19-10-2021, 06:02 PM
ধীরে এগিয়ে গেছে পার্থ সামনের ইটে বাঁধানো বড়ো উঠনের মাঝখানে শুইয়ে রাখা কর্ণ স্যারের মৃত দেহের দিকে । চোখের উপর দুটো ভিজে তুলসি পাতা , নাকে তুলো গোজা । সেই অমায়িক চেহারার অধিকারী সুপুরুষ ব্যক্তির এক কালচে শীর্ণ দেহ , পার্থর সামনে । কিছু প্রশ্নের সমাধান তখনও হয়নি , তবু পার্থ আসার কিছুক্ষনের মধ্যেই মৃতদেহ নিয়ে শশ্বানের দিকে যাত্রা শুরু হলো । পথেই লোকে মুখে কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলো পার্থ ।
পার্থ ঠিকই খবর পেয়েছিলো , কর্ণ স্যার বিয়ে করেছেন , এমন কি এও জানতে পারলো সে , স্যারের একটি মেয়েও ছিলো তার নাম সাঁঝবাতি । বছর চারেক আগে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে , সাঁঝবাতির বিয়ে দিয়েছিলেন কর্ণ বাবু । তার বছর খানেক পরে সাঁঝবাতি আরেকটি ফুটফুটে সাঁঝবাতির জন্ম দেয় , কিন্তু সেটি মেনে নিতে পারেনি তার শশুর বাড়ির লোক ,শুরু করে তার উপর অত্যাচার , শেষে আর অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সাঁঝবাতি । পড়ে থাকে তার ফুটফুটে মেয়েটি । কর্ণ বাবু নাতনিকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে । তার মাস ছয়েক পর তার স্ত্রীও দেহ রাখেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে । তারপর জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে , নিজের বর্ধমানের সব ভিটে মাটি বিক্রি করে , এসে ওঠেন নিজের কলেজের পাশের এই বৈকুন্টপুর ভারত সেবাশ্রমে । চাকরি সূত্রে এই বৈকন্টপুরে তার পরিচিত লোকের অভাব নেই ...
কলেজে পড়ানোর সময় থেকেই এই আশ্রমের প্রধান পুরোহিতের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ত্ব , সেই সুবাদে নিজের সমস্ত শেষ বয়সের সম্বল আশ্রমকে দান করে দিয়ে , দাদু নাতনি এখানেই থাকা শুরু করেছিলেন । মাস তিনেক আগে থেকেই শরীর হঠাৎই ভাঙতে শুরু করে কর্ণ বাবুর । তারপর ধীরে ধীরে আজ এই পরিণতি । শশ্বানের মাটিতে দাঁড়িয়েই একটা কথা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিলো পার্থকে । তবে কি স্যার এই নাতনির দায়িত্ব নিতেই তাকে ডেকে পাঠালেন ?
আশ্রমে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো , তারপর স্নান সেরে , আশ্রমের বারান্দায় বসলো পার্থ । পাশে এসে বসলো বিশ্বরূপ । একটা দুটো কথা হচ্ছিলো তার সাথে , কথার মূল বিষয় বলতে পুরোনো স্মৃতির পাতা উল্টে পাল্টে দেখা । কিন্তু চোখটা এদিক ওদিক খুঁজেছিলো পার্থর , ওই বাচ্চা মেয়েটিকে । কিছুক্ষন পরে আশ্রমের ওই মূল পুরোহিত , হাতে একটা সাদা খাম নিয়ে এগিয়ে এলেন পার্থর দিকে । আঠা দিয়ে আটকানো খামটা পার্থর হাতে দিয়ে উনি বললেন ....
- কর্ণ বাবু আপনাকে এটা দিতে বলে গিয়েছেন । আমাদের কারোর এই চিঠি খোলার অনুমতি নেই । বলেছিলেন , আপনি যদি তার মুখাগ্নি করতে আসেন , তাহলে যেন এটা আপনার হাতে এটি তুলে দেওয়া হয় ।
খামের একপাশ খুলে চিঠিটা বার করলো পার্থ , সেই জেল পেনের কালির গন্ধ । ঠিক যেমনটা পার্থ পেতো তার কলেজের অঙ্ক খাতা গুলি থেকে , এ যেন কর্ণ স্যারের শরীরের গন্ধ । চিঠিটা পড়তে শুরু করলো পার্থ ...
