের কথা মনে থাকেনা? শুভ যেন ধড়ে প্রাণ পায়। পানের দোকান থেকে সিগারেট কিনে সবে ধরিয়েছে দেখল হনহনিয়ে দেবযানী আণ্টি আসছেন। সুট করে দোকানের আড়ালে চলে যায়। ভালই হল পথেই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।
শুভর সঙ্গে যায়নি তাহলে কোথায় যেতে পারে রোজি? কথাটা নিয়ে রতি মনে মনে নাড়াচাড়া করে। আজকের দিনটাই খারাপ।
এত দেরী করলি কোথাও গেছিলি? সুবীর জিজ্ঞেস করল।
কে যে কোথায় ছিপ ফেলে বসে আছে কে জানে? বঙ্কা বলল।
তোর সব জানার কি দরকার বাপু? সুবীর বলল।
কোথাও না, বাস রাস্তার দিকে গেছিলাম।
শুভ কোথায় গেলরে?
কি জানি, বলল আসছি।
তোরই বা সব কথায় দরকার কি? বঙ্কা বলল।
তুই কিন্তু তখন থেকে ভাট বকছিস? সুবীর বলল।
এই তোরা কি আরম্ভ করলি? হিমেশ থামাতে চেষ্টা করে।
উমানাথ ঢুকতে সমীর বলল, কি বাজার শেষ?
দেখেছো শুভর কি সাহস? পাড়ার মধ্যে ফুকছে। বঙ্কা বলল।
সবাই তাকিয়ে দেখল শুভ সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আসছে। সিগারেট ফেলে দিয়ে শুভ দোকানে ঢুকে বসল। রতি ওর দিকে তাকালো, সবার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করলনা। চোখমুখ দেখে মনে হোল উদবেগের কিছু নেই।
তোর খুব উন্নতি হয়েছে। উমাদা বলল।
কেউ দেখেনি। শুভ বলল।
বাসায় ফিরতে মনোরমা বললেন, সারাদিন কোথায় থাকিস? একদিন এসে দেখবি।
বাসায় কেউ নেই? মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি পারবে আমায় ছেড়ে চলে যেতে?
ছাড় ছাড় বাড়ি ফিরে মায়ের কথা মনে পড়ে? হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়।
শোবার আগে ডায়েরী নিয়ে বসল রত্নাকর। উত্তেজনায় মানুষ হিতাহিত বাস্তব বোধ হারিয়ে ফেলে। বীর্যস্খলনের পর সব কেমন বিস্বাদ লাগে। জনার বয়স হয়েছে শরীর ভেঙ্গেছে, যৌবনের সেই রঙ চটে জৌলুস হারিয়েছে কিন্তু স্তিমিত কামাগ্নি কোথাও ধিকিধকি জ্বলছে। মিলিটারি আণ্টি এখনো সন্তানের জন্ম দিতে পারে, জীবনের মধ্য গগণে বলা যায়। একটা গল্পের প্লট মনে এল, ঝরা পাতার কান্না। কেমন হবে জানিনা, পরীক্ষার পর লিখে পাঠিয়ে দেব। কাল সল্ট লেকে যেতে হবে। দুশ্চিন্তা আছে ট্যুইশনিটা টিকবে কিনা? উমাদার প্রেস্টিজের ব্যাপার জড়িয়ে আছে। মি.গুপ্ত উমাদার বস। কিছু হলে নিশ্চয়ই উমাদাকে বলবে। ফোন বেজে উঠল, তাকিয়ে দেখল জনা। সাইলেন্স করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। বুড়ীমাগীর ধ্যাস্টামো ভাল লাগেনা। শুয়ে পড়ল রত্নাকর।
সকাল হতেই শুরু হয় ব্যস্ততা। মনোরমা জিজ্ঞেস করলেন, কখন বেরোবি?
মনে মনে হিসেব করে রত্নাকর বলল, একটা-দেড়টা নাগাদ বেরবো ভাবছি।
নিজের পরীক্ষার কথা ভুলে যাসনা। তোকে মনে হচ্ছে কে ডাকছে?
