18-10-2021, 09:01 PM
#কনকাঞ্জলি
#মৌমিতা_ঘোষ
'ও কি ও কি, বড়দিকে কনকাঞ্জলির থালা দিচ্ছ কেন? বড়দি তো নেবে না কনকাঞ্জলি' - হাঁপাতে হাঁপাতে ছাদে এসে বলে সুতনুকা |
'কেন বড়দি নেবে না কেন? আর তুমি তো গেছিলে বিসর্জনের গাড়ি দেখতে, তুমিই বা আবার ওপরে এলে কেন মেজদি? ' - ভুরু কুঁচকে মেজো জায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় চাঁদনী, এ বাড়ির ছোট বৌ |
দু'মাস হল কৌশিকের বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে চাঁদনী | আর এইটুকু সময়েই সবাই নতুন বৌয়ের মুখকে সমঝে চলে | সবাই জানে মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলে দিতে নতুন বৌয়ের জুড়ি মেলা ভার| কৌশিকরা তিন ভাই | বড়দা শমীক বাবার ওষুধের দোকানে বসে | মেজো ভাই দ্বারিক একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে | কৌশিক সবার ছোট, ও কলেজে পড়ায় | চাঁদনীও চাকরি করে | বিয়ের আগে থেকেই নতুন বৌয়ের চাকরি করা নিয়ে বেশ অশান্তি হয়েছিল বাড়িতে | কৌশিকের মা বাড়ির বৌয়ের চাকরি করা একদম পছন্দ করেন না | বড় বৌ তমসা তো এতদিন সংসার করছে, কই সে তো কখনো চাকরি করতে চায়নি ! মেজ ছেলে চাকরিসূত্রে সল্টলেকে ফ্ল্যাটে থাকে | এতদূরে এই উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে রোজ অতটা যাতায়াত করতে পারছিল না দ্বারিক, তাই বছর দুয়েক আগে বিয়ের পর আলাদা হয়ে গেছে ওরা স্বামী-স্ত্রী | চাঁদনীর অফিসও সেক্টর ফাইভ | মাঝে মাঝে অফিসে চাপ থাকলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় | কৌশিক তখন স্টেশনে গিয়ে বাইকে করে নিয়ে আসে ওকে | শাশুড়ি সেদিন ওর সাথে কোনো কথা বলেন না | তবে কয়েকদিনেই চাঁদনী অভ্যস্ত হয়ে গেছে এইসব কিছুর সঙ্গে | কৌশিক যে ওর পাশে আছে সেই প্রথম দিন থেকে !
এই দুর্গাপুজোর সময় সব আত্মীয় স্বজনরা এক হন ওদের এই উত্তরপাড়ার বাড়িতে | ওদের এই বাড়ির পুজো এবারে পঁচাত্তর বছরে পড়ল | কৌশিকরা তিন ভাই আবার যেন সেই ছোটবেলায় ফিরে যায় পুজোর দিনগুলোতে | তমসা, সুতনুকা আর চাঁদনী - এই তিন বৌ যেন তিন রকম | খুব যে মিল ওদের মধ্যে এমনটা নয়, তবে মুখোমুখি ঝগড়াও নেই |
তমসার বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক | নিঃসন্তান ওরা |এই নিয়ে শাশুড়ি উঠতে বসতে বড়ো বৌকে কথা শোনাতে ছাড়েন না | সুতনুকা সবে তিনমাসের প্রেগন্যান্ট | সেজন্য এবারে তার আদরের অন্ত নেই | শাশুড়ি যেন মেজ বৌমাকে চোখে হারাচ্ছেন | আর নিঃশব্দে সব দায়িত্ব পালন কিরে চলেছে তমসা | সুতনুকা এবার বিসর্জনে যাবে না | ওদের বিসর্জনে খুব আনন্দ হয়, সবাই মিলে হই হই - নাচানাচি করতে করতে একসাথে গঙ্গায় যায় | কিন্তু সুতনুকা এবারে যাবে না, ওকে নাকি এই অবস্থায় যেতে নেই | তাই বরণের পর বিসর্জনের গাড়ি সাজানো দেখতে গেছিল ও নিচে | কিন্তু ওর হঠাৎ ফিরে আসায় একটু হকচকিয়ে যায় সবাই | চাঁদনীর হাতে তখন কনকঞ্জলির থালা | ওদের শাশুড়ি এবার হাঁটুর ব্যথা নিয়ে উঁচু টুলে উঠে কনকঞ্জলি নিতে পারবেন না বলেছেন | তাই নিয়ম অনুযায়ী বড় বৌ হিসেবে তমসারই কনকঞ্জলি নেওয়ার কথা | সেই মতোই ব্যবস্থা করেছিল চাঁদনী | মেজদির হঠাৎ ওপরে আসার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে, বুঝতে পারে ও |
