10-10-2021, 09:10 AM
ক্লাস টুয়েলভে ওঠার পর সুচির সতেরো বছর বয়স হতেই , সে এতদিনে মনের ভিতর পুষে রাখা ইচ্ছাটাকে বাইরে বার করলো। মাকে কথাটা বলতেই তিনি বললেন “ আমি কিছু জানি না বাপু । আগে তোর বাবা আসুক । তারপর „
সমরেশ বাবু অফিস থেকে ফিরতেই সুচি আবদার করলো “ বাবা আমি স্কুটি চালানো শিখবো । „
“ স্কুটি চালানো শিখবি , সে তো ভালো কথা। কিন্তু তোকে শেখাবে কে ? „
“ কেন ! দিদি শেখাবে ! „
“ ওর কলেজ কোচিং আছে। ও কিভাবে শেখাবে ? „
“ শনি-রবিবার দিদির ছুটি থাকে , তখনই শেখাবে । „ খুব উৎসাহের সাথে কথাটা বললো সুচি। সুচির কথায় সমরেশ শুধু মাথাটা উপর নিচ করলেন ।
রবিবার সকাল হতেই সুচি দিদিকে নিয়ে বিল্ডিং কম্পাউন্ডে এলো স্কুটি চালানো শেখার জন্য । কিছুক্ষণ পর আকাশ এলো সুচির স্কুটি শেখা দেখতে। স্কুটির খুটিনাটি সুচি আগে থেকেই জানতো। তাই স্কুটি স্টার্ট দিয়ে আসতে আসতে চালাতে শুরু করলো। বলাবাহুল্য যে সুমি স্কুটির পিছনে বসে সুচির সাহায্য করছিল। কিছুক্ষণ পর সুচি বললো “ এবার তুই নাম আমি একা চালাবো । „
“ পারবি তো ? „
“ হ্যাঁ পারবো । „
এতক্ষণ পর সুচির কথায় আকাশ মুখ খুললো “ পারবি না তুই। ফেলে দিবি। মনে আছে ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে কি করেছিলি। কেটে রক্ত বার হচ্ছিল । প্রথম দিন সুমিদি কে সাথে রাখ ........
আকাশের কথায় সুচি রেগে গিলো । সুচির মনে হলো আকাশ তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই সুচি রেগে গিয়ে একা চালানোরই জেদ ধরলো। সুমিকে জোর করে স্কুটি থেকে নামিয়ে দিয়ে , স্কুটি স্টার্ট দিয়েই আকাশের উপর রাগের বশে সে পিকআপ বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ করে স্কুটির গতি বেড়ে যেতে সুচি স্কুটির স্টিয়ারিং সামলাতে পারলো না। সোজা গিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল ।
“ এই ! এই ! সামলে ! „ বলে সুমি আর আকাশ দৌড়ে এলো। মুখে তাদের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সুমি এসে স্কুটি তুলে দাঁড় করালো । আর আকাশ সুচিকে তুলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ লাগেনি তো কোথাও ? „
“ পায়ে লেগেছে । „ মুখ ব্যাথায় বিকৃত করে ডান পায়ের গোড়ালি দেখিয়ে দিল সুচি ।
আকাশ আর সুমি সুচির গোড়ালির দিকে তাকালো। কেটে যায়নি। শুধু ফুলেছে। সুমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো “ আজ আর শিখতে হবে না চল । বাড়ি চল । „ বলে কথাটা সুমি স্কুটিটাকে ঠেলতে শুরু করলো।
এদিকে আকাশ সুচিকে ধরে সাবধানে বিল্ডিং এর সামনে আনলো । তারপর সুমি সুচির বাম হাত নিজের কাঁধে নিল আর আকাশ সুচির ডান কাঁধ নিজের কাঁধে নিয়ে সিড়িতে উঠার সময় সুচি ব্যাথায় চিল্লিয়ে উঠলো “ লাগছে খুব। „
“ একটু ব্যাথা সহ্য কর । তিন তলা তো। „ কথাটা বলে আকাশ সুচিকে নিয়ে একটা সিড়ি ভাঙলো।
দুটো সিড়ি ভাঙার পরেই সুচি বললো “ না , খুব ব্যাথা । লাগছে খুব......
সুচির কথাটা শেষ হতেই আকাশ সুচিকে দুই হাতে তুলে কোলে নিয়ে নিয়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করলো।
সুচিকে আকাশ কোলে তুলে নিতেই সুমি মুখ হা করে দাড়িয়ে পড়লো। সুচিকে কোলে নিতেই সুচির গাল , কান লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। ব্যাথা আর অনুভব করতে পারছে না সুচি । শুধু নিজের হৃৎপিন্ডের হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া ধ্বনি শুনতে লাগলো। আকাশ তখন বলে চলেছে “ বলেছিলাম , প্রথম দিনেই একা চালাস না । এবার ঠেলা বোঝ . .......
আকাশের কথা সুচির কানেই যাচ্ছে না। কি হচ্ছে সেটাই সুচি বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তার । একভাবে সে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ ক্লান্তিহীনভাবে একের পর এক সিড়ি ভেঙে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর আকাশের কথায় সুচির হুশ ফিরলো “ নে পৌঁছে গেছি। নাম এবার । „
“ ইসসসস পৌঁছে গেলাম। „ কথাটা নিজের মনে বলে দরজা ঠেলে খুঁড়িয়ে ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো।
সুচেতা দেবী হন্তদন্ত হয়ে বললেন “ কি হয়েছে ? কোথায় লেগেছে ? এইজন্য আমি বারন করছিলাম । „
কিছুক্ষণ পর হতভম্ব অবস্থা কাটলে সুমিও উপরে উঠে এলো । এসে মায়ের কথার জবাব দিল “ ও কিছু না । পড়ে গিয়ে ফুলেছে । শিখতে গেলে এরকম ঘটনা হয় তুমি চিন্তা করো না। কিছু হয়নি ওর । „