বারান্দায় গিয়ে দেখল শুভ দাঁড়িয়ে আছে। রত্নাকর উপরে আসতে বলে। শুভ হঠাৎ সাত সকালে কেন? মুখ দেখে মনে হলনা খারাপ কিছু। ঘরে এনে বসালো।
কোচিং থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর বাসায় গেছিল। খুব ধমকে দিয়েছি। শুভ বলল।
একথা বলতে তুই এসেছিস?
না তা নয় উমাদা বলেছিল চিংড়ি মাছ এনে দিতে। বৌদিকে দিয়ে এলাম। পঞ্চাদার দোকানে কেউ নেই ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই।
মনোরমা চা নিয়ে ঢুকলেন। শুভ বলল, মাসীমা ভাল আছেন?
এই আছি একরকম। তোমার মা ভাল আছেন?
আর বলবেন না। সারাদিন খ্যাচ খ্যাচপড় পড় বলুন ভাল লাগে?
যখন খ্যাচ-খ্যাচ করার কেউ থাকবেনা সেদিন খ্যাচ-খ্যাচ শুনতে না পেলেই আবার খারাপ লাগবে।
শুভ ফ্যাকাশে হাসে। মনোরমা চলে যেতে ঘরটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। চা শেষ করে শুভ বলল, আমি যাইরে। বাড়ীতে মা এখন একা রয়েছে।
বেলা একটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে রত্নাকর। ভাগ্য ভাল বাসে উঠতে একজন সিট ছেড়ে ওঠার উদ্যোগ করছে। রত্নাকর ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ে। যাক বাবা আজ আর কেউ টানাটানি করবে না। বাস যত এগিয়ে চলেছে স্যাণ্ডির কথা মনে পড়ছে আর বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। তিন তলায় উঠে কলিং বেল টিপতে সেই মহিলা দরজা খুলে একটা ঘর দেখিয়ে দিল। রত্নাকর দেখে বুঝতে পারে এটাই স্যাণ্ডির পড়ার ঘর। দরজায় শব্দ হতে দেখল একমুখ হাসি নিয়ে স্যাণ্ডি দাড়িয়ে, চোখাচুখি হতে বলল, ইউ আর টুউ ইয়াং, আই কান্ট টেল ইউ স্যার মি.সোম।
এ্যাজ ইউ লাইক।
একটা টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল। রত্নাকর ব্যাগ থেকে দ্বিতীয়ভাগ বের করে বলল, তুমি পড়ার চেষ্টা করো। অসুবিধে হলে বলবে।
স্যাণ্ডি মনোযোগ দিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। দ্বিতীয় ভাগে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা শব্দ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ দিস?
রত্নাকর শব্দটা উচ্চারণ করতে সন্দীপা জিজ্ঞেস করে, মিনিং?
আকাঙ্ক্ষা মানে ইচ্ছে।
ওহ গড! বেঙ্গলি ইজ ভেরি টাফ। নাক কুচকে বলল সন্দীপা।
মনীষা বৌদির কথা মনে পড়ল, প্রেম থাকলেই আগ্রহ জাগে। রত্নাকর বলল, একটা কবিতা শুনবে?
পোয়েম? ওকে ফাইন।
রত্নাকর আবেগ দিয়ে আবৃত্তি করে,
বাঁকা চাঁদ জেগে রবে নদীটির জল
বাঙালী মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধুষর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে।
মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে সন্দীপা বলল, ভেরি নাইস। উড ইউ মাইণ্ড ইফ আই টেল ইউ তুমি?
নো প্রব্লেম। তোমাকে একটা অনুরোধ করি?
ওহ সিয়োর।
বাংলা শেখার সময় আমরা শুধু বাংলা বলব, রাজি?
তোমার আকাঙ্ক্ষায় সম্মত।
মনে মনে হাসে রত্নাকর। একটু আগে শেখা 'আকাঙ্ক্ষা' শব্দটা প্রয়োগ করেছে।
ভুল বলেছি?
ঠিক বলেছো। তবে তোমার ইচ্ছে মেনে নিলাম বললে আরও ভাল হত।
গ্রাজুয়ালি আই মিন ধীরে ধীরে হবে। পোয়েমটা বলো। বুঝতে না পারলেও একটা মিউজিক্ আছে মনকে নাড়া দেয়।
দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়েছে চিতা
বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে।
সোম তুমি সুন্দর করে বলতে পারো।
এটা জীবনানন্দের কবিতার লাইন।
সব কথা বুঝতে পারি নি কিন্তু মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। বাংলাটা ভাল করে শেখা হলে কবির একটা বই আমাকে দেবে?