চাঁদনীর হাত ধরে সাইডে সরিয়ে আনে সুতনুকা| তারপর ফিসফিস করে বলে, 'তুমি কি কিছুই জানো না চাঁদনী? বড়দি কি করে কনকঞ্জলি নেবে? বড়দির বাচ্চা আছে নাকি? মা বললেন আমাকে কনকঞ্জলি নিতে |'
অবাক হয়ে যায় চাঁদনী ! আজকের দিনে কেউ এমন ধ্যান ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? ওর শাশুড়ি নয় পুরোনো দিনের মানুষ, মেজদি তো ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারতো ! তা না করে মেজদিও এটা সমর্থন করলো? আজ এতদিন ধরে এই সংসারের এতো ঝক্কি সামলানোর পরেও শুধু গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারেনি বলে কোনো দায়িত্ব না নেওয়া মেজ বৌ বড় বৌয়ের চেয়ে বেশি যোগ্য? কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি চাঁদনী | সোজা শাশুড়ির কাছে গিয়ে জানিয়েছিল ওর অসন্তোষ |
'এটা কি ধরণের কথা মা? বড়দি আজ এত কিছুর পর শুধু সন্তান ধারণ করতে পারেনি বলে শুভ কাজে থাকতে পারবে না? '
'যেটা বোঝো না, সেই নিয়ে কথা বোলো না ছোট বৌমা | বাড়ির মঙ্গল-অমঙ্গলের একটা ব্যাপার আছে | বড় বৌমাকে তো আমি পুজোর কাজে থাকতে না করিনি, তবে কনকাঞ্জলি ও নিতে পারবে না ' - গম্ভীর স্বরে জবাব দিয়েছিলেন চাঁদনীর শাশুড়ি মা |
বাইরে থেকে সবাই তাড়া দিচ্ছিল ঠাকুর নামানোর জন্য | আকাশের অবস্থা ভালো না, বৃষ্টি আসতে পারে | তমসাই ব্যবস্থা করে ফেলল কনকাঞ্জলির | দ্বারিকের হাত থেকে কনকাঞ্জলি নিল সুতনুকা | 'আসছে বছর আবার এসো মা' - বলে মাকে বিদায় জানাল ব্যানার্জী বাড়ি |
তমসা এবারে বিসর্জনে যায়নি | মাথা ধরেছে বলে শুয়েছিল ঘরে | ঠাকুর বেরোনোর পরেই বৃষ্টি এসেছিল জোরে | বাড়ি মোটামুটি ফাঁকা এখন | সবাই বিসর্জনে গেছে | শুধু ওর শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন ঘরে, আর সুতনুকা যায়নি, ওকে যেতে নেই বলে | এখন বাচ্চা না হওয়ার জন্য কথা শুনতে শুনতে ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে তমসার| প্রথম প্রথম কান্না পেত খুব, আজকাল চোখের জলও শুকিয়ে গেছে |
'উঃ মা গো ' - বাইরে থেকে হঠাৎ প্রচন্ড জোর চিৎকার ভেসে এল একটা |
চোখটা লেগে গেছিল একটু তমসার | পুজোর কদিন খাটুনি তো কম যায় না ! চিৎকারটা সুতনুকার মনে হলো ! বাইরে বেরিয়ে দেখে ঠিক তাই | বৃষ্টির জলের ছাঁট এসেছিল বারান্দায় | সেখানেই পা হড়কে পরে গেছে সুতনুকা | দৌড়ে গিয়ে ওকে তোলে তমসা | ততক্ষনে ওর দু'পা বেয়ে নামতে শুরু করেছে রক্তের ধারা |