কথাটা বলে ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে মুচকি হাসতে হাসতে সুচির গোড়ালির ফুলে যাওয়া অংশে লাগাতে শুরু করলো। সুচি একবার দিদির মুখে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার আর লজ্জায় তাকাতে পারলো না। রাতে ঘুমের মধ্যে আজকে সিড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই সুচি স্বপ্নে দেখলো । স্বপ্ন দেখতে দেখতেই লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। দুপুরে সিড়ি কখন শেষ হয়ে গেছিল সেটা সুচি বুঝতেই পারেনি কিন্তু স্বপ্নে সিড়ি শেষ হচ্ছে না । আকাশ সুচিকে কোলে নিয়ে সিড়ি ভেঙেই যাচ্ছে আর সুচি একভাবে আকাশের চওড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নের জন্য ঠোটের কোনায় হাসি দেখা দিল সুচির।
কথায় আছে যারা সাইকেল চালাতে পারে তারা খুব সহজেই বাইক কিংবা স্কুটি চালানো শিখে নিতে পারে। দুই দিন পর পায়ের ব্যাথা এবং ফোলা কমে গেলে আবার স্কুটি চালানো শিখতে শুরু করলো সুচি। চার পাঁচ দিন বিকাল বেলা চালিয়ে খুব ভালো স্কুটি চালানো শিখে গেল সে।
স্কুটি চালানো শেখার পর যে স্কুটিটা রোদে পুড়ে জলে ভিজে অবহেলায় বিল্ডিং কম্পাউন্ডে দাড়িয়ে থাকতো , যে স্কুটিটার দিকে সুচি ফিরেও কখনো তাকাতো না , সেই স্কুটিটাই এখন সুচির চোখের মণি হয়ে উঠেছে। পাঁচ ছয় বছর বয়স হলেও এখনও ভালো সার্ভিস দিচ্ছে সুমির স্কুটি । সুচি এখন স্কুটিটার উপর একটুও ধুলো পরতে দেয় না। পরম যত্নে রাখে , সন্ধ্যা হলেই বড়ো প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দেয় সুচি। নিয়মিত জল সাবান দিয়ে ভালো করে স্কুটিটাকে পরিষ্কার করে ধুয়ে দেয় ।
তেমনই একদিন রবিবার দুপুর বেলা স্নান করার আগে সোসাইটি কম্পাউন্ডে সুচি স্কুটিটাকে ধুয়ে দিচ্ছিল। আর আকাশ একটা ইটের উপর বসে সুচির স্কুটি পরিষ্কার করা দেখছে। কি যত্নে স্কুটিটার প্রতি কোনায় জল দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে সুচি। কিছুক্ষণ সুচির স্কুটি ধোওয়া দেখে সুচির সাথে ইয়ার্কি করার জন্য আকাশ বললো “ স্কুটিটাকে যেভাবে স্নান করাচ্ছিস সেইভাবে একদিন নিজেও স্নান কর। গা থেকে তো শুয়োর মরা গন্ধ বার হয়। গন্ধে তোর আশেপাশে থাকা যায় না। „
সুচি আকাশের কথা শুনলো কিন্তু মুখে কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো না। কিছুই হয়নি এমন ভাবে করে যে কাপড়টা দিয়ে স্কুটিটাকে পরিষ্কার করছিল সেটা বালতির জলে একবার ডুবিয়ে স্কুটির হেডলাইট মুছতে শুরু করলো। প্রায় এক দুই মিনিট পর কাপড়টা আবার বালতির জলে ডুবিয়ে দিল। তারপর বালতিটা তুলে বালতির মধ্যে থাকা নোংরা জল আকাশের গায়ে ছুড়ে দিল “ তোর গা থেকে যে ইদুর পঁচা গন্ধ বার হয় সেটা পরিষ্কার করে আয় । আর একটু ভালো পারফিউম মাখ । গন্ধে তো পাড়ার লোকের ঘুম হয় না। „
আকাশ সুচির কাপড় দিয়ে স্কুটিটার হেডলাইট পরিষ্কার করা দেখে ভেবেছিল সুচি কিছু মাইন্ড করে নি। আর তার জন্য সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। সুচি এই সুযোগটা নিয়েই আধবালতি নোংরা জল দিয়ে আকাশকে স্নান করিয়ে দিল । আচমকা মুখে গায় নোংরা জল পড়ায় আকাশ খুব রেগে গেল। ইট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো “ আমার গা থেকে ইদুর পঁচা গন্ধ বার হয় ! „
“ হ্যাঁ বার হয়। কাকা কাকি থাকে কি করে তোর সাথে ! „
“ কি বললি !!! „
ঠিক চার থেকে পাঁচ মিনিট পর জয়শ্রী এসে দুই তিনবার আকাশের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজালো । ঘরের ভিতর থেকে স্নেহা দেবী বললেন “ আসছিরে বাবা এতো বার বেল বাজানোর কি আছে ! „
স্নেহা দেবী দরজা খুলতেই জয়শ্রী বলে উঠলো “ শীঘ্রি নিচে চলো মাসি । আকাশ আর সুচি মারপিট করছে । „
কথাটা শুনেই স্নেহা দেবীর মুখ রাগে পাথর হয়ে উঠলো । দরজা খোলা রেখেই তিনি সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে শুরু করলেন । আকাশের মাকে বলা হয়ে গেলে জয়শ্রী এবার সুচির ঘরের কলিংবেল বাজালো। সুচেতা দেবী বাইরে এসে বললেন “ কি হয়েছে ? এতো বার বেল বাজাচ্ছিস কেন ? „
“ সুচি আর আকাশ মারপিট করছে । „
“ এই মেয়েটার জ্বালায় একদিনও শান্তিতে কাটলো না আমার। যতো জ্বালা সব আমার । „ বলে তিনি নিজে নামতে শুরু করলেন
সুচেতা দেবী নিজে নেমে দেখলেন অনেক লোক জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর , সাপ-নেউল লড়াই করার সময় যেভাবে নিজেদের জড়িয়ে ধরে সুচি আর আকাশ সেইভাবে জড়িয়ে ধরে সোসাইটি কম্পাউন্ডে গড়াগড়ি খাচ্ছে । জড়িয়ে ধরে আছে বললে ভুল হবে ! সুচি এক হাতে প্লাস্টিক এর বালতি নিয়ে আকাশকে মারছে। আকাশ এক হাত দিয়ে সুচির চুল ধরে টেনে ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করছে আর অন্য হাতে বালতিটাকে নিজের শরীরে আঘাত করা থেকে থামাচ্ছে । আর দুজনেই একে অপরকে নানা কথা শোনাচ্ছে।
সুচি --- আমার গা থেকে যদি এতোই দুর্গন্ধ বার হয় তাহলে থাকিস কেন আমরা সাথে ?