সেই ভদ্রমহিলা চা নিয়ে ঢুকলেন। সন্দীপা বলল, আণ্টি বোসো। সোম দিস ইজ মাই আণ্টি, রঞ্জনা সেন।
মহিলা মৃদু হাসলেন। বসে বললেন, রাগিনীর সঙ্গে তোমার কিভাবে আলাপ?
রত্নাকর ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কার কথা বলছেন?
সেদিন যে আপনাকে পৌছে দিয়েছিল।
রত্নাকর কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, ওহ মনে পড়েছে। রাস্তায় ভদ্রমহিলাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম, উনি দেখিয়ে দিলেন। সব কথা রত্নাকর বলল না।
আমার কথা কিছু বলেছে?
ওর সঙ্গে বেশি কথা হয়নি।
রঞ্জনা চলে গেলেন। স্যাণ্ডি মন দিয়ে পড়ছে। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে আছে রতি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। এক সময় বই থেকে মুখ তুলে স্যাণ্ডি বলল, সোম আরেকটা কবিতা বলবে?
রত্নাকর শুরু করে,
সন্ধ্যা হয়চারদিকে শান্ত নীরবতা
খড় মুখে নিয়ে এক শালিক যেতেছে উড়ে চুপে
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠোপথ বেয়ে ধীরে ধীরে
আঙ্গিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তুপে
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে-আকাশে।
স্যাণ্ডি অবাক হয়ে রত্নাকরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্বস্তি বোধ করে রত্নাকর। স্যাণ্ডি হেসে বলল, সোম ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং তোমাকে খুব ভাল লেগেছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
কেন করবে না? বলো।
প্রেম সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
রত্নাকর দেখল স্যাণ্ডী বেশ চিন্তিত। হাতে সময় কম, কি বলবে বুঝতে পারেনা। বাংলা আলোচনা করতে করতে বাংলা শিখবে। রত্নাকর বলল, প্রেম ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। আজ অনেক সময় হল। পরে আরেকদিন আলোচনা করব আমরা?
স্যরি আমি খেয়াল করিনি।
স্যাণ্ডি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, ইউ আর ডিফারেণ্ট নট আ টিপিক্যাল টিচার।
আরেকটু আগে বেরনো উচিত ছিল। উমাদা বিরক্ত হয়তো হবে।
সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল। রাস্তায় এসে দেখল বাতি স্তম্ভে আলো জ্বলছে। দুপুর বেলা ঝলমলে রোদ ছিল, কখন সন্ধ্যে নেমেছে বুঝতেই পারেনি। উপর দিকে তাকালো না, হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে জনা। ফোন করছিল কে? মেয়েলি গলা, নাম বলল না, কে হতে পারে? পাড়ার পথ ধরল রত্নাকর। কিছুটা এগোতেই দেবযানী আণ্টি পথ আগলে জিজ্ঞেস করেন, হ্যারে রতি তুই কি বাস রাস্তা থেকে আসছিস?
হ্যা কেন?
না মানে তুই রোজিকে ওদিকে দেখলি?
রোজি? না ওকে তো দেখিনি। কেন আণ্টি?
না এমনি, ঠিক আছে তুই যা।
আণ্টি বাস রাস্তার দিকে চলে গেল। শুভর সঙ্গে কোথাও যায়নি তো? বিরক্ত হয় রত্নাকর, এত কি প্রেমের কথা যে এত রাত হয়ে যাবে। বাড়িতে চিন্তা হবে স্বাভাবিক। পঞ্চাদার দোকানে জমজমাট আড্ডা। বিষয় কালকের খাওয়া-দাওয়া। বঙ্কা খবর এনেছে, মেনু-ফ্রায়েড রাইস মাংস। শুভকে দেখে অবাক হল। বাইরে ডেকে শুভকে সবকথা বলল, রত্নাকর। শুভকে বেশ চিন্তিত মনে হল। শুভ বলল, তুই কাউকে বলিস না। আমি ঘুরে আসছি। মনে হল শুভ বাস রাস্তার দিকে গেল।
রোজির উপর খুব ঝামেলা হচ্ছে। কিছু করে ফেলা বিচিত্র নয়। তাকে তো কিছু বলেনি। শুভর হাত পা ঘামতে শুরু করল। কোথায় যেতে পারে? একবার কোচিং ঘুরে গেলে হয়। রাস্তার স্বল্প আলোয় দুটো মেয়েকে আসতে দেখে শুভ এগিয়ে যায়, হ্যা রোজিই তো। শুভকে দেখে রোজি বলল, না এখন না।
কোথায় গেছিলে তুমি? আণ্টি খুজতে বেরিয়েছেন।
কে মা? বিশ্বাস করো, বীনাদের বাসায় গেছিলাম। এ্যাই ঝর্ণা বলনা?