****************************
সুতনুকার গর্ভে বেড়ে ওঠা তিনমাসের ভ্রুণটিকে বাঁচানো যায়নি কোনোভাবেই | অতখানি রক্তপাতে প্রাণসংশয় হয়েছিল সুতনুকারও | ওর ও নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ | দশমীর দিন অত রাতে ওই রেয়ার গ্রুপের রক্ত পাওয়া অসম্ভব ছিল | শেষে এগিয়ে আসে তমসা | ওরও ও নেগেটিভ | তমসার দেওয়া রক্তেই আস্তে আস্তে স্থিতিশীল হয় সুতনুকা | কিন্তু তখনও ওর জ্ঞান আসেনি |
দশমীর দিনেই বাড়িতে এমন একটা আকস্মিক দুর্ঘটনায় ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েন সুতনুকার শ্বশুর শাশুড়ি | পরেরদিন ওর বড় ভাসুর জা, ওর স্বামী, ছোট দেওর, জা সকলে যখন ওর কেবিনে গিয়ে পৌঁছল, সুতনুকা তখন জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে, শূন্য দৃষ্টি | পাশে গিয়ে বসল তমসা, সুতনুকার বড় জা | কাঁধে হাত রাখলেন ওর | একটু যেন কেঁপে উঠল সুতনুকা, নড়ে উঠল ওর শুকনো ঠোঁটদুটো, হঠাৎ করে টলটল করে উঠল ওর দু'চোখের কোল |
'মন খারাপ করিস না, দেখবি, খুব শিগগির তোর কোল ভরে উঠবে' - সুতনুকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে তার বড় জা|
'পাপ দিদি, বড় পাপ ভিড় কিরে আছে আমার চারদিকে | এত সহজে আমার মুক্তি নেই | কাল আমি পাপ করেছি তোমার সাথে | মা তোমার হাতেই কনকাঞ্জলি চেয়েছিলেন, আমি তোমায় নিতে দিইনি | তার শাস্তি পেলাম আমি | কেন আমায় বাঁচালে দিদি? আমি থাকলে এই পৃথিবীর পাপের বোঝা বাড়বে শুধু | তুমি আমায় যেতে দিলে না, কেন যেতে দিলে না, বলো? ' - তমসাকে জড়িয়ে ধরেছে সুতনুকা, কেঁদে চলেছে হাউহাউ করে |
'দূর পাগল, এভাবে কাঁদে কেউ? আমাদের জন্যে না হোক, আর ক'দিন পর যে আসবে তোর কোলে জুড়ে, তার জন্যে বাঁচতে হবে না? এসব অশুভ কথা একদম মনে আনবি না |'
তমসা বুকে জড়িয়ে ধরে আছে সুতনুকাকে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর মাথায় | পরম নিশ্চিন্তে বড় জায়ের বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছে সুতনুকা | আজ যে ওর নবজন্ম হলো! আর যার জন্যে সেই জন্ম, সে কি মায়ের চেয়ে কিছু কম নাকি !
***************************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর |
'ও বড় মা, তাড়াতাড়ি এসো | দিদি বেরোবে তো এবার | দেরি হচ্ছে ওদের, মেজো জেঠি তোমায় ডাকছে তো !' - সিঁড়ি থেকে চেঁচাচ্ছে রূপ, চাঁদনী আর কৌশিকের ছেলে |
নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে তমসা | ও কিছুতেই আর বেরোবে না | বুকে করে বড় করলো যে পম্পিকে, সে আজ পরের ঘরে চলে যাচ্ছে, কোন মা এটা সহ্য করতে পারে !
'দরজা খোলো দিদি | মেয়ে জামাই যে তোমার জন্যে আটকে আছে | তুমি কনকাঞ্জলি না নিলে ওরা তো রওনা দিতে পারছে না ' - দরজায় ধাক্কা দেয় সুতনুকা, পম্পির জন্মদাত্রি মা |
'তুই নে মেজ, তুইই তো ওর মা !' - অনেক কষ্টে কান্না চেপে ভেতর থেকে বলে তমসা |
'তাই বললে কি হয় দিদি, আমি তো ওকে শুধু জন্মই দিয়েছি, বড় করলে তো তুমি | জন্ম দিলেই কি আর মা হওয়া যায়? আর মেয়েও তো তোমাকেই মা বলে মানে | মাকেই কনকাঞ্জলি নিতে হয় দিদি | মেয়ের কথা ভেবে একটিবার বাইরে এসো, লক্ষ্মীটি !'