প্রিয় অর্জুন ,
হ্যাঁ ভুল পড়িসনি , পার্থ নয় তুইই অর্জুন । পার্থর অপর নামইতো অর্জুন । অর্জুন নামের কোনো ছাত্র আমার ছিলো না , ছিলো একটি মাত্র পার্থ । যাকে অর্জুন বানানোর সংকল্প নিয়েছিলাম আমি তোর মাধ্যমে । সব অঙ্কের হিসেব জীবনে মেলে না জানিস ? আমারটাও মেলেনি । এতক্ষনে হয়তো সবটাই জেনেছিস । জেনেছিস আমার নাতনি ঝিলমিলের কথাও , হয়তো ভাবছিস ঝিলমিলের দায়িত্ত্ব নেবার জন্য তোকে ডেকে পাঠিয়েছি । নারে তা নয় , ও ওই আশ্রমেই বড়ো হবে , তার সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে রেখে এসেছি । তবু চিন্তা হয় , আমি ছাড়া আর কেউই নেই ওই খুদে প্রাণটার । আমি চলে গেলে কে কিভাবে রাখবে ? মানুষ কে বদলে যেতে দেখেছি রাতারাতি । তাই ভরসা হয় না , তাছাড়া আশ্রমের গোসাইএরও বয়স হয়েছে । সেই বা কতদিন ? তোকে শুধু এইটুকু কাজ দিলাম মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পারলে বৈকন্টপুর আসিস , মেয়েটাকে একটু দেখে যাস । নিজের ছেলে বলতে কেউই নেই আমার , শেষ বয়সে এসেও তাও ছেলের হাতে মুখাগ্নির লোভটা এই ', সন্তান কর্ণ চক্রবর্তী ত্যাগ করতে পারলো না । তাই তোকে ডেকে পাঠালাম । বৃদ্ধ মাস্টারের পাগলামি ভেবেই মেনে নিস , এক সময় তোদের কত পাগলামিতো আমি মুখ বুজে সয়েছি । খুব ইচ্ছে ছিলো জীবনে বিজ্ঞানী হবো, জানিস ? কোনোদিন কাউকে বলিনি , এই তোকে আজ বললাম । পারিনি হতে , কিন্তু চেয়েছিলাম নিজে হতে না পারলেও একখানি বিজ্ঞানী রেখে যাবো এই পৃথিবীতে । তারপর যেদিন বাজারে গিয়ে শুনলাম তুই বিজ্ঞানী হয়েছিস , বাজারের মধ্যে এই বুড়ো হাঁটুতে লাফিয়ে উঠে , হাঁটুতে চোট নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি এসেছিলাম সেদিন । গিন্নি কি বকা বকিই করেছিলেন । যাইহোক , বলতে গেলে সে অনেক কথা , ইচ্ছে ছিলো শেষ কালে একদিন তোকে পেলে , জমিয়ে গপ্পো দেবো , যাক সেসব হয়তো আর হবে না । ভালো থাকিস , ঝিলমিলটাকে একটু দেখিস ।
পার্থ ঠিকই খবর পেয়েছিলো , কর্ণ স্যার বিয়ে করেছেন , এমন কি এও জানতে পারলো সে , স্যারের একটি মেয়েও ছিলো তার নাম সাঁঝবাতি । বছর চারেক আগে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে , সাঁঝবাতির বিয়ে দিয়েছিলেন কর্ণ বাবু । তার বছর খানেক পরে সাঁঝবাতি আরেকটি ফুটফুটে সাঁঝবাতির জন্ম দেয় , কিন্তু সেটি মেনে নিতে পারেনি তার শশুর বাড়ির লোক ,শুরু করে তার উপর অত্যাচার , শেষে আর অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সাঁঝবাতি । পড়ে থাকে তার ফুটফুটে মেয়েটি । কর্ণ বাবু নাতনিকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে । তার মাস ছয়েক পর তার স্ত্রীও দেহ রাখেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে । তারপর জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে , নিজের বর্ধমানের সব ভিটে মাটি বিক্রি করে , এসে ওঠেন নিজের কলেজের পাশের এই বৈকুন্টপুর ভারত সেবাশ্রমে । চাকরি সূত্রে এই বৈকন্টপুরে তার পরিচিত লোকের অভাব নেই ...
কলেজে পড়ানোর সময় থেকেই এই আশ্রমের প্রধান পুরোহিতের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ত্ব , সেই সুবাদে নিজের সমস্ত শেষ বয়সের সম্বল আশ্রমকে দান করে দিয়ে , দাদু নাতনি এখানেই থাকা শুরু করেছিলেন । মাস তিনেক আগে থেকেই শরীর হঠাৎই ভাঙতে শুরু করে কর্ণ বাবুর । তারপর ধীরে ধীরে আজ এই পরিণতি । শশ্বানের মাটিতে দাঁড়িয়েই একটা কথা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিলো পার্থকে । তবে কি স্যার এই নাতনির দায়িত্ব নিতেই তাকে ডেকে পাঠালেন ?
