16-10-2021, 10:25 AM
#অনুগল্প
#হাঁদারামের_বৌ
#কলমে_অরু(অরুণিমা নাথ)
সোনাই... অ্যাই সোনাই... সোনাই... কানে কি কথা যাচ্ছে না নাকি... সোনাই... বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন একজন বছর পঞ্চাশের মধ্যবয়স্কা মহিলা। পরণে সাধারণ শাড়ি যার আঁচলটা কোমরে গোজা রয়েছে এবং ডান হাতে একটি স্টিলের খুন্তি ধরা, যা থেকে বোঝা যায় মহিলা রান্না করতে করতেই এখানে ছুটে এসেছেন। এই মুহূর্তে তার মুখখানা যথেষ্ট পরিমাণে লাল বর্ণ ধারণ করেছে এবং দুচোখেও স্পষ্ট রাগের ঝলক দেখা যাচ্ছে... তার দৃষ্টি স্থির হয়ে রয়েছে ঘরের একেবারে মাঝামাঝি অংশে রাখা বিছানার ওপর ঘুমিয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে... মেয়েটি ঘুমিয়ে থাকলেও তার ঠোঁটের কোণে আলতো একটা হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে যা থেকে অনুমান করা যায় যে হয়তো মেয়েটি কোনো মিঠে স্বপ্নের আবেশে বিভোর হয়ে রয়েছে... মহিলাটি আরো কয়েক মুহূর্ত মেয়েটির দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকার পরে দুই কদম এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাসটি তুলে গ্লাসে থাকা জলটা সজোরে ছুঁড়ে দিলেন সেই মেয়েটির ঘুমন্ত মুখ লক্ষ্য করে... আচমকাই নিজের মুখে এভাবে জলের আক্রমণে মেয়েটি "বৃষ্টি.. বৃষ্টি... ছাদ ফুটো হয়ে গেছে... সব ভেসে যাবে মা..." বলতে বলতে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে, তারপর চারদিকে নজর বুলিয়ে অবাক হয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বলে...
কি হল, কোথায় বৃষ্টি?
তারপর নিজের মুখে হাত দিয়ে ত্বকের সিক্ততা অনুভব করে বলে...
এই তো জল, তাহলে এটা কোথা থেকে এল?... বলতে বলতেই তার নজর পড়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে যিনি বর্তমানে তার দিকেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন...
মেয়েটি কিছু বলার আগেই সেই মহিলা বেশ ব্যঙ্গের সুরে বলে ওঠেন...
তা বলি মহারাণীর ঘুম ভাঙল নাকি আরো এক গ্লাস জল ঢালব?
মেয়েটি তখন দুহাতে চোখ রগড়ে বেশ কিছুটা আড়মোড়া ভেঙে এবং শেষে একটা বড় হাই তুলে জড়ানো গলায় বলে...
উফ্ মা কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম আমার সল্লুকে নিয়ে... সল্লু আর আমি ইতালিতে বেড়াতে গেছি... চারদিকে কত বরফ... সল্লু আমাকে গোলাপ হাতে প্রপোজ করছে... কিন্তু তুমি এসে সব ভণ্ডুল করে দিলে ধুর... মুখ পেঁচিয়ে বলে মেয়েটি ওরফে সোনাই।
এই যে খুন্তি দেখছো, এইটার বাড়ি পিঠে এক ঘা পড়লে না, সব স্বপ্ন জানলা দিয়ে পালাবে... সকাল আটটা বাজে, এই ধিঙ্গি মেয়ের এখনো ঘুম ভাঙল না... বলছি ইউনিভার্সিটি কি আমি যাবো নাকি ওটাকে তোমার এই বাবার বাড়ির হোটেল পেয়েছো যে যখন খুশি যাবে আর তোমাকে ক্লাসে ঢুকতে দিয়ে দেবে?... চিৎকার করে ওঠেন মহিলাটি ওরফে সোনাইয়ের মা।
উফ্ মা, কুল ডাউন! সবে আটটা বাজে এখনো তিন ঘন্টা দেরী আছে। কত দিন পরে জমিয়ে একটু স্বপ্ন দেখছিলাম দিলে সবটা পণ্ড করে... এক এক সময় খুন্তি হাতে এমন মা কালী হয়ে যাও না কি বলব... বিকৃত মুখে বলে সোনাই।
আর একটা কথাও শুনলে না এই গরম খুন্তির একটা মারও বাইরে পড়বে না বলে দিলাম... ওঠ্, শিগগির ওঠ... আগে বাথরুমে যা... পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি নিচে টেবিলে না দেখেছি তাহলে সত্যি সত্যিই এই খুন্তি তোর পিঠে ভাঙব বলে দিলাম... তেইশ বছর বয়স হয়ে গেল এখনো নবাবজাদীর ধিঙ্গিপনা গেল না...
ওহ্ মা চিল! বারবার ওই খুন্তির ভয় দেখিয়ে লাভ নেই সেকথা তুমিও জানো আর যতক্ষণ তুমি এখানে দাড়িয়ে আমার পিছনে টাইম ওয়েষ্ট করছো ততক্ষণে তোমার খুন্তি আর রান্না দুটোই ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে... আর সবসময় বয়সের খোটা দেবে না তো, আমি এখনো যথেষ্ট বাচ্চা আছি... বিছানা থেকে নামতে নামতে উত্তর দেয় সোনাই।
তবে রে... সোনাইয়ের কথায় তার মা তেড়ে আসলে সোনাই... "ও বাবা গো, তোমার মেয়েকে মেরে ফেলল তোমার পাগল বৌ..." বলেই একছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলে...
বাপ রে, খুব বাঁচান বেঁচে গেছি আজ নাহলে সত্যিই আজ ওই খুন্তি আমার পিঠে পড়তই.. মাদার ইণ্ডিয়া যা খেপেছে আজকে, মাথার ওই আগুন শান্ত হওয়াটা হেবি চাপের...
ওদিকে তখনও তিনি চিৎকার করে চলেছেন বাইরে থেকে...
কতবার বলেছি দেখ দেখে শেখ কিছু নির্ঝরের থেকে, কি ভালো ছেলেটা... যেমন পড়াশোনা তেমনি স্বভাব চরিত্রে। সি.এ পাশ করে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেল এইটুকু বয়সে আর উনি এখনো ধেই ধেই করে নেচে চলেছেন সারাদিন আর ইউনিভার্সিটি গিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন... মা-বাবার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান নেই আর ওদিকে নির্ঝর প্রতিদিন অফিসে বেরোনোর আগে কি সুন্দর তনুজা দিকে বলে যায় "মা, আমি আসছি"... আর এক আমার মেয়ে, ভোর রাত অবধি জেগে সাত বেলায় ঘুম থেকে উঠবে আর নাকেমুখে গুজে ছুটবে... এ জীবনে বোধহয় আমার আর শোনা হল না যে মা আমি আসছি...
এদিকে ভিতর থেকে এই সব কথাই সোনাইয়ের কানে খুব সুন্দরভাবে পৌঁছে যাচ্ছিল... এতক্ষণ মায়ের এমন মধুর বচনে সকাল সকাল নিজের কান দুটোকে সার্থক করে অবশেষে সে মুখ খোলে...
বলছি মা, তোমার মেয়ের না এখনো এম.এ টা শেষ হয়নি হ্যা, ওটা শেষ হলে যখন চাকরি পাব তখন আমিও ওই হাঁদারাম মানে তোমার নির্ঝরের মত বলে যাব যে আমি আসছি...
হ্যা.. হ্যা... দেখব কত চাকরি পাও! চাকরি তো ছেলের হাতের মোয়া না, যখন চাইবে তখনই দোকান থেকে কিনে এনে হাতে ধরিয়ে দেবে... লোকজন তো বসে রয়েছে ওনাকে চাকরি দেওয়ার জন্য... পড়াশোনার যা বহর তাতে এম.এ টা টেনেটুনে পাস করলে হয়... হা ভগবান, আমার গর্ভেই এমন একটা উড়নচণ্ডী মেয়ের জন্ম দিতে হল...