বাইরে আসেন তমসা | কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো জবাফুল হয়ে গেছে |
'আচ্ছা এত কাঁদবে যদি, মেয়ের বিয়ে দিলে কেন বলো দেখি? ' - মজা করে প্রশ্ন করে সুতনুকা |
সিঁড়ি দিয়ে নামছে পম্পির দুই মা, একজন তার জন্মদাত্রি, আর একজন তার মাম্মাম | সেই হাসপাতাল থেকে এসে অবধি মাম্মামের কোলেই ওর বড় হয়ে ওঠা | তখন ওর বাবা -মা মেয়ের জন্যে আবার উত্তরপাড়ার বাড়িতেই চলে আসেন | পম্পি তো অনেক বড় বয়স অবধি মাম্মামকেই ওর মা বলে জানতো | ওর চান-খাওয়া-ঘুম-আবদার-বেড়ানো - সব কিছু মাম্মামের কাছে | আর মাম্মামও যেন পম্পিকে পেয়ে জগৎ ভুলে যেত | অনির্বানের সাথে সম্পর্কের কথাটাও প্রথম মাম্মামকেই বলেছিল ও | মাম্মাম একদিন বাড়িতে ডেকেছিল অনির্বানকে | তারপর নিজে ওদের বাড়ি গিয়ে বিয়ে ঠিক করেছিল | আর আজ এমন করে কাঁদছে !
তমসার তখন মনে পড়ছে সুতনুকার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিনটা | সেই দুর্ঘটনার ঠিক এক বছরের মাথায় মহালয়ার দিন এসেছিল পম্পি | ওকে তমসার কোলে দিয়ে সুতনুকা বলেছিল, 'তোমার মেয়েকে আগলে রেখো দিদি' |
তারপর এতগুলো দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল | সেই ছোট্ট ময়দার তালটা আজ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে | অনির্বান ভালো ছেলে, ভালো রাখবে পম্পিকে, জানেন তমসা | তাও যে চোখ দুটো কেন এত ঝাপসা হয়ে যায় !
মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন তার দুই মা | মেয়ের হাতে কনকাঞ্জলির থালা | ঠাকুরমশাইয়ের কথা মতো আঁচল পেতে দাঁড়ালেন তমসা |
'এবার পিছন দিকে মায়ের আঁচলে চালটা ছুড়ে দিয়ে বলো, "মা তোমার সব ঋণ শোধ করলাম", বলে আর পিছনে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে যাও' - পম্পিকে বললেন ঠাকুরমশাই |
কনকাঞ্জলির থালা হাতে দাঁড়িয়ে পম্পি | হঠাৎ ওর হাতে ধরা ব্যাগটা ফাঁক করে সবটুকু চাল ভেতরে ঢেলে ফেলল মেয়ে | 'একি করলে? ' - আঁতকে উঠলেন ঠাকুরমশাই | কাউকে তোয়াক্কা না করেই পিছন ফিরল মেয়ে | সামনে এসে দাঁড়াল দুই মায়ের |
'মায়ের ঋণ শোধ করা যায় নাকি মাম্মাম? তুমি আঁচল পেতে দাঁড়ালে কেন? ওই এক মুঠো চাল দিয়ে তোমার ঋণ শোধ করবো আমি? ওটা আমি রাস্তায় কোনো ভিখারীকে দিয়ে দেবো | সে নয় একদিন একটু পেট ভরে ভাত খাবে | আর আমি তো আমার দুই মায়ের হাতের ভাত খেতে বারবার আসবো তোমাদের কাছে | তোমরাই যে আমার শিকড় !'