হ্যা আমরা কোচিং থেকে বীনাদের বাসায় গেছিলাম। ঝর্ণা বলল।
আমাকে বলে কি হবে আণ্টিকে বলো। রতির কাছে শুনে উফস কি ভয় পেয়ে গেছিলাম।
রতি তোমাকে বলেছে? কি মিথ্যে কথা বলে। এ্যাই ঝর্ণা রতির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে তুই বল? রোজি বলল।
আচ্ছা ঠিক আছে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। ঝর্ণাকে নিয়ে যাও, আণ্টিকে বলবে কোথায় গেছিলে? এত রাতে বীনাদের বাসায় কি দরকার? তোমার একটা আক্কেল নেই?
রোজি মনে মনে হাসে নিজে যখন দেরী করাও তখন আক্কেলের কথা মনে থাকেনা? শুভ যেন ধড়ে প্রাণ পায়। পানের দোকান থেকে সিগারেট কিনে সবে ধরিয়েছে দেখল হনহনিয়ে দেবযানী আণ্টি আসছেন। সুট করে দোকানের আড়ালে চলে যায়। ভালই হল পথেই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।
শুভর সঙ্গে যায়নি তাহলে কোথায় যেতে পারে রোজি? কথাটা নিয়ে রতি মনে মনে নাড়াচাড়া করে। আজকের দিনটাই খারাপ।
এত দেরী করলি কোথাও গেছিলি? সুবীর জিজ্ঞেস করল।
কে যে কোথায় ছিপ ফেলে বসে আছে কে জানে? বঙ্কা বলল।
তোর সব জানার কি দরকার বাপু? সুবীর বলল।
কোথাও না, বাস রাস্তার দিকে গেছিলাম।
শুভ কোথায় গেলরে?
কি জানি, বলল আসছি।
তোরই বা সব কথায় দরকার কি? বঙ্কা বলল।
তুই কিন্তু তখন থেকে ভাট বকছিস? সুবীর বলল।
এই তোরা কি আরম্ভ করলি? হিমেশ থামাতে চেষ্টা করে।
উমানাথ ঢুকতে সমীর বলল, কি বাজার শেষ?
দেখেছো শুভর কি সাহস? পাড়ার মধ্যে ফুকছে। বঙ্কা বলল।
সবাই তাকিয়ে দেখল শুভ সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আসছে। সিগারেট ফেলে দিয়ে শুভ দোকানে ঢুকে বসল। রতি ওর দিকে তাকালো, সবার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করলনা। চোখমুখ দেখে মনে হোল উদবেগের কিছু নেই।
তোর খুব উন্নতি হয়েছে। উমাদা বলল।
কেউ দেখেনি। শুভ বলল।
বাসায় ফিরতে মনোরমা বললেন, সারাদিন কোথায় থাকিস? একদিন এসে দেখবি।
বাসায় কেউ নেই? মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি পারবে আমায় ছেড়ে চলে যেতে?