এই যে মাদার ইণ্ডিয়া, ভগবানকে বলে লাভ নেই তার থেকে বরং তুমি গিয়ে এখন রান্নাটা শেষ করো নাহলে বাবা বাজার থেকে বাড়ি ফিরে তোমার ওপর খেপে লাল হয়ে যাবে তাই আমার ওপর ঝাল পরে ঝেড়ে এখন গিয়ে রান্নাটা শেষ করো। আমার কিন্তু এখন থেকেই পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে, টেবিলে খাবার না পেলে কিন্তু আমি না খেয়েই চলে যাব এই বলে দিলাম... ভিতর থেকে বলে সোনাই।
অসহ্য.. অসহ্য... জ্বলে গেল জীবন আমার এই মেয়ে নিয়ে... বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি।
যাক মা গেছে এবার আপনাদের সাথে একটু ঠিকমত কথা বলতে পারব... এই যে যিনি এখনি আমার ষষ্ঠীপুজো করে গেলেন তিনি আমার মা জননী শ্রীমতী তমালিকা বসু, আমার বাবা যিনি এখন বাজারে গেছেন তার নাম শ্রীযুক্ত তমাল বসু এবং আমি তাদের একমাত্র মেয়ে বিবৃতি বসু ওরফে সোনাই। আমার বয়স এখন তেইশ, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে আমি বাংলায় মাস্টার্স করছি। তাই বলে ভাববেন না সারাক্ষণ আমি কঠিন কঠিন বাংলা কপচাই... নেহাত ছোটবেলা থেকে এই সাবজেক্টে ভালো ছিলাম আর এইচ এসেও ভালো নম্বর ছিল তাই বাংলার ঘাড় ধরেই ঝুলে পড়লাম, যতই হোক মাতৃভাষা বলে কথা... এই তমালিকা দেবী মানে আমার মা এতক্ষণ ধরে আমার পিছনে বেগার খাটছিলেন তার কারণ হল আমার দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা। আচ্ছা এখানে আমার কি দোষ বলুন তো তাড়াতাড়ি ঘুম না ভাঙলে... কাল রাতে সল্লু মানে সলমন খানের হেব্বি ঝিঙ্কুমার্কা একটা রোমান্টিক সিনেমা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেছিল ঘুমাতে... এদিকে সল্লু হল আমার জানেমন, আমার দিল কা টুকড়া, আমার ফেবারিট হিরো তাই সল্লুর সিনেমা না দেখলে ভগবান আমাকে পাপ দেবে না তাইতো সিনেমাটা শেষ করে ঘুমোতে গেলাম... আর স্বপ্ন দেখলাম সল্লু আর আমি ইতালিতে বেড়াতে গেছি... চারিদিকে সাদা বরফের চাদর বিছিয়ে রয়েছে... সল্লু একটা গোলাপের তোড়া নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করছে আর যখনি আমি সেই প্রপোজাল আ্যাকসেপ্ট করে ফুলগুলো নিতে গেলাম ঠিক তখনি এই মাদার ইণ্ডিয়া রণচণ্ডী হয়ে এসে আমার স্বপ্নে মানে আমার মুখে জল ঢেলে সল্লুর প্রপোজালের বারোটা বাজিয়ে দিল... বাকি যা কিছু তার সবটাই তো আমার মায়ের থেকেই জেনে গেছেন তাহলে এবার তার বিষয়ে বলি যার সাথে মাদার ইণ্ডিয়া আমার তুলনা করছিল। নির্ঝর মিত্র ওরফে হাঁদারাম। বলছি বলছি কেন আমি ওকে হাঁদারাম বলে ডাকি... আমাদের ফ্ল্যাটের উপরের তলায় থাকে মিত্র ফ্যামিলি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তনুজা আন্টির সাথে মায়ের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই ফ্ল্যাটে আমরা এবং ওরা প্রায় একই সাথেই শিফট করেছিলাম তাই হয়তো সখ্যতা হতে বেশি সময় লাগেনি। ওদিকে বাবার সাথে রাজদীপ আঙ্কেলেরও ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব কিন্তু এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম হলাম আমি আর নির্ঝর। ওই হাঁদারামটার নামে আর কি বলব, সবটাই তো মা বলে দিল। কিন্তু সত্যি বলছি আমার না ওই নির্ঝরকে একদম সহ্য হয় না বিশ্বাস করুন। তুই ব্যাঙ্কে চাকরি করিস কোথায় ঠাটবাট নিয়ে চলবি, বন্ধুদের সাথে ঘুরবি-বেড়াবি-হ্যাং আউট করবি তা না উনি লতানো লাউডগার মত প্রতিদিন ঠিক টাইমে অফিস যাবেন আর অফিস থেকে ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। কি করছে জিজ্ঞাসা করলে বলবে কাজ করছি। কাজ না হাতির মাথা! আমার তো ডাউট হয় ব্যাটা তলে তলে অন্য কিছু করে। মাঝেমধ্যেই মা ভালোমন্দ রান্না করলে মিত্র বাড়িতে দিয়ে আসতে বলে আমাকে, কতবার বলেছি যাব না ওই হাঁদারামের বাড়িতে কিন্তু আমার কথার কোনো মূল্য আছে নাকি এই বাড়িতে... উল্টে ধমক খেতে মায়ের কাছে যে কেন ওনার আদরের নির্ঝরকে আমি হাঁদারাম বলছি। বিশ্বাস করুন ওইরকম একটা গোপাল অতি সুবোধ বালক টাইপের ছেলেকে হাঁদারাম না বলে আর কি বলব... যখনই ওদের বাড়ি গেছি আজ অবধি একটা কথা বলা তো দূর চোখ তুলে আমার দিকে তাকায় নি অবধি... নয়তো হা করে বসে ক্রিকেট গিলেছে নয়তো ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে থেকেছে আর নয়তো ডাইনিং টেবিলে বসে এমনভাবে মাথা নিচু করে খেয়েছে যেন আমার দিকে তাকালেও ওর ব্রহ্মচর্য ভেঙে যাবে... যতটুকু জানি হাঁদারাম আমার থেকে বছর চারেকের বড় তাহলে ওর বয়স আন্দাজ সাতাশ কি আঠাশ। এই বয়স থেকেই মোটামুটি ছেলেরা বিয়ের প্ল্যান করতে শুরু করে তা বাপু তুইও কর না কিন্তু না উনি ওইসব করবেন না কারণ উনি মনে হয় আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাইতো প্রতিদিন অফিস যাওয়ার আগে বলে যায় 'মা, আমি আসছি'। কোথায় বিয়ে থা করে মাকে রেহাই দিয়ে বৌকে নরম সুরে বলে যাবি যে 'ও বৌ, আমি এলাম' তা নয়, উনি সেই মায়ের ঘাড়েই চেপে বসে থাকবে। তবে যতই রাগ করি না কেন এটা অস্বীকার করার জো নেই যে হাঁদারামকে কিন্তু এক কথায় ফার্স্ট ক্লাস দেখতে... ওইরকম হ্যাণ্ডু মার্কা চেহারা, ক্লিন শেভেন মুখ, কাটা কাটা নাক-চোখ, ওইরকম হাইট আর হালকা হালকা মাসলওয়ালা বডি... এইরকম পারফেক্ট কম্বিনেশনের ছেলে আমাদের এই পাড়ায় কটা আছে হাতে গুণে বলা যায়। আমার ঘরের একটা জানলা ফ্রন্ট ফেসিং হওয়ায় মেন গেট থেকে কেউ বেরোলেই সেটা আমার চোখে পড়ে। তাই ওই হাঁদারামটাও যখন ফিটফাট হয়ে ফুল বাবু হয়ে অফিস যায় তখন না চাইতেও আমার চোখটা ওর দিকে একবার হলেও চলে যায়... কিন্তু তাই বলে ওর ওপর ক্রাশ, নৈব নৈব চ কারণ আমার ক্রাশ তো আমাদের ফ্ল্যাটের অপোজিটের মুখার্জি বাড়ির একমাত্র ছেলে রক্তিম। মানছি হাঁদারাম সুন্দর কিন্তু রক্তিমও কোনো অংশে কম যায় না... ও যখন নিজের ঘরের সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে তখন হা করে আমি ওর হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি... রক্তিম আমার মনের কথা বোঝে কি না কে জানে তবে দেখা হলেই যে কিলার স্মাইলটা দেয় না উফ্ আমি ওখানেই ক্লিন বোল্ড..! আর এই এক হাঁদারাম, রাস্তাঘাটে এমনকি লিফটে ওঠার সময়ও যদি কখনো একসাথে আসি তবুও ব্যাটা মুখ ফুটে দুটো কথা বলে না এমন উটকো ছেলে একটা... আমিও কথা বলি না। কেন বলব নিজে থেকে তাই আমারও ভারি বয়ে গেছে, হুহ্..! এই দেখেছেন আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন এতটা সময় পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করি নি। যাই এবার কাজ সারি নাহলে ওদিকে আবার মাদার ইণ্ডিয়া তাণ্ডব করতে শুরু করে দেবে...
.......
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিলাম ইউনিভার্সিটি যাব বলে হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়লে দেখি হাঁদারাম ফুল বাবু সেজে চললেন অফিসে... তবে মানতে হবে বস, এই ডার্ক ব্লু শার্ট আর লাইট ব্লু জিন্সে নির্ঝরকে দারুণ লাগছে। অবশ্য যা গায়ের রং তাতে ওকে সবকিছুতেই মানিয়ে যায় সাথে আজকে আবার চুলে জেল লাগিয়েছে মনে হচ্ছে? উম্, ব্যাপার কি? কারোর জন্য ছিপটিপ ফেলতে যাচ্ছে নাকি... না ব্যাঙ্কে নতুন মেয়ে কলিগ এসেছে যাকে ইমপ্রেস করার জন্য বাবুর এত সাজ... এই.. এই.. এই... আমি মরতে ওই হাঁদাটার কথা ভাবছি কেন? আর কি বলে ডাকছিলাম যেন, নির্ঝর... আহ্...! আমার মাথা গেছে... এ শিওর ওই জল ঢালার ফল। মায়ের জন্য আমার সল্লুকে আই লাভ ইউ টু বলা হল না আর এখন এই হাঁদারামটা আমার মাথায় চেপে বসছে সকাল সকাল ওর নামের পাঁচালি শোনার জন্য... বিবু রে, এত অধপতনের আগে তুই পাগল হলি না কেন রে... মাথা চাপড়ে যখন নিজেকে পাগল বানানোর চেষ্টা করছি ঠিক তখনি মাদার ইণ্ডিয়ার চিৎকার শুনে হাঁদারামের কথা ভুলে 'আসছিইইইই' বলে ছুট লাগালাম নাহলে আজকের ব্রেকফাস্টটুকুও আর জুটবে না কপালে শুধু গালমন্দ খেয়েই কলেজ যেতে হবে...
