18-10-2021, 09:01 PM
(18-10-2021, 10:41 AM)ddey333 Wrote: আলোর ঠিকানা
প্রতিবারই দশমী এলেই মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায় দীপ্তির। মনে হয়, এই তো মা এলেন, আবার চলেও যাচ্ছেন!
এবার তো মন আরও বেশি খারাপ ওর। প্রতিবারের থেকে এই দিনটা তো আরও অন্যরকমের। অন্যান্যবার পুরোনো পাড়ায় এইদিনে মজা হতো খুব। মা কে বরণ করার পরে সিঁদুরখেলা হত... ছবি তোলা... কত আড্ডা...
রনিও যেত ওর সাথে। ও যখন মা কে বরণ করার জন্য ওই উঁচু টুলের ওপর উঠত, তখন রনি ওর হাতের ডালাটা ধরে থাকত। তিন্নি তখন বাবার পাঞ্জাবিটা আঁকড়ে ধরে দেখত ওকে, বেশ ভয় পাওয়া চোখে!
তারপর তিনজনের সিঁদুরমাখা সেলফি তোলা হতো।
সেসব দিন কোথায় চলে গেছে!
আঠেরো সালের শেষ থেকেই বাঁধ ভেঙেছে, টের পাচ্ছিল দীপ্তি। উনিশ কাটল অশান্তিতে! কুড়ি বদলে দিল সবকিছু! একুশে তো ও একাই! এখন শুধু মেয়েটা মানুষের মতো মানুষ হোক, সেটাই চায় ও।
এইবছর অনেককিছু কেড়ে নিলেও কিছু পেয়েওছে ও। একটা নিজের মনের মতো বাড়ি খুঁজে পেয়েছে। এখানে মা মেয়ে ভালোই আছে ওরা। পাশের ফ্ল্যাটেই যে পরিবার, তাদের সাথে খুব মিশে গেছে ওরা। দাদা - বৌদি দুজনেই খুব ভাল। তিন্নির এখন অনলাইন কলেজ চলছে, তাই অসুবিধা হয় না খুব একটা।তবে কলেজ খুলে গেলেও, বৌদি বলেছেন তিন্নিকে কলেজ থেকে ফেরার পর থেকে নিজের কাছেই রাখবেন। ও 'কিন্তু কিন্তু' করায় বকাও খেয়েছে বৌদির কাছে। বেশ রাগ করেই বলেছেন উনি "এতদিন আমার শাশুড়ি মা অসুস্থ ছিলেন, ওঁকে নিয়ে সময় কেটে যেত। মাসকয়েক আগে মা চলে গেলেন, তোরা ভাড়া এলি। ভাগ্যিস এখন তিন্নি মা আছে, ওর কটরকটর শুনে ভালো আছি আমরা। ভগবান তো আর আমাদের দিলেন না কাউকে..."। এই কথা গুলো শুনলেই চুপ করে যায় দীপ্তি। এত আন্তরিকতার কি কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব?
পাড়ার ক্লাবে বরণের সময়ের ঘোষনা হচ্ছে। আর বলে দেওয়া হচ্ছে মাস্ক না পরলে মন্ডপে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এবার কোত্থাও বের হয় নি দীপ্তি। একদিন সকালে গিয়ে আশেপাশের ক'টা ঠাকুর দেখে এসেছে মেয়েকে নিয়ে। আর রান্না করে, টিভিতে পুজো পরিক্রমা দেখে সময় কাটিয়েছে। কাল থেকে আবার অফিস! তাও এবার আর বরণ করা নেই। এখন অবসর ই অবসর।
স্নান সেরে, একটা পুরোনো পুজোসংখ্যা নিয়ে বসতে যাবে, হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ। বেশ অবাক হয়েই দরজার কাছে গেল দীপ্তি। এইসময় আবার কে এলো!
দরজা খুলতেই দেখে বৌদি দাঁড়িয়ে আছেন।
"কি রে, তুই রেডি হোস নি? চল, ফাঁকায় ফাঁকায় বরণ করে আসি!"
অবাক হলো দীপ্তি।
কী যে বলছেন বৌদি! ও কিভাবে বরণ করতে যাবে! কেন যাবে!
ওর মুখ দেখেই হয়ত কিছু বুঝেছিলেন উনি। তাই বলে উঠলেন "তুই যাবি না? কেন?"
"কেন যাব বৌদি? আমি কি ম্যারেড এখন? ডিভোর্সি আমি। সিঁদুর ও তো পরি না আর! তবে কেন যাব?" প্রায় হাহাকারের মতোই শোনাল ওর গলা, যেন।
একটু হাসলেন বৌদি।
তারপর বললেন "তাতে? আমাদের ও তো অশৌচ চলছে... তাও আমি যাচ্ছি মায়ের কাছে। তুই তাহলে কেন যাবিনা?"
"আমি সত্যি জানিনা তুমি কেন যাচ্ছ... শুনেছিলাম যেতে নেই। আর আমি কেন যাচ্ছি না, তোমাকে তো বললামই। ডিভোর্সি মেয়ের কি আর এসবের অধিকার থাকে?"
"তোর মুণ্ডু! আচ্ছা, আমরা কি মানি? মা দুর্গা আমাদের মেয়ে, তাই তো? আমাদের প্রিয় গান কি? "এবার আমার উমা এলে আর উমাকে পাঠাব না.."। আমার উমা! আমরা ওঁর মা এখন! দুটো জল মিষ্টি খাইয়ে, পানপাতা দিয়ে আদর করে দিই না মাকে? বরণের সময় লক্ষী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ আমাদের নাতি নাতনি হয়ে যান না? তাঁরা অন্যসময় আমাদের আরাধ্য হওয়া সত্ত্বেও? তাহলে এখানে কে বিবাহিতা, কে ডিভোর্সি বা বিধবা... সেই প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! একজন মা তার মেয়ে স্বামীর কাছে যাবার আগে কাছে যাচ্ছে... ব্যস এইটুকুই ভাব না! আমিও তো সেজন্যই যাচ্ছি মায়ের কাছে। জরা-ব্যধি-মৃত্যু - সব ই তো তাঁর দেওয়া। তাহলে অশৌচ চললেও আমি কি তাঁর কাছে যেতে পারব না? আমি কি ওঁর কেউ না?" একটানা বলে থামলেন বৌদি।
তখনও চোখটা চিকচিক করছে ওঁর।
চোখটা চিকচিক করছে দীপ্তির ও। এভাবে তো ভাবেনি ও! ভাবেনি যে, মা মা ই থাকেন! আর জগজ্জননীর কাছে তো যখন তখন ই মঙ্গলকামনা করা যায়। মণ্ডপে যিনি আছেন, আর ওই দেওয়ালে, ক্যালেন্ডারের মধ্যে যিনি আছেন -তাঁরা কি আলাদা?
আর, ওর মনে যিনি আছেন? তবে কেন যাবে না ও?
"তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি রেডি হয়ে নিচ্ছি। আচ্ছা, এখন তো খুব ভিড় হবে না... মেয়েটাকেও নিয়ে যাই?" বলে হাসতে হাসতে একটা নতুন লালপেড়ে শাড়ি বের করে আলমারি থেকে।
ক্যালেন্ডারের মধ্যে থেকে মা দুর্গা তখন হাসছেন...
আলোর ঠিকানা লেখা আছে সেই হাসিতে...
খুব সুন্দর