ছাড় ছাড় বাড়ি ফিরে মায়ের কথা মনে পড়ে? হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়।
শোবার আগে ডায়েরী নিয়ে বসল রত্নাকর। উত্তেজনায় মানুষ হিতাহিত বাস্তব বোধ হারিয়ে ফেলে। বীর্যস্খলনের পর সব কেমন বিস্বাদ লাগে। জনার বয়স হয়েছে শরীর ভেঙ্গেছে, যৌবনের সেই রঙ চটে জৌলুস হারিয়েছে কিন্তু স্তিমিত কামাগ্নি কোথাও ধিকিধকি জ্বলছে। মিলিটারি আণ্টি এখনো সন্তানের জন্ম দিতে পারে, জীবনের মধ্য গগণে বলা যায়। একটা গল্পের প্লট মনে এল, ঝরা পাতার কান্না। কেমন হবে জানিনা, পরীক্ষার পর লিখে পাঠিয়ে দেব। কাল সল্ট লেকে যেতে হবে। দুশ্চিন্তা আছে ট্যুইশনিটা টিকবে কিনা? উমাদার প্রেস্টিজের ব্যাপার জড়িয়ে আছে। মি.গুপ্ত উমাদার বস। কিছু হলে নিশ্চয়ই উমাদাকে বলবে। ফোন বেজে উঠল, তাকিয়ে দেখল জনা। সাইলেন্স করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। বুড়ীমাগীর ধ্যাস্টামো ভাল লাগেনা। শুয়ে পড়ল রত্নাকর।
সকাল হতেই শুরু হয় ব্যস্ততা। মনোরমা জিজ্ঞেস করলেন, কখন বেরোবি?
মনে মনে হিসেব করে রত্নাকর বলল, একটা-দেড়টা নাগাদ বেরবো ভাবছি।
নিজের পরীক্ষার কথা ভুলে যাসনা। তোকে মনে হচ্ছে কে ডাকছে?
বারান্দায় গিয়ে দেখল শুভ দাঁড়িয়ে আছে। রত্নাকর উপরে আসতে বলে। শুভ হঠাৎ সাত সকালে কেন? মুখ দেখে মনে হলনা খারাপ কিছু। ঘরে এনে বসালো।
কোচিং থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর বাসায় গেছিল। খুব ধমকে দিয়েছি। শুভ বলল।
একথা বলতে তুই এসেছিস?
না তা নয় উমাদা বলেছিল চিংড়ি মাছ এনে দিতে। বৌদিকে দিয়ে এলাম। পঞ্চাদার দোকানে কেউ নেই ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই।
মনোরমা চা নিয়ে ঢুকলেন। শুভ বলল, মাসীমা ভাল আছেন?
এই আছি একরকম। তোমার মা ভাল আছেন?
আর বলবেন না। সারাদিন খ্যাচ খ্যাচপড় পড় বলুন ভাল লাগে?
যখন খ্যাচ-খ্যাচ করার কেউ থাকবেনা সেদিন খ্যাচ-খ্যাচ শুনতে না পেলেই আবার খারাপ লাগবে।
শুভ ফ্যাকাশে হাসে। মনোরমা চলে যেতে ঘরটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। চা শেষ করে শুভ বলল, আমি যাইরে। বাড়ীতে মা এখন একা রয়েছে।
বেলা একটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে রত্নাকর। ভাগ্য ভাল বাসে উঠতে একজন সিট ছেড়ে ওঠার উদ্যোগ করছে। রত্নাকর ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ে। যাক বাবা আজ আর কেউ টানাটানি করবে না। বাস যত এগিয়ে চলেছে স্যাণ্ডির কথা মনে পড়ছে আর বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। তিন তলায় উঠে কলিং বেল টিপতে সেই মহিলা দরজা খুলে একটা ঘর দেখিয়ে দিল। রত্নাকর দেখে বুঝতে পারে এটাই স্যাণ্ডির পড়ার ঘর। দরজায় শব্দ হতে দেখল একমুখ হাসি নিয়ে স্যাণ্ডি দাড়িয়ে, চোখাচুখি হতে বলল, ইউ আর টুউ ইয়াং, আই কান্ট টেল ইউ স্যার মি.সোম।
এ্যাজ ইউ লাইক।
একটা টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল। রত্নাকর ব্যাগ থেকে দ্বিতীয়ভাগ বের করে বলল, তুমি পড়ার চেষ্টা করো। অসুবিধে হলে বলবে।
স্যাণ্ডি মনোযোগ দিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। দ্বিতীয় ভাগে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা শব্দ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ দিস?
রত্নাকর শব্দটা উচ্চারণ করতে সন্দীপা জিজ্ঞেস করে, মিনিং?