আকাশ--- জন্মের দিন থেকে তুই আমার সাথে আছিস আর আমাকে জ্বালিয়ে মারছিস ।
সুচি ---- আমি তোকে জ্বালাই ! না তুই আমাকে জ্বালাস ! তোর দোষের জন্য বারবার আমি বাবার কাছে বকা খাই।
আর শুনতে পারলেন না সুচেতা দেবী আর স্নেহা দেবী। দুজনেই তাদের সন্তানকে টেনে আলাদা করলেন। তারপর দুজনেই একটা করে চড় বসিয়ে দুজনকে শান্ত করলেন। সুচেতা দেবী বললেন “ বয়স কত হয়েছে তোর ! এইভাবে গায়ে গা জড়িয়ে মারপিট করছিস । „
“ ওই তো প্রথম শুরু করলো। „ বলে রেগে গিয়ে হাতের বালতি ফেলে দিয়ে সুচি উপরে উঠে গেল।
এদিকে মায়ের হাতে এতদিন পর চড় খেয়ে আকাশ শান্ত হলো। স্নেহা দেবী বললেন “ তুই কি এখনও বাচ্চা যে ওর সাথে এইভাবে মারপিট করছিস। বোধ বুদ্ধি কবে হবে তোর ? „
মায়ের কথার জবাব না দিয়ে আকাশও উপরে উঠে গেল। এতগুলো লোকের সামনে মায়ের হাতে চড় খাওয়া দুজনেই সহ্য করতে পারে নি।
তখনও অন্ধকার হয়নি। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তে এখনও দেরি আছে । দুপুরে সুচির হাতে উদোম মার খেয়ে আর মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে এখন আর খেলতে যেতে ইচ্ছা করছে না। তাই সোফায় বসে উদাস মনে টিভি দেখছে। আর স্নেহা দেবী ছাদ থেকে শুকিয়ে যাওয়া জামা কাপড় এনে আকাশের পাশে সোফায় রেখে গুটিয়ে রাখছিলেন ।
ঠিক এমন সময় সুচি একটা ভালো সুন্দর মেরুন রঙের কুর্তি আর একটা জিন্স পড়ে ঘরে উঁকি মেরে দেখলো আকাশ টিভি দেখছে। তারপর ঘরে ঢুকে সোফার পাশে দাঁড়িয়ে বললো “ কি করছিস ? „
“ অন্ধ হয়ে গেছিস নাকি ! দেখতেই পারছিস সিনেমা দেখছি। „ এখনও রাগ কমেনি আকাশের।
সুচি একবার টিভির দিকে তাকিয়ে দেখলো অমিতাভ বচ্চনের সুরিয়াবানশি হচ্ছে “ এতো অনেকবার দেখেছিস । এখন আর দেখতে হবে না। চল আমার সাথে। „
“ কোথায় ? „
“ রাসের মেলায় । „
“ আমি যাবো না । „
আকাশের কথা যেন সুচি শুনতেই পায়নি এমন ভাবে সুচি আকাশের হাত ধরে টেনে সোফা থেকে তুলে বললো “ যেতে তো তোকে হবেই । „
“ আরে ! আমি হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডোগ্যাঞ্জি পড়ে আছি । এইসব পড়ে কি করে যাবো ! „
“ যা । ভালো জামা কাপড় পড়ে আয় । „ বলে সুচি আকাশের হাত ছেড়ে দিল।
সুচি হাত ছেড়ে দিলে আকাশ নিজের ঘরে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা সবুজ আর কালো রঙ মেশানো জামা আর একটা জিন্স পড়ে বাইরে এলো । তারপর দুজনেই নিচে নেমে গেল।
এতক্ষণ স্নেহা দেবী দেখছিলেন আর অবাক হচ্ছিলেন আর মনে মনে বলছিলেন ---- ‘ কিছুক্ষণ আগেই এরা যেভাবে ধস্তাধস্তি করছিল যেন একে অপরের প্রান না নিয়ে ছাড়বে না। আর এখন এদের ব্যাবহার দেখে মনে হচ্ছে এরা জন্ম জন্মান্তর ধরে একে অপরকে চিমটি পর্যন্ত কাটেনি , কাটতে পারে না। ‚
সোসাইটি থেকে নেমে পনের কুড়ি মিনিট হেটে সুচি আর আকাশ মেলার মাঠে পৌঁছে গেল। খুব বড়ো না হলেও ছোট বলা যায় না। মেলায় যাবতীয় যেসব থাকে তার সবই এখানে আছে । এদিক সেদিক কিছুক্ষণ ঘোরার পর নাগরদোলার সামনে এসে আকাশের মাথায় প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দিটা এলো। ছোটবেলায় একবার সুমির সাথে নাগরদোলায় উঠে ভয় পেয়ে সুচি কেঁদে ফেলেছিল। কথাটা মাথাতে আসতে আকাশ মনে মনে বললো ‘ আজকাল খুব হাত চলছে তোর ! এবার দেখ ‚ তারপর সুচিকে উদ্দেশ্যে করে বললো “ নাগরদোলা চড়বি ? „
“ না । „ সোজা মানা করে দিল সুচি
“ আরে আয় না । কিছু হবে না। „ বলে সুচির ডান হাত ধরে টানতে শুরু করলো ।
“ না , না , প্লিজ আমার ভয় লাগে খুব । „
“ আরে আমি তো আছি। চল না। „ বলে সুচিকে টেনে আনলো টিকিট কাউন্টারে তারপর ত্রিশ টাকা করে দুটো টিকিট কাটলো আকাশ ।
সুচি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো আকাশের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর । সুচির হাত ছাড়ানো দেখে আকাশ বললো “ খুব মজা হবে । আমি তো আছি । „ আকাশের কথায় সুচি একটা ঢোক গিলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।
কয়েক মিনিট পর নাগরদোলা থেমে গেলে সুচি এবার আকাশের হাত ধরলো। আকাশ দেখলো ভয়তে সুচির হাত কাঁপছে “ ভয় পাচ্ছিস কেন ? দেখ কতো লোক চড়ছে । „ চল বলে একটা খালি দোলনায় উঠে পড়লো।
সুচি আরও একটা ঢোক গিলে আকাশের সামনে না বসে আকাশের পাশেই বসলো। নাগরদোলা আস্তে করে চলতে শুরু করলেই সুচি ভয়তে চোখ বন্ধ করে আকাশের ডান হাতটা দুই হাতে ধরে ফেললো “ আমার খুব ভয় করছে । „
‘ বেশ হয়েছে। আমাকে মারা ! এখন বোঝ ঠেলা। এখন হিসাব কর কত ধানে কত চাল হচ্ছে ? ‚ মনে মনে সুচিকে চাল আর ধানের হিসাব করতে বলে মুখে বললো “ কিছু হবে না , আমি তো আছি। দেখ ! ওই দুজন কে দেখ ! কিভাবে পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছে। „
“ আমি দেখতে চাই না। আমার ভীষন ভয় করছে। ওবাবাগো...... সুচির কথা শেষ হওয়ার আগেই নাগর দোলা একটু স্পিড বাড়িয়ে ঘুরতে শুরু করলো । আর সেই সাথে সুচি আকাশকে জড়িয়ে ধরলো ।
তারপর নাগরদোলা একটু স্পিড বাড়াতেই সুচি আরও জোড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আকাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা এবং ভীত গলায় বলতে শুরু করলো “ এ এরকম কাঁপছে কেন? পড়ে যাবো আমি ! শেষ হবে কখন ? কত পাক হয়েছে ? „
আকাশ এটা ভাবেনি। একদম ভাবিনি যে সুচি এইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরবে। সুচি আকাশকে জড়িয়ে ধরায় সুচির চুলের মিষ্টি গন্ধ আকাশকে একটা ঘোরের মধ্যে পাঠিয়ে দিল। সুচির ভয়কে আরও বাড়ানোর জন্য খুব উৎসাহে আকাশ বললো “ তিন পাক হয়েছে। এখনও সাত পাক বাকি ? „
সাত পাক শুনেই সুচি আকাশকে আরো জোরে কষে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। এতক্ষণ আকাশ সুচির চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নিচ্ছিল। এবার সুচির জন্য তার দমবন্ধ হতে শুরু করলো। “ ছাড় তুই আমায় । আমার কষ্ট হচ্ছে , দম নিতে পারছি না আমি....ছাআআআআআআড় আমায় .......
আকাশ যতো সুচিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো সুচি আরও জোড়ে চেপে ধরে লাগলো । সুচি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশকে চেপে ধরে কাঁপা গলায় বললো “ আমি পড়ে যাবো। আমার ভয় হচ্ছে। মা বাচাও আমায় । আমার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। বমি হবে .....
আকাশ ভাবতেই পারেনি যে নিজের ছোড়া তীর ঘুরে এসে নিজের পিছনেই লাগবে “ না , একদম না। বমি না । আমার উপর না। আরে আর কতো ঘুরবে থামাও ! মা গো সবে পাঁচ পাক হয়েছে .....