মেয়েটা তাঁর সত্যিই বড় হয়ে গেছে | তবে আজ বড় নিশ্চিন্ত লাগছে তমসার, মেয়েটা তাঁর মানুষ হয়েছে |
©মৌমিতা ঘোষ
#মৌমিতা_ঘোষ
'ও কি ও কি, বড়দিকে কনকাঞ্জলির থালা দিচ্ছ কেন? বড়দি তো নেবে না কনকাঞ্জলি' - হাঁপাতে হাঁপাতে ছাদে এসে বলে সুতনুকা |
'কেন বড়দি নেবে না কেন? আর তুমি তো গেছিলে বিসর্জনের গাড়ি দেখতে, তুমিই বা আবার ওপরে এলে কেন মেজদি? ' - ভুরু কুঁচকে মেজো জায়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় চাঁদনী, এ বাড়ির ছোট বৌ |
দু'মাস হল কৌশিকের বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে চাঁদনী | আর এইটুকু সময়েই সবাই নতুন বৌয়ের মুখকে সমঝে চলে | সবাই জানে মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলে দিতে নতুন বৌয়ের জুড়ি মেলা ভার| কৌশিকরা তিন ভাই | বড়দা শমীক বাবার ওষুধের দোকানে বসে | মেজো ভাই দ্বারিক একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে | কৌশিক সবার ছোট, ও কলেজে পড়ায় | চাঁদনীও চাকরি করে | বিয়ের আগে থেকেই নতুন বৌয়ের চাকরি করা নিয়ে বেশ অশান্তি হয়েছিল বাড়িতে | কৌশিকের মা বাড়ির বৌয়ের চাকরি করা একদম পছন্দ করেন না | বড় বৌ তমসা তো এতদিন সংসার করছে, কই সে তো কখনো চাকরি করতে চায়নি ! মেজ ছেলে চাকরিসূত্রে সল্টলেকে ফ্ল্যাটে থাকে | এতদূরে এই উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে রোজ অতটা যাতায়াত করতে পারছিল না দ্বারিক, তাই বছর দুয়েক আগে বিয়ের পর আলাদা হয়ে গেছে ওরা স্বামী-স্ত্রী | চাঁদনীর অফিসও সেক্টর ফাইভ | মাঝে মাঝে অফিসে চাপ থাকলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় | কৌশিক তখন স্টেশনে গিয়ে বাইকে করে নিয়ে আসে ওকে | শাশুড়ি সেদিন ওর সাথে কোনো কথা বলেন না | তবে কয়েকদিনেই চাঁদনী অভ্যস্ত হয়ে গেছে এইসব কিছুর সঙ্গে | কৌশিক যে ওর পাশে আছে সেই প্রথম দিন থেকে !
এই দুর্গাপুজোর সময় সব আত্মীয় স্বজনরা এক হন ওদের এই উত্তরপাড়ার বাড়িতে | ওদের এই বাড়ির পুজো এবারে পঁচাত্তর বছরে পড়ল | কৌশিকরা তিন ভাই আবার যেন সেই ছোটবেলায় ফিরে যায় পুজোর দিনগুলোতে | তমসা, সুতনুকা আর চাঁদনী - এই তিন বৌ যেন তিন রকম | খুব যে মিল ওদের মধ্যে এমনটা নয়, তবে মুখোমুখি ঝগড়াও নেই |
তমসার বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক | নিঃসন্তান ওরা |এই নিয়ে শাশুড়ি উঠতে বসতে বড়ো বৌকে কথা শোনাতে ছাড়েন না | সুতনুকা সবে তিনমাসের প্রেগন্যান্ট | সেজন্য এবারে তার আদরের অন্ত নেই | শাশুড়ি যেন মেজ বৌমাকে চোখে হারাচ্ছেন | আর নিঃশব্দে সব দায়িত্ব পালন কিরে চলেছে তমসা | সুতনুকা এবার বিসর্জনে যাবে না | ওদের বিসর্জনে খুব আনন্দ হয়, সবাই মিলে হই হই - নাচানাচি করতে করতে একসাথে গঙ্গায় যায় | কিন্তু সুতনুকা এবারে যাবে না, ওকে নাকি এই অবস্থায় যেতে নেই | তাই বরণের পর বিসর্জনের গাড়ি সাজানো দেখতে গেছিল ও নিচে | কিন্তু ওর হঠাৎ ফিরে আসায় একটু হকচকিয়ে যায় সবাই | চাঁদনীর হাতে তখন কনকঞ্জলির থালা | ওদের শাশুড়ি এবার হাঁটুর ব্যথা নিয়ে উঁচু টুলে উঠে কনকঞ্জলি নিতে পারবেন না বলেছেন | তাই নিয়ম অনুযায়ী বড় বৌ হিসেবে তমসারই কনকঞ্জলি নেওয়ার কথা | সেই মতোই ব্যবস্থা করেছিল চাঁদনী | মেজদির হঠাৎ ওপরে আসার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে, বুঝতে পারে ও |