আশ্রমে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো , তারপর স্নান সেরে , আশ্রমের বারান্দায় বসলো পার্থ । পাশে এসে বসলো বিশ্বরূপ । একটা দুটো কথা হচ্ছিলো তার সাথে , কথার মূল বিষয় বলতে পুরোনো স্মৃতির পাতা উল্টে পাল্টে দেখা । কিন্তু চোখটা এদিক ওদিক খুঁজেছিলো পার্থর , ওই বাচ্চা মেয়েটিকে । কিছুক্ষন পরে আশ্রমের ওই মূল পুরোহিত , হাতে একটা সাদা খাম নিয়ে এগিয়ে এলেন পার্থর দিকে । আঠা দিয়ে আটকানো খামটা পার্থর হাতে দিয়ে উনি বললেন ....
- কর্ণ বাবু আপনাকে এটা দিতে বলে গিয়েছেন । আমাদের কারোর এই চিঠি খোলার অনুমতি নেই । বলেছিলেন , আপনি যদি তার মুখাগ্নি করতে আসেন , তাহলে যেন এটা আপনার হাতে এটি তুলে দেওয়া হয় ।
খামের একপাশ খুলে চিঠিটা বার করলো পার্থ , সেই জেল পেনের কালির গন্ধ । ঠিক যেমনটা পার্থ পেতো তার কলেজের অঙ্ক খাতা গুলি থেকে , এ যেন কর্ণ স্যারের শরীরের গন্ধ । চিঠিটা পড়তে শুরু করলো পার্থ ...
প্রিয় অর্জুন ,
হ্যাঁ ভুল পড়িসনি , পার্থ নয় তুইই অর্জুন । পার্থর অপর নামইতো অর্জুন । অর্জুন নামের কোনো ছাত্র আমার ছিলো না , ছিলো একটি মাত্র পার্থ । যাকে অর্জুন বানানোর সংকল্প নিয়েছিলাম আমি তোর মাধ্যমে । সব অঙ্কের হিসেব জীবনে মেলে না জানিস ? আমারটাও মেলেনি । এতক্ষনে হয়তো সবটাই জেনেছিস । জেনেছিস আমার নাতনি ঝিলমিলের কথাও , হয়তো ভাবছিস ঝিলমিলের দায়িত্ত্ব নেবার জন্য তোকে ডেকে পাঠিয়েছি । নারে তা নয় , ও ওই আশ্রমেই বড়ো হবে , তার সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে রেখে এসেছি । তবু চিন্তা হয় , আমি ছাড়া আর কেউই নেই ওই খুদে প্রাণটার । আমি চলে গেলে কে কিভাবে রাখবে ? মানুষ কে বদলে যেতে দেখেছি রাতারাতি । তাই ভরসা হয় না , তাছাড়া আশ্রমের গোসাইএরও বয়স হয়েছে । সেই বা কতদিন ? তোকে শুধু এইটুকু কাজ দিলাম মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পারলে বৈকন্টপুর আসিস , মেয়েটাকে একটু দেখে যাস । নিজের ছেলে বলতে কেউই নেই আমার , শেষ বয়সে এসেও তাও ছেলের হাতে মুখাগ্নির লোভটা এই ', সন্তান কর্ণ চক্রবর্তী ত্যাগ করতে পারলো না । তাই তোকে ডেকে পাঠালাম । বৃদ্ধ মাস্টারের পাগলামি ভেবেই মেনে নিস , এক সময় তোদের কত পাগলামিতো আমি মুখ বুজে সয়েছি । খুব ইচ্ছে ছিলো জীবনে বিজ্ঞানী হবো, জানিস ? কোনোদিন কাউকে বলিনি , এই তোকে আজ বললাম । পারিনি হতে , কিন্তু চেয়েছিলাম নিজে হতে না পারলেও একখানি বিজ্ঞানী রেখে যাবো এই পৃথিবীতে । তারপর যেদিন বাজারে গিয়ে শুনলাম তুই বিজ্ঞানী হয়েছিস , বাজারের মধ্যে এই বুড়ো হাঁটুতে লাফিয়ে উঠে , হাঁটুতে চোট নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি এসেছিলাম সেদিন । গিন্নি কি বকা বকিই করেছিলেন । যাইহোক , বলতে গেলে সে অনেক কথা , ইচ্ছে ছিলো শেষ কালে একদিন তোকে পেলে , জমিয়ে গপ্পো দেবো , যাক সেসব হয়তো আর হবে না । ভালো থাকিস , ঝিলমিলটাকে একটু দেখিস ।