......
সেদিনই তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রূপু মানে রূপকথা দুজনে মিলে যাদবপুরের এইট বি বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম বাস ধরব বলে হঠাৎ রূপু লাফিয়ে উঠে বলল...
এই বিবু, ওই দ্যাখ ফুচকা। এ কতদিন খাই না রে, চল চল...
আমিও সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে একগাল হেসে বললাম...
হ্যা চল, ফুচকাকে না বললে ভগবান পাপ দেয়।
তারপর আর কি, দুজনে মিলে জমিয়ে তখন বিভিন্ন সাইজের ফুচকাগুলোকে উদরস্ত করতে করতে ফুচকাওয়ালা কাকুকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে চলেছি কখনো ফুচকার সাইজ নিয়ে আবার কখনো টক জল নয়তো আলু মাখা নিয়ে... তখন আমি পনেরো নম্বর ফুচকাটা সবে মাত্র গালে ঢুকিয়ে আরাম করে চিবিয়ে তার স্বাদ নিচ্ছি ঠিক তখনই রূপু সামনে কিছু একটা দেখে চমকে উঠে বলল...
ওই দ্যাখ বিবু, ওটা তোর হাঁদারাম না?
রূপুর কথায় আমিও যাহোক করে আধ খাওয়া ফুচকার টুকরোগুলোকে পেটে চালান করে সামনে তাকিয়ে দেখি, হ্যা সত্যিই তো। ওইতো ওই ফুটে হাঁদারাম দাঁড়িয়ে রয়েছে আর এই শার্ট-জিন্সেই তো সকালে ওকে বেরোতে দেখলাম কিন্তু ব্যাটা এখন এই চারটের সময় এখানে কি করছে?
এই প্রশ্নটা যখন সবেমাত্র আমার মনের ভেতরে নিজের জায়গাটা ভালো করে সেট করে নিচ্ছে ঠিক তখনই রূপুও আমার ভাবনাগুলোকে শব্দে রূপ দিয়ে বলল...
এ ভাই, এই ছেলে এখন এখানে কি করছে রে? এর তো এখন ব্যাঙ্কে থাকার কথা... কাউকে লাইন-ফাইন মারছে নাকি রে ইউনিভার্সিটির..?
হ্যা সত্যিই তো, রূপুর কথাটা তো ভেবে দেখার মত। যে ছেলে কিনা রোজ মাকে বলে যায়, মা আসছি সেই ছেলেই আজ এত ইসটাইল মেরে ফুলবাবু সেজে পুরো ঝিঙ্কু লুক নিয়ে এখানে এইট বি এর কাছে কি করছে? এমনিতেই যাদবপুর আর এইট বি বাসস্ট্যান্ড প্রেমের লীলাক্ষেত্র তাই এখানে এসেছে মানে শিওর কোনো ঘাপলা কেস আছে। এইসব কথাই যখন আবার আমার মাথার ভিতর সকালের মত কিলবিল করতে শুরু করেছে ঠিক তখনই আবার রূপু আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল...
কি রে বিবু, কি এত ভাবছিস? আর ব্যাটা তো তোদের ফ্ল্যাটের ওপরেই থাকে তাহলে তুই কিছু জানিস না এই ব্যাপারে?
এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে নতুন পাড়ায় এই ফ্ল্যাটে শিফট হবার পর রূপুর সাথেই আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়। কিভাবে যেন আমাদের দুজনের ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করে গেছিল আর তারপর কিভাবে যে দুজনে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম সেকথা আমরা নিজেরাও জানি না। তাই ন্যাচারালি সব কথার মত হাঁদারামের কথাও আমি রূপুকে জানিয়েছিলাম এছাড়াও এক পাড়ায় থাকার জন্য রূপুও হাঁদারামকে চেনে আর মোটামুটি ওর বিষয়ে সবকিছু জানে ও...
রূপুর কথায় আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম...
আশ্চর্য তো, ওর খবর আমি কি করে জানব? আমি কি ওর গার্লফ্রেন্ড নাকি বিয়ে করা বৌ যে ওর সব ঠিকুজি-কুষ্ঠি, কোথায় কখন যায় আসে সব আমি জেনে বসে থাকব... হাঁদাটা তো আমাকে দেখলেই এমন ভাব করে যেন আমি বাঘ, ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ব। আস্ত উজবুক একটা, ওর মত হাঁদারামের খবর রাখতে আমার বয়েই গেছে। ফুচকা খাওয়ার মুডটাই পুরো বিগড়ে দিলি ধুত... বলে পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি গটগট করে এগিয়ে গেলাম আর শুনলাম রূপুর চিৎকার...
এই বিবু ওয়েট আমি আসছি..!
......
বেশ কয়েকদিন পরের কথা, আমি তখন দাঁড়িয়ে আছি ফ্ল্যাটের ছাদে। এই বিকেল বেলার সময়টা আমার একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে বড্ড ভালো লাগে। হালকা ফুরফুরে হাওয়া, সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম দিকে আর তার মরা আলোর লাল আভায় ভরে যাচ্ছে আকাশের সবটুকু কোণা... সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সব পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের বাসায়... এই অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যটা আমাকে ভীষণ টানে তাই প্রায়ই আমি ছাদে এসে নিজের একাকীত্বটাকে উপভোগ করি এই পরিবেশের সাথে... প্রতিদিনের মত আজও পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে সূর্যের মিলিয়ে যাওয়া দৃশ্য উপভোগ করছি ঠিক তখনই কারোর পায়ের শব্দে আমার চমক ভাঙল... পিছনে ফিরে দেখি ও বাবা, এ যে হাঁদারাম। কিন্তু এখন এই সময়ে ব্যাটা এখানে কি করছে? পরে মনে পড়ল আজ তো রবিবার তাই বাবু ছুটির দিনে ছাদে হাওয়া খেতে এসেছেন। পরণে একটা কালো ট্র্যাক প্যান্ট আর সাদা রঙের টি-শার্ট, এই সামান্য ড্রেসেই হাঁদাটাকে বেশ লাগছে কিন্তু... অবশ্য এরকম হ্যাণ্ডু হলে সব পোশাকেই মানিয়ে যায়। ওদিক হাঁদারামও ভাবেনি যে এই সময় আমাকে এখানে দেখবে তাই বেচারা নিজেও হকচকিয়ে গেছে... ওর চোখ-মুখ দেখে মনের অবস্থা বুঝে নিতে সমস্যা হল না আমার এছাড়া আমি নিজেও ওর সাথে থাকতে অত কমফর্টেবল ফিল করি না তাই ভাবলাম ছেলেটা একদিন ছাদে এসেছে, ও-ই নয় থাকুক আমি নাহয় পরে আসব... এই ভাবনা মতই সবেমাত্র ওর পাশ কাটিয়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক তখনি গম্ভীর গলায় নির্ঝর বলে উঠল...
দাঁড়াও বিবৃতি, তোমার সাথে আমার কথা আছে।
কি হল, কি ভাবছেন হঠাৎ হাঁদারাম ছেড়ে কেন নির্ঝর বললাম? বিশ্বাস করুন ছেলেটা যেরকম গাম্ভীর্যের সাথে আমাকে ডাকল তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি যেন ফ্রিজ হয়ে গেলাম...! তাছাড়া এতদিন ভাবতাম ব্যাটাচ্ছেলের আমার ওপর নজর অবধি দেয়নি কখনো কিন্তু এখন দেখছি এ আমার নামও জানে। এই কেসটা কি হল? কোনো ঘাপলা করেছি বলে তো মনে পড়ছে না তাহলে আমাকে হঠাৎ দাঁড়াতে বলল কেন, আর কি কথা বলতে চায় তাও আবার আমার সাথে... এইসব চিন্তাই মাথার মধ্যে একসাথে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তাই আমার সবসময় চলতে থাকা মুখটাও কিছু সময়ের জন্য নিজের ঝাঁপ বন্ধ করেছিল আর সেই সুযোগেই হাঁদারাম বলল...
তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে, তোমার কাছে কি একটু সময় হবে আমাকে দেওয়ার জন্য?
লে পচা, এটা কি হল? মোহাব্বতের অমিতাভ থেকে ডাইরেক্ট ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া-র সল্লুতে কনভার্ট হয়ে গেল কি করে এই ছেলে? আবার বলে কি না জরুরি কথা... ভয় আর চিন্তায় তখন আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু হয়ে গেছে। আমি বিবৃতি বসু কিনা হাঁদারামের ভয়ে... নো ওয়ে! তাই নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক করে বেশ প্রশ্নের সুরেই বললাম...
জরুরি কথা, আমার সাথে? আর আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?... যার সাথে আজ পর্যন্ত হাই-হ্যালোটুকুও ঠিকমত হয়নি আর বয়সে যে মানুষটা আমার থেকে বড় তাকে হঠাৎ করে তুমি বলতে আমার কেমন একটা বাধো বাধো ঠেকল তাই আপনি করেই বললাম। কিন্তু বদলে হাঁদাটা যা উত্তর দিল তাতে আমি শকড্ হয়ে গেলাম...
ব্যাটাচ্ছেলে বলে কিনা...
যে মানুষটা সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে এত ভাবে এমনকি আমাকে বেশ অনেকগুলো ইউনিক নামে যে ডাকে.. যে আমাকে জানলা দিয়ে দেখে তার নাম না জানাটাই তো অপরাধ তাই না?