আকাঙ্ক্ষা মানে ইচ্ছে।
ওহ গড! বেঙ্গলি ইজ ভেরি টাফ। নাক কুচকে বলল সন্দীপা।
মনীষা বৌদির কথা মনে পড়ল, প্রেম থাকলেই আগ্রহ জাগে। রত্নাকর বলল, একটা কবিতা শুনবে?
পোয়েম? ওকে ফাইন।
রত্নাকর আবেগ দিয়ে আবৃত্তি করে,
বাঁকা চাঁদ জেগে রবে নদীটির জল
বাঙালী মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধুষর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে।
মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে সন্দীপা বলল, ভেরি নাইস। উড ইউ মাইণ্ড ইফ আই টেল ইউ তুমি?
নো প্রব্লেম। তোমাকে একটা অনুরোধ করি?
ওহ সিয়োর।
বাংলা শেখার সময় আমরা শুধু বাংলা বলব, রাজি?
তোমার আকাঙ্ক্ষায় সম্মত।
মনে মনে হাসে রত্নাকর। একটু আগে শেখা 'আকাঙ্ক্ষা' শব্দটা প্রয়োগ করেছে।
ভুল বলেছি?
ঠিক বলেছো। তবে তোমার ইচ্ছে মেনে নিলাম বললে আরও ভাল হত।
গ্রাজুয়ালি আই মিন ধীরে ধীরে হবে। পোয়েমটা বলো। বুঝতে না পারলেও একটা মিউজিক্ আছে মনকে নাড়া দেয়।
দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়েছে চিতা
বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে।
সোম তুমি সুন্দর করে বলতে পারো।
এটা জীবনানন্দের কবিতার লাইন।
সব কথা বুঝতে পারি নি কিন্তু মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। বাংলাটা ভাল করে শেখা হলে কবির একটা বই আমাকে দেবে?
সেই ভদ্রমহিলা চা নিয়ে ঢুকলেন। সন্দীপা বলল, আণ্টি বোসো। সোম দিস ইজ মাই আণ্টি, রঞ্জনা সেন।
মহিলা মৃদু হাসলেন। বসে বললেন, রাগিনীর সঙ্গে তোমার কিভাবে আলাপ?
রত্নাকর ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কার কথা বলছেন?
সেদিন যে আপনাকে পৌছে দিয়েছিল।
রত্নাকর কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, ওহ মনে পড়েছে। রাস্তায় ভদ্রমহিলাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম, উনি দেখিয়ে দিলেন। সব কথা রত্নাকর বলল না।
আমার কথা কিছু বলেছে?
ওর সঙ্গে বেশি কথা হয়নি।
রঞ্জনা চলে গেলেন। স্যাণ্ডি মন দিয়ে পড়ছে। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে আছে রতি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। এক সময় বই থেকে মুখ তুলে স্যাণ্ডি বলল, সোম আরেকটা কবিতা বলবে?
রত্নাকর শুরু করে,
সন্ধ্যা হয়চারদিকে শান্ত নীরবতা
খড় মুখে নিয়ে এক শালিক যেতেছে উড়ে চুপে
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠোপথ বেয়ে ধীরে ধীরে
আঙ্গিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তুপে
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে-আকাশে।
স্যাণ্ডি অবাক হয়ে রত্নাকরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্বস্তি বোধ করে রত্নাকর। স্যাণ্ডি হেসে বলল, সোম ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং তোমাকে খুব ভাল লেগেছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
কেন করবে না? বলো।
প্রেম সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
রত্নাকর দেখল স্যাণ্ডী বেশ চিন্তিত। হাতে সময় কম, কি বলবে বুঝতে পারেনা। বাংলা আলোচনা করতে করতে বাংলা শিখবে। রত্নাকর বলল, প্রেম ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। আজ অনেক সময় হল। পরে আরেকদিন আলোচনা করব আমরা?
স্যরি আমি খেয়াল করিনি।
স্যাণ্ডি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, ইউ আর ডিফারেণ্ট নট আ টিপিক্যাল টিচার।
আরেকটু আগে বেরনো উচিত ছিল। উমাদা বিরক্ত হয়তো হবে।
All the contents posted by me have been downloaded from the internet. Credit goes to the original uploaders. Anyone having any issues with pictures posted, please message for removal.