“ এখনও পাচ পাক বাকি ! বমি বমি পাচ্ছে । „
“ নাআআআআআ । এ আমি কোথায় ফেঁসে গেলাম । „ আকাশের পুরো কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে গেল
পরবর্তী পাঁচ পাক আকাশ কিভাবে মুখ দিয়ে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিল সেটা শুধু আকাশ জানে। সুচি কিভাবে বমি না করেও আকাশকে দমবন্ধ করিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল সেটা শুধু সুচি জানে । নাগরদোলা থামার পর আকাশ সুচিকে ছাড়িয়ে দোলনা থেকে নেমে ঘাসের উপর বসে পড়লো আর বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে শুরু করলো। সুচিও আকাশের পাশে বসে কয়েকবার ওয়্যাক ওয়্যাক করে বমি করার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। আকাশ উঠে পাশের দোকান থেকে একটা এক লিটারের জল কিনে ঢকঢক করে খেয়ে সুচির দিকে বাড়িয়ে দিল। সুচি প্রথমে ভালো করে মুখে ঘাড়ে জল দিল। তারপর কয়েক ঢোক জল খেয়ে নিল “ আর একবারও যদি আমায় নাগরদোলায় চাপতে বলেছিস ! তবে তোর একদিন কি আমার একদিন ! „
“ কেউ যদি আমায় দশ কোটি টাকা দিয়ে বলে তোকে নিয়ে নাগরদোলা উঠতে , তাহলেও না। আর একটু হলে আমি মরে যেতাম। দমবন্ধ হয়ে এসছিল আমায়। আমি তো একটা মানুষ। কেউ কাউকে এইভাবে মারার চিন্তা করে ! „ রাগী মুখ করে রাগী স্বরে বললো আকাশ।
“ বাজে বকবি না একদম । তুই আমায় নিয়ে গেছিলি । আমি যেতে চাই নি। আমি বলেছিলাম আমর ভয় করে । তুই তো শুনিস নি , এখন সব দোষ আমার ? „ সুচি ও রেগে আকাশের কথার জবাব দিল।
আকাশ সুচির কথার জবাব দিল না। সত্যি ওকে শায়েস্তা করতে গিয়ে যে নিজে এইভাবে ফেঁসে যাবে ভাবিনি । কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে আকাশ বললো “ ফুচকা খাবি ? „
“ চল । „ বলে দুজন ফুচকা খেলো। তারপর পাপড়ি চাট খেলো। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য জিলিপি , বাদাম , গজা, কটকটি কিনলো। তারপর বিভিন্ন দোকানের কানের দুল, নাকের নথ , আংটি দেখতে লাগলো। একটা বড়ো দোকানে থেমে একটা আংটি পছন্দ করে সুচি বললো “ এটা কতো ? „
দোকানদার বললো “ 85 । „
“ দুটো নেবো । একশো পঞ্চাশ দেবো । „
দোকানদার তার আংটির বাক্স এগিয়ে দিতে সুচি আকাশকে একটা A লেখা আংটি পছন্দ করে দিলে আকাশ বললো “ আমি পড়িনা এসব। „
“ এখন থেকে পড়বি। „ কথাটা বলে সুচি নিজের জন্য S লেখা আংটি পছন্দ করতে লাগলো। অনেক গুলো দেখার পর তিনটে আংটি ফাইনাল করে সে আকাশকে জিজ্ঞাসা করলো “ কোনটা ভালো দেখাবে বলতো ? „
“ এটা নে তোর আঙুলে এটা মানাবে। বেশি মোটা মানাবে না। এটা শেপ ও ভালো। „ কথাটা বলে একটা ডিম্বাকৃতি আংটি দেখিয়ে দিল।
“ দিন এই দুটো । „
দোকানদার দুটো আংটি একটা প্যাকেটে দিলে দুজনে দুটো আংটি নিয়ে আঙুলে পড়ে বাড়ির রাস্তা ধরলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আকাশ রাতের অন্ধকার আকাশে তারা দেখতে দেখতে দেখতে বললো “ শোন । দুপুরে যা বলেছি ওসব রাগের বশে ........
“ ছাড় ওসব। আমিও রাগে অনেক খারাপ কথা বলেছি। „
পরের বছর আকাশ ক্লাস টেনে ওঠার কয়েক মাস পর সুচি মাধ্যমিক এর থেকেও বেশি পরিশ্রম করে, মন দিয়ে পড়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। ঠিক সেই সময় সুমিও একটা সরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিল। সুচির উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আসার আগে সুমির রেজাল্ট চলে এলো। টপ টেনে নাম উঠেছে তার। ইন্টারভিউ দেওয়ার পর এই রাজ্যের IBS ব্যাঙ্কের হেড অফিসের ম্যানেজারের সেক্রেটারি পদের চাকরিটা খুব সহজেই পেয়ে গেল সুমি ।
কিছুদিন পরে সুচির উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বার হলো। সবাই যতোটা আশা করেছিল তার থেকেও ভালো হলো সুচির রেজাল্ট । সবাই বলাবলি করতে লাগলো ------ ‘ বাড়িতে যদি সুমির মতো দিদি থাকে তাহলে এতো ভালো রেজাল্ট যে কেউ করতে পারবে । ‚
রেজাল্ট বার হওয়ার পর সুচি কোন কলেজে ভর্তি হবে সেটা নিয়েই খাওয়ার টেবিলে আলোচনা হচ্ছে। সুমি বললো “ কিংটন কিংবা টেগনো তে ভর্তি হয়ে যা। B. Com খুব ভালো পড়ায় ওখানে। „
কলেজের নাম শুনেই সমরেশ বাবু চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখন বয়স হয়েছে তার। মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। চোখের দুই কোনায় মুরগির পায়ের ছাপের মতো চামড়ার ভাজ পড়ে বয়স হওয়ার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে । তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন ---- ‘ সুমি না হয় উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে সরকারি বেসরকারি নানা ধরনের স্কলারশিপ পেয়েছিল , তাই ওর উচ্চশিক্ষার পড়াশোনার জন্য তেমন অর্থকষ্ট পোহাতে হয়নি। কিন্তু সুচির কলেজের জন্য এতো টাকা কোথা থেকে পাবো। ‚
বাবার মুখ দেখেই সুমি বুঝতে পারলো তার বাবা কি ভাবছে। তাই সে বললো “ বোনের পড়াশোনার সব খরচ আমি নেবো „
বড়ো মেয়ের কথা শুনে সমরেশ বাবুর মনটা হালকা হয়ে উঠলো ---- ‘ কখন যে মেয়ে দুটো বড়ো হয়ে গেল বুঝলাম না। এই তো সেদিন হাত ধরে হাটতো । ‚ মুখে কিছু না বললেও মেয়েকে মন থেকে শত সহস্র আশীর্বাদ করতে করতে রাতের খাবার খেতে লাগলেন। রাতে খাটে শুয়ে সুচির মাকে সমরেশ বাবু বললেন “ কে বলেছে মেয়েরা পরের ঘরের ধন হয় ? ছেলেরাই একমাত্র বুড়ো বয়সে বাপ মায়ের খেয়াল রাখে ? „ কথাটা বলতে গিয়ে সুচির বাবার চোখে এক ফোটা জল দেখা দিল ।
সমরেশ বাবু অফিস থেকে ফিরতেই সুচি আবদার করলো “ বাবা আমি স্কুটি চালানো শিখবো । „
“ স্কুটি চালানো শিখবি , সে তো ভালো কথা। কিন্তু তোকে শেখাবে কে ? „
“ কেন ! দিদি শেখাবে ! „
“ ওর কলেজ কোচিং আছে। ও কিভাবে শেখাবে ? „
“ শনি-রবিবার দিদির ছুটি থাকে , তখনই শেখাবে । „ খুব উৎসাহের সাথে কথাটা বললো সুচি। সুচির কথায় সমরেশ শুধু মাথাটা উপর নিচ করলেন ।
রবিবার সকাল হতেই সুচি দিদিকে নিয়ে বিল্ডিং কম্পাউন্ডে এলো স্কুটি চালানো শেখার জন্য । কিছুক্ষণ পর আকাশ এলো সুচির স্কুটি শেখা দেখতে। স্কুটির খুটিনাটি সুচি আগে থেকেই জানতো। তাই স্কুটি স্টার্ট দিয়ে আসতে আসতে চালাতে শুরু করলো। বলাবাহুল্য যে সুমি স্কুটির পিছনে বসে সুচির সাহায্য করছিল। কিছুক্ষণ পর সুচি বললো “ এবার তুই নাম আমি একা চালাবো । „
“ পারবি তো ? „
“ হ্যাঁ পারবো । „
এতক্ষণ পর সুচির কথায় আকাশ মুখ খুললো “ পারবি না তুই। ফেলে দিবি। মনে আছে ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে কি করেছিলি। কেটে রক্ত বার হচ্ছিল । প্রথম দিন সুমিদি কে সাথে রাখ ........