এই কেস করেছে, এ ব্যাটা তার মানে দেখেছে আমি সেদিন ওকে জানলা দিয়ে দেখছিলাম আর ইউনিক নামে ডাকে মানে ও কি এটাও জানে নাকি যে আমি ওকে হাঁদারাম বলে ডাকি? সর্বনাশ করেছে, সব কথা মায়ের কানে তুলবে নাকি... তাহলে তো আজ আমি শেষ... ! প্রচণ্ড ভয়ে একটা ঢোক গিলে বললাম...
আমি ঠিক বুঝলাম না আপনি কি বলছেন?
বুঝলে না নাকি সব বুঝেও না বোঝার ভান করছো, হুম... নিজের মুখটা আমার মুখের কাছে নিয়ে এসে বলল নির্ঝর। শুধু তাই নয় কথাগুলো বলার সময় ওর চোখে যে ভীষণরকম দুষ্টুমি মিশে ছিল এমনকি আমার ভয় পাওয়া মুখটাও ও ভীষণভাবে এনজয় করছিল এটাও বুঝতে পারলাম...
তাই মনে মনে ভয়টা চেপে ধরলেও সেই ভয়ের চিহ্ন চেহারায় ফুটে উঠতে না দিয়ে বেশ ঝাঁঝ দেখিয়েই বললাম...
অদ্ভুত কথা তো, আপনি কি বলছেন সে আপনি জানেন আমি কিভাবে সেটা বুঝব শুনি?
ওহ্ তাই! বুঝতে পারছো না... বেশ আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি... বলতে বলতে নির্ঝর আমার দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল আর আমি না চাইতেও পিছিয়ে যেতে লাগলাম... সেই সময় ওকে কোনো অ্যাঙ্গেল দিয়েই হাঁদারাম মনে হচ্ছিল না বরং ভীষণ ধূর্ত কোনো শিকারী আর নিজেকে সেই শিকারীর ফাঁদে আটকে পড়া শিকার বলে মনে হচ্ছিল...
এগিয়ে আসতে আসতেই নির্ঝর বলতে থাকে...
তোমার প্রথম প্রশ্ন আমি তোমার নাম জানলাম কিভাবে? এর উত্তর খুব সোজা, যে মেয়ে কথায় কথায় আমাকে হাঁদারাম বলে চিৎকার করে আর যার চিৎকার নিচের থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের উপরের ফ্ল্যাট অবধি শোনা যায় তার নাম বা ডাকনাম জানাটা কি এতই কঠিন স্পেশালি যখন তোমার এবং আমার মায়ের এত ভালো সম্পর্ক। আর সেকেন্ড আমার জরুরি কথা হল...
নির্ঝরের কথা শেষ হল না তার আগেই নিজের পিছনে শক্ত কিছু অনুভব করেই চমকে উঠে বুঝলাম যে সত্যিই এবার আমার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আর সামনে যেভাবে এই ছেলে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে পালানোর উপায়টুকুও নেই। ব্যাটাচ্ছেলে আমার দিকে তখনও সেই দুষ্টুমি মাখা চোখেই তাকিয়ে রয়েছে আর এতক্ষণে ঠোঁটের কোণের হাসিটাও দেখছি কিছুটা চওড়া হয়েছে। ওর হাবভাব দেখে ততক্ষণে আমি দরদর করে ঘামতে শুরু করেছি... বুকের বাঁদিকে কেউ যেন ফুল ভলিউমে ড্রাম বাজাচ্ছে আর সেই আওয়াজে আমার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম... কিন্তু এভাবে ভয় পেলে তো চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে পালাতেই হবে তাই আড়চোখে এদিক ওদিকে তাকাতে লাগলাম যে কিভাবে নিজেকে এই খড়ুশটার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি... আমার মুখ দেখে মনে হয় নির্ঝর আন্দাজ করেছিল আমার মনের ভাব তাই যে মুহূর্তে একটা ঢোক গিলে ওকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে গেলাম ঠিক তখনি ব্যাটাচ্ছেলে নিজের শক্ত দুটো হাতে আমার হাত দুটোকে ধরে দেওয়ালের সাথে আমাকে ঠেসে ধরে তারপর নিজের হাতের সাহায্যে আমার দুপাশ দিয়ে দেওয়ালে এমনভাবে একটা অভেদ্য বেষ্টনী গড়ে তুলল যে আমার পক্ষে পালানো অসম্ভব হয়ে গেল... এইরকম ঘটে যাওয়ায় আমি সত্যিই তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছি যার ফলে থরথর করে কাঁপছি আর চোখ দুটো সজোরে একে অপরের সাথে চেপে ধরেছি...
আমাকে ওইভাবে দেখে আবারও নির্ঝর আমার মুখের একটু কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে বলল...
এখনি চলে গেলে হবে, শুনবে না তোমার সাথে আমার জরুরি কথাটা কি?
আমার অত কাছে থাকায় নির্ঝরের তপ্ত নিশ্বাস আমার মুখে আছড়ে পড়ছে যার ফলে নিজের ভিতরের অস্বস্তিটা ভীষণভাবে টের পাচ্ছিলাম। ওই কথাটা বলেই নিজের মুখটা এবার আমার কানের কাছে নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল...
খুব তো বলো যে আমি রোজ মাকে কেন বলে যাই অফিস যাওয়ার আগে, মা আসছি। কেন বলি না যে ও বৌ আসছি তাই তো? তাই আমি ঠিক করেছি এবার মাকে রেহাই দিয়ে বৌকেই বলব যে ও বৌ আমি আসছি আর সেটা কাকে বলতে চাই জানো, তোমাকে... শুনবে নাকি আমার মুখে, ও বৌ আমি আসছি... কথাটা বলেই নির্ঝর হালকা করে আমার কানে একটা ফু দিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে ছাদ থেকে চলে গেল...
এদিকে এতক্ষণ নির্ঝর কি বলে গেল তার সবটাই ভয়ের চোটে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছিল কিন্তু যখন পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে শুনলাম তখন বুঝলাম যে সত্যিই এবার আমি মুক্ত। বুকের ভেতরের ড্রামটা তখনও বেজে চলেছে এমনকি কানের কাছের সেই তপ্ত নিশ্বাস এখনো যেন অনুভব করতে পারছি তবুও ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে দেখলাম যে নাহ্ ছেলেটা চলে গেছে কিন্তু তিড়িং করে আমার মাথায় ঘন্টা বেজে উঠল আর আমি নিজেকেই বললাম...
এই... এই... ব্যাটাচ্ছেলে কি বলে গেল এখনি, ও নাকি নিজের বৌকে বলতে চায় অফিস যাওয়ার আগে আর সেই কথাটা ও আমাকে... মানে... আমি... শেষে আমিই কিনা হাদারামের বৌ... মানে... মানে... অ্যাএএএএ... শেষে এই ছিল আমার কপালে...
........
এইসব কথাই এতক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে নিজেই একা হাসছিলাম সেই একই ছাদে.. একই সময়ে.. একলা দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেবেলায়... হঠাৎই কোমরে দুটো বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শে চমকে উঠলেও পরমুহুর্তেই আমার ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু চওড়া হল। কানের কাছে আবারো সেই তপ্ত নিশ্বাস আর সাথে গম্ভীর তথা আদুরে কন্ঠস্বর...
আমার কথা ভাবছিলে বুঝি?
উহ্, তোমার মত হাঁদারামের কথা ভাবতে আমার বয়েই গেছে... হালকা হেসে উত্তর দিলাম।
তাই বুঝি? তাহলে আজ থেকে একবছর আগে এই হাঁদারামের গলায় মালা দিয়েছিলে কেন শুনি... ছেলেমানুষী সুরে বলল হাঁদারাম ওরফে নির্ঝর যে এখন আমার স্বামী।
হ্যা, ঠিকই ধরেছেন গত একবছর আগে এই হাক্ষদারামের সাথেই আমি সাত পাকে বাঁধা পড়েছি। আর আজ আগের মতই ছাদে একলা দাঁড়িয়ে সেই পুরোনো স্মৃতিই মনে করছিলাম আর একাই হাসছিলাম... আমরা ওই ফ্ল্যাটেই থাকি তবে আলাদা ফ্লোরে। নির্ঝর আর আমি দুজনের কেউই নিজেদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হতে চাইনি তাই এই ফ্ল্যাটেরই থার্ড ফ্লোরে নিজেদের ছোট্ট একটা সংসার সাজিয়ে নিয়েছি।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে নির্ঝর আবার বলল...
কি হল বললে না তো কেন তাহলে রাজি হয়েছিলে আমার প্রস্তাবে?
ঠোঁটের কোণে ফাজিল হাসি ফুটিয়ে বললাম...
কি করব বলো, তুমি যেভাবে রিকোয়েস্ট করলে যে মামণিকে রেহাই দিয়ে আমাকেই বলে যেতে চাও অফিস যাওয়ার আগে, সেটা আর ফেলতে পারলাম না। আফটার অল, হাঁদারাম বলে কথা...
আমার কথায় নির্ঝর চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালেও পরক্ষণেই হা.. হা.. করে হেসে উঠে আলতো করে আমার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল...
ওহ্ আমি যদি হাঁদারাম হই তাহলে তুমি কি শুনি?
আমিও একইভাবে নির্ঝরের গালে চুমু একে দিয়ে হেসে বললাম...
আমি হাঁদারামের বৌ...!