চাঁদনীর হাত ধরে সাইডে সরিয়ে আনে সুতনুকা| তারপর ফিসফিস করে বলে, 'তুমি কি কিছুই জানো না চাঁদনী? বড়দি কি করে কনকঞ্জলি নেবে? বড়দির বাচ্চা আছে নাকি? মা বললেন আমাকে কনকঞ্জলি নিতে |'
অবাক হয়ে যায় চাঁদনী ! আজকের দিনে কেউ এমন ধ্যান ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? ওর শাশুড়ি নয় পুরোনো দিনের মানুষ, মেজদি তো ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারতো ! তা না করে মেজদিও এটা সমর্থন করলো? আজ এতদিন ধরে এই সংসারের এতো ঝক্কি সামলানোর পরেও শুধু গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারেনি বলে কোনো দায়িত্ব না নেওয়া মেজ বৌ বড় বৌয়ের চেয়ে বেশি যোগ্য? কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি চাঁদনী | সোজা শাশুড়ির কাছে গিয়ে জানিয়েছিল ওর অসন্তোষ |
'এটা কি ধরণের কথা মা? বড়দি আজ এত কিছুর পর শুধু সন্তান ধারণ করতে পারেনি বলে শুভ কাজে থাকতে পারবে না? '
'যেটা বোঝো না, সেই নিয়ে কথা বোলো না ছোট বৌমা | বাড়ির মঙ্গল-অমঙ্গলের একটা ব্যাপার আছে | বড় বৌমাকে তো আমি পুজোর কাজে থাকতে না করিনি, তবে কনকাঞ্জলি ও নিতে পারবে না ' - গম্ভীর স্বরে জবাব দিয়েছিলেন চাঁদনীর শাশুড়ি মা |
বাইরে থেকে সবাই তাড়া দিচ্ছিল ঠাকুর নামানোর জন্য | আকাশের অবস্থা ভালো না, বৃষ্টি আসতে পারে | তমসাই ব্যবস্থা করে ফেলল কনকাঞ্জলির | দ্বারিকের হাত থেকে কনকাঞ্জলি নিল সুতনুকা | 'আসছে বছর আবার এসো মা' - বলে মাকে বিদায় জানাল ব্যানার্জী বাড়ি |
তমসা এবারে বিসর্জনে যায়নি | মাথা ধরেছে বলে শুয়েছিল ঘরে | ঠাকুর বেরোনোর পরেই বৃষ্টি এসেছিল জোরে | বাড়ি মোটামুটি ফাঁকা এখন | সবাই বিসর্জনে গেছে | শুধু ওর শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন ঘরে, আর সুতনুকা যায়নি, ওকে যেতে নেই বলে | এখন বাচ্চা না হওয়ার জন্য কথা শুনতে শুনতে ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গেছে তমসার| প্রথম প্রথম কান্না পেত খুব, আজকাল চোখের জলও শুকিয়ে গেছে |
'উঃ মা গো ' - বাইরে থেকে হঠাৎ প্রচন্ড জোর চিৎকার ভেসে এল একটা |
চোখটা লেগে গেছিল একটু তমসার | পুজোর কদিন খাটুনি তো কম যায় না ! চিৎকারটা সুতনুকার মনে হলো ! বাইরে বেরিয়ে দেখে ঠিক তাই | বৃষ্টির জলের ছাঁট এসেছিল বারান্দায় | সেখানেই পা হড়কে পরে গেছে সুতনুকা | দৌড়ে গিয়ে ওকে তোলে তমসা | ততক্ষনে ওর দু'পা বেয়ে নামতে শুরু করেছে রক্তের ধারা |