আকাশের কথায় সুচি রেগে গিলো । সুচির মনে হলো আকাশ তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই সুচি রেগে গিয়ে একা চালানোরই জেদ ধরলো। সুমিকে জোর করে স্কুটি থেকে নামিয়ে দিয়ে , স্কুটি স্টার্ট দিয়েই আকাশের উপর রাগের বশে সে পিকআপ বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ করে স্কুটির গতি বেড়ে যেতে সুচি স্কুটির স্টিয়ারিং সামলাতে পারলো না। সোজা গিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল ।
“ এই ! এই ! সামলে ! „ বলে সুমি আর আকাশ দৌড়ে এলো। মুখে তাদের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সুমি এসে স্কুটি তুলে দাঁড় করালো । আর আকাশ সুচিকে তুলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলো “ লাগেনি তো কোথাও ? „
“ পায়ে লেগেছে । „ মুখ ব্যাথায় বিকৃত করে ডান পায়ের গোড়ালি দেখিয়ে দিল সুচি ।
আকাশ আর সুমি সুচির গোড়ালির দিকে তাকালো। কেটে যায়নি। শুধু ফুলেছে। সুমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো “ আজ আর শিখতে হবে না চল । বাড়ি চল । „ বলে কথাটা সুমি স্কুটিটাকে ঠেলতে শুরু করলো।
এদিকে আকাশ সুচিকে ধরে সাবধানে বিল্ডিং এর সামনে আনলো । তারপর সুমি সুচির বাম হাত নিজের কাঁধে নিল আর আকাশ সুচির ডান কাঁধ নিজের কাঁধে নিয়ে সিড়িতে উঠার সময় সুচি ব্যাথায় চিল্লিয়ে উঠলো “ লাগছে খুব। „
“ একটু ব্যাথা সহ্য কর । তিন তলা তো। „ কথাটা বলে আকাশ সুচিকে নিয়ে একটা সিড়ি ভাঙলো।
দুটো সিড়ি ভাঙার পরেই সুচি বললো “ না , খুব ব্যাথা । লাগছে খুব......
সুচির কথাটা শেষ হতেই আকাশ সুচিকে দুই হাতে তুলে কোলে নিয়ে নিয়ে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠতে শুরু করলো।
সুচিকে আকাশ কোলে তুলে নিতেই সুমি মুখ হা করে দাড়িয়ে পড়লো। সুচিকে কোলে নিতেই সুচির গাল , কান লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। ব্যাথা আর অনুভব করতে পারছে না সুচি । শুধু নিজের হৃৎপিন্ডের হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া ধ্বনি শুনতে লাগলো। আকাশ তখন বলে চলেছে “ বলেছিলাম , প্রথম দিনেই একা চালাস না । এবার ঠেলা বোঝ . .......
আকাশের কথা সুচির কানেই যাচ্ছে না। কি হচ্ছে সেটাই সুচি বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তার । একভাবে সে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ ক্লান্তিহীনভাবে একের পর এক সিড়ি ভেঙে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর আকাশের কথায় সুচির হুশ ফিরলো “ নে পৌঁছে গেছি। নাম এবার । „
“ ইসসসস পৌঁছে গেলাম। „ কথাটা নিজের মনে বলে দরজা ঠেলে খুঁড়িয়ে ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো।
সুচেতা দেবী হন্তদন্ত হয়ে বললেন “ কি হয়েছে ? কোথায় লেগেছে ? এইজন্য আমি বারন করছিলাম । „
কিছুক্ষণ পর হতভম্ব অবস্থা কাটলে সুমিও উপরে উঠে এলো । এসে মায়ের কথার জবাব দিল “ ও কিছু না । পড়ে গিয়ে ফুলেছে । শিখতে গেলে এরকম ঘটনা হয় তুমি চিন্তা করো না। কিছু হয়নি ওর । „
কথাটা বলে ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে মুচকি হাসতে হাসতে সুচির গোড়ালির ফুলে যাওয়া অংশে লাগাতে শুরু করলো। সুচি একবার দিদির মুখে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার আর লজ্জায় তাকাতে পারলো না। রাতে ঘুমের মধ্যে আজকে সিড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই সুচি স্বপ্নে দেখলো । স্বপ্ন দেখতে দেখতেই লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। দুপুরে সিড়ি কখন শেষ হয়ে গেছিল সেটা সুচি বুঝতেই পারেনি কিন্তু স্বপ্নে সিড়ি শেষ হচ্ছে না । আকাশ সুচিকে কোলে নিয়ে সিড়ি ভেঙেই যাচ্ছে আর সুচি একভাবে আকাশের চওড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নের জন্য ঠোটের কোনায় হাসি দেখা দিল সুচির।