©কলমে অরু। ( স্বত্ব সংরক্ষিত )
#হাঁদারামের_বৌ
#কলমে_অরু(অরুণিমা নাথ)
সোনাই... অ্যাই সোনাই... সোনাই... কানে কি কথা যাচ্ছে না নাকি... সোনাই... বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন একজন বছর পঞ্চাশের মধ্যবয়স্কা মহিলা। পরণে সাধারণ শাড়ি যার আঁচলটা কোমরে গোজা রয়েছে এবং ডান হাতে একটি স্টিলের খুন্তি ধরা, যা থেকে বোঝা যায় মহিলা রান্না করতে করতেই এখানে ছুটে এসেছেন। এই মুহূর্তে তার মুখখানা যথেষ্ট পরিমাণে লাল বর্ণ ধারণ করেছে এবং দুচোখেও স্পষ্ট রাগের ঝলক দেখা যাচ্ছে... তার দৃষ্টি স্থির হয়ে রয়েছে ঘরের একেবারে মাঝামাঝি অংশে রাখা বিছানার ওপর ঘুমিয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে... মেয়েটি ঘুমিয়ে থাকলেও তার ঠোঁটের কোণে আলতো একটা হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে যা থেকে অনুমান করা যায় যে হয়তো মেয়েটি কোনো মিঠে স্বপ্নের আবেশে বিভোর হয়ে রয়েছে... মহিলাটি আরো কয়েক মুহূর্ত মেয়েটির দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকার পরে দুই কদম এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাসটি তুলে গ্লাসে থাকা জলটা সজোরে ছুঁড়ে দিলেন সেই মেয়েটির ঘুমন্ত মুখ লক্ষ্য করে... আচমকাই নিজের মুখে এভাবে জলের আক্রমণে মেয়েটি "বৃষ্টি.. বৃষ্টি... ছাদ ফুটো হয়ে গেছে... সব ভেসে যাবে মা..." বলতে বলতে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে, তারপর চারদিকে নজর বুলিয়ে অবাক হয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বলে...
কি হল, কোথায় বৃষ্টি?
তারপর নিজের মুখে হাত দিয়ে ত্বকের সিক্ততা অনুভব করে বলে...
এই তো জল, তাহলে এটা কোথা থেকে এল?... বলতে বলতেই তার নজর পড়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে যিনি বর্তমানে তার দিকেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন...
মেয়েটি কিছু বলার আগেই সেই মহিলা বেশ ব্যঙ্গের সুরে বলে ওঠেন...
তা বলি মহারাণীর ঘুম ভাঙল নাকি আরো এক গ্লাস জল ঢালব?
মেয়েটি তখন দুহাতে চোখ রগড়ে বেশ কিছুটা আড়মোড়া ভেঙে এবং শেষে একটা বড় হাই তুলে জড়ানো গলায় বলে...
উফ্ মা কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম আমার সল্লুকে নিয়ে... সল্লু আর আমি ইতালিতে বেড়াতে গেছি... চারদিকে কত বরফ... সল্লু আমাকে গোলাপ হাতে প্রপোজ করছে... কিন্তু তুমি এসে সব ভণ্ডুল করে দিলে ধুর... মুখ পেঁচিয়ে বলে মেয়েটি ওরফে সোনাই।
এই যে খুন্তি দেখছো, এইটার বাড়ি পিঠে এক ঘা পড়লে না, সব স্বপ্ন জানলা দিয়ে পালাবে... সকাল আটটা বাজে, এই ধিঙ্গি মেয়ের এখনো ঘুম ভাঙল না... বলছি ইউনিভার্সিটি কি আমি যাবো নাকি ওটাকে তোমার এই বাবার বাড়ির হোটেল পেয়েছো যে যখন খুশি যাবে আর তোমাকে ক্লাসে ঢুকতে দিয়ে দেবে?... চিৎকার করে ওঠেন মহিলাটি ওরফে সোনাইয়ের মা।
উফ্ মা, কুল ডাউন! সবে আটটা বাজে এখনো তিন ঘন্টা দেরী আছে। কত দিন পরে জমিয়ে একটু স্বপ্ন দেখছিলাম দিলে সবটা পণ্ড করে... এক এক সময় খুন্তি হাতে এমন মা কালী হয়ে যাও না কি বলব... বিকৃত মুখে বলে সোনাই।
আর একটা কথাও শুনলে না এই গরম খুন্তির একটা মারও বাইরে পড়বে না বলে দিলাম... ওঠ্, শিগগির ওঠ... আগে বাথরুমে যা... পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি নিচে টেবিলে না দেখেছি তাহলে সত্যি সত্যিই এই খুন্তি তোর পিঠে ভাঙব বলে দিলাম... তেইশ বছর বয়স হয়ে গেল এখনো নবাবজাদীর ধিঙ্গিপনা গেল না...
ওহ্ মা চিল! বারবার ওই খুন্তির ভয় দেখিয়ে লাভ নেই সেকথা তুমিও জানো আর যতক্ষণ তুমি এখানে দাড়িয়ে আমার পিছনে টাইম ওয়েষ্ট করছো ততক্ষণে তোমার খুন্তি আর রান্না দুটোই ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে... আর সবসময় বয়সের খোটা দেবে না তো, আমি এখনো যথেষ্ট বাচ্চা আছি... বিছানা থেকে নামতে নামতে উত্তর দেয় সোনাই।
তবে রে... সোনাইয়ের কথায় তার মা তেড়ে আসলে সোনাই... "ও বাবা গো, তোমার মেয়েকে মেরে ফেলল তোমার পাগল বৌ..." বলেই একছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলে...
বাপ রে, খুব বাঁচান বেঁচে গেছি আজ নাহলে সত্যিই আজ ওই খুন্তি আমার পিঠে পড়তই.. মাদার ইণ্ডিয়া যা খেপেছে আজকে, মাথার ওই আগুন শান্ত হওয়াটা হেবি চাপের...
ওদিকে তখনও তিনি চিৎকার করে চলেছেন বাইরে থেকে...
কতবার বলেছি দেখ দেখে শেখ কিছু নির্ঝরের থেকে, কি ভালো ছেলেটা... যেমন পড়াশোনা তেমনি স্বভাব চরিত্রে। সি.এ পাশ করে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেল এইটুকু বয়সে আর উনি এখনো ধেই ধেই করে নেচে চলেছেন সারাদিন আর ইউনিভার্সিটি গিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন... মা-বাবার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান নেই আর ওদিকে নির্ঝর প্রতিদিন অফিসে বেরোনোর আগে কি সুন্দর তনুজা দিকে বলে যায় "মা, আমি আসছি"... আর এক আমার মেয়ে, ভোর রাত অবধি জেগে সাত বেলায় ঘুম থেকে উঠবে আর নাকেমুখে গুজে ছুটবে... এ জীবনে বোধহয় আমার আর শোনা হল না যে মা আমি আসছি...
এদিকে ভিতর থেকে এই সব কথাই সোনাইয়ের কানে খুব সুন্দরভাবে পৌঁছে যাচ্ছিল... এতক্ষণ মায়ের এমন মধুর বচনে সকাল সকাল নিজের কান দুটোকে সার্থক করে অবশেষে সে মুখ খোলে...
বলছি মা, তোমার মেয়ের না এখনো এম.এ টা শেষ হয়নি হ্যা, ওটা শেষ হলে যখন চাকরি পাব তখন আমিও ওই হাঁদারাম মানে তোমার নির্ঝরের মত বলে যাব যে আমি আসছি...
হ্যা.. হ্যা... দেখব কত চাকরি পাও! চাকরি তো ছেলের হাতের মোয়া না, যখন চাইবে তখনই দোকান থেকে কিনে এনে হাতে ধরিয়ে দেবে... লোকজন তো বসে রয়েছে ওনাকে চাকরি দেওয়ার জন্য... পড়াশোনার যা বহর তাতে এম.এ টা টেনেটুনে পাস করলে হয়... হা ভগবান, আমার গর্ভেই এমন একটা উড়নচণ্ডী মেয়ের জন্ম দিতে হল...