****************************
সুতনুকার গর্ভে বেড়ে ওঠা তিনমাসের ভ্রুণটিকে বাঁচানো যায়নি কোনোভাবেই | অতখানি রক্তপাতে প্রাণসংশয় হয়েছিল সুতনুকারও | ওর ও নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ | দশমীর দিন অত রাতে ওই রেয়ার গ্রুপের রক্ত পাওয়া অসম্ভব ছিল | শেষে এগিয়ে আসে তমসা | ওরও ও নেগেটিভ | তমসার দেওয়া রক্তেই আস্তে আস্তে স্থিতিশীল হয় সুতনুকা | কিন্তু তখনও ওর জ্ঞান আসেনি |
দশমীর দিনেই বাড়িতে এমন একটা আকস্মিক দুর্ঘটনায় ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েন সুতনুকার শ্বশুর শাশুড়ি | পরেরদিন ওর বড় ভাসুর জা, ওর স্বামী, ছোট দেওর, জা সকলে যখন ওর কেবিনে গিয়ে পৌঁছল, সুতনুকা তখন জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে, শূন্য দৃষ্টি | পাশে গিয়ে বসল তমসা, সুতনুকার বড় জা | কাঁধে হাত রাখলেন ওর | একটু যেন কেঁপে উঠল সুতনুকা, নড়ে উঠল ওর শুকনো ঠোঁটদুটো, হঠাৎ করে টলটল করে উঠল ওর দু'চোখের কোল |
'মন খারাপ করিস না, দেখবি, খুব শিগগির তোর কোল ভরে উঠবে' - সুতনুকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে তার বড় জা|
'পাপ দিদি, বড় পাপ ভিড় কিরে আছে আমার চারদিকে | এত সহজে আমার মুক্তি নেই | কাল আমি পাপ করেছি তোমার সাথে | মা তোমার হাতেই কনকাঞ্জলি চেয়েছিলেন, আমি তোমায় নিতে দিইনি | তার শাস্তি পেলাম আমি | কেন আমায় বাঁচালে দিদি? আমি থাকলে এই পৃথিবীর পাপের বোঝা বাড়বে শুধু | তুমি আমায় যেতে দিলে না, কেন যেতে দিলে না, বলো? ' - তমসাকে জড়িয়ে ধরেছে সুতনুকা, কেঁদে চলেছে হাউহাউ করে |
'দূর পাগল, এভাবে কাঁদে কেউ? আমাদের জন্যে না হোক, আর ক'দিন পর যে আসবে তোর কোলে জুড়ে, তার জন্যে বাঁচতে হবে না? এসব অশুভ কথা একদম মনে আনবি না |'
তমসা বুকে জড়িয়ে ধরে আছে সুতনুকাকে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর মাথায় | পরম নিশ্চিন্তে বড় জায়ের বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছে সুতনুকা | আজ যে ওর নবজন্ম হলো! আর যার জন্যে সেই জন্ম, সে কি মায়ের চেয়ে কিছু কম নাকি !
***************************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর |
'ও বড় মা, তাড়াতাড়ি এসো | দিদি বেরোবে তো এবার | দেরি হচ্ছে ওদের, মেজো জেঠি তোমায় ডাকছে তো !' - সিঁড়ি থেকে চেঁচাচ্ছে রূপ, চাঁদনী আর কৌশিকের ছেলে |
নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে তমসা | ও কিছুতেই আর বেরোবে না | বুকে করে বড় করলো যে পম্পিকে, সে আজ পরের ঘরে চলে যাচ্ছে, কোন মা এটা সহ্য করতে পারে !
'দরজা খোলো দিদি | মেয়ে জামাই যে তোমার জন্যে আটকে আছে | তুমি কনকাঞ্জলি না নিলে ওরা তো রওনা দিতে পারছে না ' - দরজায় ধাক্কা দেয় সুতনুকা, পম্পির জন্মদাত্রি মা |
'তুই নে মেজ, তুইই তো ওর মা !' - অনেক কষ্টে কান্না চেপে ভেতর থেকে বলে তমসা |
'তাই বললে কি হয় দিদি, আমি তো ওকে শুধু জন্মই দিয়েছি, বড় করলে তো তুমি | জন্ম দিলেই কি আর মা হওয়া যায়? আর মেয়েও তো তোমাকেই মা বলে মানে | মাকেই কনকাঞ্জলি নিতে হয় দিদি | মেয়ের কথা ভেবে একটিবার বাইরে এসো, লক্ষ্মীটি !'