কথায় আছে যারা সাইকেল চালাতে পারে তারা খুব সহজেই বাইক কিংবা স্কুটি চালানো শিখে নিতে পারে। দুই দিন পর পায়ের ব্যাথা এবং ফোলা কমে গেলে আবার স্কুটি চালানো শিখতে শুরু করলো সুচি। চার পাঁচ দিন বিকাল বেলা চালিয়ে খুব ভালো স্কুটি চালানো শিখে গেল সে।
স্কুটি চালানো শেখার পর যে স্কুটিটা রোদে পুড়ে জলে ভিজে অবহেলায় বিল্ডিং কম্পাউন্ডে দাড়িয়ে থাকতো , যে স্কুটিটার দিকে সুচি ফিরেও কখনো তাকাতো না , সেই স্কুটিটাই এখন সুচির চোখের মণি হয়ে উঠেছে। পাঁচ ছয় বছর বয়স হলেও এখনও ভালো সার্ভিস দিচ্ছে সুমির স্কুটি । সুচি এখন স্কুটিটার উপর একটুও ধুলো পরতে দেয় না। পরম যত্নে রাখে , সন্ধ্যা হলেই বড়ো প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দেয় সুচি। নিয়মিত জল সাবান দিয়ে ভালো করে স্কুটিটাকে পরিষ্কার করে ধুয়ে দেয় ।
তেমনই একদিন রবিবার দুপুর বেলা স্নান করার আগে সোসাইটি কম্পাউন্ডে সুচি স্কুটিটাকে ধুয়ে দিচ্ছিল। আর আকাশ একটা ইটের উপর বসে সুচির স্কুটি পরিষ্কার করা দেখছে। কি যত্নে স্কুটিটার প্রতি কোনায় জল দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে সুচি। কিছুক্ষণ সুচির স্কুটি ধোওয়া দেখে সুচির সাথে ইয়ার্কি করার জন্য আকাশ বললো “ স্কুটিটাকে যেভাবে স্নান করাচ্ছিস সেইভাবে একদিন নিজেও স্নান কর। গা থেকে তো শুয়োর মরা গন্ধ বার হয়। গন্ধে তোর আশেপাশে থাকা যায় না। „
সুচি আকাশের কথা শুনলো কিন্তু মুখে কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো না। কিছুই হয়নি এমন ভাবে করে যে কাপড়টা দিয়ে স্কুটিটাকে পরিষ্কার করছিল সেটা বালতির জলে একবার ডুবিয়ে স্কুটির হেডলাইট মুছতে শুরু করলো। প্রায় এক দুই মিনিট পর কাপড়টা আবার বালতির জলে ডুবিয়ে দিল। তারপর বালতিটা তুলে বালতির মধ্যে থাকা নোংরা জল আকাশের গায়ে ছুড়ে দিল “ তোর গা থেকে যে ইদুর পঁচা গন্ধ বার হয় সেটা পরিষ্কার করে আয় । আর একটু ভালো পারফিউম মাখ । গন্ধে তো পাড়ার লোকের ঘুম হয় না। „
আকাশ সুচির কাপড় দিয়ে স্কুটিটার হেডলাইট পরিষ্কার করা দেখে ভেবেছিল সুচি কিছু মাইন্ড করে নি। আর তার জন্য সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। সুচি এই সুযোগটা নিয়েই আধবালতি নোংরা জল দিয়ে আকাশকে স্নান করিয়ে দিল । আচমকা মুখে গায় নোংরা জল পড়ায় আকাশ খুব রেগে গেল। ইট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো “ আমার গা থেকে ইদুর পঁচা গন্ধ বার হয় ! „
“ হ্যাঁ বার হয়। কাকা কাকি থাকে কি করে তোর সাথে ! „
“ কি বললি !!! „
ঠিক চার থেকে পাঁচ মিনিট পর জয়শ্রী এসে দুই তিনবার আকাশের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজালো । ঘরের ভিতর থেকে স্নেহা দেবী বললেন “ আসছিরে বাবা এতো বার বেল বাজানোর কি আছে ! „
স্নেহা দেবী দরজা খুলতেই জয়শ্রী বলে উঠলো “ শীঘ্রি নিচে চলো মাসি । আকাশ আর সুচি মারপিট করছে । „
কথাটা শুনেই স্নেহা দেবীর মুখ রাগে পাথর হয়ে উঠলো । দরজা খোলা রেখেই তিনি সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে শুরু করলেন । আকাশের মাকে বলা হয়ে গেলে জয়শ্রী এবার সুচির ঘরের কলিংবেল বাজালো। সুচেতা দেবী বাইরে এসে বললেন “ কি হয়েছে ? এতো বার বেল বাজাচ্ছিস কেন ? „
“ সুচি আর আকাশ মারপিট করছে । „
“ এই মেয়েটার জ্বালায় একদিনও শান্তিতে কাটলো না আমার। যতো জ্বালা সব আমার । „ বলে তিনি নিজে নামতে শুরু করলেন
সুচেতা দেবী নিজে নেমে দেখলেন অনেক লোক জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর , সাপ-নেউল লড়াই করার সময় যেভাবে নিজেদের জড়িয়ে ধরে সুচি আর আকাশ সেইভাবে জড়িয়ে ধরে সোসাইটি কম্পাউন্ডে গড়াগড়ি খাচ্ছে । জড়িয়ে ধরে আছে বললে ভুল হবে ! সুচি এক হাতে প্লাস্টিক এর বালতি নিয়ে আকাশকে মারছে। আকাশ এক হাত দিয়ে সুচির চুল ধরে টেনে ছিড়ে ফেলার চেষ্টা করছে আর অন্য হাতে বালতিটাকে নিজের শরীরে আঘাত করা থেকে থামাচ্ছে । আর দুজনেই একে অপরকে নানা কথা শোনাচ্ছে।
সুচি --- আমার গা থেকে যদি এতোই দুর্গন্ধ বার হয় তাহলে থাকিস কেন আমরা সাথে ?