এই যে মাদার ইণ্ডিয়া, ভগবানকে বলে লাভ নেই তার থেকে বরং তুমি গিয়ে এখন রান্নাটা শেষ করো নাহলে বাবা বাজার থেকে বাড়ি ফিরে তোমার ওপর খেপে লাল হয়ে যাবে তাই আমার ওপর ঝাল পরে ঝেড়ে এখন গিয়ে রান্নাটা শেষ করো। আমার কিন্তু এখন থেকেই পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে, টেবিলে খাবার না পেলে কিন্তু আমি না খেয়েই চলে যাব এই বলে দিলাম... ভিতর থেকে বলে সোনাই।
অসহ্য.. অসহ্য... জ্বলে গেল জীবন আমার এই মেয়ে নিয়ে... বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি।
যাক মা গেছে এবার আপনাদের সাথে একটু ঠিকমত কথা বলতে পারব... এই যে যিনি এখনি আমার ষষ্ঠীপুজো করে গেলেন তিনি আমার মা জননী শ্রীমতী তমালিকা বসু, আমার বাবা যিনি এখন বাজারে গেছেন তার নাম শ্রীযুক্ত তমাল বসু এবং আমি তাদের একমাত্র মেয়ে বিবৃতি বসু ওরফে সোনাই। আমার বয়স এখন তেইশ, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে আমি বাংলায় মাস্টার্স করছি। তাই বলে ভাববেন না সারাক্ষণ আমি কঠিন কঠিন বাংলা কপচাই... নেহাত ছোটবেলা থেকে এই সাবজেক্টে ভালো ছিলাম আর এইচ এসেও ভালো নম্বর ছিল তাই বাংলার ঘাড় ধরেই ঝুলে পড়লাম, যতই হোক মাতৃভাষা বলে কথা... এই তমালিকা দেবী মানে আমার মা এতক্ষণ ধরে আমার পিছনে বেগার খাটছিলেন তার কারণ হল আমার দেরীতে ঘুম থেকে ওঠা। আচ্ছা এখানে আমার কি দোষ বলুন তো তাড়াতাড়ি ঘুম না ভাঙলে... কাল রাতে সল্লু মানে সলমন খানের হেব্বি ঝিঙ্কুমার্কা একটা রোমান্টিক সিনেমা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেছিল ঘুমাতে... এদিকে সল্লু হল আমার জানেমন, আমার দিল কা টুকড়া, আমার ফেবারিট হিরো তাই সল্লুর সিনেমা না দেখলে ভগবান আমাকে পাপ দেবে না তাইতো সিনেমাটা শেষ করে ঘুমোতে গেলাম... আর স্বপ্ন দেখলাম সল্লু আর আমি ইতালিতে বেড়াতে গেছি... চারিদিকে সাদা বরফের চাদর বিছিয়ে রয়েছে... সল্লু একটা গোলাপের তোড়া নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করছে আর যখনি আমি সেই প্রপোজাল আ্যাকসেপ্ট করে ফুলগুলো নিতে গেলাম ঠিক তখনি এই মাদার ইণ্ডিয়া রণচণ্ডী হয়ে এসে আমার স্বপ্নে মানে আমার মুখে জল ঢেলে সল্লুর প্রপোজালের বারোটা বাজিয়ে দিল... বাকি যা কিছু তার সবটাই তো আমার মায়ের থেকেই জেনে গেছেন তাহলে এবার তার বিষয়ে বলি যার সাথে মাদার ইণ্ডিয়া আমার তুলনা করছিল। নির্ঝর মিত্র ওরফে হাঁদারাম। বলছি বলছি কেন আমি ওকে হাঁদারাম বলে ডাকি... আমাদের ফ্ল্যাটের উপরের তলায় থাকে মিত্র ফ্যামিলি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তনুজা আন্টির সাথে মায়ের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই ফ্ল্যাটে আমরা এবং ওরা প্রায় একই সাথেই শিফট করেছিলাম তাই হয়তো সখ্যতা হতে বেশি সময় লাগেনি। ওদিকে বাবার সাথে রাজদীপ আঙ্কেলেরও ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব কিন্তু এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম হলাম আমি আর নির্ঝর। ওই হাঁদারামটার নামে আর কি বলব, সবটাই তো মা বলে দিল। কিন্তু সত্যি বলছি আমার না ওই নির্ঝরকে একদম সহ্য হয় না বিশ্বাস করুন। তুই ব্যাঙ্কে চাকরি করিস কোথায় ঠাটবাট নিয়ে চলবি, বন্ধুদের সাথে ঘুরবি-বেড়াবি-হ্যাং আউট করবি তা না উনি লতানো লাউডগার মত প্রতিদিন ঠিক টাইমে অফিস যাবেন আর অফিস থেকে ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। কি করছে জিজ্ঞাসা করলে বলবে কাজ করছি। কাজ না হাতির মাথা! আমার তো ডাউট হয় ব্যাটা তলে তলে অন্য কিছু করে। মাঝেমধ্যেই মা ভালোমন্দ রান্না করলে মিত্র বাড়িতে দিয়ে আসতে বলে আমাকে, কতবার বলেছি যাব না ওই হাঁদারামের বাড়িতে কিন্তু আমার কথার কোনো মূল্য আছে নাকি এই বাড়িতে... উল্টে ধমক খেতে মায়ের কাছে যে কেন ওনার আদরের নির্ঝরকে আমি হাঁদারাম বলছি। বিশ্বাস করুন ওইরকম একটা গোপাল অতি সুবোধ বালক টাইপের ছেলেকে হাঁদারাম না বলে আর কি বলব... যখনই ওদের বাড়ি গেছি আজ অবধি একটা কথা বলা তো দূর চোখ তুলে আমার দিকে তাকায় নি অবধি... নয়তো হা করে বসে ক্রিকেট গিলেছে নয়তো ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে থেকেছে আর নয়তো ডাইনিং টেবিলে বসে এমনভাবে মাথা নিচু করে খেয়েছে যেন আমার দিকে তাকালেও ওর ব্রহ্মচর্য ভেঙে যাবে... যতটুকু জানি হাঁদারাম আমার থেকে বছর চারেকের বড় তাহলে ওর বয়স আন্দাজ সাতাশ কি আঠাশ। এই বয়স থেকেই মোটামুটি ছেলেরা বিয়ের প্ল্যান করতে শুরু করে তা বাপু তুইও কর না কিন্তু না উনি ওইসব করবেন না কারণ উনি মনে হয় আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাইতো প্রতিদিন অফিস যাওয়ার আগে বলে যায় 'মা, আমি আসছি'। কোথায় বিয়ে থা করে মাকে রেহাই দিয়ে বৌকে নরম সুরে বলে যাবি যে 'ও বৌ, আমি এলাম' তা নয়, উনি সেই মায়ের ঘাড়েই চেপে বসে থাকবে। তবে যতই রাগ করি না কেন এটা অস্বীকার করার জো নেই যে হাঁদারামকে কিন্তু এক কথায় ফার্স্ট ক্লাস দেখতে... ওইরকম হ্যাণ্ডু মার্কা চেহারা, ক্লিন শেভেন মুখ, কাটা কাটা নাক-চোখ, ওইরকম হাইট আর হালকা হালকা মাসলওয়ালা বডি... এইরকম পারফেক্ট কম্বিনেশনের ছেলে আমাদের এই পাড়ায় কটা আছে হাতে গুণে বলা যায়। আমার ঘরের একটা জানলা ফ্রন্ট ফেসিং হওয়ায় মেন গেট থেকে কেউ বেরোলেই সেটা আমার চোখে পড়ে। তাই ওই হাঁদারামটাও যখন ফিটফাট হয়ে ফুল বাবু হয়ে অফিস যায় তখন না চাইতেও আমার চোখটা ওর দিকে একবার হলেও চলে যায়... কিন্তু তাই বলে ওর ওপর ক্রাশ, নৈব নৈব চ কারণ আমার ক্রাশ তো আমাদের ফ্ল্যাটের অপোজিটের মুখার্জি বাড়ির একমাত্র ছেলে রক্তিম। মানছি হাঁদারাম সুন্দর কিন্তু রক্তিমও কোনো অংশে কম যায় না... ও যখন নিজের ঘরের সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে তখন হা করে আমি ওর হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি... রক্তিম আমার মনের কথা বোঝে কি না কে জানে তবে দেখা হলেই যে কিলার স্মাইলটা দেয় না উফ্ আমি ওখানেই ক্লিন বোল্ড..! আর এই এক হাঁদারাম, রাস্তাঘাটে এমনকি লিফটে ওঠার সময়ও যদি কখনো একসাথে আসি তবুও ব্যাটা মুখ ফুটে দুটো কথা বলে না এমন উটকো ছেলে একটা... আমিও কথা বলি না। কেন বলব নিজে থেকে তাই আমারও ভারি বয়ে গেছে, হুহ্..! এই দেখেছেন আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন এতটা সময় পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করি নি। যাই এবার কাজ সারি নাহলে ওদিকে আবার মাদার ইণ্ডিয়া তাণ্ডব করতে শুরু করে দেবে...
.......
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিলাম ইউনিভার্সিটি যাব বলে হঠাৎ জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়লে দেখি হাঁদারাম ফুল বাবু সেজে চললেন অফিসে... তবে মানতে হবে বস, এই ডার্ক ব্লু শার্ট আর লাইট ব্লু জিন্সে নির্ঝরকে দারুণ লাগছে। অবশ্য যা গায়ের রং তাতে ওকে সবকিছুতেই মানিয়ে যায় সাথে আজকে আবার চুলে জেল লাগিয়েছে মনে হচ্ছে? উম্, ব্যাপার কি? কারোর জন্য ছিপটিপ ফেলতে যাচ্ছে নাকি... না ব্যাঙ্কে নতুন মেয়ে কলিগ এসেছে যাকে ইমপ্রেস করার জন্য বাবুর এত সাজ... এই.. এই.. এই... আমি মরতে ওই হাঁদাটার কথা ভাবছি কেন? আর কি বলে ডাকছিলাম যেন, নির্ঝর... আহ্...! আমার মাথা গেছে... এ শিওর ওই জল ঢালার ফল। মায়ের জন্য আমার সল্লুকে আই লাভ ইউ টু বলা হল না আর এখন এই হাঁদারামটা আমার মাথায় চেপে বসছে সকাল সকাল ওর নামের পাঁচালি শোনার জন্য... বিবু রে, এত অধপতনের আগে তুই পাগল হলি না কেন রে... মাথা চাপড়ে যখন নিজেকে পাগল বানানোর চেষ্টা করছি ঠিক তখনি মাদার ইণ্ডিয়ার চিৎকার শুনে হাঁদারামের কথা ভুলে 'আসছিইইইই' বলে ছুট লাগালাম নাহলে আজকের ব্রেকফাস্টটুকুও আর জুটবে না কপালে শুধু গালমন্দ খেয়েই কলেজ যেতে হবে...