বাইরে আসেন তমসা | কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো জবাফুল হয়ে গেছে |
'আচ্ছা এত কাঁদবে যদি, মেয়ের বিয়ে দিলে কেন বলো দেখি? ' - মজা করে প্রশ্ন করে সুতনুকা |
সিঁড়ি দিয়ে নামছে পম্পির দুই মা, একজন তার জন্মদাত্রি, আর একজন তার মাম্মাম | সেই হাসপাতাল থেকে এসে অবধি মাম্মামের কোলেই ওর বড় হয়ে ওঠা | তখন ওর বাবা -মা মেয়ের জন্যে আবার উত্তরপাড়ার বাড়িতেই চলে আসেন | পম্পি তো অনেক বড় বয়স অবধি মাম্মামকেই ওর মা বলে জানতো | ওর চান-খাওয়া-ঘুম-আবদার-বেড়ানো - সব কিছু মাম্মামের কাছে | আর মাম্মামও যেন পম্পিকে পেয়ে জগৎ ভুলে যেত | অনির্বানের সাথে সম্পর্কের কথাটাও প্রথম মাম্মামকেই বলেছিল ও | মাম্মাম একদিন বাড়িতে ডেকেছিল অনির্বানকে | তারপর নিজে ওদের বাড়ি গিয়ে বিয়ে ঠিক করেছিল | আর আজ এমন করে কাঁদছে !
তমসার তখন মনে পড়ছে সুতনুকার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিনটা | সেই দুর্ঘটনার ঠিক এক বছরের মাথায় মহালয়ার দিন এসেছিল পম্পি | ওকে তমসার কোলে দিয়ে সুতনুকা বলেছিল, 'তোমার মেয়েকে আগলে রেখো দিদি' |
তারপর এতগুলো দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল | সেই ছোট্ট ময়দার তালটা আজ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে | অনির্বান ভালো ছেলে, ভালো রাখবে পম্পিকে, জানেন তমসা | তাও যে চোখ দুটো কেন এত ঝাপসা হয়ে যায় !
মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন তার দুই মা | মেয়ের হাতে কনকাঞ্জলির থালা | ঠাকুরমশাইয়ের কথা মতো আঁচল পেতে দাঁড়ালেন তমসা |
'এবার পিছন দিকে মায়ের আঁচলে চালটা ছুড়ে দিয়ে বলো, "মা তোমার সব ঋণ শোধ করলাম", বলে আর পিছনে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে যাও' - পম্পিকে বললেন ঠাকুরমশাই |
কনকাঞ্জলির থালা হাতে দাঁড়িয়ে পম্পি | হঠাৎ ওর হাতে ধরা ব্যাগটা ফাঁক করে সবটুকু চাল ভেতরে ঢেলে ফেলল মেয়ে | 'একি করলে? ' - আঁতকে উঠলেন ঠাকুরমশাই | কাউকে তোয়াক্কা না করেই পিছন ফিরল মেয়ে | সামনে এসে দাঁড়াল দুই মায়ের |
'মায়ের ঋণ শোধ করা যায় নাকি মাম্মাম? তুমি আঁচল পেতে দাঁড়ালে কেন? ওই এক মুঠো চাল দিয়ে তোমার ঋণ শোধ করবো আমি? ওটা আমি রাস্তায় কোনো ভিখারীকে দিয়ে দেবো | সে নয় একদিন একটু পেট ভরে ভাত খাবে | আর আমি তো আমার দুই মায়ের হাতের ভাত খেতে বারবার আসবো তোমাদের কাছে | তোমরাই যে আমার শিকড় !'
মেয়েটা তাঁর সত্যিই বড় হয়ে গেছে | তবে আজ বড় নিশ্চিন্ত লাগছে তমসার, মেয়েটা তাঁর মানুষ হয়েছে |
©মৌমিতা ঘোষ