আকাশ--- জন্মের দিন থেকে তুই আমার সাথে আছিস আর আমাকে জ্বালিয়ে মারছিস ।
সুচি ---- আমি তোকে জ্বালাই ! না তুই আমাকে জ্বালাস ! তোর দোষের জন্য বারবার আমি বাবার কাছে বকা খাই।
আর শুনতে পারলেন না সুচেতা দেবী আর স্নেহা দেবী। দুজনেই তাদের সন্তানকে টেনে আলাদা করলেন। তারপর দুজনেই একটা করে চড় বসিয়ে দুজনকে শান্ত করলেন। সুচেতা দেবী বললেন “ বয়স কত হয়েছে তোর ! এইভাবে গায়ে গা জড়িয়ে মারপিট করছিস । „
“ ওই তো প্রথম শুরু করলো। „ বলে রেগে গিয়ে হাতের বালতি ফেলে দিয়ে সুচি উপরে উঠে গেল।
এদিকে মায়ের হাতে এতদিন পর চড় খেয়ে আকাশ শান্ত হলো। স্নেহা দেবী বললেন “ তুই কি এখনও বাচ্চা যে ওর সাথে এইভাবে মারপিট করছিস। বোধ বুদ্ধি কবে হবে তোর ? „
মায়ের কথার জবাব না দিয়ে আকাশও উপরে উঠে গেল। এতগুলো লোকের সামনে মায়ের হাতে চড় খাওয়া দুজনেই সহ্য করতে পারে নি।
তখনও অন্ধকার হয়নি। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়তে এখনও দেরি আছে । দুপুরে সুচির হাতে উদোম মার খেয়ে আর মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে এখন আর খেলতে যেতে ইচ্ছা করছে না। তাই সোফায় বসে উদাস মনে টিভি দেখছে। আর স্নেহা দেবী ছাদ থেকে শুকিয়ে যাওয়া জামা কাপড় এনে আকাশের পাশে সোফায় রেখে গুটিয়ে রাখছিলেন ।
ঠিক এমন সময় সুচি একটা ভালো সুন্দর মেরুন রঙের কুর্তি আর একটা জিন্স পড়ে ঘরে উঁকি মেরে দেখলো আকাশ টিভি দেখছে। তারপর ঘরে ঢুকে সোফার পাশে দাঁড়িয়ে বললো “ কি করছিস ? „
“ অন্ধ হয়ে গেছিস নাকি ! দেখতেই পারছিস সিনেমা দেখছি। „ এখনও রাগ কমেনি আকাশের।
সুচি একবার টিভির দিকে তাকিয়ে দেখলো অমিতাভ বচ্চনের সুরিয়াবানশি হচ্ছে “ এতো অনেকবার দেখেছিস । এখন আর দেখতে হবে না। চল আমার সাথে। „
“ কোথায় ? „
“ রাসের মেলায় । „
“ আমি যাবো না । „
আকাশের কথা যেন সুচি শুনতেই পায়নি এমন ভাবে সুচি আকাশের হাত ধরে টেনে সোফা থেকে তুলে বললো “ যেতে তো তোকে হবেই । „
“ আরে ! আমি হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডোগ্যাঞ্জি পড়ে আছি । এইসব পড়ে কি করে যাবো ! „
“ যা । ভালো জামা কাপড় পড়ে আয় । „ বলে সুচি আকাশের হাত ছেড়ে দিল।
সুচি হাত ছেড়ে দিলে আকাশ নিজের ঘরে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা সবুজ আর কালো রঙ মেশানো জামা আর একটা জিন্স পড়ে বাইরে এলো । তারপর দুজনেই নিচে নেমে গেল।
এতক্ষণ স্নেহা দেবী দেখছিলেন আর অবাক হচ্ছিলেন আর মনে মনে বলছিলেন ---- ‘ কিছুক্ষণ আগেই এরা যেভাবে ধস্তাধস্তি করছিল যেন একে অপরের প্রান না নিয়ে ছাড়বে না। আর এখন এদের ব্যাবহার দেখে মনে হচ্ছে এরা জন্ম জন্মান্তর ধরে একে অপরকে চিমটি পর্যন্ত কাটেনি , কাটতে পারে না। ‚
সোসাইটি থেকে নেমে পনের কুড়ি মিনিট হেটে সুচি আর আকাশ মেলার মাঠে পৌঁছে গেল। খুব বড়ো না হলেও ছোট বলা যায় না। মেলায় যাবতীয় যেসব থাকে তার সবই এখানে আছে । এদিক সেদিক কিছুক্ষণ ঘোরার পর নাগরদোলার সামনে এসে আকাশের মাথায় প্রতিশোধ নেওয়ার ফন্দিটা এলো। ছোটবেলায় একবার সুমির সাথে নাগরদোলায় উঠে ভয় পেয়ে সুচি কেঁদে ফেলেছিল। কথাটা মাথাতে আসতে আকাশ মনে মনে বললো ‘ আজকাল খুব হাত চলছে তোর ! এবার দেখ ‚ তারপর সুচিকে উদ্দেশ্যে করে বললো “ নাগরদোলা চড়বি ? „
“ না । „ সোজা মানা করে দিল সুচি
“ আরে আয় না । কিছু হবে না। „ বলে সুচির ডান হাত ধরে টানতে শুরু করলো ।
“ না , না , প্লিজ আমার ভয় লাগে খুব । „
“ আরে আমি তো আছি। চল না। „ বলে সুচিকে টেনে আনলো টিকিট কাউন্টারে তারপর ত্রিশ টাকা করে দুটো টিকিট কাটলো আকাশ ।
সুচি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো আকাশের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর । সুচির হাত ছাড়ানো দেখে আকাশ বললো “ খুব মজা হবে । আমি তো আছি । „ আকাশের কথায় সুচি একটা ঢোক গিলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।
কয়েক মিনিট পর নাগরদোলা থেমে গেলে সুচি এবার আকাশের হাত ধরলো। আকাশ দেখলো ভয়তে সুচির হাত কাঁপছে “ ভয় পাচ্ছিস কেন ? দেখ কতো লোক চড়ছে । „ চল বলে একটা খালি দোলনায় উঠে পড়লো।
সুচি আরও একটা ঢোক গিলে আকাশের সামনে না বসে আকাশের পাশেই বসলো। নাগরদোলা আস্তে করে চলতে শুরু করলেই সুচি ভয়তে চোখ বন্ধ করে আকাশের ডান হাতটা দুই হাতে ধরে ফেললো “ আমার খুব ভয় করছে । „
‘ বেশ হয়েছে। আমাকে মারা ! এখন বোঝ ঠেলা। এখন হিসাব কর কত ধানে কত চাল হচ্ছে ? ‚ মনে মনে সুচিকে চাল আর ধানের হিসাব করতে বলে মুখে বললো “ কিছু হবে না , আমি তো আছি। দেখ ! ওই দুজন কে দেখ ! কিভাবে পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছে। „
“ আমি দেখতে চাই না। আমার ভীষন ভয় করছে। ওবাবাগো...... সুচির কথা শেষ হওয়ার আগেই নাগর দোলা একটু স্পিড বাড়িয়ে ঘুরতে শুরু করলো । আর সেই সাথে সুচি আকাশকে জড়িয়ে ধরলো ।
তারপর নাগরদোলা একটু স্পিড বাড়াতেই সুচি আরও জোড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আকাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা এবং ভীত গলায় বলতে শুরু করলো “ এ এরকম কাঁপছে কেন? পড়ে যাবো আমি ! শেষ হবে কখন ? কত পাক হয়েছে ? „
আকাশ এটা ভাবেনি। একদম ভাবিনি যে সুচি এইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরবে। সুচি আকাশকে জড়িয়ে ধরায় সুচির চুলের মিষ্টি গন্ধ আকাশকে একটা ঘোরের মধ্যে পাঠিয়ে দিল। সুচির ভয়কে আরও বাড়ানোর জন্য খুব উৎসাহে আকাশ বললো “ তিন পাক হয়েছে। এখনও সাত পাক বাকি ? „
সাত পাক শুনেই সুচি আকাশকে আরো জোরে কষে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। এতক্ষণ আকাশ সুচির চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নিচ্ছিল। এবার সুচির জন্য তার দমবন্ধ হতে শুরু করলো। “ ছাড় তুই আমায় । আমার কষ্ট হচ্ছে , দম নিতে পারছি না আমি....ছাআআআআআআড় আমায় .......
আকাশ যতো সুচিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো সুচি আরও জোড়ে চেপে ধরে লাগলো । সুচি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশকে চেপে ধরে কাঁপা গলায় বললো “ আমি পড়ে যাবো। আমার ভয় হচ্ছে। মা বাচাও আমায় । আমার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। বমি হবে .....
আকাশ ভাবতেই পারেনি যে নিজের ছোড়া তীর ঘুরে এসে নিজের পিছনেই লাগবে “ না , একদম না। বমি না । আমার উপর না। আরে আর কতো ঘুরবে থামাও ! মা গো সবে পাঁচ পাক হয়েছে .....