......
সেদিনই তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রূপু মানে রূপকথা দুজনে মিলে যাদবপুরের এইট বি বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম বাস ধরব বলে হঠাৎ রূপু লাফিয়ে উঠে বলল...
এই বিবু, ওই দ্যাখ ফুচকা। এ কতদিন খাই না রে, চল চল...
আমিও সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে একগাল হেসে বললাম...
হ্যা চল, ফুচকাকে না বললে ভগবান পাপ দেয়।
তারপর আর কি, দুজনে মিলে জমিয়ে তখন বিভিন্ন সাইজের ফুচকাগুলোকে উদরস্ত করতে করতে ফুচকাওয়ালা কাকুকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে চলেছি কখনো ফুচকার সাইজ নিয়ে আবার কখনো টক জল নয়তো আলু মাখা নিয়ে... তখন আমি পনেরো নম্বর ফুচকাটা সবে মাত্র গালে ঢুকিয়ে আরাম করে চিবিয়ে তার স্বাদ নিচ্ছি ঠিক তখনই রূপু সামনে কিছু একটা দেখে চমকে উঠে বলল...
ওই দ্যাখ বিবু, ওটা তোর হাঁদারাম না?
রূপুর কথায় আমিও যাহোক করে আধ খাওয়া ফুচকার টুকরোগুলোকে পেটে চালান করে সামনে তাকিয়ে দেখি, হ্যা সত্যিই তো। ওইতো ওই ফুটে হাঁদারাম দাঁড়িয়ে রয়েছে আর এই শার্ট-জিন্সেই তো সকালে ওকে বেরোতে দেখলাম কিন্তু ব্যাটা এখন এই চারটের সময় এখানে কি করছে?
এই প্রশ্নটা যখন সবেমাত্র আমার মনের ভেতরে নিজের জায়গাটা ভালো করে সেট করে নিচ্ছে ঠিক তখনই রূপুও আমার ভাবনাগুলোকে শব্দে রূপ দিয়ে বলল...
এ ভাই, এই ছেলে এখন এখানে কি করছে রে? এর তো এখন ব্যাঙ্কে থাকার কথা... কাউকে লাইন-ফাইন মারছে নাকি রে ইউনিভার্সিটির..?
হ্যা সত্যিই তো, রূপুর কথাটা তো ভেবে দেখার মত। যে ছেলে কিনা রোজ মাকে বলে যায়, মা আসছি সেই ছেলেই আজ এত ইসটাইল মেরে ফুলবাবু সেজে পুরো ঝিঙ্কু লুক নিয়ে এখানে এইট বি এর কাছে কি করছে? এমনিতেই যাদবপুর আর এইট বি বাসস্ট্যান্ড প্রেমের লীলাক্ষেত্র তাই এখানে এসেছে মানে শিওর কোনো ঘাপলা কেস আছে। এইসব কথাই যখন আবার আমার মাথার ভিতর সকালের মত কিলবিল করতে শুরু করেছে ঠিক তখনই আবার রূপু আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল...
কি রে বিবু, কি এত ভাবছিস? আর ব্যাটা তো তোদের ফ্ল্যাটের ওপরেই থাকে তাহলে তুই কিছু জানিস না এই ব্যাপারে?
এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে নতুন পাড়ায় এই ফ্ল্যাটে শিফট হবার পর রূপুর সাথেই আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয়। কিভাবে যেন আমাদের দুজনের ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করে গেছিল আর তারপর কিভাবে যে দুজনে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম সেকথা আমরা নিজেরাও জানি না। তাই ন্যাচারালি সব কথার মত হাঁদারামের কথাও আমি রূপুকে জানিয়েছিলাম এছাড়াও এক পাড়ায় থাকার জন্য রূপুও হাঁদারামকে চেনে আর মোটামুটি ওর বিষয়ে সবকিছু জানে ও...
রূপুর কথায় আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম...
আশ্চর্য তো, ওর খবর আমি কি করে জানব? আমি কি ওর গার্লফ্রেন্ড নাকি বিয়ে করা বৌ যে ওর সব ঠিকুজি-কুষ্ঠি, কোথায় কখন যায় আসে সব আমি জেনে বসে থাকব... হাঁদাটা তো আমাকে দেখলেই এমন ভাব করে যেন আমি বাঘ, ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ব। আস্ত উজবুক একটা, ওর মত হাঁদারামের খবর রাখতে আমার বয়েই গেছে। ফুচকা খাওয়ার মুডটাই পুরো বিগড়ে দিলি ধুত... বলে পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি গটগট করে এগিয়ে গেলাম আর শুনলাম রূপুর চিৎকার...
এই বিবু ওয়েট আমি আসছি..!
......
বেশ কয়েকদিন পরের কথা, আমি তখন দাঁড়িয়ে আছি ফ্ল্যাটের ছাদে। এই বিকেল বেলার সময়টা আমার একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে বড্ড ভালো লাগে। হালকা ফুরফুরে হাওয়া, সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম দিকে আর তার মরা আলোর লাল আভায় ভরে যাচ্ছে আকাশের সবটুকু কোণা... সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সব পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের বাসায়... এই অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যটা আমাকে ভীষণ টানে তাই প্রায়ই আমি ছাদে এসে নিজের একাকীত্বটাকে উপভোগ করি এই পরিবেশের সাথে... প্রতিদিনের মত আজও পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে সূর্যের মিলিয়ে যাওয়া দৃশ্য উপভোগ করছি ঠিক তখনই কারোর পায়ের শব্দে আমার চমক ভাঙল... পিছনে ফিরে দেখি ও বাবা, এ যে হাঁদারাম। কিন্তু এখন এই সময়ে ব্যাটা এখানে কি করছে? পরে মনে পড়ল আজ তো রবিবার তাই বাবু ছুটির দিনে ছাদে হাওয়া খেতে এসেছেন। পরণে একটা কালো ট্র্যাক প্যান্ট আর সাদা রঙের টি-শার্ট, এই সামান্য ড্রেসেই হাঁদাটাকে বেশ লাগছে কিন্তু... অবশ্য এরকম হ্যাণ্ডু হলে সব পোশাকেই মানিয়ে যায়। ওদিক হাঁদারামও ভাবেনি যে এই সময় আমাকে এখানে দেখবে তাই বেচারা নিজেও হকচকিয়ে গেছে... ওর চোখ-মুখ দেখে মনের অবস্থা বুঝে নিতে সমস্যা হল না আমার এছাড়া আমি নিজেও ওর সাথে থাকতে অত কমফর্টেবল ফিল করি না তাই ভাবলাম ছেলেটা একদিন ছাদে এসেছে, ও-ই নয় থাকুক আমি নাহয় পরে আসব... এই ভাবনা মতই সবেমাত্র ওর পাশ কাটিয়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক তখনি গম্ভীর গলায় নির্ঝর বলে উঠল...
দাঁড়াও বিবৃতি, তোমার সাথে আমার কথা আছে।
কি হল, কি ভাবছেন হঠাৎ হাঁদারাম ছেড়ে কেন নির্ঝর বললাম? বিশ্বাস করুন ছেলেটা যেরকম গাম্ভীর্যের সাথে আমাকে ডাকল তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি যেন ফ্রিজ হয়ে গেলাম...! তাছাড়া এতদিন ভাবতাম ব্যাটাচ্ছেলের আমার ওপর নজর অবধি দেয়নি কখনো কিন্তু এখন দেখছি এ আমার নামও জানে। এই কেসটা কি হল? কোনো ঘাপলা করেছি বলে তো মনে পড়ছে না তাহলে আমাকে হঠাৎ দাঁড়াতে বলল কেন, আর কি কথা বলতে চায় তাও আবার আমার সাথে... এইসব চিন্তাই মাথার মধ্যে একসাথে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তাই আমার সবসময় চলতে থাকা মুখটাও কিছু সময়ের জন্য নিজের ঝাঁপ বন্ধ করেছিল আর সেই সুযোগেই হাঁদারাম বলল...
তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে, তোমার কাছে কি একটু সময় হবে আমাকে দেওয়ার জন্য?
লে পচা, এটা কি হল? মোহাব্বতের অমিতাভ থেকে ডাইরেক্ট ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া-র সল্লুতে কনভার্ট হয়ে গেল কি করে এই ছেলে? আবার বলে কি না জরুরি কথা... ভয় আর চিন্তায় তখন আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু হয়ে গেছে। আমি বিবৃতি বসু কিনা হাঁদারামের ভয়ে... নো ওয়ে! তাই নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক করে বেশ প্রশ্নের সুরেই বললাম...
জরুরি কথা, আমার সাথে? আর আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?... যার সাথে আজ পর্যন্ত হাই-হ্যালোটুকুও ঠিকমত হয়নি আর বয়সে যে মানুষটা আমার থেকে বড় তাকে হঠাৎ করে তুমি বলতে আমার কেমন একটা বাধো বাধো ঠেকল তাই আপনি করেই বললাম। কিন্তু বদলে হাঁদাটা যা উত্তর দিল তাতে আমি শকড্ হয়ে গেলাম...
ব্যাটাচ্ছেলে বলে কিনা...
যে মানুষটা সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে এত ভাবে এমনকি আমাকে বেশ অনেকগুলো ইউনিক নামে যে ডাকে.. যে আমাকে জানলা দিয়ে দেখে তার নাম না জানাটাই তো অপরাধ তাই না?