“ এখনও পাচ পাক বাকি ! বমি বমি পাচ্ছে । „
“ নাআআআআআ । এ আমি কোথায় ফেঁসে গেলাম । „ আকাশের পুরো কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে গেল
পরবর্তী পাঁচ পাক আকাশ কিভাবে মুখ দিয়ে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিল সেটা শুধু আকাশ জানে। সুচি কিভাবে বমি না করেও আকাশকে দমবন্ধ করিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল সেটা শুধু সুচি জানে । নাগরদোলা থামার পর আকাশ সুচিকে ছাড়িয়ে দোলনা থেকে নেমে ঘাসের উপর বসে পড়লো আর বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে শুরু করলো। সুচিও আকাশের পাশে বসে কয়েকবার ওয়্যাক ওয়্যাক করে বমি করার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। আকাশ উঠে পাশের দোকান থেকে একটা এক লিটারের জল কিনে ঢকঢক করে খেয়ে সুচির দিকে বাড়িয়ে দিল। সুচি প্রথমে ভালো করে মুখে ঘাড়ে জল দিল। তারপর কয়েক ঢোক জল খেয়ে নিল “ আর একবারও যদি আমায় নাগরদোলায় চাপতে বলেছিস ! তবে তোর একদিন কি আমার একদিন ! „
“ কেউ যদি আমায় দশ কোটি টাকা দিয়ে বলে তোকে নিয়ে নাগরদোলা উঠতে , তাহলেও না। আর একটু হলে আমি মরে যেতাম। দমবন্ধ হয়ে এসছিল আমায়। আমি তো একটা মানুষ। কেউ কাউকে এইভাবে মারার চিন্তা করে ! „ রাগী মুখ করে রাগী স্বরে বললো আকাশ।
“ বাজে বকবি না একদম । তুই আমায় নিয়ে গেছিলি । আমি যেতে চাই নি। আমি বলেছিলাম আমর ভয় করে । তুই তো শুনিস নি , এখন সব দোষ আমার ? „ সুচি ও রেগে আকাশের কথার জবাব দিল।
আকাশ সুচির কথার জবাব দিল না। সত্যি ওকে শায়েস্তা করতে গিয়ে যে নিজে এইভাবে ফেঁসে যাবে ভাবিনি । কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে আকাশ বললো “ ফুচকা খাবি ? „
“ চল । „ বলে দুজন ফুচকা খেলো। তারপর পাপড়ি চাট খেলো। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য জিলিপি , বাদাম , গজা, কটকটি কিনলো। তারপর বিভিন্ন দোকানের কানের দুল, নাকের নথ , আংটি দেখতে লাগলো। একটা বড়ো দোকানে থেমে একটা আংটি পছন্দ করে সুচি বললো “ এটা কতো ? „
দোকানদার বললো “ 85 । „
“ দুটো নেবো । একশো পঞ্চাশ দেবো । „
দোকানদার তার আংটির বাক্স এগিয়ে দিতে সুচি আকাশকে একটা A লেখা আংটি পছন্দ করে দিলে আকাশ বললো “ আমি পড়িনা এসব। „
“ এখন থেকে পড়বি। „ কথাটা বলে সুচি নিজের জন্য S লেখা আংটি পছন্দ করতে লাগলো। অনেক গুলো দেখার পর তিনটে আংটি ফাইনাল করে সে আকাশকে জিজ্ঞাসা করলো “ কোনটা ভালো দেখাবে বলতো ? „
“ এটা নে তোর আঙুলে এটা মানাবে। বেশি মোটা মানাবে না। এটা শেপ ও ভালো। „ কথাটা বলে একটা ডিম্বাকৃতি আংটি দেখিয়ে দিল।
“ দিন এই দুটো । „
দোকানদার দুটো আংটি একটা প্যাকেটে দিলে দুজনে দুটো আংটি নিয়ে আঙুলে পড়ে বাড়ির রাস্তা ধরলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আকাশ রাতের অন্ধকার আকাশে তারা দেখতে দেখতে দেখতে বললো “ শোন । দুপুরে যা বলেছি ওসব রাগের বশে ........
“ ছাড় ওসব। আমিও রাগে অনেক খারাপ কথা বলেছি। „
পরের বছর আকাশ ক্লাস টেনে ওঠার কয়েক মাস পর সুচি মাধ্যমিক এর থেকেও বেশি পরিশ্রম করে, মন দিয়ে পড়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। ঠিক সেই সময় সুমিও একটা সরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিল। সুচির উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আসার আগে সুমির রেজাল্ট চলে এলো। টপ টেনে নাম উঠেছে তার। ইন্টারভিউ দেওয়ার পর এই রাজ্যের IBS ব্যাঙ্কের হেড অফিসের ম্যানেজারের সেক্রেটারি পদের চাকরিটা খুব সহজেই পেয়ে গেল সুমি ।
কিছুদিন পরে সুচির উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বার হলো। সবাই যতোটা আশা করেছিল তার থেকেও ভালো হলো সুচির রেজাল্ট । সবাই বলাবলি করতে লাগলো ------ ‘ বাড়িতে যদি সুমির মতো দিদি থাকে তাহলে এতো ভালো রেজাল্ট যে কেউ করতে পারবে । ‚
রেজাল্ট বার হওয়ার পর সুচি কোন কলেজে ভর্তি হবে সেটা নিয়েই খাওয়ার টেবিলে আলোচনা হচ্ছে। সুমি বললো “ কিংটন কিংবা টেগনো তে ভর্তি হয়ে যা। B. Com খুব ভালো পড়ায় ওখানে। „
কলেজের নাম শুনেই সমরেশ বাবু চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখন বয়স হয়েছে তার। মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। চোখের দুই কোনায় মুরগির পায়ের ছাপের মতো চামড়ার ভাজ পড়ে বয়স হওয়ার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে । তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন ---- ‘ সুমি না হয় উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে সরকারি বেসরকারি নানা ধরনের স্কলারশিপ পেয়েছিল , তাই ওর উচ্চশিক্ষার পড়াশোনার জন্য তেমন অর্থকষ্ট পোহাতে হয়নি। কিন্তু সুচির কলেজের জন্য এতো টাকা কোথা থেকে পাবো। ‚
বাবার মুখ দেখেই সুমি বুঝতে পারলো তার বাবা কি ভাবছে। তাই সে বললো “ বোনের পড়াশোনার সব খরচ আমি নেবো „
বড়ো মেয়ের কথা শুনে সমরেশ বাবুর মনটা হালকা হয়ে উঠলো ---- ‘ কখন যে মেয়ে দুটো বড়ো হয়ে গেল বুঝলাম না। এই তো সেদিন হাত ধরে হাটতো । ‚ মুখে কিছু না বললেও মেয়েকে মন থেকে শত সহস্র আশীর্বাদ করতে করতে রাতের খাবার খেতে লাগলেন। রাতে খাটে শুয়ে সুচির মাকে সমরেশ বাবু বললেন “ কে বলেছে মেয়েরা পরের ঘরের ধন হয় ? ছেলেরাই একমাত্র বুড়ো বয়সে বাপ মায়ের খেয়াল রাখে ? „ কথাটা বলতে গিয়ে সুচির বাবার চোখে এক ফোটা জল দেখা দিল ।