এই কেস করেছে, এ ব্যাটা তার মানে দেখেছে আমি সেদিন ওকে জানলা দিয়ে দেখছিলাম আর ইউনিক নামে ডাকে মানে ও কি এটাও জানে নাকি যে আমি ওকে হাঁদারাম বলে ডাকি? সর্বনাশ করেছে, সব কথা মায়ের কানে তুলবে নাকি... তাহলে তো আজ আমি শেষ... ! প্রচণ্ড ভয়ে একটা ঢোক গিলে বললাম...
আমি ঠিক বুঝলাম না আপনি কি বলছেন?
বুঝলে না নাকি সব বুঝেও না বোঝার ভান করছো, হুম... নিজের মুখটা আমার মুখের কাছে নিয়ে এসে বলল নির্ঝর। শুধু তাই নয় কথাগুলো বলার সময় ওর চোখে যে ভীষণরকম দুষ্টুমি মিশে ছিল এমনকি আমার ভয় পাওয়া মুখটাও ও ভীষণভাবে এনজয় করছিল এটাও বুঝতে পারলাম...
তাই মনে মনে ভয়টা চেপে ধরলেও সেই ভয়ের চিহ্ন চেহারায় ফুটে উঠতে না দিয়ে বেশ ঝাঁঝ দেখিয়েই বললাম...
অদ্ভুত কথা তো, আপনি কি বলছেন সে আপনি জানেন আমি কিভাবে সেটা বুঝব শুনি?
ওহ্ তাই! বুঝতে পারছো না... বেশ আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি... বলতে বলতে নির্ঝর আমার দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল আর আমি না চাইতেও পিছিয়ে যেতে লাগলাম... সেই সময় ওকে কোনো অ্যাঙ্গেল দিয়েই হাঁদারাম মনে হচ্ছিল না বরং ভীষণ ধূর্ত কোনো শিকারী আর নিজেকে সেই শিকারীর ফাঁদে আটকে পড়া শিকার বলে মনে হচ্ছিল...
এগিয়ে আসতে আসতেই নির্ঝর বলতে থাকে...
তোমার প্রথম প্রশ্ন আমি তোমার নাম জানলাম কিভাবে? এর উত্তর খুব সোজা, যে মেয়ে কথায় কথায় আমাকে হাঁদারাম বলে চিৎকার করে আর যার চিৎকার নিচের থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের উপরের ফ্ল্যাট অবধি শোনা যায় তার নাম বা ডাকনাম জানাটা কি এতই কঠিন স্পেশালি যখন তোমার এবং আমার মায়ের এত ভালো সম্পর্ক। আর সেকেন্ড আমার জরুরি কথা হল...
নির্ঝরের কথা শেষ হল না তার আগেই নিজের পিছনে শক্ত কিছু অনুভব করেই চমকে উঠে বুঝলাম যে সত্যিই এবার আমার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আর সামনে যেভাবে এই ছেলে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে পালানোর উপায়টুকুও নেই। ব্যাটাচ্ছেলে আমার দিকে তখনও সেই দুষ্টুমি মাখা চোখেই তাকিয়ে রয়েছে আর এতক্ষণে ঠোঁটের কোণের হাসিটাও দেখছি কিছুটা চওড়া হয়েছে। ওর হাবভাব দেখে ততক্ষণে আমি দরদর করে ঘামতে শুরু করেছি... বুকের বাঁদিকে কেউ যেন ফুল ভলিউমে ড্রাম বাজাচ্ছে আর সেই আওয়াজে আমার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম... কিন্তু এভাবে ভয় পেলে তো চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে পালাতেই হবে তাই আড়চোখে এদিক ওদিকে তাকাতে লাগলাম যে কিভাবে নিজেকে এই খড়ুশটার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারি... আমার মুখ দেখে মনে হয় নির্ঝর আন্দাজ করেছিল আমার মনের ভাব তাই যে মুহূর্তে একটা ঢোক গিলে ওকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে গেলাম ঠিক তখনি ব্যাটাচ্ছেলে নিজের শক্ত দুটো হাতে আমার হাত দুটোকে ধরে দেওয়ালের সাথে আমাকে ঠেসে ধরে তারপর নিজের হাতের সাহায্যে আমার দুপাশ দিয়ে দেওয়ালে এমনভাবে একটা অভেদ্য বেষ্টনী গড়ে তুলল যে আমার পক্ষে পালানো অসম্ভব হয়ে গেল... এইরকম ঘটে যাওয়ায় আমি সত্যিই তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছি যার ফলে থরথর করে কাঁপছি আর চোখ দুটো সজোরে একে অপরের সাথে চেপে ধরেছি...
আমাকে ওইভাবে দেখে আবারও নির্ঝর আমার মুখের একটু কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে বলল...
এখনি চলে গেলে হবে, শুনবে না তোমার সাথে আমার জরুরি কথাটা কি?
আমার অত কাছে থাকায় নির্ঝরের তপ্ত নিশ্বাস আমার মুখে আছড়ে পড়ছে যার ফলে নিজের ভিতরের অস্বস্তিটা ভীষণভাবে টের পাচ্ছিলাম। ওই কথাটা বলেই নিজের মুখটা এবার আমার কানের কাছে নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল...
খুব তো বলো যে আমি রোজ মাকে কেন বলে যাই অফিস যাওয়ার আগে, মা আসছি। কেন বলি না যে ও বৌ আসছি তাই তো? তাই আমি ঠিক করেছি এবার মাকে রেহাই দিয়ে বৌকেই বলব যে ও বৌ আমি আসছি আর সেটা কাকে বলতে চাই জানো, তোমাকে... শুনবে নাকি আমার মুখে, ও বৌ আমি আসছি... কথাটা বলেই নির্ঝর হালকা করে আমার কানে একটা ফু দিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে ছাদ থেকে চলে গেল...
এদিকে এতক্ষণ নির্ঝর কি বলে গেল তার সবটাই ভয়ের চোটে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছিল কিন্তু যখন পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে শুনলাম তখন বুঝলাম যে সত্যিই এবার আমি মুক্ত। বুকের ভেতরের ড্রামটা তখনও বেজে চলেছে এমনকি কানের কাছের সেই তপ্ত নিশ্বাস এখনো যেন অনুভব করতে পারছি তবুও ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে দেখলাম যে নাহ্ ছেলেটা চলে গেছে কিন্তু তিড়িং করে আমার মাথায় ঘন্টা বেজে উঠল আর আমি নিজেকেই বললাম...
এই... এই... ব্যাটাচ্ছেলে কি বলে গেল এখনি, ও নাকি নিজের বৌকে বলতে চায় অফিস যাওয়ার আগে আর সেই কথাটা ও আমাকে... মানে... আমি... শেষে আমিই কিনা হাদারামের বৌ... মানে... মানে... অ্যাএএএএ... শেষে এই ছিল আমার কপালে...
........
এইসব কথাই এতক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে নিজেই একা হাসছিলাম সেই একই ছাদে.. একই সময়ে.. একলা দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেবেলায়... হঠাৎই কোমরে দুটো বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শে চমকে উঠলেও পরমুহুর্তেই আমার ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু চওড়া হল। কানের কাছে আবারো সেই তপ্ত নিশ্বাস আর সাথে গম্ভীর তথা আদুরে কন্ঠস্বর...
আমার কথা ভাবছিলে বুঝি?
উহ্, তোমার মত হাঁদারামের কথা ভাবতে আমার বয়েই গেছে... হালকা হেসে উত্তর দিলাম।
তাই বুঝি? তাহলে আজ থেকে একবছর আগে এই হাঁদারামের গলায় মালা দিয়েছিলে কেন শুনি... ছেলেমানুষী সুরে বলল হাঁদারাম ওরফে নির্ঝর যে এখন আমার স্বামী।
হ্যা, ঠিকই ধরেছেন গত একবছর আগে এই হাক্ষদারামের সাথেই আমি সাত পাকে বাঁধা পড়েছি। আর আজ আগের মতই ছাদে একলা দাঁড়িয়ে সেই পুরোনো স্মৃতিই মনে করছিলাম আর একাই হাসছিলাম... আমরা ওই ফ্ল্যাটেই থাকি তবে আলাদা ফ্লোরে। নির্ঝর আর আমি দুজনের কেউই নিজেদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হতে চাইনি তাই এই ফ্ল্যাটেরই থার্ড ফ্লোরে নিজেদের ছোট্ট একটা সংসার সাজিয়ে নিয়েছি।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে নির্ঝর আবার বলল...
কি হল বললে না তো কেন তাহলে রাজি হয়েছিলে আমার প্রস্তাবে?
ঠোঁটের কোণে ফাজিল হাসি ফুটিয়ে বললাম...
কি করব বলো, তুমি যেভাবে রিকোয়েস্ট করলে যে মামণিকে রেহাই দিয়ে আমাকেই বলে যেতে চাও অফিস যাওয়ার আগে, সেটা আর ফেলতে পারলাম না। আফটার অল, হাঁদারাম বলে কথা...
আমার কথায় নির্ঝর চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালেও পরক্ষণেই হা.. হা.. করে হেসে উঠে আলতো করে আমার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল...
ওহ্ আমি যদি হাঁদারাম হই তাহলে তুমি কি শুনি?
আমিও একইভাবে নির্ঝরের গালে চুমু একে দিয়ে হেসে বললাম...
আমি হাঁদারামের বৌ...!
©কলমে অরু। ( স্বত্ব সংরক্ষিত )